সে অনেক আগের কথা! আমি ছিলাম ক্লাস টু তে তখন।সেসময় বিকালবেলা আমরা বাড়ির ছেলেমেয়ে সবাই মিলে একসাথে লামা’র মাঠে গোল্লাছুট খেলতাম। কখনো বা লুকোচুরি কিংবা হা-ডু-ডু’র খেলাও চলতো। আর মাঝেমধ্যে সবাই একসঙ্গে হেঁটে চলে যেতাম ফাঁকা মাঠে ঘুড়ি উড়াতে,বা অনেকটা দূরের ডাক্তারবাড়িতে তেঁতুল কুড়াতে! ডাক্তারবাড়িতে ছিলো ইয়া বিশাল এক তেঁতুলগাছ। লোকেরা বলতো ঐ গাছে নাকি জ্বীনের বাস আছে! কিন্তু আমরা ওসব জ্বীন-ভূত এর গল্পটা শুধুমাত্র গল্প বলেই উড়িয়ে দিতাম। এর সত্যতা আসলে কতটুকু তা যেমন আমাদের কারোরই জানা ছিলোনা তেমনি কেউ সেটা জানার কোন প্রয়োজনও বোধ করিনি কখনো।
মনে আছে, সেদিন বুধবার। আমরা বিকালবেলা একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে ডাক্তারবাড়িতে যাই তেঁতুল কুঁড়াতে।সেখানে আমি, মিজান, ছোটভাই, জুবেরসহ আরো কয়েকজন ছিলো। ফলকুড়াতে আমাদের কী যে মজা হতো তখন, যতোটা হয়তো ফল খেতেও হয়না। তখন আবার প্রতিযোগিতা হতো কে বেশি তেঁতুল কুড়াতে পারে। এ নিয়ে বিজয়ীরা গর্ব ও বাহবা পুরষ্কারও পেতো।আর এভাবেই কেটে যেতো আমাদের তখনকার সোনালী দিনগুলো। সেদিন বিকালবেলা আমরা পুরো তেঁতুলবন চষে শেষে আমারই বেশি কুড়ানো হয়েছে বলে নিজেই নিজের ঢাক পেটাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে সেই কাঁচাপাকা আধাপাকা পোকাধরা তেঁতুলগুলো খেয়ে আমরা বাড়ি ফিরে আসি।
বাড়ি এলেও কিন্তু আমার মন থেকে ঐ তেঁতুলকুড়ানোর ভাবনাটা গেলোনা তখনো। সেদিন শেষরাতে আমার প্রাকৃতির ডাক পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। আমি তখন বাথরুমে গিয়ে কাজ সেরে আসার সময় ভেন্টিলেটর দিয়ে বাইরের কিছুটা আলো দেখতে পাই। তখন আমার মাথায় গতকালকের তেঁতুল কুড়ানোর কথাটা আসে! তখন আমি ভাবলাম এসময় যদি আমি ডাক্তারবাড়ির তেঁতুলতলায় চলে যাই তাহলে সবার চেয়ে বেশি কুড়ানো’র রেকর্ডটা আমার ভাগেই চলে আসবে!
যেই ভাবা সেই কাজ। আমি চলে গেলাম সেই নীরব-নিস্তব্ধ রজনীতে কচিপায়ে হেঁটে ডাক্তারবাড়ির দিকে। যেতে যেতে তখন মাঝেমধ্যে অবশ্য আমার শরীর শিউরে উঠছিলো! কেন যেন মনে হচ্ছিলো কোন ঠান্ডা হাওয়ার একটা স্রোত যেন প্রবলবেগে আমার শরীরের একপাশ দিয়ে ঢুকে আবার অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি সেটাকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে যখন তেঁতুলতলায় পৌঁছে যাই তখন আমার আনন্দ আর দেখে কে! কেননা সেসময় অনেক কাঁচাপাকা তেঁতুল পড়েছিলো গাছটির নিচে। আর এখন তো এখানে মিজান, জুবের, মণিভাই কিংবা রুম্মান কেউই নেই। আমি একাই এখানে! মনের খুশিতে আমি তেঁতুল কুড়াতে শুরু করে দেই।
আমার পরনে ছিলো হাফপ্যান্ট ও ফ্রক। প্যান্টের দু’দিকে ও পিছনে দুটি করে মোট চারটি পকেট ও ফ্রকের সামনের দিকেও একটি বড় পকেট ছিলো। সবগুলোই একসময় তেঁতুলফলে ভর্তি হয়ে গেলে আমি আনন্দে নেচে উঠলাম। আজ সবাইকে দেখানো যাবে যে কে বেশি তেঁতুল কুড়িয়েছে! কি মজা ইয়াহুহ! এমন সময় আমি দেখতে পাই একটি ছোট্ট ছেলে স্থিরপায়ে দাঁড়িয়ে অনেকটা বাতাসে ভেসেই আমার দিকে এগিয়ে আসছে! আমি ভাবলাম সেও বুঝি আমার মতোই এখানে তেঁতুল কুড়াতে এসেছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় ছেলেটা না হেঁটে শুধু হাওয়ায় ভেসে এগিয়ে আসছে কিভাবে! এও কি সম্ভব! আর যদি তাই হয় তবে আমি কেন এভাবে ভেসে আসতে পারিনা?ওটা জানলে কি আর এ দুই কিলোমিটার পথ কষ্ট করে পায়ে হেঁটে আসতাম!
যাই হোক- সেই ছেলেটি তখন আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে- ‘এই মেয়ে তুই কি বাঘকে ভয় পাস?’ আমি তার কথা শুনে অহংকারের সাথে বলে উঠি -না? আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না। আসলে একথা অনেকের মুখে শুনতাম তো তাই শুনে শুনে আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো কথাটা। আর সে কথাই আমি ঐ হাওয়ায় ভাসা ছেলেকে শুনিয়ে দিয়েছিলাম। তাকে একথা বলে আমার পায়ের কাছ থেকে আরেকটি বড়সড় তেঁতুল কুড়িয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখি হাওয়ায় ভাসা ছেলেটি বেমালুম হাওয়া হয়ে গেছে! কিন্তু এখান থেকে এতো তাড়াতাড়ি ও যাবেই বা কোথায়!নাকি হাওয়ায় ভাসা মানুষরা মুহূর্তের মধ্যে সরেও যেতে পারে!
তবে আমি এ নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে ফের তেঁতুল কুড়াতে মন দিই। তেঁতুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে সেই লম্বা গাছটির মগডালের দিকে তাকাতে দেখতে পাই একটি বিশাল আকৃতির বাঘ খাড়া গাছ বেয়ে আমার দিকেই নেমে আসছে। কিন্তু ঐ বাঘটি গাছটির উল্টোদিকে হেঁটে আসবে কিভাবে! যদি পা পিছলে নিচে পড়ে যায় তবে সে কি আর জ্যান্ত থাকবে নাকি? কিন্তু আমি তখনো জানতামই না যে ওটা আসলে সত্যিকারের কোন বাঘই নয়! এটা হচ্ছে সেই জিনিস যেটার কথা আমরা গল্পে শুনি, আর শুনলেও বাস্তবে তেমন পাত্তাই দিই না! সেটি হচ্ছে- অশরীরী!!! ডোরাকাটা সেই বাঘকে দেখে আমি ভয়ে অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে আবারো ফলকুড়াতে লেগে যাই। সেখান থেকে ভয়ে ভয়ে গাছটির দিকে একবার তাকাতেই দেখি বাঘটি আর সেখানে নেই!
ততক্ষণে আমারও তেঁতুল কুড়ানো প্রায় শেষ। ফ্রক ও প্যান্টের সবগুলো পকেটই কানায় কানায় ভরে গেছে। তাই ভাবলাম এখন চলে যাই নচেৎ এতক্ষণে ডাক্তারবাড়ির লোকেরা যদি জেগে যায় তো দেখে ফেলবে আমাকে! আর তখন যদি আব্বুর কাছে নালিশ করে দেয় তবে কি আর আব্বু আমাকে আস্ত রাখবে! বলে রাখা ভালো তখন এলাকায় আমার আব্বুর যতেষ্ঠ নাম-যশ ছিলো। আব্বু জানলে আমার পিঠে আস্ত কাঠের চেল্লাই ভাঙবে। এই ভেবে যেই না বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি তখন হঠাৎ আমার কানে ভেসে এলো মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠের আযান!
ফযরের আযান এখন পড়ছে! আমি চমকে উঠে ভাবি এতোক্ষণ পর কেউ কি আযান দেয়? এখন তো প্রায় ভোরের আলো ফুটে উঠলো বলে!
হঠাৎ কোন অদৃশ্য শক্তি আমার মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরলো। আমি দেখতে পেলাম আকাশের ফুটফুটে রূপালী পূর্ণিমা চাঁদটাকে! তার মানে ভেন্টিলেটরে আমি যে আলো দেখেছিলাম সেটা ছিলো এই চাঁদের আলো! আর আমি ওটাকেই ভোরের আলো ভেবে এই মধ্যরাতে দুই কিলোমিটার দূরের এই তেঁতুলতলায় একা একাই চলে এসেছি!! ও ও মাগোও… বলে ভয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে সেই তেঁতুলগাছের নিচে পড়ে যাই। এভাবে কতক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম আমার মনে নেই। যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন অনেকটা ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। আর তখন আমার মনে পড়লো মাঝরাত্রির কথা যখন আমি রাতের চাঁদনীকে দিনমণির আলো ভেবে মধ্যনিশিতে এই ভূতুড়ে জায়গায় একা একাই হেঁটে হেঁটে চলে এসেছিলাম!
ভাবতেই আবারো আমার সারা গাঁ ভয়ে কাটা দিয়ে উঠলো! এই নির্জন ভৌতিক পরিবেশে ভয় ও আতংকে গাঁ-টা যেন ছমছম করে উঠলো আমার! আর তখন বুঝলাম যে আমার শুনা ঐ আযানটিই ছিলো আসলে ফযরের প্রথম আযান। আমার জানা ছিলোনা যে, সেদিনের ঐ রাতটি ছিলো একটি চাঁদনীরাত! না,শুধু চাঁদনীরাত বললে ভুল হবে ওটা ছিলো একটি “ভূতুড়ে চাঁদনীরাত”!