অলক্ষণের গণ্ডি

অলক্ষণের গণ্ডি

লক্ষ্মণের গণ্ডির কথা তাে আপনারা সবাই জানেন। ওই গণ্ডির বাইরেই ওত পেতে ছিল যত বিপদ। কিন্তু আমি এখন আপনাদের শােনাতে বসেছি অলক্ষণের গণ্ডির কথা—যে-গণ্ডির ভেতরে অজানা এক বিপদ প্রায় একশাে বছর ধরে অষ্টপ্রহর ওত পেতে রয়েছে। ঘটনাটা আমাকে শুনিয়েছিল প্রায় পঁচানব্বই বছরের বৃদ্ধ একজন খাসিয়া উপজাতির মানুষ। ওর নাম ছিল পহেলা। জাটিঙ্গা গ্রামে ও জন্ম থেকেই আছে। অসমের নর্থ কাছাড় হিল্স জেলার একটি গ্রাম জাটিঙ্গা। গ্রামটির ভৌগােলিক অবস্থান 25°12°N 93 °E। তার অধিবাসী খাসিয়া উপজাতির মাত্র হাজার দেড়েক মানুষ। ১৯০৫ সালে হাফলঙ নগরের দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় দশ কিলােমিটার দূরত্বে জাটিঙ্গা গ্রামের পত্তন হয়েছিল। জায়গাটির ‘অভিশপ্ত’ বলে বদনাম ছিল। ইউ. লাখােনবঙ সূচ্যাঙ নামের একজন খাসিয়া সেখানকার আদি অধিবাসী জেমিনাগাদের কাছ থেকে নামমাত্র দামে অভিশপ্ত গ্রামটিকে কিনে নেন। তখন পহেলার বয়েস ছিল মাত্র তিন বছর।

তার টিনের চালের বাড়ির দাওয়ায় বসে নেশাগ্রস্ত পহেলা আমাকে এক অদ্ভুত কাহিনী শুনিয়েছিল। সন্দেহ নেই, প্রথমে কাহিনীটি আমার কাছে আপাদ মস্তক আজগুবি বলে মনে হয়েছিল। তা ছাড়া পূর্ণিমার চাঁদের আলাে, ঠাণ্ডা বাতাস,আর পহেলার জরাজীর্ণ আঁকিবুকি কাটা মুখ সব কিছুর ওপরে একটা অলৌকিক মাত্রা চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গল্পের শেষে এমন প্রমাণ পহেলা দাখিল করেছিল যে, আমি আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলাম—ওর কথা সেই মুহূর্তেই আগাগােড়া বিশ্বাস করেছিলাম আমি। খুব সাধ জেগেছিল, পহেলার বর্ণনা মতাে অলক্ষণের গণ্ডি ঘেরা জায়গাটা একবার দেখে আসব। কিন্তু একটা পরিচয়হীন ভয় আমাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছিল। বুকের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠেছিল, যেয়াে না তা হলে আর কোনওদিনই তুমি ফিরতে পারবে না।

পহেলাও সে কথা বলেছিল—এই অলক্ষুণে জায়গা থেকে কেউ কখনও ফিরে আসেনি। শুধু পহেলা নেহাতই ভাগ্যের জোরে ফিরে এসেছিল—ভয়ঙ্কর এক প্রমাণ সঙ্গে নিয়ে। ও জগাখিচুড়ি ভাষায় জড়ানাে গলায় যে-গল্প সেদিন শুনিয়েছিল সেটাই সহজ করে আপনাদের বলছি। তবে আগেই বলে রাখছি, এ-কাহিনী যদি আপনারা বিশ্বাসনা করেন তা হলে আমি অন্তত কোনও অভিযােগ করব না।পহেলা আমাকে বলেছিল। স্যার, আপনাকে তাে আগেই বলেছি, জাটিঙ্গার পাহাড়ে-জঙ্গলে শিকার করে বেড়ানােটা আমার নেশা। সেই কোন যুগে জার্মানির একটা দোনলা শটগান বাবার কাছ থেকে হাতে পেয়েছিলাম। সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে আমি সব সময় শিকারে বেরােতাম।

জাটিঙ্গার জঙ্গলে বেশির ভাগই মুলি বাঁশের ঝাড় আর বেতগাছের রমরমা। আপনি খেয়াল করেছেন কি না জানি না, আমাদের গ্রাম থেকে হাফলঙের দিকে দু-কিলােমিটার এগােলে ডানদিকের খাদে খুব ঘন জঙ্গল দেখতে পাবেন। এই জঙ্গলে কেউ যায় না। মানে, আমি যাওয়ার পর থেকে আর কেউ যায়নি। আমার আগে ডাকাবুকো খাসিয়া যুবকরা কেউ-কেউ হয়তাে গিয়ে থাকবে, কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। আমিই একমাত্র মানুষ, যে ফিরে এসে আর সবাইকে সাবধান করে দিয়েছি। জানিয়ে দিয়েছি, ওখানে গেলে কী হতে পারে। পিচের রাস্তা থেকে যদি আপনি ঢাল বেয়ে নামেন তা হলে, স্যার, দেখতে পাবেন ওখানে একটা নাে এন্ট্রি বাের্ড লাগানাে রয়েছে। আর লেখার নীচে একটা মড়ার খুলি আঁকা আছে। তবে এসব করা হয়েছে অনেক পরে।

আপনি তাে জানেন, আমাদের চাষবাস বলতে ‘জুম’-এ গিয়ে আদা, লঙ্কা, কমলালেবু, আনারস এসবের চাষ। জঙ্গলের সরু পথ দিয়ে চাষের জমিতে যাতায়াতের পথে অনেক সময় দাঁতালাে শুয়ােরের মুখােমুখি হতে হয়। তখনচার্লস ডেলি মডেলের শটগানটা আমার কাজে লাগে। একদিন সন্ধের মুখে জুম’থেকে ফেরার সময় এক প্রকাণ্ড মাপের দাতালে শুয়ােরের মুখােমুখি হলাম। দু-দুটো গুলি ছুড়লাম বটে, কিন্তু ওটাকে সেরকম ভাবে ঘায়েল করতে পারলাম না।তখন আমি শূন্য শটগান হাতে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করলাম। কিন্তু ওই ঘন জঙ্গলের মধ্যে সেভাবে দৌড়নাে অসম্ভব। আমি কোনও রকমে ঝোপঝাড় ঠেলে পথ তৈরি করে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।ডালপালা-পাতার আওয়াজ ছাপিয়ে আহত শুয়ােরটার গজরানি বেশ কানে আসচ্ছিল।অন্ধকার ক্রমেই গাঢ় হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমার কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল।

শটগানের নল দিয়ে ঝােপঝাড় সরিয়ে আমি এগােচ্ছিলাম, হঠাৎই একটা গুঞ্জনের শব্দ আমার কানে এল। সন্ধে হলে জাটিঙ্গাতে ঝিঝির ডাকে কানে তালা লেগে যায়। কিন্তু এটা সেই শব্দ নয়—তার চেয়ে আলাদা। ঝিঝির ডাক থাকা সত্ত্বেও ওই মিহি গুঞ্জনের শব্দটা আলাদা করে বেশ কানে আসছিল। দাতালে শুয়ােরটা বােধহয় একগুঁয়ে ভাবে বনবাদাড় ভেদ করে ছুটছিল। কারণ আমি গাছপালার এলােপাতাড়ি নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, আর শুনতে পাচ্ছিলাম আহত প্রাণীটার গর্জন। বলতে গেলে আচ্ছন্নের মতােই আমি সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই দেখি খানিকটা ফাকা জায়গা—অনেকটা মাঠের মতাে। কুয়াশা মাখা ঘােলাটে আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট ভাবে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে ছােট-ছােট কিছু ঝোপঝাড় ছাড়া জায়গাটা অস্বাভাবিকরকম ফাঁকা। যেন কেউ মালী লাগিয়ে জায়গাটা সাফ করিয়েছে।

আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গুঞ্জনটা এখন তীব্রভাবে শােনা যাচ্ছিল। যেন কোনও বদরাগী ভিমরুল আমাকে
লক্ষ্য করে তীরের মতাে ছুটে আসছে—আর তার ডানার শব্দ এসে আমার কানেবিধছে। একই সঙ্গে একটা অচেনা কটু গন্ধ আমার নাকে এসে ধাক্কা মারল। এমন সময় কোনও ছুটন্ত প্রাণীর শব্দ শুনতে পেলাম।চমকে মুখ ফিরিয়েই দেখি গাঢ় কালাে আঁধারের মতাে শুয়ােরটা ঝোপঝাড় ঠেলে ছিটকে ঢুকে পড়েছে সেই ফাঁকা জায়গায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল সেই অদ্ভুত ঘটনা। শুয়ারটা ফাকা জায়গাটায় ঢােকামাত্রই গােড়া কাটা কলাগাছের মতাে কাত হয়ে খসে পড়ল মাটিতে। আর কোনও নড়াচড়া করল না, কোনও রকম চিৎকার। আমি অবাক হয়ে গেলাম। টের পেলাম, আমার হাত-পা থরথর করে কাপছে। একটু আগে উকি মারা ভয়টা একলাফে আমাকে একেবারে জাপটে ধরল। হঠাৎইআমার শরীরের ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সেই ঠাণ্ডার স্রোত পা বেয়ে নামতে লাগল মাটিতে।

