গভীর রাতের আতঙ্ক

গভীর রাতের আতঙ্ক

সবে চোখটা একটু লেগেছিল, আওয়াজ শুনে ভুরু কুঁচকে উঠল জটাধারীর। না, আলাদা করে কোনাে শব্দ এখন আর বােঝার উপায় নেই। সেই দুপুর থেকে যে প্রলয় কাণ্ড শুরু হয়েছে- ভেবেছিল সন্ধে রাত নাগাদ সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, নিম্নচাপ না কী সব বললে রেডিয়ােতে, সে আর কতক্ষণ থাকবে। কিন্তু রাত যত বাড়বে তর্জন-গর্জন ততই বাড়তে থাকবে, এ তাে বাপু বাপের জন্মে দেখিনি কখনাে। জটাধারী চোখ বুজেই কান দুটো খাড়া রাখল। সারাদিন যা ঝক্কি গেছে, এত চট করে ঘুম ভেঙে হবার তাে কথা নয়।

শব্দটা হল কিসের! সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এত সব বিচ্ছিরি আওয়াজের মধ্যেও যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন ঘুমটা তাে আর যে সে আওয়াজে ভাঙবে না। ঘুম তাে একেবারে বিখ্যাত জটাধারীর। চন্দনপােতা গ্রামে যখন থাকত, গাঁসদ্ধ লােক চিনত তাকে ওই ঘুমে—বলত ঘুমুলে তুই একেবারে মরা! ঘরে আগুন লাগলে টের পাবি না!’ তা সে তাে বহুকালের কথা, গাঁয়ে মড়ক লাগার পর বউ গেল, মেয়েটাও গেল—থাকা বলতে ওই ঘেঁটুচরণকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল কলকাতায়। সেও তাে আজ নয় নয় করে- ঠক! ঠক! ঠক! ঘাড় হঠাৎ ঘুরে গেল জটাধারীর। দরজায় আওয়াজ হচ্ছে ? ডাকছে কেউ? এই ঘাের দূর্যোগের রাতে !

সিঁটিয়ে পড়ে রইল জটাধারী। অসম্ভব! এই ঝড়জলের রাতে বাইরে হাওয়ার বেগ আরাে বেড়েছে বােধহয়। ঘরটা বােধহয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে এবার। এক- একবারের দমকা হাওয়া আছড়ে পড়ছে আর মনে হচ্ছে কাঠের পার্টিশান দেওয়া ঘরটা বুঝি কাত হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে জলের ঝাপটা। ছাদের অ্যাজবেস্টসের ওপর এমন জোরে পড়ছে ফোটাগুলাে, ছাদ যেন ফুটো হয়ে যাবে মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে। না, এই ভয়ংকর রাতে জটাধারীর কাছে কেউ আসবে না, তা সে যত ভালাে কাঠের মিস্ত্রিই হােক না কেন! সবচেয়ে বড়াে কথা, এ ঘর সে খুঁজেই পাবে না। রামমােহন সরণীর এই বাড়ির সামনে গা থেকে যেদিন ছেলেটাকে কোলে করে হাজির হয়েছিল, ও তাে একটা কাঠের গােলাই ভেবেছিল এটাকে। হ্যা, চিন্টুরামের গােলা তাে এটা বটেই, কিন্তু ভেতরে এই যে ঘরের মধ্যে ঘর, তার মধ্যে ঘর—এই গােলকধাঁধার কিছু কি ছাই জানত তখন সে!

চিন্টুরাম তার হাতের কাজ দেখে খুশি হয়ে যখন এই ঘরটা তিরিশ টাকায় ভাড়া দিয়েছিল, ঘরে উঠতে গিয়েই তাে ভিরমি খেয়েছি। সে। পাঁচবার উঠোনে পাক খাবার পর কাঠের সিঁড়ি—সিঁড়ি না বলে মই বলাই ভালাে, অতি সাবধানে উঠে এই ছােট্ট কাঠের ঘর, ওপরে অ্যাজবেস্টসের ছাউনি। না, তার অবশ্য অসুবিধে হয় না। বাপ- ছেলে বসে কাজ করে, কাঠ তাে চিন্টুর কাছেই থাকে। দুপুর বেলা এই ঘরেই দুটো ফুটিয়ে নেওয়া রাত্তিরেও বেশিরভাগ চলে যায় তাতেই। আজকেও সেই রকম করেই মুড়ি-টুড়ি খেয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল জটাধারীর। শব্দটা হল আবার। কোনাে ভুল নেই। এবার আরাে জোরে। আশ্চর্য! এমন রাতে কেউ আসতে পারে তার কাছে! সামান্য একটা ছুতাের মিস্ত্রির কাছে কে আসবে ঝড়-জল ঠেলে! এই ছােট্ট কাঠের ঘর, ওপর কাছেই থাকে। দুপুর বেলা করেই মুড়ি-টুড়ি — গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল জটাধারীর।

শব্দটা হল আবার। কোনাে ভুল নেই। এবার আরাে জোরে। আশ্চর্য! এমন রাতে কেউ আসতে পারে তার কাছে! সামান্য একটা ছুতাের মিস্ত্রির কাছে কে আসবে ঝড়-জল ঠেলে! একবার মনে হল, চিন্টুভাই নয় তাে! কিন্তু এই রাত-বিরেতে তারই বা কী দরকার। সে তাে আর পালিয়ে যাচ্ছে না। সকাল হলেই তাে — ঠক! ঠক ঠক? এবার আরাে জোরে এবং আরাে নির্ভুল ভাবে। কোনাে উপায় নেই না উঠে। বিছানা থেকে উঠে হাত বাড়িয়ে সুইচটা টিপল জটাধারী। সেই একই রকম রয়েছে আলােটা। ভােল্টজ খুব কমে গেছে আর কাঁপছে মৃগী রােগীর মতাে। সন্ধের পরই হয়েছিল এইরকম, এখনও ঠিক হল না। বিরক্ত মুখে ঘাড় ঘােরাতেই অ্যালার্ম ঘড়ির ওপর চোখ পড়ল। একটা দশ। রাত একটা দশে কেউ কারাে বাড়ি আসে!

গলাটা কেমন শুকিয়ে উঠছিল জটাধারীর। তাকিয়ে দেখলে, ঘেঁটু অঘােরে ঘুমােচ্ছ। ওঃ, ঘুম পেয়েছে বটে বেটা! বাপকেও টেক্কা দেয় একেবারে। গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিল একবার, গলায় জোর তেমন ছিল না, ডাকল ফিসফিস করে, এই ঘেঁটু-ঘেঁটু রে— নাঃ, ওকে তােলা যাবে না। যা থাকে কপালে। পায়ে পায়ে কপাটের দিকে এগিয়ে গেল জটাধারী। দুর্যোগের রাত বটে, তবে গােটা বাড়িতে থই থই করছে লােক। তেমন করে একটা হাঁক মারতে পারলে লােকের অভাব হবে না। কপাট খােলার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের উন্মত্ত তাণ্ডব হু হু করে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে। এলােপাথাড়ি হাওয়া আর শোঁ শোঁ শব্দ মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড করে দিল সব কিছু। দরজা ফের বন্ধ করার আগেই মানুষটা ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। মানুষ না বলে দৈত্য বলাই ভালাে!

দরজার চেয়ে উঁচু মাথায়। গতরও সেইরকম। সমস্ত শরীরটাই বর্ষাতি দিয়ে ঢাকা। মাথার টুপি নেমে এসেছে মুখের ওপর—ফলে নাক-মুখ-চোখ কিছুই বােঝা যাচ্ছে না। তার ওপর ঘরের কাপা কাপা আবছা আলাে লােকটাকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে। দেখলেই কেমন যেন আতঙ্ক জাগে মনে। চোখ পড়লেই গাটা শিরশির করে ওঠে। ‘জটা মিস্ত্রি ? কোথা থেকে যেন ভেসে এল স্বরটা। যেন এ ঘর থেকেই নয়, ফঁাসা ফ্যাসা খােনা কণ্ঠস্বর। উচ্চারণটাও কেমন কেমন। কিন্তু তার চেয়েও অবাক লাগছে নাম জানাটা। আপাতত অবশ্য কোনাে রকমে বিদায় করাটাই আগে দরকার, তাই কোনােরকমে বললে, ‘হ্যা, কিন্তু আপনি ‘কফিন বানাতে পারাে?’ থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল সেই হিসহিসে কণ্ঠস্বর, এবার যেন সাপের মতাে কেমন ছােবল মারছে। কফিন বানাতে পারে জটাধারী। খানদানী মুসলমান পরিবারের কিছু কফিন বানিয়েছে, চিন্টুই নিয়ে এসেছে ওর কাছে। বলল সে কথা।

‘কালকেই চাই কিন্তু আমার, রাত্তিরে। কালকেই—মানে, হাতের কিছু কাজ- বাজে কথা আমার পছন্দ নয়’—এবার গলার আওয়াজে যেন মেঘ ডাকছে। মেঘ ডাকছে এখানেই, নাকি বাইরে—নাকি ওর বুকের মধ্যেই ! বলছিল, ‘প্রচুর টাকা পাবে, সে জন্যে ভেবাে না। কাঠটা দামি চাই, পিওর বার্মা টিক। পিওর বার্মা টিক! ব্যাটা জানল কোথা থেকে? আসল বার্মা সেগুন কি এখন চট করে পাওয়া যায়! কালই চিন্টুরাম নিলামে কিনে এনেছে—রাসেল স্ট্রিটে একটা সাহেববাড়ি ভাঙা হচ্ছিল, মওকা বুঝে কিছু মাল তুলে ফেলেছে। ‘নাও, ধরাে’—লােকটাই বলছিল। হাতটা একবার ওভারকোটের পকেটে ঢুকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসেছে। আর সেদিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর কে যেন দু’বার হাতুড়ি পিটে দিয়েছে জটাধারীর।

হাতে কড়কড়ে কিছু নােট, তার পরিমাণ বিশাল। কিন্তু কারণটা ঠিক তাও নয়। এরকম হাত কোনাে মানুষের হয়। আবছা আলােয় ঠিক দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে এমন দশাসই মানুষের হাতে এক ফোটা মাংস নেই—একেবারে শুকনাে খটখটে একটা সাদা হাত। ভাববার মতাে মনের অবস্থা ছিল না। কোনােরকমে আলগােছে টাকাটা নিয়ে জটাধারী বললে, “আজ্ঞে, মাপটা কী হবে? ‘দেখে নাও। “মানে?” জটাধারীর মাথায় কিছু ঢুকছিল না। বেশি কিছু ভাববার আগেই লােকটা আবার বললে, ‘আমারই কফিন। গুম গুম করে একসঙ্গে হাজারটা ঢাক যেন বেজে উঠল কানের কাছে। সাপের ছােবলের মতাে ঠান্ডা বাতাস আছড়ে পড়ল বুকে!

হতভম্বের মতাে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল কে জানে। খেয়াল হতে দেখল, কেউ কোথাও নেই। দরজাটা খােলা।। বাইরে বেরিয়ে দেখে এলে হত, জটাধারী দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগল। গােটা ব্যাপারটাকেই একটা দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছিল সকালে। , ঘুম ভালাে করে হয়নি জটাধারীর রাত্তিরে। একটু করে চোখ লেগে এসেছে আর দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে মনে করে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সকালে ঘেঁটু সব শুনে হেসে উঠেছিল, বলেছিল, ‘তুমি বাবা একটা ভীতুর ডিম! কেউ এলে আমার ঘুম ভাঙতাে নি!’ ঘুম ভাঙবে! তুই তাে ব্যাটা বাপের চেয়ে এক কাঠি বাড়া। আসলে সব স্বপ্ন হতে পারে, কিন্তু চোখের সামনে ওই কড়কড়ে নােটের তাড়া—ওটা তাে আর স্বপ্ন নয়।

চিন্টুরাম বলেছিল, ‘দূর, অতাে রাত্তিরে এসেছে বলেই তাের আবােল-তাবােল কথা মনে হচ্ছে। কেউ হঠাৎ মারা গেলে কফিন তাে সঙ্গে সঙ্গেই লাগে, এ আর বেশি কথা কী ? ‘কিন্তু ওই যে বললে কফিন ওর নিজের জন্যে । ‘তবে কি ডেডবডি সঙ্গে করে নিয়ে আসবে! ওর মতােই হয়তাে বড়ােসড়াে চেহারা—তাই নিজেকে দেখিয়ে দিয়েছে।’ না, তাও ভয় কাটছিল না জটার। দেখে চিন্টু বলেছে, “ঠিক আছে বাবা, রাত্তিরে লােকটা আসবে বলেছে তাে! আমি থাকব না হয় রাতে তাের সঙ্গে। “না না, তার দরকার নেই’—জটাধারী বলেছিল, ‘তুমি আজ ঘেটুরে তােমার কাছে রেখে দিয়ে, তাইলিই হবে।’ তাে, সেইরকমই হয়েছে। সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে দুটো ভাতে ভাত বেঁধে ওকে খাইয়ে দিয়েছে জটাধারী, নিজেও খেয়ে নিয়েছে। ঘেটু অঘঘারে ঘুম দিচ্ছে, দেখে এসেছে নটার পর গিয়ে। তারপর থেকেই এই প্রতীক্ষা।

ঘড়িটা একবার দেখতে পারলে হত। দেখে অবশ্য লাভ নেই, যতক্ষণ শুয়ে আছে, বারােটা- সাড়ে বারােটা হবেই। তেষ্টাও যেন পাচ্ছে একটু একটু। কিন্তু উঠতে গেলেই মােমবাতিটা জ্বালতে হবে। কালকের দুর্যোগ তাে কাটেনি এখনও, একটু ভাটা পড়েছে এইমাত্র। তবে আলােটা তেমনি গেছে দুপুর থেকে। যাওবা মিট মিট করছিল পিদিমের মতাে, দুপুর থেকে তাও ফট। সেইজন্যেই তো সারা দুপুর-বিকেল কাজ করে কাজটা উদ্ধার করেছিল জটাধারী, আলাে যদি রাত্তিরেও না আসে, হাতের কাজ তাে সারতে পারবে না। ঠিক তাই হল, ছাইয়ের আলাে কি আজ আর আসবে। কক্ষনাে না। না, কাজটা জটাধারী খারাপ করেনি। ভয়েই হােক আর টাকার গুণেই হােক, কাজটা একেবারে পাকা হাতে সেরেছে। চিন্টুরাম মালটাও দিয়েছিল সরেস—ওই সাহেববাড়ি থেকে কেনা এক নম্বর সেগুন কাঠ। র্যাদা চালাচ্ছে যেন হাত বােলাচ্ছে ঘেঁটুর গায়ে। একটু ঘষতেই কি ফাইবার! আফশােস।

হচ্ছিল, এমন কাঠ কেউ মাটির তলায় দিয়ে নষ্ট করে! যাক গে, সে যার জিনিস সে যা খুশি তাই করুক। কিন্তু কথা হচ্ছে, সত্যি সত্যি সে আসবে তাে! নাকি সারাদিন ধরে জটার এই পরিশ্রমটাই বেকার! বলেছিল রাত্তিরে আসবে, তাে সে রাত্তির মানে ক’টা! রােজ রােজই কি মানুষের কাছে গিয়ে রাতদুপুরে এইরকম উৎপাত করবে নাকি! সারাদিন। পরিশ্রম করেছে, একটু ঘুম-টুম তাে মানুষের দরকার, না কী! ভাবছিল, তার মধ্যেই শব্দটা কানে এল জটার। কালকের সেই শব্দই, কিন্তু একটু মােলায়েম, একটু আস্তে আস্তে। শব্দটা শুনেছে তাে ঠিক! নাকি ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা রয়েছে বলেই ভুল শুনছে! একটু অপেক্ষা করে দেখবে? কেউ এলে সে তাে ডাকবে আর-একবার! ডাকল। বেশি অপেক্ষা করতে হল না জটাধারীকে।

ঠক! ঠক! ঠক! বিছানা থেকে নামল জটাধারী। মাথার কাছেই ছিল দেশলাইটা। মােমবাতির কাছে এগিয়ে গেল। হাত কাঁপছিল। দুটো দেশলাই কাঠি খরচা করে কোনাে রকমে ধরাল মােমবাতিটা। কুঁজো থেকে গড়িয়ে একটু জল খেল। জল একটু ছলকে পড়ল মেঝেয়। একটু বুঝি লাগলও কফিনের গায়ে। প্রায় গােটা ঘর জুড়েই তাে রয়েছে ওটা। দরজা পর্যন্ত এগুবার আগেই আবার সেই শব্দ। আবার সেই মূর্তি। আজ যেন আরাে উৎকট লাগছে। মােমবাতির আবছা আলােয় মুখের গহ্বরগুলােই যেন বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। ভেরি গুড। কফিনের ওপর নজর পড়েছে তার, আগের দিনের মতাে ফঁাসা গলায় বলেছে, ‘ওটা বার করে দাও ঘর থেকে। সে আর বলতে! আপদ যত তাড়াতাড়ি বিদেয় হয় ততই তাে মঙ্গল। বাকি রাতটা অন্তত ঘুমােতে পারবে একটু শান্তিতে।

বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল, কোনাে রকমে টানতে টানতে কফিনটাকে নীচে নামবার সিঁড়ির কাছে নিয়ে এল জটাধারী। ওভারকোটের পকেট থেকে হাত বার করেছিল লোেকটা, বললে, “ঠিক আছে। হাত নেড়ে চলে যেতে ইঙ্গিত করল। না বললেই যেন দাঁড়াত জটাধারী! তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে মােমবাতিটা ঠিক জায়গায় রেখেছে, পেছন ফিরতেই সেই মানুষ। ঘাড়ের কাছে যেন নিশ্বাস ফেলছে। বুকটা ধক করে উঠেছিল জটাধারীর, বললে, “আজ্ঞে—’ হাতটা বেরিয়ে এল লােকটার পকেট থেকে। হাতে ধরা একটা ছােটো সুদৃশ্য তালা আর রিংসমেত একটা চাবি।

‘তালাটা তুমি বন্ধ করে দেবে কফিনের। ঠিক আছে? তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে হাতটা বােধহয় ছুঁয়ে ফেলেছিল জটাধারী। সঙ্গে সঙ্গে যেন গােটা শরীরে বিদ্যুত্তরঙ্গ খেলে গিয়েছে। হিমশীতল একটা হাত। যেন বরফের চেয়েও ঠান্ডা। একেবারে অবশ করে দেওয়ার মতাে। কোনােরকমে মাথা নিচু করে কফিনের দিকে এগিয়ে গেল। বেশ দামি তালা মনে হচ্ছে। সােনার না কি? কে জানে! চাবিটা লাগিয়ে রিংসুদ্ধ চাবিটা ফেরত দেবার জন্যে মুখ তুলেই চক্ষুস্থির। গেল কোথায় মানুষটা! এই তাে জলজ্যান্তো দাঁড়িয়ে ছিল চোখের সামনে। এর মধ্যে যাবে কোথায়! ঘরে সেঁধােয়নি তাে গিয়ে আবার? তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল জটাধারী। কই না, ঘরেও তাে নেই। তাহলে! বিস্মিত চোখে ঘাড় ঘুরিয়েছিল জটা। চোখে যা পড়ল তা না দেখলেই বুঝি ছিল ভালাে।

গােটা কফিনটা এখন ভাসছে হাওয়ায়। ঠিক যেন কেউ কাঁধের ওপর তুলে নিয়েছে। মনে হচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে কেউ নেমে যাচ্ছে নীচে। চোখ দুটো ভালাে করে কচলে নিল জটাধারী। সম্ভব না, একেবারেই সম্ভব নয়। একা একা ওই কফিন নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামবে, সেটাই অসম্ভব—কারণ সিড়ি তাে ওটা নয়, আসলে ওটা মই। তার চেয়েও বড় কথা হল, কে বইছে ওটা! কেউ তাে কোথাও নেই—স্পষ্টই তাে দেখা যাচ্ছে ওটা আপনি-আপনি এগিয়ে যাচ্ছে। জটাধারী এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে। ইচ্ছে ছিল না একটুও, কিন্তু মনে হল কেন যেন টানছে ওকে চুম্বকের মতাে। কফিনের পেছন পেছন যাওয়া ছাড়া কোনাে উপায়ই যেন তার নেই। এক অদৃশ্য শক্তি যেন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তাকে ওদিকে। রাস্তায় এসে পড়ল কফিন। হাওয়ার বেগ ততটা নেই, কিন্তু যা আছে তাও নেহাৎ মন্দ নয়।

বৃষ্টি পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি। শীত এখনাে পড়েনি, কিন্তু ভিজে গায়ে হাওয়ার ঝাপটা লেগে রীতিমতাে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল জটাধারীর। কেন যাচ্ছে, কতক্ষণ যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে—কিছুই খেয়াল ছিল না জটার। খেয়াল রেখে কোনাে লাভও ছিল না তার। গায়ে নিশির ডাকের কথা শুনেছে, এও যেন ঠিক তেমনি ব্যাপার। দেহ কাঁপছে ঠক ঠক করে, ভেতরে ভেতরে কাঁপুনি ধরছে—অথচ চোখের দৃষ্টি ওই একদিকে, পা চলছে যন্ত্রের মতাে। শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে কফিন থেমেছে সে জায়গাটাকে চিনতে পেরেছে জটাধারী। পেরে আর-একবার একটা শীতল স্রোত নেমে গিয়েছে ওর মাথা থেকে শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে। এটা তাে কবরখানা।

হ্যা, সেই কবরখানা। বহু কবর যেখানে শােয়ানাে। মাটির ওপর ছােট ছােট স্তম্ভ আর ফলক। চিন্টুরাম একবার নিয়ে এসেছিল তাকে এখানে। কফিন ওই দু-এক মুহূর্তই চুপ করে ছিল। নির্জন রাস্তা। একটি লােক নেই কোথাও। প্রত্যেকটি বাড়ির জানলা বন্ধ। রাস্তা ছাড়া এক ফোটা আলাে নেই কোথাও। শুধু আবছা ঘােলাটে রাস্তার আলােয় দেখা যাচ্ছে এখন, কফিন বড়াে লােহার গেটের ওপর দিয়ে ঢুকছে ভেতরে। আমি কী করে ঢুকব, গেট তাে আমায় খুলে দেবে না কেউ—এ সব চিন্তার অনেক আগেই জটাধারী দেখতে পেল গেট বেয়ে সে ওপরে উঠছে। কে দেখে ফেলবে, দেখে ফেললে কী হবে, এ সব কথা ভাববার সময়ও ছিল না, ভাবার মতাে অবস্থাতেও ছিল না সে। কফিনের সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়াল বিস্তীর্ণ গােরস্থানে। আর তারপর যা হল- কোনােদিন কল্পনাও করা যাবে না সে দৃশ্য !

কফিন থেমে গেল একটা স্তম্ভের কাছে এসে। ঠিক তার পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় নেমে পড়ল সেটা মাটিতে। আর ওই স্তম্ভটা এবার যেন নড়ে উঠল হঠাৎ। দেখতে দেখতে, কেঁচো যেমন করে মাটি খুঁড়ে ওঠে, তেমনি ভাবে মাটির পুঞ্জ সরিয়ে একটা কফিন উঠে এল নীচ থেকে। একটা হু হু হাওয়া ছুটে এল যেন কোথা থেকে। সমস্ত গােরস্থান কাঁপিয়ে ধুলাের ঝড় উঠল। ধুলােয় ঢেকে গেল সমস্ত কিছু। সেই ধুলাের আস্তরণ যখন সরে গেছে সামনে থেকে, জটাধারীর কানে এল শিস দেবার মতাে এক তীব্র শব্দ। সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেছে দুটো কফিনের ডালা। পরমুহুতেই উঠে এসেছে কফিনের ভেতর থেকে দুটো চেহারা।

একেবারে সেই চেহারা যে কফিনের অর্ডার দিয়ে এসেছিল, কফিন চাইতে এসেছিল। যেন দুটি যমজ ভাই। এক চেহারা, এক পােশাক। দুজনে এগিয়ে এল সামনে। জড়িয়ে ধরল দুজন দুজনকে। আবার একটা তীব্র হাওয়া। টুপি উড়ে গেল হাওয়ায়। এবার স্পষ্ট দেখতে পেল জটাধারী। দুটি নরকরােটি হাসছে হা হা করে। বীভৎস হাসিতে ফেটে পড়ছে—সাদা দাঁতের পাটি ঝলসে উঠছে। ওই মৃদু আলােতেও—সেই সঙ্গে কান-ফাটানাে অট্টহাসি- একটা আর্ত চিৎকার এবার বেরিয়ে এসেছে বুক চিরে। কাটা গাছের মতাে সেখানেই আছড়ে পড়েছে জটাধারী। ধড়মড় করে উঠতে যাচ্ছিল জটাধারী, ছুটে এল খাকি পােশাক পরা গার্ড, বললে, “যাক, জ্ঞান হয়েছে তাহলে। চুপ করে শুয়ে থাকো, আমি ফাদারকে একটা খবর দিই।’

গার্ড চলে গেলে জটাধারী একটু ভালাে করে দেখতে চেষ্টা করল কোথায় আছে সে। ছােটখাটো ঘর একটা। জানলা দিয়ে এক টুকরাে রােদ পড়েছে দেওয়ালে। তার মানে সকাল। হয়ে গেছে। দুর্যোগও কেটে গিয়েছে। ঘরের চেহারা দেখে বােঝাই যায় লােকটা একা থাকে এখানে। কাপড়-জামা ঝুলছে ক’টা। রান্নাবান্নার সরঞ্জাম রয়েছে একদিকে। তার মতােই ব্যবস্থা। একটু একটু করে গােটা ব্যাপারটা মনে পড়ছিল জটাধারীর। কফিনের সঙ্গে সঙ্গে সারা কলকাতার রাস্তায় ঘােরা, গােরস্থানে এসে পড়া, লােহার গেট টপকানাে, তারপর আর! আর ভাবতে পারে না জটাধারী। মাথার ভেতরটা কেমন টনটন করে ওঠে। তাহলে কি সেই কংকালটাই তাকে আক্রমণ করেছিল, নাকি—গলার আওয়াজে বুঝতে পারল গার্ডটা ঢুকেছে ফের, বলছিল, একটু দুধের ব্যবস্থা করে এলাম তােমার জন্যে। নাড়ি খুব দুর্বল, ওই অবস্থায় অক্কা যে পাওনি এই ঢের।

“কী হয়েছিল আমার ? খুব আস্তে আস্তে কোনােরকমে বলল জটাধারী। ‘সেটা তাে তুমিই বলবে আমাকে। লােকটা বসল এসে পাশে—‘চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে গিয়ে দেখি একটা কবর খোড়া, কফিন বাইরে বার করা—আর তুমি পাশে পড়ে আছ অজ্ঞান হয়ে। ‘আর একটা কফিন ছিল না পাশে? নতুন কফিন?’ ‘ছিল বলেই তাে বেঁচে গেলে তুমি। আমি ভেবেছিলাম তুমি ডেডবডি চুরি করতে এসেছ পুলিশকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, তখন দেখি ওপাশে আর একটা নতুন কফিন। ‘যাক পেয়েছ তাহলে!’

“হ্যা, কিন্তু তারপর যে ব্যাপার হল সে তাে আরাে সাংঘাতিক। ফাদারকে যখন ডেকে নিয়ে এলাম তখন দেখি কবর খোঁড়ার কোনাে চিহ্নই নেই, স্তম্ভ যেমন ঠিক তেমনটি। ‘সেকি? ‘তার চেয়েও আজব কাণ্ড—নতুন কফিনে আর একটা ডেডবডি। সেটা আবার জানা গেল তােমার হাতের মুঠোয় ধরা চাবি দিয়ে সেটা খুলে। তার মানে ডেডবডি কফিনে ভরে তুমি নিয়ে এসেছ একা একা, যেটা আরাে অসম্ভব। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিল জটাধারী, কিছুই ঢুকছিল না মাথায়। দেখতে পেল সাদা পােশাক পরা এক ফাদার ঢুকছেন ঘরে। হাসিমুখে তিনিই বললেন, কিছু বুঝতে পারছ না তাে? সব বুঝিয়ে বলছি তােমাকে, আগে তুমি আমাকে বলল কী হয়েছে।’

গুছিয়ে সব কিছু বলার মতাে জ্ঞানগম্যি কি আর আছে নাকি ছাই জটাধারীর! তার ওপরে শরীরের যা অবস্থা! একটুখানি দুধ খেয়ে উঠে বসল, তারপর যেটুকু পারল বলল সব। ফাদার বললেন, হ্যা, যা ভেবেছি ব্যাপারটা ঠিক তাই। রাসেল স্ট্রিটের যে সাবেক বাড়িটা ভাঙা হয়েছে ওখানে অনেক দিন আগে থাকতেন দুই ভাই, জন পামার আর হ্যামফ্রে পামার। তামাকের ব্যবসায় খুব পয়সা করেছিলেন তারা। বার্মা থেকে এক ব্যবসায়ী ওঁদের বাড়িতে আসার পরই জন পামার হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। হ্যামফ্রের ধারণা তার ভাইকে খুন করে ওই বাড়িতেই কোথাও গুম করে রাখা হয়েছে—যে কারণে ব্যবসাতে মন্দা দেখা গেলেও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাননি উনি। এ সব গল্প আমাকে উনিই বলেছেন। শেষ দিকে দেখেছি মাথার একটু গােলমাল দেখা দিয়েছিল।

সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াতেন। আমাকে অনুরােধ করেছিলেন ওঁর কবরের পাশে যেন একটা জায়গা ফাকা রাখা হয় ভাইয়ের জন্যে। সে ইচ্ছেও আমি পূর্ণ করেছিলাম ওঁর। প্রায় বছর তিনেক হল উনি মারা গেছেন। বিয়ে-থা দুই ভায়ের কেউই করেননি। এখন বিলেত থেকে ওঁর এক ওয়ারিশন এসে জোর করাতেই বাড়িটা ভাঙা হয়েছিল। বুঝতে পারছি, হ্যামফ্রের অনুমানই ঠিক। জনের অতৃপ্ত আত্মা এতদিনে ভাইয়ের মনের আশা পূর্ণ করতে পারল। হাঁ করে শুনছিল সব কিছু, ফাদার থামতে জটাধারী জিগ্যেস করলে, কিন্তু উনিই যে পামার সাহেব আপনি বুঝলেন কী করে? “দেখো, কী করে বুঝলাম’—সেই চাবি বার করলেন ফাদার গাউনের পকেট থেকে, এই চাবিই উনি দিয়েছিলেন তােমাকে। খাটি আইভরিতে বানানাে চাবির রিং, নামটা খােদাই করা আছে ওখানেই,
দেখাে না!’

হাসি পাচ্ছিল জটাধারীর, এই এতক্ষণ পরে। ক-অক্ষর গাে-মাংস বলে কথা। সে পড়বে ইংরেজিতে লেখা নাম! হেসে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল, বললে, ‘আমি যাচ্ছি ফাদার। ‘একটু রেস্ট নিয়ে যাও, তুমি এখনাে দুর্বল’ ধুত্তেরি ছাই দুর্বলের নিকুচি করেছে। আসলে ঘেটুচরণের কথা মনে পড়ে গিয়েছে ওর। সারা রাত ছেলেটা যে কী করেছে কে জানে। দরজা দিয়ে ছিটকে বেরুতে বেরুতে বলেছে, “আমার ছেলেটা যে একা আছে গাে ফাদার’।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত