পৃথিবীর আলো বাতাসের উপর আমি সকল আগ্রহ হাড়িয়ে ফেলেছি আজ। বেঁচে থাকা বাধ্যতা বৈ আর কিছুনা। অক্সিজেন যেন বিষাক্ত কোন গ্যাস। নিশ্বাস হয়ে ভেতরে ঢুকে এ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকাই চারিপাশে। আমার পাথুরে দৃষ্টি প্রতিবিম্ব হয়ে ফিরে আসে আমার কাছে। আমার একটি ভুলের কারনে ওলট পালট হয়ে গেলো আমার সহ আরও কয়েকটা জীবন। আজ আমি আপনাদের সেই ঘটনাটি-ই বলবো। যা থেকে আমি এখনো বেড়িয়ে আসতে পারিনি, আর কখনো পারবো কিনা তাও জানিনা। অতীত যেনো মোহরের মতন কেউ আমার অন্তরে বসিয়ে দিয়েছে।
আমি মেহরুমা…
গেলো বছরের কথা, অনেকদিন পর গ্রামে দাদা বাড়ি যাচ্ছি। গাড়িতে বাবা, আমি, ড্রাইভার চাচা আর অন্তু। অন্তু আমার ছোট ভাই, তার বয়স ৬। খুবি দুষ্টু প্রকৃতির। গাড়ির মধ্যেও কোন ব্যতিক্রম নেই। ওর লাফ-ঝাপ, জানালার কাঁচে হাত দিয়ে বাদ্য-বাজনা বাজানোর যন্ত্রণায় বাবা রীতিমত বিরক্ত। পেছনের ছিট পুরোটা ওরই দখলে। আমাদের মা নেই। অন্তুর জন্মের সময় সে মারা যায়। আমার বয়স তখন ১১। মা মারা যাবার পর আমার মনে হলো কেউ যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে অন্ধকার কুয়োতে ফেলে দিলো। সেই অন্ধকারে বেঁচে থাকার আলো নিয়ে এলো অন্তু। ছোট্ট এই পুতুল ছেলেটাকে নিয়েই আমি,বাবা ভুলে থাকলাম মাকে হারানোর কষ্ট।
হু হু হু… ব্যা ব্যা ব্যা… অন্তু দু কানে বুড়ো আঙ্গুল চেপে ধরে চোখ ট্যারা করে জীভ বের করে উদ্ভট শব্দ করছে। এত দুষ্ট হয়েছে ছেলেটা! আমি জানি, আমি বল্লে সে ক্ষান্ত দিবে। থাকনা,কি দরকার, আনন্দ করছে করুক। আমার ওপাশেই বাবা চোখ বন্ধ করে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে। ঠোটের কোনে মৃদু হাসি নিয়ে জানালার কাঁচটা নামিয়ে বাইরে তাকালাম। সব কিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। শেষ বিকেলের আলোয় সব কিছুতে কেমন মায়া মায়া একটা ছোঁয়া। চোখ বন্ধ করে আমিও ঘাড় এলিয়ে দিলাম ছিটে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। চোখ মেলতেই নিজেকে গাড়িতে একা আবিষ্কার করলাম। জানালার কাঁচটা বন্ধ, নিশ্চয় বাবা তুলে দিয়েছে। কিন্তু এরা আমাকে রেখে গেলো কোথায়! কাঁচটা নামিয়ে চারপাশে চোখ বুলালাম, ছোট একটা বাজার, একপাশে কিছু মানুষের একটা জটলা। সেখান থেকে থেমে থেমে হাত তালি আর হইহুল্লর শব্দ আসছে। ডুগডুগির আওয়াজ পেয়ে বুঝলাম বাদর নাচ হচ্ছে। সেই ভিড় ঠেলে দেখলাম তারা তিন জন এগিয়ে আসছে। অন্তুর চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। বাবা হয়তো বকা দিয়েছে। যা শুনলাম তা হলো বাবা জরুরি কাজে গাড়ি থেকে নেমেছে, সেই সুযোগে অন্তুও গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ছুটে যায় সেই ভিড়ের মধ্যে।
বাকিটা পথ অন্তু আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পার করলো। বাবা চলে গেলো পেছনের ছিটে। ভাইটার জন্য খারাপ লাগছে, ঘুমের মধ্যেও কেমন ফুপিয়ে উঠছে।
দাদা বাড়ি যাওয়ার পথে যেই সড়কটা সেটা ইংরেজি “Y” এর মতন। সড়কের দুটি শাখার মধ্যে বা পাশ দিয়ে একটি চলে গেছে দাদা বাড়ি গ্রামটায়, আরেকটি গেছে সোজা অনেক দূর কোথাও। ডান পাশে শুধু খোলা মাঠ, একটা খাল, আর খালের ওপারে একটা ছোট জংলা মতন। জংলাটার আসেপাশে কোন বাড়ি ঘর নেই। তবে গাছ গাছলা ছাড়িয়ে একটা লাল চিমনির মতন দেখা যাচ্ছে। কেউ থাকে নাকি ওখানে? কল্পনায় বাধা পড়লো গাড়ির বেশ কয়েকটা ঝাকুনি খেয়ে। ড্রাইভার চাচার বিরক্তি ভরা অভিযোগ। গাড়িটা থেমে গেছে, স্টার্ট নিচ্ছেনা। ধ্যৎ ! আর ৫/৬ মিনিটের রাস্তা হবে!
বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলাম। অন্তুও লাফিয়ে নামলো। সন্ধার প্রথম প্রহর। চারিদিকে মন খারাপ একটা ভাব। আমার দৃষ্টি আবার সেই লাল চিমনিটার দিকে গেলো। দেখে মনে হচ্ছে লাল ইটের দালান।
“আপু… “ চমকে লক্ষ্য করলাম অন্তু আমার পেছনের লুকিয়ে আঁচলের নিচ দিয়ে একটা চোখ বের করে সামনে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। আমিও ওর দৃষ্টি লক্ষ করে ওদিকটায় তাকালাম।
“কাউকে দেখেছিস ?”
অন্তু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। ততক্ষণে বাবাও বাইরে নেমে এসেছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম” কে? কে ওখানে ?”
কিছু একটা যেন নড়ে উঠলো গাড়ির পেছনে। আবার কিছু বলতে যাব তখনি বেড়িয়ে আসলো কালো পোশাক ধারি অদ্ভুত একজন মানুষ! অন্তু ভয় পেয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো। লোকটির পুরোটা মুখ যেন কেউ আগুন দিয়ে ঝলসিয়ে দিয়েছে। উফ, কি বীভৎস! বাবা এবার হই হই করে উঠলো “ এই কে তুমি?! কি চাই এখানে? চলে যাও এখান থেকে, বাচ্চাদের ভয় দেখাচ্ছ শুধু শুধু! “
লোকটি একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে উল্টো দৌড় দিয়ে কিছু দূর গিয়ে ফিরে তাকালো, তারপর আবার দৌড়াতে শুরু করলো। আমরা অবাক হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এর মধ্যে গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে। উফ, হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। অবশেষে গিয়ে পৌছুলাম দাদা বাড়ি।
দাদাজান বেঁচে নেই। দাদীজান আমাদের দেখে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। অন্তুকে যে কোলে নিলেন আর ছাড়ার নাম নেই। অন্তু ও দাদীজানএর ভক্ত হয়ে গেলো। আমাদের দেখতে প্রচুর লোকের ভিড় হয়েছে উঠোনে। একজন হ্যাংলা মতন লোক, নাম সম্ভবত আল আমিন, সে সবার মাঝে বিস্কিট, মিষ্টি বিতরণ করছেন। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। কেমন উৎসব উৎসব একটা পরিবেশ। আমাদের গাড়িটাকে ঘিরে এক গাদা বাচ্চার কৌতুহলি দৃষ্টি। কেউ কেউ ধরেও দেখছে। আল আমিন নামের লোকটি এবার সেই বাচ্চাগুলোকে দূরে সরাতে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন। তারা তাকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা। বরংচ তাদের হুড়োহুড়ি আরও বেড়ে গেলো। আমার ভীষণ মজা লাগলো।
দাদীজান বয়সি একজন বৃদ্ধা এবার অন্তুকে ইঙ্গিত করে বলে উঠলেন “ও ছুডু মিয়া, আমারে বিয়া করবানি? দেহ চাইন পছন্দ হইয়নি এই বুড়িরে?”
অন্তু লজ্জায় লাল হয়ে দাদীজানের আঁচলের নিচে মুখ লুকিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ করে না করলো। এতে বৃদ্ধার কি আনন্দ ! হো হো করে পান খাওয়া মুখে হেসে প্রায় গড়িয়ে পরছেন তিনি। হাসির বেগে পানের পিক গড়িয়ে পরছে চিবুক বেয়ে। বাহ ! কি সহজ সরল মানুষ এরা।
দাদা বাড়িটা বিশাল একতলা দালান। সম্ভবত এ অঞ্চলে আর এমন বাড়ি নেই। সামনে টানা বারান্দা, পেছনের দিকটায় লোহার সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠার ব্যাবস্থা। ঠিক করলাম সকালের চা টা ওখানেই পান করবো। উঠে গেলাম ছাদে। প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল দিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরোটা ছাদ খুব যত্ন সহকারে পরিস্কার করা। অন্তু নিচে বাচ্চাদের সাথে ডাংগুলি খেলায় ব্যাস্ত। ধুলোবালি মাখিয়ে একাকার সে। সবখানে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছেলেটার। অন্তু এবার আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো। আমিও এক গাল হেসে হাত নাড়লাম।
আল আমিন ভাই সতর্কতার সাথে এক হাতে চা অন্য হাত দিয়ে রেলিং ধরে ছাদে উঠে এলেন। তিনি এ বাড়ির কেয়ার টেকার এর কাজটাই করেন।
“আল আমিন ভাই, ওপাশটায় ওটা কি ?” আঙ্গুল তুলে আসার পথে সেই জংলাটাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম। যদিও এখান থেকে চিমনিটা দেখা যায়না তেমন।
তিনি চলেই যাচ্ছিলেন, আমার প্রশ্ন শুনে থেমে গেলেন এবং কাছে এসে ঝট করে আমার হাত টা নামিয়ে দিলেন।
“ক্ষমা করেন আপাজান, আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়েন না।“
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কেন?”
“ওই দিকটা ভালো না। অভিশাপ আছে।“
“মানে!!”
“কুনু মানে নাই, চলেন ছাদ থাকি নাইমা যাই। “
“অসম্ভব, ঘটনা কি তা না জেনে আমি নামবো না। “
“থাকনা আপাজান,জাননের কিছু নাই। “
“নাহ,আমি শুনবোই। “
আমার একঘেয়েমিতে আল আমিন ভাই হতাশ হলেন।
“ওইটা জগলু ডাকাইতের বাড়ি। সে মারা গেছে প্রায় এক যুগ। কিছু মানুষ তারে সহ তার সমস্ত পরিবার আগুনে পুরাইয়া মারছে। এর পর থেইকা……..”
“এর পর থেকে কি ?”
আল আমিন ভাই ভয়ার্ত চোখে সেদিকটায় তাকালেন। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে আবার শুরু করলেন।
“এর পর থেইকা ওই বাড়িটায় অনেক কিছু হারাইছে।
“মানে? বুঝিয়ে বলেন “ হাতের তালুতে চিবুক ঠেকিয়ে গভীর আগ্রহে প্রশ্ন করলাম।
“জগলু ডাকাইত খুবি বড় ডাকাইত আছিলো। যদিও এই গ্রামে সে ডাকাতি করতো না, কিন্তু আশেপাশের গ্রামে সে খুবই কুখ্যাত আছিলো । মানুষ ও খুন করছে সে। এইভাবেই প্রচুর টেকার মালিক হইয়া পাকা ইটের দালান দিলো। এক রাইতে কে বা কারা দালানের ভিতর আগুন দিয়া তারে আর তার পরিবারের সবাইরে মাইরা থুইয়া গেলো। এরপর থেইকা ওই দালানের ভিতর অনেক মানুষ আর গরু ছাগল হারাইছে। পরে স্থানীয় প্রশাসন কাঁটাতার দিয়া দালানটা ঘের দিয়া দেয়।“
এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে শেষ করলেন আল আমিন ভাই।
“আপনি নিজের চোখে কিছু গুম হতে দেখেছেন ?”
তিনি এবার একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।
“ জী না। তয় রঘু দেখছে। “
“ রঘু কে ?”
“গ্রামের ই একজন। কাঁটাতারের আগের ঘটনা। একদিন সে তার গাভী চড়াইতে ছিলো মাঠে। হঠাৎ সে দেখলো গাভীটা দৌড়াইয়া জগলুর লাল দালানের দিকে যাইতেছে। সেও ছুটলো গাভীর পেছন পেছন। রুজি রুজগারের সম্বল ওই একটা গাভী-ই তার। এই কারনে ভয় ডরের মাথা খাইলো। কোথাও গাভীটারে না পাইয়া সে সাহস কইরা লাল দালানের জানালা দিয়া মাথাটা ঢুকাইলো। আর তখনি কেউ যেন তার মাথাটা ধইরা টান দিলো। রঘু তার সমস্ত শক্তি দিয়া মাথাটা টাইনা বাইর করলো। সেই দিনের পর থাইকা ওর সারা মুখে পোড়া দাগ, যেন কেউ আগুন দিয়া পুড়াই দিছে। মাথাটাও কিঞ্চিৎ খারাপ হইয়া যায়। আর তার গাভীটারও কুনু খোজ পাওয়া যায়নাই।”
আমি নিশ্চুপে গল্পটা শুনলাম। গল্প-ই বটে। গ্রামের মানুষ ক্ষুদ্র অনেক ঘটনাকে বড় রুপ দিতে পছন্দ করে। রঘুর গল্পটা শুনে অবশ্য আমার গতকালের রাস্তায় দেখা হওয়া সেই লোকটির কথা মনে পড়লো। পরক্ষণেই মনে হলো, ধুর ! ব্যাপারটা সেরকম কিছুই না। প্রতিটি গ্রামেই বোধয় একটি করে পাগল থাকে, গতকালের লোকটি সেরকম কিছুই হবে। তবে ঘটনা হোক বানানো, লাল দালান দেখার ইচ্ছা আমার মনে চাড়া দিয়ে উঠেছে। আমাকে ওখানে যেতেই হবে। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই ঠোটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো আমার।খুব ছোটোবেলায় একবাড় এসেছিলাম এখানে,কিছু মনে নেই। তবে এবারের দাদা বাড়ি ট্যুর তা রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে।
চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, তবুও পুরোটা এক চুমুকে শেষ করে বললাম “ ঠিক আছে আপনি এখন যান। “
আল আমিন ভাইকে কেমন ভীত দেখাচ্ছে।
“আপাজান, আপনেরে যে এত কিছু বলছি, আব্বাজান আর দাদিজান যেন না জানে। “
“জানবেনা, তবে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।“
“কি কাজ ?”
“আমাকে ওই লাল দালানের ওখানটায় নিয়ে যেতে হবে।“
“কি কন!?” আল আমিন ভাই যেন আকাশ থেকে পরলেন।
“হু…আমি যেতে চাই ওখানে, ব্যাপারটা আপনারা যা মনে করছেন তা নয়, সেটাই প্রমান করতে চাই।“
“প্রমান করতে হইবনা আপাজান, আপনেই সঠিক। যাওনের দরকার নাই।“
“আমি সঠিক হলেতো কোন ভয় নেই তাইনা ?”
উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন।
“দাদীজান জানলে আমারে মাইরা ফেলাইবো।“
“জানবেনা। গাড়িটা নিয়ে যাবো, বলবো যে গ্রাম দেখতে যাচ্ছি।“
মুখ দিয়ে অস্পষ্ট একটা শব্দ করলেন আল আমিন ভাই।
“তাহলে আমরা আজ বিকেলে যাচ্ছি, কেমন ?”
তিনি নিশ্ছুপে ঘাড় কিঞ্চিৎ কাত করলেন। তারপর নিচে নেমে গেলেন। আমি খালি কাপে চুমুক দিতে দিতে লাল দালানের ওদিকটায় তাকালাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সেখানে ধোঁয়ার মতো কিছু কুণ্ডুলি পাকিয়ে উপরে উঠছে। পরক্ষণই বুঝলাম মনের ভুল। এতো দূর থেকে ধোঁয়া দেখা যাবার কথানা। মনের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভুতি নিয়ে নিচে নেমে এলাম। আর তোর সইছেনা। কখন বিকেল হবে…!
বিকেলের শুরুতে তৈরি হলাম লাল দালান দেখতে যাওয়ার উদ্দেশে। বাবা আর দাদীজানকে বুঝালাম গ্রাম দেখতে বেরুচ্ছি। আল আমিন ভাই মুখ কালো করে বারান্দার এক কোনায় দাড়িয়ে আছেন। “আল আমিন, আমার নাতি নাতনি গো যেন কোন কষ্ট না হয়।“আদেশের সুরে বললেন দাদীজান। আল আমিন ভাই চিঁ চিঁ করে কিছু একটা বললেন ঠিক বোঝা গেলো না।
গাড়ি স্টার্ট দিতেই দেখলাম অন্তু দৌড়ে এদিকেই আসছে, দাদীজান তাকে তৈরি করেই রেখেছিলেন। “আমিও যাবো আপু…আমিও যাবো…” বায়না ধরলো সে। আল আমিন ভাই ড্রাইভার চাচার পাশেই বসেছেন, আমি কিছু বলতে যাব,তার আগেই তিনি হই হই করে উঠলেন, “না না, অন্তু বাবাজির যাবার দরকার নাই।” আমি অন্তুকে বোঝালাম যে আমরা এই পাশের বাড়িতেই যাচ্ছি,এক্ষুনি চলে আসব। কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। যাবেই যাবে। রীতিমত কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। দাদীজানও তার সাথে সুর মিলিয়ে পিড়াপিড়ি শুরু করে দিলেন। বুঝলাম অন্তুকে না নিলে আমারও যাওয়া হবেনা। বাধ্য হয়েই সাথে নিতে হলো তাকে। আল আমিন ভাইয়ের ব্যাপারটা একদম পছন্দ হলো না। তার কালো মুখ এবার আরও কালো হয়ে গেলো। আমি এবার একটু বিরক্ত হলাম। লোকটি মোটামোটি শিক্ষিত। একজন পড়ালেখা জানা মানুষ কি করে এমন রটানো ভূতুরে গল্পে বিশ্বাসী হয়! গাড়িতে উঠেই অন্তু বিজয়ী ভঙ্গিতে দাত বের করে হাসলো। আমিও তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। কি সুন্দর লাগছে তাকে, আকাশী সার্ট ইন করেছে বাদামি পেন্ট এর ভেতর। খয়রি বেল্ট, বুট পরায় রাজপুত্রের মতো লাগছে। কপালের এক পাশে ছোট্ট একটা কালো টিপ চোখে পড়লো। নিশ্চয় দাদীজানের কাজ, নজর কাটানোর হাস্যকর পদ্ধতি।
গাড়িটা সড়ক থেকে এবার প্রশস্ত খোলা মাঠে নেমে গেলো। এই মাঠ ধরে এগুলেই খাল, খালের ওপারে লাল দালান ।৬/৭ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নামার আগে আল আমিন ভাই প্রমিস করিয়ে নিলেন যে লাল দালানের বেশি কাছাকাছি যাবনা। ড্রাইভার চাচা বোধয় কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। তিনি এবার উদ্দিগ্ন হয়ে বলে উঠলেন “ তাড়াতাড়ি যা দেখার দেইখা চলেন আম্মাজান।”
আমার ভয় করছেনা একদম-ই। গাড়ি থেকে সবাই নামলাম। অন্তু তার স্বভাব মতো লাফিয়ে নামলো। গাছ গাছলার ফাঁকফোকর দিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া লাল রং এর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। মরা খালটা পেরিয়ে চলে গেলাম ওপারে। জায়গাটা রীতিমত একটা ছোট খাটো জংলা। আমরা দাড়িয়ে আছি একটা উঠোনের মাঝামাঝি। আমাদের সামনেই কাঁটাতারে ঘেরা কুঁজো হয়ে দাড়িয়ে আছে বিদ্ধস্ত লাল দালান। প্রধান দরজার আকৃতির পাশেই দুটো জানালার আকৃতি। ভেতরে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। নিরেট অন্ধকার। মরচে ধরা কাঁটাতারের কিছু অংশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছিরে গেছে, যা দিয়ে কিনা আনায়াসে একটা ছাগল অথবা ভেড়া ঢুকে যেতে পারবে। আল আমিন ভাই এবার তাগাদা দিলেন, “দেখলেন তো আপাজান, চলেন এইবার ফিরা যাই।”
আমি তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে আরেকটু থাকার অনুরোধ করে জায়গাটার দিকে মনোযোগ দিলাম। উঠোনের চারদিকে ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বোঝাই যাচ্ছে মানুষের ছোঁয়া নেই এখানটায়। এবার চোখ গেলো দালানের ডান পাশে চৌবাচ্চার মতো দেয়াল ঘেরা একটা জায়গায়। পা উঁচিয়ে ভেতরে গেলাম। মাঝখানে বিশাল এক নাম না জানা গাছ ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। ডালপালার ফাক দিয়ে মৃদু রোদ নকশা আকছে মাটিতে। বাহ, দারুনতো! এমন একটা জায়গাকে কিনা গ্রামের লোক ভৌতিক রুপ দিয়ে রেখেছে! শিকড়ে বসে পিঠ ঠেকালাম গাছে। শীতল একটা বাতাস প্রান জুড়িয়ে দিলো। চোখ প্রায় বুঝে আসছে ঠিক তখনি কত্থেকে দুটো তপ্ত হাত আমায় সাপের মতো পেছিয়ে ধরলো। আমি শিউরে উঠে হাত দুটো থেকে নিজেকে কোনমতে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুলনা অনেক চেষ্টার পরও।
কই! সবই তো স্বাভাবিক! ওই তো তারা ৩ জন দাড়িয়ে আছে। বোধয় তন্দ্রা মতো এসেছিলো আর তখনি দুঃস্বপ্ন দেখেছি, বুঝ দিলাম মনকে, মন বুঝ মানলো না। ভেতরে কিছু একটা খচখচ করতে লাগলো।
“আল আমিন ভাই চলেন।” যেন কিছু হয়নি এমন ভাব করে বললাম। নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে, জায়গাটা কি আসলেই অভিশপ্ত!? চোখ গেলো অন্তুর দিকে, ড্রাইভার চাচা ওর হাত ধরে আছে। আমরা হেটে চলে যাচ্ছি, কিন্তু হাটার মধ্যেই অন্তু বারবার পিছন ফিরে চোখ বড়বড় করে কিছু দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। মজার কিছু দেখে শিশুরা যেমন হাসে ঠিক তেমন। আমি অন্তুর হাত টা এবার নিজের হাতে নিয়ে ওর মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম, ও মৃদু হাসলো। আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো, কেন যেন ক্ষীণ মনে হলো ওকে এখানে আনা ঠিক হয়নি। শুধু ওকে নয়, আমাদেরও আসা ঠিক হয়নি। কি আশ্চর্য! যেগুলোকে কুসংস্কার বলে তাচ্ছিল্য করেছি এতদিন, সে কুসংস্কারই ভয় হয়ে এখন আমার ভেতরটা কাঁপিয়ে দিচ্ছে!
আবার খাল পেরুবার পালা। খালের ওপারেই গাড়িটা। মনে খটকা লাগলো, খালটা পেরুতে পারবোতো? সাথে সাথেই মনকে বুঝালাম আমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছি, সব কিছুই স্বাভাবিক আছে। উফ, বাড়ি যেয়ে পৌছুতে পারলেই বাঁচি। কেন যেন জায়গাটাকে আর সহ্য হচ্ছেনা। এক নিশ্বাসে খাল পেরিয়ে ওপারে চলে গেলাম। আটকে থাকা শ্বাসটা গোপনে ছারলাম। সন্ধ্যা হই হই করছে। তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছি গাড়ির দিকে, বেশিনা, খাল থেকে মাত্র ১০/১৫ কদম, অথচ আমার মনে হচ্চে অনন্তকাল হেটে যাচ্ছি। হঠাৎ করে আমার প্রচণ্ড ভয় করছে। অন্তুর হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম। মনের মধ্যে অশুভ কিছু একটা খটখট করছে। আর তখনি ঘটলো ব্যাপারটা!!!
ছোঁ মেরে কেউ যেন আমার হাত থেকে অন্তুকে ছাড়িয়ে নিলো। আর সাথে সাথে অন্তু উল্টো দৌড় শুরু করলো খাল বরাবর। ব্যাপারটা এত ধ্রুত ঘটে যে আমরা কিছু মুহূর্তের জন্য স্তব্দ হয়ে যাই। হুস ফিরতেই সবাই দৌড়ে ওর পেছন পেছন ছুটলাম আর চিৎকার করে ওকে ডাকতে লাগলাম। কিন্তু আমাদের ডাক ওর কানে পৌছায়না। অন্তু যেন প্রায় ভেসে ভেসে দৌড়ে যাচ্ছে! এবার সে খাল পেড়িয়ে পৌঁছে গেলো কাঁটাতারের কাছে। হায় আল্লাহ্, এ আমি কি দেখছি! আমরা খাল পেরুতে পেরুতেই অন্তু কাঁটাতারের ছিরা অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। তারপর টপ করে ঢুকে গেলো লাল দালানের ভেতর। কেউ যেন আমার কলিজাটা ব্লেড দিয়ে চিঁরে চিঁরে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। অন্তু…… আছড়ে পরে একটা চিৎকার বেড়িয়ে এলো। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো।
চোখ মেলতেই নিজেকে খালের এপারে একজন অপরিচিত মহিলার কোলে আবিস্কার করলাম। মুহূর্তে সব মনে পরে গেলো। তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালাম। অন্তু কোথায়? অন্তু…? চিৎকার করে ছুটলাম লাল দালান বরাবর। অনেক মানুষের ভীর। পুরো গ্রামবাসি যেন চলে এসেছে। কেউ একজন আমায় ধরে রেখে সান্তনা দিচ্ছে, কিন্তু আমার কানে কিছুই যাচ্ছেনা। একটা ঘোরের মধ্যে আছি আমি। ওই তো দাদীজান, ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। আমিও ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। কিছুক্ষণ দাদীজানের বুকে পরে রইলাম। চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমেছে, এই অন্ধকার মনে করিয়ে দিলো লাল দালানের ভেতরকার অন্ধকারের কথা। অন্তু বোধয় ভয় পাচ্ছে… উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটলাম সেদিকে। অন্ধকারে যেন ভয়ংকর কোন দানব দাড়িয়ে আছে। কাঁটাতার অনেকটাই কেটে ফেলা হয়েছে। অনেক মানুষ আলো বাতি নিয়ে দালানের ভেতর ঢুকেছে। আমিও ঢুকলাম। গুমোট বাঁধা, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। ক্ষীণ আলোতেও মেঝের মধ্যে লেপটে থাকা শ্যাওলা চোখ এরায়না। ভেজা একটা গন্ধ নাকে আসছে। বাবা, ড্রাইভার চাচা,আল আমিন ভাই সহ গ্রামের অনেকেই ঢুকেছে ভেতরে। পুলিশের কিছু লোকও দেখলাম লাঠি হাতে এদিক ওদিক ঘুরছে। কই, কারুরতো কিছু হচ্ছেনা! তাহলে নিশ্চয় অন্তুর ও কিছু হবার কথা না। মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে পাগলের মতন অন্তুকে খুজতে থাকি প্রতিটা রুম এ। হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে ভাইটা, খুবই দুষ্টু এই ছেলেটা।
বাবা আমায় সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে, যদিও সে নিজেও ভেঙে পরেছে। পুলিশের লোকগুলো ও নানান রকম প্রশ্ন করছে। এরা কেন বৃথা সময় নষ্ট করছে!? কেন অন্তুকে খুজে দিচ্ছেনা!?…. ভেতর থেকে এক দলা ব্যাথা গলা ফুরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। সব আমার দোষ। ডুকরে কেঁদে উঠে আবার জ্ঞান হারালাম।
রাত কত হয়েছে জানিনা। জানার ইচ্ছা ও নেই। অন্তুকে খুজে পাওয়া যায়নি। সারা বাড়িতে কান্নার রোল। এই গ্রাম সহ আসে পাশের গ্রামেও মাইকিং হচ্ছে। বৃথা চেষ্টা, অন্তু ওই লাল দালানেই আছে। আমি জানি। আমার দেহে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। শুধুমাত্র নিশ্বাসের আসা যাওয়াই বেঁচে থাকার প্রমান। চোখ বন্ধ করে অসাড় হয়ে পরে আছি। চোখ বুঝলেই অন্তুর ছবিটা ভেসে উঠে। দুষ্ট হাসি মাখা মুখ। নিজেকে খুনি মনে হচ্ছে। নিজের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভে কিনা জানিনা, পেট উগলে বমি করলাম। পুরোটা গ্রাম আমার কাছে মৃত্যুপুরীতে পরিনত হলো।
এর ১৫ দিন পর দাদা বাড়িতে আমি আমার অতি প্রিয় একজন মানুষকে হারিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। এই ১৫ দিন আমি একটা প্রবল ঘোরে ছিলাম, এখনো আছি। শুধু এতটুকু জানলাম, লাল দালানের চারপাশের কাঁটাতার মেরামত করা হয়েছে। পুলিশ কোন মামলা নিতে না চাওয়ায় বাধ্য হয়ে একটা সাধারণ ডায়রি করা হয়। আল আমিন ভাইয়ের শাস্তি হিসাবে তাকে চাকরীচ্যুত করা হয়েছে। সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে দোষ তার নয় আমার। তাই তাকে তার চাকরি ফেরত দেয়া হোক। ১৫ দিনে তন্ন তন্ন করে অন্তুকে খোজা হয়েছে। কোথাও পাওয়া যায়নি।
গাড়িতে উঠে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আমার দুষ্ট ভাইটা কই! কে আজ লাফিয়ে গাড়িতে উঠবে! কে আজ সারাটা রাস্তায় জালাতন করবে! কে আজ আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবে! ব্যাথা… প্রচণ্ড ব্যাথা ভেতরটাকে দুমরে মুচরে দিচ্ছে। পুরোটা রাস্তা চোখ বুঝে অন্তুর কথা ভাবতে ভাবতে এলাম। অন্তুর বয়স যখন ৩ সে একবার হোঁচট খেয়ে পরে যায়। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি সে ব্যাথায় নীল হয়ে মুখ হা করে চিন্তা করছে কাঁদবে কি কাঁদবে না। ওর এই অবস্থা দেখে আমি হেসে ফেলি, আর তাই দেখে অন্তুর সেকি চিৎকার করে কান্না…
চোখ দুটো আবারো ভিজে উঠলো আমার…।
ঢাকা ফেরার পর এই প্রথম ভালো করে বাবার দিকে তাকালাম। শুকিয়ে গেছে অনেক। চেহারা ভেঙ্গে গেছে একদম। দাড়ি গোঁফ তার বয়সটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পুত্র শোকে সে কততা মর্মাহত তা বুঝতে পারি। বাবা আমার সাথে এখন তেমন কথা বলেনা। হয়তো সেও আমার মতো ভাবে অন্তুর হারিয়ে যাবার জন্য আমি-ই দায়ী।
আমার দিনগুলো বিষাদময় হয়ে উঠলো। এর মধ্যে ড্রাইভার চাচাও অসুস্থ হয়ে পরেছেন। নতুন ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া হলো। আমাদের বাড়িটায় আনন্দ বলতে অবশিষ্ট কিছুই রইলো না।
একদিন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলাম। কোথায় সেই দিপ্তিময় সুন্দর মুখ খানা! মনে হলো অচেনা কোন মেয়ে দাড়িয়ে আছে। চোয়ালের হাড়গুলো ঠেলে বেড়িয়ে এসেছে। চুল প্রায় সবই পরে যাচ্ছে। টানা চোখ-দুটো কেমন বিষণ্ণ আর নিভু নিভু। ঘুমের জন্য প্রতিদিন হাই পাওয়ারের ঔষধ খেতে হয় আমাকে, তবুও ভালো ঘুম হয়না। শুধু দুঃস্বপ্ন দেখি। মাঝে মাঝে ঘুমুতেও হয়না, জেগে জেগেই অনেক কিছু দেখি। রাতে বাতি নিভাতে পারিনা। মনে হয় বাতি নিভালেই সারা ঘরে কেউ হেটে বেড়ায়। এক রাতে শুয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো মাথার কাছে কেউ একজন আছে। ঘাড় উচিয়ে তাকাতেই দেখি আমার মা বসে আছে। আমি ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম। চিৎকার দেয়ার আগেই মা উধাও হয়ে গেলো। মাঝে মাঝে বাথরুমে ঢুকে দেখি এক কোনায় বসে অন্তু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ভয়ে আমি আড়ষ্ট হয়ে দাড়িয়ে থাকি। এক সময় অন্তুও চলে যায়। আমার এ অবস্থায় আমাদের কাজের বুয়া কয়েক রাত আমার সাথে ঘুমায়। তারপর সে আর আমার রুম এ ঘুমাবেনা বলে জানিয়ে দেয়। তার ভাষ্যমতে আমি রাতে না ঘুমিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। হয় সে ভয়ে অজুহাত দেখিয়েছে আর নাহয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি!
অন্তু হাড়িয়ে যাওয়ার ৫ মাস পর গ্রাম থেকে খবর এলো দাদীজান খুবই অসুস্থ। বাবা ভেঙে পড়লো। নতুন ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে ছুটলাম গ্রামের উদ্দেশে। প্রাণহীন একটা ভ্রমন শেষে এসে পৌছুলাম সেই মৃত্যুপুরীতে। দাদী জানের অবস্থা আশংকাজনক। তাকে হাসপাতালে অক্সিজেন দেয়া হয়েছে। বাবাকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে আমার। কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে। নতুন ড্রাইভারকে বললাম দাদীজান দের বাড়ি নিয়ে যেতে। আমার উদ্দেশ্য লাল দালান। সমস্যা একটাই, আমি কোথাও গেলে আমার প্রতি মুহূর্তের খবরা খবর নেয় বাবা। নতুন ড্রাইভারের কাছে মুঠো ফোনটা বিশেষ করে সে কারনেই যেন দেয়া। কিন্তু আমাকে এতো কিছু ভাবলে হবেনা। ভাগ্য যেহেতু আবার আমাকে এই মৃত্যুপুরীতে টেনে এনেছে সেহেতু লাল দালানের শেষটা আমি দেখেই ছাড়বো…
জায়গাটা ঠিক আগের মতোই আছে তবে খালটা আর মরা নয়। হাঁটু পানি আছে এতে। গাড়ি থেকে নেমেই ঝপাৎ করে পানিতে নেমে পরলাম। পা পিছলে পরে যেতে যেতে নিজেকে সামলিয়ে পানি ভাঙতে লাগলাম। নতুন ড্রাইভার এবার অবাক হয়ে বললেন ”কি করেন আপামনি?!”
“কিছুনা, আপনি ওখানেই থাকুন। আমি আসছি।”
তিনি আমার কথায় আশ্বস্ত হলেন না। পকেট থেকে মুঠো ফোনটা বের করলেন। আমি এবার প্রায় দৌড়ে পানি ভেঙে ওপারে উঠে গেলাম। পানিতে কিছু পরার শব্দ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালাম। নতুন ড্রাইভার রীতিমত পানিতে ঝাপিয়ে পরেছেন। আমি আর দেরি না করে দৌড়ে কাঁটাতারের সামনে চলে এলাম। কি আশ্চর্য! এটাকে নাকি মেরামত করা হয়েছে?! কই! এখনো তো কত জায়গা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আছে! যাক, আমার জন্য ভালোই হলো। কাঁটাতার ডিঙাতে হলো না। ছিঁড়ে যাওয়া একটা অংশ দিয়ে ভিতরে ঢোকার জন্য নিচু হয়ে বসলাম। প্রথমে ডান পা টা ঢুকিয়ে তারপর যতটা সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে মাথাটা ওপাশে নেয়ার চেষ্টা করলাম। আমার যাই কিছু চুল অবশিষ্ট ছিল কাঁটাতারে আটকে গেলো। সেই চুল তাড়াহুড়া করে ছাড়াতে গিয়ে হাতের বেশ কয়েকটা অংশে কেটে গেলো। কপালের কাছটায় ছিলে গেলো খোঁচা লেগে। কাঁটাতারে কিছু চুল বিসর্জন দিয়ে আমি ওপাশটায় যেতে সক্ষম হলাম। নতুন ড্রাইভারের ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে আসছে” আপামনি … কোথায় যান, আপামনি…”
ম্লান হয়ে আসছে সেই চিৎকার। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি লাল দালানের দিকে। ঠিক দরজার সামনে এসে দাড়ালাম। গা টা কেমন ছম ছম করে উঠলো। বাইরের এক চিলতে আলো ও প্রবেশ করতে পারেনি ভেতরে। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে পা রাখতেই কেউ যেন আমাকে হ্যাঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে ফেললো। অন্ধকারে কোথাও আছরে পড়লাম। ব্যাথায় কুকরে উঠে দাড়ালাম। অন্ধকারটাকে যতই চোখে সওয়াবার চেষ্টা করি ততোই গাড় হয়। হাতরে হাতরে সামনে এগুচ্ছি, হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন ফিস ফিস করে কথা বলছে। সাথে সাথে একটা বোটকা গন্ধ নাকে আসে আমার। ফিস ফিস শব্দটা এবার মনে হলো আমার কানের কাছে হচ্ছে। ভয়ে আমি প্রায় জমে গেলাম। অন্তুর কথা মনে পরছে। ওটুকুন একটা ছেলে, না জানি কত ভয় পেয়েছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ভয় ভুলে অন্তুকে হারানোর বেদনাই আমার মনে তোলপাড় শুরু করলো।
হুট করে একটু আলো জলে উঠলো, সাথে ধক করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মোমের আলোর চেয়েও ক্ষীণ আলোটা স্থির নয়, কেঁপে কেঁপে খেলা করছে ঢেউ এর মতন, যেন কিছু পোড়ানো হচ্ছে এ ঘড়ে । চারপাশটা হাল্কা দেখা যাচ্ছে। এর আগের বারের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখলাম এবার। নিজেকে কঙ্কালের স্তূপ এর মাঝে আবিস্কার করলাম। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষ এবং পশুপাখির হাড়। বড় একটা গরুর মতো প্রানির কঙ্কাল দেখে মনে পড়লো রঘুর হাড়িয়ে যাওয়া গাভীটার কথা। আমার গলা শুকিয়ে আসছে ভয়ে। তবুও অন্তুকে পাবার আশায় তাকাচ্ছি এদিক ওদিক। আমার ডান পাশে সামনে ৩ হাত দূরে পরে আছে ছোট্ট একটা শিশু কঙ্কাল। মনের মধ্যে তুফান বয়ে গেলো। অসম্ভব! এটা কিছুতেই অন্তুর নয়। কিছুতেই না! চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল জমে এলো। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরলাম। আর তখনি প্রচণ্ড তপ্ত একটি হাতের মতো কিছু একটা আমার কাধ স্পর্শ করলো। কেউ যেন গরম লোহা দিয়ে কাধে ছেকা দিলো। আমি চমকে প্রায় ২ হাত দূরে ছিটকে গেলাম। তীব্র একটা জলুনি নিয়ে পিছনে ফিরে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে মনে হলো আমার গায়ের সমস্ত রক্ত জমে গেছে। ফ্যাকাসে ঠোটে জীভ বুলিয়ে একটা ছোট ঢোক গিল্লাম। আমার সামনেই প্রায় ৬ ফুট একটা কঙ্কালসার মানুষের মতো দাড়িয়ে আছে। শুধুমাত্র হাড়ের উপর আঠা দিয়ে পোড়া চামড়া সেটে দিলে যেমন হবে ঠিক তেমন। আমি ঘামতে শুরু করলাম, মনে হলো এক্ষুনি ধপাস করে পরে জ্ঞান হারাবো। জিনিসটার ডান চোয়ালের কাছে এক থবলা চামড়া নেই। হাড়টাও ভাঙ্গা। বা হাতের ৫ টি হাড়ের মধ্যে তর্জনীটা ভাঙ্গা। এইকি জগলু ডাকাত!?
ক্যাঁচ ক্যাঁচ একটা শব্দ হলো। জিনিসটা যেন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। হ্যাঁ, এই সেই কুখ্যাত ভয়ংকর জগলু ডাকাত। মরে গিয়েও সে তার খারাপ শক্তি দ্বারা হত্যা করে যাচ্ছে নিরীহ মানুষ, পশুপাখি!
জগলু ডাকাত এবার কাঠের দরজার মতো ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে এক পা এগুলো। আমি এক পা পিছিয়ে গেলাম। হে আল্লাহ্, আমার ভাইটা না জানি কতটা ভয় পেয়েছে! এই শয়তানটা না জানি কিভাবে কিভাবে তাকে ভয় দেখিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। আমার ভেতর একটা ক্রোধ জেগে উঠলো। এদিক ওদিক তাকালাম কোন হাতিয়ারের আশায়। পায়ের কাছটায় একটা হাড় ঠেকতেই সেটা হাতে তুলে নিলাম। তীব্র ঘৃণা নিয়ে ঝাপিয়ে পরে বসিয়ে দিলাম এক ঘা জগলু ডাকাতের ঘাড় বরাবর। জগলু ডাকাত একটু নড়ে উঠলো। আমি অনাবরত বারি দিতেই লাগলাম। একসময় আমার হাতে থাকা হাড়টা দু টুকরো হয়ে গেলো। ক্রোধের উত্তেজনায় আমি ভাঙ্গা হাড়টা ছুরে দিলাম তার মুখ বরাবর। ভয়ংকর হাসি দিয়ে পুরোটা দালানকে কাঁপিয়ে দিলো জগলু ডাকাত। কেঁপে উঠলো আমার ভেতরটা ও। এবার সে একটা থাবা বসিয়ে দিলো আমার মুখে। বিদঘুটে পোড়া গন্ধে আমার ভেতরটা গুলিয়ে আসলো। এর সাথে নিঃশ্বাস ফেলতে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো প্রাণটা। জগলু ডাকাতের হাতটা এতই তপ্ত যে মনে হচ্ছে আমার সারা মুখে ফোসকা পরে যাচ্ছে। হাত টা সরাতে চেষ্টা করেও পারলাম না। অন্তুর কথা মনে পড়লো, অন্তু বুঝি এভাবেই…… তপ্ত হাতের থাবার মাঝেই ভিজে উঠলো আমার চোখ দুটো।
কি হলো ঠিক বুঝলাম না। আবিষ্কার করলাম জগলু ডাকাত আর সামনে নেই। বুক ভরে একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। ঘরের আলোটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। তীক্ষ্ণ আলোটা পেছন থেকে আসছে বুঝতে পেরে সেদিকে তাকালাম। যেন হাজার ভোল্টেজের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ। চোখ ধাঁদিয়ে যায় এতো আলো। পিটপিট করে যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হলো দেয়ালের উপরের অংশের সাথে ছাদ সংযুক্ত নয়। আমি যদি এখন দেয়াল বেয়ে কোনরকমে উপরে উঠতে পারি, লাফিয়ে বেড়িয়ে যেতে পারবো এই নরক থেকে। তবে বেড়িয়ে কোথায় যেয়ে পরবো সে ধারনা অবশ্য আমার নেই। দরদর করে ঘামছি। এতো কিছু ভাবার সময় এখন নেই। দেয়ালের দিকে পা বাড়াতেই সজোরে কেউ আমার পিঠে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিলো। আমি দেয়ালের উপর আছরে পড়লাম। আমার পিঠ বরাবর যেন কেউ আগুনের পিণ্ড ঢুকিয়ে দিলো। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে ফিরে তাকালাম। জগলু ডাকাত আবারো! আর সময় নষ্ট করলে চলবে না। পায়ের পাতা দিয়ে ইটের দেয়ালে গর্তের আশায় ঘষতে লাগলাম। কি আশ্চর্য! ছোট ছোট গর্ত পায়ে ঠেকলো! যেন কেউ ইচ্ছে করেই এ ব্যবস্থা করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, দেয়াল থেকে কিছু কিছু ইট ও বেড়িয়ে আছে যা ধরে আমি উঠে যেতে পারবো উপরে। আর দেরি না করে দেয়ালটাকে খামচে ধরে শরীরের অবশিষ্ট শক্তি প্রয়োগ করে দেয়ালটা বাইতে লাগলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হলো না। পায়ের গোড়ালিতে জগলু ডাকাতের তপ্ত হাত পেঁচিয়ে ধরলো। তারপর হ্যাঁচকা টানে হেঁচড়ে নামিয়ে আনলো আমাকে। মুখ হাত ছিলে গেলো আমার। নাকটা মনে হলো থেতলে গেলো। হাতের কিছু নখ ভেঙ্গে উঠে আসলো, কিছু রয়ে গেলো দেয়ালে। যন্ত্রণায় কাতরে উঠি আমি। তবু আশা না ছেড়ে রক্তাত্ত হাতে আবারো চেষ্টা করি দেয়ালটা বেয়ে উঠার। হাত গুলো অসাড় হয়ে আসছে। পায়ের পাতা পিছলে পিছলে যাচ্ছে। হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পরি আমি। আর তখনি ছোট্ট একটি হাত আমার দিকে এগিয়ে এলো উপর থেকে… কান্না ভুলে হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। প্রচণ্ড আলোতে হাত টি ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। আমি কোন কিছু না ভেবে হাতটিকে জড়িয়ে ধরলাম দু হাত দিয়ে। বুক ফেটে একটা চিৎকার বেড়িয়ে এলো, অন্তু……
ছোট্ট হাত টি আমায় টেনে উপরে নিয়ে যাচ্ছে। যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছি। ওই তো নিচে জগলু ডাকাত আঙ্গুল বিহীন একটা হাত এখনো উছিয়ে আছে আমাকে ধরার আশায়। কিন্তু আলোর খুব কাছাকাছি সে আসতে পারছেনা। সত্য এবং ভালোর জয় সবসময় ই হয়। আর কিছু ভাবতে পারছিনা। কেউ যেন ভাসিয়ে এনে আমায় মাটিতে শুইয়ে দিলো……
অনেক মানুষের হইচই ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে… কেউ আমায় কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে বোধয়… মাথার উপর আকাশটা কেমন দোল খাচ্ছে… ঘাড় কাত করে তাকালাম লাল দালানের দিকে। ওই তো অন্তু দাড়িয়ে আছে… আকাশের মতো সেও যেন দোল খাচ্ছে আর হাত নাড়ছে আমায় দেখে… আমিও হাত নাড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। ফোটা ফোটা জল গড়াচ্ছে চোখ বেয়ে। ধীরে ধীরে অন্তু দূরে চলে যাচ্ছে, অথবা আমি দূরে চলে যাচ্ছি… আমার ভাইটা… ভেতরটা হু হু করে উঠলো… সজোরে কাঁদতে যেয়ে একটা হেঁচকি সহ দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো… মনে পরছে অনেক কথা…অন্তুর জীভ বের করে ভেঙানো… ভো ভো করে সারা বাড়ি দৌড়ানো… ডাংগুলি খেলা… হাত নাড়ানো… আহ…কি কষ্ট… ঝাপসা হয়ে আসছে অন্তুর ছোট্ট অবয়ব টা…
এই ছিলো আমার ভুলের কারনে ঘটে যাওয়া আমাদের জীবনের ভয়ংকর অপ্রিয় সত্যি ঘটনা। এর মাঝে কত কিছু পালটে গেছে! শুনেছি লাল দালান ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাবা অনেক বুড়িয়ে গেছে। আমাদের পুরাতন ড্রাইভার চাচাও অসুখে ভুগে মারা গেলেন। বছরের একটা সময় আমি খুব অসুস্থ থাকায় আমাকে সেই সময়টা হাসপাতালেই রাখা হয়, তখন নাকি আমার মাথা গরম থাকে। এইতো, এইভাবে আমিও সময় কাটিয়ে দিচ্ছি সময়ের সাথে যুদ্ধ করে…
(সমাপ্ত)