যখন শিবাজী আর ওর বন্ধুরা মিলে রাত্রির মৃতদেহটা নিয়ে পৌঁছাল বাড়িতে তখন বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা পর্যন্ত ছিল না। পুরো পাড়া যেন ভেঙে পড়েছিল বাড়িতে। সবাই যে শুধু দুঃখের সাথী হতে এসেছিল তা নয়। সহানুভূতি হয়তো তাদের ছিল কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি ছিল কৌতূহল। প্রশ্নগুলো ঘুরছিল সবার মুখে মুখে। কি হয়েছিল সেদিন রাত্রির সাথে ? কতজন ছিল ? কি করছে পুলিশ ? কাউকে কি ধরলো ? অনিমাকে ঘিরে বসেছিল দুই দিদি, ছোটো জা, ননদ আরো কতজন তার ইয়ত্তা নেই। রাত্রির মৃহদেহটা ঘরে এনে রাখতেই কান্নার রোল উঠল। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
সাদা চাদরে মোড়া ছিল মাথা থেকে পা পর্যন্ত। শিবাজী আগেই ঠিক করে ফেলেছিল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাত্রির মৃতদেহ নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। সেই মতো চটপট সব কিছু ব্যবস্থা করে নিচ্ছিল সে। কাজের মাঝে মাঝে বার বার মাথায় আসছিল শিবাজীর যে ছোটো বোনটা এমন হঠ্ করে চলে গেল তা সত্ত্বেও তার চোখে এক ফোঁটাও জল নেই কেন ? তার ভেতরটা কই কাঁদছে না তো ? শুধু হওয়ার মধ্যে একটাই জিনিসই হচ্ছিল ওর – জ্বলে যাচ্ছিল শুধু ওর ভেতরটা। রাগে যেন মাথায়, বুকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছিল জ্বালাটা। কি করে জুড়বে এই জ্বালা জানেনা সে। হয়তো সেই তিনজন শাস্তি পেলে জুড়িয়ে যাবে ভেতরটা ? সেই তিনজন।
কথাটা মাথায় আসতেই যেন শিবাজীর হাত দুটো আপনাআপনিই মুঠো হয়ে গেল। ওর চোখ দুটো যেন জ্বালা জ্বালা করে উঠল। তিনজনের মুখগুলো পাক খেয়ে গেল ওর চোখের সামনে দিয়ে। শিবাজীর কপালের দুপাশ দপ দপ করে উঠল। ফুলের মতো মেয়েটাকে এই তিনজনে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছে। কেন ? কেন এমন করল ওরা ? মানুষের জীবনের কি কোনো দাম নেই ? শিবাজীর কানে ভেসে এল চিৎকার। আবার অজ্ঞান হয়ে গেছে অনিমা। বারে বারে জ্ঞান হারাচ্ছিল অনিমা মেয়ের শোকে। আর দেবপ্রসাদ বসেছিল এক ভাবে। নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছিলো সে। শিবাজী এক ঘন্টার মধ্যে সব তোড়জোড় করে বেরিয়ে পড়ল রাত্রির মৃতদেহ নিয়ে। হরিবোলের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল বাড়ির আনাচে কানাচে। দুঃখের সাথী হতে আসা মানুষগুলোর সাথে সাথে কৌতূহল মেটাতে আসা মানুষগুলোর পর্যন্ত চোখের পাতা ভিজে গেল জলে। সময়ের অনেক আগেই চলে গেল একটা জীবন। কিন্তু কে এই রাত্রি ?
একটা সাধারণ মেয়ে। মধ্যবিত্ত বাঙালী ঘরের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই একটা মেয়ে। শুধু তার দোষের মধ্যে ছিল একটাই। একবার কেউ তাকালে ওর দিকে আবার একবার ফিরে তাকাবেই সে। বাবা দেবপ্রসাদ আর মা অনিমা বেশ আগলেই রাখতো মেয়েকে। হাজার একটা নিষেধের ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে জীবনের পথে এগোচ্ছিল সে। কিন্তু কেন নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে না সে ? প্রশ্নটা বারে বারে করত সে বাবা, মা আর দাদার কাছে। কিন্তু কি উত্তর দেবে তারা ? তারাও কি চাইতনা যে রাত্রি আর পাঁচটা মেয়ের মতো জীবন কাটাক ? কিন্তু উপায় কই ? তাও শিবাজী কিন্তু মাঝেসাঝেই তাকে নিয়ে যেত এদিক সেদিক। তবে বন্ধুদের সাথেই যাক আর দাদার সাথেই যাক, রাত্রি সন্ধ্যের পরে খুব একটা বাড়ির বাইরে থাকতো না। কারণ তাকে সন্ধ্যের পরে বাড়িতে না দেখলে যে দেবপ্রসাদ আর অনিমা বড়ো হানটান করত।
রাত্রির মোটেও ভালো লাগতো না সেটা। তাই চেষ্টা করত সে সন্ধ্যের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসার। অবশ্য রাত্রি নিজেও তো সন্ধ্যের পরে বাড়ির বাইরে থাকতে ভয় পেতো। বছর দু’য়েক আগে কিন্তু এই রকম পরিস্থিতি ছিল না। তখন রাত্রিও অন্য সবার মতো পাখা মেলে উড়ে বেড়াতো। জীবনটাকে নিজের মতো করে বাঁচতো। কিন্তু যেদিন ও এলাকার ত্রাস যদু নস্করের ভাই দুলাল নস্করের নজরে পড়ে গেল সেদিন থেকে ওর জীবনটা একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করল। সেই সময় সবে সবে কলেজে ঢুকেছিল রাত্রি। কিছু নোটস নেওয়ার তাগিদে এক দিন কলেজ ফেরতা রাত্রি গিয়েছিল প্রিয়ার বাড়িতে। প্রিয়ার বাড়ি থেকে সেই রাতে রাত্রির বেরোতে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে আচমকাই নির্জন গলির মধ্যে যেন মাটি ফুঁড়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল দুলাল নস্কর। দুলাল নস্করকে মাঝে মধ্যেই দেখেছিল রাত্রি আসা যাওয়ার পথে। তবে তার গতিবিধির ওপর যে সে এভাবে নজর রাখছে সেটা বুঝতে পারেনি রাত্রি।
প্রিয়ার বাড়ি থেকে তার বেরোনোর অপেক্ষায় যে দুলাল কোথাও ঘাপটি মেরে বসেছিল সেটা এই নির্জন গলির মধ্যে তাকে আচমকা মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে দেখে বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল রাত্রি। পলকে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল সে রাত্রির একদম সামনেটায়। তারপর ঝটকায় রাত্রির একটা হাতকে মুড়িয়ে তার পিঠের কাছে চেপে ধরেছিল। রাত্রিকে এতটুকুও সময় না দিয়ে অন্য হাতটা দিয়ে সে চেপে ধরেছিল রাত্রির মুখটা। তারপর হিড়হিড় করে সে টেনে নিয়ে গিয়েছিল রাত্রিকে গলির মুখটাতে। গলির মুখটাতে ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছিল একটা গাড়ি। রাত্রি তার শেষ চেষ্টা করেছিল বাঁচার জন্য। বাঁ হাতের আঙুলের বড় বড় নখগুলোকে চেপে বসিয়ে দিয়েছিল দুলালের কপালেতে। তারপর আঁছড়ে নামিয়ে নিয়েছিল থুতনি অবধি। যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠেছিল দুলাল।
রাত্রির গা থেকে হাত সরিয়ে চেপে ধরেছিল সে নিজের মুখটাকে। সুযোগ পেয়েই দৌড়েছিল রাত্রি। কিন্তু গাড়িটা ধেয়ে এসেছিল তার পেছনে। বাঁচার তাগিদে প্রাণপণে চিৎকার করেছিল রাত্রি। আটটা পঞ্চাশের লোকালে আসা কিছু অফিস ফেরতা মানুষ চিৎকার শুনে এগিয়ে এসেছিল পাশের গলি থেকে। অগত্যা ফিরে গিয়েছিল দুলাল নস্করের দল। কিন্তু এরপর নিত্য হয়রানি শুরু হয়েছিল রাত্রির। শেষে দেবপ্রসাদ আর শিবাজী পাড়ার বেশ কিছু লোকজন নিয়ে গিয়েছিল যদু নস্করের বাড়িতে। যদু নস্কর বিরক্ত হলেও আস্বস্ত করেছিল দেবপ্রসাদ আর শিবাজীকে যে দুলাল আর কোনো রকম ভাবে বিরক্ত করবে না রাত্রিকে। এরপর বেশ কয়েকটা দিন দুলাল সত্যিই কোনো রকম বিরক্ত করেনি রাত্রিকে। রাত্রি আবার ফিরে এসেছিল তার স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু দোলের দিনে ঘটে যায় একটা ঘটনা।
নেশায় টইটুম্বুর দুলাল আর ওর বন্ধুরা দুপুরের দিকে আচমকাই চড়াও হয় রাত্রিদের বাড়িতে। আচমকাই বাড়ির ভেতর তিন চারটে ছেলেকে ঢুকে আসতে দেখে দেবপ্রসাদ আর অনিমা থমকে যায়। ততক্ষণে নেশায় মত্ত দুলাল ঘর থেকে টেনে বার করে নিয়ে যেতে শুরু করে রাত্রিকে। বাধা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে দেবপ্রসাদ আর অনিমা। চিৎকার চেঁচামেচিতে আসে পাশের মানুষজন জড়ো হয়। সঙ্গে সঙ্গে খবর যায় পাড়ার ক্লাবে। শিবাজী দৌড়ে আসে বন্ধু বান্ধব নিয়ে। অবস্থা বেগতিক থেকে আবার সরে পরে দুলালের দল। এবার আর যদু নস্করের কাছে না গিয়ে সোজা থানায় যায় দেবপ্রসাদ আর শিবাজী। এটা বোধহয় হজম করতে পারেনি যদু নস্কর। ছোট ভাইকে সরিয়ে এরপর সামনে এসে দাঁড়ায় যদু নস্কর। শুরু হয় একের পর এক উৎপাত। কখনো রাত্রিদের বাড়ির ছাদে পাথর পড়ে তো কখনো দরজার সামনে পড়ে থাকে হাড়গোড়। কখনো ফোনে হুমকি আসে তো কখনো জানলার কাঁচ ইটের ধাক্কায় ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে। এই সব হতে হতে হঠাৎ করে একদিন সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়।
খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও আতঙ্কটাকে পুরোপুরি সরিয়ে ফেলতে পারেনি রাত্রিরা কেউই। একটা আশঙ্কা থেকেই গিয়েছিল ওদের মনের মধ্যে। সেই আশঙ্কাটা যে ভুল নয় সেটা দেবপ্রসাদ, অনিমা আর শিবাজী বুঝতে পারলো গত শুক্রবার যখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলেও রাত্রি ফেরে না বাড়িতে। শুক্রবার সারাটা দিনই চলছিল বৃষ্টি। দুপুরের কিছুটা পর থেকে শুরু হয়েছিল মুষলধারে বৃষ্টি। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল চারিদিক। এমনিতে রোজ রাত্রিরা ছ বন্ধু কলেজ থেকে বেরিয়ে স্টেশন অবধি হেঁটে যায় এক সাথেই। তারপর যে যার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। রাত্রি আর প্রিয়া ওঠে একই ট্রেনে।
এ পাড়া ও পাড়া থাকে দুজন। ট্রেন থেকে নেমে কিছুটা পথ এক সাথে হেঁটে গিয়ে দুজনেই নিজের পথ ধরে। কিন্তু শুক্রবারে জ্বর হয়েছিল বলে কলেজ যায়নি প্রিয়া। বৃষ্টির জন্যে কম ছাত্র ছাত্রীই সেদিন পৌঁছেছিল কলেজে। কিন্তু প্র্যাক্টিকল ক্লাস ছিল বলে ইচ্ছে না থাকলেও কলেজে যেতে হয়েছিল রাত্রিকে। বিকাল চারটের মধ্যেই রাত্রিরা তিন বন্ধু প্র্যাক্টিকল ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে পড়েছিল কলেজ থেকে। অন্ধকার মেঘলা দিনে যেন হুট করে সন্ধ্যে নেমেছিল। অনিমা আর দেবপ্রসাদ অনেক্ষণ ধরেই হানটান করতে করতে শেষে ফোন করেছিল শিবাজীকে। সেদিন রাত্রি বাড়ি ফেরেনি শুনে ছ’টার মধ্যেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল শিবাজী। তারপর বাড়ি ফিরে প্রিয়াকে ফোন করতেই সে অন্য বন্ধুদের থেকে জেনে শিবাজীকে জানিয়েছিল যে রাত্রি কলেজ থেকে বেরিয়ে স্টেশন অবধি এসেছিল অন্য দুই বন্ধুর সাথে। ওদের সামনেই রাত্রি উঠে পড়েছিল ট্রেনে।
ওদের ট্রেন আসতে তখনো কিছুটা সময় বাকি ছিল। প্রিয়ার কাছ থেকে খবর পেয়েই শিবাজী দৌড়েছিল স্টেশনে দিকে। মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় করে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে স্টেশনের দিকে এগোনোর সময় শিবাজীর ভয়ে বুকটা কেঁপেছিল বারে বারে। তাও সে নিজেকে আশ্বস্ত করেছিল এই বলে যে স্টেশনে গিয়েই হয়তো সে দেখা পাবে রাত্রির। বৃষ্টির জন্যে আটকে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো কোনো শেডের নীচে। কিন্তু স্টেশনে পৌঁছেই প্রায় ফাঁকা স্টেশন চত্তর দেখে প্রমাদ গুনেছিল সেদিন শিবাজী। রাত্রির বন্ধু প্রিয়ার কথা অনুযায়ী প্রায় আড়াই ঘন্টা আগে চারটে পয়ঁত্রিশের ট্রেনে উঠেছিল রাত্রি। সেই অনুযায়ী পাঁচটা দশে এই স্টেশনে নেমে যাওয়ার কথা তার। তাহলে এই সাতটা সাড়ে সাতটা অবধি সে বাড়ি পৌঁছালো না কেন ? চিন্তায় পাগল পাগল দশা হয় শিবাজীর। বাড়ি ফিরেই দেবপ্রসাদকে নিয়ে দৌড়ায় শিবাজী থানায়।
সোজাসুজি আরোপ আনে দুলাল নস্করের বিরুদ্ধে। দুলাল নস্করের খোঁজে তার বাড়িতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে যে দুদিন আগেই নাকি সে তার মাসির বাড়ি বেড়াতে গেছে। এরপর শিবাজী আর ওর বন্ধুরা সারাটা রাত বৃষ্টির মধ্যে খুঁজে বেড়ায় রাত্রিকে। অবশ্য পুলিশের তরফ থেকেও বেশ তৎপরতা দেখানো হয়েছিল। তারই ফল পাওয়া গিয়েছিল ভোর রাতে। ট্রেন লাইনের পাশের ঝোঁপ থেকে উদ্ধার হয়েছিল রাত্রির প্রায় নিথর হয়ে আসা শরীরটা। রাত্রিকে মৃত ভেবেই বোধহয় ফেলে রেখে গিয়েছিল শয়তানগুলো। ডাক্তাররা রাত্রির অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছিল প্রায়। এতোটা নৃশংস হতে পারে মানুষ সেটা বোধহয় রাত্রির শরীরটাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। মারা যাওয়ার আগে একবার চোখ চেয়েছিল রাত্রি। খুব আস্তে আস্তে ঠোঁট দুটো নড়ে উঠেছিল ওর। শিবাজী কানটাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর মুখের কাছে। খুব আস্তে হলেও স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল সে তিনটে নাম—-দুলাল, টুকাই আর বাবুসোনা।
আজ সকালেই থানার লক আপে শিবাজী আর ওর তিন বন্ধুকে এনে ঢুকিয়েছে পুলিশ। রাত্রির মৃত্যুর পর কেটে গেছে একটা মাস। এই এক মাসে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। রাত্রির মৃত্যুর পরে দুলাল, টুকাই আর বাবুসোনা গা ঢাকা দেয়। কিন্তু শিবাজীর বন্ধুরাও তাদের খুঁজে বার করতে জান লড়িয়ে দেয়। দিন কুড়ি কেটে যায় খোঁজ খবর করতে করতেই। তারপর একদিন দিঘার একটা ভাড়া বাড়িতে বাবুসোনার খোঁজ পাওয়া যায়। শিবাজী সেদিনই দুই বন্ধুকে নিয়ে একটা গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ে দিঘার উদ্যেশ্যে।
তিনজনই নিজেদের সেল ফোনটাকে রেখে যায় চতুর্থ বন্ধুটির বাড়িতে। সেই রাতে বাবুসোনাকে মেরে সিলিং ফ্যানটার সাথে টাঙিয়ে ভোর রাতে ফিরে আসে ওরা চতুর্থ বন্ধুটির বাড়িতে। ওদের বিরুদ্ধে বাবুসোনার বাড়ির লোক অভিযোগ আনলেও চতুর্থ বন্ধুটির সাক্ষীতে প্রমান হয় যে সে রাতে ওরা চার বন্ধু এক সাথেই ছিল চতুর্থ বন্ধুটির বাড়িতে। সেল ফোন লোকেশন বার করেও পুলিশ তার প্রমাণ পায়। সন্দেহ হলেও প্রমাণের অভাবে কিছুই করতে পারেনি পুলিশ। এর প্রায় দিন তিনেক পরে টুকাইয়ের বাড়িতে রীতিমতো ফোন করে ওর মৃত্যুর খবর দেয় শিবাজী। টুকাইকে শ্বাস রোধ করে মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল শিবাজী আর ওর বন্ধুরা।
টুকাইয়ের বাড়ির লোক অভিযোগ করেছিল যে শিবাজী তাদের ফোনে জানিয়েছিল যে সে টুকাইকে খুন করেছে। কিন্তু যে সময় টুকাইয়ের বাড়ির লোকের কাছে শিবাজীর ফোনটা গিয়েছিল ঠিক সেই সময় শিবাজী বসেছিল থানার ওসির সামনে। রাত্রির কেসের তদন্ত কতদূর এগোলো জানতে সে গিয়েছিল থানায়। বুঝতে পেরেছিল পুলিশ যে প্ল্যান করে এগোচ্ছে শিবাজী। কিন্তু এবার প্রমাণ ছিল শিবাজীর স্বপক্ষে। মনে মনে হেসেছিল শিবাজী। নিজের কথা গুলোকে রেকডিং করে বন্ধুর কাছে দিয়ে নিজে সে গিয়ে বসেছিল থানায় ওসির সামনে। আর যে ফোনটা থেকে টুকাইয়ের বাড়িতে ফোন করা হয়েছিল সেই ফোনটা ছিল বাবুসোনার। এই ফোনটাকে বাবুসোনার মৃত্যুর পর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল পুলিশ। কিন্তু ফোনটা যেন উবে গিয়েছিল সেদিন। বাবুসোনার সেই সুইচ অফ হওয়া ফোনটা এই দিন পাড়ার শেষ প্রান্তে চ্যাটার্জিদের পোড়ো বাড়িতে গিয়ে সুইচ অন হয়। তারপর টুকাইয়ের বাড়িতে তার মৃত্যু সংবাদটা পৌঁছে দিয়েই আবার সুইচ অফ হয়ে যায় ফোনটা।
এর ঠিক দুদিনের মাথায় বাবুসোনার ফোনটা আবার সুইচ অন হয় যেখানে রাত্রির প্রায় নিথর হয়ে আসা শরীরটা পাওয়া গিয়েছিল। যদু নস্করকে শুধু একটা কথা জানিয়ে আবার সুইচ অফ হয়ে যায় ফোনটা যে আজ দুলালের শেষ দিন। এরপর ফোনটাকে সুইচ অফ করে একটা পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। শিবাজী ভাবতেও পারেনি যে বিনা প্রমাণেও পুলিশ তাকে আর তার তিন বন্ধুকে তুলে এনে ভরে দেবে লক আপে। বার বার এর বিরোধ করলেও পুলিশ একটাই কথা বলে যায় শিবাজীদের যে শুধু আজকের দিনটা তাদের এখানে রেখে ছেড়ে দেবে তারা। দুলাল নস্করকেও পুলিশ এনে রেখেছিল তাদের ইনটারোগেশনের ঘরটাতে। সারা দিন যাতে তাকে সংরক্ষণ দেওয়া যায়। যদু নস্করও সব কাজ ফেলে এসে ঠায় বসেছিল থানায়। শিবাজী আর ওর তিন বন্ধু বসেছিল লক আপে।
বার বার নিজেকে দোষারোপ করছিল শিবাজী যে আগে ফোনটা বোধহয় না করলেই হত। সারাটা দিন পেরিয়ে গিয়েছিল নির্বিঘ্নে। একসময় সন্ধ্যেটাও পেরোলো শান্তিতে। মনমরা শিবাজী আর ওর তিন বন্ধু রাত প্রায় দশটা নাগাদ চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে সজাগ হল। থানায় দৌড়াদৌড়ি আর হৈ চৈ এর মাঝে জানতে পারলো যে ইনটারোগেশন রুমে আচমকাই দুলালের শরীর নীল হয়ে যায়। তারপর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠতে শুরু করে। প্রথমে সবাই ভাবে বোধহয় সাপ আছে ঘরে। তার কামড়েই বোধহয় দুলালের এই অবস্থা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অবাক হয়ে দেখে থানায় ডিউটিতে থাকা কয়েকজন যে দুলালের সারা শরীর ভরে যেতে থাকে আঁচড়ে। দাগড়া দাগড়া আঁচড়ে সারা শরীর থেকে বেরিয়ে আসে রক্ত। ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায় দুলাল।
যখন দুলালের ক্ষত বিক্ষত শরীরটাকে শিবাজীদের সামনে দিয়ে নিয়ে যায় এম্বুলেন্সে তোলার জন্যে তখন শিবাজী যেন স্পষ্ট দেখে রাত্রিকে। হাসি মুখে বেরিয়ে যাচ্ছে সে দরজা দিয়ে। এক দৃষ্টে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে শিবাজী। এক সময় দরজার বাইরে গিয়ে হাওয়ার সাথে যেন মিলিয়ে যায় রাত্রি। কিছুক্ষণ পরে ওসির আদেশে ছেড়ে দেওয়া হয় শিবাজী আর ওর বন্ধুদের। থানা থেকে বেরোনোর সময় শিবাজী ওসির অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু এইটুকু বলে-“আজ আমার বোনের আত্মা মুক্তি পেলো”।