ছায়ায় মায়ায়

ছায়ায় মায়ায়

অফিসের গাড়ি যখন বাড়ির গেটে এসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল তখন রাত্রি শেষের দিকে। ঘড়িতে সময় দেখলাম—দুটো বেজে কুড়ি। তবুও তাে আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে পেরেছি। সংবাদপত্র অফিসের সাব-এডিটরের কাজ। শহরসংস্করণ অর্থাৎ শেষ সংস্করণের প্রিন্ট-অর্ডার হয় সাধারণত রাত দুটোয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আরওপরে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলে সম্পাদনার কাজ। সম্পাদন সহযােগী হিসেবে এই সময়ে আমার মতােসাব-এডিটরদের ব্যস্ততার শেষ নেই। বার্তা সম্পাদকের টেবিলে প্রিন্ট-পােপােজাল দাখিল করে তার অনুমােদন পেলে তবেই আমাদের ছুটি।

দীর্ঘ আট মাস পর বদলি হয়ে ফিরে আজই প্রথম কলকাতায় প্রধান দফতরে কাজে যােগ দিয়েছি। মাত্র গতকাল বিকেলেই ফিরেছি নয়াদিল্লি থেকে। ক’দিন তল্পিতল্পা বাঁধাবাঁধি, ট্রেনযাত্রারধকল, আবার বাড়ি ফিরে এসে নতুন করে গােছগাছ ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অফিসের প্রথমদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি।তবুও সমস্ত অগ্রাহ্য করে অদম্য আগ্রহে বাড়ির সদর দরজার বেল বাজাই। ন’টা নাগাদবাড়ি থেকে মায়ের ফোন গিয়েছিল অফিসে। শুনেছিলাম মায়ের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর—‘খােকা, জানিস, সে এসেছে! সে মানে পিঙ্কি ! আমাদের ছােট্ট অশরীরী বন্ধু। ভুল লিখলাম। মায়ের ছায়াসঙ্গিনী কন্যা। আমার চপলা-চঞ্চলা ভগ্নী। পুরােনাে দিল্লির পাহাড়গঞ্জের ভাড়া বাড়ি থেকে মায়ের অপত্য স্নেহ যাকে টেনে এনেছে এখানে। সেই পিঙ্কি, যার অকাল মৃত্যুতে ভয় পেয়ে তার মা-বাবা-বােনেরা পালিয়েগেছে বাড়ি ছেড়ে, এমন কি শহর ছেড়েও।

পরিত্যাগ করে গেছে তাকে। দিনের পর দিন অসহায়,একা, যে নীরবে গুমরে মরেছে পরিত্যক্ত অন্ধকার বাড়িতে। আর যার অস্তিত্ব আবিষ্কার করে মাএকদিন আঁকড়ে বুকে তুলে নিয়েছেন যাকে। কীভাবে পিঙ্কি এখানে এসে পৌঁছেছে জানি না। তবে সে এসেছে নাকি আমাদের সঙ্গেই। আমাদের অজান্তে। মায়ের ফোন পাওয়া মাত্রই বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে পড়েছি। খুশিতে প্লাবিত হয়ে চলেছি। কোনাে মতে চেপে রেখেছি উচ্ছাস। হােক অশরীরী! পিঙ্কি আমাদের অজ্ঞাতেই হয়ে উঠেছেআমাদেরই একজন।দরজা খুলতে বেশ দেরি করছেন মা। বুঝতে পারছি—আজ আর আমার অপেক্ষায়একতলায় বসে নেই তিনি। নিশ্চয় পিঙ্কিকে নিয়ে ব্যস্ত দোতলায় তার ঘরে। তাই নামতেদেরি হচ্ছে।

দরজা খােলা মাত্রই কৌতূহল প্রকাশ হয়ে পড়ল আমার—মা, কী করছে পিঙ্কি? কোথায়মায়ের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। আঙুল ঠোটে চেপে চাপা গলায় তিনি বললেন—‘জোরে কথাবলিস না খােকা, ও জেগে উঠবে। ও খুব ক্লান্ত রে! ঘুমােচ্ছ! ওপরে উঠে মা তার ঘরের দিকে ইশারা করলেন। ঘরে আলাে জ্বলছে। পাখা ঘুরছে। দু-দুটো—একটা সিলিং, একটা পেডিস্টাল। মশারি খাটানাে বিছানায় পাশাপাশি দুটো বালিশ। যেমন থাকত পাহাড়গঞ্জের বাড়িতে। অনুমান করলাম পিঙ্কি ঘুমােচ্ছে, কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না। হতাশ চোখে তাকালাম মায়ের দিকে। মা আশ্বস্ত করলেন—‘এখন কাপড়-জামা বদলে হাত-মুখ ধুয়ে নে। আমি খাবার গরম করি। সময়ে ঠিক দেখা পাবি।

কোনাে দিনই সকালে ঘুম ভেঙে উঠতে পারি না আমি। সম্ভবও নয়। রাত তিনটে নাগাদ তাে বিছানায় যাই। অন্তত ঘণ্টা ছয়েক না ঘুমােলে চলে? তাই বিছানা ছাড়তে ছাড়তে ন’টা, সাড়ে ন’টা তাে বাজেই। কোনাে কোনােদিন দশটা, সাড়ে দশটাও! আজ ঘুম ভাঙল সমস্ত রেকর্ড অতিক্রম করে দশটা চল্লিশে। চোখ খুলে টেবিল ঘড়িতে সময় দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। বাথরুমে গিয়ে দাঁত ব্রাশ করে চায়ের প্রতীক্ষায় টেবিলে এসে বসেছি, মা রান্নাঘর থেকে জানান দিলেন—খােকা বােস, এক্ষুনি চা নিয়ে যাচ্ছি।’ টেবিলের ওপর খবরের কাগজ। অভ্যাসবশে একবার স্পর্শ করলাম। পড়তে ইচ্ছে হল না।আমাদেরই কাগজ। সম্পাদনার কাজে মােটামুটি পুরােটাই পড়া হয়ে যায় পূর্বরাতে। তাই আমাদেরকাছে পরদিন সকালে এসব সংবাদের আর কোনাে আকর্ষণ-ই থাকে না। পরিবর্তে প্রস্তুত হতে হয়নতুন সংবাদ পরিবেশনের উদ্দেশ্যে।

টিভি খুলতে গিয়ে থমকাতে হল। যা কেবল অপারেটরকে তাে খবর দেওয়া হয়নি। আর অ্যানটেনার পাট চুকিয়ে ফেলেছি তাে বছর পাঁচেক আগেই। অগত্যা কাগজটা খুলতেই হল। আর খুলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একী! এটা কেমন করে হল? আর এ অবস্থায় কাগজটা বেরল-ই বা কী করে? এটা কি শেষ মুহূর্তের সম্পাদকীয় কোনাে সিদ্ধান্ত ? নাকি মুদ্রণের ভুল? এই কাগজের ইতিহাসে তাে এমন কোনােদিন ঘটেনি! শুধু এই কাগজ কেন, কোনাে কাগজের কোনাে সংস্করণেই আদৌ এমন ঘটেছে কি? প্রথম পাতায় কাগজের টাইটেল-ব্লকের পরের অংশ, দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশিতহয় যেখানে-বােল্ড-লেটার হেডিংয়ে, প্রায় অর্ধেক পাতা জুড়ে—সেই অংশটা একেবারে সাদা!কিচ্ছুটি নেই? আশ্চর্য!

অথচ, আমার বেশ মনে আছে গতরাতের বিষয়টা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত। হ্যা, হেডিংটা- ও স্মরণে আছে স্পষ্ট। আমিই লিখেছিলাম সেটা—“রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হলেন লক্ষ্মী সায়গল। হেডিং সমেত পুরাে নিউজটাই উধাও! এমন অবশ্য বহুবার ঘটেছে যে শেষ সংস্করণের প্রিন্ট-অর্ডার হয়ে যাবার পরও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ এসে পৌঁছেছে। মুহূর্তে বদলে গেছে বিষয়। তা-ই যদি ঘটে থাকে তাে তা অন্য কথা। কিন্তু পাতা সাদা থাকার কথা নয়। তড়িৎ গতিতে উঠে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলাম। ডায়াল করলাম আমাদের চিফসাব-এডিটর শশাঙ্কদাকে। লাইন এনগেজড। হবেই তাে, এমন একটা ব্যাপার! ওঁরা কি আর চুপ করে বসে থাকবেন?

একটু অপেক্ষা করে, সাহস করে ডায়াল করলাম নিউজ-এডিটর প্রভাতদার বাড়িতে। লাইনপাওয়া গেল, তাকে পেলাম না। স্ত্রী-কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছেন প্রভাতদা। ফিরতে দেরি হবে। জানাল বাড়ির কাজের লােক।আরও দু-চার জায়গায় ফোন করা যেত, কিন্তু ইচ্ছে হল না। কেমন তিক্ত হয়ে গেল মেজাজটা ! আবার এসে বসে পড়লাম টেবিলে। ততক্ষণে মা চায়ের কাপ হাতে হাজির—‘খােকা, উঠতে অনেক দেরি করে ফেলেছিস আজ। অনেকগুলাে কাজ আজই করতে হবে তােকে। প্রথম কাজ, মমতাকে খবর পাঠাবি—আমরা ফিরেছি। কাল থেকেই যেন কাজে আসে। দ্বিতীয় কাজ, দুধের দোকানে বলবি আজ বিকেলেই দুধ দিতে। কাল থেকে সকালে। যেমন দিত রােজ হাফ লিটারের প্যাকেট, একটা করে। মা গাে! দুধ ছাড়া চা তুই খেতে পারিস ঠিক কথা, আমি একেবারে পারছি না।’

আমি মৃদু হেসে কাপে চুমুক দিলাম। ‘আর হ্যা, সবচেয়ে বড় কাজ—কেবল কানেকশান। আজ-ই বলে করিয়ে দিস। মা বলে চলেন— ‘নইলে মেয়েটাকে সামলানাে যাবে না। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল পিঙ্কির কথা। ভুলে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করে উঠলাম—কোথায় সে? ‘সেকি আর এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে? লাটুর মতাে সারা বাড়ি পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে।নতুন বাড়ি, নতুন পরিবেশ—ওর এখন উৎসাহের ঘাটতি নেই। কোন ভােরে উঠেছে জানিস?’—মায়ের সেই অত্যধিক কথা বলার প্রবণতা, যা কয়েকদিন অন্তর্হিত ছিল, তা আবার ফিরে এসেছে লক্ষ করলাম।

‘আর দৌরাত্মও করছে খুব। মা বলে যান—‘ছাদে উঠে পাশের বাড়ির কুকুরটাকে রাগিয়েছে খুব। একবার গিয়ে দেখি রাস্তায় গাছে আটকে থাকা একটা ঘুড়ি পাড়ার জন্য কার্নিশে নেমেছে।ধমকে এনেছি। তাের ঘুম ভাঙাবার চেষ্টাও করেছে এ ঘরে ঢুকে কয়েকবার। আমি আগলে আগলে নিয়ে গেছি। মনের কোণে সন্দেহ দেখা দিল, পিঙ্কির বিরহে মা প্রলাপ বকছেন না তাে! সত্যিই পিঙ্কি এসেছে নাকি এ সব মায়ের বিকার! নিরাসক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম—‘এখন কী করছে সে? ‘এই তাে আমাকে রান্নাঘরে লুচি বেলে দেবার চেষ্টা করছিল। দেখি গিয়ে আবার কি কাণ্ড করেছে!’ মা ঘর ছেড়ে বেরােতে গিয়েও আবার ফিরে আসেন।‘হ্যা রে, তাের শরীরটা কি খারাপ লাগছে? ‘না তাে!’ আমি জোরাল গলায় বলি।

মা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। বললেন—কেমন যেন মনে হচ্ছে তােকে। কিছু যেন ভাবছিস, কথাগুলাে শুনতে চাইছিস না। কেমন অন্যমনস্ক।‘আসলে কী হয়েছে জানাে মা- কাগজের ঘটনাটা জানাতে চাইলাম মাকে। একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়েছে। আমাদের আজকেরকাগজের শেষ সংস্করণে বলতে বলতে মুহূর্তে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মাকে দেখাব বলে কাগজটার ভাঁজ খুলছিলাম। চোখ পড়তেই স্তব্ধ হতে হল বিস্ময়ে। কোথায় সাদা অংশ! বােল্ড-লেটারে জ্বলজ্বল করছে গতরাতের ঠিক হওয়া সেই হেডলাইন, অবিকল। নিজের অজ্ঞাতে আমার গলা দিয়ে অস্ফুটে উচ্চারিত হয়ে পড়ল—‘অদ্ভুত!

মা কিছুই বুঝলেন না। আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন—“কী অদ্ভুত ? তুই কিসের কথা বলছিস খোেকা? ‘আজকের কাগজের এই অংশটা। মায়ের দিকে কাগজটা মেলে ধরে আমি উত্তেজিত গলায় বলতে থাকি—একটু আগেই এই অংশটা আমি দেখেছি শূন্য, একেবারে সাদা! এই জন্য একে- ওকে আমি ফোনও করে ফেললাম কয়েকটা। ধর—মিনিট দশেকের ব্যবধান। এখন দেখছি সব ঠিক আছে!—মানে, যা থাকার কথা তাই! ভেবেছিলাম মা-ও আমাকে অবিশ্বাস করবেন। তা না করে তিনি ভয়ে ভয়ে শুধোলেন—হ্যা রে, পিঙ্কির কোনাে কারসাজি নয় তাে? কাগজটা কিন্তু সদর দরজা থেকে তুলে এনে ওই তাের ঘরে রেখে গেছে। কাগজটা হাতে ধরে আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। বুঝতে পারছি না কী করব? মাকে অবিশ্বাস করব, না নিজেকে?

তখনই দরজার বাইরে থেকে অস্পষ্ট একটা চাপা হাসির শব্দ ভেসে এল যেন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আমি শব্দের উৎসের দিকে ছুটে গেলাম—কে? কে ওখানে? কাউকেই দেখতে পেলাম না ঠিক, তবে আমার সমুখ দিয়েই দুটি চপল পায়ের ছুটে যাওয়ার শব্দ সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে গেল। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। গেটে বেল বাজানো মাত্রই গেট খুলে গেল ‘খুট’ শব্দে। ভেতরে ঢুকে অবাক হতে হল। আশেপাশে কেউ নেই তাে! তবে কি দরজা খােলা ছিল? অসাবধানে মা খােলা রেখে গেছেন? নিঃশব্দে দরজার খিল এঁটে, ছিটকিনি এঁটে, পকেটের ডুপ্লিকেট চাবি বের করে কড়ার গায়ে আটকে রাখা তালা-ও এঁটে দিলাম ভেতর থেকে।

সতর্কতার জন্য একতলার ঘরগুলাে, বারান্দা, বাথরুম একবার করে দেখে নিলাম ভালাে করে। অযথা অনেকগুলাে আলাে জ্বলছে। বারান্দা আর সিঁড়ির আলাে ছাড়া বাকি আলােগুলাে নিভিয়ে দোতলার সিঁড়িতে পা রেখেছি—শুনতে পেলাম পেছনে কারও পায়ের শব্দ। ঘাড় ঘােরালাম, না কেউ নেই! আবার ওপরে উঠছি—মনে হচ্ছে কেউ যেন উঠছে পিছু পিছু। থমকে গেলাম। শব্দও থেমে গেল তৎক্ষণাৎ। আবার সামনের দিকে এগােতে শুরু করা মাত্রই পায়ের শব্দও এগােতে শুরু করল। অবশ্যই লঘু পায়। আর এই সময় হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চলে গেল। লােডশেডিং! মুহূর্তে তীক্ষ্ণ সুরেলা শিশু-কণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকারে কেঁপে উঠল সমস্ত বাড়ি। চিৎকারে হতচকিত আমি দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকলাম ঠকঠক। চিৎকারটা উঠছে আমার পেছন দিক থেকেই।

মাত্র কয়েকটা সেকেন্ড। পড়িমরি করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন মা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তাকে অনুমান করতে পারছি তার উদ্বেগ ভরা কণ্ঠস্বরে—কী হয়েছে? কী ব্যাপার? পিঙ্কি কী হল তাের! আমি আসছি, ভয় নেই দাঁড়া! বুঝতে পারলাম ভয়ার্ত কণ্ঠটি পিঙ্কির। ভয় পেয়েছে হঠাৎ অন্ধকারে। আমাকে অন্ধকারে ধাক্কা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে কোনােমতে সামলে নিয়ে নীচে নেমে গেলেন মা। তার কণ্ঠ তখনও ব্যাকুল—‘দাঁড়িয়ে থাকিস না খোকা, ঝটপট একটা কিছু অন্তত জ্বালা। কী জ্বালাব? আমি সিগারেট খাই না। সঙ্গে দেশলাই, লাইটার কিছু নেই।

কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা কাটিয়ে মায়ের ঘরে এদিক-সেদিক হাতড়ে টর্চটা খুঁজে পেলাম। ওপর থেকে সিঁড়িতে ফোকাস ফেললাম। আর তখনই দেখতে পেলাম পিঙ্কিকে। কলকাতায় এসে এই প্রথম এবং সাকুল্যে দু’বার। মায়ের পেটের কাছটায় মুখ গুঁজে সে। মাথায় সেই নীল ফিতে, বিনুনি বাঁধা চুল। পরনে সেই ধূসর ফ্রক। প্রথমবার যেমন দেখেছিলাম—পাহাড়গঞ্জের বাড়ির ছাদে, জোছনার মৃদু আলােয়—আজও তেমনই দেখতে পেলাম টর্চের স্বল্প আলােয় তার আবছা অবয়ব। একে অপরকে আঁকড়ে ধরে সিঁড়ি- পথে উঠে আসছে দুজন—মা আর পিঙ্কি! ‘জানিস, কিছুতেই ঘুমােবে না!’ মা জানালেন-“ঠায় জেগে রয়েছে। কী—? না, তুই এলে গেট খুলবে। তাের অফিসের গাড়ির আওয়াজ পেতেই নেমে এসেছে। আমাকে মােটেই নামতে দিল না। আর দেখলি তাে, গেট খুলতে এসে কি বিপত্তি!

‘কাল একবার এমারজেন্সি লাইটটার কথা মনে করিও তাে মা!’ বলি আমি—‘চার্জে দিয়ে দেখতে হবে ঠিক আছে কিনা। বহুদিন তাে ব্যবহার হয়নি। মা ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালেন। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল আরও এক চিৎকারে। বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি মমতা। আমাদের বাড়ির দীর্ঘদিনের ঠিকে কাজের লোক। গতকাল ওকে খবর দিয়ে এসেছিলাম। কাজ শুরু করার কথা ছিল আজ সকাল থেকে। শুরুও করেছে দেখলাম। হাতে ফুলঝাড়। তা নিয়ে দোতলার বারান্দা প্রান্তে, নীচতলায় নামার সিড়ির কাছে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে সে। চিৎকার টা তারই।

অজানা আশঙ্কায় জিজ্ঞাসা করে উঠলাম—কী রে মমতা, কী ব্যাপার? মমতা সম্ভবত আচমকা চেঁচিয়ে ফেলে একটু বিব্রত। বুঝতে পেরেছে ওরই চিৎকারে ঘুম ভেঙেছে আমার। অপ্রস্তুত মুখে তাই নালিশ জানাল—“দ্যাখাে না দাদা, আমি বারান্দা ঝট দিচ্ছিলাম, হঠাৎ কি একটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে। আর একটু হলেই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তাম। ততক্ষণে মা-ও ছুটে এসেছেন। বােধহয় বাথরুমে স্নান করছিলেন। মাথাও মুছতে পারেননি ভালাে করে। আমি ও মা নীরবে নিজেদের দৃষ্টি বিনিময় করলাম। ‘কি একটা ধাক্কা দিয়ে নীচে নেমে গেল, মানে?’ মা জিজ্ঞাসা করলেন—দেখতে পাসনি?

‘না গাে মাসিমা। মমতা জানাল—“আমি তাে সামনে ঝুঁকে ঝট দিচ্ছিলাম। মনে হল তােমাদের বড় ঘরটা থেকে কিছু একটা আমাকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেল। ‘তবে বেড়াল-কুকুর হবে বােধহয়। চুল ঝাড়তে ঝাড়তে মা ব্যাপারটা ম্যানেজ দেবার চেষ্টা করলেন—“দ্যাখ, নীচে সদর দরজা খােলা পেয়ে কখন ঢুকে বসেছিল। না না, এ বেড়াল-কুকুরের ধাক্কা নয় মাসিমা। মমতা জোর দিয়ে বলে—“ঠিক আমার কোমরের কাছটায় কেমন যেন দু’হাতে ঠেলে দেওয়ার মতাে কেউ ধাক্কা দিয়ে গেল। আমি ‘হুট’ ‘হট’ শব্দ করতে করতে সিঁড়ি ভেঙে নীচতলায় নেমে এলাম। সত্যি বলতে কি পালিয়ে বাঁচলাম।

সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। নীচতলার সমস্ত ঘরগুলাে দেখলাম। একবার শুধু চাপা কিন্তু স্পষ্ট কথায় পিঙ্কির উদ্দেশে বললাম—‘পিঙ্কি, সামলে চল। জানাজানি হয়ে গেলে তােরই বিপদ। সাবধান। তারপর মমতাকে উদ্দেশ করে নীচে থেকে চেঁচালাম-“ওই দ্যাখ, বেড়ালই ঢুকেছিল রে মমতা, বেরিয়ে গেল। তখনকার মতাে ব্যাপারটা চাপা পড়ল বটে, কিন্তু মিনিট পনেরাে পর আবার চেঁচাল মমতা। এবারও আমরা হাজির হলাম।

মমতা দোতলার বারান্দা মােছা শেষ করে সিঁড়ি মােছর জন্য বালতির জল বদল করতে ঢুকেছিল বাথরুমে। সেখান থেকে বেরিয়েই সে আবিষ্কার করেছে ভেজা মেঝে দিয়ে হেঁটে যাওয়া কার ছােট ছােট পায়ের ছাপ। সেদিকে আঙুল নির্দেশ করে সে বলল—‘আমি বলছি দাদা, নিশ্চয়ই তােমাদের বাড়িতে কেউ ঢুকেছে। তােমরা আমার কথা গেরায্য করছ না! এবার হাতে-নাতে প্রমাণ দেখিয়েছে মমতা, খণ্ডন করার সাধ্যি নেই। বাধ্য হয়ে আমরা এঘর- সেঘর খোঁজার ভান করলাম। সঙ্গে মমতা। শেষে মমতাই আবিষ্কার করল পায়ের ছাপ দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে ছাদে। ভাগ্যিস ছাদের দরজা খােলা ছিল। বেঁচে গেলাম সেই জন্যই। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। মমতাকে বােঝানাে গেল—যে ঢুকেছে সে পালিয়েও গেছে ছাদ টপকে অন্য বাড়িতে।

সেই মুহুর্তেই পাশের বাড়ির অ্যালসেশিয়ানটা তারস্বরে চিৎকার শুরু করল। মমতা আমাকে ঝাঝিয়ে উঠল—“তােমার জন্যই মাসিমা ফাঁকা বাড়িতে খুন হয়ে পড়ে থাকবে কোনােদিন। আমি বােকা বােকা মুখে জিজ্ঞাসা শুরলাম—“কেন রে!’ আর ঢঙ করাে না।’ মমতা মুখ ভ্যাঙচলি—“বিয়ে যদি করতে তবুও তাে মাসিমা বাড়িতে একজনকে পেত। বাড়ি থাকো কতক্ষণ? আর ওই তাে ডিউটির ছিরি! দুপুরে অফিস বেরােবার জন্য তৈরি হচ্ছি, এমন সময় নিউদিল্লি থেকে বিপ্রদাসের ফোন পেলাম। বিপ্রদাস, আমাদের রাজধানীর চিত্র-সাংবাদিক। ‘অঞ্জনদা, কেমন আছেন? ‘ভালাে আছি ভাই। তােমাদের খবর বলাে। ‘আমরা সবাই ভালাে আছি। মাসিমার খবর কী? ‘মা-ও ভালাে আছেন।

‘আপনাদের পৌছনাের খবরও পেয়েছি ঠিক সময়ে। আপনার বন্ধু দীপক শর্মা আমাদের জানিয়েদিয়েছিলেন। আপনি তাে হাওড়ায় পৌছেই ওঁকে ফোন করেছিলেন। উনি বলেছেন সে কথা। ‘গাড়ি একদম রাইট টাইমে পৌছেছে, জানাে!’ হেসে বললাম—আর রাস্তায় কোনাে ট্রাবলও ফেস করতে হয়নি।’ ‘থ্যাঙ্ক গড। বিপ্রদাস খুশি—গতকাল সন্ধেতে কলকাতা দফতরে ফোন করেছিলাম। ইচ্ছে করেই আপনাকে চাইনি। ঠিক করেছিলাম বাড়িতে ধরব। ওদের কাছ থেকেই আপনার ফোন নম্বর নিয়েছি। তবে ফোন করেছি কিন্তু খুব ভয়ে ভয়ে। বিপ্রদাসের রসিকতা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করি—কেন? যদি পিঙ্কি ফোন রিসিভ করে?

‘একজ্যাক্টলি। বিপ্রদাস উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।‘সেই ভয় কিন্তু দূর হয়নি ভাই, দুঃখিত! আমি হাসতে হাসতে বলি—“তুমি চাইলে এক্ষুনি আমি পিঙ্কির হাতে রিসিভার তুলে দিতে পারি। ‘তার মানে!’ বিপ্রদাসের গলায় উৎকণ্ঠা। ‘হ্যা ভাই, পিঙ্কি এখানে চলে এসেছে। ‘অসম্ভব! বিপ্রদাস চেঁচিয়ে ওঠে—এ হতে পারে নাকি! ‘কিন্তু তাই যে হয়েছে ভাই।’ এরপর বিপ্রদাসকে সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করি। এখানে ফেরার পর থেকে যা যা ঘটেছে তা। এমন কি একটু আগে কী ঘটেছে—তাও। বিপ্রদাস অবিশ্বাস করে না। সে জানে। সে তাে আমারও আগে, নিজেই প্রত্যক্ষ করেছিল পিঙ্কিকে পাহাড়গঞ্জের বাড়িতে, সেই দোলনা চেয়ারে, ক্যামেরার লেন্সে চোখ ঠেকিয়ে!

সব শুনে বিপ্রদাস প্রশ্ন করে—‘অঞ্জনদা কাউকে, মানে আমাদের দফতরের কাউকে এ সব জানিয়েছ নাকি?’ না ভাই, কাউকে নয়! এসব বলতে যাই আর লােকে আমাকে পাগল ভাবুক আর কি! ‘আমি কি সুমিত্ৰদাকে জানাতে পারি ? “নিশ্চয়!’ জোরের সঙ্গে বলি।‘তুমি আর সুমিত্র ওখানে আমাকে যে সহযােগিতা করেছ তা কি করে ভুলি? তােমরা আমার বিপদের বন্ধু। তােমাদের না জানিয়ে পারি? ‘ধন্যবাদ অঞ্জনদা, বিপ্রদাস বলে—“আপনার প্রশংসায় আমরা গর্বিত।‘আর ভাই, দীপককেও ব্যাপারটা জানিও এবং সঙ্গে আমার ফোন নাম্বারটাও।

‘অবশ্যই জানাব। বিপ্রদাস ফোন রেখে দেয়। সেদিন অফিসে ঢুকেই হইহই ব্যাপার। এখানে-ওখানে জটলা, গুঞ্জন। সম্পাদকের চেম্বারে ঢাকার দরজার মাথায় জ্বলছে লাল জরুরি আলাের সংকেত। ছােটাছুটি করছেন প্রসেসিং, প্রিন্টিং, সার্কুলেশান বিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা। সকলের জরুরি তলব। সকালেও নাকি জরুরি মিটিং হয়ে গেছে জি. এম-এর চেম্বারে। এসেছিলেন কাগজের ডিরেক্টর বাের্ডের সদস্যরাও। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই ভূত দেখার মতাে অবাক হয়ে আমাকে জরিপ করল সহকর্মী অবনীশ— সে কি! এত বড় ঘটনা আর আপনি জানেন না? সারা শহরে হইহই!’ আমি হাঁ করে থাকি। ‘আজ সকালে কাগজ দেখেননি? ‘আমি না-সূচক মাথা নাড়ি। ‘তবে কি আপনাকে কাগজ দেয়নি? অনেক জায়গায় অবশ্য ডেলিভেরিম্যানরা গােলমাল বুঝতে পেরে কাগজ বিলি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই হয়তাে আপনাকে দেয়নি।’

‘দিয়েছে কি-না তাও বলতে পারব না। আমি ইতস্তত করে বলি—“আসলে সকাল থেকে আজ এত ব্যস্ত ছিলাম, মনটা এত বিক্ষিপ্ত ছিল কয়েকটা ঘটনায়, যে কাগজ দেখার অবকাশই পাইনি। ‘সত্যি এত বড় একটা ভুল আমাদের মতাে এত বড় একটা কাগজের পক্ষে খুবই লজ্জার। পাড়ায়, বাজারে, রাস্তায় লােককে কৈফিয়েৎ দিতে দিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেছে প্রায়। বলে চলে অবনী  ‘আপনাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি? ‘আমার আজ দোকান-বাজার কোথাও বেরােবারই ফুরসৎ হয়নি। অফিস আসবার জন্যই প্রথম বেরিয়েছি। কিন্তু কী হয়েছে? কী ব্যাপার?

‘আমাদের কাগজের শহর সংস্করণ আজ মেইন নিউজটাকে মিস করে ছেপে বেরিয়ে গেছে। ফ্রন্ট-পেজের অর্ধেকটাই সাদা, একেবারে শূন্য। শূন্যদৃষ্টিতে অবনীশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমি ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ি। আশ্চর্য হয় না অবনীশ। ওরা জানে আমার এমন প্রতিক্রিয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, চিফ সাব-এডিটরের বদান্যতায় ওই অংশটিরও দায়িত্বপ্রাপ্ত আমি। প্রতিক্রিয়ার প্রকৃত কারণ ওদের জানা। নেই। গতকাল সকালের সেই অদ্ভুত ঘটনাটাকে আমি তখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। মা ভয়ার্ত কণ্ঠে আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন—‘হারে, পিঙ্কির কোনাে কারসাজি নয় তাে? তবে কি আজকের ঘটনাটিই আগাম দেখতে পেয়েছিলাম আমি? আমাকে কি সতর্ক করতে চেয়েছিল পিঙ্কি ? এদিক-সেদিক চেয়ে দেখলাম কেউ আমাকে সেভাবে লক্ষ করছে কিনা! করছে না, নিশ্চিত হয়ে ফোনের কাছে উঠে গেলাম। ডায়াল করলাম বাড়িতে। মা ফোন ধরলেন।

‘মা—? এ প্রান্ত থেকে জিজ্ঞাসা করি। ‘হ্যা, বল। ‘মা দেখ তাে আজকের কাগজটা। কাগজটা কোথায় ? ‘দেখছি, একটু ধর। ফোন ধরে থাকি। একটু পরে আবার মায়ের কণ্ঠস্বর—খােকা, কাগজটা তাে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছিস?” ‘কোথাও রাখিনি?’ চাপা অথচ উত্তেজিত কণ্ঠে বলি—“আজকের কাগজ চোখেই দেখিনি আমি।  ‘তাের টেবিলে এই তাে কালকেরটা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আজকেরটা- “দেখ, দেখ। ভালাে করে খুঁজে দেখ। ফোন ধরে রাখি। মিনিট দুই পরে মা জানান আবার—না রে খােকা, দেখতে পাচ্ছি না। একতলায়ও খুঁজে এলাম। পেলাম না। তবে কি কাগজ দেয়নি?

মা একটু ভাবলেন মনে হল। তারপরই জোর গলায় বললেন-“না, আজ কাগজ দিয়েছে। মমতা দোতলায় কাগজ নিয়ে এসেছে, আমি দেখেছি। ‘মমতা এ বেলা এসেছে? ‘না, আসবে। দেরি আছে।’ বলেই পালটা প্রশ্ন করেন মাহা রে, আবার কী হল? আবার কিছু ঘটেছে কাগজে? সে কথার উত্তর না দিয়ে আমি বলি—‘মমতা এলে কাগজটা কোথায় রেখেছে জেনে তুমি আমাকে ফোন করাে। আর শােন, কাগজটা ফোনের সামনে রাখবে। আমি যা জানতে চাইব তার উত্তর দেবে। মা ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন—“আচ্ছা। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেছে মাকে ফোন করার পর। এখনও মায়ের ফোন পাইনি।

মমতা কি তবে বিকেলে আসেনি? আর অপেক্ষা না করতে পেরে আবার ফোন করলাম বাড়িতে। মা! কী ব্যাপার! কাগজটা কোথাও নেই খোকা, ‘মায়ের কণ্ঠ ভীত, কম্পিত। বিরক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করি— মমতা এসেছিল ? ‘হ্যা, ও বলেছে ও তােরই টেবিলের ওপর রেখেছিল—এ ঘরে। ‘তবে সেটা গেল কোথায় ? ‘জানি না। মায়ের গলা বাস্পসিক্ত মনে হল।ও আর আমি অনেক খুঁজেছি।’ ‘তােমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছ? উত্তর দিতে গিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললেন মা—“পিঙ্কিকে খুঁজে পাচ্ছি না খােকা, কোথাও না!

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত