তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। সেদিন কোচিং শেষ করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। বাড়িতে এসেই বেশ অবাক হলাম। কারণ বাবা ঘরের এক কোণে মন খারাপ করে বসে ছিলো। মা ও মন খারাপ করে ব্যাগ খুছাচ্ছিলো। আমার ছোট বোনটাও চুপচাপ বসে ছিলো। অনেকটা কৌতুহল হয়েই মাকে প্রশ্ন করলাম:
-কী হয়েছে মা? সবাই চুপ চাপ বসে আছে কেনো?
মা বললো, গ্রাম থেকে আমার জেঠা নাকি একটু আগে বাবাকে কল দিয়ে জানিয়েছেন যে আমার দাদা খুব অসুস্হ্য। ডাক্তার বলেছেন হয়তো বড়জোড় কাল সকাল পর্যন্ত বাঁচবেন। দাদা শেষবারের মতো একবার বাবাকে দেখতে চেয়েছেন। তারপর মা আমাকে বললেন আমাকেও ব্যাগ গুছিয়ে নিতে। একটু পরেই আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো। এরপর আমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। আমার মনটা ও বেশ খারাপ ছিলো কারণ বাবাকে এতোটা মন খারাপ করতে এর আগে কখনো দেখিনি। বলে রাখা ভালো আমার নাম মাসুদ। আমরা শহরেই থাকি। আমার দাদার বাড়ি চাঁদপুর। তবে আমার বাবা তার ১৬ বছর বয়সেই গ্রাম থেকে এখানে চলে আসেন। এরপর কয়েক বছর পর পর একবার করে গ্রামে যায়।
আমাদেরও তাই খুব একটা গ্রামে জাওয়া হয় না। আজো আমাদের জাওয়া হতো না যদি না দাদা অসুস্হ্য হতেন। এরপর জামাকাপড় গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতে প্রায় রাত ৮টা বেজে গেলো। আমরা একটা ডাইরেক্ট গাড়িতে উঠলাম।গাড়ি সরাসরি গিয়ে চাঁদপুরের বিরামপুর বাজারে থামবে। সেখান থেকে আমার দাদার বাড়িতে রিক্সায় যেতে সর্বচ্চ আধা ঘন্টা সময় লাগে। আমাদের গ্রামের নাম হাঁইমচর। যদিও জীবনে এই পর্যন্ত মাত্র ৪ বার গ্রামের বাড়িতে জাওয়া হয়েছে। গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে প্রায় রাত ১০ টা বাজলো। বাবা বললেন ৬ ঘন্টা পর আমরা বিরামপুর বাজারে পৌছাবো। অর্থাৎ ভোর ৪ টায়। এরপর সাড়ে চারটার মধ্যে আমরা দাদার কাছে পৌছে যাবো।
সবই ঠিক ছিলো। তবে চার ঘন্টা গাড়ি করে যেতেই রাত ২ টায় হঠাৎ গাড়িটা মাঝরাস্তায় থেমে গেলো। গাড়িতে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ গাড়িটা থেমে জাওয়ায় সবাই একসাথে ঘুম থেকে উঠে গেলো। এরপর কন্টাক্টার আমাদের বললো গাড়ির ইন্জিনে নাকি সমস্যা হয়েছে। কাল সকালের আগে কিছুই করা যাবে না। সারারাত আমাদের এখানেই থাকতে হবে। কথাটা শুনে সবাই রেগে গিয়েছিলো। তবে আমার বাবা একটু বেশিই রেগে গিয়েছিলো। কারণ দাদা অসুস্হ্য আর তাই আমাদের কাল সকালের আগেই দাদার কাছে পৌছাতে হবে। এরপর কোন্টাক্টর এর সাথে বাবা কিছুক্ষন রাগারাগি করার পর বুঝতে পারলেন যে রেগে কোন লাভ নেই কারন তাদেরো এখন কিছুই করার নেই। বাবা কিছুক্ষন চুপচাপ বসে ছিলেন। এরপর কন্টাক্টারকে প্রশ্ন করলেন:
-আচ্ছা রাতের মধ্যে হাঁইমচরে জাওয়ার অন্য কোন রাস্তা কী নেই? আমাকে সকালের আগেই সেখানে পৌছাতে হবে। আমার বাবা খুব অসুস্থ্য। কন্টাক্টার বললো যে:
-না। আর কোন রাস্তা নেই। আপনাকে কাল সকাল পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে। বাবা আরো চিন্তীত হয়ে পড়লেন। এরপর বাসের একজন যাত্রী হঠাৎ বাবাকে বললো:
-একটা উপায় রয়েছে সেখানে জাওয়ার। বাবা অনেকটা উত্তেজনার সাথেই বললো:
-কী উপায়? কিভাবে যেতে পারি? প্লিজ বলুন। এরপর লোকটা বাবাকে বললো:
-এইখান থেকে মাইল তিনেক দুরে হবে একটা নদী রয়েছে। নদীটার নাম বিতর্ক নদী। সেই নদী পার হলেই দাসপাড়া গ্রাম। আর দাসপাড়া গ্রাম পার হলেই বিরামপুর বাজার। সেখান থেকেই আপনি চাইলে চলে যেতে পারেন। লোকটার কথা শুনে কিছুটা স্বঃস্তি পেলো বাবা। থাক! তাওতো একটা উপায় পাওয়া গেলো। জায়গা গুলোর নাম বাবার বেশ পরিচিত মনে হচ্ছিলো। হয়তো ছোটবেলায় নাম শুনেছে কিন্তু কখনো জাওয়া হয়নি তার। তবে লোকটার কথা শুনে কন্টাক্টার বেশ রেগে যায়। রেগে গিয়ে কন্টাক্টার বাবাকে বলে:
-আপনি কী পাগল হয়ে গিয়েছেন যে এতোরাত্রে বউবাচ্চা নিয়ে ঐদিকে যাবেন?!! আপনার মনে ভয় বলে কিছু নেই? বাবা ভাবলো হয়তো সেখানে চোর ডাকাতের ভয় আছে। তাই বাবা কন্টাক্টারকে বললো:
-কেনো ভাই? চোর ডাকাত বেশি আছে নাকি সেখানে?
-মানুষ থাকলেতো চোর ডাকাত থাকবে।
সেটা ভুতের এলাকা। সেখানে নাকি এখনো মৃত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। (কন্টাক্টার ) ভুতের কথা শুনে আমি কিছুটা হেসেই ফেললাম। আমরা শহরে থাকি। তাই আমরা মোটেও প্রেতাত্মা বা অশরীরীতে বিশ্বাস করি না। এরপর তাদের কথা না শুনে বাবা বললেন: – আমাকে যে করেই হোক রাতের মধ্যে সেখানে পৌছাতেই হবে। কারণ আমার বাবা খুবই অসুস্হ্য। তবে ভুতে বিশ্বাস না করলেও গ্রামে যে চোর ডাকাত থাকতে পারে সেটা অবিশ্বাসের কিছু নেই। তাই বাবা আমার মা আর ছোটবোনকে বললো:
-তোমরা গাড়িতেই থাকো। সকালে গাড়ি ঠিক করে বিরামপুর বাজারে পৌছালে একটা কল করে দিও। আমি আর মাসুদ রাতেই বিতর্ক নদী দিয়ে বিরামপুরের উদ্দেশ্যে চলে যাই। যেই কথা সেই কাজ। বাবা শুধু তার মোবাইল,কিছু টাকা আর আমাকে নিয়েই বিরামপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। মূল্যবান জিনিসগুলো গাড়িতে মায়ের কাছেই রেখে আসলাম। কারণ গ্রামীন রাস্তা মোটেও নিরাপদ না। এরপর আমরা পায়ে হেটেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। কিছুটা দুর জাওয়ার পরেই একটা পায়ে চালিত রিক্সা ভ্যান দেখতে পেলাম। ভাবলাম যাক! কপালটা মনে হয় ভালোই। এরপর ভ্যানচালক আমাদের দেখেই আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। এরপর আমাদের প্রশ্ন করলো:
-বাবুরা কই যাইবেন? বাবা বললেন:
-এইতো এই গ্রাম দিয়ে বিতর্ক নদী পর্যন্ত যাবো। ভাড়া কতো নিবেন?
বাবার কথা শুনে লোকটা কেমন যেনো আৎকে উঠলো। এরপর অবাক দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আবার বাবার দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে আর কিছু না বলে তার ভ্যানটা নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো। আমি আর বাবা কিছুই বুঝলাম না। আমরা অবাক হয়ে তার চলে জাওয়া দেখছিলাম। তার এমন করার কারণটা কিছুতেই মাথায় আসছিলো না। এরপর বাবা আমাকে বললো
-চল পায়ে হেঁটেই গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে থাকি। কিছু না কিছুতো পেয়েই যাবো। এরপর আমরা দুজনেই হাঁটতে থাকি গ্রামের রাস্তায়। তখন রাত হলেও আকাশে পুরো চাঁদটা ছিলো তাই আমাদের হাঁটতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। কিছুটা পথ হাঁটার পর হঠাৎ আমাদের দৃষ্টি গেলো একটা মোটর বাইকের দিকে। একটা ছেলেকে দেখতে পেলাম মোটর বাইকের আয়নায় তাকিয়ে তাকিয়ে তার দাত খিলি করছিলো। আমরা দুজনেই ছেলেটাকে দেখে বেশ খুশি হলাম। এরপর বাবা ছেলেটার কাছে গেলো এবং ছেলেটাকে আমাদের সমস্যার কথা বললো। বললো যে, আমাদের গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে এদিকে আমার দাদাও খুব অসুস্হ্য। যেকরেই হোক আমাদের কাল সকালের আগেই হাঁইমচরে পৌছাতেই হবে। এরপর বাবার কথা শুনে ছেলেটা কিছুটা মুচকি হেসে বললো:
-আপনারাতো আমার গাঁয়েরই মেহমান। চলেন আপনাদের আমিই বিতর্ক নদী পর্যন্ত পৌছাইয়া দিয়া আসি। ছেলেটার কথা শুনে আমরা দুজনেই বেশ খুশি হলাম। যাক! তাওতো একটা উপায় পাওয়া গেলো। এরপর মোটর সাইকেলে করে আমরা বিতর্ক নদীর উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। আমি চুপচাপ বসেই ছিলাম। বাবা আর সেই ছেলেটার মধ্যে কথা হচ্ছিলো। বাবা ছেলেটাকে প্রশ্ন করলো:
-আচ্ছা আপনাদের এই গ্রামের নামটা কী? (বাবা)
-পলানপাড়া গাঁও। (ছেলেটা )
-আচ্ছা আপনাদের গ্রামের নাম শুনে সবাই এতো ভয় পায় কেনো? একটা ভ্যানচালকো এখানে আসতে চাইলো না।
-আর বইলেন না কাকা। আমাদের জিবন্ত গাঁও টারে মানুষরা মাইরা ফেলতেছে। আমাদের গ্রামের সব মানুষ শহরে চলে যাইতেছে। গাঁয়ে মানুষ নাই বললেই চলে। আমাদের এলাকাটা অনেক নির্জন। তাই লোকে বলে এখানে নাকি ভুত থাকে। আর আমাদের গ্রামের নামে বদনাম ছড়ায়।
-তা বাবা তোমার নামটাতো জানা হলো না?
-আমার নাম আলী মাদবর। আমার বাবার নাম ওসমান মাদবর। আমার বাবা এই এলাকার মেম্বার।
-ওহ অনেক ভালো। বাবা এবং ছেলেটার মধ্যে কথা হতে হতেই খুব দ্রুত আমরা বিতর্ক নদীর কাছে পৌছে গেলাম। এরপর ছেলেটা আমাদের বললো:
-ঐখানে নদীর দিকে দেখেন কোন মাঝিরে পান কিনা। আমার একটা জরুরী কাম আছে। আমি চইলা যামু। তবে সাবদানে যাবেন। এই বিতর্ক নদী আর ঐপাশের দাসপাড়া গাঁওটা খুব একটা ভালো না। এরপর ছেলেটা আমাদের ধন্যবাদ বলারো সুযোগ দিলো না। খুব দ্রুত বাতাসের বেগে চলে গেলো সে। এরপর আমরা বিতর্ক নদীর এপার থেকে ওপারে তাকিয়ে কেউ আছে কিনা দেখতে লাগলাম। তবে কাউকে দেখতে পেলাম না। এরপর হঠাৎ আমরা একটা ছোট নৌকা দেখতে পেলাম কিছুটা দূরে। তবে নৌকার আশেপাশে কেউ ছিলো না। এরপর আমরা নৌকার কাছাকাছি গেলাম। কাউকে দেখতে না পেয়ে বাবা জোড়ে শব্দ করে বলছিলো:
-এখানে কেউ আছেন? এই যে এই নৌকা কার? আমাদের দাসপাড়া যেতে হবে। কেউ আছেন এখানে? তবে বাবার কথার উত্তর কেউ দিলো না। তার মানে আশেপাশে কেউ নেই। মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ করে নৌকার পাশের পানি কিছুটা নড়তে থাকলো। আমি আর বাবা দুজনেই হঠাৎ পানি নড়তে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর পানির নিচ থেকে হঠাৎ একটা বৃদ্ধ লোক উঠে আসলো। লোকটার পড়নে ছিলো শুধু একটা লুঙ্গী আর একটা ছ্যাড়া গেন্জী। বাবা বেশ অবাক হয়ে লোকটাকে প্রশ্ন করলো:
-কে আপনি? আর এতোরাতে পানির নিচে কী করছিলেন? লোকটার মুখে একটা মায়াভরা মিষ্টি হাসি লেগেছিলো। তবে তার কন্ঠটা বেশ ধীরো আর গম্ভীর ছিলো। সে হাসি মুখেই গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো:
-জ্যাঁ । আমার নাম নয়ন মাঝি। সারাদিন নৌকা চালাইয়া হয়রান হইয়া গেছিলাম। তাই একটু পানির নিচে ডুব দিছিলাম। তয় এতোরাইতে আপনারা এইখানে কী করেন? কই যাইবেন?!
-আসলে আমাকে সকাল হওয়ার আগেই হাঁইমচরে পৌছাতে হবে। আমার বাবা খুব অসুস্হ্য। সে শেষবারের মতো একবার আমাকে দেখতে চেয়েছেন। আপনি আমাদের দাসপাড়া পর্যন্ত দয়া করে দিয়ে আসুন।!!
-বিতর্ক নদী পার হইলেইতো দাসপাড়া গাঁ। এতো রাইতে ঐখানে জাওয়া কী ঠিক হইবো? গ্রামটা তেমন ভালা না।
– সেটা আমরা দেখে নিবো। আপনি দয়া করে আমাদের নিয়ে চলুন।
-এতোরাত্রে আমি নৌকা চালাইনা।
তয় আপনার যখন বাবা অসুস্হ্য তাই বাধ্য হইয়াই যাইতাছি। নৌকায় উইঠা পড়েন। এরপর আমি আর বাবা দুজনেই নৌকায় উঠে পড়ি। এরপর নয়ন মাঝি দাসপাড়ার উদ্দেশ্যে নৌকা চালানো শুরু করেন। তবে নয়ন মাঝিকে দেখে কেনো জানি আমার বেশ ভয় করছিলো। তার একটা ব্যাপার আমি ঠিক বুঝলাম না। সে একটু আগেও পানির নিচে ছিলো। এরপর সে তার জামা-কাপড় পাল্টায়নি। কিন্তু এখন তার জামা দেখে মনে হচ্ছে একদম শুকনা। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব!! ব্যাপারটা বাবা লক্ষ করেনি। তাই সে স্বাভাবিকই ছিলো। কিছুক্ষন পর বাবা হঠাৎ করে মাঝিকে প্রশ্ন করে:
-আচ্ছা এই নদীটার নাম বিতর্ক নদী কেনো দেওয়া হয়েছে?
-এইটা একটা বড় গল্প।
এই নদীটা দাসপাড়া আর পলানপাড়ার মাঝখানে আছিলো। তাই দুই গ্রামের লোকেরা সব সময় ঝগড়া করতো যে নদীটা কাগো?! একদিন এক সভা ডাকা হয় নদীটা ভাগ করে দেওয়ার জন্য। তয় সেখানে সবার মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে নদীটা নিয়া। এরপর বিচারক বললো, যে নদীটা কোন গাঁয়েরই না। নদীটা দুই গাঁয়ের মানুষেরা সমান ভাবে ব্যবহার করতে পারবে। তয় নদীটা নিয়া এতো বিতর্ক হওয়ায় নদীটার নামই বিতর্ক নদী দেওয়া হয়।
-ওহ খুব ভালো একটা নাম।
-আইচ্ছা? বিতর্ক নদীতো শহরের রাস্তা থিকা অনেক ভেতরে? এতো রাইতে আপনারা এইখানে আইলেন কেমনে? পায়ে হাঁইটা?!