আমি হয়তাে পড়ে যাওয়া শুয়ােরটার কাছে এগিয়ে যেতাম, যদি না সেই মুহুর্তে আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পেতাম। জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যেন একটা রাতপাখি ডেকে উঠেছিল। সেই ডাকে চমকে উঠে মুখ তুলতেই দুটো বাদুড় আমার চোখে পড়ল। সীসের মতাে আকাশের পটভূমিতে ওদের দেখতে পেলাম আমি। অন্ধকারে আরও অন্ধকার ডানা মেলে দিয়ে ওরা নিঃশব্দে নিপুণ ছন্দে ভেসে চলেছে। উড়তে উড়তে ফাকা জায়গাটার ওপরে আসা মাত্রই বাদুড় দুটো গাছ-পাকা ফলের মতাে টুপ করে খসে পড়ে গেল নীচে। ওদের দেহ দুটো আছড়ে পড়ারভোঁতা শব্দ হল। আর সেই মুহূর্তে আমার চিন্তা ভাবনাও যেন অবশ হয়ে গেল। অন্ধকার মাঠ থেকে আর কোনও শব্দ শােনা যাচ্ছিল না—শুধু সেই গুঞ্জনের শব্দটা ছাড়া।

আমি ক্লান্ত দেহে জঙ্গলের গাছ-পাতার মধ্যেই বসে পড়লাম। অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে ওঠায় আমার চোখের সামনে থেকে সব কিছু মুছে যাচ্ছিল। সামনের ফাকা জমিটা ঘিরে একটা মারাত্মক ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরল। গায়ের নানা লােকের নানা কথা আমার মনে পড়ল। এটাই তা হলে সেই অভিশপ্ত জায়গা ! এটার সঠিক পরিচয় কেউ জানত না বলে এটাকে সবাই জঙ্গল বলে ভেবেছে। যারা এই অভিশপ্ত জায়গাটা চোখে দেখেছে তারা কেউ ফিরে যায়নি—ফিরতে পারেনি। তাই অভিশপ্ত জঙ্গল’ হিসেবেই গড়ে উঠেছে জাটিঙ্গার কিংবদন্তী। আমার হাতে অস্ত্র বলতে একটা খালি রাইফেল। আর সারা শরীর পাকে- পাকে জড়িয়ে এক অজানা ভয়। সব মিলিয়ে নড়াচড়ার মতাে ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই কাছাকাছি একটা বড় গাছ খুঁজে নিয়ে তাতে চড়ে বসলাম। অন্ধকারে বােধহয় পিপড়ের বাসায় হাত দিয়ে ফেলেছিলাম। কারণ হঠাই হাতে-পায়ে জ্বালা ধরানাে কামাড় টের পেলাম।কোনও রকমে গাছে উঠে হাত-পা ঘষে পিপড়েগুলাে ছাড়ালাম।

ঝিঝিপােকার ডাকে কানে যেন তালা লেগে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে আলাদা ভাবে মিহি গুঞ্জনটা শােনা যাচ্ছিল। গাছের ওপর থেকে ফাকা জায়গাটা চাদের আলােয় অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। একই সঙ্গে লক্ষ করলাম, দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে অর্থাৎ, মাউন্ট হেম্পিয়ার দিক থেকে তরল কুয়াশার স্রোত সাপের মতাে ধীরে ধীরে এঁকেবেঁকে নেমে আসছে জাটিঙ্গার খাদের দিকে। একটু পরেই হয়তাে দুধের মতাে সাদা কুয়াশা সামনের ফাকা জায়গাটাকে একেবারে ঢেকে ফেলবে। খিদেয় শরীর আনচান করলেও কোনও উপায় ছিল না। আমি হতভাগ্য শুয়ােরটা আর বাদুড় দুটোর কথা ভাবছিলাম। এই জায়গাটায় কী এমন অভিশাপ আছে যে, কোনও প্রাণী সেখানে ঢুকলেই সঙ্গে-সঙ্গে মারা যায়। আমি যদি ওখানে যাই তা হলে আমারও কি একই দশা হবে! মনে-মনে ঠিক করলাম, যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি তা হলে সবার আগে গায়ের হেডম্যানকে ব্যাপারটা জানাৰ। সেই গায়ের লােককে সতর্ক করার ব্যবস্থা করবো।

রােববার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধেবেলা জাটিঙ্গার গির্জায় গায়ের লােকেরা উপাসনায় যােগ দিতে আসে। হেডম্যান যদি বুদ্ধি করে উপাসনার পর চার্চ থেকেই এই বিপদের কথা ঘােষণা করে দেয় তা হলে সবচেয়ে ভালাে হয়। খবরটা ছােট্ট গ্রামে দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়বে। কুয়াশা ক্রমশ চারপাশ ঢেকে ফেলছিল। ফলে চাদের আলাে কেমন যেন ঘােলাটে হয়ে সমান ভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক যেন ঘষা কাচ দিয়ে কেউ চাদকে আড়াল করে দিয়েছে।। এরই মধ্যে ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। জাটিঙ্গায় এরকম বৃষ্টি প্রায়ই হয়। যেমন হঠাৎ করে তার শুরু, তেমনই হঠাৎ করে তার শেষ। গাছের পাতার ফাক দিয়ে ঝরে পড়া জলে আমি ভিজতে লাগলাম। ঠাণ্ডায় শরীরটা কুঁকড়ে যেতে চাইছিল। অসহায় ভাবে আমি দিনের আলাের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর মাঝে-মাঝে ওই ভয়ঙ্কর জায়গাটার দিকে নজর চলে যাচ্ছিল।

নিজের অজান্তেই কখন যেন সামান্য তন্দ্রা মতন এসে গিয়েছিল। হঠাৎই কী একটা শব্দে আমার ঘাের কেটে গেল। চমকে সজাগ হয়ে দেখি, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তখনও পড়ছে। তবে কুয়াশা অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। সামনের ফাকা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটা অদ্ভুত গােলাপী আভা সামনের খােলা জমিটা থেকে ঠিকরে বেরােচ্ছে। আর মিহি গুঞ্জনটা কেমন যেন বিচিত্র সুরে ওঠানামা করছে। এরকম আলাে আমি কখনও দেখিনি। এরকম মায়া-জড়ানাে সুরও কখনও শুনিনি আমি। আমার ঘুম পেয়ে গেল—না, স্বাভাবিক কোনও ঘুম নয়, নেশায় পাওয়া ঘুম। ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর ছেয়ে গেল, চোখ জুড়িয়ে গেল অলৌকিক কোনও টানে। প্রাণপণে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে আমি সম্মােহিতের মতাে সামনের ফাকা জায়গাটার দিকে চেয়ে রইলাম।

গােলাপী আভা ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল। আর তখনই নজরে পড়ল, তার মধ্যে কতকগুলাে অদ্ভুত কালাে ছায়া চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে। ছায়াগুলাের অবয়ব যেন ‘নিরাকার’—ওদের নির্দিষ্ট কোনও আকার ছিল না। অথচ ওরা গােলাপী কুয়াশার মধ্যে অনায়াস দ্রুত গতিতে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎই আমার শীত-শীত ভাবটা কমতে লাগল। আর তার একটু পরেই বেশ গরম ভাব টের পেলাম। যেন সময় ভুল করে গ্রীষ্মকাল আবার ফিরে এসেছে। পরিবেশের উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে অসহ্য মাত্রায় পৌছে গেল। অলৌকিক এক তাপে আমার মুখ-চোখ যেন পুড়ে যেতে চাইল। আমার মাথাটা কেমন টলে উঠল। চারপাশের গাছপালা দুলে উঠল ভয়ঙ্কর ভাবে। আমার হাত থেকে বন্দুকটা খসে পড়ে গেল নীচে। কোনও রকমে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি, একটা দ্যুতিময় গােলাপী বল কুয়াশার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে উড়ে চলেছে শুন্যে। কী অদ্ভুত মাতাল করা আভিজাত্যে ভরা তার মসৃণ গতি!

আর আমার কিছু মনে নেই, কারণ তখন আমি জ্ঞান হারিয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম নীচে। কাক-ভােরে আমার ঘুম ভাঙল—যদিও, স্যার, এখানে কাক, শালিক বা চড়ুই দেখতে পাওয়া যায় না। হাফলঙে যে-দু-একটা কাকের দেখা মেলে। সেগুলাে দাঁড়কাক। ঘুম ভেঙে যা দেখলাম সে বােধহয় রাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর। জল-কাদা মাখা শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমি টলতে টলতে ফাকা জমিটার কিনারে গিয়ে দাঁড়ালাম। জমির এলাকায় হয়তাে ঢুকেই পড়তাম, যদি না সেই মুহূর্তে দুটো প্রকাণ্ড বড় মাপের প্রজাপতি জমির এলাকায় ঢুকেই টুপ করে খসে পড়ত।

হেলে থাকা একটা সরু বাঁশগাছ ধরে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গতকাল সন্ধের আবছা আলােয় যা-যা চোখে পড়েনি এখন সেগুলাে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ল। মিহি গুঞ্জনের শব্দটা আর শােনা যাচ্ছে না। এবড়াে খেবড়াে ফাকা জমিটায় যেসব আগাছা গজিয়েছিল সেগুলাে সব পুড়ে কালাে হয়ে গেছে। নানা ধরনের কঙ্কালে জায়গাটা ভরতি। জমিটার ডান দিক ঘেঁষে একটা লম্বা ফাটল। সেই ফাটল দিয়ে সাদা ধোঁয়ার রেখা সাপের মতাে এঁকেবেঁকে বেরিয়ে আসছে। জমিটার বাদিকে একটা বড় মাপের পােড়া গাছ। তার একটা পােড়া ডাল থেকে একটা নাম-না-জানা পাখির কঙ্কাল ঝুলছে।

সব কিছু দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠল। কাল রাতের কটু গন্ধটা বেশ কয়েক গুণ হয়ে যেন একেবারে মস্তিষ্কে গিয়ে ধাক্কা মারল। এ আমি কোন অলৌকিক শ্মশানের চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছি! কোন অলৌকিক প্রক্রিয়ায় এখানে দিনের পর দিন ধরে শুধু হাড় জমা হয়েছে। কোথায় গেল কাল রাতে শুয়ােরটা আর বাদুড় দুটোর দেহ? ওগুলাে কি মুহুর্তে কঙ্কালের চেহারা নিয়েছে? কোথায় উড়ে গেল ওই গােলাপী গােলক? অবয়বহীন কালো ছায়াগুলােই বা গেল কোথায় ? ওরা কারা? ওরা কি আবার ফিরে আসবে? আমার ক্লান্ত অবসন্ন। মনের মধ্যে এইসব প্রশ্ন উথাল পাথাল করছিল, অথচ কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল। মাতালের মতাে টালমাটাল পায়ে পেছনের জঙ্গলের ঘাস-পাতা-কাদা ঘেঁটে দোনলা বন্দুকটা খুঁজে বের করলাম। ওটা তুলে নিয়ে জঙ্গল হাঁটকে ফেরার পথের হদিস করতে চাইলাম।

ঠিক তখনই একটা প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার পাখি যাকে চলতি কথায় আপনারা দুধরাজ বলেন—আমার পাশ দিয়ে উড়ে চলে গেল ওই অভিশপ্ত জায়গাটার দিকে। আর তার এলাকায় ঢুকে পড়ামাত্রই ব্যস—অমন সুন্দর ধবধবে পাখিটা খতম। কী যে হল আমার, দৌড়ে ফিরে গেলাম ওই ফাকা জমিটার সীমানায়। দেখি সীমানার কাছাকাছিই পড়ে রয়েছে পাখিটা। তার লম্বা বাঁকানাে লেজ একেবারে স্থির। ডানার একটি পালকও আর নড়ছে না। হঠাৎই আমার চোখের সামনে যেন ম্যাজিক শুরু হল। পাখিটার নরম পালক আর শরীর তিলতিল করে ক্ষয়ে যেতে লাগল। জমির মাটির সঙ্গে আগাছার সঙ্গে তার পালক আর শরীরের কণা যেন মন্ত্রবলে মিলিয়ে গেল। হা ভগবান! একটু পরেই পড়ে রইল শুধু পাখিটার কঙ্কাল। যেন ভাগ অঙ্ক সম্পূর্ণ হয়ে শুধু ভাগশেষ পড়ে আছে।

চোখের সামনে এ-দৃশ্য দেখে আমি পাগলের মতাে হয়ে গেলাম, স্যার। দাঁতালাে শুয়ােরের মতাে রাগ হয়ে গেল শরীরে। জানােয়ারের মতাে চিৎকার করে জমিটাকে খিস্তিখেউড় করে উঠলাম আমি। শটগান সমেত ডানহাত ছুড়ে দিলাম সামনে। রাগে বােধহয় আমার আন্দাজে ভুল হয়ে গিয়ে থাকবে। বােধহয় আমার হাতটা ঢুকে পড়েছিল জমিটার এলাকায়। কারণ চোখের পলকে আমার হাতে ধরা অবস্থাতেই বন্দুকটা গরম হয়ে গেল। আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে বন্দুকটা ছেড়ে দিয়ে হাত টেনে নিলাম। আমার হাত অসহ্য রকম জ্বালা করছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।

ওই অবস্থাতেই দেখলাম, বন্দুকটার কাঠের অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পড়ে রইল তার ইস্পাতের কঙ্কাল। আর আমার সাহসে কুলােয়নি, স্যার। বাঘে তাড়া করা ছাগল ছানার মতাে ভয়ে পাগল হয়ে জঙ্গলের মধ্যে এলােপাতাড়ি ছুটতে শুরু করলাম। কী করে যে সেদিন গায়ে ফিরে আসতে পেরেছিলাম জানি না। গাঁয়ে ফিরে হেডম্যানকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। তারপর গাঁয়ের সবাই ব্যাপারটা জানতে পারে। তখন ওই জঙ্গলটাকে ঘিরে এইসব ‘নো এন্ট্রি বাের্ড লাগানাে হয়েছে। আর জাটিঙ্গার সব ছেলেমেয়েই বংশপরম্পরায় ওই জায়গাটাকে এড়িয়ে চলতে শিখেছে। ওই জায়গাটা, স্যার, অভিশাপের গণ্ডি দিয়ে ঘেরা। কিন্তু কী অভিশাপ সেটা কেউ জানে না—আমিও সেদিন বুঝতে পারিনি।

ওর কাহিনী শেষ করে পহেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটা ময়লা সুতীর চাদর ওর গায়ে জড়ানো ছিল, সেটাকে আঁকড়ে ধরে শরীরের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে চাইল। তারপর চিবুক সামান্য তুলে আমার দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে রইল। যেন ওর রােমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমার কিছু একটা বলা উচিত। অন্ধকার পহেলাকে প্রায় আড়াল করে রেখেছিল। তবু তারই মধ্যে ওর চোখ চকচক করছিল। কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল। ঝিঝিপােকার দল মুহূর্তের জন্যে ‘ওদের চিৎকার থামিয়ে আবার এক ঘেয়ে সুরে কান্না শুরু করল। সিগারেটের ধোঁয়ার মতাে কুয়াশার রেখা পুবদিক থেকে ভেসে আসছিল। চাদের আলােয় মনে হচ্ছিল, যেন কোনও পাহাড়ী মেয়ে বাতাসে ওড়না ভাসিয়ে দিয়েছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আর কোনও উপায় না দেখে আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘পহেলা, সেদিন তুমি…ইয়ে…আজকের মতাে নেশা করে ছিলে একটা হেঁচকি তুলল পহেলা। তারপর নেশা-ধরা গলায় হাে-হাে করে হেসে উঠল। ওর হাসির মধ্যে কোথায় যেন একটা তিক্ত আক্ষেপ আর বিদ্রুপ লুকিয়ে ছিল। হাসির রেশটা অন্যরকম ভাবে শেষ হতেই সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। হাসি থামিয়ে জড়ানাে গলায় পহেলা বলল, স্যার, কেউ যখন আমার কথা বিশ্বাস করে না তখন আমি তাকে আমার ডান হাতটা দেখাই.এই দেখুন! চাদরের আড়াল থেকে ডান হাতটা বের করে সামনে বাড়িয়ে দিল পহেলা। আর সেই মুহূর্তেই ওর গল্প আগাগােড়া বিশ্বাস করলাম আমি।

জ্যোৎস্নার আলােয় দেখলাম, ওর হাতের পাঁচটা আঙুলের মাংস যেন কোন অলৌকিক উপায়ে উধাও হয়ে গেছে। কঙ্কালের হাতের মতাে পাঁচটা হাড়ের আঙুল শুন্যে নড়াচড়া করছে। আর সেই সাদা আঙুল থেকে ঠিকরে বেরােচ্ছে। এক অপূর্ব গােলাপী আলাের আভা। সঙ্গে-সঙ্গে আমার চোখের সামনে বহু বছর আগে পহেলার দেখা অভিশপ্ত ফাঁকা জায়গাটা জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠল।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত