দ্যা ডেভিল রিটার্ন

দ্যা ডেভিল রিটার্ন

দার্জিলিং এর পাহাড়ী রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে এক পাহাড়ী গাড়ি.রাস্তাটা খুবই ছোট .বড়জোড় ৬/৭ ফুট চওড়া হবে.সমতল থেকে প্রায় ৫০০০ ফিট উপরে উঁচু পাহাড় কেটে রাস্তা করা .রাস্তাটা পাহাড়টার চারিদিকে বৃওাকার হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে.আর রাস্তার একপাশে প্রায় গভীর খাদ .যত পাহাড়ের উপর উঠা যায় নিচের সমতলীয় শহর ততই ছোটো বিন্দু আকার ধারণ করে….

গাড়ির পিছনের সিটে জানলার ওপর দুহাত মুড়ে তার উপর নিজের মুখ রেখে বাইরেটা দেখছিল সোহা.বাইরের ভেসে যাওয়া তুলোর মত সাদা মেঘগুলো মাঝে ছুয়ে দেখছিল ও.আজ ওর সবকিছু অত্যাচার আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি.আজ ও আর কারুর কাছে বন্দী নয়.আজ ও পাখির মত মুক্ত .দীর্ঘ ৩ বছরের যন্ত্রণার অবসান করে ও শহর থেকে চলে এসেছে এই পাহাড়ে.পাহাড় সোহার খুব ভালো লাগে ছোটোবেলা থেকেই.ওর বাবা আর্মি অফীসার থাকার দরুণ ওর বাবা পোস্টিং হত বিভিন্ন জায়গায়.তারমধ্যে বেশিরভাগ সময়ই ওর বাবাকে কাটাতে হয়েছে শিলং এ.সোহার জন্মও শিলং এ.কিন্তু সোহার যখন ১৮ বছর বয়স সোহার বাবার ১৫ বছরের আর্মি লাইফ শেষ হয়ে যায়.আর তারপর ওরা ফিরে আসে কলকাতার বাড়িতে.যেখানে ওর এক জেঠুর সাথে ওরা থাকত.জেঠু অববিবাহিত ভবঘুরে জীবন কাটাত.বছরের ১০ মাসই ঘুরে বেড়াত এদেশ ওদেশ.আর যখন আসত তখন সোহাকে ঘোরার গল্প শোনাত.আর সোহারও জেঠুর গল্প শুনতে খুব ভাল লাগত.জেঠু যখন বাড়িতে থাকত সোহার বেশিরভাগ সময়টাই জেঠুর সাথে কাটত.জেঠু ছাড়া মা বাবার একমাএ আদুরে মেয়ে হওয়ার দরুণ বাবা মা ও সোহার সব আবদার মেটাত.সোহার জীবনটা আনন্দে খুশিতেই কাটছিল কিন্তু সোহার জীবনটা নরকের থেকেও খারাপে পরিণত হয় নিলয়ের সাথে ওর বিয়ের পর.
ইউনিভার্সিটি পাশ করার পর সোহা ওর বাবা মার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে করে.বিয়ের আগে অবশ্য সোহা আর নিলয় কয়েকবার ডেটে গেছে.সোহার ভালোই লেগেছিল নিলয়কে.নিলয়ের প্রতি সহানুভূতিও হয়েছিল ওর.ছেলেটার মা বাবা দুজনেই মারা গেছিল কার অ্যাক্সিডেন্টে.নিলয়ই সোহার মা বাবার কাছে এসেছিল সোহাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়.সোহার ইউনিভারসিটি এর এক অনুষ্ঠানে চিফ গেস্ট হিসাবে গিয়ে সোহাকে দেখে নিলয়ের ভালো লেগে গেছিল.তাই মা বাবা কেউ না থাকায় নিলয় নিজেই সোহার মা বাবা সাথে বিয়ের কথা বলতে আসে.সোহার মা বাবাও নিলয়ের খোজ নিয়ে জানতে পারে যে নিলয় শহরের বড় শিল্পপতিদের মধ্যে একজন এবং খুবই ভালো এবং পার্ফেক্ট ম্যান হিসাবে পরিচিত.তাছাড়া নিলয়ের আচার আচরনে সোহা ও তার মা বাবার সংগে খুব তাড়াতাড়িই পরিবারের মত মিশে গেছিল.তাই ইউনিভারসিটি কমপ্লিট হতেই সোহা নিলয়ের বিয়ে হয়ে যায়.আর বিয়ের পরের দিনই নিলয় সোহাকে নিয়ে চলে যায় ওর বাড়িতে.নিলয়ের বাড়িটা ঠিক বাড়ি বলা যায়না.রাজাদের প্যালেসের মত.সোহা নিলয়ের বাড়ীতে গিয়ে বাড়িটাকে নিজের মত করে সাজতে শুরু করে কিন্তু নিলয়ের তা কিছুতেই পছন্দ হতনা.ওর প্রত্যেকটা জিনিস পার্ফেক্ট চাই.এমনকি ডিমের অমলেটটাও গোল সেপই চাই.এছাড়াও নিলয় সোহাকে বাইরে থেকে বন্ধ করে যেত অফিস যাওয়ার আগে আর পুরো বাড়ীতে সি .সি .টীভি ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছিল সোহা কি করছে দেখার জন্য.যাতে প্রত্যেকটা মুহূর্ত ও নজর রাখতে পারে সোহা কি খাচ্ছে কি করছে.সোহার প্রত্যেক টা জিনিসে নিলয় কন্ট্রোল করতে চেয়েছিল.ও কি পরবে কি খাবে কারসাথে কথা বলবে.ওকে জেলখানার মত বন্দী করে রাখত নিলয়.সোহা ওর মা বাবাকে কিছু বলতেও পারতনা কারণ নিলয় সোহার বাবা মার কাছে নিজেকে এতটাই ভালো করে ওদের বশ করে রেখেছিল যে সোহা কিছু নিলয়ের নামে বলতে গেলেও ওরা নিলয়ের সমন্ধে কিছুই শুনতে চাইতনা.আর সোহা নিলয়ের কাছে ডিভোর্স চাইলে বা সোহা কোনো কাজ একদম পার্ফেক্ট না করতে পারলে সোহাকে শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ করতো নিলয় .কখনো দিনের পর দিন অন্ধকার ঘরে কোনো খাবার ও জল না দিয়ে আটকে রাখা বা কখনো সোহার হাত টেবিলে চেপে ধরে চাকু দিয়ে ওর আঙুলের ফাকে জোরে চালান , দরজায় হাত চেপে দেওয়া.একবারতো সোহাকে কফিনে বন্ধ করে রেখেছিল অনেকক্ষন.নিলয় সোহাকে রেগে গেল অত্যাচার করত আর পরে এসে ওরকাছে বাচ্চাদের মত ক্ষমা চাইত.নিলয় বলত যে ও সোহাকে খুব ভালবাসে কিন্তু সোহা ওর কথা না শুনলে বা কিছু ভুল করলে ও নিজেকে সামলাতে পারেনা.ও সোহাকে ওর মত পার্ফেক্ট দেখতে চায় প্রত্যেকটা জিনিসে.সোহা বুঝতে পেরে গেছিল বিয়ের ৬ মাসের মধ্যে যে নিলয় একটা বদ্ধ পাগল যে দুনিয়ার সামনে নরমাল এবং হাসিখুসি দেখালেও .ভেতরে ভেতরে ও একটা রাবণ.বিয়ের দুবছর পর সোহা নিলয়ের সীক্রেট স্টাডি রুমে নিলয়ের একটা ডাইরি থেকে এটা জানতে পারে যে নিলয় বিসনেস পাওয়ার জন্য ওর বাবা মাকে কার অ্যাক্সিডেন্ট করায়.ওর বাবা মা ওকে ওর এই আচরণের জন্য ট্রীটমেনট করাতে চাইলেও ও নিজেকে সুস্থ বলে দাবি করত…নিলয়ের ডাইরীটা পুরোটাই ছিল ওর বিকৃত মনের প্রকাশ…এইসব জানার পর আর দীর্ঘ ২ বছর নিলয়ের বিকৃতির শিকার হয়ে ঘরবন্দী থেকে সোহা পালাতে চেয়েছিল কারণ ও জানত নিলয় ওকে ডিভোর্স দেবেনা আর ওর বাবা মা ও নিলয় যে পাগল তা মানবেনা.উল্টে ওকেই দোষারোপ করবে নিলয়ের নামে অভিযোগ করার জন্য.সোহা পালানোর জন্য নিলয়ের বাড়ি থেকে কষ্ট করে কোনোরকমে বেরোলেও নিলয় ওকে ধরেই ফেলে আর তারপর থেকে বাড়ীর প্রত্যেকটা কাচ শক্ত জাল দিয়ে সিল করে দেয় যাতে সোহা বেরোতে না পারে আর.সোহা পাগল হয়ে যেতে থাকে.মা বাবা ফোন করলেও নিলয়ের ভয়ে কিছু বলতে পারতনা কারণ ও জানত মা বাবাকে বললে সেটা নিলয়কে বলবে আর নিলয় জানতে পারলে ওকে আরও কষ্ট দেবে.কিন্তু একদিন সোহার সহ্য ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়.ও বুঝতে পারে যে ওর মৃত্যু ছাড়া এই নরক থেকে বাচার উপায় নেই.ও চাকু নিয়ে যেইমাএ নিজের হাতের শিরা কাটতে যাবে.নিলয় দরজা খুলে ঢোকে.ওকে চাকু ধরা অবস্থায় দেখে নিলয় সোহা বলে চিতকার করে দৌড়ে গিয়ে ওর হাত থেকে চাকু নিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়.সোহা কাদতে কাদতে মাটিতে বসে পরে..নিলয় মাটিতে বসে ওকে জরিয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলে

“সোহা তুমি কেন বোঝনা আমি তোমায় কত ভালবাসি ..আমি তোমাকে ছাড়া বাচবনা”

সোহা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওর রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে.নিলয়ও ওর পিছন পিছন রুমে এসে ওরসাথে কথা বলতে চাইলেও সোহা একটা কথাও বলেনা.অনেক চেষ্টার পরেও যখন সোহা কিছু বলছে না দেখে নিলয় ভাবে সোহা হয়ত ঘুমিয়ে গেছে.এইভেবে নিলয়ও ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে……

ঘড়ির কাটায় রাত ১:৪০ মিনিট …সোহা আসতে আসতে বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে ফিরে আসে রুমে….

সোহার ভাবনায় ছেদ পড়ে পাহাড়ি চালক বাহাদুরের ডাকে…

বাহাদুর – ম্যাডম ..আপকা সোন গাও আ গয়া ..

সোহা একটা ছোটটো হাসি দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যায়.বাহাদুর গাড়ি থেকে ওর লাগেজগুলো নামিয়ে ভাড়া নিতে এলে সোহা ভাড়া মিটিয়ে জিজ্ঞাসা করে যে এই গ্রামে কোনো হোটেল পাবে কিনা যদি ও যাকে খুজতে এসেছে তাকে না পায় তবে রাতে হোটেলেইতো থাকতে হবে.বাহাদুর জানায় যে হোটেলের দরকার নেই কারণ এই গ্রামের মানুষেরা খুব ভালো ওদের কারুর বাড়িতেই থাকতে পারবে সোহা.সোহা বাহাদুরকে ধন্যবাদ বললে বাহাদুর গাড়িতে উঠে চলে যায় আর যাওয়ার আগে নিজের নম্বর দিয়ে যায় যদি দরকার পড়ে তো ও চলে আসবে..
বাহাদুর চলে গেলে সোহা লাগেজ নিয়ে এগোতে থাকতে..আজ সোহা পাহাড়ে ঘুরতে নয় খুজতে এসেছে ৩ বছর আগে ওর হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধু রাজাকে…ইউনিভারসিটিতে ওর সহপাঠী রাজা ৩ বছর আগে জানিয়েছিল সোনগাও এ ওর বাড়ি আর এও জানিয়েছিল যে ওর সপ্ন সেখানে সবার শিক্ষ্যার জন্য একটা স্কূল করতে চায় ও কারণ ওই গ্রামের একমাএ ছেলে যে স্কূলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজ ইউনিভারসিটি পড়ছে…সোহা বলেছিল ও স্কূল করলে একদিন দেখতে যাবে…

মাঝখানে তিনটে বছর কেটে গেছে আর অনেক কিছু বদলে গেছে…

সোহা আজ ওর বন্ধুকে দেওয়া কথা রাখতে এসেছে সোনগাও তবে ও জানেনা ও রাজাকে খুজে পাবে কিনা…তবুও এগিয়ে যায়…ওকে পেতেই হবে….

সোহা ওর লাগেজগুলো নিয়ে গ্রামটার দিকে এগোতে থাকে.গ্রামটা খুব সুন্দর ছিমছাম.সোহা দেখে গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়ি মাটির তৈরী আর খড়ের চালা.মাটির হলেও বাড়িগুলোতে প্রাচীন বাংলার পটচিএের ধাচে আলপনা ও বিভিন্ন ছবি আঁকা.সোহার আকাগুলো দেখে খুবই ভালো লাগে.ও ভাবে যে এই ছোটটো গ্রামটা এখনো বাংলার ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে.সোহার গ্রামটা দেখে মনে হয় এটা যেন কোন কবির লেখা একটা সরল গ্রামের ছবি.সোহা একটা বাড়ির দালানে একটা বউকে ঝুড়ি বুনতে দেখে তারকাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে

সোহা- আচ্ছা আপনি রাজা বলে কাউকে চেনেন .এই গ্রামেই থাকে .ও আমার সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত.

বৌটা বেশ হাসিমুখ করে বলে

“আমাদের রাজাবাবুকে খুজতাছেন.?.সেতো মস্ত শিক্ষিত ..একটু দাড়ান আমি পুটিরে ডাকি ও আপনারে রাজাবাবুর স্কুলে নিয়ে যাবে…”

সোহা- আরে না.আপনি কোন পথে যেতে হবে বলুন আমি চলে যাব..

বৌটা – আরে আপনি হইলেন আমাগো রাজাবাবুর বন্ধু …আপনি আমাদের গ্রামের অতিথি ….আপনারে একা ছাড়ি কি করে.শেষে খুঁজে না পেয়ে পথ ভুল করলে…

এইবলে পুটির নাম ধরে ডাক দিতে থাকে

“ও ও পুটি ..একবার আয়তো মা..দেখ কে আইছে”

পুটি ভেতর থেকে বলে

“আসছি মা…কে আইছে আবার”

কিছুকণ পর একটা ১৭-১৮ বছর বয়সী মেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলে বৌটা সোহাকে দেখিয়ে বলে

“ইনি হল আমাদের রাজাবাবুর বন্ধু .ওনাকে একটু রাজাবাবুর ইস্কূল পোর্জোন্তো ছেড়ে আয়তো মা”

মেয়েটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে সোহাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে.যেতে সোহা মেয়েটির কাছ থেকে জানতে পারে যে এই গ্রামে ৩ বছর আগে কোনো স্কূল বলতে সেরকম কিছু ছিলনা.শুধু কয়েকটা পাঠশালা ছিল .সেগুলিতে পড়াশুনা বলতে কিছুই হতোনা.গ্রামের অার্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় মা-বাবারা তাদের ছেলে মেয়েদের দুবেলা খাওয়ারই জোগাতে পারতনা তো পড়াশুনা করানোতো দূরের কথা.কিন্তু রাজাবাবু তারমধ্যেও অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করে এখানে এসে স্কূল করেছে সরকারি সাহায্য নিয়ে.সেই স্কুলে এখন ক্লাস ৪ পোর্জোন্তো পড়ানো হয়.আর তারপরের আরও পড়ানোর ব্যাবস্থা রজবাবু গ্রাম থেকে ৫ মাইল দূরে এক স্কুলে অনেক কষ্ট আর লড়াই করে করে দিয়েছে কারণ আগে সেখানে নিচু জাতির ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করার অধিকার ছিলনা.পুটির কাছ থেকে সোহা আরও জানতে পারে যে পুটি এইবছর এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে আর এইবার সে কলেজেও পড়তে যাবে…

প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর সোহা আর পুটি একটা টিনের চাল দেওয়া একতলা বাড়ীর সামনে এসে দাড়ায়.বাড়িটা ইটের আর তিনদিকে লম্বা আর মাঝখানে একটা মাঠ যেখানে অনেক বাচ্চা একই জামা পড়ে খেলা করছে.পুটি একটা ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে.

“ওটা হল রাজাবাবুর ঘর আর এটা ওনার স্কূল .”

সোহা একটু হেসে বলে

“থাঙ্কস পুটী …”

পুটি -(হেসে) ওয়েলকাম …তাহলে আমি আসি..

সোহা – হুম ….এস.

পুটি চলে যায়…সোহার মধ্যে একটা নার্ভাসনেস হতে থাকে ও এতবছর বাদে রাজার সামনে কি করে যাবে.যদিও একসময় ওরা ভালো বন্ধু ছিল কিন্তু নিলয়ের কারণে ওর সব বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে.নিলয়ের কথা মনে পড়তেই ওর মনটা ঘৃণায় ভরে ওঠে.সোহা নিলয়ের নামে মাটিতে থু-থু ফেলে.ওই শয়তানটাকে ও শেষ করে এসেছে .ও আর এই জীবনে সোহার জীবনে কালো ছায়া হয়ে আসতে পারবেনা.সোহা এখানে আসার আগে ওর বাবা-মাকে বলে এসেছে যে নিলয় অফিসিয়াল টুরে গেছে.কবে ফিরবে ঠিক নেই.তাই ও একটু পাহাড়ে ঘুরে আসতে চায়.ওর বাবা-মা বাধা দেয়নি….