-আর বলবেন না ছেলেকে নিয়ে সেই বিপদে পড়েছিলাম। এরপর ঐ গ্রামেরই একটা ছেলে মোটর সাইকেল করে আমাদের এই বিতর্ক নদী পর্যন্ত পৌছে দিয়ে গেলো।
– এতো রাইতে মোটর সাইকেল ওয়ালা ছেলে!!? নাম কী তার?
-কি যেনো নাম!? ও! হ্যাঁ। মনে পড়েছে। আলী মাদবর নাম তার।
তার বাবার নাম নাকি ওসমান মাদবর। তার বাবা নাকি পলানপাড়ার মেম্বার। বাবার কথা শুনে নয়ন মাঝি যেনো আকাশ থেকে পড়লো এমন ভাব নিলো! সে বৈঠা চালানো বন্ধ করে দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো:
-কী কন মিয়া এইসব? ওসমান মাদবরের পুলা আলীতো মারা গেছে ৩ বছর হইবো। ও আপনাদের নিয়া আইবো কেমনে??! লোকটার কথা শুনে আমরাতো পুরোই অবাক হয়ে গেলাম। লোকটা কি বলছে!!? এটা কী করে হতে পারে? একটা মৃত ছেলে কী করে আমাদের এই পর্যন্ত মোটর সাইকেলে করে নিয়ে আসতে পারে?!! বরং আমাদের এই মাঝিকেই পাগল বলে মনে হচ্ছিলো। কী উল্টাপাল্টা কথা বলছে! মৃত মানুষ আবার দেখা যায় নাকি!!? এরপর বাবা আর কিছু বললো না। বাবার মনে হচ্ছিল মাঝিটা পাগল। মাঝিও চুপচাপ নৌকা চালাতে লাগলো। এরপর মাঝি একবার বলেছিলো:
-তয় হুনা যায় মাঝেমধ্যে নাকি ঐ এলাকার মরা মানুষগুলার আত্মাগুলা দেখা যায়। তবে তার কথাগুলো আমাদের কাছে অনেকটা পাগলের প্রলাপের মতোই লাগে। তাই আমরা আর কোন উত্তর দেইনি। আমাদের উত্তর না পেয়ে মাঝিও আর কথা না বলে নৌকা চালাতে থাকে। এর কিছুক্ষন পরেই আমরা দাসপাড়ায় পৌছে যাই। এরপর নৌকা থেকে নেমে মাঝিকে যেই টাকা দিতে যাবো হঠাৎ আমাদের দিকে কে যেনো লাইটের আলো ধরলো। আমি আর বাবা বেশ অবাক হয়ে যাই। এখানে আবার কে এলো!!? এরপর একজন বৃদ্ধ লোককে দেখতে পাই আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। এরপর বাবাকে প্রশ্ন করলো:
-কে আপনারা? এতোরাত্রে নদীর পারে কী করতাছেন? এরপর বাবা বললো যে:
-আমরা পলানপাড়া থেকে নৌকা করে বিতর্ক নদী দিয়ে এখানে এসেছি। বৃদ্ধ লোকটা কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো:
-কী কন মিয়া? এতো রাত্রে আপনি এই মরা নদীতে মাঝি আর নৌকা পাইবেন কই? এরপর বাবা যেই আঙুল দিয়ে ইশারা করে সেই নয়ন মাঝির নৌকাটিকে দেখাতে গেলো, হঠাৎ আমরা তাকিয়ে দেখি একুল ওকুলে কোন নৌকার আসারো চিহ্ন নেই। আমরা চমকে গেলাম। নৌকাটা এতো দ্রুত কী করে চলে গেলো?! এরপর লোকটা বাবাকে আবার প্রশ্ন করলো:
-আচ্ছা! মাঝির নাম কী ছিলো?
-নয়ন মাঝি?
-পাগল হইছেন? তিনিতো মারা গেছেন
৩ বছর হইছে। বৃদ্ধ লোকটার কথা শুনে আমি আর বাবা দুজনেইতো পুরো অবাক হয়ে গেলাম। এরপর বাবা বৃদ্ধ লোকটাকে সব কথা খুলে বললেন। সেই গাড়ি নষ্ট হওয়া, মোটরবাইকের আলী মাদবর আর বিতর্ক নদীর নয়ন মাঝির সব কথা খুলে বললেন বাবা তাকে। বাবার কথা শুনে লোকটা বাবাকে বললো:
-এ যাত্রার তাঁর দোয়ায় বেঁচে গেছেন। ঐ পলানপাড়া আর বিতর্ক নদীতে দিনের বেলাতেই কেউ যেতে সাহস পায় না। আজ থেকে ৩ বছর আগে আমাদের এই দিকে এক ভয়ানক বজ্যপাত হয়। সেই বজ্যপাতে পলানপাড়ার সবমানুষ মারা যায়। আলী মাদবর আর নয়ন মাঝিও তখন মারা যায়। শুনা যায় তাদের আত্মা নাকি এখনো রাতে দেখা যায়। লোকটার কথা শুনে আমরা যেনো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। তার কথা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না আমাদের। আমরা দুটো মৃত মানুষের সাহায্য নিয়ে এখানে এসেছি এটা বিশ্বাস করার মতো কোনো কথা না। কিন্তু তখন তার কথা শুনা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমাদের। কারণ এই এলাকার আর কাউকে আমরা চিনি না। লোকটা আমাদের রাতে তার বাড়িতে থেকে যেতে বললেন। তবে বাবা বললেন যে সকালের আগেই তাকে হাঁইমচরে পৌছাতেই হবে । তাই আর দেরী করতে পারবে না। এরপর লোকটা বাবাকে বললো
-চলুন তাহলে আপনাদের বিরামপুর বাজার পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসি। এরপর লোকটা আমাদেরকে নিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। এর মধ্যেই আমরা লোকটার নাম জানতে পারি। লোকটার নাম ছিলো মজিদ বেপারী। আমরা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর কিছুটা দুরে অনেক আলো দেখতে পেলাম আর গাড়ির শব্দও শুনতে পেলাম। বুঝলাম যে আমরা বিরামপুর বাজারের কাছাকাছি চলে এসেছি। এরপর লোকটা বললো:
-সামনেই বিরামপুর বাজার। আপনারা চলে যান তাহলে। আমাকে বাড়িতে ফিরতে হবে। এরপর লোকটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সামনের দিকে চলতে লাগলাম। বাবা আর পিছনে না তাকিয়েই চলতে লাগলো। আমি বৃদ্ধ লোকটাকে আবার একবার দেখার জন্য যেই পিছনে তাকালাম হঠাৎ আমার মনে হলো যে লোকটা বাতাসে মিলিয়ে গেলো। কিন্তু একটা লোক কিভাবে বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে!! ভাবলাম হয়তো আমার দেখার ভুল ছিলো। এরপর আমরা বিরামপুর বাজারে পৌছালাম। আমাদের মনে হচ্ছিলো হয়তো ঐ গ্রামের সব লোক গুলোই পাগল। কী অদ্ভুত কথা বলছিলো তারা। বাজারে রিক্সা পেতে কষ্ট হলো না আমাদের। এরপর আমরা একটা রিক্সা নিয়ে হাঁইমচরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
এরই মধ্যে আম্মু কল দিয়ে জানিয়েছে যে আমাদের সেই বাসটা ঠিক হয়েছে। আর ২ ঘন্টা পরে তারাও বিরামপুর পৌছে যাবে। এরপর অবশেষে আমরা হাঁইমচরে পৌছালাম। বাবা খুব টেনশনে ছিলেন। কারণ তিনি জানেন না যে দাদা কী অবস্হায় আছেন। বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। এরপর আমরা দুজনেই বেশ ভয়ে ভয়ে দাদা বাড়িতে ঢুকলাম। তবে ঢুকে যা দেখলাম আমরা পুরোই অবাক হয়ে গেলাম। আমরা দেখলাম দাদা আর জেঠা পুকুরের পারে ওজু করছিলো। দাদাকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছিলো না যে সে অসুস্হ্য। দাদা হঠাৎ করে বাবাকে দেখে বেশ খুশী হলেন। দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বলতে লাগলো, কেমন আছিস রে বাবা?! এরপর জেঠাও অনেক খুশি হলো। জেঠা বাবাকে প্রশ্ন করলো:
-কিরে হঠাৎ কিভাবে তোর গ্রামের কথা মনে পড়লো? জেঠার কথা শুনে বাবা বেশ অবাক হয়ে গেলেন। বাবা বললো:
-তুই ইতো আমায় কল দিয়ে বললি যে বাবা নাকি খুব অসুস্হ্য। শেষবারের মতো একবার আমাকে দেখতে চায়। বাবার কথা শুনে জেঠা আর দাদা দুজনেই বেশ অবাক হয়ে যায়। জেঠা অবাক হয়ে বাবাকে বলে:
-তুই মজা করছিস? আমি আবার তোকে কবে কল দিলাম?
জেঠার কথা শুনে বাবা আরো বেশি অবাক হয়ে গেলো। এরপর নিজের মোবাইল বের করে যেই জেঠাকে দেখাতে গেলো যে গতকাল বিকালে জেঠা কল দিয়েছিলো, বাবা আরো বেশি অবাক হলো। কারণ বাবার মোবাইলে দেখাচ্ছিলো গতকাল বিকালে কোন নাম্বার থেকে কলই আসেনি। বাবা পুরোই অবাক হয়ে গেলো। আমিও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এরপর দাদা প্রশ্ন করলো যে আমার আম্মু আর ছোটবোন কোথায়! এরপর বাবা সব ঘটনা দাদাকে আর জেঠাকে খুলে বললো। মোবাইলে কল আসা থেকে এই পর্যন্ত পলানপাড়া, বিতর্ক নদী, দাসপাড়া, আলী মাদবর, নয়ন মাঝি, মজিদ ব্যাপারী সহ সবার কথা তাদের বললো। জেঠা আর দাদা বাবার এই কথা শুনে দোয়া দরুদ পড়া শুরু করে দিলেন আর আমাদের ফু দিতে লাগলেন। এরপর দাদা যা বললেন:
-আল্লাহ তোদের বাঁচিয়ে এনেছে রে। নাহলে রাতে কেউ ঐ গ্রামে ঢুকলে আর বেঁচে ফিরতে পারে না। আজ থেকে ৩ বছর আগে একটা বিশাল ঝড় হয় এবং প্রচুর বজ্যপাত হয়। সেই বজ্যপাতে পলানপাড়া এবং দাসপাড়ার সব মানুষ মারা যায়। সেখানে কেউ আর বেঁচে নেই। আলী মাদবর, নয়ন মাঝি ও মজিদ ব্যাপারীও তাদের পুরো পরিবার নিয়ে মারা যায়। এরপর থেকে গ্রামদুইটা অভিশপ্ত হয়ে যায় এবং সেই বজ্যপাতে যারা মারা গেছে তাদের আত্মাগুলোকেও রাতে সেখানে দেখা যায়। দাদার কথা শুনেতো আমরা আরো অবাক হয়ে গেলাম। তারমানে আমরা গতরাত পুরোটা মৃতগ্রামে মৃত মানুষগুলোর সাথে কাটিয়েছি?! পলানপাড়ার মোটরসাইকেলের সেই আলী মাদবর, বিতর্ক নদীর নয়ন মাঝি এবং এরপরে সেই মজিদ ব্যাপারীও প্রেতাত্মা ছিলো।
আমি আর বাবা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর সেই সকল মুহুর্ত, মানুষগুলো আর তাদের চেহারার কথা মনে করতেই ভয়ে আমাদের শরীর শিহরে উঠছিলো। এরপরেই দাদা আর জেঠা আমাদের ঘরে নিয়ে গেলো। আমরা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। এরপরেই আমার আম্মু এবং ছোট বোনও গ্রামে এসে পৌছালো। তাদের কোন সমস্যা হয়নি। এরপর সারাদিনটা আমাদের স্বাভাবিক ভাবেই কাটলো। রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই কান্নার শব্দ পেলাম। এরপর জানতে পারলাম যে হঠাৎ আজ রাতেই আমার দাদা মারা গেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তার মৃত্যু হয়েছে।
কিন্তু তার মৃত্যুর একদিন আগেই সেই পিশাচ_গ্রামের_আহ্বানে কেনো আমরা এখানে ছুটে এলাম এর উত্তরটা আমাদের কাছে রহস্যই থেকে গেলো। কেনোই বা বাবার নাম্বারে অদৃশ্য কল এসেছিলো, কেনোই বা গাড়িটা সেখানে নষ্ট হয়েছিলো তার উত্তরটাও আমাদের কাছে রহস্যই থেকে গেলো। পলানপাড়া, বিতর্ক নদী, দাসপাড়া গ্রাম এইগুলোও আমাদের কাছে আরো বড় রহস্য হয়ে থাকলো। সেই একটা রাত পুরোটাই আমাদের কাছে একটা বড় রহস্য। তবে রহস্যের কোন সমাপ্তি বা উত্তর পাওয়া যায় না।