সভা শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেলো।আমার থাকার জন্য যে বাড়িটা ঠিক করা হয়েছে সেটা সেই বাড়িটা শহরের বাইরে ডাকবাংলোয় কর্মকর্তাদের একজন আমাকে মোটর দিয়ে পৌছে দিতে গেলেন,কিন্ত পথেই বিপত্তি ঘটলো, শহর ছাড়িয়ে একটু দুরে যেতেই মোটর টা বিকল হয়ে গেলো আধঘন্টা ধরে অনেক চেষ্টা করেও মোটর টা চালু করা গেলো না।ঘড়িতে রাত তখন ১১:১০বাজে কর্মকর্তা বললেন এ ত মহাবিপদ হলো দেখছি,এক কাজ করা যাক। সামনেই নবাব বাহাদুরের বাড়ি,রাত টা না হয় এখানেই কাটানো যাক।
ফিকে চাদের আলোয় বিরাট অট্রালিকায় অস্পষ্ট কাঠামো দেখা গেলো,মস্ত বড় লোহার ফটক। কর্মকর্তা ফটকের এপার থেকে চিৎকার শুরু করলেন,দারোয়ান দারোয়ান?অনেক্ষন ডাকার পর এক আধবুড়ো দারোয়ান এসে দাড়ালো, কর্মকর্তাকে চিনতে পেরে সালাম দিলো।কর্মকর্তা বললেন,নীচের দুটো ঘর খুলে দাও,মোটর খারাপ হয়ে গেছে,আমরা রাত টা এখানেই কাটাবো।দারোয়ান বিড় বিড় করে কি যেনো বললো,তারপর কোমরে বাধা চাবির গোছা থেকে চাবি বের করে ২টা ঘর খুলে দিলো।একটা ঘরে আমি আর অন্যটায় কর্মকর্তা,আর এক ড্রাইভার।ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম যে ঘরটা রীতিমত ঝাড়পোছ করা হয়। কোথাও কোন ময়লা আবর্জনা নেই। উচু খাট,তার উপর পরিস্কার বিছানা আর অনেক সুন্দর দুটো বালিশ।
সারারাত বাতি জ্বেলে ঘুমানোর অভ্যাস আমার,অন্ধকারে ঘুমাতে পারিনা আমি।কম পাওয়ারের নীলাভ বাতি টা জ্বেলে রাখলাম। শুয়ে শুয়ে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চোখে পড়ে পায়ের দিকে একটা চেল রঙের ছবি। সিংহাসনের মত কারুকার্য করা একটা চেয়ারে একজন লোক বসে আছে।গায়ে জমকালো পোশাক প্রকান্ড মুখ,বিরাট গুফ রক্তাক্ত দুটি চোখ যেনো জ্বল জ্বল করছে। ইনিই সম্ভবত নবাব বাহাদুর,যিনি এই অট্রালিকার মালিক ছিলেন। বাইরে বৃষ্টির শব্দ,গাছের পাতায় পাতায় নুপুরের মতন আওয়াজ।এক সময় আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ঘট ঘট ঘট- হঠাৎ করেই ঘুমের মধ্যে শব্দটা কানে এলো।প্রথমে মনে হলো ঝড়ের বেগে জানালার পাল্লা কাঁপছে,তারপর মনে হলো কে যেনো দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।
এতো রাতে কে দরজা ঠেলছে?তবে কি কোন কারনে কর্মকর্তা কিংবা ড্রাইভার ডাকছে।দুহাতে চোখ রগড়ে উঠে বসলাম।না,,যেদিকে দরজা সেদিক থেকে ত শব্দটা আসছে না, পিছনে ফিরতেই সারা শরীর কেঁপে উঠলো,আমি ভীরু এমন বদনাম কেউ দেবে না,কিন্ত চোখের সামনে এমন একটা দৃশ্যকে অস্বীকার করি কিভাবে।ছবির ফ্রেমটুকু রয়েছে কিন্ত নবাব বাহাদুর নেই। ছবির ঠিক নিচে নবাব বাহাদুর বসে আছেন।এক পোশাক এক ভঙ্গি, নিশ্চল নিথর,তবুও হাতের মোষের সিং এর ছড়িটা মেঝের উপর ঠেকছেন,খটখট করে। আমার মনে হলো শরীরের সমস্ত রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে।চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি,তাই চুপচাপ রইলাম।বাইরে ঝড়ের গতি আরও উদ্দাম।হঠাৎ করে এক সময় ১টা শব্দ করে দরজা খুলে গেলো।
হাওয়ার ঝলোকের সঙ্গে দীর্গকৃশ চেহারার মত একটা লোক ঘরে এসে ডুকলো।লোকটা এগিয়ে আসতেই দেখতে পেলাম খালি পা আর ময়লা ধুতি হাটুর উপর তুলা,মাথা মোটা টিকি,এই লোকটা দেখতে চাষা মত মনে হচ্ছে।লোকটা নবাব বাহাদুরের সামনে গিয়ে দাড়াতেই ভ্রুকুটি ফুটে উঠলো। কে?? আমি ঠাকুরপ্রসাদ। ঠাকুর প্রসাদ?এখানে এতো রাতে কি দরকার? আমার ছেলে শিউপ্রসাদ কই? শিউপ্রসাদ,,তা আমি কি করে জানবো। হ্যা তুমি জানো!তুমার লোক তাকে ধরে এনেছে।আমার খাজনা বাকি ছিলো দু সাল আমি দিতে পারছিনা তাই তুমার লোক আমার ছেলে কে ধরে এনেছে,বলো আমার ছেলে কই? মনে হলো নবাব বাহাদুর একটু অস্বস্তি বোধ করলেন।একবার খোলা দরজার দিকে দেখলেন এই আশায় যদি তার কোন পাইক এ ঘরে এসে পড়ে,কিন্ত না কেউ এলো না।
এই গভীর রাতে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে সবাই বোধ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কেউ এলো না দেখে নবাব বাহাদুর বললেন আমি তুমার ছেলের কথা জানি না,তুমি এখন যেতে পারো। আমি যাবারর জন্য আসিনি। ঠাকুরপ্রসাদের গলায় যেনো সিংহ গর্জনের সুর। তার মানে? আমি প্রথমে ভাবলাম বিদ্যুৎ চমকালো।কিন্ত না বিদ্যুৎ নয় ঠাকুর প্রসাদ কোমর থেকে ধুতির আড়ালে লুকানো প্রকান্ড একটা ভোজালি বের করলো।একি??? নবাব বাহাদুর আর্তকন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন।শিউপ্রসাদ কে আমি চাই নইলে তুমাকে প্রানে বাঁচতে দেবো না,বলো শিউপ্রসাদ কোথায়? চোরা কুটুরিতে,বলতে বলতে নবাব বাহাদুর উঠে দাড়ালেন।উঠে দাড়িয়েই দেয়ালে ফটোর পিছনে হাত দিয়ে কি যেনো টিপলেন,সঙ্গে সঙ্গে গড় গড় করে শব্দ হলো।
নবাব বাহাদুর সেইদিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন,ওই যে চোরা কুঠুরি ওখানে তুমার ছেলে আছে। ঠাকুরপ্রসাদ যেভাবে নেমে গেলো তাতে মনে হলো ওখানে সিড়ি আছে। একটু পরেই একটা আর্তনাদ শুনা গেলো।তারপর ঠাকুরপ্রসাদ উপরে উঠে এলো,তার কোলে মরা ছেলে শিউরপ্রসাদ।ঠাকুরপ্রসাদ খুব কাঁদছে তার ছেলে মরে যাওয়ায়। ওর কান্নার শব্দ শুনে আমার বুকের ভেতর টা কেমন যেনো কেপে উঠলো মরা ছেলেকে মেঝেতে রেখে ঠাকুর প্রসাদ নবাব বাহাদুরের সামনে এসে মুখোমুখি দাড়ালো।আর সিংহ গর্জনে বললো আর নয় তুমার অত্যাচার অনেক সয্য করেছি এবার প্রতিশোধ নেবো।
যে ভোজালিটা কোমরে গুজে রেখেছে সেটা সে আবার টেনে বের করলো।আমি ভয় পেয়ে গেলাম, এখনি আমার চোখের সামনে একটা খুনোখুনি হয়ে যাবে ভেবে চিৎকার করে উঠলাম।কিন্ত কি আশ্চর্য আমার গলা দিয়ে একটুও স্বর বের হলো না।নবাব বাহাদুর চেচালেন, কুমার সন্জিব মদন,,,,ঠাকুরপ্রসাদ তখন জোরে হেসে বললো হাহাহা কেউ আসবে না,সবাই যাত্রা শুনতে গেছে,সেই খবর পেয়েই আমি এসেছি ভগমানের নাম স্বরন করো। তারপর কি হয়ে গেলো,আমার চারিদিকে ধোঁয়ার রুপ,আর সেই ধোয়ার মধ্যেই ঠাকুরপ্রসাদ আর নবাব বাহাদুর দুজনেই হারিয়ে গেলো আমার ঘুম যখন ভাঙলো তখন দেখলাম মাত্র ভোর হচ্ছে।
কাঁচের জানালা দিয়ে সূর্যের প্রথম কিরন এসে বিছানার উপর পড়ছে আমি বিছানা থেকে উঠেই ফটোর দিকে দেখলাম নবাব বাহাদুরের প্রকান্ড মূর্তি।বিছানা থেকে নেমে আমি ফটোর পিছনে হাত দিয়ে দেখলাম।কিন্ত চোরাকুটুরি খোলার কোন বোতাম পেলাম না,মেঝে খুব ভালো করে দেখলাম কোথাও কোন ফাঁটল নেই।তাহলে কি সবই আমার মনের ভুল কিংবা সপ্নে আমি এসব কিছু দেখেছি?দরজা খুলে বাইরে এলাম দারোয়ান গেটের পাশে বসে আছে।তার কাছে গিয়ে দাড়াতেই সে উঠে আমাকে সালাম দিলো। তাকে সুজাসোজি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা এখানে চোরাকুটুরি টা কোথায় দারোয়ান চমকে উঠলো,চোরাকুটুরি হ্যা,যেখানে নবাব বাহাদুর প্রজাদের ধরে এসে রাখতেন। আপনাকে এসব কে বললো স্যার? যেই বলুক,কথা টা সত্যি কিনা তুমি বলো না? দারোয়ান চাপা গলায় বললো আমি কিছু জানি না স্যার।তবে বাবার কাছে শুনেছি যে ঘরে আপনি শুয়েছিলেন সেখানেই চোরাকুটুরি ছিলো।
মেঝেটা ফাঁক হয়ে নেমে যাওয়ার রাস্তাও ছিলো।নবাব বাহাদুর মরে যাবার পর তার ছেলে বিলাত থেকে ফিরে এসে মেঝে গেথে চোরা কুটুরি বন্ধ করে দিয়েছিলো। নবাব বাহাদুরের ছেলে কোথায় থাকেন? কলকাতায়!মাঝে মাঝে ১০/১২দিনের জন্য এখানে আসেন। আচ্ছা নবাব বাহাদুর মারা গেলেন কিভাবে?দারোয়ান তখনই কোন উত্তর দিলো না।এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো।কি?বলো?বলো? দারোয়ান প্রায় কেদে ফেললো,আমি কিছু জানি না স্যার। আমার বাবার কাছে শুনেছি তিনি এক প্রজার হাতে খুন হয়েছিলেন। যে প্রজার নাম ঠাকুর প্রসাদ। দারোয়ান উত্তর দেওয়ার আগেই কর্মকর্তার গলা কানে এলো।চলুন মুখ ধুয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি।
সকালে কলিকাতা ফেরার ট্রেন আছে তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, কিন্ত সে রাতের সে দৃশ্যের কথা আমি আজও ভুলতে পারি নি।এখনও মাঝ রাতে জেগে চমকে উঠি।নবাব বাহাদুরের চিৎকার কানে ভেসে উঠে। সঙ্গে ঠাকুরপ্রসাদের উৎকট হাসি, কেউ নেই কেউ আসবে না। ঠাকুরপ্রসাদের পায়ের কাছে মরা ছেলে হাতে ভোজালি।সে রাতে নিছক স্বপ্নে দেখেছি সে কথা মন মানতে চায় না।অথিতের একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটেছিলো এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।কিন্ত কি করে এটা সম্ভব হলো? এর উত্তর আমার জানা নেই।