রানার মাসিমার ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। রানাই তার নয়নের মণি। আর সেই সুবাদে আমরা রানার দু’তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও যথেষ্ট স্নেহ আদর নিমন্ত্রণ পাই রানার মাসিমার কাছ থেকে। মাসিমাদের বাড়ি আছে বিহার আর ওড়িশাতে—সব স্বাস্থ্যকর স্থানে। উত্তরবঙ্গে জমিজমা ছিল, এবার একটা বাড়িও কিনেছেন সেখানে। গরমের ছুটিতে সেই নতুন বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রণ পেয়েছি তার কাছ থেকে। মাসিমার সঙ্গে মায়েরও খুব ভাব হয়ে গেছে। ঠাকুমাও খুব স্নেহ-সহানুভূতির সঙ্গে দেখেন মাসিমাকে।
মাসিমার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুমা বলেছেন, এমন ধনী ও রূপবতী অথচ এমন অমায়িক ভালাে মানুষ দেখিনি। যাই হােক আমরা বেড়াতে যাবার ব্যাপারে বাবার আপত্তি টিকল না। ঠাকুমাই আমার পক্ষ নিয়ে বলে দিয়েছেন—কি এমন জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের পড়া পড়ছে! সবে তাে ক্লাস এইট। যাক, বেড়িয়ে আসুক। এরপরে উঁচু ক্লাসে উঠলেই বরং যেতে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া মেয়ে অমন করে বলে গেছে। মাসিমা তাঁর আন্তরিকতা দিয়ে ঠাকুমাকে এমন মুগ্ধ করেছেন যে ঠাকুমা তাকে মেয়েই বলেন।
নির্দিষ্ট দিনে দার্জিলিং মেল-এ আমরা রওনা হলাম। বেড়াতে যাবার আনন্দে-উত্তেজনায় সারারাত ঘুমােতেই পারলাম না। পরদিন ভােরে নামা হল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। তারপর জনবহুল রাস্তা ছেড়ে প্রায় মাইলটাক পথ এসে খােয়ামাটির রাস্তার উপরেই মাসিমাদের নতুন বাড়ি। দোতলা, বেশ বড় বাড়ি, কিন্তু পুরােনাে। সঙ্গে আম, জাম, কাঁঠাল, কত রকমের লেবু, পেয়ারা, বেল, কমলালেবু, দুটো বড় স্বর্ণচাপার গাছ নিয়ে বিশাল বাগান। চাঁপাফুলের গন্ধ তাে রয়েছেই সেই সঙ্গে আরও যেন একটা মিষ্টি কি গন্ধে সারাক্ষণ ম-ম করছে বাতাস। একটু দূরে একা একা দাঁড়িয়ে আছে একটা শিমুল গাছ। কলকাতার ছেলে আমরা এত বড় বাগান পেয়ে আত্মহারা।
এই বিশাল এলাকাসহ বাড়িটা নাকি মেলােমশাই কিনেছেন প্রায় জলের দামে। বাড়িটা অযত্নে অব্যবহারে পড়ে ছিল। তাই সারানাে, রঙ করা ইত্যাদিতে অনেক খরচ হয়েছে। জল, ইলেকট্রিকের ব্যবস্থাও করেছেন নতুন করে। এত সুন্দর বাড়ি, কিন্তু এ বাড়িতে কাজ করার লােক একটাও পাওয়া গেল না। অল্প কয়েকদিনের ব্যাপার বলে হয়তাে কেউ গরজ দেখাচ্ছে না। মাসিমার সঙ্গে সব সময়েই দুজন কাজের লােক, রাম আর বাসনা থাকে। এখানেও তারা এসেছে, তাই কোনাে অসুবিধা হল না। নতুন বাড়িতে ঢােকা মানেই তাে পুজোপাঠ খাওয়া-দাওয়া। প্রয়ােজনের চাইতে মাসিমার আয়ােজন থাকে সব সময়েই বেশি। আজও তাই হয়েছে। অথচ অতিরিক্ত খাবার-দাবার বিলিয়ে দেবার মতাে গরিব মানুষও পাওয়া যাচ্ছে না।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে মেলােমশাই কি কাজে দার্জিলিং চলে গেলেন। ফিরে আসবেন আজই। আমরা কলকাতা ফেরার আগে যে দার্জিলিং যাব, সে ব্যবস্থাও করে আসবেন। এটাও দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার। কারণ খুব ছােটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে কবে দার্জিলিং এসেছিলাম, তা এখন আর মনে নেই। সন্ধ্যার মুখে পাওয়ার কাট হল। মাসিমার কাজের লােক রাম পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে ফেলল, বাসনা জ্বালল দুটো বড় হ্যারিকেন। একটা রেখে এল সিঁড়ির মুখে। অন্যটা ড্রইংরুমে। পেট্রোম্যাক্স থাকল ঠাকুরঘরের সামনে। মেসোমশাই আগেই বলেছিলেন জেনারেটরের কথা, মাসিমাই বারণ করেছেন। বলেছেন, পরের বার একটা কিনে নিও। এই কটা দিনের জন্য আর এত ব্যস্ত হবার দরকার নেই।
মাসিমা ঠিক কথাই বলেছেন, পরে লাগবেই। কারণ মেসোমশাই তাঁর এরিয়া অফিস করবেন এই বাড়িটা ভবিষ্যতে। বাড়িতে এখন আমি, রানা, সৌরভ-তিন বন্ধু, মাসিমা আর তার রাম ও বাসনা। এরই মধ্যে বাড়ির সব কটা আলােই একসঙ্গে হঠাৎ টুপ করে নিভে গেল। আমরা অন্ধকারে ডুবে গেলাম যেন। মাসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, ও রাম, দেখ তাে আললাগুলােয় তেল-টেল আছে কিনা। তােরা একটা কাজও ঠিক করে করতে পারিস না। বাবুর ঘরের বড় টর্চটা নিয়ে আয় চটপট। আলােগুলাের সঙ্গে ক’টা বড় মােমবাতিও জ্বেলে দিস। প্রথম দিনেই দেখ তাে কী অবস্থা! রাম আর বাসনা ব্যস্তহাতে আলােগুলাে ফের জ্বেলে ফেলল। সেই সঙ্গে ইয়াব্বড় তিন-চারটে মােমবাতিও। তারপর রাম বলল, মা তেল তাে সব বাতিতেই ভরা ভর্তি রয়েছে।
মাসিমা ঠাকুরঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ দিয়েছিলেন হঠাৎ তার খেয়াল হল প্রদীপটা কে যেন তুলে নিয়ে গেছে। মাসিমা বিরক্ত হয়ে ভাবলেন এ নিশ্চয়ই বাসনার কাজ। হাতের কাছে দেশলাই না পেয়ে ঐটাই তুলে নিয়েছে। কিন্তু ফিরিয়ে দেবে তাে! যতসব অলুক্ষণে কাজকর্ম। ঠাকুরঘর অন্ধকার করে কেউ প্রদীপ নেয়! বিরক্ত কণ্ঠে তাই ডাকলেন, বাসনা, বাসনা? মাসিমার ডাকে বাসনা রান্নাঘর থেকে হাতের কাজ ফেলে ছুটে এল, বলল, কি বলছ মা? কি বলছি? প্রদীপটা কোথায় রেখে এলি ? আমি প্রদীপ নিয়েছি! কি যে তুমি বল না মা! তখনই বলেছিলুম, এই শরীলে তুমি এত ধকল নিওনি, কি দেখতে কি দেখছ! মাসিমা একটু থতমত খেয়ে বললেন, নে আর খবরদারি করতে হবে না, প্রদীপটা কোথায় রেখে এলি তাই দেখ।
ঐ তাে পিলসুজের উপরেই রয়েছে মা। বলতে বলতে বাসনা চলে গেল। বাসনার কথা অবশ্য মিথ্যে নয়, কাজের লােক না পাওয়ায় মাসিমার পরিশ্রম হয়েছে খুবই হয়েছে বিশ্রাম, না হয়েছে সময়মতাে খাওয়া-দাওয়া। ভুল তাে তাঁর হতেই পারে। আমরা তিনবন্ধু বাগানের দিকের দোতলার বারান্দায় বসে গল্প করছিলাম। মাসিমা, বাসনা ওরামের কথােপকথন কমবেশি শুনেছি, যদিও আমাদের দৃষ্টি ছিল আধাে জ্যোৎস্নামাখা বাগানের দিকে। ভারী সুন্দর দুটি মেয়ে, হয়তাে আমাদের মতােই বয়স হবে, অনেকক্ষণ থেকে চাপাগাছের ওদিকটায় খেলা করছিল। এখন তাদের দেখতে পাচ্ছি না। আমরা অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কি দুষ্টু আর সাহসী মেয়ে রে বাবা! কখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তবু বাড়ি ফেরার নাম নেই। ওদের বাড়ির লােকেরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।
একটু পরে পরিষ্কার জ্যোৎস্নায় ভরে গেল চারিদিক। শুনেছি এখান থেকে নাকি এমন জ্যোত্মারাতে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখা যায়। কিন্তু আমরা তাে দেখতে পাচ্ছি না! কি জানি হয়তােতিন-চারতলা বাড়ির ছাদে উঠলে দেখা যায়। এতক্ষণে কারেন্ট ফিরে এল। এবার আমরা ঠিক করলাম ছাদে উঠে নগাধিরাজ হিমালয়ের তুষার শােভিত শৃঙ্গগুলাে দেখার চেষ্টা করব। সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে দেখলাম সেই মেয়ে দুটি ছাদ থেকেই নেমে আসছে। ছাদের দরজায় তালা দেওয়া। রানা গেছে রামের কাছ থেকে চাবিটা আনতে। অবাক হয়ে জিগ্যেস করতে যাব—ওরা ওপরে কি করছিল, না মেয়ে দুটি আমাদের ধাক্কা দিয়েই নীচে নেমে গেল। আর তক্ষুনি রানাও চাবি নিয়ে দৌড়ে এল। বলল—কি জোর একটা হাওয়া বইল রে! ছাদে আর গিয়ে কাজ নেই,বৃষ্টি আসতে পারে।
ছাদে যাওয়ার গরজ কারুরই আর থাকল না। বসার ঘরে চলে এলাম তিনজনে। ওদিকে মাসিমা রান্নায় ব্যস্ত টের পাচ্ছি। বাসনা মাসিমার হাতে হাতে যােগান দিচ্ছে। রাম বিছানাপত্র রেডি করছে। এক ঘরে শােব আমরা তিনবন্ধু একই খাটে, সেই ঘরের মেঝেতে একপাশে রামের বিছানা। অন্য ঘরে মাসিমা আর তার বাসনা। মেসোমশাইয়ের ঘর আলাদা। মাসিমা একপ্লেট ফিশ ফ্রাই নিয়ে এলেন, বললেন, খেয়ে দেখাে কেমন হল? এখন আর বেশি খেয়ে কাজ নেই। তােমাদের মেসোমশাই এলে খেতে দিয়ে দেব, নাকি আগে খাবে? না না, মেসােমশাই ফিরে এলে একসঙ্গে খাব, দার্জিলিংয়ের গল্প শুনতে শুনতে। আমরা প্রায় একই সুরে বলে উঠলাম তিনজনেই। বেশ, তবে তাই হবে। হ্যা, ভালাে কথা, তােমাদের সঙ্গে ওদের পরিচয় হয়েছে? ভারী মিষ্টি মেয়ে দুটি। কি লাজুক!
মাসিমার কথায় আমরা মাথা নাড়লাম, হয়নি। রানা বলল, বাগানে ওদের আমরা দেখেছি। মাসিমা নিজের কাজে চলে গেলেন। কিন্তু আমাদের সবারই কেমন যেন একটা গা-ভারী অবস্থা, সবাই সবাইয়ের গা ঘেঁষে বসতে চাইছি। কেন এমন হচ্ছে! গাছগাছালির মধ্যে এতবড় বাড়িতে মাত্র এই ক’জন লােক বলে হয়তাে এমন একটা ভাব হতেও পারে। পরে জানতে পারি আমাদের চোখ এড়িয়ে মেয়ে দুটো কখন মাসিমার কাছে ঠাকুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাসিমা ওদের দু’খানা থালায় সাজিয়ে দিয়েছিলেন প্রসাদ মিষ্টি পায়েস। কিন্তুএত লাজুক যে মাসিমার সামনে খেতে বসছিলই না। মাসিমা তাই হেসে ওখান থেকে সরে এসেছিলেন,যাতে ওরা ভালাে করে খেতে পারে। বাসনাকে বলেছিলেন, বাসনা যা তাে, বলে আয় ওরা যেনযাবার সময় দেখা করে যায়।
বাসনার খুব ভুলাে মন। সে তক্ষুনিই ঠাকুরঘরে গিয়েছিল, কিন্তু মেয়ে দুটিকে দেখতে পায়নি। মাসিমাকে সে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল। কাজের ব্যস্ততায় ব্যাপারটাও চাপা পড়ে গিয়েছিল। ঠিক এরকম সময় মেসােমশাই ফিরে এসেছিলেন আর আমরা দার্জিলিংয়ের গল্পে কথায় মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। মাসিমা যে একা হাতে কত রান্না করেছেন। কোনটা ফেলে কোনটা খাই! খেতে দিতে দিতেও মাসিমা বার দুয়েক বললেন মেয়ে দুটির কথা। মেসােমশাইকে বললেন,কালই মেয়ে দুটির মা-বাবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে হবে। হাজার হােক প্রতিবেশী তাে। আমরা তিনবন্ধু নীরবে দৃষ্টি বিনিময় করলাম। ভাবলাম মাসিমার পুষ্যি বাড়ল আর কী। একটু হিংসেও যে হল না মনে মনে তা নয়। তবে ভালােও লাগল, ভারী সুন্দর পরী পরী দেখতে। বােধহয় যমজ বােন। যদি বন্ধুত্ব হয় ভালােই।
প্রথম দিন খাওয়া-দাওয়া চুকতে বেশ রাতই হয়ে গেল। সবাই যে যার ঘরে ঢুকলাম নিশ্চিন্ত ঘুমের আশায়। কিন্তু কেউই ঘুমােতে পারলাম না। প্রথমে মনে হল যেন বাড়িতে অনেক লােক ঢুকে পড়েছে, দুপদাপ পায়ের শব্দ। রাম তাে ‘চোর চোর’ বলে চেঁচিয়েই উঠেছিল। মাসিমা- মেসােমশাইকে আমরা ডেকে সব বললাম। সারা বাড়ির সব আলােগুলাে জ্বালা হল, তন্ন তন্ন করে খোজা হল চারদিক—কেউ কোথাও নেই। দরজা-জানলার ছিটকিনি, খিল, চাবি সব ঠিক আছে। মেসােমশাই মাসিমাকে বললেন, খাটাখাটনি করে রাম বেঘােরে ঘুমিয়ে ছিল, ঘুমের ঘােরে স্বপ্ন- টপ্ন দেখে থাকবে। কোথায় কি! চল শুয়ে পড়া যাক।
মাঝরাত পেরিয়ে আবার ঘটল একই ঘটনা। এবার শুধুমাত্র ঠাকুরঘরের দিকেই। আবার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হল কোথাও কিছু নেই। মাসিমা খুব ভয় পেয়ে গেলেন। বাসনাকে নিয়ে তিনি ঢুকলেন আমাদের ঘরে। মেলােমশাইকেও বাধ্য করলেন আমাদের ঘরে শুতে। একটা কেমন গা-ছমছম ভাব, একটু একটু করে সবাই তবু ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙল সারাবাড়ি জুড়ে দাপাদাপির আওয়াজে। তারপর কখনাে দরজা খােলার শব্দ, কখনাে পাতকুয়ােয় বালতি ফেলে জল তােলার আওয়াজ হতে থাকল। সবাই জেগে উঠেছে, ঘরে হলঘরে আলাে জ্বলছে। কি যে করা যায়, করা উচিত আমরা কেউই ভেবে পাচ্ছি না। হাতের কাছে একটা ছােট লাঠি রেখে মেসােমশাই জেগে বসে রইলেন। রামের তাে ভয়ে মুখ কালাে, বাসনার মুখ ফ্যাকাশে, মাসিমা গুরুর নাম করছেন। আকাশটাও থমথম করছে মেঘে, বৃষ্টি আসবে নিশ্চয়ই। বাতাসে বেশ ঠান্ডার আমেজ।
কখন দু’চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। আচমকা মাথার বালিশটা কেউ টেনে নিতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি সৌরভ ও রানা একে অপরের দিকে উল্টো মাথা করে শুয়ে আছে। ওদের মাথায়ও বালিশ নেই। এ কি রে বাবা! আমাদের বালিশগুলাে গেল কোথায়? যেই এই কথা ভাবা, অমনি সেই মেয়ে দুটো খাটের পাশে উঁকি দিয়ে হেসে উঠল। স্বপ্ন দেখছি নাকি! তাড়াতাড়ি চোখ রগড়ে তাকাতেই দেখি কেউ নেই! তক্ষুনি আবার সেই দুপদাপ শব্দ। এবার ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। রান্নাঘরে কারা যেন বাসনপত্র এলােপাথাড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলছে। একটু পরে সব শান্ত হয়ে গেল। মেসােমশাই বললেন, তােমরা শুয়ে পড়। আমি তাে জেগেই আছি। রাম বরং টর্চটা নিয়ে আমার সঙ্গে থাক।
পরদিন বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল। দিনের আলােতে কাল সন্ধে থেকে প্রায় সারারাত যে তাণ্ডব গেছে বাড়ির উপর দিয়ে তা সবই যেন স্বপ্ন বলে মনে হল। মাসিমা-মেসােমশাইয়ের চোখে-মুখেও রাত্রি জাগরণের ক্লান্তির ছাপ। দুশ্চিন্তাগ্রস্তও বটে। আমরা তিনবন্ধু ব্রেকফাস্ট করছি এমন সময় মেসোেমশাইয়ের এক বন্ধু এলেন। তাকে চা দিয়ে মাসিমা-মেসােমশাই তার সঙ্গে নিচু গলায় কথাবার্তা বলতে লাগলেন। হঠাৎ শুনতে পেলাম ভদ্রলােক বলছেন, বাড়ি কিনছ বলেছিলে। কোথায় কিনছ, কি বৃত্তান্ত তা তুমিও বলনি। আমিও ব্যস্ততার মধ্যে জিগ্যেস করিনি। ভেবেছিলাম অনেকদিন ধরেই খুঁজছিলে, পেয়েছ, ব্যস। কিন্তু এই বাড়ির ব্যাপারে জানলে নিশ্চয়ই বারণ করতাম।
কথাটা শুনে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। একটা গা-ছমছম ভাব যেন ঘিরে ধরল। এই দিনের বেলায়ই একঘরে বন্ধুরা একসঙ্গে থেকেও খালি মনে হচ্ছে, কে যেন আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থা শুধু আমার একার নয়, বাড়িসন্ধু সবার। তারপর শুনলাম, আজ বিকেলেই তিনটে নাগাদ আমরা দার্জিলিং রওনা হব। শুনে মানসিক চাপটা কিছুটা হাল্কা হল। তবু চলছি-ফিরছি, মনে হচ্ছে যে কারুর সঙ্গে যেন ধাক্কা লাগছে। পাছে বন্ধুরা আমাকে ভীতু ভাবে, তাই মনের কথা প্রকাশ করছি না। আর কতক্ষণই বা আছি এ বাড়িতে। রানাকে দেখলাম সারাক্ষণই রামকে ছুঁয়ে আছে। দুপুরে আমরা তিনবন্ধু আর মেলােমশাই এক টেবিলের চারদিকে খেতে বসেছি। হঠাৎ টেবিলটা খুব জোরে নড়ে উঠল। যেন ভূমিকম্প হল। গ্লাস থেকে জল চলকে পড়ল। মাসিমার মুখ চিন্তায় কালাে। মেসােমশাইয়ের সঙ্গে চোখে চোখে যেন কিছু একটা ভাব বিনিময় হল।
গােছগাছ শেষ। বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল একটা স্টেশন ওয়াগন। সবাই চড়ে বসলাম। সকলের হাতেই একটা করে গরম পােশাক। ঘণ্টাদেড়েক পরেই, অর্থাৎ কার্শিয়াং থেকেই তাে গায়ে চাপাতে হবে। মেসােমশাই আর তার বন্ধু সব বন্ধ-টন্ধ করে এলেন। অনেকক্ষণ সময় লাগল ওঁদের। কি জানি কেন। গাড়ি চলছে। আমরা সবাই নীরব। সব চাইতে বেশি মনমরা অবস্থা মাসিমার। এক একবার আমাদের এক একজনের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন যেন এক পরম নিশ্চিতায়।
এক সময় আমরা সেবক ব্রিজ পেরিয়ে শুকনা ফরেস্টের দিকে এগিয়ে চললাম। মাসিমার একটু বােধহয় তন্দ্রা মতন এসেছে। কাল সারা দিনরাত যা ধকল শরীরে আর মনের উপর দিয়ে গেছে ওঁর! মাসিমার কান বাঁচিয়ে রানা বলল, রামের কাছে আমি সব শুনেছি। আমরা খুব বেঁচে গেছি। ওটা ভূতের বাড়ি। ওই দুই যমজ বােনকে ডাকাতরা মেরে কুয়ােয় ফেলে দিয়েছিল। ওখানে আর ফিরব না আমরা। দার্জিলিং থেকে সােজা কলকাতা।