লিপস্টিকের প্রতি আমার বরাবর একটু অন্যরকম দুর্বলতা আছে। নানা শেডের নানা কোম্পানির লিপস্টিকের কালেকশন রয়েছে আমার ঘরে। সাজতে আমি খুব একটা সময় নেই না, তবে লিপস্টিকটা বেশ সময় নিয়েই লাগাই।
সেদিন আমার প্রিয় লিপস্টিকটা পরেই গেছিলাম ইন্টার্ভিউটা দিতে। একটা নতুন এয়ারলাইন্সের ইন্টার্ভিউ। পেপারে এড বেরিয়েছিল ছোট করে। সবে গ্ৰাজুয়েশন শেষ করেছি। কি করব ভাবছিলাম, ঋতুজা দিয়েছিল খবরটা। আমরা দু জনেই গেছিলাম ইন্টার্ভিউ দিতে পার্ক-স্ট্রিটের এক হোটেলে। প্রায় তিনশো মেয়েকে ডেকেছিল ওরা, পঞ্চাশ জনকে প্রথমে নেবে বলেছিল।
আমার জীবনের প্রথম ইন্টার্ভিউ। একটু টেনশন তো ছিলই। একেকটা মেয়ের কনফিডেন্স দেখে অবাক হচ্ছিলাম। একটি মেয়ে প্রথম থেকেই খুব বকবক করছিল নিজেকে চূড়ান্ত স্মার্ট প্রমাণ করার জন্য। মেয়েটার নাম দিয়া, প্রচুর জানে বিভিন্ন ব্যপারে। কিন্তু ইন্ট্রোডাকশন রাউন্ডে দেখা গেল ও সবে ফাস্ট ইয়ারে পড়ে, গ্ৰ্যাজুয়েশন হয়নি। তবুও ওর কনফিডেন্স লেবেল দেখে অবাক হচ্ছিলাম আমরা। চূড়ান্ত ঝাড়াই বাছাইয়ের পর ওরা বিকেলে পঞ্চাশ জনের লিস্ট বার করেছিল। লিস্টের নিচের দিকে ঋতুজা ও আমার নাম দেখে যে কি আনন্দ হয়েছিল বলে বোঝাতে পারবো না। পরের সপ্তাহে মুম্বাইতে আমাদের ট্রেনিং শুরু হবে বলে দিয়েছিল কোম্পানি। দিয়াকেও ওরা নিয়েছিল দেখে ভালো লাগছিল।
ফেরার পথে একটু নিউ মার্কেটে ঢুকেছিলাম টুকটাক শপিং করতে। ব্যাগের দোকান রাস্তার প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে। নানাধরনের হকারের ভিড় রাস্তা জুড়ে। এর মধ্যেই একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলছিল -”দিদি লিপস্টিক চাহিয়ে ক্যায়া ?”
দোকান ছাড়াও নিউমার্কেটের সামনে এদের কাছ থেকে আমি এর আগেও দু একবার লিপস্টিক নিয়েছি। মনে হয় চোরাই মাল। কোনো বড় দোকান থেকে ঝেড়ে এখানে বিক্রি করে। কিছু কমে পাওয়া যায় বলে আমি নিয়েও নেই। ওর হাতে দুটো লিপস্টিক ছিল। ঐ ভিড়ের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম ওগুলো কমন কালার। ওদিকে ঋতুজা তারা দিয়েই চলেছে। ওর খুব খিদা পেয়েছে, ও কেএফসিতে ঢুকবে তখন। চলেই যাচ্ছিলাম, ছেলেটা বলল -”ইয়ে একবার দেখিয়ে দিদি।
” একটা নতুন লিপস্টিক, কোম্পানির নামটা নতুন। রঙটাও বেশ অন্য রকম, কালচে লাল বা মেরুনের মাঝামাঝি, রক্তের মত, একটু উজ্জ্বল অথচ ড্রাই ম্যাট। দু বার হাতে লাগিয়ে ছেলেটাকে দাম জিজ্ঞেস করলাম। দু শো টাকায় জিনিসটা নিয়েই নিলাম। কেএফসিতে ঢুকে ঋতুজা বকবক করছিল এভাবে রাস্তা থেকে লিপস্টিক কেনা উচিত নয়। কে জানে কার ইউজ করা!! আমি পাত্তা না দিয়ে ছোট্ট আয়না বের করে ততক্ষণে লিপস্টিক ঠোঁটে লাগাতে ব্যস্ত। রঙটা সত্যি আনকমন। এত উজ্জ্বল লালচে মেরুন আগে পাইনি কখনো।
রাতে বাড়ি ফিরেই যখন খবর দিলাম যে সিলেক্টেড মা আর বোন খুব খুশি হয়েছিল। বাপি শুধু বলেছিল -”আর একটু পড়াশোনা করে অন্য কোনো লাইনে গেলে হত না ? এসব উটকো এয়ারলাইন্সের ভবিষ্যৎ নেই তেমন। কিংফিশার, এয়ারডেকান , সাহারার মত কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলো !! সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় বসো। সিভিল-সার্ভিসে যাও, এ চাকরী করে কি হবে?”
আমারও জেদ চেপে গেছিল। প্রথম চাকরী পেয়েছি নিজের চেষ্টায়, এটাই করবো। অনেক রাত অবধি গল্প করে শুতে এলাম নিজের ঘরে। বোন একতলায় গেস্ট রুমে পড়াশোনা করে রাত জেগে, এইচ এস দেবে সামনেই। মাঝ রাতে কেমন একটা চাপা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙ্গে গেছিল। এসির আলোটা জ্বললেও ঘরটা কেমন গরম লাগছিল। গ্যাস কমে গেছে বোধহয়। উঠে এসিটা বন্ধ করে জানালা খুলে দিলাম। একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বোনের ঘরে তখনো আলো জ্বলছে, ঘড়িতে রাত দুটো। বাথরুম করে জল খেয়ে শুতে যাচ্ছিলাম, আয়নার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। কাচের গায়ে লাল রঙ দিয়ে লেখা রয়েছে ”সাবধান, বিপদ !!”
তাড়াতাড়ি বড় আলোটা জ্বেলে আয়নার কাছে গিয়ে দেখি আমার সাধের নতুন লিপস্টিক দিয়ে কে লিখে রেখেছে শব্দ দুটো। একটা ওয়েট টিসু দিয়ে মুছে দিয়ে ভাবছিলাম কে লিখল? বোন না বাপি ? আর কেউ তো আসেনি এ ঘরে। মা লিখবে না এসব। লিপস্টিকটা রয়েছে ড্রেসিং টেবিলেই। ওটা দিয়ে লিখলেও ভোতা হয়নি মাথাটা।
এসব চিন্তা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরদিন সকালে উঠে দেখি লেখাটা আবার ফুটে উঠেছে। তবে কি রাতে মুছিনি ঠিক করে ? ঘুমের ঘোরে ভুল হতেই পারে। আবার মুছে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম। সারাদিন আর মনে পড়েনি এই ঘটনার কথা। সেদিন ও মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আবার দেখি আয়নায় লেখা কথা দুটো। এবার লাইট জ্বালিয়ে ভালো করে দেখলাম। লিপস্টিকটা দিয়েই লেখা। নতুন লিপস্টিকটা খুলে দেখলাম মাথাটা একটু থেবড়ে গেছে । কিন্তু আমার বাড়ির কেউ এমন কেনো করবে আমার সাথে !! বোন নিজের পড়া নিয়েই ব্যস্ত, আর বাপি এমন মজা করার লোক নয়। তবে কি মা? কিন্তু কেনো??
পরদিন সকালে আয়নাটা পরিষ্কার করে লিপস্টিকটা ব্যাগে ভরে নিলাম। সেদিন আমাদের কিছু ডকুমেন্টেশনের জন্য অফিসে ডেকেছিল। আমি আর ঋতুজা একটা ওলা বুক করে ওয়েট করছিলাম পাড়ার মোড়ে। আগের দিন সারা রাত বৃষ্টিতে জল জমেছে বিভিন্ন জায়গায়। হঠাৎ একটা গাড়ি বিচ্ছিরি ভাবে আমায় ভিজিয়ে দিয়ে গেলো। ঋতুজার গায়েও লেগেছিল অল্প নোংরা। বাধ্য হয়ে ঘরে এলাম পোশাক বদলাতে, আকাশ ভেঙ্গে এমন বৃষ্টি নামল যে আর বেরোতেই পারছিলাম না। অফিসে ফোন করলাম শেষে পরদিন যাব বলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে ছাড় দিলো ওরা।
দেখতে দেখতে যাওয়ার দিন এসে গেলো, এয়ারপোর্টে সবাই এসেছিল । ওরা দশ জন করে পাঁচটা দল করেছিল। আমি ঋতুজা একটা দলেই ছিলাম। মুম্বাই পৌঁছে প্রথম দিন দারুণ কাটল। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে দেখি আয়নার কাচে লেখা, ‘বিপদ, ফিরে যাও’।ঐ লিপস্টিকটা দিয়েই লেখা। ভাগ্যিস ঋতুজা দেখেনি, ঘুমচ্ছিল। আমি কাঁপা হাতে লেখাটা মুছে ভাবতে বসলাম কে লিখতে পারে। বাড়ির ঘটনা আমি ঋতুজাকেও বলি নি। তাহলে?? সেদিন আমাদের দশ জনের ট্রেনিং শুরু হল। তিনদিন ট্রেনিংএর পর আমাদের দশ জনকে একটা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে পাঠানো হবে দুবাই।
প্রথম দিন ট্রেনিং শেষে হোটেলে ফিরে দেখি আবার কাচের উপর লেখা সাবধান বানী। লেখা -”ফিরে যাও, বিপদ। ” ভাগ্যিস ঋতুজা নিচে ছিল, ও আসার আগেই মুছে ফেললাম। কিন্তু ভাবতে বসলাম এবার, আমার লিপস্টিক ব্যবহার করে কে এমন লিখতে পারে, রুমের চাবি আমার কাছে ছিল। ঋতুজা আমার সাথেই ছিল। আর ঐ একটা লিপস্টিক বারবার কে ইউজ করছে? মাথাটা কাজ করছিল না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম, সমুদ্রের ভেজা বাতাসে যদি মাথা কাজ করে, খেতেও গেলাম না রাতে। মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছিল, ঘরটা কেমন গুমোট লাগছে। এসিটা বাড়িয়ে ফোনটা টেনে নিলাম। পর পর কত গুলো হোয়াটস এপ ম্যাসেজ ঢুকছে মনে হল। একটা আননোন নম্বর থেকে বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ দেখে পড়তে শুরু করলাম, প্রথম ম্যাসেজে একটা দু বছরের পুরানো পেপার কাটিং, ছয়টি মেয়ে মুম্বাইতে এয়ার হোসটেসের ট্রেনিং নিতে এসে নিখোঁজ। কেঁপে উঠলাম ভেতর ভেতর।
দ্বিতীয় পেপার কাটিং এ আটটি মেয়ে নিখোঁজ। শেষটায় আবার পাঁচটা মেয়ের খবর। শেষ পেপার কাটিং টা দেখে চমকে উঠলাম, আমি ঋতুজা সবাই রয়েছি খবরে, তারিখটা এক সপ্তাহ পরের, এটা কি করে সম্ভব। এতো এডভান্স পেপার বের হয় নাকি? খবরটা পড়ে হাত পা কাঁপছিল। এটা একটা বড় গ্ৰুপ, এভাবে মেয়ে পাচার হয়। কিন্তু কে আমায় এভাবে এলার্ট করছে!! ঋতুজাকে ডেকে তুললাম, সবটা দেখালাম। ঘুম চোখে প্রথমে ও কিছুই মানতে চাইছিল না। ম্যাসেজ গুলো দেখে ও থম মেরে গেছিল। বলল -”এ জন্যই ওরা ভাগে ভাগে ট্রেনিং রেখেছে।এখন উপায় ?” সাথে-সাথে ম্যাসেজ ঢুকল -”কাল পুলিশে জানাও। পালিয়ে যাও। ” এর পরের ঘটনা বেশ অন্যরকম। পরদিন ট্রেনিং এর জন্য বেরিয়ে আমরা দুজন সোজা থানায় যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু ওদের গাড়িতেই উঠতে হল। একা কোথাও যাওয়ার পার্মিশন নেই। যে হোটেলে ট্রেনিং হচ্ছিল সেখান থেকে লাঞ্চের সময় পালিয়ে থানায় গিয়ে সবটা খুলে বললাম। ম্যাসেজ দেখাতে গিয়ে শুধু ঐ এডভান্স ম্যাসেজটা পেলাম না খুঁজে।
থানার অফিসারটি খুব ভাল ছিল। আমাদের সব কথা মন দিয়ে শুনে বলল -”গ্যাংটাকে বহুদিন ধরে খুঁজছি। এদের কাজ এতটাই নিট আর ক্লিন হাত লাগাতেই পারছিলাম না। ” আমাদের থানায় বসিয়েই ওরা রেড করেছিল হোটেলে। বাকি মেয়ে গুলোও বেঁচে গেছিল, তবে অন্য গ্ৰুপের দশটা মেয়ে ততক্ষণে পাচার হয়ে গেছিল বিদেশে। এরা এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে নাম বদলে বদলে মেয়ে পাচার করত, কখনো চাকরীর লোভ দেখিয়ে, কখনো নার্সিং ও অন্য কোনো কিছুর ট্রেনিংএর নাম করে এভাবেই বাইরে পাচার হত শিক্ষিত মেয়েরা। আমাদের সাক্ষ্য নিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল মুম্বাই পুলিশ।
কলকাতায় ফিরে লিপস্টিকটা আর খুঁজে পাইনি।ব্যাগ থেকে হাওয়া!! নিউমার্কেট এরিয়ায় গিয়ে সেই ছেলেটাকেও বহু খুঁজেছি, আর পাইনি। আর মেসেজ গুলো যে নম্বর থেকে এসেছিল মুম্বাই পুলিশ পরে জানিয়েছিল ওটা ইনভেলিড নম্বর, অস্তিত্ব নেই। সিমটা কলকাতার। তৃষা রায় বলে কারো নামে নেওয়া হয়েছিল। দু বছর হল ওটা ইনভেলিড।
আমি একজন তৃষা রায় কে চিনতাম আগে। সেদিন বহুদিন পর ঘুমের ভেতর তৃষাদিকে স্বপ্নে দেখলাম, আমার মামা বাড়ির পাশে থাকত তৃষাদি। শুনেছিলাম এয়ারহোষ্টেসের চাকরী নিয়ে বাইরে চলে গেছিল দু বছর আগে। পরদিন সকালে উঠেই মামাবাড়িতে ফোন করেছিলাম। দু বছর আগেই তৃষাদি নাকি হারিয়ে গেছিল চাকরী করতে গিয়ে। ওর বিধবা মা যখন খোঁজ করতে গেছিল এয়ারলাইন্সটা নাকি বলেছিল ওনার মেয়ে ওদের স্টাফ নয়, ঐ নামে কেউ চাকরীই করে না ওদের কাছে। তৃষাদি লিপস্টিক পড়তে খুব ভালোবাসতো। স্বপ্নে সেদিন ঐ কালচে মেরুন লিপস্টিকটাই পরেছিল ও। তবে কি ও আমাদের বাঁচাতেই এসেছিল !!