ঘটনাটি ১৯৯৫ সালের হেমন্তের মাঝামাঝি, আমার স্যারের নাম আতিক। তিনি ছিলেন আমার অংক শিক্ষক….
(এখন একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে আছেন)।
স্যারের দেশের বাড়ি চাঁদপুরে। ঘটনাটি যখন ঘটে স্যার তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
স্যার ৪র্থ শ্রেণীর এক ছাত্র পড়াতেন গ্রাম থেকে দেঢ় মাইল দূরে কাশিমপুর গ্রামে গিয়ে।
বেতন বেশি হওয়ায় স্যার সকল কষ্ট উপেক্ষা করে নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে পড়াতে যেতেন।
রোজ বিকেলে স্যার সাইকেল চালিয়ে কাশিমপুর যেতেন আবার সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফিরে আসতেন নিজ গ্রামে।
আমার স্যারের গ্রাম এবং কাশিমপুর গ্রামের মাঝে প্রায় এক মাইলের ফাঁকা ধানের মাঠ রয়েছে।
দিনের বেলা কৃষকে পরিপূর্ণ থাকলেও রাতের বেলা একদম ফাঁকা থাকে।
এই এক মাইলের মধ্যে কোন বসত বাড়ি নেই, শুধু আঁধা পাকা রাস্তাটা দিয়ে এঁকে বেঁকে চলতে হয়।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার, স্যার একটা বিশেষ কাজে আটকে যাওয়ায় সন্ধ্যা বেলা কাশিমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
সাইকেলটা সমস্যা হওযায়, রিক্সায় করে চললেন। আকাশের অবস্থ্যা খারাপ। থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে।
এই আবহাওয়ায় না বের হলেই ভাল হতো কিন্তু উপায় নেই। কাল স্টুডেন্ট- এর অংক পরীক্ষা, আজ না গেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।
অবশ্য ভোর বেলা যাওয়া যেতো কিন্তু কাল ভোরের গাড়িতে স্যারকে জরুরী ঢাকায় আসতে হবে।
কাশিমপুরের কাছে যেতেই মুষলধারায় বড় বড় ফোটা আকারে বৃষ্টি শুরু হলো। কোন রকম ছাত্রের বাসায় উঠে নিজেকে রক্ষা করলেন স্যার।
স্যারের একটা অভ্যাস হলো যখন তিনি অংক করান তখন আর ঘড়ির দিকে তাকান না। তেমনি অংক করাতে করাতে ঘড়িতে দশটা বেজে গেল।
অবশ্য বাইরে যে ঝড় শুরু হয়েছে তাতে ঘড়ি দেখেও লাভ নেই স্যারের।
ছাত্রের বাবা এসে স্যারকে আজ রাতটা থেকে যেতে বললেন,
–স্যার হাসি মুখে বললেন কাল ভোরেই ঢাকা যেতে হবে অতএব আজ রাতে গিয়ে সব কিছু গুছাতে হবে।
ঝড় থামলো রাত সাড়ে এগারোটায়। একটা ছাতা হাতে স্যার বেরিয়ে পড়লেন।
স্যারকে সাবধানে যেতে বলে বাড়ির বাহির পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন ছাত্রের বাবা।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রাস্তার মধ্যে কাঁদা হওয়ায় স্যারের চলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।
এক পা দু’ করে স্যার ছাড়া বনের কাছে চলে এলেন। (ছাড়া বন মানে, সে বনের আশে পাশে কেউ থাকে না এবং খুব খারাপ বন)।
ছাড়া বনের পাশেই চিতাখোলা।স্যার মনে মনে ভয় পেতে লাগলেন তবুও সাহস হারালেন না।
চিতাখোলা কাছে আসতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস স্যারের শরীলটাকে হিম করে দিয়ে গেল।
সাথে সাথে স্যারের শরীল বেশ ভারি হয়ে গেল। স্যার যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে চললেন।
বাতাসে কাঁদা মাটির গন্ধ, স্যার খোলা রাস্তা ধরে এগুতে লাগলেন।
আকাশে কালো মেঘের ফাকে মরা চাঁদ উকি দিয়েছে।চারিদিকে মোটামুটি হালকা দেখা যাচ্ছে।
একা একা স্যার হেঁটে চলছেন, এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ পেলেন। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় পানি জমে আছে তা থেকেই পায়ের শব্দ আসছে।
স্যার পেছনে তাকালেন, কোথাও কিছু নেই। আবার হাঁটতে লাগলেন, আবার পেছনে সেই শব্দ।
স্যার আবার পেছনে ফিরে তাকালেন, এবার দেখলেন একটা বড় কালো রঙের কুকুর দাঁড়িয়ে আছে স্যারের থেকে ৫-৬ হাত দূরে, চোখ দুটো সাদা।
স্যার কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, এত বড় কুকুরতো জীবনেও দেখিনি। স্যার আবার হেঁটে চললেন, পেছনে পায়ের শব্দ।
স্যার বুঝতে পারলেন মারাত্মক একটা ভুল হয়ে গেছে। এত রাতে না বেরুলেই বোধহয় ভালো হতো।
মনে মনে স্যার ভাবছেন যদি একটা মানুষের দেখা পাওয়া যেতে……। ঠিক এমন সময় কেউ একজন স্যারের পিঠে হাত রাখলেন।
চমকে গেলেন স্যার,পেছনে তাকিয়ে দেখে কিছু নেই, কুকুরটাও নেই। ফাঁকা রাস্তা। রাস্তার দু’পাশের গাছগুলো যেন ভেঙে পড়ছে স্যারের মাথায়।
অথচ আশে পাশে কোন বাতাস নেই। স্যারে আরো দ্রুত হাঁটতে লাগলেন।
এবার দেখলেন, একজন তরুণী রাস্তার পাশে অর্ধেক মাটির ভেতরে আর অর্ধের বাহিরে।
স্যারের দিকে তাকিয়ে ডাকছে। তরুনীর চোখ দুটো সাদা কোন মণি নেই।
পেছনে আবার সেই পায়ের শব্দ স্যার তাকিয়ে দেখেন এবার একটি নয় দুটি নয় কয়েক হাজার কুকুর স্যারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার সাহসী স্যার তখন একেবারে সাহস হারা হয়ে গেলেন। হিংস্র কুকুর গুলো এখনি মনে হচ্ছে স্যারকে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে।
সামনের দিকে তাকিয়ে আরো ভয় পেয়ে গেলেন স্যার।একটা ছায়ামূতি বাতাসের গতিতে এগিয়ে আসছে স্যারের দিকে।
খোলা রাস্তা তাই অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ছায়ামূতি দেখে মনে হচ্ছে কোন কাফনে মোড়ানো লাশ। সাদা কাপড়ে বাঁধা, পা নেই মাথা নেই।
এবার পেছনে কুকুরগুলো হেসে উঠলো, কি ভয়ানক সে হাসি তা বলে বোঝানো যাবে না।
স্যার কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না, শুধু বুঝতে পারছেন প্রচন্ড ভয় পাওয়ার কারনে তার হাত পা নাড়াতে পারছে না।
ছায়ামূতিটি ঝড়ের গতিতে এসে স্যারকে ধাক্কা মারে। কানে ভেসে আসে ভয়ানক হাসির শব্দ।
তারপর আর কিছু মনে নেই স্যারের। যখন জ্ঞান ফিরেছে,তখনি নিজেকে ধানের মাঠে আবিস্কার করে। কাঁদা জলে ভিজে আছে পুরো শরীর।
রাস্তা থেকে দশ বিশ হাত দূরে। চারিদিকে তখনো অন্ধকার।রাতের নীরবতা ভেঙে কানে ভেসে আসে ফজরের আযান।
স্যার আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এবং আলো ফুটলে নিজ গ্রামে চলে যায়।