শেষের সেদিন

শেষের সেদিন

এটা দেখেছিস?” কথাটা বলে টেবিলের উপর ঝপ করে পেপারটা রাখল নিলু।

“হুমম…” ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল তমোঘ্ন।

“পড়ে কী বুঝলি?”

“কী আবার? ফালতু, রদ্দি খবর?”

“তাই কি? কিন্তু আমার তো বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল।”

“কেন?” ল্যাপটপ বন্ধ করে নিলুকে দেখল তমোঘ্ন, “ছবিটা যে পাতি সুপারইম্পো করা, সেটা বোঝা যায়নি, তাই?”

“ধুর, তা নয়,” কাঁধ ঝাকাল নিলু, “যদি ধরেও নিই ছবিটা সুপারইম্পোজ করা, তা হলেও কি পরের খবরটা চোখ এড়িয়ে যায়?”

“কোনটা? ওই ছেলেটার মৃত্যু?”

“হ্যাঁ, অদ্ভুত না? ছবিটা তুলে এল, প্রিন্ট করাল, তারপর মারা গেল!” বিস্ময়ে চোখ বড়-বড় হয়ে যায় নিলুর।

“না, অদ্ভুত নয়, তমোগ্ন অধৈর্য হল, “প্রথমত, ছেলেটা মারা গিয়েছে কিনা, তুই জানিস না। কারণ বডি পাওয়া যায়নি। আর দ্বিতীয়ত, যে ছেলেটি সঙ্গে ছিল…ওর বন্ধু…”

“হ্যাঁ, তারও তো কোনও খোঁজ নেই! তা হলেই বোঝ…”

“যা বোঝার তৃই বোঝ নিলু! আমার দরকার নেই। ভুলভাল খবর নিয়ে এত নাচিস না। তোর মতো ছেলের সেটা মানায় না।” তমোঘ্ন উঠে জানলার ধারে গিয়ে সিগারেট ধরাল।

“না, ভাবছিলাম…” নিলু কাগজটা তুলল, “গাপজালি যেতে কতক্ষণ সময় লাগে রে?”

“মানে?” তমোগ্ন গলা চড়াল, “তুই পাগল হয়েছিস নাকি? ওখানে যাবি?”

“ওই আর কী, গেলে মন্দ হয় না। গিয়ে একবার দেখে আসতাম নিলু হাসল।

“কী হয়েছে কি তোর? কী ভুলভাল বলছিস?”

“শোন না,” নিলুর গলায় কাকুতি, “সামনের উইকএন্ডে তো বেড়াতে যাওয়ার কথাই আছে। চল না, ওখানেই যাই। বিশ্বাস কর, খবরটা পড়ার পর থেকে অদ্ভুত লাগছে। হোক না গাঁজাখুরি, তাও ঘোরা তো হবে। অচেনা জায়গা…অ্যাডভেঞ্চার…কী রে?”

“আমি নেই!” তমোঘ্ন পাত্তা দিল না!

“শোন তমোগ্ন, একবারটি চল। আরে এক রাতের তো ব্যাপার…”

কিছুদিন আগে পেপারে বেরিয়েছে খবরটা। ছোট্ট খবর। দু’জন অজ্ঞাত পরিচয় ছেলে বাঁকুড়া স্টেশন থেকে ৫০ কিলোমিটার ভিতরে গাপজালি নামে একটি গ্রামে গিয়েছিল। প্রত্যন্ত গ্রাম, আগে হয়তো তেমন কেউ নামও শোনেনি। সেখানেই সন্ধে নাগাদ, জঙ্গলের মধ্যে এক বন্ধু অপর জনের ছবি তোলে। কিন্তু ছবি প্রিন্ট করতেই দেখা যায়, একটি বিকটদর্শন মেয়ের মুখ, ছেলেটির পিছনে থাকা গাছের কাছে। রক্তহীন, ফ্যাকাসে, হাড়ের উপর চামড়া জড়ানো, শুধু চোখের সাদা অংশটি দেখা যাচ্ছে। এতটা পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু ঘটনাটি ঘটে এর কয়েকঘণ্টা পর। ছবিতে থাকা ছেলেটি রহস্যজনকভাবে মারা যায়।

পুলিশ প্রাথমিকভাবে হার্ট অ্যাটাক বলে সন্দেহ করেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সঙ্গে থাকা ছেলেটিরও কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। ব্যস, এতেই চোখ টেনেছে নিলুর। গোঁ ধরে বসেছে, অন্তত একবার যাবে। তমোঘ্ন অনেক চেষ্টাতেও বুঝিয়ে পারেনি। তমোঘ্ন আর নিলু সেই ছোট্টবেলা থেকে বন্ধু। তমলুকের মন্দিরপাড়া নামে যে অঞ্চলে তমোঘ্নদের পৈতৃক ভিটে, সেখানেই থাকে নিলুরা। ওর বাবা পুলিশে চাকরি করেন। ছোটবেলায় একবার বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ায়, নিলুর বাঁ গাল বিশ্রীভাবে কেটে গিয়েছিল। তারপর এতদিন কেটে গিয়েছে, কিন্তু সেই কাটা দাগ এখনও যায়নি। তার উপর ও আবার স্টাইল করে ন্যাড়া হয়ে যাওয়ার মত করে চুল কাটে। ফলে দেখে মনে হওয়ার জো নেই যে, ও কলকাতার একটি স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক। তমোঘ্ন বেঙ্গালুরুতে একটা আই টি সেক্টরে চাকরি করে। এখন শুধু ছুটিতে এলেই দেখা হয় দু’জনের। আর প্রতিবারই দু’দিনের জন্য কোথাও না কোথাও ঘুরতে যায়। এবার ঠিক ছিল, মন্দারমণি যাবে। কিন্তু কাগজে খবরটা বেরিয়েই যত গন্ডগোল হয়েছে।

নিলু ভীষণ রকমের জোরাজুরি শুরু করেছে। দিন নেই রাত নেই, এই এক কথা বলে যাচ্ছে। কীসের যে টান, কে জানে। ফলে বেশ অনিচ্ছে নিয়েই রাজি হয়েছে তমোঘ্ন। ঠিক হয়েছে, এই শনিবার সকালে মেচেদা স্টেশন থেকে ট্রেন ধরবে। কিন্তু তমোঘ্নর মন তাও খুঁতখুঁত করছিল। নিলুকে বলেছিল, “বাড়িতে কী বলে যাবি? ওসব ভূতের গল্প দিলে না দেখতে হবে না, এই বয়সেও ক্যালাবে!” নিলু চোখ বড়-বড় করে বলেছিল, “ধুসস্, এটা কোনও ব্যাপার? বলবি, মন্দারমণি যাচ্ছিস!”

“মিথ্যে বলব?”

“উঃ! সত্যবাদী যুধিষ্ঠির আমার! বেঙ্গালুরুতে কী করিস, আমি জানি না? কাকিমাকে সত্যি কথাগুলো বলে দিলে না, ওই বেঙ্গালুরু ছাড়, এই তমলুক বাসস্ট্যান্ড পর্যন্তও একা ছাড়বে না।” রেগে গিয়ে ব্যাগটা কাঁধ প্রায় ছুঁড়েই নামাল তমোঘ্ন। তারপর নিলুর দিকে ফিরে খিঁচিয়ে উঠল, “হল তোর গাপজালি আসা? শালা, জায়গার নামের সঙ্গে জালি, সেখানকার লোক জালি… আর পারা যায় না!”

“আহা, দাঁড়া না, অত অধৈর্য হলে চলে? কিছু না কিছু ঠিক পাওয়া যাবে!” নিলু আশ্বস্ত করল।

“তোমার মাথা যাবে। গত এক ঘণ্টা ধরে তো হাঁটছিস, কিছু পেয়েছিস কি এখনও…” তমোঘ্ন চিৎকার করে উঠল।

নিলু আর উত্তর দিল না। সত্যিই, ও ভুল কিছু বলেনি। ভোরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে এমনিতেই ওদের বেরোতে অসুবিধে হয়েছে। তার উপর প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে, ক্লান্ত শরীরে বাঁকুড়াতে নেমেই আর এক বিপত্তি। শুরুতে গ্রামটার নাম কেউ শুনেছে বলেই মনে হচ্ছিল না। তারপর যদিও বা চেষ্টা চরিত্র করে বোঝানো গেল, তখন আর কেউ যেতে চায়নি। চায়ের দোকানের একটি লোক তো বলেই দিল, “গাড়ি ভাড়া করুন বাবু। নয়তো এখানেই থাকতে হবে!”

তারপর প্রায় ডবল ভাড়া দিয়ে একটি অ্যাম্বাসাডর ভাড়া করতে হয়েছে। সেও আবার প্রায় ৪০ মিনিট গাড়ি চালানোর পর একটা রাস্তার ধারে, দাঁড় করিয়ে বলেছে, “ডানদিকের রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। আর গাড়ি যাবে না” ব্যস, তারপর থেকে হেঁটেই যাচ্ছে ওরা।

দু’দিকে জঙ্গল, আর মাঝখানে সরু এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। এই দুপুরেও যেন সেখানে আলো ঠিকমতো ঢোকে না। একটা ঝিঁঝিঁ পোকা প্রাণপণ ডেকে চলেছে। জায়গাটা দেখেই কেন জানা নেই, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে তমোঘ্নর। কীরকম একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। হঠাৎ করেই আলো অনেকটা কমে এসেছে। কিন্তু রাস্তা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। কোনও জনবসতি তো দূরস্থান, একটা লোককেও রাস্তায় দেখা যায়নি। ফলে এক প্রকার ক্লান্ত হয়েই বসে পড়েছে ও। নিলু কী করবে বুঝতে পারছিল না। এখন মনে হচ্ছে, না এলেই বুঝি ভাল ছিল। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। তাই জোর করেই বলল, “চল আর একটু দেখি, কিছু পাওয়া যায় কি না?”

“কী পাওয়া যাবে? এইভাবে কতক্ষণ হাঁটব?”

“বসে থেকে কোনও লাভ আছে কি?” নিলুও এবার অধৈর্য হল।”

“অগত্যা…”

আরও মিনিট কুড়ি হাঁটতে হল ওদের। রাস্তা সোজা হলে কী হবে, দু’পাশের জঙ্গল যেন আরও ঘন হচ্ছে। কোনও পাখির শব্দ নেই, পাতাগুলোও যেন নড়ছে না। অদ্ভুত লাগল নিলুর। পশ্চিমবঙ্গে এখনও এরকম জায়গা আছে? ছেলে দু’টো কী করতে এসেছিল এখানে? হঠাৎ করেই রাস্তা শেষ হল যেন। রাস্তার ধারে একটা খোলা জায়গার উপর একটা ছোট বাড়ি নজরে পড়ল ওদের। ধড়ে প্রাণ এল তমোঘ্নর, “যাক অবশেষে মানুষের দেখা পাওয়া গিয়েছে। চল, তো দেখি”বলেই বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে, বাড়িটার ভিতরে কেউ নেই। কোনও আলো জ্বলছে না। এরকম একটা জঙ্গলের মধ্যে বাড়িটা যেন একেবারেই বেমানানভাবে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কয়েকটি ইট দিয়েই যেন তৈরি হয়েছে স্ট্রাকচার। চারপাশে জনবসতির চিহ্নমাত্র নেই। অন্যসময় হলে, বাড়িটা হয়তো এড়িয়েই যেত নিলু। কিন্তু তমোঘ্নর অবস্থা দেখে আর কিছু বলল না। বেচারা সত্যিই খুব টায়ার্ড হয়ে পড়েছে।

“কেউ আছেন?” তমোঘ্ন কড়া নাড়তে শুরু করে দিয়েছে।

“ও দাদা? ভিতরে কেউ আছেন?” ফের ডাকল। তিন-চারবার চিৎকার করার পর, ভিতর থেকে খুব মিহি একটা গলা ভেসে এল, “হ্যাঁ, কে?”

“বলছি, দরজাটা একটু খুলুন, দরকার আছে।”

দরজা খুলল, আর ভিতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন, তাকে দেখে গা শিরশির করে উঠল নিলুর। ভদ্রলোকের হাইট খুব বেশি হলে সাড়ে পাঁচ ফিট। মাথাভর্তি চকচকে ট্রাকের পিছনে কয়েকগোছা সাদা চুল। বয়স আন্দাজ ৬০-৬৫ হবে। খাটোপেড়ে ধুতি আর গায়ে একটা সাদা ফতুয়া।

কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভদ্রলোকের মুখ। দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন, মুখের চামড়া চারদিক থেকে জোর করে টেনে মাথার পিছনে নিয়ে গিয়ে জড়ো করেছে। ফলে তাঁর নাক, চোখ, ঠোট বিকটভাবে প্রসারিত। কিন্তু সারাজীবনে এত শীর্ণ লোক নিলু দেখেনি। বেঁচে আছে কী করে লোকটা? মনে হচ্ছে, কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি বা ভয়ানক দুশ্চিন্তা যেন কুড়েকুড়ে খাচ্ছে ওঁকে!

“হ্যাঁ সার, বলুন?” হাতজোড় করল লোকটি।

“গাপজালি গ্রাম…?” জিজ্ঞাসা তমোঘ্নর।

“এখান থেকে আরও মিনিটদশেক হাঁটা।”

“আরও মিনিট দশেক?”

“এখান থেকে একটু!” লোকটির ঠোঁটে হাসি দেখা দিল।

“ছাড়ুন মশাই, আপনাদের একটু’র যা বহর…” তমোঘ্ন রেগে গিয়েও, কিছু বলতে পারল না, “আচ্ছা, ওখানে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে?”

“তা তো জানি না! এখানে তো তেমন একটা কেউ আসে না!”

“ও বাবা। তা এখানে কি থাকার বন্দোবস্ত করে দিতে পারবেন?” তমোগ্ন অধৈর্য হল।

“এখানে?” অবাক হলেন লোকটি, “এখানে থাকবেন কী করে?”

“কেন? থাকা যায় না?”

“তা যায়। কিন্তু আপনারা কি থাকতে পারবেন?”

“খুব পারব। এখান থেকে গাপজালি কাছেই তো? ব্যস, তা হলেই হবে।”

তমোঘ্ন ব্যাগ নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে গেল, “চলে আয় নিলু।” ভদ্রলোক দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। নিলুও ভিতরে ঢুকে এল। ঘরের ভিতরের অবস্থা বাইরের চেয়েও সঙ্গিণ। ঢুকতেই কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল। অন্ধকার ঘরের এক কোনে একটা ছোট্ট কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। দেওয়াল দেখে মনে হল, কেউ বুঝি ছেনিহাতুড়ি দিয়ে বিভিন্ন জায়গা গর্ত করে দিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ঝুল আর উপরের কড়িকাঠ থেকে একটা জীর্ণ ফ্যান ঝুলছে।

নিলু আর তমোঘ্ন ঘরে দাঁড়িয়েই ছিল। হঠাৎই পিছন থেকে ভদ্রলোক এসে বললেন, “আপনারা উপরের ঘরে থাকতে পারেন। কিন্তু ক’দিন থাকবেন?” “কাল সকালেই চলে যাব।”বলল নিলু “ঠিক আছে সার, উপরে যান।” “তা এখানে কি খাবার-দাবার কিছু পাওয়া যাবে?” তমোঘ্ন জিজ্ঞেস করল। “কাছেপিঠে তো দোকান নেই! তা আমি যা খাই, তাই আপনাদের জন্যও ফুটিয়ে দেব না হয়!” ভদ্রলোকের হাত তখনও জোড় করা।

“অনেক ধন্যবাদ!” উপরের ঘরে এসে একটু আশ্বস্ত হল নিলু। যাক, দুজনের শোওয়ার মতো একটা তক্তপোষ অন্তত রয়েছে। তমোঘ্ন কোনও কথা না বলে, সোজা খাটের উপর বসে, একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তোর সঙ্গে এই আমার শেষ আসা। শালা, কী একখানা খবর, তার জন্য পুরো উইকেন্ডের বাঁশ করে দিলি। কী যে তোর মাথায় চাপে না নিলু! আমিও মাথামোটা। তোর কথায় নেচে ফেললাম!”

নিলু হেসে ফেলে বলল, “থাক, অনেক রাগ করেছিস। এখন একটা মাথা গোঁজার ঠাই তো অন্তত পাওয়া গিয়েছে! চল একটু ফ্রেশ হয়ে বেরই। ক্যামেরাটা নিয়ে নে।” ভদ্রলোকের প্রশংসা করতেই হয়। এর মধ্যেই চা তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। এসেই সামনের টেবিলের উপর রেখে বললেন, “আপনারা এসেছেন ভালই হয়েছে। কিছুটা গল্প করা যাবে।” “ধন্যবাদ আপনাকে। থাকতে না দিলে যে কোথায় যেতাম!” নিলু হাসল। “না না, ধন্যবাদের কী আছে সার! আসলে এদিকে কেউ আসে না তো?” “আচ্ছা, এই যে কিছুদিন আগে দু’টো ছেলে এসেছিল, তারপর তাদের একজন মারা গেল। জানেন কিছু?” তমোঘ্ন জিজ্ঞেস করল।

হঠাৎ কিছুটা শিউরে উঠেই ভদ্রলোক বললেন, “ওরা আমার এখানেই এসেছিল সার?” “মানে? এখানে ছিল?” নিলুর চোখ বড় বড়। “হ্যাঁ সার! কিন্তু রাতে যে কোথায় চলে গেল।” “মানে? মাঝ রাতে চলে গিয়েছিল নাকি?” “জানি না স্যার। জানলে কি যেতে দিই? তারপরেই তো শুনি একজন মারা গিয়েছে!” ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। “ছবি তোলার ব্যাপারটা কী?” তমোঘ্ন চায়ে চুমুক দেয়। “ওটাও ঠিক জানি না। তবে এখানে কাছে একটা বুড়ো অশ্বথ গাছ আছে, সেদিকেই গিয়েছিল।” “ওখানে যাওয়া যায়?” “আলবাত যায়। বেরিয়ে নাক বরাবর তিন মিনিট হাঁটলেই রাস্তার উপর পড়বে।”

ভদ্রলোক চায়ের কাপ তুলে বেরিয়ে গেলেন। নিলু যেন আর তর সইতে পারল না। জামাটা ছেড়েই একটা কালো গেঞ্জি গায়ে চড়িয়ে নিল। তারপর তমোঘ্নকে বলে, “চল, যাই! ক্যামেরাটায় ফুল চার্জ আছে তো?” এখানে বড্ড তাড়াতাড়ি সন্ধে নামে। আর তখন পাশাপাশি হাঁটলেও, অপর জনের মুখ দেখা যায় না। এতটা গাঢ় অন্ধকার অনেকদিন দেখেনি তমোঘ্ন। যদিও প্রাথমিক খারাপ লাগাটা ওর কেটে গিয়েছে। কারণ ও সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। বুড়ো অশ্বথ গাছের পাশে দাড়িয়ে অন্তত পাঁচ রকমের ছবি তুলেও, কোনও বিকট দর্শন মুখ দেখতে পায়নি নিলু। ফলে বিশ্বাস করেছে, ছবিটা সুপারইম্পোজ করা ছিল।

যদিও জায়গাটা দেখে গা ছমছমে ভাব আসা স্বাভাবিক। অশ্বত্থগাছটা রাস্তার উপরেই এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন মনে হচ্ছিল, যাওয়ার রাস্তা শেষ হয়ে গিয়েছে। অশ্বথের চারপাশেও বহু নাম না জানা গাছ প্রাচীর তৈরি করে রেখেছিল। ফলে অশ্বত্থের সামনের একটু ফাঁকা অংশেই যাবতীয় ছবি তুলেছিল ওরা। নিলু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল তখন, বারবার অশ্বথের দিকে তাকিয়ে বলছিল, “হ্যাঁ, রে তমোঘ্ন, এখানেই দেখা গিয়েছিল না মুখটা? ছেলেটা কীভাবে দাঁড়িয়েছিল মনে আছে শোন? আমিও দাঁড়াচ্ছি। তোল তো ছবি?”

তমোঘ্ন রেগে গিয়েছিল নিলুকে দেখে, “কী করছিস বলতো? কী পাগলামি চেপেছে তোর মাথায়? “পাগলামি নয়! দেখতে চাইছি। সত্যি ওসব হয়েছিল কিনা!” “কী দরকার?” “আচ্ছা, শোন না! ভূত দেখা কি সকলের ভাগ্যে থাকে রে? আমার খুব ইচ্ছে করে জানিস, একবার অন্তত কথা বলেই যাচ্ছিল নিলু। যেন কোনও একটা ঘোরে ছিল। আর বিরক্ত লাগছিল তমোঘ্নর। ছোটবেলা থেকেই ও এসব এক্কেবারে বিশ্বাস করে না। ভূতের গল্প ও পড়াও পছন্দ নয়। নিলুটাও এরকম ছিল না। হঠাৎ যে কী হয়েছে। একটা অজ পাঁড়াগাঁয়ে এসে, ছবি তুলে, ভূত দেখতে চেয়ে, কী প্রমাণ করতে চাইছে?

প্রায় এক ঘণ্টা পাগলামি চলার পর ধমক দিয়ে নিলুকে ধমক দিয়ে শান্ত করেছিল তমোঘ্ন। কিন্তু ফিরতে গিয়ে আর এক বিপত্তি! রাস্তা এত অন্ধকার যে বাড়িটা হারিয়েই ফেলেছিল ওরা। বাড়িটা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। ফলে ফিরতি পথে আরও কিছুক্ষণ হাঁটতে হয়েছে। কিন্তু তমোঘ্ন এখন খুশি। অন্তত নিলুকে বোঝানো গিয়েছে। নিলু এখন ল্যাপটপে ছবিগুলো তুলে রাখছে। তমোঘ্ন সেই সুযোগে ছাদে উঠে এল। অন্য এক রূপকথার দেশে চলে এসেছে বলে মনে হল ওর। এত গাছ, এত অন্ধকার…এত ঘন জঙ্গল বলেই বোধ হয়, জায়গাটাকে খারাপ বলে লোকে। অন্ধকারকেই তো মানুষের বেশি ভয়! যদিও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এতক্ষণ থাকলেও, কোনও পাখি উড়তে দেখেনি ও। এমনকী, রাস্তায় একটা কুকুরও দেখা যায়নি। এত গাছপালা, অথচ কোনও প্রাণী নেই? কে জানে, সন্ধে হয়ে গিয়েছে বলেই কিনা! তমোঘ্ন পিছন ফিরে ঘরের দিকে যেতে যাবে, হঠাৎই চমকে উঠল। ভদ্রলোক কখন চুপি-চুপি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, “স্যার, কেমন লাগছে?”

“ভালই তো!” তমোঘ্ন সিগারেট বের করল। “সেটাই। তাও কেন যে লোক আসে না!” “হুমম। অনেকে বলে, জায়গাটা নাকি খারাপ?” “সে তো ছিল!” “ছিল মানে?” তমোগ্ন অবাক হয়! “হ্যাঁ স্যার। অনেকদিন আগে এখানে ফি বছর তন্ত্র সাধনা হত!” ভদ্রলোকের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল! “হ্যাঁ, কাছে পিঠের সব কাপালিক এখানে এসে সাধনা করতেন। দশদিন ধরে চলত!” “কীসের সাধনা?” “পিশাচ, দুষ্ট আত্মাদের বশে আনার!” “আচ্ছা! সে তো অনেক জায়গাতেই হয়!” তমোঘ্ন মনে সাহস আনার চেষ্টা করল!

“না স্যার। এই সাধনা অন্য রকম! শুনেছি, মধ্যপ্রদেশের ভোপালের একটা গ্রামে নাকি এখনও হয়! সারারাত মৃতদেহের উপর বসে সাধনা, সঙ্গে বলি “বলি? মানে,” তমোঘ্নর গলা শুকিয়ে এল। “হ্যাঁ স্যার, নরবলি! গ্রামের ছেলেমেয়েদের এনে বলি দেওয়া হত! আর সেই মৃতদেহের উপর বসে চলত সাধনা। জোর করে বাড়ি থেকে তুলে এনে…কত বাড়ি এই করে ছারখার হয়ে গিয়েছে জানেন? পুরো গাপজালি গাঁ-টাই তো শেষ হয়ে গেল!” অন্ধকারের মধ্যেও তমোঘ্ন দেখল, ভদ্রলোকের মুখ ক্রমশ কালো হচ্ছে! “তা তা আপনি এখনও এখানে” তমোঘ্নর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।

“আমার মেয়ের জন্য সার, সুবির জন্য! কী ফুটফুটে মেয়ে যে ছিল এই গাপজালি গ্রাম যেন মাতিয়ে রাখত! কিন্তু সার হঠাৎ যে কী হল” ভদ্রলোকের গলায় উদ্বেগ ফুটে উঠল। “কী?” “কুড়ি বছরের জন্মদিনের দিন রাতে স্যার একদল লোক এসে, আমার ওই মা মরা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গেল! আমায় বেধড়ক মেরে তারপর তারপর শুনলাম, ওই অশ্বথ গাছের তলায় কারা যেন আমার সুবির ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিয়েছে!” ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ভদ্রলোক। তমোগ্ন কী করবে বুঝতে পেরে তাঁর পিঠে হাত রাখল। কিন্তু ভদ্রলোক বলেই চললেন, “কিন্তু আমি অপেক্ষা করে আছি সার। আমার মেয়ে যাওয়ার আগে বলেছিল, “বাবা আমি আসব। চিন্তা কোরও না তুমি। ঠিক ফিরে আসব।”

“কী বলছেন? মৃতরা ফিরে আসবে কী করে?” তমোঘ্ন অবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে। “সুবি যখন বলেছে, তখন নিশ্চয়ই আসবে স্যার। আমার মেয়ে কখনও মিথ্যে কথা বলত না,” ভদ্রলোকের গলায় ইস্পাত কাঠিন্য। “যাই হোক, তারপর? তারপর থেকেই এ গ্রাম যেন অভিশপ্ত! কাকপক্ষী দুরের কথা, কোনও মানুষও আসে না। সকলে বলে, গাপজালিতে নাকি শয়তানের বাস! কিন্তু আপনারা তো এলেন! কিছু হল?” ভদ্রলোক যেন আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন! “কিন্তু শুনেছি, ওই দুটি ছেলে নাকি…” “ওসব গুজব স্যার! অত ভয় পেলে চলে, বলুন?” ভদ্রলোক হাসলেন, “যান আপনি নীচে যান!”

তমোঘ্ন আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করল না। সিগারেটটা নিভিয়েই ঘরে ফিরে এল। কিন্তু এসেই দেখল, অন্ধকারের মধ্যেই নিলু পিছন ফিরে একদৃষ্টে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে। তমোঘ্ন হেসে ফেলল, “কী রে নিলু? নিজের ছবি আর কত দেখবি? এবার বন্ধ কর! ল্যাপটপের চার্জ শেষ হয়ে যাবে যে!” “ইচ্ছেটা পূরণ না হলেই বোধ হয় ভাল হত রে!”

“মানে?” তমোঘ্ন অবাক হয়। “মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছিল।” “কোন মেয়েটা?” “ওই যে রে, সুবি, যাকে বলি দেওয়া হয়েছিল!” নিলু ল্যাপটপ থেকে চোখ সরায় না। “সুবির কথা তুই কী করে জানলি?” তমোঘ্নর গলা কেঁপে গেল! “ওই তো বলল!” “কী বলছিস উল্টোপাল্টা?” তমোঘ্নর গলা চড়াল। “উল্টোপাল্টা নয়। সত্যিই ও বলল!” তমোঘ্নর মেজাজ গরম হয়ে গেল। একেই এই অন্ধকারে থাকতে এর একেবারে ভাল লাগছে না। তার উপর নিলুটা আজেবাজে ইয়ার্কি মারছে। এবার কিছু বলা দরকার। “ধুর, চুপ করবি এবার!” বলে ল্যাপটপের দিকে এগিয়ে যেতেই বুকের ভিতরটা ছাৎ করে উঠল ওর! ছবিতে নিলুর পাশে ওই মেয়েটা কে? সেই সাদা চোখ, রক্তহীন, ফ্যাকাসে! আগে তো ছিল না!

“নিলু এটা কে?” চিৎকার করতে গিয়ে যেন দম আটকে এল তমোঘ্নর। জানলাটা হঠাৎ খুলে এক ঝটকা বাতাস এসে চুল উড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোতেও ও স্পষ্ট দেখতে পেল, ঘর ফাঁকা আর কড়িকাঠ থেকে উল্টো করে ঝুলছে একটা দেহগায়ে সেই কালো রংঙের গেঞ্জি, গালে কাটা দাগ, মাথার চুলগুলো ছোট-ছোট করে ছাঁটা চোখগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে! যেন কিছুতে খুব ভয় পেয়েছিল নিলু! অথচ এইমাত্র তো সামনে বসে কথা বলছিল ছেলেটা?

তমোঘ্নর ‘নিলু’ বলে চিৎকার করে কাছে যেতে গিয়েও যেন পারল না। হঠাৎ করে মনে হল, এখান থেকে পালিয়ে যেতেই হবে ওকে। ঘর থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল ও। কিন্তু দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই, ভদ্রলোক রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন, “কী হয়েছে স্যার? কী হয়েছে? হাঁফাচ্ছেন কেন?” “আমার বন্ধু! কেউ ওকে খুন করেছে। আর সেই মুখ” কথাগুলো আর্তনাদ করে কোনওরকমে মুখ দিয়ে বের করল তমোঘ্ন! “খুন করেছে? আপনার বন্ধুকে! কোথায়? আর কোন মুখের কথা বলছেন স্যার? কার মুখ?” ভদ্রলোকও যেন চিৎকার করেন! “সেই মেয়েটা, যাঁর ছবি কাগজে?” তমোঘ্নর দমবন্ধ হয়ে এল। “কাগজে? মেয়ে? আচ্ছা সার, ওই দিকে দেখুন তো, ওই মুখটা কিনা?”

পাশের দেওয়ালের দিকে তাকিয়েই তমোঘ্নর হৃৎপিণ্ড মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হল। রক্তহীন, ফ্যাকাশে, হাড়ের উপর চামড়া। জড়ানো মেয়েটা যেন ক্রমশ কাছে চলে আসছে! চারিদিক হঠাৎ যেন খাঁ-খাঁ করতে শুরু করল। আর কিছু মনে থাকল না তমোঘ্নর! দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল। বাড়ি থেকে বেরিয়েই বাঁ দিকে যেদিকে অ্যাম্বাসাডরটা ওদের ছেড়েছিল।

কিন্তু ও বুঝতে পারল, পিছনেও কেউ খুব জোরে দৌড়ে আসছে, যেন হাওয়ার চেয়েও বেশি বেগ তার। একটু পরেই ধরে ফেলৰে তমোঘ্নকে! কানের পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ শব্দে হাওয়া ছোটার পাশাপাশি আর কিছু শব্দও আসছে! এক অশরীরী কণ্ঠের আর্তনাদের সঙ্গে সেই ভদ্রলোকের গলা, “সুবি, সার, সুবি! আমার মেয়ে ফিরে এসেছে স্যার! বলেছিলাম না, ও কোনওদিন মিথ্যে বলে না! ওর জন্যই তো অপেক্ষা করে আছি বহুযুগ!” নিলুর গোঙানির শব্দও পাচ্ছে তমোগ্ন। সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর আজ আর থামার অবকাশ নেই। ছুটতে ওকে হবেই।

অন্ধকারের বুক চিরে ছুটছে তমোঘ্ন, পিছনের আর্তনাদ আর দৌড়ের শব্দটা যেন আরও কাছে আসছে পাঁচদিন পর এক পুলিশ এসে স্থানীয় থানায় রিপোর্ট করল, “স্যার, দিন কয়েক দু’জন ছেলে গাপজালি বলে একটি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। কথা ছিল, পরের দিন ফিরে আসবে। কিন্তু ফেরেনি। আমরা কুকুর নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও এসেছি। কিন্তু কিছু পাইনি। অদ্ভুত জায়গা, ওই এলাকায় একজনই মাত্র ভদ্রলোক থাকেন, তাঁর মেয়েকে নিয়ে। তিনিও জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে সেখানে কেউই নাকি আসেনি! ভদ্রলোকের মেয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ স্যার। নাম সুবি। কোনও কথা বলে না, শুধু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। পরনে ছেলেদের মতো কালো গেঞ্জি জিনস, চুলগুলো প্রায় নেড়ার মতো করে ছাঁটা আর বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে।”

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত