নির্জন ফরেস্ট বাংলােয়

নির্জন ফরেস্ট বাংলােয়

দু’ধারের ঘন বনের জমাট অন্ধকারের ভেতর থেকে হাওয়ার একটা অদ্ভুত শব্দ গাড়ির শব্দকে ছাপিয়ে বুঝি জেগে উঠছে। তীক্ষ্ণ একটা শিস দিয়ে শব্দটাকে কেউ বুঝি আরও তীব্র করে তুলছে। গাড়িটাকে একবার থামিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে কোথা থেকে সেই শব্দটা আসছে সেটা ভালাে করে অনুভব করবার চেষ্টা করেছিল সজল, কিন্তু শব্দের উৎসটা ধরতে পারেনি। সেই শব্দ এখন সারা শরীরে আশ্চর্য একটা স্রোত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। না, এরকম অদ্ভুত আর অস্বস্তিকর শব্দ আগে কখনাে শােনেনি সজল। গাড়ির হেডলাইটে যতটুকু দেখতে পাচ্ছে, তত টুকু স্থির হয়ে আছে। হাওয়ার কোনাে খেলাকোনােখানে নেই। কী জানি, হয়তাে বনের ভেতর রাতে এরকম অস্বস্তিকর শব্দই জেগে ওঠে। বলতে গেলে জীবনে এই প্রথম রাত্রিবেলায় এভাবে এরকম গভীর একটা বনের ভেতর দিয়ে সজল গাড়ি চালাচ্ছে।

দু’দিন আগে ডুয়ার্সের দমনপুরে এসেছিল সজল। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে বড়সড় চাকরি করে পিসতুতাে ভাই সুরঞ্জন। বছর দেড়েক হল সুরঞ্জন দমনপুর ফরেস্ট অফিসে বদলি হয়ে এসেছে। বদলি হয়ে এসেই সজলকে বেড়াতে আসবার জন্য চিঠি লিখেছিল সুরঞ্জন। আসলে, সজল ছােটবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে। দমনপুরে এলে হয়তাে সেই অর্থে অ্যাডভেঞ্চার হবে না, কিন্তু ডুয়ার্সের অরণ্যের যে সবুজ সৌন্দর্য তা দেখা যাবে। অ্যাডভেঞ্চারের চাইতে সেটা এতটুকু কম নয়। একথা লিখেছিল সুরঞ্জন। ‘সময় পেলেই যাব।’ সুরঞ্জনের চিঠির উত্তরে লিখেছিল সজল। কিন্তু কিছুতেই যাবার মতাে সময় করতে পারছিল না। এবার একসঙ্গে কয়েক দিনের ছুটি পেয়েই চলে এসেছিল দমনপুরে। আসবার একটা কারণও আছে। মাসখানেক আগে একটা গাড়ি কিনেছে সজল।

গাড়ি নিয়ে লম্বা দৌড়ে বেরিয়ে পড়ার মতাে মজা নেবার ইচ্ছেটাও খেলা করছিল সজলের মনের ভেতর। দু’দুটো দিন সুরঞ্জনের সঙ্গে বনের ভেতর বেড়িয়ে ডুয়ার্সের নিবিড় অরণ্যের সৌন্দর্য উপভােগ করেছে সজল। সুরঞ্জন যাই বলুক, বনের ভেতর সেই বেড়ানাে অ্যাডভেঞ্চারের চাইতে কম আনন্দ দেয়নি সজলকে। বনের ভেতর বেড়াতে বেড়াতেই জয়ন্তীর গল্প করেছিল সুরঞ্জন। ছােট্ট একটা শহর জয়ন্তী। পাহাড়ের মজা আছে সেই ছােট্ট শহরে। একসময় জমজমাট ছিল জয়ন্তী। লাইমস্টোন কোম্পানির অফিস ছিল বলেই প্রচুর লােকের যাওয়া-আসা ছিল জয়ন্তীতে। প্রচুর গাড়িও চলাচল করত। এখন সেই অফিস আর নেই। নির্জন হয়ে গেছে জয়ন্তী। সেই নির্জনতার জন্যেই এখন জয়ন্তীকে আরওভালাে লাগবে সজলের। কিন্তু থাকবার জায়গা কি পাওয়া যাবে? প্রশ্ন করেছিল সজল। জয়ন্তীতে একটা ফরেস্ট ডাকবাংলাে আছে। সত্যিই যদি সজল যেতে চায়, সুরঞ্জন তাহলে ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। বলেছিল সুরঞ্জন।

সজল যেতে চেয়েছিল আর সুরঞ্জনও ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ডাকবাংলাের। সকালের দিকে বেরিয়ে পড়বার কথা বলেছিল সুরঞ্জন। কিন্তু রাতের বন দেখবার জন্যেই সজল সন্ধের পর গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। বেশ ভালােই লাগছিল প্রথমটা। গাড়ির হেডলাইট, বনের পথ আর ড্যাশবাের্ডের নীল আলােয় পুরাে ব্যাপারটাকেই অ্যাডভেঞ্চার-অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন বনের ভেতর থেকে উঠে আসা হাওয়ার শব্দের সঙ্গে সেই শিসের শব্দ খানিকটা অস্বস্তি তৈরি করেছে বলে তাড়াতাড়ি জয়ন্তীতে পৌছবার একটা তাড়া অনুভব করছে সজল। ক’টা বাজল? ঘড়ির কাটায় চোখ রাখল সজল। সাতটা দশ।

বনের ভেতর সন্ধ্যার পরই বুঝি গভীর রাত নেমে আসে। মনে মনে ভাবল সজল। গাড়িটা থামিয়ে সব আলাে নিভিয়ে দিয়ে একটু সময় বনের অন্ধকারটুকু উপভােগ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল সজলের। কিন্তু এখন সেই ইচ্ছেটাকে মনের ভেতরই রেখে দিল। সামনের দিকে চোখ রেখে হেডলাইট থেকে ছড়িয়ে পড়া আলাে দেখতে দেখতে আর সেই অস্বস্তিকর শব্দটা শুনতে শুনতে গাড়ি চালাতে থাকল নিঃশব্দে। সুরঞ্জন যেভাবে জয়ন্তীর ফরেস্ট ডাকবাংলােয় যাবার পথটা বলে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে ফরেস্ট ডাকবাংলোেয় পৌঁছােতে খুব একটা অসুবিধে হল না সজলের। ফরেস্ট ডাকবাংলাের নেপালি গার্ড সজলের গাড়িটা দেখেই একটা টর্চ হাতে কাছে এসে দাঁড়াল।

স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে এল সজল। গার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার আসবার খবরটা নিশ্চয়ই তােমার কাছে আছে। ‘হ্যা, সাব। চলুন, আপনার ঘরটা দেখিয়ে দিচ্ছি।’ গার্ড বলল। সজল বলল, একটু দাঁড়াও। বলে গাড়ি থেকে ব্যাগটা বের করে গার্ডের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িটাকে লক করল। তারপর ফিরে গার্ডের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল, “নাও, চল। চারদিকের গাছপালা আর অন্ধকারের মধ্যে বাংলােটাকে কেন যেন ভৌতিক একটা বাড়ি মনে হচ্ছে। খুব কম পাওয়ারের যে আলােটা বারান্দায় জ্বলছে, সে আলােটা বুঝি যে কোনাে মুহূর্তে হারিয়ে যাবে অন্ধকারে। মনে হচ্ছে, হারিয়ে যাবার জন্যেই যেন জ্বলছে আলােটা।

এখন কি আর কেউ বাংলােয় আছে?’ গার্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল সজল। না সাব। আজ কেউ নেই। গার্ড বলল। গার্ডকে আর কোনাে প্রশ্ন করল না সজল। ফিরে গার্ডের সঙ্গে পায়ে পায়ে বাংলাের বারান্দায়উঠে এল। বারান্দার প্রথম ঘরটাই সজলের জন্য। গার্ড সেই ঘরটার দরজার তালা খুলতেই বুঝতে পারল সজল। ‘আসুন সাব। ঘরে ঢুকে আলােটা জ্বালিয়ে সজলকে ডাক দিল গার্ড। ঘরে ঢুকল সজল। দেখল ঘরটাকে। এগিয়ে গিয়ে তারপর টেবিলের ওপর রাখল ব্যাগটা। গার্ড বলল, “খানা বলতে হবে সাব?’ ‘না। রাতের খানা আমি রাস্তায় খেয়েই এসেছি।’ সজল বলল। “ঠিক আছে। কোনাে দরকার হলে ডাকবেন। আমি ওপাশের ঘরটাতে থাকি। গার্ড বলল। সজল বলল, “ঠিক আছে। আর দাঁড়াল না সে। চলি সাব’, বলে চলে গেল। ব্যাগটা থেকে জিনিসপত্র বের করতে হবে।

ব্যাগের ওপর ঝুঁকে পড়ে চেনটা টানল সজল। ঠিক সেই মুহূর্তেই সেই তীব্র শিসের সঙ্গে বনের ভেতরের সেই হাওয়ার শব্দ যেন দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর লাফিয়ে নেমে পড়ল। ঝনঝন করে উঠল কাচের জানালাগুলাে। কম পাওয়ারের আলােটার ওপর কেউ যেন কালাে একটা ওড়না দোলাতে থাকল। চমকে উঠে ফিরে দাঁড়াল সজল। চোখ রাখল দরজায়।দেখল, একটা কালাে ছায়া দরজায় স্থির হয়ে আছে। মনে হল, জমাট সেই কালাে ছায়ার মুখে তীক্ষ দুটো দাঁত তীব্র কোনাে আকাঙক্ষায় একটু খানি ফাঁক হয়ে আছে। পাথরের মতাে স্থির হয়ে গেল সজল। মৃত্যুর মতাে একটা আতঙ্ক মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত হয়ে তরঙ্গিত হতে থাকল। নিজের অজান্তেই হঠাৎ তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠল সজল। দু’হাত মুঠো করে শূন্যে তুলল।

বাইরে থেকে উঁচু গলায় গার্ডের চিৎকার ভেসে এল, ‘কেয়া হুয়া সাব?’ সঙ্গে সঙ্গে সেই জমাট কালাে ছায়া দুটো ডানা তৈরি করল। দুলে উঠল সেই ডানাদুটো। তীব্র সেই শিসের শব্দ তীব্র হল আরও। সেই হাওয়ার শব্দ ঝড়ের ভয়ংকর গর্জন হয়ে চুরমার করে দিতে থাকল সব কিছু। চোখ বন্ধ করে সজল। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে একটু একটু করে ঝুঁকে পড়তে থাকল।  ফের গার্ডের সেই চিৎকার ভেসে এল, ‘সাব, কেয়া হুয়া সাব?’ ঝুঁকে পড়া সজল বুঝি উত্তর দেবার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।সিঁড়ি বেয়ে পায়ের শব্দ কি উঠে আসছে? হ্যা, সিঁড়ি বেয়ে সত্যিই উঠে আসছে পায়ের শব্দ। সেই পায়ের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সজলের মধ্যে একটু একটু করে বুঝি চেতনা ফিরে আসছে। দরজায় এসে থামল সেই শব্দ।

সােজা হয়ে দাঁড়াল সজল। খানিকটা আচ্ছন্নভাবে চোখ রাখল দরজায়। গার্ড এসে দাঁড়িয়েছে। সজলের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে থাকল গার্ড। তারপর দরজা পেরিয়ে পায়ে পায়ে ভেতরেএসে দাঁড়াল সজলের সামনে। খানিকটা উদবিগ্ন গলায় বলল, “আপনার কি শরীর ঠিক নেই সাব?’ “না না, শরীর আমার ঠিক আছে। কোনােমতে বলল সজল। গার্ড বােধহয় বিশ্বাস করল না কথাটা। সজলের মনে হল। কিন্তু যা ঘটেছে খানিক আগে, সজল কিছুতেই তা বলতে পারবে না গার্ডকে। ভাববে, কোনাে কারণে ভয় পেয়েছে সজল। এই বাংলােয় সেরকম কোনাে ভয়ের ব্যাপার থাকলে গার্ড নিশ্চয়ই এই নির্জন ডাকবাংলােয় একা থাকতে পারত না। শরীর যে ভালাে আছে সেই কথাটা বােঝাবার জন্য সজল ফের কিছু একটা বলবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই গার্ড বলল, ‘সাব, আপনি কি কিছু দেখে ভয় পেয়েছেন? ‘কেন, আমার আগে কি কেউ এখানে এসে কিছু দেখে ভয় পেয়েছে?’ খানিকটা চমকে উঠে প্রশ্নটা করল সজল।

গার্ড হাসল। বলল, “না সাব, এখানে এসে কেউ কখনও ভয় পাবার মতাে কিছু দেখেনি। আমি এখানে পনেরাে বছর আছি। মাঝে-মধ্যেই একা থাকতে হয় আমাকে। আমিও সাব কোনাে দিন কিছু দেখিনি। তাহলে দারুণ ভয়টা কি তাকেই অনুসরণ করে ফরেস্ট বাংলাে পর্যন্ত এসেছে? খানিক আগে দরজায় ভয়ংকর যে কালাে ছায়াটাকে দুলতে দেখেছে সজল, দেখেছে তার তীক্ষ্ণ সাদা দুটো দাঁত, সেই কালাে ছায়াটাই কি সেই ভয়? তীব্র একটা ভয়ের তরঙ্গ সজলকে নিয়ে বুঝি আছড়ে পড়ল। কোনােরকমে দু’পা এগিয়ে এসে খাটের ওপর বসল সজল। খাটের পাশেই রাখা ছিল জলের বােতল-ভরা ব্যাগটা। হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিয়ে জলের বােতলটা বের করল সজল। ঢকঢক জল খেল অনেকটা।

স্থির-চোখে সজলের জল খাওয়াটা দেখল গার্ড। তারপর হঠাৎ সজলের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘একটা কথা বলব সাব?’ সজল জলের বােতলটা ব্যাগে ভরে রাখতে রাখতে বলল, বলল। ‘আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ আপনার ভয় পাবার কিছু নেই।’ গার্ড বলল। সজল যে ভয় পেয়েছে, গার্ড সেটা ঠিক ধরতে পেরেছে। স্পষ্টই বুঝতে পারল সজল। এবারে হঠাৎই গার্ড টানটান হয়ে দাঁড়াল। হাত বাড়াল সজলের দিকে। বলল, “জলের বােতলটা আমায় দিন সাব, জল ভরে এনে দিচ্ছি। সত্যিই বােতলটাতে জল ভরে আনা দরকার। যতটা জল আছে বােতলে সারাটা রাত তাতে চলবে না। ব্যাগ থেকে জলের বােতলটা বের করে গার্ডের হাতে ধরিয়ে দিল সজল। বােতলটা হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে সজলকে আর একবার দেখে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গার্ড।

ভয়ে ভয়েই দরজার দিকে চোখ রাখল সজল। ভেতরে ভেতরে অসহায় একটা অস্থিরতা বুঝি বিপন্ন করল সজলকে।এরকম একটা ভয় যে তাকে তাড়া করে ফিরবে, সজল তা ভাবতেই পারছে না। সজল যদি এখান থেকে বেরিয়ে পড়ে এখন? কিন্তু বেরিয়ে পড়ার মতাে সাহস এই মুহূর্তে বুকের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে না সজল। অচেনা বন-পাহাড়ের পথ। অন্ধকারে ডুবে আছে চারদিক। হঠাৎ যদি জমাট কালাে ছায়াটা গাড়ির উইন্ড-স্ক্রিনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে? যদি এলােমেলাে করে দেয় ফেরার পথ? সত্যিই, সজল ভয়ের এক অন্ধকার শূন্যতার মধ্যে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে। জলের বােতল নিয়ে তাড়াতাড়িই ফিরে এল গার্ড।

বােতলটা বেডসাইড টেবিলের ওপর রেখে সজলের দিকে তাকিয়ে গার্ড বলল, একটা কথা বলব সাব?’ কী জানি কী বলবে গার্ড। মনে মনে ভাবল সজল। বলল, “বলাে।’ ‘বাংলাের ভেতর কিছু একটা হয়েছে সাব। সেজন্যেই ভয় পেয়েছেন আপনি। কিন্তু সেটা আমাকে বলছেন না। কথাটা বলতে গিয়ে গার্ডের মুখের রেখায় বুঝি কয়েকটা ভয়ের রেখা জেগে উঠতে দেখল সজল। চমকে উঠল সজল। বলল, “কী করে বুঝলে কিছু একটা হয়েছে বাংলাের ভেতর? ‘সেটা ঠিক আপনাকে আমি বােঝাতে পারব না।’ বলে একটু থামল গার্ড। চাপা একটা উত্তেজনায় বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ফের বলল, “কিছু ভাববেন না সাব। বন্দুক নিয়ে সারারাত আমি পাহারা দেব।’

কথাটা শেষ করে আর দাঁড়াল না গার্ড। ‘আচ্ছা চলি সাব। গুড নাইট।’ বলে প্রায় ছুটেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আর এক মুহূর্ত দেরি করল না সজল। খাট থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। তারপর পায়ে পায়ে এসে খাটের ওপর বসে হাতঘড়িটা চোখের সামনে তুলে ধরল। মাত্র সাড়ে আটটা। কিন্তু সাড়ে আটটাতেই যেন মধ্যরাত্রের নৈঃশব্দ্য জমাট হয়ে হিমশীতল একটা নির্জনতা তৈরি করেছে। সেই নির্জনতা আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে সজলের সমস্ত অস্তিত্বকে।বেডসাইড টেবিলটা থেকে জলের বােতলটা নিয়ে ফের খানিকটা জল খেল সজল।গার্ড তার ভয় পাবার কারণটা স্পষ্ট করে সজলকে বােঝাতে পারেনি।

তাহলে কি সজল যা দেখেছে, গার্ডও তাই দেখেছে। সেইজন্যেই ঠিক বােঝাতে পারেনি। সজলের সারা শরীরে বিদ্যুতের মতাে একটা ভয় খেলা করে গেল।মস্ত বড় কাচের জানালার দিকে চোখ ফেরাল সজল। অন্ধকারে ডুবে থাকা গাছপালাগুলাে বুঝি অশরীরী একটা ভয়ংকর ভয়ের অস্তিত্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ বুজল সজল। তারপর জুতােসুদ্ধ পায়েই চিৎ হয়ে শুয়ে অন্য কিছু ভাবতে চেষ্টা করল। কাল দিনের আলাে ফুটবার সঙ্গে সঙ্গেই এখান থেকে বেরিয়ে পড়বে সজল। এক মুহূর্তও আর থাকবে না এখানে। এখন রাতটা শুধু ভালােয় ভালােয় কেটে গেলে হয়। অবশ্য একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্তি। রাতটা জেগেই পাহারা দেবে গার্ড। তেমন কিছু ঘটে যাবার আগেই সাহায্য পাওয়া যাবে তার।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল সজল, তা সে নিজেও টের পেল না। হঠাৎ প্রবল একটা কিসের শব্দে লাফিয়ে উঠে বসল সজল। নিজের অজান্তেই দু’হাত মুঠো করে নিজেকেই বুঝি আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করল। স্পষ্টই বুঝতে পারল বাংলােটার চারদিকে কিছু একটা উড়ে বেড়াচ্ছে। ডানার শব্দে ছড়িয়ে পড়ছে ঝােড়াে হাওয়ার শব্দ। দারুণ একটা আতঙ্কে কাচের জানালার দিকে চোখ রেখে সেই শব্দটাকে বােঝার চেষ্টা করল সজল। ঠিক সেই মুহূর্তেই কালাে একটা জমাট ছায়া বিশাল ডানা মেলে আছড়ে পড়ল জানালার কাচের ওপর। ঝনঝন্ করে ভেঙে পড়ল জানালার কিছু কাচ। সেই ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ সাদা দুটো দাঁত বেরিয়ে এল। কী তীব্র, কী দারুণ ভয়ংকর সেই দুটো দাঁত! সজলের সমস্ত শরীর শব্দহীন, বােধহীন গভীর এক শূন্যতার ভেতর ডুবে যেতে থাকল একটু একটু করে।

সেই ভয়ংকর দাঁত দুটো ক্রমশ বুঝি এগিয়ে আসছে সজলের দিকে। দারুণ তৃষ্ণায় যেন অধীর হয়ে উঠেছে দাঁত দুটো। চিৎকার করে সজল গার্ডকে ডাকতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনাে শব্দ বেরােল না। লাফ দিয়ে নামতে চাইল খাট থেকে। নামতে পারল না কিছুতেই। হঠাৎ একটা গুলির শব্দ রাতের অন্তহীন নৈঃশব্দ্যকে খানখান করে ভেঙে দিল। নিজের অজান্তেই লাফিয়ে উঠল সজল। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল, কাচের ওপরের সেই জমাট অন্ধকার তার ডানাদুটো ঝাপটে শুন্যে উঠল মুহূর্তের জন্য। তীব্র সেই শিসের শব্দ তীব্রতর হল। ফের ঝােড়াে হাওয়ার শব্দ ভয়ংকরভাবে বাংলাের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল।

আর সহ্য করতে পারছে না সজল। নিজের অজান্তেই দু’চোখ বুজল।। নিশ্চয়ই সেই কালাে অন্ধকারকে ওপর থেকে নেমে আসতে দেখেছে গার্ড। দেখেছে, জানালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। গুলিও ছুঁড়েছে জানালার ওপর ঝাপিয়ে পড়বার পরই। সেই গুলির শব্দই শুনেছে সজল। কী জানি, কী হবে শেষ পর্যন্ত! অদ্ভুত একটা শব্দ বেরিয়ে এল সজলের বুকের ভেতর থেকে। কত রাত এখন? চোখ খুলল সজল। অসম্ভব ভয়ে ভয়ে জানালার দিকে চোখ ফেরাল। না, জানালায় সেই জমাট অন্ধকারটা আর নেই। ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে বাইরের অন্ধকারটুকুই শুধু দেখা যাচ্ছে। এবার নিজেকে ফিরে পেতে চেষ্টা করল দারুণ ভাবে। ঠিক তখুনি বাইরের অন্ধকারের ভেতর থেকে রক্ত-জল-করা তীব্র একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল। মনে হল, কেউ যেন ভয়ংকর মৃত্যুর মুঠোর ভেতর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

জীবনে এরকম চিৎকার কখনাে শশানেনি সজল। ঝুঁকে পড়ে দু’হাতে কানদুটো চেপে ধরল। কিন্তু সেই ভয়ংকর চিৎকার থেকে মুক্তি পেল না। দারুণ রকমের একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর ক্রমশডুবে যেতে থাকল। তবু কোনােরকমে খানিকটা স্থির রাখতে চেষ্টা করল নিজেকে। অমনিভাবে হঠাৎ মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করছে কে? আচ্ছা, গার্ডের কি কিছু হয়েছে ?, গার্ড ছাড়া এখানে এই মুহূর্তে আর কারাে থাকবার কথা নয়। এরকম চিৎকার সে ছাড়া কে করবে। আর কিছু ভেবে উঠবার আগেই হঠাৎ থেমে গেল সেই চিৎকার। সেই শিসের শব্দ যেন জান্তব উল্লাসে অদ্ভুত এক ছন্দে দোল খেতে থাকল এবার। কিছুক্ষণদোল খেতে খেতে থেমে গেল সেই শিসের শব্দও। তারপর এক অনন্ত নৈঃশব্দ্য খেলা করতেথাকল চতুর্দিকে। সজলের মনে হল, সে এবার ঠিক মরে যাবে।

দারুণ একটা কান্নায় গলার ভেতরটা ব্যথা করতে থাকল সজলের। চোখ তুলে ছাদের দিকে তাকাল সজল। কী যেন খুঁজতে চেষ্টা করল সেখানে।জানালায় ঝুলতে থাকা কাচের একটা টুকরাে হঠাৎ মেঝের ওপর শব্দ করে পড়ল। অনন্ত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে যেন ঘরের ভেতরের চার দেয়াল, ছাদ আর মেঝের ওপর প্রতিধ্বনিত হল সেই শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে কি যেন ঘটে গেল সজলের ভেতর। টানটান হয়ে বসল সজল। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল জলের বােতলটা। ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা জল খেল। বাকি জলটুকু ঢেলে দিল মাথায়। একটু একটু করে নিজেকে কি ফিরে পাচ্ছে সজল? হ্যা, একটু একটু করে সত্যিই সজল নিজেকে ফিরে পাচ্ছে। নিজের অজান্তেই সজল চোখের সামনে হাতটা তুলে চোখ রাখল ঘড়ির ওপর। দুটো বেজে কুড়ি।

সজল এবার একটু সরে এসে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল। অনেকদিন অসুখে ভুগে উঠলে যেমন মনে হয়, তেমনি মনে হচ্ছে এখন! গার্ডের খবরটা একবার নেওয়া উচিত। হঠাৎই কথাটা মনে হল সজলের। দরজার দিকে তাকাল একবার। বড় করে শ্বাস নিল একটা। তারপর পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। উত্তেজনায় তােলপাড় হচ্ছে বুকের ভেতরটা। তবু নিজেকে নিজেই অতিক্রম করল সজল। হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ এলােমেলাে ঝােড়াে হাওয়া বুঝি ঝাপিয়ে পড়ল সজলের শরীরে। শিউরে উঠল সজল। স্থির ভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ বাড়াল বাইরে।

নির্জনতা যেন ভয়ংকরভাবে তরঙ্গিত হচ্ছে চারদিকে। এভাবে যে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে নির্জনতা, সজল বুঝি তা ভাবতেও পারছে না! বারান্দার মৃদু আলােটুকু রাতের হালকা কুয়াশায় ডুবে আছে। বারান্দা ছাড়িয়ে বাংলাের। প্রাঙ্গণে নামতে পারছে না আলােটুকু। দরজা দিয়ে লাফিয়ে পড়া ঘরের আলােটুকুও বারান্দায় এসে থমকে গেছে। কিন্তু গার্ড কোথায়? গুলি ছুঁড়ে কখনােই সে মিলিয়ে যেতে পারে না! দরজা খুলে সজলকে বেরিয়ে আসতে দেখে নিশ্চয়ই তার কাছে এসে জিগ্যেস করা উচিত ছিল কেন সজল দরজা খুলেছে। গার্ডকে কি চেঁচিয়ে একবার ডাকবে সজল?

ডাকাই তাে উচিত। মনে মনে কথাটা ভেবে সজল দু’পা এগিয়ে এল। তারপর ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে ডাকল গার্ডকে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাের প্রাঙ্গণ থেকে তীব্র সেই শিসের শব্দ চারদিকের ভয়ংকর নির্জনতাকে যেন ঝড়ে উত্তাল সমুদ্রের মতাে অস্থির গর্জনে ভরে দিল। কোনােরকমে দু’পা এগিয়ে এল সজল। বারান্দার রেলিঙ ধরে সামলে নিল নিজেকে। তারপর দু’চোখ বুজে বড় বড় করে শ্বাস নিল বার কয়েক। কয়েক মুহূর্ত সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে চোখ খুলল সজল। রেলিঙের ওপর আরও খানিকটা ঝুঁকে পড়ে অন্ধকারের ভেতরই চোখ বাড়াল কিছু বুঝবার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল সজলের।

সেই জমাট অন্ধকারটা প্রাঙ্গণের ওপর কী যেন একটা জিনিসকে তার দুটো ডানায় চেপে ধরে আছে। ধীরে ধীরে দুলছে ডানা দুটো। অলৌকিক একটা ছন্দে যেন দোলাচ্ছে প্রাঙ্গণের পুরাে অন্ধকারটাকেই। ফের তেমনি ভাঙা গলায় গার্ডকে ডাকল সজল। না, কোনাে উত্তর এল না। খানিকটা সময় কীভাবে যেন গড়িয়ে গেল। হঠাৎ সজল দেখল, সেই ডানাদুটো আরও জোরে দুলতে দুলতে ভেসে উঠল আস্তে আস্তে। চতুর্দিকের সমস্ত অন্ধকার যেন ভর করেছে সেই ডানায়। বাতাস যেন সেই ডানার সঙ্গী হল। গাছপালার ভেতর অসংখ্য পাখি ডেকে উঠল একসঙ্গে। ডানাদুটো উড়তে উড়তে দু’বার প্রদক্ষিণ করল বাংলােটাকে। তারপর হঠাৎই তীব্র বেগে উত্তরের পাহাড়ি অরণ্যের কুয়াশায় হারিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিক পাল্টে গেল আশ্চর্য ভাবে। কুয়াশায় ঢেকে থাকা রাত্রিটা ভারহীন একটা অনুভবে ভরে দিল সজলকে।

এবার বাংলাের প্রাঙ্গণের দিকে চোখ রাখল সজল। প্রাঙ্গণের অস্বচ্ছ অন্ধকারে চিৎ হয়ে কে শুয়ে আছে? তীব্র একটা ভয়ে সজল ঝুঁকে পড়ল সেদিকে। মাথার টুপিটা দেখে মুহূর্তে চিনে ফেলল গার্ডকে। তাহলে গার্ডকেই ঢেকে রেখেছিল সেই ডানা দুটো। আর এক মুহূর্তও দেরি করল না সজল। টানটান হয়ে দাঁড়াল। তারপর দ্রুতপায়ে বারান্দা থেকে নেমে এল। ফের একবার চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা গার্ডকে দেখে নিয়ে পায়ে পায়ে সামনে এসে ঝুঁকে পড়ল গার্ডের শরীরের ওপর। ঝুঁকে পড়েই আতঙ্কে লাফিয়ে উঠল। মৃত্যু যন্ত্রণায় বিস্ফারিত গার্ডের চোখদুটো আকাশের দিকে স্থির হয়ে আছে। হাঁ হয়ে আছে মুখটা। বন্দুক আর টর্চটা পড়ে আছে পাশে।

গার্ড আর বেঁচে নেই। স্পষ্টই বুঝতে পারল সজল। প্রবল একটা আতঙ্কে পালাতে গিয়েও সজল পালাতে পারল না। কোনাে রকমে পাশে পড়ে থাকা গার্ডের টর্চটা তুলে গার্ডের মুখের ওপর আলাে ফেলল। চমকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। গার্ডের গলার দু’দিকে গভীর দুটো ক্ষত। রক্তের দাগ লেগে আছে সেই ক্ষত দুটোয়। মুহূর্তে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল সজল। তাহলে ডানাওয়ালা জমাট অন্ধকারের মতাে যেটা এতক্ষণ ধরে ভয়ংকর শিসের শব্দ বাজিয়ে সজলের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছিল, সেটা একটা ভ্যাম্পায়ার—রক্তচোষা বাদুড়! শেষ পর্যন্ত গার্ডের গলায় নিষ্ঠুর দাঁত বসিয়ে সে তার তৃষ্ণা মিটিয়েছে! অথচ আশ্চর্য, বনের ভেতর ঢােকার পর থেকেই তাে সে অনুসরণ করে এসেছিল সজলকে। তাহলে কি জানালায় জমাট অন্ধকারটাকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখে গুলি ছুঁড়তেই ক্রোধে সজলকে ছেড়ে গার্ডের ওপরই ঝাপিয়ে পড়েছিল সেই রক্তচোষা বাদুড়টা?

সজলের বদলে গার্ডের রক্তেই সে কি তার তেষ্টা মিটিয়েছে! ভেতরে ভেতরে দারুণ একটা ভয়ে শিউরে উঠল সজল! না, নিজেকে বুঝি আর ধরে রাখতে পারছে না সজল। ফের একবার গার্ডের গলার সেই ক্ষত দুটোর দিকে তাকাল। তাকাল আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় বিস্ফারিত হওয়া গার্ডের মুখের দিকে। কখন যে অবশ হয়ে যাওয়া হাত থেকে জ্বলন্ত টর্চটা খসে পড়ল সজল তাও টের পেল না। অন্ধকারে ডুবে থাকা নির্জন ফরেস্ট বাংলাের প্রাঙ্গণে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে একটা রৌদ্রময় সকালের জন্য অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে থাকল সজল।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত