জয়পুর থেকে যাত্রা করেছেন স্বামীজী খেতড়ি অভিমুখে। দীর্ঘপথ চলেছেন উটের গাড়িতে। সঙ্গে রাজাসাহেব ও তাঁর অমাত্যবর্গ। সন্ধ্যা হয়-হয়, এমন সময় তাঁরা এসে পৌঁছলেন পিথমপুরীগঞ্জে। জায়গাটা মরুভূমির মাঝে এক ‘পড়াওয়ে’ অর্থাৎ পান্থশালা। দোকানপাট সবই আছে। আছে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও। যানবাহী পশুদেরও আস্তাবল আছে। মহারাজা স্বামীজীর বিশ্রামের জন্য পৃথক ঘরের ব্যবস্থা করেছেন। নৈশভোজ শেষ হলে সকলে শয্যা নিলেন। স্বামীজীও ঢুকলেন তাঁর ঘরে।
মরুভূমির রাত্রি গাঢ় হল। দিনের বেলা ভীষণ গরম হলেও রাত্রে হাওয়া বয় সেখানে। অনেকটা স্বস্তি। সারাদিন গরমে কষ্ট পেয়েছেন খুব, তাই শুয়েই স্বামীজি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। হঠাৎ যেন শুনতে পেলেন সশব্দে ঘরের দরজার পাল্লাদুটো খুলে গেল। হাওয়ার বেগ ঘরটাকে ভরিয়ে দিল। স্বামীজি ভাবলেন, তাড়াতাড়িতে হয়তো দরজায় খিল দেওয়া হয়নি। সেই কারণেই হাওয়ার বেগে পাল্লাদুটো খুলে গেছে। তিনি এ ব্যাপারে আর চিন্তিত হলেন না। ঘুমোতে চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ কাটল। তারপর দেখলেন, দরজার পাল্লাদুটো আবার নিজে থেকেই সশব্দে এঁটে গেল। এবারও তিনি চিন্তিত হলেন না। ভাবলেন হাওয়ার বেগেই তারা এঁটে গেছে। ভালোই হয়েছে। তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাইলেন।
ঘুম কিন্তু এল না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরেই অনুভব করলেন, কারা যেন তাঁর চৌকিটা নাড়াচ্ছে। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। আর কোনো কম্পন নেই। ভাবলেন – তাঁরই মনের ভুল। আবার শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরেই আবার সেই চৌকির কম্পন। এবার স্বামীজী একটু চিন্তিত হলেন। কিন্তু উঠলেন না। ক্রমে চৌকির কম্পনবেগ বাড়তে লাগল। আর থাকতে না পেরে চৌকি থেকে মেঝেতে নামলেন তিনি। ঘরের লন্ঠনটি নিয়ে ঘরের চারিপাশ ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলেন। কোথাও কিছু দেখতে পেলেন না।
বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন এবং ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলেন। কিছুটা সময় কাটতেই বাইরে থেকে কাদের ফিসফিস কথাবার্তার শব্দ তাঁর কানে এল। তন্দ্রাবিষ্ট অবস্থায় স্বামীজী জানলার দিকে তাকাতে চাইলেন কিন্তু কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না। তন্দ্রাবিষ্টই রইলেন, হঠাৎ মনে হল কারা যেন জানলার কাছে জমায়েত হয়ে তাঁকে কিছু বলছে। তন্দ্রা কাটিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন স্বামীজি এবং হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – ” কে তোমরা?” কিন্তু এবারও জানলায় কাউকেই দেখতে পেলেন না।
আবার শুয়ে পড়লেন বিছানায়। ঘটনাগুলো ভাবতে ভাবতে আবার তন্দ্রাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। স্বপ্নের ঘোরে এবার দেখলেন, আবার জানলার কাছে কতগুলো মুখ – কেমন যেন কালো কালো বিকৃত আকারের – তাদের মাথায় চুল নেই। তারা যেন বলছে, “স্বামীজি, আমরা বড় কষ্টে আছি। আমাদের উদ্ধার করুন, আমাদের কৃপা করুন”। স্বামীজী স্বপ্নের ঘোরেই প্রশ্ন করলেন – “তোমরা কারা? কি চাও?” কিন্তু তারপরেই স্বামীজীর ঘুমটা ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসেছেন। তারপর দরজা খুলে বাইরে এলেন। চারদিকে তাকালেন, কোথাও কিছু দেখতে পেলেন না।
ততক্ষণে রাত্রি প্রায় শেষ। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে পূবের আকাশে। বাইরে পায়চারি করতে লাগলেন স্বামীজি। সকাল হতে না হতেই রাজভৃত্য চা নিয়ে হাজির হল স্বামীজির ঘরে। চা পান শেষ করেই স্বামীজী ছুটলেন পান্থশালার মালিকের কাছে। তাঁকে রাত্রের সব ঘটনা খুলে বলার পর জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার বলুন তো? ”
পান্থশালার মালিক জানালেন, “কয়েক বছর আগে এক শীতের রাত্রে একটি পরিবারের সকলে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। স্বামী-স্ত্রী আর তাদের একটি বাচ্চা। তাদের অতৃপ্ত আত্মাই গত রাতে আপনার কাছে মুক্তি প্রার্থনা করেছে”। পান্থশালা মালিকের কথাগুলো শুনতে শুনতে স্বামীজীর মুখ বিষণ্ণতায় ভরে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ স্থানত্যাগ করলেন।