অস্বাভাবিক মানুষ ও অস্বাভাবিক ঘটনা যে হরদম চোখে পড়ে এ বিষয় তো কোন সন্দেহ নেই-ই, এমনকি এমন বহু ঘটনার কথাও শােনা যায় যাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গেলে অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কে না জানে যে সে সব ঘটনাও হামেশাই ঘটে থাকে। হামেশাই ঘটে থাকে বলছি বটে, তবে সব সময় নিজেদের জীবনে ঘটে না, তাই চাক্ষুষ প্রমাণ দিতে পারে এমন সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু যাদের কথা অবিশ্বাস করা যায় না, এ রকম বহু লােকের নিজেদের জীবনে না থাক, তাদের নিকট আত্মীয় স্বজনদের কিংবা অন্তরঙ্গ বন্ধুদের জীবনে সে সব ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকতে শােনা যায়।
যেমন ধরুন আমার মার সই মিস গাঙ্গুলীর কথা। বিয়ে-থা করেননি, নামকরা খ্রীশ্চান বাড়ির মেয়ে, নামটা অবিশ্যি পালটে দিয়েছি, নইলে সবাই চিনে ফেলবেন শেষটা—ভবানীপুবের দিকে একটা মেয়েদের হােস্টেল চালান। আমার মামাবাড়ির পুরােন চাকর বনমালীও সেখানে বহু বছর কাজ করছে। সব জানাশােনা লােকের ব্যাপার, বুঝতেই পারছেন, এরা কেউই সেরকম একটা বানিয়ে মিথ্যে কথা বলবার মানুষও নন, অথচ ঘটনাটা শুনে কী বলবেন তা ভেবে পাবেন না । সারাদিন বনমালী ন্যাপাকে আগলিয়েছে, এখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, আর ভাল লাগছে না। মানুষের ভাইবােন কেন হয় ? ন্যাপাটা পাজির একশেষ, আর কেউ হলে বনমালী তার সঙ্গে কথাটি বলত না, অথচ মায়ের পেটের ভাই বলে যেই না জেল থেকে ছাড়া পেল, অমনি বনমালীও তাকে নিয়ে গিয়ে রান্না ঘরে ঢােকাতে বাধ্য হল।
‘ওর জুড়ি রাঁধুনে সারাটা পৃথিবী ঘুরে আর একটা খুঁজে পাবেন না দিদি, নিদেন একটা ট্রায়েল দিন। কথাটা মিথ্যেও নয়। একবেলা ন্যাপার রান্না খেয়েই দিদিমণিদের মুখে তার প্রশংসা আর ধরে না।আর ন্যাপাকে পায় কে! তবু কাজটা ভাল হয়নি। ন্যাপার মনে কী আছে কে জানে! দুষ্টবুদ্ধি জাগতেই বা কতক্ষণ? বাড়ির ভিতরে তাে বনমালী আর বাইরের ফটকে দরােয়ান ছাড়া আর একটা ব্যাটাছেলে নেই। সারাদিন দিদিরা ইস্কুলে পড়ায়, বাড়ি-ঘর খাঁ-খাঁ করে, জিনিসপত্র এধারে ওরে ছড়ানাে পড়ে থাকে। ন্যাপার যা স্বভাব, বনমালীর মনে শান্তি নেই। অথচ মায়ের পেটের ভাইটাকে সে-ই যদি আশ্রয় না দেয় তাে আর কে দেবে?
যাক, তবু যতক্ষণ রান্নাঘরে কাজে মেতে থাকে ততক্ষণ রক্ষা। বাস্তবিক রাঁধে খাসা। ছেলেবেলা থকে ওর হাতে জাদু আছে, বেশ ভাল মাইনেতে সাহেব-বাড়িতে করে খেতে পারত, অথচ তবু যে কোন বুদ্ধি জাগে কে জানে! যাকগে, এখন রাতের খাবার জন্য টেবিলটা লাগাতে হবে, এসব ভেবে তাে কোন লাভ নেই। দরজার কোণা থেকে বনমালী লক্ষ্য করে দেখল, মােড়ের বাড়ির বুড়ি মাসিমা এসেছেন। সবাই মিলে টেবিল ঘিরে বসেছেন। কথাও কানে আসছে। মাসিমা একবার কথা বলতে শুরু করলে আর রক্ষা নেই, কিন্তু শুনতে বেশ মজাও লাগে । ‘হ্যাঁ, একদম চেঁছেছে সব নিয়ে এলাম ব্যাঙ্ক থেকে। আমাকে সন্দেহ করে এত বড় আস্পর্ধা।
-বুঝলি উমাশশী, প্রত্যেকটি জিনিস আমাব বাবা আমার মার জন্য গড়িয়ে দিয়েছিলেন। মা মরবাব সময় সমান দুই ভাগ করে আমার হাতে দিলেন। একটা ভাগ আমার, একটা ভাগ ভাদুর বউয়ের। সে একেবারে চুলচেরা ভাগ ভাই। জোড়া ভেঙে ভেঙে একটা বাংলা আমাকে একটা ওকে ; একটা ইয়ারিং আমাকে, একটা ওকে। যেমন দুটি রুমালে বেঁধে দিয়েছিলেন, তেমনি ব্যাঙ্কে তুলে ‘গিয়েছিলাম, এই দশ বছরে একবারও খুলিনি। ও রাও মফস্বলে ঘুরেছে, সাহস করে কিছু নেয়নি। এখন এখানে এসে বসেছে, অমনি বউ কি আমাকে সন্দেহ ‘করতে শুরু করেছে। আজ ভাবি রেগে গেছি, এই পুঁটুলিসুদ্ধ ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেব।’
উমাদিদি কিছু বলবার আগেই কম বয়সের মণিদিদি বলে উঠলেন, ‘কই মাসিমা, দেখি, দেখি কি রকম গয়না। মাসিমাও তাই চান, দুই পুঁটুলি খুলে টেবিলের উপর ঢেলে দিলেন। কালোপানা কাঠের উপর ছােট ছোট দুটি সোনার ঢিবির মত জ্বলজ্বল করতে লাগল। বনমালীর চোখ ঝলসে গেল। এত গয়না যে ওই থানকাপড়-পরা বুড়ি মাসিমার থাকতে পারে, এটা বনমালীর ধারণা ছিল না। ইস, লাল নীল সাদা সবুজ পাথর বসানাে একেবাবে তাল তাল সােনা গাে। এর দাম কত হাজার টাকা হবে কে জানে? এর ছোটপানা একটা বেচলেই বনমালীর মার ইজেকশগুলোর দাম উঠে যাবে। বুড়ি মাসিমা তাে আচ্ছা, এই রাজার ধনরত্ন তুলে রেখে দিয়ে মিলের থানকাপড় আর রবারের চটি পরে বেড়ায়, বুড়াে বয়স অবধি ইস্কুলে সেলাই শেখায়। একটা ভাল জিনিস কোনদিন কেনে , নয় ।
দিদিমণিরা জিনিসগুলাের উপর ঝুঁকে পড়ে নেড়ে চেড়ে দেখছে, এক-একটার উপর আলাে পড়ে অমনি ঝিলমিলিয়ে ওঠে। বনমালীর চোখ জ্বালা করে। ভয়ে ভয়ে একবার পিছন ফিরে দেখে, ভাগ্যিস, ন্যাপা রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে। বর্নমালীর বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। আঃ বাঁচা গেল, মাসিমা আবার ওগুলােকে পুঁটুলি বেঁধে ফেলছেন। মণিদিদির হাতে তখনও লাল পাথর বসানাে মালাটা রয়েছে। আপনার কী সাহস মাসিমা ! এত সব দেখে আমাদেরই চুরি করে নিতে ইচ্ছে করবে, আর আপনি ওই ব্যাগ নিয়ে সন্ধেবেলা এতটা পথ একা হেঁটে বাড়ি গিয়ে, তবে লােহার সিন্দুকে তুলবেন। ভয়ডর নেই আপনার প্রাণে ?
মাসিমাও অমনি পুঁটুলি বাঁধা বন্ধ করে একগাল হেসে বললেন, “আরে, আমার বাবার জ্বালায় কি আমাদের ভয়টয় পাবার জো ছিল! জানিস তাে বাবা মস্ত বড় উকিল ছিলেন, রাশি রাশি টাকা রােজগারও করতেন, দুই হাতে খরচও করতেন। সােনাদানায় রুপাের বাসনে আর তার চেয়েও দামী কাট-কাচের ফুলদানি আর ঝাড়লণ্ঠনে বাড়ি বােঝাই ছিল। এক একটা বিলিতি ছবিরই কত দাম ছিল। তার কিছুই নেই অবশ্যি এখন, রিটায়ার করে বাবা বিদেশ ঘুরে বেরিয়ে সব উড়িয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন, শুধু মার গায়ের গয়নাগুলাে ছাড়া। তা, যাঁ, কী যেন বলছিলাম, ভয় পাব কী, এই দৈত্যের মতাে দুটো কুকুর ছিল যে আমাদের। সারাদিন বাঁধা থাকত, সারা রাত ছাড়া থাকত। একটার রঙ ছিল হলদে, আর কালাে পোড়া হাঁড়ির মত এই প্রকাণ্ড মুখ, তার নাম ছিল রােলাে। হাঁউমাউ করে তেড়ে এলে তাই দেখে ভয়ে প্রাণ উড়ে যেত। কিন্তু আসলে কিছু বলত না শুধু ধারালাে ছুঁচলাে দাঁত দিয়ে কুটকুট করে জামার সব বাে তাম কেটে ফেলে দিত। সে এক মজার ব্যাপার। অন্যটার নাম ছিল কিম। কী সুন্দর সে দেখতে ছিল, সে আর কী বলব। এই লম্বা চকচকে লাল লােম সারা গায়ে, মখমলের মত চোখ, ঝালরের মত ল্যাজ । মুখে কিছু বলত না।
নিঃশব্দে ছুটে এসে এক লাফে টুটি কামড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করত। বাড়ির লােকদের কিছু বলত না। পাঁচ-সাতশাে টাকার জন্য এখানে কত চুরি-ডাকাতি খুন-খারাবির কথা শােনা যেত, আর আমাদের বাড়িতে হাত বাড়ালেই হাজার টাকার আসবাবে হাত ঠেকে যেত, অথচ ওই দুই কুকুরের জন্য কুটোটা কখনও চুরি যেত না। আরে তােরা কী বলিস, গােছ-গােছা জড়ােয়া চুড়ি হাতে দিয়ে মার সঙ্গে তােদের এই বাড়িতেই চায়ের নেমন্তন্ন খেয়ে কত রাত করে বাড়ি ফিরেছি। সঙ্গে ওই দুটো কুকুর থাকতে শুধু আমাদের কাছাকাছি কেন, এই ফুটপাথ দিয়ে লােক চলেনি। এখানে তখন স্যার গিরীন্দ্র থাকতেন। কত নাম করা লােকের যাওয়া-আসা ছিল এ-বাড়িতে, কী সুন্দর সাজানাে-গােছানাে ছিল । কী ভালই যে বাসতাম আমরা ওই কুকুর দুটোকে’ কানের কাছে একটা ফোঁস শব্দ শুনে বনমালী চমকিয়ে উঠল । ন্যাপার চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম জুলজুল করছে। যা ভাগ, তাের কাজকম্ম নেই নাকি ? ন্যাপা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘কারও অত সােনাদানা থাকা উচিত না, কারও না।’
‘ন্যাপা তাের পায়ে পড়ি। আবার কিছু পাকিয়ে বসিস না। এই সবেমাত্র ছাড়া পেয়েছিস, বুড়াে মাকে আর জ্বালানি বলছি, ও নাপা শোন বলছি।’ কিন্তু ন্যাপা এতক্ষণে হাওয়া। মাসিমা পুঁটুলি দুটোকে ততক্ষণে বেঁধে-ছেদে, হাতে ঝােলানাে কালাে কাপড়ের থলির মধ্যে পুরে, ছাতাটা হাতে নিয়ে উঠে পড়েছেন। পুটুলিটাকে তুলে ধরে বললেন, “তােরাই বল, কার বাবার সাধ্যি বুঝবে এই থলির মধ্যে আবার সাত রাজার ধন থাকতে পারে । আর ভয়ের কথা মনেও আনিস না, চল্লিশ বছর আগে, কুকুর দুটো মরে গেছে, কিন্তু ভয়টা আমাদের তখন থেকেই ঘুচে গেছে। তবে শরীরটা আজকাল বড় সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, এই যা। কুকুর দুটোর জন্য মাঝে মাঝে বড় মন-কেমন করে।’ মাসিমা চটি পায়ে দিয়ে বিদায় নেন, দিদিমণিরাও নিজেদের মধ্যে গয়নার বিষয় বলাবলি করতে উঠে পড়েন।
এতক্ষণ পরে বনমালী টেবিল লাগায়। তার মন ভাল নেই। ভয়ে প্রাণ উড়ে যাবার যােগাড়। রান্নাঘরে ন্যাপা নেই। খাবারদাবারগুলাে উনুনের পাশে গাদাগাদি করে গরমে রাখা। কোনমতে সে সব টেবিলে পৌঁছে দিয়ে, বনমালী উমাদিদিকে বলল, ‘আর আমি পারছি না দিদি, বড্ড শরীর খারাপ লাগছে ।’ বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে খিড়কি দোরের দিকে ছুটল। বেশি দূরে যেতে হল ন’। দরজা খােলার সঙ্গে সঙ্গেই ন্যাপা এসে গায়ের উপর আছড়িয়ে পড়ল। সবঙ্গ থরথর করে কাঁপছে, মুখে গলায় রক্তের ছােপ, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে । ধড়াস করে খিড়কিদোর বন্ধ করে বনমালী বলল, ন্যাপা, আবার কী সর্বনাশ করে এলি রে, বল্ শিগগির ? দেয়ালে ভর দিয়ে বিবর্ণ মুখে ন্যাপা বলল, ‘মাইরি বলছি, কারও অনিষ্ট করিনি। আমার পিছন পিছন কাউকে আসতে দেখলে দাদা? ‘কই, না তাে, কে আবার আসবে ?
রান্নাঘরের রকের উপর বসে পড়ে ন্যাপা বলল, কী জানি মনে ভাবলাম ওর গােটা পুঁটলি হাতিয়ে নিলেই আমাদের এ-জন্মের ভাবনা-চিন্তা ঘুচে যাবে। মােড়ের মাথায় গিয়ে ওই অন্ধকার জায়গাটায় লুকিয়ে থাকি, উনি পার হয়ে গেলে পর, পিছন থেকে মাথায় এক বাড়ি দিয়ে—অমন করে তাকাচ্ছ কেন, কাউকে কোনদিন প্রাণে মেরেছি বলতে পার ? মারিনি, কিছু করিনি। উনিও পার হয়ে গেছেন, আমিও সেই লাঠি তুলেছি, অমনি কোথা থেকে সে যে কী বিকট দুটো কুকুর এসে আমাকে আক্রমণ করল সে আর কী বলব দাদা। এই প্রকাও কালাে পােড়া হাঁড়ির মত মুখ, বুকের উপর বাঘের মত বাবা তুলে লাফিয়ে উঠে পট-পট করে জামার সব কটা বােম দাঁত দিয়ে ছিড়ে দিল গাে ! অন্যটা দেখতে কী সুন্দর, লাল লাল লম্বা লম্বা ললাম, আগুনের ভাটার মত চোখ করে আমার গলাটা ছিড়ে নিতে চেষ্টা করছিল।
ওইখানেই লাঠি ফেলে দিয়ে কোনরকমে পালিয়ে বেঁচেছি। উঃ! কোথেকে যে এল বুঝলাম না। তারপর দৌড়তে দৌড়তে একবার ফিরে দেখি ওনার সঙ্গে সঙ্গে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ঘরের দাওয়ায় গিয়ে উঠল। আশ্চর্যের বিষয়, এত কাণ্ড ঘটে গেল, বুড়ি একবার ফিরেও দেখল না। বনমালীর হাত-পা কাঁপছিল, মুখে কথা সরল না। কোন মতে ন্যাপাকে ধরে তুলল, ন্যাপা, প্রতিজ্ঞা কর, অমন কাজ আর করবি নে। কী বাচা বেঁচেছিস রে ন্যাপা! জানি, আমি নিজের কানে শুনলাম মাসিমা বলছেন, ওই কুকুর দুটো ওনাদের বড় আদরের ছিল, চল্লিশ বছর হল মরে গেছে। ও কি, ও ন্যাপা, আবার বসে পড়লি যে।
(সমাপ্ত)