মানুষ ভূতের গল্প

মানুষ ভূতের গল্প

আলোরানী হেরিকেনের দম কমিয়ে শুয়ে পড়তেই একটা ঘুম-ঘুম পুরুষশরীরের ফাঁদে আটকে যাচ্ছিল প্রায়, এমন সময়ে বাড়ির পেছনে খিড়কির দিকে কাঁপা-কাঁপা গলায় সন্দেহজন ডাকাডাকি, ‘ঘনশ্যাম। ঘনশ্যাম। ঘনা রে।‘

এক ঝটকায় ফাঁদ ছিঁড়ে উঠে বসল আলোরানী। বাইরে বারান্দার খানিকটা দরমা-বাতার ঘেরা কুঠুরি। শাশুড়ি তারাদাসীর ডেরা সেখানে। তার ভয়কাতুরে চাপা ধমক শোনা যাছিল, ‘যা। যা। ধুস ধুস।‘ বয়স বাড়লে ঘুম কমে। কানও খর হয়। গাছগাছালী থেকে পাতা খসে পড়লেও শাসায়। কিন্তু এটা কোনো পাতা খসার ঘটনা নয়, স্পষ্ট ডাকাডাকি এবং গলাটা অবিকল ঘিনশ্যামের বাবা বোটকেষ্টর। আলোরানীর ধাক্কা খেয়ে ঘনশ্যামের ঘুম ও প্রেম দুই-ই গেল। অভিমান করে বলল, ‘কী মাইরি খালি—‘ আলোরানী হেরিকেনের দম বাড়িয়ে চমকানো গলায় বল, ‘বাবার গলা মনে হচ্ছে যেন?’ সেই সময় আবার শোনা গেল, ‘ও ঘনা। ঘনা রে।‘

আলোরানীকে ছেড়ে ঘনশ্যাম লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। হাড়জ্বালানে মামলাবাজ বলে গাঁয়ে তার বাবার খুব বদনাম ছিল। আড়ালে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাসাও করা হত। কিন্তু আর তো লোকটা বেঁচে নেই। তাছাড়া বাবা খারাপ হতে পারে, ঘনশ্যাম মোটেও খারাপ নয়। কারও সাতে-পাঁচে থাকে না। বাবার রেখে-যাওয়া মামলা-মোকর্দমা নিয়েও তার মাথাব্যথা নেই। অন্যপক্ষ এই এক মাসেই ঝটপট একতরফা ডিক্রি পেয়ে যাচ্ছে। ঘনশ্যাম লাঠি হাতে বেরুল। পেছনে হেরিকেন হাতে তার বউ আলোরানী। তারাদাসী দরমাবাতা এবং তেরপলের ভেতর থেকে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, ‘স্বভাব না মলে। সকালে গেনুকে খবর দিস বরং’। গেনু ভূতের বদ্যি। ঘনশ্যাম মায়ের মুখে গেনুর নাম শুনে একটু ভড়কে গেল বটে, কিন্তু ফের করুণ স্বরে ‘ঘনা রে’ শুনে লাঠি বাগিয়ে হাঁক ছাড়ল, ‘কোন শালা রে?’

খিড়কির দরজার বাইরে থেকে অবিকল বটকেষ্টর গলা শোনা গেল, ‘আমি রে, আমি। খামোকা শালাসমন্দি না করে দুয়ার খুলবি না কী? শীতে অবস্থা কাহিল একেবারে।’ ঘনশ্যাম হকচকিয়ে গিয়েছিল। আলোরানী ঠোঁট কামড়ে ধরে কী ভাবছিল। তার হাতে হেরিকেন। হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে খিড়কির দরজা খুলে দিল এবং যে লোকটি বাড়ি ঢুকল, সে অবিকল বটকেষ্ট। সেই ময়লা ফতুয়া, খাটো ধুতি, কাঁচাপাকা গোঁফ, কাঁধে ব্যাগ। চোখে তেমনই জুলুজুলে চাউনি, চালাক-চালাক ঝিলিক।

ঘনশ্যাম প্রচণ্ড আতঙ্কের চোটেই লাঠি তুলেছিল। বটকেষ্ট খপ করে ধরে ফেলে খাপ্পা মেজাজে বলল, হতচ্ছাড়া বাদর বাবার মাথয় লাঠি তুলতে হাত কাঁপল না? তখন থেকে ডেকে ডেকে গলা ভেঙে গেল, আবার বাড়ি ঢুকতেই লাঠি। মারব গালে এক থাপ্পড়।’ ঘনশ্যাম লাঠি ছেড়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। সেই আদি অকৃত্রিম বাবা মনে হচ্ছে, কিন্তু— সে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে উঠল, ‘ধুস শালা। তাহলে ধার-দেনা করে কার বডি পুড়িয়ে এলাম?’ বটকেষ্ট থমকে দাঁড়িয়ে বল, ‘পুড়িয়ে এলি মানে?’

ঘনশ্যাম গুম হয়ে বল, ‘বেড খালি দেখে খোঁজ করলাম। বলল, মগগে গিয়ে দেখুন।‘ বটকেষ্ট হতভম্ব হয়ে বল, ‘মগগে গিয়ে আমায় দেখলি?’ ‘তাই তো মনে হলো।’ ঘনশ্যাম মিনমিনে স্বরে বলল, ‘হাসপাতালের লোকেরাও বলল। তা ছাড়া বডি ফুলে ঢোল।‘ বটকেষ্ট এতক্ষণে একটু হাসল। ‘আর বলিস নে। হাসাপাতালের যা খাবার। গত জন্মের ভাত উঠে আসে পেট থেকে। কাঁহাতক আর সহ্য হয়। শেষে কেটে পড়লাম।‘

আলোরানী মুখ টিপে হাসছিল। গৃহবধুর গলায় বলল, ‘গরম জল করে দিই। হাত-মুখ ধুয়ে নিন।’ তারপর শ্বশুরের পায়ে ঢিপ করে প্রণামও ঠুকল। বটকেষ্ট আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে বল, ‘আগে এক কাপ চা। রায়পুরে খগেনের বাড়ি খ্যাঁট দিয়ে বেরিয়েছি।’ বলে ছেলের দিকে ঘুরল। ‘মাথা ন্যাড়া করেছিলি দেখছি। তার মানে, বাপের ছেরাদ্দও করেছিস। হাঁদারাম।’ তারাদাসী তার ডেরায় চুপচাপ ছিল। হঠাৎ তার ফোঁপানি শোনা গেল। আলোরানী বলল, ‘আঃ। চুপ করুন তো। রাতদুপুরে কেলেংকারি করবেন না।’

বউমার তাড়ায় তারাদাসী থেমে গেল। ঘনশ্যাম গুম হয়ে বল, ‘কেলেংকারি হবেই সকালে, গাঁসুদ্ধু হইচই পরে যাবে। তুমি মাইরি খালি ঝামেলা বাড়াও—কোনো মানে হয়? হাসপাতালে ভালো লাগল না তো বাড়ি চলে আসবে। তা নয়, এক মাস নিপাত্তা। এদিকে কোন শালার বডির মুখে আগুন দিয়ে—ধুস্‌।’

বটকেষ্ট আস্তে বলল, ‘চেপে থাক দিন কতক। কাকপক্ষীটিও যেন টের না পায়।’ বলে সে বারান্দায় উঠল। ‘বিধবা’ স্ত্রীর দিকে ফিক করে হেসে বল, ‘কী? গোঁসাঘরে খিল দিলে নাকি? যা-যা বলতাম, ঠিক-ঠিক মিলে গেছে তো? বলেছিলাম না ঘনা ঘরে ঢুকবে আর তোমাকে এই পায়রার খোপে ঢোকাবে?’ ঘনশ্যাম ফুঁসে উঠল। ‘না জেনে খামোকা যা-তা বোলো না। মা নিজেই বলল, ‘তোরা ঘরে থাক। আমাকে বাইরে দে।’

মামলায় মামলায় প্রায় সর্বস্বান্ত বটকেষ্ট বউমা আর ছেলের জন্য বারান্দায় এই ঘেরাটোপের ব্যবস্থা করেছিল। আশা ছিল, হরেনের সঙ্গে টুকরো জমি নিয়ে মামলায় তার জয় হবে এবং তাই বেঁচে পাশে একখানা ঘর তুলবে। কিন্তু হাকিমের অভাবে আদালতে নাকি মামলার পাহাড় জমে উঠেছে। বটকেষ্ট হেরিকনটা তুলে তেরপলের পর্দা ফাঁক করে তার ‘বিধবা’কে দেখতে গেল। কিন্তু তারাদাসী লেপমুড়ি দিয়েছে। বটকেষ্ট খ্যা খ্যা করে বল, ‘ঢঙ। বিধবা হয়েছ তো বিধবা হয়েই থাকো, ছারাদ্দ-হওয়া লোকের বউ। যাগযজ্ঞ করে গণ্ডা কতক বামুন খাইয়ে আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে হবে, জানো তো? বউমা, আমাকে এখানে বিছানা করে দিও!’

ঘমশ্যাম পিতৃভক্তিতে গদ্গদ হয়ে বল, ‘না, না। তুমি ঘরে শোবে। আমরা বরং এখানেই শোব। এখনও তত শীত পড়েনি! সকালে শ্বাশুড়ির সাড়াশব্দ না পেয়ে আলোরানী তেরপলের পর্দা তুলেছিল। তারাদাসীর বিছানা খালি। বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরেও পাত্তা পেল না। গাঁয়ের একটেরে বাড়ি। পড়শিদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে ফিরে এল আলোরানী। কেউ দেখেনি তারাদাসীকে। তখন উদ্বগ্ন ঘনশ্যাম বেরুল মায়ের খোঁজে। কিছুক্ষণ পরে ঘুরে এসে সে গম্ভীর মুখে বলল, জগা, ভোরের বাসে মাকে চাপতে দেখেছে। বাবাকে মাইরি কী বলব? খালি ঝামেলা বাড়ানো স্বভাব।’

ঘরের ভেতর তক্তপোশে বসে বটকেষ্ট চা খাচ্ছিল এবং পুরনো পোকায় কাটা দলিল-পরচা দেখছিল। ছেলের কথা কানে যেতেই চাপা গলায় ডাকল, ‘ঘনা। শুনে যা।’ ‘তোর মা কেটে পড়েছে তো?’ বটকেষ্ট বাঁকা হাসল। ‘জগা বলল না কোন বাসে চাপতে দেখেছে?’ ‘সাঁইথের বাসে। কেন?’ বটকেষ্ট তারিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি ভাবছিলাম হাসাপাতালে গিয়ে ঢুকবে নাকি। সাঁইথে যাওয়া মানে রোঘোড় বাড়ি। যত্নআত্যি পাবে। তোর মায়ের কিছু কিছু ব্যাপারে টনটনে বুদ্ধি। আয়, বস্‌ এখানে।’ ঘনশ্যাম অনিচ্চছার ভঙ্গিতে বসল। সিন্দুক থেকে এসব পোকায় কাটা কাগজপত্র বের করে খুঁটিয়ে দেখা তার মামলাবাজ বাবার বরাবরকার অভ্যাস। মুখ তেতো করে বল, ‘আবার ওই মড়া ঘাটতে বসেছে?’

‘স্বভাব যায় না মলে।’ বটকেষ্ট ফিক করে হাসল। তোর মা কাল রাত্তিরে বেশ বলছিল। তোর মায়ের কথাটা মনে ধরার মতো। তুই ছেরাদ্দ করে ন্যাড়া হয়েছিস। তোর মা শাঁখা ভেঙে সিঁদুর মুছে বিধবা হয়েছে। তার মানে, আমি এখন মরা মানুষই বটে। কাজেই চেপে যা।’ ‘চাপবটা কি?’ ঘনশ্যাম জানতে চাইল। বটকেষ্ট জুলজুলে চোখে ঝিলিক তুলে বল, ‘কাল রাত্তিরে বললাম কী তোকে? আমি যে বেঁচেবত্তে আছি, একেবারে চেপে যা।’ ‘হু।, তারপর?’ ‘তেঁতুলতলার জমিতে একখানা ঝাণ্ডা পুঁতে দিয়ে আয়।’ ঘনশ্যাম জোরে মাথা নেড়ে বল, ‘তোমার মাথা খারাপ? হন্নাদা আমার বডি ফেলে দেবে। কলাই বুনে কাঁটার বেড়া দিয়ে রেখেছে—নিজে গিয়ে দেখে এসো গে না।’

বটকেষ্ট একটু ভেবে বল, ‘কাঁটার বেড়া দিয়েছে নাকি? যাচ্ছলে। মামলা এখনও ঝিলে আছে। মগের মুল্লুক পড়ে গেছে দেখছি। তোর বাধা দেওয়া উচিত ছিল।’ ঘনশ্যাম চটে গেল। ‘তুমি গিয়ে ঝাণ্ডা পুঁতে দিয়ে দেখ না, কী হয়। হন্নাদা এখন গাঁয়ের মাথা হয়েছে। পঞ্চায়েতের মেম্বার। এসব আমার দ্বারা হবে না।’ ‘তুই এরকটা অকম্মা।‘ বটকেষ্টো চটল। ‘তোরই ভালোর জন্য চিন্তা-ভাবনা করে বাড়ি ফিরে এলাম। নৈলে অ্যাদ্দিন গয়া-কাশী-মথুরা করে দিব্যি ঘুরে বেড়াতাম। সংসারে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল, জানিস?’ ঘনশ্যাম আঙুল খুঁটতে থাকল। বটকেষ্ট চাপা গলায় ডাকল, ‘বউমা! শোনো তো!’

আলোরানী মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরে ঢুকল। সে বারান্দা থেকে কান করে সব শুনছিল। বলল, ‘কাকে কী বলছেন? সেদিন তালপুকুরে মাছ ধরে সব্বাই যে-যার ভাগ নিয়ে বাড়ি ঢুকল। মাঝখান থেকে আমি চ্যাঁচামেচি করে গলা ভাঙলাম। আপনার ছেলে উলটে আমাকে বকাঝকা করে ঠেলতে ঠেলতে ‘বাজে কথা কথা বোলো না!’ ঘনশ্যাম বাধা দিয়ে বলল, ‘মেয়েছেলে—অপমান করে বসলে খুব ভালো হতো? চারটে পুঁটিমাছের জন্য ঝামেলার মানে হয় না।’ ‘পুটি নয়, বাবা!’ আলোরানী শ্বশুরকে হাত তুলে মাছের সাইজ দেখালো। ‘এত-এত বড়ো পোনা।’ বটকেষ্টর গলার ভেতর বলল, ‘এক আনার শরীক আমি। আচ্ছা দেখছি। ফিরে যখন এসেছি, একটা এস্পার-ওস্পার না করে ছাড়ছি না।’ আলোরানী শ্বশুরের সায় পেয়ে উৎসাহে বলল, ‘জানেন বাবা? হাসপাতালের ব্যাপারটাতেও সন্দেহ হয়েছিল। যত বলি, কাকে দেখতে কাকে দেখেছ, তত বলে, আমাকে বাবা চেনাচ্ছ?’

বটকেষ্ট অভিমানী শ্বাস ফেলে বলল, ‘আমাকে যদি চিনবে, তাহকে এ অবস্থা হয়? যাক্‌ গে। বউমা, তোমাকে একটা কাজের ভার দিতে চাই। ঘনার দ্বারা কিস্যু হবে না।’ আলোরানী ঝটপট বল, ‘ঝাণ্ডা পুঁততে হবে তো? পুঁতে আসব। আমি সব পারি—আপনি কিছু ভাববেন না।’ ঘনশ্যাম নড়ে উঠল, ‘মারা পড়বে বলে দিচ্ছি। মেয়েছেলের এত সাহস ভালো নয়। শালা হন্নাদা বড্ড ঢ্যামনা!’ খপ্‌ করে তার কান ধরে বটকেষ্ট ঝাঁকুনি দিল। ‘চো-ও-প্‌! কাল রাত্তির থেকে শুনছি আমার মুখের সামনে খালি শালা-টালা মুখখিস্তি। একটা মাস আমি ছিলাম না, তাতেই এই? সত্যি সত্যি মলে মুখ থেকে নাদি বেরুবে হতচ্ছাড়ার।‘

ঘনশ্যামের পিতৃভক্তির মূল কারণ, ছোটবেলা থেকেই তার কাছে বাবা একটা বিপজ্জনক সাংঘাতিক জিনিস। তা ছাড়া বটকেষ্টর এক সময় গাঁয়ে প্রচণ্ড দাপটও ছিল। বউয়ের সামনে কান ধরায় অপমানের চোটে ঘনশ্যাম শেষ পর্যন্ত কী আর করে, খি খি করে হাসতে লাগল। আলোরানী একটু লজ্জা পেয়েছিল অবশ্য। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘনশ্যাম বল, ‘খুব হয়েছে। কান ছাড়ো, বেরুব।’

কান ছাড়ার সময় শেষ ঝাঁকুনি দিয়ে বটকেষ্ট বলল, ‘যেখানে যাবি যা। তোর আশা কখনও করিনি। কিন্তু সাবধান, আমার কথা চেপে রাখবি। চাউর করলেই কী হবে জানিস?’ উঠে দাঁড়িয়ে ঘনশ্যাম বলল, ‘বাড়ি থেকে বের করে দেবে তো? দিও।’ ‘না।’ বটকেষ্ট শক্ত মুখে বলল, ‘তাহলে সত্য-সত্যি মরব।’ ঘনশ্যাম একটু অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে?’ মাথার ওপরকার কড়িকাঠ দেখিয়ে বটকেষ্ট বলল, ‘ওখান থেকে ঝুলব বুঝতে পারছিস তো? এক হাত জিভ করে ঝুলে থাকব।’ ঘনশ্যাম ভয় পেয়ে জিভ কেটে বলল, ‘ধুস্‌! খালি আজেবাজে কথা।

বটকেষ্টর মরার খবর পেয়ে হরেন নিশ্চিন্ত হয়েছিল। টুকরো জমিটা নিয়ে জ্ঞাতি বটকেষ্টর সঙ্গে মামলা চলছিল। জমিটার তিন দিকে আগাছা জঙ্গল, একদিকে কয়েকটা ঝাঁকড়া প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছ। তার ওধারে একটা পুকুর। ভাদ্রমাসের ধান তুলতে থানাপুলিশ হয়ে গেছে। সেই ফৌজদারি মামলাও ঝুলছে আদালতে। আশ্বিনে হঠাৎ কী অসুখে ভুগে বটকেষ্ট শহরের হাসপাতালে গেল এবং মারাও পড়ল। শ্রাদ্ধে দয়া করে হরেন ঘনশ্যামকে কিছু নগদ টাকাকড়িও দিয়েছে। শর্ত হলো, ঘনশ্যাম আদালতে যাবে না। তারপর হরেন জমিটাতে কলাই বুনে দিয়েছে। সারের জোরে দেখতে দেখতে ঝাঁপালো সবুজ হয়ে উঠেছে জমিটা। গরু-ছাগলের বড়ো উপদ্রপ এদিকটাতে। তাই কা৬টা-ঝোপের বেড়া দিয়েছে। এবেলা-ওবেলা এসে একবার করে দেখে যায় হরেন। তার কাছে খুব গর্বের জিনিস এই মাটিটুকু।

বিকেলে বাসরাস্তার ধারে গজার দোকানে হরেন চা খাচ্ছিল। সেই সময় তার মেয়ে পাত্তি হাপাতে হাপাতে এসে খবর দিল, ‘বাবা! শিগগির এস। তেঁতুলতলার কলাইয়ের ক্ষেতে ঘনাকাকায় বউ ঝাণ্ডা পুঁতেছে।’

ঝাণ্ডা পোঁতার ব্যাপারটা পাড়াগাঁয়ে ইদানিং রীতিমত ঘটনা। কিন্তু হরেনের বিশ্বাসই হলো না। ঘনশ্যাম তার বাবার মতো নয়। কোনো ঝামেলায় থাকে না। তবে তার বউটা একটু তেজি, একথা ঠিকই। তাই বলে তার ঝাণ্ডা পোঁতার সাহস হবে, এটা অবিশ্বাস্য—এবং সেও কিনা হরেনের দখল করা কলাইবোনা জমিতে? হরেন বলল, ‘যাঃ!’ ‘সত্যি বাবা!’ পাত্তি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মা দেখেছে। আমি দেখলাম। মা বলল, ‘শিগগির তোর বাবাকে খবর দে।’

হরেন হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, ‘বাড়ি যা দিকিনি। কাজ নেই কম্ম নেই, খালি পাড়া-বেড়ানো। ঝাণ্ডা পুঁতেছে তো কী হয়েছে? বাড়ি যাবার সময় উপড়ে ফেলে দিয়ে যাব।’ পাত্তি মনমরা হয়ে চলে গেল। জগা বলল, ‘পেছনে লোক জুটিয়েছে হে হরেন! নৈলে ঘনার বউয়ের এত সাহস হতো না।’ হরেন চটে গিয়ে বলল, ‘তুমিও মাইরি যেন কী! লোক জোটাবে! এত শস্তা? লোক জটাতে হলে মালকড়ি দরকার। ঘনার হাঁড়ির অবস্থা ঢনঢন। কালই দেখবে মুনিশ খাটতে নেমেছে!’

জগা বলল, ‘তোমার বেপাট্টির লোক হলেই জুটবে। আজকাল তো একরকমই হয়েছে।’ গোঁ ধরে হরেন বলল, ‘বেপাট্টি? এ গাঁয়ে আমার বেপাট্টি হবে কোন শালা? সবগুলোকে তো দেখলাম। পায়ের তলায় এসে মুণ্ডু কাত করেছে। মরা মানুষের নিন্দে করতে নেই—বটকেষ্ট সম্পক্কে জ্যাঠাও ছিল বটে, তবে সেও গেছে, সব ঠাণ্ডাও হয়েছে।’ জগা কথা বাড়ালো না। চায়ের দোকানে এ সময়টা খদ্দেরের ভিড় বেড়ে যায়।

চা শেষ করে হরেন উঠল। কিছুক্ষণ দোনামনা করে রাস্তার নয়ানজুলির দিকে ঘুরল। শর্টকাটে যাওয়ার পথে বাধা নয়ালজুলির জল। শেষ বেলার আলোর গায়ে কুয়াশার ছাপ পড়েছে। এখান থেকে তেঁতুলতলার জমিটা দেখা যায় না। অনেকটা ঘুরে বাঁধের ওপর দিয়ে মাঠে নামল হরেন। গাঁয়ের শেষ দিকটায় ঘন গাছগাছালি। জমিটার কাছাকাছি যেতে দিনের আলো কমে এল আরো। তেঁতুলতলা পৌঁছেই চোখ জ্বলে গেল হরেনের। সত্যিই কলাইয়ের জমির মাঝখানে পোঁতা কঞ্চিতে লটকানো একটা ঝাণ্ডা। খুঁজতে খুঁজতে একখানে কাঁটার বেড়া উপড়ানোও চোখে পড়ল। হরেন হুঙ্কার দিল, ‘তবে রে হতচ্ছাড়ি।’ হুঙ্কারের লক্ষ্য ঘনশ্যামের বউ।

তারপর সে মসমস করে জমিতে ঢুকে ঝাণ্ডাটা ওপড়াল। কঞ্চিটা দুমড়ে মুচড়ে এবং কাপড়ের ফালিটা ফালাফালা করে ছুঁড়ে ফেলল জমির বাইরে। আগের মতো কাঁটার বেড়ার ওপড়ানো অংশটা কোনো রকমে আটকে সে তেঁতুলতলায় উঠে এল। রাগী চোখে তাকিয়ে রইল জমিটার দিকে। ঠিক এই সময়ে তেঁতুল্গাছের ওপর থেকে কেউ ডাকল, ‘হন্না নাকি রে! ও হন্না!’ হরেন ভীষণ চমকে উঠেছিল। মাথার ওপরকার ঘন ডালপালার ভেতর থেকে চেনা—খুবই চেনা গলায় কেউ তাকে ডাকছে। হরেন মুখ তুলতেই আবছা আঁধারে একটা মূর্তিও দেখল, একটু ওপরে মোটা ডালে বলে দুটো ঠ্যাং দোলাচ্ছে। হরেন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ক্কে ক্কে?’

বটকেষ্ট দুটো ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে বলল, ‘ন্যাকা, চিনেও চিনতে পারছিস না—কে কে করছিস? সোজা ঝাঁপ দিয়ে পড়ব। তারপর ঘাড়টি মটকে দেব। আর কখনো যদি এই জমির তল্লাটে দেখেছি তো— হরেন বানবাদাড় ভেঙে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। একটু পরে বটকেষ্ট চাপা গলায় ডাকল, ‘বউমা! মইটা নিয়ে এস। নামব।’ আলোরানী একটু তফাতে হাল্কা একটা মই আড়ালে বসে ছিল। এসে শ্বশুরকে গাছ থেকে নামালো। বটকেষ্ট খি খি করে হেসে বলল, ‘খুব জব্দ হয়ে গেছে হন্না। চলো, এখনই এখান থেকে কেটে পড়া ভালো।’

একটু রাত করে ঘনশ্যাম ফিরল। মুখটা গম্ভীর। বউকে দেখে বলল, বাবা কী যে ঝামেলা করে মাইরি। সন্ধাবেলা হন্নাদা তেঁতুলগাছে নাকি বাবাকে দেখেছিল। বাড়ি অজ্ঞান হয়ে যায়। শেষে একদল লোক লাঠিসোটা টর্চ হ্যাজাগ নিয়ে তেঁতুলতলায় খুব খোঁজাখুঁজি করেছে। খবর শুনেই লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমি তো ভয়ে সারা। একটা কিছু সন্দ করে আমাদের বাড়ি এলেই কেলেঙ্কারি হতো।’ আলোরানী নির্বিকার মুখে বলল, ‘হতো না।’ ‘হতো না মানে?’ ঘনশ্যাম ফুঁসে উঠল। ‘এসেই বাবাকে দেখতে পেত। তারপর—’ ‘বাবা তখনই চলে গেছেন।’ ঘনশ্যাম অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী!’ ‘রায়পুরে রাত্তিরে থাকবেন। সকালে ওখান থেকে সাইঁথে চলে যাবেন।‘

আলোরানী মুখ টিপে হাসছিল। ঘনশ্যাম একটু উদ্বিঘ্ন হয়ে বলল, ‘মা যদি ছোটমামার বাড়ি গিয়ে থাকে আর বাবা সেখানে হাজির হয়, আবার এক ঝামেলা।’ আলোরানী বলল, ‘কিসের ঝামেলা?’ ‘ধুস! বোঝো না কিছু।’ ঘনশ্যাম বিরক্ত হয়ে বলল। ‘মা তো বিধবা হয়ে আছে এখনও!’ আলোরানী হাসতে লাগল। ‘সে তুমি ভেবো না। তোমার মা সব শাড়ি-গয়না গুছিয়ে নিয়েই গেছেন। কিচ্ছু খুঁজে পাইনি ওঁর ঘরে। আর শাঁখা-সিঁদুর? বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।’

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত