খবর শুনেছিস? আজ দুপুর বারোটায় বিজন হাসপাতালে মারা গিয়েছে!” জিৎ গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে আবিরের দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কলেজ ক্যান্টিনের একপ্রান্তের টেবিলটায় একা বসে আবির নিজের মনে রোল খাচ্ছিল। নিশ্চুপে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ানো জিতের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বলল, “জানি। আর এও শুনেছি, মারা যাওয়ার আগে ও নাকি একটা নাম বলার চেষ্টা করেছিল স্পষ্ট শোনা না গেলেও ও খুব সম্ভবত ‘অভী’ জাতীয় কিছু একটা বলতে চেয়েছিল আবিরকে থামিয়ে দিয়ে জিৎ সপাটে বলে উঠল, “ও ‘অভী’ বলতে চেয়েছিল না ‘আবি’, সেটা কিন্তু এখনও পরিষ্কার হয়নি আবির! শুনেছি, বিজন দু’বার ওই শব্দটা উচ্চারণ করেছিল। আর সেই সময় নাকি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল ওর চোখমুখে!”
আবিরের পিঠে যেন সজোরে চাবুক পড়ল। চারপাশে তাকিয়ে ও সোজা হয়ে বসল। ক্যান্টিনে এইমুহুর্তে সবাই যে যার নিজের মত ব্যস্ত। হাসিঠাট্টা, গল্পগুজবে মত্ত। বিজন আসলে ওদের কলেজের ছাত্র ছিল না। তাই বিজনের মৃত্যু নিয়ে এই কলেজে আপাতত কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। বিজন ছিল জিতের বন্ধু, সিটি কলেজে পড়ত। অমায়িক, মিশুকে ছেলে। ফর্সা, বেঁটেখাটো চেহারা। জিৎদের পাড়াতেই থাকত। তা সত্ত্বেও বেঁটে বিজনের সঙ্গে ওদের কলেজের লম্বু জিৎ, মাঝারি গড়নের আবির এবং মোটাসোটা অভীক, এই চারজনের বন্ধুত্বটা ধীরে-ধীরে বেশ মাখোমাখো হয়ে উঠতে শুরু করেছিল!
জিতের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে আবির এবার বেশ কড়া গলাতেই বলে উঠল, “তার মানে? তুই কী বলতে চাইছিস জিৎ?” এমনিতে ঠান্ডা মাথার জিৎ আজ যেন অকারণেই বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, “ন্যাকা সাজছিস কেন আবির? কিছুই যেন বুঝতে পারছিস না? বিজন বলেছিল, গত সপ্তাহে বিজনের ই মেলে তুই একটা ছবি পাঠিয়েছিলি। বিজন ওদের ছ’তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে পাঠিয়েছিলি একটা ক্যাপশন, ‘বিওয়্যার অফ হাইট’! সেই ছ’তলা থেকে পড়েই বিজন মারা গেল!”
“মিথ্যে কথা!” আবিরের চোখ ধিকিধিকি জ্বলছে, “একদম মিথ্যে কথা! যে ছবিটার কথা বিজন বলেছিল, তা পুরোপুরি ওর মস্তিষ্কপ্রসূত। সেই ছবিটা কিন্তু ও দেখাতে পারেনি আমাদের। ওকে যদি আমি ওরকম কোনও ছবি পাঠিয়েই থাকি তা হলে ও সেটা পরের দিন ই মেল খুলে দেখাতে পারল না কেন? শুধু ওর মুখের কথায় তুই বিশ্বাস করে ফেললি?”
“করলাম, কারণ তুই নিজে বলেছিলি ও তোকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে জিতের কথা শেষ হল না, আবির চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “হ্যাঁ, করছিল। ও আমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টাই করছিল। শনিবার তোর বার্থডে পার্টিতে কী বাওয়ালটাই হল তোর মনে নেই? তোদের পাড়ার মিঠিকে আমার ভাল লাগে, তাতে ওর কী? তাই নিয়ে আমার পিছনে লাগতে কে বলেছিল ওকে? আর তুইও জানিস, ট্রেকিংয়ের সময় কালিয়াপোখরিতে অভীকের সঙ্গে আমার ঝামেলার ভিডিয়োটা ও ঠিক তার পরদিন-রবিবারেই ফেসবুকে পোস্ট করে দিল! অথচ সেটা পুরোপুরি অস্বীকার করে বলল, সেই ভিডিয়ো পোস্ট করা তো দূরের কথা, ওটা নাকি ওর তোলাই নয়! ওর মোবাইলে নাকি তখন চার্জ ছিল না আর ক্যামেরাটাও নাকি তখন অকেজো হয়ে পড়ে ছিল! তা হলে ওই ভিডিয়োটা এল কোথা থেকে? পোস্ট করলই বা কে? ওখানে বিজন ছাড়া তখন তো আর কেউ ছিল না!”
জিৎ জানে উত্তেজিত হলেও এই জায়গা এসব কথার উপযুক্ত নয়। তাই খুব কেটে-কেটে বলল, “ওই ভিডিয়ো আমিও তুলিনি আবির। তুই খুব ভাল করেই জানিস সেটা। সেদিন ঘটনার সময় আমি একটু এগিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ছবি তুলছিলাম। তোদের চিৎকার শুনে আমি যখন দৌড়ে আসি “তখন সব শেষ, তাই তো? তোরা কেউ তুললি না, ঐ ভিডিয়ো আপনা আপনি উঠে গেল” মুখ বেঁকিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল আবির! তারপর তেতো গলায় বলল, “ভালই হয়েছে। তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আজ আমিও তোকে খুঁজছিলাম। সকালে এমসির ক্লাসে যখন তোকে দেখলাম না, ভাবলাম, আজ বোধ হয় কলেজ ডুব দিলি তুই। এসেছিস ভালই হয়েছে। এবার একটু বল তো, কাল রাতে এই যে ছবিটা তুই পাঠিয়েছিস, এর মানে কী?”
পকেট থেকে স্মার্টফোনটা বের করে। মেসেঞ্জার খুলল আবির। জিৎ ওকে একটা ফটো পাঠিয়েছে, সময় দেখাচ্ছে গতকাল রাত বারোটা। একটা ইমেজ। আবির ওর কম্পিউটার ডেস্কের ওপর মাথা নিচু করে বসে আছে। পাশের দেওয়ালে একটা অস্পষ্ট ক্যানভাস। আর ফোটোটার ঠিক নীচে একটা ক্যাপশন লেখা আছে, ‘বিওয়্যার অফ হার্ট’!
চরম অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল জিৎ! বোঝাই যাচ্ছে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছে ও। চোখে ওর আতঙ্কগ্রস্ত চাউনি! কোনওমতে ঢোঁক গিলে বলল ও, “এ কী করে হতে পারে? এই ছবি পাঠানো তো দূরের কথা, গতকাল আমি মেসেঞ্জার খুলিইনি! তুই বিশ্বাস কর, এমন কোনও ছবিই আমি তোকে পাঠাইনি! এটা তোর বাড়ি, তোর কমপিউটার ডেস্কের ছবি। আর তুই জানিস, আমি তোর বাড়ি কোনওদিন যাইনি! নিশ্চয়ই আমার অ্যাকাউন্ট কেউ হ্যাক করেছে! আর সবথেকে বড় ব্যাপার হল, এই ছবিটা আমি আজই প্রথম দেখছি আবির একটু থমকে গেল। খানিক আগেই আবিরের ওপর তুমুল তড়পাচ্ছিল ছেলেটা। আর এখন কী যেন এক অজানা আশঙ্কায় সিঁটিয়ে গিয়েছে! এসব যে কী হচ্ছে, আবির নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না!
একটা বিচ্ছিরি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল আবির। গত কয়েকদিন ধরেই এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে ওকে। সেই ভয়াবহ দৃশ্য! গভীর পাহাড়ি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়াচ্ছন্ন মূর্তি। মাথা ফেটে বেরিয়ে আসা রক্তের ধারায় সমস্ত মুখ ঝাপসা! আস্তে-আস্তে আঙুল তুলছে ছেলেটা আবিরের দিকে। হ্যাঁ, ওরই দিকে! মেঘে ঢাকা অন্ধকার শুনশান পাহাড়ি পথের বাঁকে লোকজন তো ছার, একটা প্রাণিও নেই…শুধু ওরা দু’জন! হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে আসতে শুরু করেছে একটা হিমশীতল আর্তনাদ! শিউরে উঠে আবির তাকিয়ে দেখছে, ছেলেটার রক্তাক্ত শরীর তলিয়ে যাচ্ছে গভীর খাদের নীচে! সেই হাড়হিম করা আর্তনাদটা যেন এখনও আবিরের কানে বাজছে। রহস্যময় অন্ধকার ঘরে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসেছে ও ভয়ে ওর সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে! আজ আবিরের শরীরটা ঠিক ভাল ছিল না। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসেই তাই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিল। মাসতুতো দিদির কাল আইবুড়োভাত। মা আজ দুপুরে সেখানেই চলে গিয়েছে। একেবারে কাল ফিরবে।
আজ সকালে পুলিশ স্টেশনে একপ্রস্ত হাজিরা দেওয়া হয়ে গেছে আবিরের, সঙ্গে জিৎও ছিল। ইন্সপেক্টর মিত্রর স্বভাব মোটেই মিত্রসুলভ নয়। যেমন কাটা-কাটা কথা, ঠিক তেমনই ট্যারাব্যাঁকা প্রশ্ন! আজকাল তো প্রতিটি মুহূর্তে আবিরের মনে হচ্ছে, কেউ যেন ওর উপর সারাক্ষণ নজর রেখে চলেছে! জিৎকে সেকথা বলাতে ও কোন গুরুত্ব না দিয়ে খালি ভুরু কুঁচকেছে, “এমন দুটো ঘটনার পর যে আমাদের দু’জনকে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না, সে তো জানা কথাই?”
সে তো বটেই! ওদের সঙ্গে ট্রেকিংয়ে গিয়ে নিখোঁজ অভীকের সন্ধানে কালিয়াপোখরির ওদিকে টিম পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও অবধি অভীকের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশি জেরায় যখন প্রায় পাগল হতে বসেছিল ওরা, ঠিক তখনই বিজনের এই আত্মহত্যা! আজকাল সবাই ওকেই সন্দেহের চোখে দেখছে। এমনকি মিঠিটাও যেন কেমন অদ্ভুত, অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে! চেনা চোখের ওই অচেনা অভিব্যক্তিতে অজান্তেই রক্ত গরম হয়ে যায় আবিরের!
সকাল থেকেই আজ মাথাটা ধরে ছিল ওর। আজকাল আর ওর কলেজ যেতেও ইচ্ছে করে না। হাসিখুশি বিজনের এই হঠাৎ মৃত্যুটা আত্মহত্যা, নাকি খুন তা এখনও পরিষ্কার হয়নি! পুলিশ তদন্ত করছে। বিজন যখন সেদিন দুপুরবেলা ওদের ছ’তলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ মারে, তখন ওর বাড়িতে কেউই ছিল না, বাবা-মা দুজনেই অফিসে। ওর বোনটাও কলেজে চলে গিয়েছিল। বিজন যায়নি। ওর নাকি সকাল থেকেই সেদিন মাথা ধরে ছিল, কাকিমা বলেছিলেন কলেজে না গিয়ে বাড়িতে রেস্ট নিতে তারপরই ওই অঘটন।
বিজনটা কেন এমন করল? মৃত্যুর সময় কী বলতে চেয়েছিল ও? সে সময় যে নিদারুণ আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল ওর চোখেমুখে, তার কারণটাই বা কী? নাহ, ওই সান্দাকফু ট্রেকিংয়ের সময় থেকেই ওদের যত দুর্ভাগ্যের শুরু! মার্চের শুরুতে বিজন আর আবির দু’জনে মিলে যখন প্ল্যান করছিল সান্দাকফু ট্রেকিংয়ের, অভীক আর জিৎও তখন ওদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে লাফিয়ে উঠেছিল। অবশ্য বিজন, আবির দু’জনেই এর আগে ট্রেকিংয়ে গেলেও সেদিক থেকে জিৎ বা অভীকের কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না।
অভীক ছিল বড়লোক বাবা-মার একমাত্র সন্তান। এই ট্রেকিংয়ে অভীক এসেছিল বাবা-মা’র অমতেই। অভীকের মধ্যে সবসময় একটা জেদ কাজ করত, কিছুটা একগুঁয়ে, রগচটা ছেলেটা নিজের নিয়ম নিজেই তৈরি করে নিত। পাহাড়ের নিয়ম, ট্রেকিংয়ের নিয়ম কোনও কিছুই ও গুরুত্ব দিত না। প্রথমদিন মানেভঞ্জন থেকেই ও তড়বড়িয়ে এগনোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু তারপরে পথে ও বারবার পিছিয়ে পড়ছে দেখে, নিয়মমাফিক ধীরে চলা অভীককে সামনে রাখতে চেয়েছিল আবির। কিন্তু অভীকের তাতে প্রবল আপত্তি, সে মিনিটে-মিনিটে থেমে দাঁড়াচ্ছিল। অসতর্কভাবে পাহাড়ি পথের মাঝেই বারবার স্মার্টফোন বের করে সেলফি তুলছিল। ফেসবুকপ্রীতি আর গার্লফ্রেন্ড ‘প্রীতি’ ছাড়া বোধ হয় ছেলেটা পৃথিবীতে আর কিছু জানত না। টাওয়ার পেলেই ফোন, আওয়ারমাফিক এফবি। এইসব নানা কারণে আবির, এমনকী বিজনের সঙ্গেও অভীকের মতানৈক্য বেড়েই চলছিল। ইগোর জ্বালা ধরানো সংঘাতটা ডালপালা ছড়াচ্ছিল তিলে তিলে। আর কম্পাসহীন নৌকোর মতো ক্রমশই যেন দূরে সরে-সরে যাচ্ছিল অভীক।
সেবার মানেভঞ্জন থেকেই চূড়ান্ত খারাপ আবহাওয়া ওদের সঙ্গী হয়েছিল। কী এক অমঙ্গলের আশঙ্কায় যেন অশান্ত হয়ে উঠেছিল প্রকৃতিও। সারাদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কালো মেঘে আকাশ ঢাকা, ফিনফিনে কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক। এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ট্রেকিংয়ের কথা ভাবাটাই বোধ হয় দুঃস্বপ্ন। একে তো বৃষ্টির জন্যে চারপাশের দৃশ্যমানতা তলানিতে, তার উপর বৃষ্টিপিছল চড়াই উতরাই তখন যেন মরণফাঁদ। জনহীন পাহাড়ি পথে দিনের বেলাতেও যেন সন্ধের অন্ধকার জমাট বেঁধে ছিল। আর সেই গা ছমছমে নির্জন পথে, পাইন-ওক-হেমলকের অন্ধকার ঘন জঙ্গলে, বৃষ্টির সঙ্গে যোগ দিয়েছিল প্রবল ঝোড়ো হাওয়া।
পাহাড়ে-পাহাড়ে ঠোক্কর খেয়েখেয়ে সে যেন কী এক বিভীষিকার খবর নিয়ে ফিরে-ফিরে আসছিল। যেন কোনও রহস্যময় অশরীরীর তীব্র হাহাকার! যেন বনপাহাড়ের বুকে মানুষের অনুপ্রবেশের সংকটে সে বিলাপ করে চলেছে! নিঝুম পাহাড়বাঁকে, ঝড়ে উত্তাল জঙ্গলের মর্মরধ্বনি ছাপিয়ে ভেসে আসা আমুর বাজপাখির আকস্মিক তীক্ষ্ণ, কানফাটানো চিৎকারে মাঝে-মাঝেই কেঁপে উঠছিল সবাই, গা শিরশির করে উঠছিল! বারবার মনে হচ্ছিল, নিশ্চয়ই কোনও অশুভ ক্ষণে যাত্রা শুরু করেছিল ওরা, তাই এত ভোগান্তি! কিন্তু পথের শেষে যে ওদের জন্যে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করে ছিল, তা ওরা সেদিন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি!
শেষ পর্যন্ত সবাই যখন সেইরাতে, আধোঅন্ধকারে প্রায় ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকা টংলুর লজে গিয়ে পৌঁছেছিল, তখন সকলের ক্লান্তি ছাপিয়ে আকাশ ছুঁয়েছিল অভীকের অসহিষ্ণুতা। পাহাড়ি পথের আদরে আদুরে অভীকের পা ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। চোখের খিদের মত শখের ট্রেকিং তার ফ্যান্টাসির স্বপ্নময়তা সরিয়ে শকিং হয়ে দাঁড়িয়েছিল, বাস্তবের মাটিতে আরও কঠিন হয়েছিল পথ চলা।
অভীক আবিরদের এটাও আগে জানায়নি। যে, ওর সিওপিডি, মানে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ আছে। এমনিতেই পাহাড়ি পথে ৭০০০ ফুটের উপর উঠলে সাধারণ মানুষেরই শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। তার উপর যে ইনহেলারটা ও সঙ্গে এনেছিল, সেটাও প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরের দিন আবার আর-এক সমস্যা! জিৎ, অভীক দু’জনেরই হাই অল্টিচুড সিকনেস, মাথাধরা, পেট খারাপ শুরু হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে হাজার প্রতিকূলতা টপকে পরের দিন কালিয়াপোখরির কাছে ওরা যখন গিয়ে পৌঁছেছিল, ঘড়িতে তখন প্রায় বারোটা বাজে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও ততক্ষণে একটু ধরে এসেছিল।
একটা হেয়ারপিন বেন্ডের কাছে পৌছে, থমথমে গভীর খাদের কিনারায় বিপজ্জনকভাবে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিল অভীক। বিজন আর আবির দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে নিচ্ছিল। আর জিৎ হাঁটতে-হাঁটতে একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। আবিরের আজও মনে হয়, কী কুক্ষণে যে সেদিন ও অভীককে কথাটা বলতে গিয়েছিল কড়-কড়-কড়াৎ! আবিরকে প্রচণ্ড চমকে দিয়ে বিকট শব্দে কোথায় যেন বাজ পড়ল, তিনতলার কাঁচের জানালার শার্সিগুলো যেন ঝনঝন করে উঠল! বাব্বা, বৃষ্টি শুরু হল নাকি? মাথা ধরাটা কমানোর জন্যেই বাড়ি আসার আগে আজ পাড়ার দোকান থেকে তিন পেগ মেরে এসেছিল আবির। ফিরে এসেই কখন যেন বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। কিন্তু ঘুমটা ভেঙে গেল সেই বিশ্রী দুঃস্বপ্নটা দেখে। এই মুহূর্তে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে আবিরের!
মনে হচ্ছে, এই বদ্ধ ঘরেও কে যেন সারাক্ষণ ওর উপর নজরদারি করে চলেছে! মাথাধরাটা তো কমেইনি, উলটে আরও বেড়ে গিয়েছে। কোথা থেকে একটা পচা গন্ধ ধক করে এসে নাকে লাগল ওর! তড়িঘড়ি উঠে ঘরের আলোটা জ্বালাল আবির। বাইরে জোর বৃষ্টির শব্দে জানলার দিকে তাকাতেই ওর নজরে পড়ল, ওর ঘরের বন্ধ কাচের জানালার ওপারে রক্তের মতো টকটকে লাল রং দিয়ে কেউ কিছু এঁকে রেখেছে! বিকট একটা মুখ, বৃষ্টিতে যা একটু-একটু করে ধুয়ে যাচ্ছে, ফোঁটায়-ফোঁটায় যেন ঝরে পড়ছে রক্তের ধারা! তিনতলার ফ্ল্যাটের জানালায় বাইরে থেকে কোনও মানুষের পক্ষে এমন ছবি আঁকাটা শুধু অসম্ভবই নয়, অবিশ্বাস্যও!
চোখ কচলে ভাল করে দেখল আবির। বন্ধ জানলাটা খুলে একটু উঁকি মারতে গিয়েই মনে হল ফ্ল্যাটের কোণের বাড়িটার জামরুল গাছের আড়ালে যেন সড়াৎ করে একটা ছায়া সরে গেল! ভাল করে দেখার চেষ্টা করল আবির। কিন্তু বৃষ্টিতে কিছুই আর চোখে পড়ল না ওর। হ্যালুসিনেশন নিশ্চয়ই! হঠাৎ টুংলুর সেই রাতটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। সেদিন টুংলুতে পৌছে কোনওমতে রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই যখন তড়িঘড়ি কম্বলের তলায় সেঁধিয়ে গিয়েছিল, লজের অন্ধকার ঘরে বসে জানালায় টুথপেস্ট দিয়ে ঠিক এরকমই একটা ছবি আঁকছিল বদমেজাজি অভীক!
দুর! কীসব ভাবছে ও! নিজের ডেস্কে গিয়ে ল্যাপটপটা অন করল আবির। কিন্তু ওর অবাক হওয়ার পালা যে শেষ হয়নি, তা ধীরে-ধীরে বুঝতে পারছে ও। ডেস্কের পাশেই ঘরের দেওয়ালে টাঙানো একটা নতুন ছবি! কই, এটা তো আগে দ্যাখেনি ও! নির্ঘাৎ মা আজকেই টাঙিয়েছে ওটা! কী আশ্চর্য! আর কোনও ছবি পেল না মা! রক্তাক্ত ক্যানভাসে। বীভৎস, আর্তনাদরত একটা মুখ! সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হল, শিল্পীর সইয়ের জায়গায় ছোট করে লেখা ‘অভীক’ নামটা! এটা কি ওদের অভীকেরই আঁকা? ছবিটা কোথায় যেন দেখেছে আবির, ঠিক মনে করতে পারল না। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর। এসব অলৌকিকে ও বিশ্বাস করে না মোটেই, কিন্তু আজ এসব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার কোনও ব্যাখ্যাই ও খুঁজে পাচ্ছে না! মনটা ঘোরাবার জন্যে ফেসবুকটা খুলে নোটিফিকেশন চেক করতে যাবে, ঠিক তখনই ওর চোখে পড়ল, অভীকের নামের পাশে অইলাইন থাকার গ্রিন সিগন্যালটা জ্বলজ্বল করছে!
শিরদাঁড়া বেয়ে সঙ্গে-সঙ্গে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল আবিরের। কী এক অজানা ভয় যেন ওকে গ্রাস করতে শুরু করেছে! এ কী করে সম্ভব? তারপরই মনে হল, এ নিশ্চয়ই কোনও হ্যাকারের কাজ! কিংবা এমন কেউ, যে দুর্ঘটনার দিন ওদের কাছাকাছিই ছিল। যে সব কিছু জানে, আর জানে বলেই ওদের বন্ধুদের মধ্যে এইসব মেসেজ, ইমেজ পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে! কিন্তু সে কে?
পিং করে ইনবক্সে একটা মেসেজ আসার আওয়াজ এল। চমকে দেখল আবির, অভীক মেসেজ পাঠিয়েছে। কাঁপা হাতে মেসেজটা খুলতে যাবে ঠিক তখনই যাহ! লোডশেডিং হয়ে গেল। ঝুপ করে একরাশ অন্ধকার নেমে এসেছে ওর চারপাশে। অন্ধকারে ল্যাপটপের অস্পষ্ট আলোয় উঠে মোমটা জ্বালতে যাবে, হঠাৎই ওর পিলে চমকে দিয়ে তীক্ষ তীব্র চিৎকারে মোবাইলের অ্যালার্মটা বেজে উঠল! বারোটা বাজে। এইসময় আবার কে অ্যালার্ম দিল? ও তো অ্যালার্ম দেয়নি! এসব কী কাণ্ড ঘটছে রে বাবা! পিং করে আবার একটা আওয়াজ হল। অভীক পোস্ট করেছে কিছু। ফেসবুকের হোমপেজেই ছিল আবির। যা দেখল ওর গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল!
সেবার গৈরিবাসে পৌঁছনোর পর একটা বিশাল পাইন গাছের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল অভীক। সেটাই এতদিন ওর প্রোফাইল পিক হয়ে শোভা পাচ্ছিল। আর তারপরই তো কালিয়াপোখরিতে সেলফি তুলতে গিয়ে অভীককে নিছক রাগানোর জন্যেই সেদিন বলে বসেছিল আবির, “ছবি তোলার জন্যেই তো আসা, সেই সুখে ছবি হয়ে গেলেও ওর কোনও ক্ষতি নেই…কী বলিস!” আবিরের কথায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিজনও তখন হো হো করে হেসে উঠেছিল! হঠাৎই যেন আগুনে ঘি পড়েছিল! বিচ্ছিরি একটা খিস্তি মেরে খ্যাপা হাতির মতো অভীক এগিয়ে এসেছিল আবিরের দিকে। ক’দিন ধরে বিজন আর আবিরের নানা মন্তব্যে-টিপ্পনিতে ধিকিধিকি জমে ওঠা ক্ষোভ ওর সহনশীলতার ঠুনকো আগল ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল জ্বলন্ত লাভার মতো।
আবির মোটেই প্রস্তুত ছিল না এর জন্যে। এভাবে যে অভীক সশরীরে হামলে পড়বে ওর উপর, তা স্বপ্নেও ভাবেনি আবির। নিজেকে বাঁচানোর জন্যেই আগুপিছু কিছু মুহুর্ত… হাতের বাইরে চলে যাওয়া কিছু অবাধ্য সময় এবং ধ্বস্তাধ্বস্তি! এর মাঝেই হঠাৎ খাদের ধারে আলগাভাবে ঝুলে থাকা একটা বৃষ্টিভেজা, শ্যাওলাধরা নড়বড়ে পাথরে পা পড়ে গিয়েছিল অভীকের! ওরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা হাড়হিম করা আর্তনাদ… উফফ! পিং!
সামান্য আওয়াজেই আজকাল আঁতকে উঠছে আবির! ভয়ার্ত চোখে ও চেয়ে দেখল, ফেসবুকে নোটিফিকেশন এসেছে, ‘অভীক রয় আপডেটেড হিজ প্রোফাইল পিকচার’! ছবিটায় একটা বহুতল ফ্ল্যাট দেখা যাচ্ছে, ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে…হ্যাঁ, ছবিটা ছেলেটার সাইড থেকে তোলা হলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে আবির, বারান্দার গ্রিলে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বিজন ছাড়া আর কেউ নয়। ব্যালকনি থেকে ঘরের দেওয়ালের একটা অংশও দেখা যাচ্ছে, একটা দেওয়ালঘড়ি। তাতে বারোটা বেজে রয়েছে। আর বিজনের ঠিক পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে একটা ঘন কালো ছায়া। ছায়াটার পুরো অবয়বটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার মাঝেও মুখটা যেন আবছা-আবছা বোঝা যাচ্ছে… মড়ার মতো সাদা দুটো চোখ! খুলির কাছে ফেটে কালচে রক্ত জমাট বেঁধে আছে… ক্ষতবিক্ষত গাল! টিকোলো নাকের নীচে বরফসাদা, ফ্যাকাশে ঠোঁটের কোণে কুটিল হাসি! অভীক! আবির স্পষ্ট দেখছে এফবির এই নতুন প্রোফাইল পিকে বিজনের পিছনে দাঁড়িয়ে অভীক হাসছে। ওর তীক্ষ দাঁতগুলো ঝুলে পড়া চোয়ালের খাঁজে বীভৎস মুখের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন!
অভীক হাসছে! আর ঠিক সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে, মোমের আবছা দমবন্ধ-করা অন্ধকারে আবিরের মনে হল ওর পিছনে,আলমারির গায়ে লেপ্টে থাকা আয়নাটার কাছে কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে! আবির চমকে তাকাল পিছনে। আয়নায় টেবিল, চেয়ার, ল্যাপটপ, ঘরের মিরর ইমেজ… সব, সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ল্যাপটপের সামনেই চেয়ারটায় বসে থাকা আবিরই নেই! কোথাও নেই! ল্যাপটপের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটা ইমেজ, যেটা জিতের কাছ থেকে ফেসবুকে মেসেজ এসেছিল! আবির ওর কম্পিউটার ডেস্কের উপর মাথা নিচু করে বসে আছে, ডেস্কের সামনের দেওয়ালে অভীকের আঁকা ভুতুড়ে রক্তাক্ত ক্যানভাস, আর ইমেজটার ওপরে জ্বলজ্বল করছে সেই ক্যাপশনটা…’বিওয়্যার অফ হার্ট’! কোথা থেকে যেন একটা হাড় হিম করা আর্তনাদ ভেসে আসছে! কেউ যেন পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে নীচে! আর সেই কর্কশ, কানফাটানো চিৎকারটা ক্রমশই যেন তলিয়ে যাচ্ছে বহুতল থেকে গভীর অতলে!
জিৎ যেদিন সেই অদ্ভুত ফোনটা পেল, কলকাতায় সেদিন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। নিম্নচাপের প্রভাবে সারাদিন ধরেই একঘেয়ে অঝোর বৃষ্টি, জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছিল মহানগরীর অর্ধেক শিরাউপশিরা। আর ঠিক সেদিনই অভীকের নাম্বার থেকে ফোনটা এসেছিল। দুপুর তখন ক’টা হবে, বারোটা!
“জিৎ, আমার আর ফেরা হল না রে! অবশ্য কিছু জিনিস ফেরত পাঠাচ্ছি। মা-বাবা আর প্রীতিকে পারলে একটু জানিয়ে দিস…ওদের কথা দিয়েছিলাম আমি একসপ্তাহের মধ্যে ফিরব পারলাম না” ফোনের ওপ্রান্তে, সুদূর থেকে অভীকের ঘড়ঘড়ে, অস্পষ্ট গলার স্বর ভেসে এসেছিল! নাহ, প্রত্যুত্তরে সেদিন ভয়বিহুল জিৎ কিছুই বলে উঠতে পারেনি! এমনিতেই বিজন আর আবিরের এমন আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় গত কয়েকদিন ধরেই গুম হয়ে ছিল ও!
আর ঠিক তার পরের দিনই যখন ও খবরটা পেল, কালিয়াপোখরির কাছে একটা বরফাবৃত খাদ থেকে অভীকের বিকৃত ডেডবডিটা আবিষ্কার করেছে পুলিশ। জিৎ জানে, নিশ্চিত জানে, পাহাড়ের ঘড়িতেও সেই মুহূর্তে… ঠিক সেই মুহূর্তে বারোটাই বেজেছিল! অভীকের ব্যাকপ্যাকটা পাহাড়ের একটা খাঁজে পাওয়া গেলেও ওর স্মার্টফোনটার আর কোনও খোঁজই পাওয়া যায়নি!
(সমাপ্ত)