(পর্ব – ১)
*** তন্ময় ***
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চমকে উঠে তন্ময়। আগুন গরম চা।
তবে তার চমকে উঠার কারণ চায়ের উত্তাপ নয়, চাতো গরমই হবে। চমকে উঠে চায়ের স্বাদে।
এই অজ পাড়া গাঁয়ের ছাপড়া চায়ের দোকানের চা যে এতোটা ভালো হবে তা ছিল কল্পনার অতীত।
চায়ের কারিগরের দিকে দৃষ্টি ফেরায় তন্ময়। পরণের সার্টটি পুরোনো হলেও বেশ পরিষ্কার করে কাচা।
প্রচন্ড গরমে আমি দর দর করে ঘামছি, অথচ এই লোক দিব্যি চুলোর পাশে বসে চা বানাচ্ছে।
চোখে-মুখে বিরক্তির কোনো চিহ্ণই নেই। শরীরে নেই এক ফোটা ঘামের আভাস।
চমৎকার চায়ের স্বাদ নিতে নিতে তন্ময়ের মনের সকল বিরক্তি ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। বিরক্ত হওয়ার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের পাশে এই ছাপড়া দোকানে সে বসে আছে ঝাড়া একঘন্টা ধরে।
তাকে নিতে যার আসার কথা তার কোনো পাত্তা নাই। বার বার মোবাইলে ফোন করে শুনতে পাচ্ছে-সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।
এদিকে গরমে জান ভাজা ভাজা।
তন্ময়ের আমেরিকা প্রবাসী মামার শখ হয়েছে গাজীপুরে কিছু জমি কিনে বাগান বাড়ি বানাবেন। সেই জমি দেখতেই আসা।
কিন্তু জমির দালাল দোলোয়ারের কোনো পাত্তা নাই।
অথচ কাল রাতেও কথা হয়েছে বাঘের বাজার বাস স্ট্যান্ডে সে আমার জন্য মোটর সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করবে।
মোটর সাইকেল তো দূরের কথা, কোনো সাইকেলেরও দেখা নেই।
কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে। আর পনের মিনিট; এর মধ্যে দেলোয়ার না এলে টাটা বাইবাই। এর মধ্যে আর থাকবে না তন্ময়।
সময় কাটানোর জন্য চায়ের দোকানীর সঙ্গে আলাপ জুরে দেয়।
‘ভাই কী এই এলাকার মানুষ?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় দোকানী।
‘তাহলে তো আপনি দেলোয়ারকে চিনেন?’
এবারও ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। বোঝা গেল চা বিক্রেতা আলোচনায় আগ্রহী নয়। সময়তো কাটাতে হবে!
তাই চা বিক্রেতার নিরু]সাহ উপেক্ষা করে একতরফা আলাপ চালিয়ে যায় তন্ময়।
‘আমাকে নিতে তার আসার কথা, আর মোবাইলও বন্ধ।’
এবার তার দিকে চোখ তুলে তাকায় চা বিক্রেতা।
‘দেলোয়ারের তো হুন্ডা একছিডেন হইছে। হেয় আইতে পারবো না।’
খবরটা শুনে চমকে উঠে তন্ময়। ওহহো, তাহলে তো বসে থেকে লাভ নেই।
পরের বাস লোকাল হোক আর সরাসরি হোক, সেটাই ধরতে হবে। লোকাল হলে গাজীপুর গিয়ে বাস বদলে নিলেই হবে।
আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। মানিব্যাগ বের করে চায়ের দাম চুকায়।
খুচরা টাকা ফেরত দিতে দিতে চায়ের দোকানী বলে
–‘ভাইজান কী ঢাকা থাকেন?’
–‘হ্যা’
–‘অখনই চইলা যাইবেন?’
তার প্রশ্নে একটু অবাক হয় তন্ময়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
আলটপকা এই প্রশ্নের জন্যই হয়তো একটু লজ্জিত বোধ করে দোকানী।
দাঁত বের করে একটু বিব্রত হাসি দিয়ে বলে,
–‘আপনের হাতে সময় থাকলে একটু বসেন।’
–‘কেন কিছু বলতে চান আমাকে?’
এবার বেশ অবাক হয় তন্ময়। জানা নেই শোনা নেই এই চায়ের দোকানীর কী কথা থাকতে পারে তার সঙ্গে?
সেই সঙ্গে বেশ একটু কৌতুহলও বোধ করে। শোনাই যাক না কী বলতে চায় এই অপরিচিত দোকানী!
আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে জুত হয়ে বসে।
–‘বলেন কী কথা।’
বেশ উদার ভঙ্গীতে বলে।
–‘সবার আগে আপনার নামটা বলেন। নাম জানা না থাকলে আলাপ করে আরাম পাই না।’
–‘আলম।’
এক কথায় আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে আলম।
মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে নেয়। কিংবা গল্পটি কোথা থেকে শুরু করবে তা ঠিক করে নেয়।
একটু পর গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করে।
–‘সে আমার লগেই থাকে। তিন বছর ধইরা আছে। তার ডরে আমি রাইতে কুনু খানে যাইবার পারিনা।
দেখেন, আশে পাশের দুকানে কাস্টমারের ভিড়, কিন্তু আমার দুকানে একখান মাছিও বয় না।
গেরামের লুকজন আমার লগে মিশে না। আমি বাই এক রকম এক ঘইরা।’
আলমের কথার মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
তবে আশপাশের দোকানগুলোতে সত্যি অনেক গ্রাহক, আর আলমের দোকানে আমি একা।
কিন্তু এতেও কিছু পরিষ্কার হলো না। তন্ময়ের অবস্থা আঁচ করেই আলম গোড়া থেকে তার গল্পটি বলতে শুরু করে।
তার কাছ থেকে শোনা ঘটনাটির সারাংশ হচ্ছে-
…তিন বছর আগে পৌষ মাসে খালুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাগেরহাটের খোন্তাকাটায় যায় আলম।
সেখানে গিয়ে জানতে পারে একটি বাড়িতে প্রতি বুধবার জ্বীন নামানো হয়।
সেই জ্বীন মানুষের রোগ-শোকের নিদান দেওয়া ছাড়াও প্রেমে ব্যর্থতা, আর্থিক উন্নতি, পরীক্ষায় পাশ,
হারানো স্বজনকে খুঁজে দেওয়াসহ সব ধরণের সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে। কৌতুহলী আলম হাজির হয় সেই বাড়িতে।
জ্বীন নামানোর পর্বটি আবার দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। তবে শর্ত হচ্ছে পাক-পবিত্র পোশাক পরে এবং ওজু করে আসরে বসতে হবে।
সব নিয়ম মেনেই আলম দুরু দুরু বুকে অন্ধকার ঘরে বসে থাকে। সেখানেই কোব্বালার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাত।
এর পর থেকেই জ্বীন কোব্বালা তার সঙ্গে আছে।
হাইওয়ে ধরে সাঁই সাঁই করে বাস যাচ্ছে-আসছে। চারদিতে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ। বাস স্ট্যান্ডে হাজারো মানুষের আনা-গোনা।
এই পরিবেশে এ ধরণের একটি আষাড়ে ভুতের গল্প! হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না তন্ময়।
চা দোকানী আলমের মানষিক সুস্থ্যতা নিয়ে এবার সন্দেহ জাগে।
আর মনে মনে নিজেতে গাল দেয়, এই ছেদো গপ্প শুনে সময় নষ্ট করার জন্য।
তন্ময়ের মনের অবস্থা আঁচ করতে পারে আলম।
–‘আপনের পকেটের মানিব্যাগটা যে আপনেরে দিছে হ্যায় আপেনেরে ছাইরা চইলা গেছে। অনেক দূরে।’
ফ্যাল ফ্যাল করে আলমের দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়। বিচিত্র অনুভুতি খেলা করতে থাকে তার ভেতর।
তন্ময়কে ছেড়ে শ্বেতা ডিভি লটারি পওয়া এক যুবকের হাত ধরে হাসতে হাসতে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে।
কিন্তু এ কথা এই চায়ের দোকানদান আলমের কিছুতেই জানার কথা না।
আস্তে আস্তে তন্ময়ের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তীব্র চোখে আলম তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
–‘আমারে বিশ্বাস না করতে পারেন, কিন্তুক কোব্বালারে বিশ্বাস না করনের কুনু পথ নাই।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলম বলতে শুরু করে,
–‘পরথম পরথম খুব যন্ত্রণা দিছে। ঘাড় বাইয়া মাথায় উইঠা যাইতো।
হের পরে আমার হইতো বুদ্ধি নাশ। কী কী কাম যে করতাম, নিজেই কইতে পারতাম না।
একবারতো দাও দিয়া কোপাইয়া এক ল্যাংড়া ফকিররে মাইরাই ফালাইলাম।
তয় কেউ দেখনের আগেও সইরা পরছিলাম বইলা থানা-পুলিশের ঝামেলায় পড়িনাই।
হের পরেও কোব্বালা আমারে দিয়ে আরো কতগুলান খুন করাইছে। তয় হেয় খুব চালাক, আমারে ধরা খাওয়ায় নাই।
একবারতো গেরামের লুকজন মিলা আমার ধইরা-বাইন্দা পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পাডাইলো।
কিন্তুক হেইখানে আমার ওয়ার্ডের দুইজন নার্স আর একটা আয়া খুন হওনের পর হাসপাতাল থিকা আমার বাইর কইরা দিছে।’
মোহাবিষ্টের মতো আলমের বিচিত্র কাহিনী শুনে যায় তন্ময়।
–‘তয় দিনে দিনে আমিও কোব্বালারে বশ করন শিখছি। অখন আর মাথাত চড়তে দেই না।
সব সময় কমরের নীচে রাখনের চেষ্টা করি। তয় রাইতে হের উপর আমার কন্টোল থাকেনা।
হের লেইগা রাইতে নিজের ঘরেই বাইরে দিয়া তালা মাইরা শুই।’
তন্ময় বুঝতে পারে না আলমের কথাগুলো কতোটুকু বিশ্বাসযোগ্য। আর কেনই বা তাকে এসব গল্প শোনাচ্ছে!
–‘কোব্বালার মতো খবিস জ্বীনের পাল্লায় যদি পরেন, তাইলে মনে রাখবেন, কুনু সময় হেরে মাথাত উঠতে দিবেন না।
বসে রাখবেন। একবার যুদি মাথাত উঠে, তাইলে হেয় আপনের বুদ্ধিরে বশে নিবো।
তখন হেয় আপনেরে দিয়া যা খুশি তা করাইতে পারবো।
কোব্বালার মুশ্কিল কী জানেন, হেয় বেশি দিন একজনরে ভর কইরা থাকতে পারে না।
যখনই হেই মানুষটা তারে বশ করন শিখা যায়, কথনই কোব্বালা নতুন আশ্রয় খুজতে থাকে।
অখন আর কোব্বালা আমারে না, আমিই কোব্বালারে চালাই। এখন কোব্বালা নতুন কাউকে খুঁজছে’
এটুকু বলে থামে আলম। দু চোখ তুলে সরাসরি তাকায় তন্ময়ের দিকে।
তার চোখদুটো যেন তার কপাল ভেদ করে সরাসরি মস্তিষ্ক দেখতে পাচ্ছে। তন্ময়ের মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়।
ভেতর থেকে কে যেন ক্রমাগত তাড়া দিতে থাকে-পালাও পালও। ছিটকে দোকান থেকে বেড়িয়ে আসে।
হিতাহিত জ্ঞানশূন্যভাবে সামনে যে বাসটি পায় ঝড়ের বেগে চড়ে বসে তাতে।
একটু পরই লক্ষ্য করে এটি ঢাকাগামী নয়, ময়মনসিংহের দিকে চলছে।
যাই হোক পরে বাস বদলে নেওয়া যাবে। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে।
ধাতস্ত হয়ে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভাবতে থাকে তন্ময়। এবার নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে।
দিনে দুপুরে এমন একটি উদ্ভট ভুতের গল্প শুনে ভয়ে দৌড়ে পালালো সে!
যাই হোক বাস পাল্টে ঢাকামুখী একটি সরাসরি বাসের সিটে বসে মথা এলিয়ে দেয়।
সারাদিন খুব ধকল গেল। চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল হয়তো। হঠাৎ ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করে তন্ময়।
দু’চোখে আঁধার নেমে আসে। অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে হলদেটে ক্রুর দুটি চোখ দেখতে পায়।
একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। ওই চোখ দুটি যেন তন্ময়ের চোখের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।
মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় হঠাৎ। তীব্র একটি জান্তব বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠে।
তন্ময় বুঝতে পারে কোব্বালা নতুন আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।
………..
এই গল্পের সব পর্বের জন্য নীচের লিঙ্ক গুলোতে ক্লিক করুন —
কোব্বালা ( পর্ব- ৫ / শেষ পর্ব )