ভাই আপনার ভাড়াটা দেন? কন্ডাকটরের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।কতো রে? কই থেকে উঠেছেন? কারাগার গেট থেকে,সাভার নামিয়ে দিস। ২৫ টাকা দেন।
বাসের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। মানবসমাজ বড় অদ্ভুত। এই আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যেতে পারছি। যা ইচ্ছে করতে পারছি। অথচ শুভ আজ আটকে রয়েছে ইট দিয়ে তৈরি চার দেয়ালের মাঝে। যে দেয়ালের মাঝে তাকে সারাজীবন আটকে থাকতে হবে। যেন একটা জীবন্ত কবর।কবর বলছি এই কারণে। কবর যেমন চারদিক ঘেরা জেলখানাও ঠিক তেমনি চারদিক দেয়াল ও কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। পার্থক্য শুধু কবরে থাকে মৃত মানুষ, আর জেলখানায় থাকে জীবিত মানুষ।
শুভর সাথে আমার পরিচয় হয় জাহাঙ্গীরনগরের একটি হলে।দেখতে লম্বা, সুদর্শ, আর বড্ড মিশুকে একটা ছেলে। যে কারো সাথে খুব সহজে মিশতে পারতো। এটাই ছিল ওর সব থেকে বড় গুণ। ক্যাম্পাসে সবাই ওকে ডাকতো পাগলা শুভ বলে।বাংলা বিভাগের তুখোড় ছাত্র ছিল।বাংলা সাহিত্য সম্পর্কিত ওর জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যেতাম। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন আবৃতি করতো। মাত্র দশ মিনিটে পেন্সিল দিয়ে এতো সুন্দর স্কেচ বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো। যেই ছেলের এতো গুণ সেই ছেলে কি সহজে মেয়েদের হাত থেকে রক্ষা পাবে?
অনেক মেয়ের কাছেই প্রেমের প্রস্তাব পেতো। কতো চিঠি যে আমরা দুজন মিলে পড়েছি সেসব ভাবলে এখনো হাসি পায়।শুভ এসবে বিশেষ পাত্তা দিতো না। ও সব সময় বলতো প্রেম করে জীবনানন্দ হতে চাইনা। জীবনানন্দ একটাই,একটাই থাক না।
একদিন ক্যাম্পাসে বসে আছি। এমন সময় একটা মেয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল ওর নাকি শুভর সাথে কথা আছে।আমি মেয়েটিকে বসতে দিয়ে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলাম।এসব দেখে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলাম এই বুঝি আরেকটা প্রস্তাব পায়। তবে মেয়েটা বেশ সুন্দরী বলতে হয়।অনেক মেয়ে আছে না যাদের একবার দেখলে আরেকবার ভুল করে তাকাতে ইচ্ছে করে এই মেয়ে ঠিক সেই রকম।
সেইদিন রাতে শুভর কাছে শুনলাম মেয়েটির নাম রাত্রি। কেমিস্ট্রিতে পড়াশুনা করে।বড়লোকের মেয়ে।বাবার দামি গাড়ীতে যাওয়াআসা করে।শুভকে অনেকদিন থেকেই নাকি পছন্দ করে।আজ নাকি তাই মনের কথা বলে দিয়েছে। আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে শুভর কাছে জানতে চাইলাম সে কি রাজি হয়েছে।উত্তরে শুভ জবাব দিল “না”। শুভ বলেছে বন্ধু হয়ে থাকলে সে রাজি আছে।এছাড়া সে এসব সম্পর্কে যেতে চায় না।রাত্রি নাকি বলেছে শুভর সাথে প্রেম করেই ছাড়বে। এমন সময় দরজাতে কেউ বাইরে থেকে ঠোকা দিলো। তখন বাজে রাত ১১ টা বাইরে তুমুল বৃষ্টি। এই সময় কে আসতে পারে।আমি আর শুভ দুজনেই বেশ অবাক হয়ে গেলাম। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখি সেই মেয়ে। যে আজ ক্যাম্পাসে শুভর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল।আমার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। এই মেয়ে এতো রাতে ছেলেদের হোস্টেলে কিভাবে ঢুকল।এসব ভেবে মাথার চুল ছিঁড়া মতো অবস্থা আমার। তাড়াতাড়ি ওকে রুমে ঢুকতে দিয়ে আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ আছে নাকি।আশেপাশে বিশেষ কাউকে দেখতে পেলাম না।তবে ভয় পাচ্ছিলাম খুব।কেউ যদি দেখতে পায় তাহলে আমাদের অবস্থা খারাপ। কালকেই হোস্টেল থেকে বের করে দিবে। আমি বারবার ঘড়ির দিকে আর এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছি। এমন সময় ভিতর থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পেলাম। মেয়েটা কাঁদছে। খুব জোরে জোরে শব্দ করে কাঁদছে। হঠাৎ দরজা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে যেমন ভাবে এসেছিল। ঠিক সেইভাবেই চলে গেলো। রুমে এসে দেখি শুভ মম খারাপ করে বসে আছে।বুঝলাম এই সময় কথা না বলাই ভালো।
পরদিন সকালে লোকজনের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজা খুলে দেখি বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।বুঝলাম কাল রাতের ঘটনা জানাজানি হয়ে গেছে। আমাদের আর হোস্টেল থাকা হলো না।মেয়েটার উপর মনে মনে রেগেই গেলাম আমি।একজন পুলিশের আমাদের রুমে ঢুকে প্রথমেই সজোরে শুভর গায়ে লাথি দিয়ে বলে “প্রথমে মেয়েকে প্রেগন্যান্ট করিস তারপর বিষ খেয়ে মরতে বলিস? ” এবার বুঝবি মজা।কার মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিস জানিস? দেখি তোকে কোন বাপেরবেটা বাঁচায়।
এসব কথা শুনে আমি হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছি পুলিশের মুখের দিকে। আমাদের দুজন কেই সেইদিন গ্রেফতার করা হয়েছিল। থানায় গিয়ে শুনেছিলাম রাত্রি বিষ খেয়ে মারা গেছে। আর শুভর জীবনে ঢেলে দিয়ে গেছে শুভকে না পাওয়ার ভয়ংকর বিষ।
কোটে সবকিছু ছিল শুভর বিরুদ্ধে।টাকা দিয়ে সব কিনে নিয়েছিল রাত্রির বাবা।আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও শুভকে বাঁচানো যায়নি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ওর।আজ অনেকদিন পর সেই শুভকে দেখতে গিয়েছিলাম। শুভ ঠিক আগের মতোই আছে।মাঝখান থেকে রবীন্দ্রনাথের মতো লম্বা দাঁড়ি রেখেছে। মামা সাভার এসে গেছে, নামেন।