“ডক্টর সাহেব, আমি না গন্ধ পাই।”
“তা সবাই পায়। নাক থাকলে গন্ধ পাবেনা কেন? ওহ তুমি করে বলে ফেললাম।
কিছু মনে করো না। আফটারঅল, বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট হবে!”
“তাতো বটেই! তবে জানেন কী…. উদ্দেশ্য ভাল হলে, যেকোন জুনিয়রকেই তুমি করে বলা যায়।”
তুমি” বলার অনুমতি চাওয়া হচ্ছে নাটকীয়তা। কিংবা কারো সাথে ক্লোজ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ।”
“হুম.. বুঝলাম। তাহলে তোমার ধারনা…”
“আমার কোন ধারনা নেই, ডক্টর সাহেব। যা মাথায় এসেছিল, তাই বললাম। পাগলের প্রলাপ ভেবে এড়িয়ে যান।
…আমার সমস্যাটা নিয়ে যেন কী বলছিলেন?”
“বলছিলাম, নাক থাকলে গন্ধ পাওয়া স্বাভাবিক। তাইনা?”
রুনু বিব্রতবোধ করে। ধীরে ধীরে বলে,
“এটা ঠিক নাক দিয়ে পাওয়ার মত সাধারণ গন্ধ নয়। অন্যরকম গন্ধ!”
ড. শফিক নড়েচড়ে বসলেন। অবাক গলায় জানতে চাইলেন,
“তাহলে?”
“আমি আসলে মৃত্যুর গন্ধ পাই।”
“ও,তাই নাকি? ইন্টারেস্টিং। গন্ধটা কেমন? কোথায় কোথায় পাও?”
ড. শফিকের কথায় কৌতুকের সুর স্পষ্ট। রুনু গায়ে মাখল না সেটা। শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
“নিয়ম ধরে ঘটেনা ব্যাপারটা। হঠাৎ হঠাৎ কোথাও গেলে পাই। যেমন, এখানে পাচ্ছি। লোবান চেনেন তো? লাশে ব্যবহৃত সুগন্ধী।
গন্ধটা লোবানের গন্ধের মত। স্পষ্ট। সুতীব্র একটা গন্ধ। মানে, মৃত্যুক্ষণ অত্যন্ত সন্নিকট। আচ্ছা, আপনি মৃত্যুর পর কোথায় যেতে চান?”
ড. শফিকের অস্বস্তিবোধ হয়। বিরক্ত ও হন মনে মনে।
“ব্যস, তোমার সমস্যা এটুকুই? এটা বলার জন্য গত কয়েকদিন ধরে আমার পেছনে ঘুরছো, রাত বিরাতে ফোন করছো?”
“আপনি রাগছেন যে? আচ্ছা ডক্টর, আপনি আত্মায় বিশ্বাস করেন? A bodyless soul?”
“নাহ। কারণ, আমি বিজ্ঞানপন্থী একজন মানুষ। আর বিজ্ঞান বিদেহী আত্মায় বিশ্বাস করা, আমাকে এলাউ করবেনা।”
“ও.. আচ্ছা বলুন তো, বিজ্ঞান কী কী সাপোর্ট করে? ব্ল্যাক ম্যাজিক সাপোর্ট করে তো?………”
রুনু থামল কিছুক্ষণ। তারপর আনমনে মাথা নাড়ার ভঙ্গীতে বলল,
“…অবশ্যই করে। নইলে আপনি আপনার প্রথম স্ত্রী থেকে মুক্তি পেতে, ব্ল্যাক ম্যাজিকের আশ্রয় নেবেন কেন, তাইনা?”
ড. শফিক বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন। কী বলছে এসব,তার বিপরীতে বসা মেয়েটা!
“এসব কী, মিস..”
“রেহানা। সবাই আমাকে রুনু বলে ডাকত। এখন অবশ্য নামে কী আসে যায়! আপনি বললেন নাতো, বিজ্ঞান ব্ল্যাক ম্যাজিক সাপোর্ট করে কিনা।”
“স্ট্রেন্জ! আমি কী করে জানব?”
“আপনার জানার কথা। ভুলে গেলেন এত তাড়াতাড়ি? মাত্র তো গত বছরের ঘটনা।
বদি তান্ত্রিক থেকে একটা মোমের মূর্তি এনে তাতে পিন ফুটিয়ে দিলেন। আর আপনার স্ত্রী প্যারালাইজড হয়ে গেল।
এতেও আপনার মন না ভরায় আবার গেলেন সেই তান্ত্রিকের কাছে…”
“হোয়াট রাবিশ!!!”
“এবার বড় কোন আয়োজন। আরও বেশি শক্তির প্রয়োগ। আপনার স্ত্রী তার এক ভাগ্নীকে নিয়ে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেল!
ব্ল্যাক ম্যাজিকের কত্ত ক্ষমতা! আচ্ছা,এটা একটা সায়েন্স। তাইনা? অকাল্ট সায়েন্স বলে একে।
নয়ত আপনার মত বিজ্ঞানপন্থী মানুষ বিশ্বাস করবে কেন?”
ড. শফিক আর রাগ চেপে রাখতে পারলেন না। টেবিলের উপরে রাখা ফোনটা তুলে নিলেন সরোষে।
সেক্রেটারী রাহানুমাকে সিকিউরিটি গার্ড নিয়ে তক্ষুণি তার রুমে আসতে বললেন।
ফোন নামিয়ে দেখলেন, রুনু কেমন বিষণ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“অযথা ওদের কেন ডাকলেন, ডক্টর? সমস্যা যে আপনারই হবে।”
“চুপ থাক। তোর আর তোর সমস্যার নিকুচি করি আমি।”
“আপনি অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষা ব্যাবহার করছেন, ডক্টর শফিক।”
“তোর আপত্তিকর ভাষার আমি…”
ঠিক এসময় ষন্ডামার্কা এক লোক এবং অতীব সুন্দরী এক তরুণী, দরজা খুলে ঢুকল ভেতরে। তার চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বিগ্নতা।
“স্যার এভরিথিং ওকে?”
ড. শফিক তার ডেস্কের অপর পাশে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন,
“রাহানুমা, এই মেয়েটাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দাও। বদ্ধ উন্মাদ একটা!
আর কিছুক্ষণ সে এখনে থাকলে,আআআমি পাগল হয়ে যাব।”
রাহানুমা অবাক চোখে রুনুর চেয়ারের দিকে তাকাল। বেচারী পরিস্থিতি বুঝতে পারছেনা।
“স্যার আপনি শান্ত হন। দয়া করে এভাবে চেঁচামেচি করে, নিজের তৃতীয় হার্ট এটাক ঘটিয়ে বসবেন না, প্লিজ!”
রুনু ভ্রু তুলে ড. শফিককে দেখল কিছুক্ষণ। তার কোমল বিষণ্ণ চেহারায় এক চিলতে রূক্ষতা উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল,
“তৃতীয় এবং শেষ হার্ট এটাক…”
“স্যার, আমি আপনার আজকের সব এপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে দিচ্ছি। আপনি বাসায় চলে যান। বিশ্রাম নিন।”
রাহানুমা চলে যাওয়ার পর, ড. শফিক কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। তাকে কেমন যেন বিধ্বস্ত দেখাতে লাগল।
তিনি চোখ তুলে রুনুর দিকে তাকালেন। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। অল্প অল্প শরীর দুলছে তার। ধ্যানমগ্ন পীর কিংবা সন্যাসীর মত।
“রাহানুমা এমন ভাব করল, যেন সে তোমাকে দেখতেই পায়নি! কেন?”
“না দেখাটাই বোধহয় ভাল।”
“কী বললে?”
“ডক্টর, মৃত মানুষদের জগৎ কেমন হয় বলতে পারেন? স্বর্গ আর নরকে বিশ্বাস আছে, আপনার?”
“দেখো..”
“নেই, তাইনা? আমি জানতাম! আচ্ছা, আপনার প্রথম স্ত্রী কোথায় স্থান পেয়েছে বলে আপনার মনে হয়?”
ড. শফিক পকেট থেকে লাইটার আর সিগারেট বের করলেন। অনেকটা সময় নিয়ে সিগারেটে আগুন সংযোগ করলেন।
তারপর ড্রয়ার থেকে কিছু একটা নিয়ে আলগোছে,পকেটে ভরলেন। রুনু এর সবই খেয়াল করল।
তার ঠোঁটে সূক্ষ একটা হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল।ততক্ষণে ড. শফিক উঠে দাঁড়িয়েছেন। চিন্তিত ভঙ্গীতে পায়চারি করছেন এখন।
“তুমি কি রাবেয়ার কিছু হও?”
“হতাম। এখন সেটা কোন অর্থই বহন করেনা।”
“হতে, এখন সেটা কোন অর্থই বহন করেনা- মানে কী এর?”
“এর মানে… হবে কিছু একটা!”
“আমার এই রুম যে সাউন্ডপ্রুফ, এটা জানো?”
ড. শফিক এখন রুনুর ঠিক পেছনে রয়েছেন। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে সে হাসল।
“হুম, জানিতো। আর এজন্যই আপনার আগের সেক্রেটারির করুণ আর্তনাদ কেউ শোনেনি।”
পেছনে কোন কিছুর পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে, ড. শফিক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
তার পায়ের কাছে পড়ে আছে চকচকে একটা রিভলবার। রুনু হাত বাড়িয়ে রিভলবারটা কুড়িয়ে নিল।
ড. শফিকের দিকে তাক করে ধরে বলল,
“আপনার এই রুমটা তো সাউন্ডপ্রুফ,তাইনা? তাহলে গুলির শব্দ কেউ শুনবেনা। আগেরবার যেমন শোনেনি!”
ড. শফিক ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়লেন। পা জোড়ায় জোর পাচ্ছেন না তিনি।
“তুমি কে আসলে ,বলবে?”
“আমি কে, এটা এখন কোন অর্থ বহন করেনা। আপনার সায়েন্স ঈশ্বরে বিশ্বাস এলাউ করে তো,ডাক্তার?
আমার মনে হয় করে। কেন মনে হয়,বলব?”
ড. শফিক চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। রুনু নিজের চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে বসল।
এখন সে লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবে।
“আপনি রোজ রাতে একটা স্বপ্ন দেখেন। খুব জীবন্ত একটা স্বপ্ন।
যেখানে ঈশ্বরের নির্দেশে একটা বিকটদর্শন প্রাণী আপনাকে তাড়া করে! কারণ আপনার পাপের সীমা বহু আগেই পেরিয়ে গেছে।
প্রতিরাতেই একই স্বপ্ন। বিকটদর্শন প্রাণীটা আপনাকে তাড়া করে…. করেই যায়….. কখনও প্রাণীটার চেহারা আপনার মৃতা স্ত্রীর মত।
আবার কখনও সেই সেক্রেটারী মেয়েটার মত….”
রুনু লক্ষ্য করে,ড. শফিকের শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখে অপ্রকৃতস্থ একটা দৃষ্টি।
“তারপর… প্রাণীটা আপনাকে তাড়া করতে থাকে। আর আপনি ছুটতে থাকেন… ছুটতেই থাকেন…. বিস্তীর্ণ একটা মাঠ ধরে।
তারপর হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যান। নিজের ঘাড়ের উপর তখন সেই বিকটদর্শন প্রাণীটার নিঃশ্বাস টের পান।
ধড়মড় করে উঠে আবার ছোটেন আপনি….”
“স্টপ! ফর গডস সেক জাস্ট স্টপ ইট!”
ড. শফিক বুকের বাঁ পাশটা চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠেন। রুনু তবু থামেনা। হিংস্র গলায় দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে বলে,
“আবার পড়ে যান… আবার উঠে দৌড়ান…. দৌড়াতেই থাকেন…. দৌড়াতেই থাকেন… আবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যান।
তখন প্রাণীটা আপনাকে প্রায় ধরে ফেলে। বিকটদর্শন প্রাণী। যার চেহারা আপনার মৃতা স্ত্রী কিংবা সেই সেক্রেটারির মত…”
ড. শফিক হঠাৎ অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলে, মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকেন। ঠিক ডাঙ্গায় ওঠানো মাছের মত।
গোঙ্গাচ্ছেন বুকের বাঁ পাশ চেপে ধরে। তার মুখ দিয়ে অনবরত ফেনা ঝরছে…
সেদিকে তাকিয়ে রুনু বলে,
“মৃত্যুর গন্ধটা এখন আরও স্পষ্ট। আরও তীব্র। ঠিক এমন একটা গন্ধই সেদিন গাড়িতে পেয়েছিলাম আমরা।
আমি আর রাবেয়া খালামণি। যখন আগুনে ঝলসে যাচ্ছিল আমাদের পুরো শরীর। মাংস পোড়া গন্ধ পাইনি তবু।
মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছিলাম। লোবানের গন্ধের মত। স্পষ্ট। তীব্র।”
পরিশিষ্ট: রাহানুমা বাসায় ফেরার আগে, ড. শফিকের রুমে একবার উঁকি দেয়। দেখে ড. শফিক দেয়ালে হেলান দিয়ে, মেঝেতে বসে আছেন।
তার খোলা চোখজোড়ায় বিস্ফোরিত দৃষ্টি। যেন ভারী আশ্চর্যজনক কিছু দেখলেন মাত্র। বাতাসে লোবানের ভ্যাপসা একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।