সোহার হুশ ফেরে রাজার ডাকে

“আরে সোহা তুমি??”

সোহা- (হেসে)তোরসাথে দেখা করতে এলাম.বলেছিলামনা..তোর স্কূল দেখতে আসব…

রাজা- তুমি একা..মিস্টার কোথায় ?

সোহা- ও অফিসিয়াল টুরে গেছে …তাই আমি একাই চলে এলাম…

রাজা- ভালোই করেছ…ভেতরে এসো..

এইবলে রাজা সোহার লাগেজটা নিজে নিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়…

সোহাকে একটা চেয়ারে বসতে বলে রাজা দৌড়ে চলে যায়..সোহা দেখে যে ঘরটা একদম সাদামাটা.একপাশে একটা তক্তা আর প্রচুর বই ছাড়া বিশেষ কিছুই নেই.সোহা বসে অপেক্ষা করতে থাকে.প্রায় মিনিট পাচেক পর রাজা জল আর মিষ্টি এনে সোহার হাতে দিয়ে বলে

“এইটুকুই এখন জোগাড় করতে পারলাম .তবে দুপুরে মাংস আর ভাতের জন্য পাশের বাড়ীর দিদিকে বলে দিয়েছি.তুমি ওর বাড়ীতেই থাকবে”

সোহা – এসবের কি দরকার ছিল..আমি তোর স্কূল দেখতে এসেছি….আর আমার সাথে এতটা ফোর্মলিটির দরকার নেই.তুই যা খাস তাই চলবে

রাজা – তা বললে কি হয়.আমার গ্রামে প্রথম এসেছেো দেখা আমার গ্রামের ভালবাসা …

প্রায় ঘণ্টা দুই রাজা আর সোহা গল্প করে.রাজাকে ওর স্কূলের কথা জিজ্ঞাসা করলে রাজা জানায় যে ও সরকারি সাহায্যে নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষ্যাতো চালু করেছে কিন্তু তারপরের জন্য গ্রামের ছেলে মেয়েদের ৫-৬ মাইল হেটে স্কুলে যেতে হয় আর তাছাড়া ওর স্কূলটা ছোট হওয়ায় সব ছেলে মেয়েদের জায়গায় কুলায় না আর আর্থিক সমস্যা থাকায় বেশি টিচারও রাখতে পারেনি.৪ জন মিলে কোনোরকমে সামলায়..সব শুনে সোহা রাজাকে বলে যে ও স্কূলটার জন্য কিছু করতে চায়.ও নিলয়ের দেওয়া কলকাতার বাড়িটা বেচে ওই টাকাটায় এখানে স্কূলের জন্য বিল্ডিং বানাতে চায় আর প্রতিমাসে ও ৫০০০০ করে দেবে স্কূলের বাচ্চাদের উন্নতির জন্য.রাজা প্রথমে রাজি না হলেও সোহার জোরাজুরিতে আর বাচ্চাদের কথা ভেবে সোহার কথায় রাজি হয়ে যায়.সোহা বলে যে ও এক সপ্তাহ এখানে থেকে ফিরে যাবে কলকাতায়.আর রাজাকেও ওর সংগে যেতে বলে ..রাজা যাবে জানায়…

এক সপ্তাহ সোহার রাজার গ্রামে খুব আনন্দে কাটে সবার সাথে.এক সপ্তাহ পর রাজা আর সোহা কলকাতায় এসে নিলয়ের বাড়ীতে ওঠে…সেই বাড়ীতে যেখানে এক সপ্তাহ আগে সোহা নিলয়কে খুন করে পুতে দিয়েছিল….

পুরো একটা রাত জার্নি করার পর সোহা আর রাজা সকাল ৯ টায় সোহার বাড়ীতে এসে পৌছায়.দুজনেই খুব টায়ার্ড থাকায় বাড়ীতে এসেই ঘুমিয়ে পড়ে.বিকাল ৪ টে নাগাদ সোহা উঠে দুজনের জন্য অনলাইনে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার ওর্ডার করে গোসল করতে যায়.যখন গোসল করে জামা পরে ওর ঘর থেকে বেরোয় ও দেখে হলে সোফায় রাজা বসে আছে.সোহা রাজাকে বলে

“তোর খিদে পেয়েছে না..আমারতো প্রচণ্ড পেয়েছে.একটু ওয়েট কর .আমি ওর্ডার করে দিয়েছি.আসল বলে”

রাজা – হুম …

সোহা রাজার পাশে এসে বসে.রাজা সোহার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে.সোহাকে আজ ভেজা চুলে সেই আগের মত সুন্দর লাগছে.রাজার মনে পড়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় রাজা যেদিন সোহাকে প্রথমদিন দেখে ওরসাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল.কিন্তু ওই একটা গাইয়া আর সোহা স্টাইলিশ বড়লোক বাবার মেয়ে বলে কাছে যেতে ভয় পেত.তাছাড়া সোহার ফ্রেন্ডস সার্কলের সবাই ছিল হাই ফাই সোহার মতই.সোহাকে প্রথমবার ইউনিভার্সিটির গ্রাউন্ডে ভিজতে দেখে ও ভালোবেসে ফেলেছিল ওকে.তারপর যতবারই বৃষ্টি হতো রাজা কলেজে থাকা কালীন ও ছুটে যেত ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে কারণ ও জানত যে আর কেউ ভিজুক না ভিজুক সোহা ভিজবেই ..আর রাজার মনে হত বৃষ্টি যেন প্রত্যেকদিন হয় শুধু সোহার জন্য আর ও ওকে ভিজতে দেখবে কারণ সোহা বৃষ্টিতে ভিজলে ওর চুলগুলো ওর চোখের সামনে এসে পড়ত তাতে ওকে আরও সুন্দর লাগত.রাজার মনে হত ওর মুখে আসা চুলগুলোকে ও নিজের হাতে সরিয়ে ওর কানের পাশে করে ওর কপালে একটা চুমু একে দিক.কিন্তু শুধু দুর থেকেই দেখে আশ মেটাতে হত.সোহার ডাকে রাজা সৃতির জগৎ থেকে বাস্তবে ফেরে

সোহা- (হেসে)কিরে এত মন দিয়ে কার কথা ভাবছিস..কোনো মেয়ে টেয়ে নাকি.

রাজা একটু লজ্জা পেয়ে

“কি যে বলোনা..আমার মতো গাইয়াকে কে ভালবাসবে…”

সোহা – (একটু ইমোশনাল হয়ে) তোর মতো হিরের দাম হাজারটা কোটীপতির থেকেও বেশী …তোকে ভালবাসে যে তাকে শুধু বুঝে নিতে হবে তোকে…

রাজা -(অবাক হয়ে) মানে?…

সোহা – ছাড় ওসব …খাবার এসে গেছে…আমি আর থাকতে পারছিনা..পেটে ছুচো ইদুঁর সব ওলিংপিক দৌড় লাগাচ্ছে …

রাজা – হুম চল

রাজা আর সোহা ডাইনিং এ গিয়ে বসে.রাজা দেখে যে সোহা ওর পছন্দের প্রত্যেকটা খাবার আনিয়েছে.রাজা সোহাকে বলে

“তোমার এখনো মনে আছে আমি কি কি পছন্দ করি”

সোহা প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলে

“মনে থাকবেনা …তুই আমার একমাএ সত্যিকারের বন্ধু ছিলিস আছিস আর থাকবি”

রাজা খুব খুশি হয়.এই তিনবছর ও ভেবেছিল সোহা ওকে ভুলে গেছে তাই একবারও কল বা চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করেনি.কিন্তু না ও ভুল ছিল.সোহা আজও ওর পছন্দগুলো মনে রেখেছে.রাজা ভাতের প্লেটে হাত ঘোরাতে ভাবে সোহা যদি ওকে মনেই রাখে তবে এই তিনবছর ও যোগাযোগ করেনি কেন.আর ওর সব কনট্যাক্টস্‌ বন্ধ ছিল কেন.

সোহা রাজাকে ভাতের মধ্যে আঙ্গুল চালাতে দেখে বলে

“কিরে তুই একটু পরপর কোথায় হারিয়ে যাস..খাচছিস না কেন?”

রাজা – এইতো খাচছি বলে

খেতে শুরু করে…

খাবার পর দুই বন্ধু প্লেট ধুয়ে দোতলার ঝুল বারানদায় এসে দুটো বেতের চেয়ারে বসে..তারপর গল্প করতে করতে হাসি মজা করতে করতে কখন যে রাত ১১ টা বেজে যায় বুঝতেই পারেনা ওরা…সোহা বলে

“অনেক রাত হয়ে গেলো রে..বাট তোরসাথে গল্প করে পুরোনো দিনের ইউনিভার্সিটির দিনগুলো মনে পড়ে গেল.সত্যিই কত ভাল ছিল দিনগুলো”

রাজা হেসে বলে

“আজ সত্যিই খুব মজা হল.কতদিন বাদে আবার আগের মত আড্ডা মারছি আমরা”

সোহা- হুম ..ঠিক বলেছিস …চল খেয়ে শুয়ে পড়.অনেক রাত হল..

সোহা দুপুরে আনা খবরগুলো মাইক্রো ওভেনে গরম করে তারপর দুজনে খেয়ে নিজেদের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে.সোহা ঘুমিয়েই পড়েছিল হঠাৎ একটা জোড়াল শব্দে ওর ঘুম ভেঙে যায়.ও বেড ল্যাম্বটা জালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে হলের দিকে যায় আর তখনই ওর রুমের ঘড়িতে রাত ১:৫০ মিনিটের ঘন্টা বেজে ওঠে…সোহার বুকটা কেপে ওঠে ওই শব্দে অনধকার হলে একা….

সোহা অন্ধকার হলে হঠাৎ ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে গেলে ও নিজের মনে মনেই বলে

ধত ওটাতো ঘড়ির আওয়াজ …

সোহা হলের বাদিকের দেওয়ালে কাছে যখন লাইট জালাতে যাবে ওর মনে হয় যে ওর পিছনে অন্ধকারে যেন কেউ লুকিয়ে পড়ল একটা থামের পিছনে.সোহা তাই লাইট জালানো ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যেই এগিয়ে যায় থামের কাছে কে আছে দেখার জন্য কিন্তু ও কাউকেই দেখতে পায়না.ও যখন থামের দিকে দেখে পিছনে ঘুরতে যাবে অন্ধকারের মধ্যে একটা বিভত্সো মুখ জলনতো আগুনের মত ওর সামনে এসে পড়ে.সোহা ভয়ে চিতকার করে মাটিতে পড়ে যায়.সোহার চিতকার শুনে রাজা ধরমড় করে ঘুম থেকে উঠে সোহার ঘরে ছুটে যায় কিন্তু ওখানে ওকে দেখতে না পেয়ে সোহার নাম ধরে ডাকতে থাকে.সোহার সাড়া না পেয়ে রাজা হলে এসে লাইট খুঁজে জালিয়ে দেখে সোহা একটা থামের পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে.রাজা দৌড়ে গিয়ে হাটু মুড়ে বসে সোহার মাথাটা ওর কোলে নিয়ে সোহাকে ডাকতে থাকে.রাজার প্রচণ্ড ভয় লেগে গেছিল সোহার এই অবস্থা দেখে ও বুঝতেও পারছিলনা ও কি করবে.সোহার বাবা মা বা নিলয়ের নম্বরও জানে না যে ওদের জানাবে সোহার অবস্থার কথা.হঠাৎ ওর মনে হয় সোহার ফোনেতো থাকবে.ও দৌড়ে গিয়ে সোহার ফোন সোহার বেডরুম থেকে নিয়ে এসে দেখে ফোনটা পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা.ও তখন ঠিক করে সোহাকে আগে কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাবে তারপর যা করার করবে.সোহাকে কোলে তুলে বাইরে রাখা একটা গাড়িতে তুলে নিজে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অ্যাডমিট করে দেয়.তারপর সারা রাত জেগে বাইরে বসে থাকে এইভেবে যে সোহার হুশ কখন ফিরবে.আর ডাক্তারা সারারাত সোহার চিকিৎসা করতে থাকে.ভোরের দিকে ডাক্তার বাইরে এসে জানায় যে সোহা কোনোকিছু দেখে খুব ভয় পেয়েছে তাই ওর হার্টে বড় একটা শক লেগেছে.আর ও এখন কোমায় চলে গেছে .কবে ঠিক হবে কিছুই বলা যাবেনা.রাজা চিনতায় ভেঙে পড়ে.ও বুঝতে পারেনা ও কি করবে.হঠাৎ কি করে কি হয়ে গেল ..রাজা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে.তারপর সোহার ফোনটা একটা সাইবার নিয়ে গিয়ে লক খুলিয়ে আনে আর ওর বাবা মা কে ফোন করে সব জানায়.নিলয়ের নম্বরেও ট্রাই করে কিন্তু ফোন না লাগায় ও ছেড়ে দেয় .তারপর হাসপাতালে ফিরে আসে.সারারাত জাগা আর চিনতায় রাজাকে পাগলের মত উদ্দেশ্যহীন লাগছিল.সোহার মা বাবা এসে পৌছালে রাজা ওদের সব খুলে বলে ও কেন এখানে এসেছে আর কাল রাতে কি হয়েছে.আর এও বলে যে নিলয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেনা .সোহার বাবা মা ওদের একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা দেখে সোহার বেডের সামনে মাটিতে বসে পাগলের মতো কাদতে থাকে.রাজাও কাদতে থাকে আর সোহার বাবা মাকে সানতনা দিতে থাকে যে সোহা ঠিক হয়ে যাবে…

কিন্তু ওরা এটা জানতনা যে অবস্থা আরও ভয়ংকর হতে চলেছে….সোহাকে শেষ করতে নিলয়ের আত্মা আবার ফিরে এসেছে….

এক সপ্তাহ কেটে গেলেও সোহার কোনো উন্নতি না হওয়ায় ডাক্তার ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলে.এদিকে রাজা আর সোহার মা বাবা একদিকে সোহার এই অবস্থা আর আরেকদিকে নিলয়ের সাথে যোগাযোগ না করতে পেরে প্রচণ্ড চিনতায় পড়ে যায়.রাজা সোহার মা বাবাকে বলে যে ওদের নিলয়ের নামে একটা মিসিং কমপ্লেন করা উচিত থানায়.সোহার মা বাবা তাতে রাজি হয়ে যায়.রাজা সোহার আর নিলয়ের বাড়ি থেকে নিলয়ের একটা ফটো নিয়ে থানায় গিয়ে কমপ্লেয়ন লিখিয়ে আসে.তারপর সোহাকে বাড়ি নিয়ে আসে.সোহার বাবা মা ও সোহার ওদের মেয়ের খেয়াল রাখার জন্য রাজার সাথে আসে.রাজা সোহাকে ওর বেডরুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ইে দেয় আর ওর সেলাইনের বোতলটা খাটের উপরে একটা স্ট্যান্ড এ রেখে দেয়.রাজার চোখ দিয়ে গড়গড় করে জল গড়িয়ে পরে.যাকে ও এতটা ভালবাসে তার এই অবস্থা ও কিছুতেই দেখতে পারছেনা.এমন সময় সোহার বাবা মা ওই ঘরে আসলে রাজা ওর চোখের জল মুছে বলে

“কাকু কাকিমা আপনারা রেস্ট নিন কিছু খেয়ে .আমি খাবার এনে দিচ্ছি.”

সোহার বাবা- “না লাগবেনা..আমাদের মেয়েটার এই অবস্থা আর আমাদের কি করে গলা দিয়ে খাবার নামে”

রাজা- (চিন্তিত হয়ে) এক সপ্তাহ আপনারা নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছেন.না খেলে আপনারাও যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন.

বাবা- আমাদের আর কি আছে…মেয়েটা ছাড়া আমাদের কেইবা আছে..এদিকে জামাইয়েরও কোনো খবর নেই…

সোহার বাবা মা কাদতে কাদতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়…

রাজা কিচেনে গিয়ে ভাত আর ভাজি বানিয়ে সোহার বাবা মা কে জোর করে খায়িয়ে ওদের ঘুমের ঔষধ দেয় যাতে ওরা একটু ঘুমায়.ঘুমের ঔষধ ওর সাথেই থাকে.সোহার বিয়ের খবর পেয়ে ও খুব কেদেছিল কারণ ও সোহাকে ভালবেসে ফেলেছিল….ওর রাতে ঘুম হতনা সোহার দুঃখে…ওর শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল .শেষে একদিন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় ওকে গ্রামের সবাই মিলে হাসপাতালে ভরতি করে.আর তখনই ওকে ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দেয় ওর রাতে ঘুমের জন্য.তখন থেকেই আজ ৩ বছর ধরে ও ঘুমের ওষুধ ওর সাথে থাকে.কিন্তু ৩ বছর পর সোহা যখন ওরকাছে আবার গেল আর ও সোহার সাথে আগের মত মিশতে শুরু করল ওর আর এই ঔষধের প্রয়োজন হয়না….

রাজা এই এক সপ্তাহ সোহার চিনতায় পাগল হয়ে গেছিল.একদিকে ওর বাবা মা একদিকে সোহা আর আরেকদিকে নিলয়ের মিসিং ওর মাথা পাজেল করে দিচ্ছিল….

*******

রাজা সোহার রুমে যায় ..সোহা একইভাবে পড়েছিল বিছানায়..রাজা দেওয়ালে রাখা ঘড়ির দিকে তাকায় ১০:৫ মিনিট হয়েছে রাএি.ও সোহার বেডের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে সোহার হাতটা ওর দুহাতে নিয়ে ওর নীরব মুখের দিকে তাকিয়ে বলে

“আমি তোমাকে ভাল করে তুলবই”

তারপর ওর হাতটা বিছানায় রেখে ওরহাতে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে.ওর মনে পড়ে যায় ইউনিভারসিটিতে ওর আর সোহার বন্ধুত্বের প্রথম দিনের কথা…

সোহা আর রাজা দুজনেই একটা ডিবেট কমপিটিশনে নাম দিয়েছিল যেখানে একটা লটারি সিস্টেমে সোহা আর রাজা জোড়ি হিসাবে আরও ১০ জন জোড়ির সাথে লড়ে ডিবেটে জিতেছিল…আর তারপর থেকেই ওরা ভাল বন্ধু হয়ে যায়.সোহা রাজাকে শহুরে আদবকায়দা পোশাক অনুযায়ী গড়ে তুলেছিল.সবাই অবাক হয়ে গেছিল রাজাকে একটা গেয়ো বোকা লুক থেকে শহুরে হতে দেখে.সোহার সাথে রাজার খুব ভাল লাগত.রাজা সোহার প্রত্যেকটা বাচ্চার মত আবদার পুরণ করত .কিন্তু হঠাৎ একদিন সোহার বিয়ে হয়ে যায় .সোহা ওকে কিছুই বলেনি.রাজা ভাবে সোহা ওকে যতই শহুরে করুক ও কি আর সোহার স্টান্ডার্ড এ হতে পারবে.ও ফিরে যায় ওর গ্রামে.প্রথম কয়েক মাস কষ্ট পেলেও ধীরে ধীরে ও নিজের মনকে মানায় যে সোহা আর ও আলাদা দুনিয়ার.সোহার দুনিয়ায় ওর কোনো জায়গা নেই….

এমন সময় সোহার আওয়াজে রাজার ঘুমটা ভেঙে যায়…ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে…ও ধরমর করে উঠে দেখে সোহা বিছানায় বসে ভয়ে কাপছে…ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে.রাজা ওর পাশে বসে ওর মুখটা নিজের দুহাতে ধরে বলে

“সোহা কি হয়েছে …ভয় পাচ্ছো কেন?”

সোহা নিলয়ের দিকে ভয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ঢোক গিলে কাপা কাপা গলায় বলে

“ওওওও……আআমায় মেরে ফেলললবে.ওও ফিরে এসেছে”

রাজা-(অবাক হয়ে) কে মারবে…কে ফিরে এসেছে…

সোহা (ভয়) – নিলয়য়!!

রাজা -(অবাক হয়ে)”নিলয় কোথায় …ওর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না আমরা”

সোহা – আমি ওই জানোয়ারটাকে মেরে ফেলছি ..দেখো ও আমায় কত কষ্ট দিত ..

এইবলে সোহা ওর হাতে পায়ে পিঠে কালশিটে পড়ে যাওয়া মারের দাগ দেখায়.রাজা ওগুলো দেখে বলে

“কিন্তু তুমি ওকে মারলে কেন.কাউকে বলতে পারতে.আর ওর বডি কোথায় ?”

সোহা- ওই শয়তানটা আমার মা বাবাকে বশ করে রেখেছিল..ওরা আমার কথা বিশ্বাস করত না.তাই ওকে মেরে আমি সামনের বাগানে পুতে দিয়েছি.আমি আর পারছিলামনা…ওর অত্যাচার সহ্য করতে….কিন্তু ও বদলা নিতে আবার ফিরে এসেছে…

রাজা সোহাকে বুকে জরিয়ে ধরে …সোহাও ওকে জোর করে ধরে কাদতে থাকে..রাজা ওকে বলে যে ওর কিছু হতে দেবেনা…ও সব ঠিক করে দেবে..পরেরদিন সকালে সোহাকে ঠিক হতে দেখে ওর বাবা মা খুব খুশি হয়.সোহাকে ওরা বুকে জড়িয়ে খুব আদর করে.সোহাও ওর মা বাবাকে খুব ভালবাসে…তারপর রাজার কথামতো সোহা ওর বাবা মাকে জোর করে ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়.আর বলে যে নিলয়কে নিয়ে না ভাবতে ও বাইরে আছে তাই যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা়..আর ওর চিনতাও করতে বারণ করে কারণ ওর কিছু অসুবিধা হলে রাজা ওরসাথে আছে.সোহার বাবা মা রাজার এই কয়দিনে ওদের প্রতি কন্সর্ন দেখে ওর উপরে সোহার ভার দিয়ে চলে যায়…

সোহার বাবা মা চলে গেলে সোহা আর রাজা দুজনে গাড়ি করে এসে পৌছায় একটা পুরানো চার্চের সামনে…..

সোহা আর রাজা চার্চ এর একপাশে গাড়িটা পার্ক করে ভিতরে ঢোকে.এই চার্চটা শহরের অন্য চার্চগুলির থেকে অনেক পুরোনো.সোহা আর নিলয় ওদের বিয়ের পর একবার এইখানে এসেছিল.তখন এইখানের পাদরীকে অশুভ আত্মা সম্মন্ধে ওরা বেকখা করতে শুনেছিল.তাই আজ সোহা রাজাকে নিয়ে এই চার্চে আসে ওর সমস্যার সমাধানের জন্য.ওরা ভেতরে গিয়ে দেখে চার্চটা ফাঁকা .শুধু পাদরি যিশুর ক্রুশ চিহ্নের পাশে দাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রেখে প্রার্থণা করছে.সোহা রাজাকে চোখের ইশারায় বোঝালো যে এই সেই পাদরি.ওরা পাদরীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল একটা টেবিলে বসে.প্রায় মিনিট ৫ পর পাদরী প্রার্থণা শেষ করলে ওরা দুজন পাদরীর কাছে গিয়ে সোহার সাথে ঘটে যাওয়া সব কথা খুলে বলে.কিন্তু সোহা যে নিলয়কে খুন করেছে সেটা চেপে যায়.পাদরী সব শুনে ওদের একটা করে ক্রুশ লকেট দিয়ে ওটা পরে থাকতে বলে.আর বলে যে উনি কাল রাতে ওদের বাড়ীতে যাবে.ওরা পাদরীর সাথে কথা বলে চার্চ থেকে বেরিয়ে সোজা পুলিশ স্টেশনে এসে রাজা নিলয়ের নামে যে মিসিং কমপ্লেনটা করেছিল সেটা তুলে নেয়.পুলিশ কারণ জানতে সোহা জানায় যে ওর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল আর তাতে ওর কয়েকদিন জ্ঞান ছিলনা.আর সেইসময় ওর মা বাবা নিলয়ের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় মিসিং কমপ্লেন করে কিন্তু আসলে নিলয় বিজনেসের কাজে বাইরে এমন জায়গায় ছিল যেখানে নেটওয়ার্ক কাজ করতনা.কিন্তু আজ সকালেই নিলয়ের সাথে কথা হয় তাই মিসিং কমপ্লেন তুলতে এসেছে ও.সোহা আর রাজা বেরিয়ে গেলে থানা থেকে বড়বাবু একজন কন্স্টেবলকে সোহা আর রাজার উপর নজর রাখতে বলে কারণ ওনার ওদের সন্দেহ হচ্ছে …

এদিকে সোহা আর রাজা বাড়ীতে ফিরে আসে…

বাড়ীতে ফিরে ওরা ফ্রেশ লানচ হয়ে যে যার রুমে চলে যায়.হঠাৎ একটা শব্দে সোহার ঘুমটা ভেঙে যায়.ও দেখে যে ও চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল.ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১:৪৭ মিনিট বাজে…ওর বুকটা আবার কেপে ওঠে…আবার ১:৫০ এএএ….

ও দৌড়ে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে রাজার ঘরের দিকে দৌড়াতে থাকে কিন্তু ঘর থেকে বেরোতেই অন্ধকারের হলে ও কিছু একটা আসবাবে ধাক্কা লেগে পড়ে যায়…আর পড়ে যেতেই ওর গলা থেকে ফাদারের দেওয়া ক্রস চেনটা ছিটকে খুলে যায় অন্ধকারে কোথাও…আর তখনই একটা জোরালো আলো এক ঝটকায় ওর শরীরে ঢুকে যায়….

****

পরেরদিন রাজা উঠে দেখে সোহা ওর রুমে ঘুমাচছে .রাজা ওকে না ডেকে কিচেনে গিয়ে চা বানাতে থাকে দুজনের জন্য.ও নিজের মনে বলে যে ফাদারের দেওয়া চেনটা তাহলে কাজ করেছে.নাহলে সোহা ভয়ে ঘুমাতেই পারতনা…

এদিকে ওদের বাড়ীর উপর সবসময় নজর রাখছে একজন কন্স্টেবল কিন্তু এমন কিছুই হচ্ছে না যেটা বড়বাবুকে বলার মত…

জয় দু কাপ চা এনে সোহার ঘরে আসে.তারপর চায়ের ট্রেটাকে বেডের পাশে টেবিলটায় রেখে সোহাকে ডাকতে ওর গায়ে হাত দিলে দেখে সোহার পুরো শরীর বরফের মত ঠাণ্ডা কিন্তু ওর পালস চলছে..সোহার গলায় চেনটা না দেখে রাজা ভয় পেয়ে যায়…ও তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ফাদারকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলে…

ফাদার ১৫ মিনিটের মধ্যে চলে আসলে রাজা ওনাকে সোহার ঘরে নিয়ে যায়…

এদিকে একজন ফাদারকে আসতে দেখে কন্স্টেবল বড়বাবুকে ফোন করে তা জানায়.বড়বাবু ওকে নজর রাখতে বলে…

ফাদার সোহার ঘরের সামনে এসেই বলে

“দেয়ার হ্যাভ সামথিং ডেভিল স্পিরিট হেয়ার ”

রাজা- (কাদোকাদো হয়ে)
আপনি ওকে কিছু করুন প্লীজ্

ফাদার- ডোনট ওয়ারী ..ইফ দেয়ার হ্যাভ ডেভিল ,গড অলসো বি দেয়ার টু সেভ হিজ চাইল্ড …

ফাদার সোহার কাছে গিয়ে ওর মাথায় ক্রস ধরতেই সোহা পাগলের মত হাত পা ছুড়ে চিতকার করতে থাকে…ফাদার ক্রসটা ছাড়তেই ওর শরীরটা আবার মড়ার মত নিসতেজ হয়ে যায়…

ফাদার বাইরে এসে রাজাকে বলে যে ওর শরীররে নীলয়ের আত্মা কবজা করে নিয়েছে..আর ওদের হাতে খুব কম সময় আছে..কাল সূর্য্য ওঠার আগেই নীলয়ের আত্মাকে সোহার শরীর থেকে না বের করতে পারলে সোহার আত্মাকে নীলয়ের আত্মা নিয়ে চলে যাবে ওর দুনিয়ায়…
রাজাকে সোহাকে দেওয়া চেনের কথা জিজ্ঞাসা করলে রাজা জানায় ও কিছুই জানেনা…

ফাদার বলে যায় যে আজ রাতেই পুরো বাইবেল পড়তে হবে.তবেই নীলয়ের ডেভিল আত্মা বশ হবে এবং এই দুনিয়া ছেড়ে দেবে.তবে এটা খুবই শক্ত হবে কারণ ডেফিল কখনই এটা করতে দেবেনা .ও বাধা সৃষ্টি করবে …
রাজা জানায় যে যতই বাধা আসুক ও মরে গেলেও সোহাকে বাচাবে…

ফাদার ওকে শুভকামনা দিয়ে চলে যায় আর বলে যে রাত ১০ টায় উনি চলে আসবেন..আর রাত ১:৫০ থেকে ক্রিয়া শুরু হবে…

ফাদার চলে গেলে রাজা সোহার ঘরে এসে ওর নিসতেজ শরীরের পাশে বসে ওর হাত ধরে কাদতে থাকে..আর প্রতিজ্ঞা করে শয়তান নীলয়ের হাত থেকে ওকে বাচাবেই…..

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত