মিস্ট্রি বিহাইন্ড এ্যা ডেথ

মিস্ট্রি বিহাইন্ড এ্যা ডেথ

সময় রাত একটা বাজতেছে প্রায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আমি। কক্সবাজার শহরটা এতো রাতেও যেন জীবন্ত। বাইরে লোকজনের কোলাহল শুনা যাচ্ছে। আমি এক নজরে তাকিয়ে দেখতেছি দূরের বিল্ডিংগুলো। এমন সময় আমার রুমে মা এসে জিজ্ঞেস করলো:
–কি রে, ঘুমাসনি এখনো?”
–হুমমম….. মা এখন ঘুমাবো।” মাকে দেখে বিচলিত হলাম।
–ঘুমা, বেশি রাত জাগিসনা।” দরজাটা বন্ধ করে মা চলে গেলো। আমি জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে বেডে শুয়ে পড়লাম। পাশ থেকে সুইচ টিপে লাইট অফ করলাম। তারপর মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটু ফেসবুকে লগ ইন করলাম। তখনই “Nilpori Nilanjona” নামে একটা আননোন আইডির মেসেজ পেলাম।
–হাই মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া…..”
মেসেজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকালাম। তারপর ওর প্রোফাইল চেক করলাম চেনাজানা কেউ বলে মনে হলোনা। মেয়েটা আমাকে “মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া” বলে ডেকেছে, তারমানে সে আমার কাহিনীগুলো জানে। সেই বাংলোর কথা, স্বর্ণের কলসির কথা, জওহরলাল মিত্রের খুনের কথা সব জানে হয়তো।
–কি হলো ভাইয়া, রিপ্লাই নাই যে?” মেয়েটা আবার মেসেজ দিলো আমার কোনো রিপ্লাই না পেয়ে। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম:
–হু আর ইউ?”
মেয়েটা সাথে সাথে রিপ্লাই দিলো:
–আমার নাম ঈশিতা। আপনার অনেক বড় ভক্ত……
–তাই নাকি? কতো বড়?
–বলে বুঝাতে পারবোনা। আমি কী আপনার ফ্রেন্ড হতে পারি?
–হুমম…শিওর….”
–থ্যাংকস, তাহলে এখন থেকে বন্ধুকে “তুমি” করে বলতে পারি?” মেয়েটার মনে হয় ধৈর্য্যশক্তি কম। সবকিছু ফাস্ট ফাস্ট করতে চাই।
–তোমার ইচ্ছে….”
–আচ্ছা, এখন ঘুমাও….. কাল কথা হবে।
–ওকে……” প্রথমবার এইটুকুই কথা হয় ঈশিতার সাথে।

পরদিন ঈশিতা আমার সেল নাম্বার চাইলো, আমিও কী মনে করে যেন দিয়ে দিলাম নাম্বার। নাম্বারটা দিয়েই বুঝলাম কী ভুলটাই না করলাম। ডেলি অনেকবার ফোন দিয়ে সে আমাকে বিরক্ত করতে থাকে। তবে আমি যে বিরক্ত হয় এটা ওকে বুঝতে দিতে চাইতামনা। কিন্তু ও একদিন বুঝে ফেলে। সেদিন ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো:
–রানা, তুমি আমার আচরণে খুব বিরক্ত হও তাইনা?”
আমি বললাম:
–না তো, কেন এমন মনে হলো?
–না, একটু বেশি বিরক্ত করি তো তাই….. আসলে সারাদিন একা থাকি তো, কারো সাথে কথা বলতে পারিনা।” শেষের কথাটুকু খুব করুণ শুনালো তার। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–একা থাকো মানে?
–মানে, আমি কারো সাথে কথা বলতে পারিনা। সারাদিন বাসায় একা থাকতে হয়।
–কেন? তোমার বাবা মা থাকেনা?
–বাবা রেল লাইনে জব করে, সারাদিন ওখানে থাকে, আর মা টিচার। আমাকে বাড়িতে থাকতে হয় একা।
–ওহ….বন্ধু/বান্ধবী নেই তোমার?
–না…..”

ঈশিতার কথা কেন জানি বিশ্বাস হতে চাইলোনা। বন্ধু ছাড়া আবার মানুষ আছে নাকি? আর বাবা মা কি এতোটা কেয়ারলেস হয় সন্তানের প্রতি? মনে হয় আমার সাথে ভাব জমাতে ঈশিতা একের পর এক মিথ্যে বলে যাচ্ছে। আর মিথ্যে আমি একদম পছন্দ করিনা। ও আমার বন্ধু হতে চাই ভালো কথা, তাই বলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে? সেদিনের পর থেকে ঈশিতার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিলাম। তাকে ইগনোর করতে শুরু করলাম। ফোন দিলে রিসিভ করতামনা। ব্যস্ত দেখাতাম নিজেকে।

একরাতে ঈশিতা আমাকে অনেকগুলো ফোন দিলো। আমি রিসিভ করিনি। তখন সে একটা টেক্সট দিলো:
*রানা, আমার খুব ভয় করতেছে, প্লিজ একটু কথা বলো*
কেন জানি ঈশিতার এই মেসেজটা পড়ে একটু মায়া হলো। ফোন দিলাম তাকে। সে ফোন রিসিভ করে আবার বললো:
–রানা, আমার ভয় করতেছে…..”
–কেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–জানিনা আমি……
–এটা কেমন কথা?
–আমার সাথে কি একটু কথা বলা যায়না?” কথাগুলো বলছিল ঈশিতা চেপেচেপে।
–আচ্ছা, কী বলবে বলো…..”
–তোমার শিখার কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
–মানে?
–শিখা দেখতে কেমন ছিল?
–অনেক সুন্দর এবং ভালো একটা মেয়ে।
–আমার না ওর মতো অশরীরী হতে ইচ্ছে হয় মাঝেমাঝে….
–কেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিরতি নিলো একটু ঈশিতা। তারপর বললো:
–জানিনা….. তবে ইচ্ছে হয় খুব…. ইচ্ছে হয় অশরীরী হয়ে চাঁদের আলোতে তোমার হাতটি ধরে হাটতে।
–তাই? আর কী কী ইচ্ছে হয়?”
ওপাশ থেকে ঈশিতার আর কোনো সাড়া পেলামনা। হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ার একটা শব্দ শুনলাম শুধু। তারপর লাইন কেটে গেলো। আমি আবার ফোন দিলাম, কোনো সংযোগ পেলামনা ওর নাম্বারে। একটু চিন্তা হলো ওর জন্য। কীসব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছিলো সে। হঠাৎ তার কী হলো?

এরপর অনেকবার ঈশিতার নাম্বারে ফোন দিলাম। একবারো সংযোগ পেলামনা। দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েকমাস। ঈশিতার কথা প্রায় ভুলে গেছি। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে আবার মনে পড়লো ঈশিতার কথা। সেদিন অন্য একটা অপরিচিত মেয়ে আমাকে মেসেজ দিলো ফেসবুকে, ঠিক প্রথমদিন যেমন ঈশিতা দিয়েছিলো। মেয়েটা শুরুতেই ঈশিতার মতো করে মেসেজ দিলো:
–হাই মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া…..”
–হু আর ইউ?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–আমার নাম ইরা। আপনার অনেক বড় ভক্ত…..”
–কতো বড়?” নিজের প্রশ্ন করা দেখে নিজেই আশ্চর্য হলাম। কারণ ঈশিতার সাথে প্রথমদিন যেভাবে কথা শুরু হয়েছিল, এই মেয়েটার সাথেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আমার ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে মেয়েটা এখন বলবে:
–বলে বুঝাতে পারবোনা। আমি কী আপনার ফ্রেন্ড হতে পারি?”
আমার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে মেয়েটা ঠিক তাই বললো। আমি তখন কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম:
–তুমি ঈশিতা?
–কোন ঈশিতা?” যেন মেয়েটা অবাক হলো।
–নাহ, কেউনা…..
–বললেননা যে, আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি?
–হুমমম…..শিওর…..
–তাহলে এখন থেকে আর “আপনি” না, তুমি করে বলবো।
–তোমার ইচ্ছে….. আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?
–কী প্রশ্ন?
–তুমি কি বাসায় একা থাকো?
–হ্যা, আসলে আমার বাবা রেললাইনে জব করে, আর মা টিচার। ওরা সারাদিন বাইরে থাকে, আর আমি একা থাকি বাসায়, বাসার সব কাজ করি।
–তার মানে তুমি ঈশিতা….
–কোন ঈশিতা, সত্যি বলছি আমি কোনো ঈশিতাকে চিনিনা। আমার নাম ইরা।
–তোমার সাথে আমার আগে যখন কথা হতো, তখন তো তোমার নাম বলেছিলে “ঈশিতা”
–তোমার সাথে তো আমার আগে কখনো কথা হয়নি, আজ প্রথম কথা হচ্ছে।”
ইরার মেসেজটা দেখে চমকে উঠলাম। এটা কেমনে সম্ভব? ঈশিতার সাথে ইরার সবকিছু মিলে যাচ্ছে, তাহলে দুইজন আলাদা হয় কেমনে?
–কি হলো? চুপ কেন?” ইরা আবার মেসেজ দিলো। আমি তখন ঈশিতার ফোন নাম্বারটা ইরাকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–এটা তোমার নাম্বার না?”
–হুমমম, আমার নাম্বার। তুমি কীভাবে পেলে?
–তোমার সাথে আমার আগেও কথা হয়ছে, তখন দিয়েছিলে তুমি।
–সত্যি বলছি, আগে কখনো কথা হয়নি আমাদের। আচ্ছা, আমার নাম্বারে একটা কল দাও প্লিজ……”
আমি তখন ইরার নাম্বারে ফোন দিলাম। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন ফোন রিসিভ করে ভারী কণ্ঠে বললো:
–হ্যালো….”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম:
–ঈশিতা আছে?
–কোন ঈশিতা?” ভারীকণ্ঠের লোকটা যেন অবাক হলো নামটা শুনে।
–না মানে ইরা…. ইরা আছে?”
ওপাশের লোকটা হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো আমার প্রশ্ন শুনে। আমি আবার বললাম:
–কি হলো? আপনি চুপ কেন?”
ফোনে লোকটার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনলাম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটা জিজ্ঞেস করলো:
–বাবাজি, তুমি কে?
–আমি ইরার বন্ধু।” জবাব দিলাম আমি।
লোকটা কিছু মুহূর্ত বিরতি নিয়ে বললো:
–ইরা নেই…..
–নেই মানে?” আশ্চর্য হলাম আমি।
–ইরা মারা গেছে আজ থেকে পাঁচমাস আগে।
–হোয়াট!!” নিজেকে সামলাতে পারলামনা আমি কথাটা শুনে। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম পড়ে থাকা ফোনটার দিকে। তারপর ওটা আবার হাতে তুলে নিয়ে ইরাকে মেসেজ করতে যাবো, তখন ইরার আইডিটা আর খুঁজে পেলামনা। এতক্ষণ ইরার সাথে যে মেসেজে কথা হলো, মেসেজগুলো একটাও নেই। আরো বেশি চমকে উঠলাম আমি। তাহলে এতক্ষণ যা যা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা কী? ভাবতে লাগলাম আমি ইরার মৃত্যু নিয়ে। নিশ্চয়ই তার সাথে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে, তার মৃত্যুটা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ছিলনা, যার কারণে মৃত্যুর এতোদিন পরে এসে সে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে অদ্ভুতভাবে। কী হতে পারে তার মৃত্যুরহস্য? ভাবতে লাগলাম আমি। তার মৃত্যু রহস্য জানার জন্য আমাকে যেতে হবে তাদের এলাকায়। তাই আর দেরি না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, যাবো আমি, অবশ্যই যাবো। আই হ্যাভ টু ফাইন্ড আউট দ্যা মিস্ট্রি বিহাইন্ড হার ডেথ।

পরদিন বাইক নিয়ে বের হলাম ইরার এলাকায় যাওয়ার জন্য। অনেকদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই একটু সকাল সকাল বের হলাম। সাথে প্রয়োজনীয় সব একটা ব্যাগে নিলাম। ওয়ালথার আর ড্যাগারটাও সাথে নিতে ভুললামনা। কারণ এই দুইটা জিনিসই আমার এডভেঞ্চারের চালিকাশক্তি। বিপদআপদে সবচেয়ে আগে কাজে আসে এই দুইটা। বলা তো যায়না কখন বিপদ এসে কুর্ণিশ করে বলে, এসে গেছি আমি।

ঢাকার কমলাপুরে এসে পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো। একটা হোটেলে রুম বুকিং করলাম আমি থাকার জন্য। বাইকটা নিচে পার্কিং করে ব্যাগ নিয়ে রুমে এলাম। অনেকদূর জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। রাতে আর কোথাও বের হবোনা আজ। রাতের খাবার রুমেই অর্ডার করে খেয়ে নিলাম।

খাওয়ার পর শরীরটা বেডে এলিয়ে দিলাম। তারপর তারেককে একটা ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে তারেক ফোন রিসিভ করে বললো:
–হ্যালো…..”
–হ্যাঁ তারেক, কোথায় তুই? কী করিস?”
–এইতো, বাসায়। ডিনার সেরে উঠলাম। তুই কোথায়?
–আমি ঢাকায়। সরি দোস্ত, তোকে না জানিয়ে চলে আসতে হলো।
–ইটস ওকে। কিন্তু হঠাৎ ঢাকায়?
–একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি। একটা মেয়ের মৃত্যু হয়েছে পাঁচমাস আগে……
–তারপর?
–আমি গতকাল জানতে পারি মেয়েটার মৃত্যুর ব্যাপারে। মেয়েটার মৃত্যুটা কেন জানি আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলোনা।
–কেন?
–কেন? হুমমম…..আসলে মেয়েটা নিজেই আমার সাথে কথা বলেছে গতকাল।
–হোয়াট? পাঁচমাস আগেই তো তার মৃত্যু হয়েছে।
–হুমম…. হয়েছে…কিন্তু ও আমার সাথে মেসেজে কথা বলেছে।” তারপর তারেককে সব খুলে বললাম। শুনে তারেক বললো:
–আমারো মনে হচ্ছে মেয়েটার মৃত্যুর আড়ালে কোনো রহস্য আছে। আর আমি জানি সেই রহস্য একদিন উন্মোচন করবে আমার বন্ধুবর রানা।
–আমাকে পারতেই হবে দোস্ত। কিন্তু তোর একটা হেল্প দরকার।
–কি হেল্প বল?
–এখানে হয়তো আমার বিপদও হতে পারে, আমার সিকিউরিটির জন্য এখানকার পুলিশকে জানিয়ে রাখবি একটু।
–কোন থানা?
–কমলাপুর রেলওয়ে থানা।
–আচ্ছা, ঐ থানার ওসির সাথে আমি কথা বলে তোর ব্যাপারে বলবো।
–থ্যাংক ইউ দোস্ত।
–ইটস ওকে। কিন্তু দোস্ত, একটা জিনিস খুব মিস করছি।
–কী?
–তোর এবারের মিশনে আমি সঙ্গে থাকতে পারলাম না। আমার জন্য এটা খুব দুর্ভাগ্যের।”
আমি একটু হেসে দিয়ে বললাম:
–আরে না, দুর্ভাগ্য কেন হবে। কাজের ফাক পেলে তুইও চলে আসিস এখানে।
–হুমম…… আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আসতে।
–আচ্ছা ভালো থাকিস।
–তুইও ভালো থাকিস। বেস্ট অব লাক।”
তারেকের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। ফোনের স্ক্রিনে টাইম দেখলাম ১২ টা বেজে ৪৪ মিনিট। তারপর ফোনটা পাশে রেখে, লাইট অফ করে চোখ বুজলাম। খুব ক্লান্ত, তাই ঘুমিয়ে পড়তে বেশিক্ষণ লাগলোনা।

পরদিন রুমেই ব্রেকফাস্ট সেরে বের হলাম। ঐদিন ইরার নাম্বারে ফোন করার পর ভারীকণ্ঠে যে লোকটা কথা বলেছিলো, তারসাথে দেখা করতে যাচ্ছি। একটু আগে লোকটার সাথে ফোনে কথা বলে ঠিকানা নিয়েছি। লোকটার দেয়া ঠিকানা খুঁজে বের করতে আমার বিশ মিনিটের মতো সময় লাগলো।

লোকটার নাম ইউসুফ খান। সম্পর্কে ইরার বাবা। আমাকে দেখেই তিনি প্রথমে সারা শরীরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। আমি মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম:
–আঙ্কেল আমার নাম রানা। ইরার বন্ধু।”
–ও বাবাজি, বসো।” সামনের একটা সোফার দিকে ইশারা করলেন তিনি।
আমি সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম:
–কেমন আছেন আপনি?
–ভালো আছি। হঠাৎ এতদূর থেকে এলে যে?” বলেই ইউসুফ খান ভেতরে কার উদ্দেশ্যে যেন চা নাস্তা আনার জন্য বললেন।
–আঙ্কেল, আসলে আমি জানতাম না ইরার মৃত্যুর ব্যাপারে। হঠাৎ ওর মৃত্যুর কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারলামনা। ভাবলাম তার লাশ তো দেখতে পাইনি, অন্তত তার কবরটা একবার দেখে আসি।
–ওহ….ভালো করেছো বাবাজি।”
একটা মহিলা ঢুকলো তখন চা নাস্তা নিয়ে। আমাকে চোখ বড় বড় করে একবার দেখে নিলেন তিনি। উনার তাকানোটা আমার কাছে সুবিধার মনে হলোনা। ইউসুফ খান মহিলাটিকে দেখিয়ে বললেন:
–ও হচ্ছে ইরার মা।”
আমি একটু নড়েচড়ে বসে বললাম:
–ও আন্টি স্লামুআলাইকুম। ভালো আছেন?
–হ্যা বাবা, ভালো আছি। চা নাও।” বলেই উনি একটা চায়ের কাপ আমার হাতে দিলেন, আরেকটা দিলেন স্বামীর হাতে। তারপর উনি ভেতরে চলে গেলেন।

আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইউসুফ খানকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম:
–আঙ্কেল, ইরা কীভাবে মারা যায়?”
ইউসুফ খানও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা সামনের টেবিলে রাখলেন। তারপর বললেন:
–বাবাজি, মেয়েটা হঠাৎ করে মারা যায় ঘুমের ঘোরে।
–মানে?
–মানে এক রাতে সে তার রুমে ঘুমায়ছে। কিন্তু সকালে তার ঘুম আর ভাঙেনি।
–কোনো অসুখ ছিল তার?
–ঐ রাতে তার একটু জ্বর ছিল শরীরে। ডাক্তার ডেকে ওষুধ দেয়া হয়ছিল। কিন্তু কী যে হলো মেয়েটার, সেই রাতে ঘুমের মধ্যেই মারা যায়।
–ওহ! ভেরি স্যাড! আঙ্কেল ওর কবরটা একটু দেখাতে পারবেন?
–আচ্ছা চলো…..”
আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রাখলাম টেবিলে। তারপর ইউসুফ খানের সাথে বের হলাম। উনাকে বাইকের পেছনে তুলে বাইক স্টার্ট দিলাম। এরই মধ্যে একবার আমার চোখ গেল ইউসুফ খানের বাসার দুতলায়। ওখান জানালা দিয়ে দুটি চোখ আমাকে দেখছিল উৎসুক দৃষ্টিতে। আমি ওদিকে তাকাতেই উনি পর্দা টেনে দিলেন জানালায়। মুহূর্তের জন্য দেখলেও চিনতে পারলাম, উনি ইউসুফ খানের স্ত্রী ছিলেন। কেন জানি মনে হলো আমার আগমনে তিনি সন্তুষ্ট নন……..

গোরস্থানে এসে কয়েকটা কবর পেরিয়ে চোখে পড়লো ইরার কবরটা। ইউসুফ খান কবরটা আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো:
–বাবাজি, তুমি থাকো এখানে, আমি গোরস্থানের বাইরে আছি।” বলেই উনি চলে গেলেন। হয়তো মেয়ের কবরের সামনে নিজেকে সামলাতে পারেননি বা অন্য কোনো কারণও হতে পারে। যাইহোক, আমি ইরার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার কবরটা জিয়ারত করলাম। তারপর আল্লাহর কাছে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম।

গোরস্থান থেকে বের হয়ে এসে দেখলাম ইউসুফ খান আমার বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর উনাকে উনার বাসায় পৌঁছে দিলাম। উনি আমাকে তখন জিজ্ঞেস করলেন:
–বাবাজি, তুমি কী আজকেই চলে যাবে?
–না আঙ্কেল, আমি হয়তো বেশ কিছুদিন থাকবো এখানে।
–কেন? কোনো কাজ আছে নাকি?
–নাহ, তেমন কোনো কাজ না, দেখবো আপনাদের এলাকাটা।
–ওহ, তো কোথায় উঠেছো তুমি? কোনো আত্মীয়ের বাসায়?
–নাহ, হোটেলে উঠেছি আমি।
–হোটেলে কেন? তুমি আমাদের বাসার মেহমান, আমাদের বাসায় থাকবে।”
ইউসুফ সাহেবের কথায় খুব খুশি হলাম। মনে মনে এটাই প্রত্যাশা করেছিলাম আমি, কারণ এখানে থাকলেই আমার কাজটা সহজ হবে। তবুও সৌজন্যবোধ দেখিয়ে বললাম:
–না আঙ্কেল, আপনাদের কষ্ট দিয়ে লাভ কি?
–আরে নাহ, কিসের কষ্ট? যাও, তুমি তোমার সবকিছু হোটেল থেকে নিয়ে আসো। দাড়াও, একটা লোক পাঠাচ্ছি তোমার সাথে…..” বলেই উনি “হারুন” নামে কাউকে ডাক দিলেন। একটু পর একটা ১৯/২০ বছরের ছেলে এসে দাঁড়ালো উনার পাশে। মনে হয় ছেলেটা এই বাড়িতে কাজ করে। ইউসুফ খান ছেলেটাকে বললো:
–হারুন, তুমি যাও ওর সাথে। ওকে হোটেল থেকে নিয়ে আসো।”
–আচ্ছা….” বলেই হারুন বাইকের পেছনে উঠলো। আমি বাইক স্টার্ট দিলাম।

যেতে যেতে হারুনকে জিজ্ঞেস করলাম:
–হারুণ, তুমি কতদিন ধরে আছো ঐ বাড়িতে?
–ভাইজান, আমি তো বেশিদিন হচ্ছেনা ঐ বাড়িতে কাজ করি, এই ধরেন মাস দুয়েক হবে।”
–ও…. তুমি জানো ইরার ব্যাপারে?
–কোন ইরা ভাইজান?
–ও বাড়ির মেয়ে…..
–ও বাড়িতে তো ইরা নামে কেউ থাকেনা।
–তাই?
–হ ভাইজান, উনাদের দুই মেয়ে, একটার নাম ইরিন খান, আরেকটার নাম শিরিন খান।
–খান?
–হুমম….. ওরা খান বংশ।”
হারুনকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলামনা। তবে ওর কাছ থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেলাম। সবার নামের শেষে খান পদবীটা আছে, কিন্তু ইরার পুরো নাম ইরা রহমান। তার মানে ইরা ওদের আসল মেয়ে না।

হোটেলের রুমটা ছেড়ে, ওখানকার বিল মিটিয়ে আবারো ইউসুফ খানের বাসায় আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেলো। আমাকে থাকার জন্য একটা রুম দিলো এরা। আমি আমার ব্যাগটা রুমে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর সবার সাথে লাঞ্চ করতে বসলাম। লাঞ্চ করার সময় হঠাৎ ইউসুফ খানের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললাম:
–আন্টি, আপনার নামটা জানা হয়নি…..
–আমার নাম তসলিমা….
–পুরো নামটা?
–তসলিমা খান…..
–ওহ….
–আর এরা হচ্ছে আমার দুই মেয়ে ইরিন আর শিরিন।” দুই মেয়েকে দেখিয়ে বললেন তসলিমা খান। ইরিন আর শিরিন একসাথে “হাই” বললো আমাকে। আমিও মুখে একটু হাসি নিয়ে ওদেরকে “হাই” বললাম। তারপর লাঞ্চ শেষ করে উঠলাম।

বিকেল পর্যন্ত রুমে রেস্ট নিয়ে বের হওয়ার সময় ইউসুফ খান আমাকে জিজ্ঞেস করলো:
–কোথায় যাচ্ছো বাবাজি?”
–আঙ্কেল একটু বের হবো, ফিরতে হয়তো রাত হবে।” জবাব দিলাম আমি।
–আচ্ছা যাও…..” বলেই ইউসুফ খান সামনের টেবিল থেকে একটা পত্রিকা টেনে নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন। আর আমি বের হয়ে এলাম।

কমলাপুর রেলওয়ে থানায় এসে ওখানকার ওসির সাথে দেখা করলাম। তারেকের সাথে এখানকার ওসির আগে থেকেই পরিচয় আছে। সে আমার কথা আগে থেকেই বলে রেখেছিল। আমার পরিচয় পেয়ে ওসি সাহেব হ্যান্ডশেক করে বসতে বললেন। বসতে বসতে আমি উনার ড্রেসের উপর থেকে উনার নামটা পড়ে নিলাম।
–তো মি.রাতুল হাসান, ভালো আছেন আপনি?” জিজ্ঞেস করলাম উনাকে।
–জ্বী, ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন?
–আমিও ভালো আছি। তারেক নিশ্চয়ই আমার কথা বলেছে আপনাকে।
–শুধু বলেনি, আপনার পুরো ইতিহাস শুনিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে আমি অপেক্ষা করে আছি রানা নামের মানুষটা দেখতে কেমন তা দেখার জন্য।
–শুধু শুধু লজ্জা দেবেননা। এবার তাহলে কাজের কথায় আসি।
–হুমমম….. বলুন, আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগীতা পাবেন।
–পাঁচমাস আগে এই এলাকার একটা মেয়ে রহস্যজনক ভাবে মারা যায়। মেয়েটার নাম ইরা রহমান। ফেসবুকে পরিচয় তার সাথে আমার। মেয়েটার মৃত্যু তার ফ্যামিলি নরমালি নিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ইরা আসলে খুন হয়েছে।
–এরকম মনে হওয়ার কারণ?
–কারণটা পরে না হয় আরেকদিন বলবো। আচ্ছা, আপনার এখানে কী ইরা রহমান নামে কোনো মেয়ের খুনের ডায়রি করা হয়নি পাঁচমাস আগে?
–নাহ, এরকম কোনো ডায়রি হয়নি। তবে আমার মনে আছে, পাঁচমাস আগে এক পাগল লোক এসেছিল এখানে খুনের মামলা করতে।
–পাগল লোক?
–হুমমম…… লোকটার মুখে তখন “ইরা” নামটি শুনেছিলাম। কিন্তু তখন পাগলের প্রলাপ ভেবে তার কথার কোনো গুরুত্ব দিইনি।
–লোকটাকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?
–তা তো জানিনা।
–লোকটাকে আমার দরকার। ওকে খুঁজে বের করতে হবে।
–কিন্তু কীভাবে খুঁজবেন একটা পাগলকে?
–তা জানিনা, তবে লোকটার খোঁজ আমার চাই-ই চাই। আর কোনো হেল্প লাগলে আপনাকে বলবো। আজ তাহলে আসি।
–আগেই বলেছি, আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগীতা পাবেন।
–ধন্যবাদ।” বলে উঠে দাঁড়ালাম বসা থেকে। তারপর রাতুলের সাথে আবার হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে আসলাম থানা থেকে।

রাতে ঘুুমানোর আগ পর্যন্ত শুধু একটা বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো- কে ঐ পাগল লোকটা? তার সাথে ইরার কি সম্পর্ক? আর ইরার খুনের ব্যাপারে যেখানে কেউ জানেনা, সেখানে একটা পাগল লোক কীভাবে জানে সে খুন হয়েছে? মাথার মধ্যে এরকম আরো অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। মধ্যরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলো একটা চিৎকার শুনে। কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাক দিয়ে বললো:
–রানা, ওরা আমাকে বাঁচতে দেয়নি, মেরে ফেলেছে আমায়।”

চমকে বেডের উপর উঠে বসলাম আমি। কথাটা কয়েকবার প্রতিধ্বনি করলো আমার কানে। লাইট অন করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম একবার। কাউকে দেখতে পেলামনা। তখন আমি বেড থেকে নেমে জানালার পাশে গেলাম। একটা সুগন্ধ পেলাম বাতাসে। ঘুমানোর সময় এই সুগন্ধটা ছিলনা এখানে। মনে হয় কেউ এসেছিল। কিন্তু কে আসবে এতরাতে? দরজাটা খুলে বের বাইরে বের হলাম আমি। জ্যোৎস্না রাত, চারপাশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছেনা। আমি কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম বাইরে। হঠাৎ অদৃশ্য কেউ একজন ফিসফিস করে আমার কানেকানে বললো:
–মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া…. মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া…..”
আমি একটুও চমকালাম না শুনে। শান্তকণ্ঠে ডাক দিলাম তাকে:
–ইরা…..”
–কেমন আছো মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া?
–ভালো আছি।
–আমি জানতাম রানা, তুমি এখানে আসবে।
–কীভাবে জানতে?
–কারণ রহস্য তোমায় টানে। আর আমার মৃত্যুর রহস্য বের করতে তুমি ছুটে আসবে এটাই স্বাভাবিক।
–কিন্তু তুমি কীভাবে মারা গেছো? কে মেরেছে তোমায়?
–তা তো বলবোনা…..
–কেন?
–কারণ আমি তোমার অনেক বড় ফ্যান। আমি দেখবো তুমি কীভাবে আমার মৃত্যুর রহস্যভেদ করতে পারো।
–তাই?
–হুমমম….. মরে গিয়ে এক প্রকার ভালো হয়েছে। আমার প্রিয় হিরোর একটা মিশনে এভাবে থাকতে পারছি।
–ইতোমধ্যে আমি জেনে গেছি তুমি এদের আসল মেয়ে না।
–খুব ব্রিলিয়ান্ট!
–সামনে আসবেনা তুমি?
–আসবো, যেদিন তুমি আমার খুনিদের শাস্তি দিতে পারবে সেদিন আসবো তোমার সামনে।
–একটা জিনিস খুব অবাক লাগছে আমার।
–কি?
–একদিন তুমি শিখার মতো অশরীরী হতে চেয়েছিলে, আজ তুমি সত্যি সত্যি অশরীরী হয়েছো।
–অনেক কষ্টে কথাটি বলেছিলাম সেদিন। আমারো তো সবার মতো বাঁচতে ইচ্ছে করেছিলো। কিন্তু আমি পারিনি রানা, ওরা আমাকে বাঁচতে দেয়নি রানা।
–কথা দিচ্ছি তোমায়, তোমার খুনিদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে যাবোনা আমি।
–এইজন্যই তো আমি তোমার অনেক বড় ফ্যান। তোমার সাহস, তোমার আত্মবিশ্বাস, তোমার কৌশল আমাকে মুগ্ধ করে। যাইহোক, এতো রাতে আর বাইরে থেকোনা। ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
–আচ্ছা……” বলেই আমি রুমে চলে আসলাম। তারপর আবারো ঘুমিয়ে পড়লাম।

বাকি রাতটা ভালোভাবেই কাটলো ঘুমিয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মর্নিং ওয়াকে বের হলাম। কিছুক্ষণ হাটলাম একা একা। একটুপর দেখি একটা মেয়ে আমার পেছন পেছন হাটছে। প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েটাও আমার মতো মর্নিং ওয়াকে বের হয়ছে, কিন্তু পরে মেয়েটির ভাবভঙ্গিমায় বুঝলাম, মেয়েটা আমাকে ফলো করছে। আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–এক্সকিউজ মি, আপনি কি আমায় ফলো করছেন?”
আচমকা আমার এই প্রশ্নে মেয়েটা দ্বিধায় পড়ে গেলো। ইতস্তত করে বললো:
–আপনাকে কেন আমি ফলো করতে যাবো? আপনাকে আমি চিনিনা, জানিনা….”
–ও আচ্ছা তাই? তাহলে আমারি বুঝতে ভুল হয়েছে। সরি……” বলে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। তারপর আবার মেয়েটার দিকে ঘুরে বললাম:
–এতো রাত জাগা ভালো না…..”
–মানে?” মেয়েটা অবাক হলো।
–মানে আপনি অনেক রাত করে ঘুমায়ছেন রাতে। এটা কিন্তু শরীরের জন্য মোটেও ভালোনা।
–আচ্ছা, আমি যে অনেক রাত করে ঘুমায়ছি আপনি জানলেন কী করে?
–আমি কীভাবে জানলাম তা না হয় আপনার অজানায় থাক।
–প্লিজ বলুন…. আমি সত্যিই অনেক রাত করে ঘুমায়ছি। বাট অবাক হচ্ছি আপনি এটা জানলেন কী করে?
–অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা খুব সিম্পল একটা ব্যাপার। তার আগে বলুন, গভীর রাতে আমার রুমে উকি মারার মতলবটা কী ছিল?
–মানে? আমি কেন উকি মারতে যাবো?” অবাক হওয়ার ভান করলো মেয়েটা।
–মেরেছেন তো…..
–না মারিনি…….”
–আচ্ছা মারেননি……” বলেই আমি চলে যাচ্ছিলাম, তখন পেছন থেকে মেয়েটা আবার বললো:
–এক্সকিউজ মি……
–জি বলুন…” মেয়েটার দিকে ঘুরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। সে আমতা আমতা করে বললো:
–আমি না সত্যি উকি মেরেছিলাম আপনার রুমে, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন? আপনি তো তখন ঘুমিয়েছিলেন? আর আমাকেও দেখেননি।
–এটাও না হয় রহস্যই থাক…..
–প্লিজ বলুননা, আপনি এমন কেন?”
–ঐ যে, পারফিউম…..
–পারফিউম?
–মানে আপনার একটু সাজগোজ করার ইচ্ছে আছে কিনা, গায়ে পারফিউম লাগাতে ভালোবাসেন। পারফিউম এর গন্ধটা রাতে আমি জানালার পাশে পেয়েছিলাম, আর এখন এখানে পাচ্ছি। আহ! কী সুগন্ধ! ” বলেই নাক দিয়ে পারফিউমের ঘ্রাণ নেওয়ার ভান করলাম।
মেয়েটা একটু লজ্জাভাব নিয়ে বললো:
–এইবার বুঝতে পেরেছি…. বাই দ্যা ওয়ে, আমার নাম সাবরিনা।
–আর আমার নাম রানা। রাতে কোন মতলবে উকি মারতে গেছিলেন বলে ফেলুন….. নাকি সুন্দর ছেলে দেখে…..”
–না… না… ওসব কিছুনা, আসলে আপনার সাথে জরুরী কথা ছিল।
–কী কথা?
–এখন এখানে এভাবে বলা যাবেনা। এটা ধরুন…….” বলেই সাবরিনা আমার হাতে একটা ছোট্ট চিরকুট ধরিয়ে দিলো। তারপর হনহন করে চলে গেলো। আমি চিরকুটটা খুলে পড়লাম। ওখানে লেখা আছে:
**রাত ঠিক তিনটায় আমি আপনার জন্য ওয়েট করবো বাইরে। আপনি বের হবেন সাবধানে, কেউ যেন জানতে না পারে। জরুরী কথা আছে।**
চিরকুটটা পড়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। মেয়েটা আমাকে এমন কী বলতে চাই, যা সবার অজান্তে বলতে হবে? দেখা যাক রাত তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে……..”
এই দিনটাও কেটে গেল স্বাভাবিকভাবে। কাউকে বুঝতে দিইনি আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য। তবে এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ইউসুফ খান লোকটা খুব একটা ভালো না। তিনি রেললাইনে কাজ করেন ঠিকই, কিন্তু তা কেবল লোক দেখানো। লোকটা ভয়ংকর। বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সাথে লিপ্ত। কেউ তার বিরোধীতা করার সাহস পাইনা। শত্রুকে একবার চিনতে পারলে কৌশলে রেললাইনে নিয়ে গিয়ে ট্রেনের নিচে শেষ করে দেন তিনি। এলাকার লোকজন ইউসুফ খানকে জমের মতো ভয় পায়, তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চাইনা সহজে। কয়েকজনকে ইরার কথা জিজ্ঞেস করলে, তারাও বলে ইরার মৃত্যু হয়েছে ঘুমের মধ্যে। হয়তো তারা ইউসুফ খানের ভয়ে মুখ খুলতে চাইনি।

রাত তিনটে বাজার পর আমি সাবধানে বের হলাম রুম থেকে। সাবরিনা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। আমাকে দেখেই সে টেনে নিয়ে গেলো একটা বড় গাছের আড়ালে। তারপর চাপাকণ্ঠে বললো:
–আপনি ৫ মিনিট দেরি করেছেন……”
–মাঝেমাঝে কাউকে অপেক্ষা করাতে ভালো লাগে, সে যদি সুন্দরী কোনো মেয়ে হয় তাহলে আরো বেশি ভালো লাগে।” কথাটি বলে তাকালাম সাবরিনার মুখের দিকে। গাছের পাতার ফাক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঠিক তার মুখের উপর। একটুখানি লজ্জা পেয়ে সে বললো:
–বাদ দিন ওসব, আপনাকে যে কারণে ডেকেছি আমি……
–কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি…..
–কী?
–ইরার সম্পর্কে বলতে চান তাইতো? ইরা আসলে মারা যায়নি, তাকে খুন করা হয়েছে এসব?
–হুমমম….. এগুলো ছাড়াও আরো অনেক কথা আছে।
–সব শুনবো, তার আগে একটা কথা বলুন…..
–কী কথা?
–আমার ধারণা যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে আপনি আমাকে পাঁচমাস আগে থেকেই চিনেন, রাইট?
–হুমমম….. কিন্তুু আপনি কী করে বুঝলেন?”
–স্বাভাবিক। আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য কেউ জানেনা, কিন্তু আপনি আমার পিছু লেগেছেন কিছু একটা বলার জন্য, কী হতে পারে সেই কথা? আপনার সাথে তো আমার কোনোদিন কথা বা দেখা হয়নি। তখন আন্দাজ করলাম, আপনি হয়তো ইরার খুব কাছের একজন, ইরার কাছে হয়তো আমার কথা শুনেছেন, আমার ছবি দেখেছেন, তাই আমাকে এখানে দেখেই চিনতে পেরেছেন, এবং আপনি যা বলতে চান তা নিশ্চয়ই ইরাকে নিয়ে।
–বাহ! পাঁচমাস আগে আপনার শুধু বুদ্ধি/মেধার কথা শুনেছিলাম ইরার কাছে। আজ আমি নিজ চোখে দেখছি।
–দেখো আবার প্রেমে পড়ে যেওনা……
–ছিঃ ছিঃ কী যে বলেন?
–এবার তাহলে আসল কথায় আসেন…..
–আপনি জানেন ইরার আসল মা বাবা নয় এরা?
–প্রথমদিন এসেই তা বুঝেছি।
–ইরার জন্মের পর তার মা মারা যায়, তখন তার বাবা এই মহিলাটিকে বিয়ে করেন ইরার কথা চিন্তা করে। কিন্তু মহিলাটি ছিল লোভী। ইরার বাবার সম্পত্তি দেখে বিয়ে করতে রাজি হন, কিন্তু আড়ালে তিনি ইউসুফ খানের সাথে সম্পর্ক করেন।
–এক মিনিট দাঁড়ান…..” সাবরিনাকে থামালাম আমি। তারপর জিজ্ঞেস করলাম:
–বিয়ের আগে থেকেই কি ইউসুফ খানের সাথে তসলিমা খানের সম্পর্ক ছিল?
–হুমম…… তাই শুনেছি।
–তারমানে ইউসুফ খান নিজের প্রেমিকাকে ইরার বাবার সাথে বিয়ে দিতে রাজি ছিল। এমনো হতে পারে ইউসুফ খান নিজেই চেয়েছেন তসলিমা খান যেন ইরার বাবাকে বিয়ে করে, যাতে ইরার বাবার সম্পত্তির কাছাকাছি যেতে পারেন তিনি।
–হয়তোবা…..
–তারপর ইউসুফ খান আর তসলিমা খান এক হলো কী করে?
–মসিউর রহমান, মানে ইরার বাবা। উনার সাথে তসলিমা আন্টি পাঁচবছর সংসার করেন। এই পাঁচ বছরে কোনো সন্তান হয়নি তাদের। শুনেছি তসলিমা আন্টি নিজেই সন্তান নিতে দেননি। তিনি বিভিন্ন কৌশলে মসি আঙ্কেলকে মানসিক চাপ দিতে থাকেন। গোপনে ইউসুফ খানের সাথে মিলে উনাকে পাগল বানাতে চেষ্টা করেন। তারা একসময় সফলও হয়। মসি আঙ্কেল একসময় পাগল হয়ে যায় সত্যি সত্যি। পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমাঝে কোথায় যেন হারিয়ে যায়, আবার মাঝেমাঝে উনাকে দেখা যায়। তবে উনাকে শেষবার দেখা যায় পাঁচ মাস আগে। তারপর আর দেখা যায়নি। উনি পাগল হয়ে যাবার পর তসলিমা আন্টি ইউসুফ খানকে বিয়ে করেন। সব সম্পত্তি তখন ইরার নামে ছিল। ইরার বয়স ২০ বছর পূর্ণ হলে, সে সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার দাবি করতে পারবে। তাই ইরাকে ওরা নিজেদের কাছেই রেখে দেন। ইরার বয়স তখন মাত্র পাঁচ পেরিয়েছে। সেই বয়স থেকেই সে এদের নির্যাতনের শিকার। ও বড় হয়েছে চাকরের মতো। পড়ালেখার পাশাপাশি সে বাড়ির সব কাজ করতো। কোনো একটা ভুল করলে ওরা সবাই মিলে ইরাকে মারতো। মারটাও ভয়ানক! লোহা আগুনে গরম করে ওর গায়ে লাগিয়ে দিতো। ইরার একমাত্র কাছের মানুষ ছিলাম আমি। বয়সে ওর ২ বছর বড় হলেও, আমরা ছিলাম বন্ধুর মতো। সে আমাকে গোপনে সব কেঁদে কেঁদে বুঝাতো। আমি ওর সাথে কথা বলতাম সবার গোপনে। কারণ ওরা ইরাকে কারো সাথে মিশতে দিতোনা। কাউকে ইরার সাথে ভাব জমাতে দেখলে তার করুণ পরিণতি হয়। সে ছেলে হোক বা মেয়ে। ইরা ছিল যথেষ্ট সুন্দরী। তার রুপে মুগ্ধ হয়ে একদিন এক ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু পরদিন থেকে ঐ ছেলেকে আর এই এলাকায় দেখা যায়নি। সবার ধারণা ইউসুফ খানের কারণে ঐ ছেলেকে রেললাইনে জীবন দিতে হয়েছে। কেউ এটা নিয়ে তখন কিছুই বলেনি, কারণ ইউসুফ খানকে সবাই ভয় পায়। ইরার জীবনটা একাকীত্বে কাটতে থাকে। কেউ তার সাথে কথা বলেনা, সেও কারো সাথে বলেনা। তবে আমি জীবনের ঝুকি নিয়ে মাঝেমাঝে ওর সাথে কথা বলতাম সবার আড়ালে। ও যখন কান্না করে ওর কষ্টের কথা বুঝাতো, তখন আমারো কান্না পেতো। আমি ওর একাকীত্ব দূর করার জন্য একদিন নিজের মোবাইলটা ওকে দিয়ে দিই। যাতে সে মানুষের সঙ্গে না হোক, অন্তত একটা যন্ত্রের সাথে ভাব করতে পারে।” এইটুকু বলেই সাবরিনা থামলো। আমার মুখ দিয়ে তখন কোনো কথা বের হচ্ছিলো না এই কাহিনী শুনে। সাবরিনার চোখ বেয়ে জল বের হচ্ছে। সে কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের জল মুছলো। আমি তখন বললাম:
–মসি আঙ্কেলকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে বা উনাকে খুঁজে পাওয়ার কোনো পথ খোলা আছে কিনা? উনাকে আমার খুব দরকার। কারণ উনি হয়তো জানে ইরার মৃত্যুরহস্য।”
সাবরিনা আবারো দুচোখ মুছে বললো:
–জানিনা। হয়তো উনার জীবনটাও রেললাইনে শেষ হয়ে গেছে পাঁচমাস আগে……”

–আচ্ছা, তারপর কী হলো বলুন ইরার?” প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম সাবরিনার দিকে। সাবরিনা বললো:
–মোবাইলটা হাতে পেয়ে ও শত কষ্টের মধ্যেও একটু সুখ খুঁজে পায়। যখন একাকি থাকতো, তখন ফেসবুকে সময় কাটাতো। কী করবে বেচারি, কারো সাথে কথা বলার সুযোগ পায়না।
–কারো সাথে কথা বলতে দিতোনা কেন ওকে? কারণটা কী?
–কারণ, ওরা চাইতোনা ইরা কারো সাথে ভাব জমাক।
–মানে ওদের ভয় ছিলো ইরা কারো সাথে ভাব জমালে ওর সাহস বেড়ে যাবে আর প্রতিবাদ করবে?
–হয়তোবা…..
–তারপর?
–তারপর আর কী, একদিন আপনার সাথে পরিচয় হয় ওর। আর মনে মনে কল্পনা করে আপনি ওর হিরো, একদিন আপনি এসে ওকে এখান থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু কিছুই হলোনা। একরাতে আপনার সাথে ফোনে কথা বলার সময় দেখে ফেলে ওর সৎমা। তখন যে কী অত্যাচার করা হয় তার উপর, তা বলার মতো না। লোহার শিক গরম করে তার হাতে পায়ে দেয়া হয়। অনেক বড় বড় ফোসকা পড়ে গেছিলো তার শরীরে, ব্যথায় তার কী যে যন্ত্রণা হতো, কিন্তু ঐ নরকের কীটগুলো ফিরেও দেখতোনা। তবে বেশিদিন ইরাকে আর এসব নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। ওর জন্মদিন পালন করবে বলে ওরা ওকে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কিন্তু ফিরে আসে ওর লাশ নিয়ে। সবাইকে ওরা বলে, ইরা ঘুমের মধ্যে মারা গেছে। কিন্তু আমরা জানি ইরাকে ঘুমের মধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে।”
–হুহ….” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম আমি। তারপর সাবরিনাকে জিজ্ঞেস করলাম:
–আগে কখনো ইরার জন্মদিন পালন করেছিল এরা?”
–না, আগে কখনো করেনি।” চোখ মুছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবাব দিলো সাবরিনা।
–এখন অনেকগুলো প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, যেখানে আগে কখনো ইরার জন্মদিন পালন করেনি, সেখানে ইরার জন্মদিন পালন করতো চাইলো কেন এরা? আর জন্মদিনটা ঘরে পালন না করে, ইরাকে ওরা কোথায় নিয়ে গেছিলো? ইরার মৃত্যুটা ঠিক কিভাবে হয়? কে কে জড়িত ছিল তার মৃত্যুতে? আচ্ছা, ওটা তার ২০ তম জন্মদিন ছিলো তাইনা?
–হুমমম….”
–তার ২০ বছর যেদিন পূর্ণ হবে, সেদিনই সব সম্পত্তির উপর সে পূর্ণ অধিকার দাবি করতে পারবে তাইতো?
–হুমমম তাই…..”
–তারমানে এই শয়তানগুলো আর দেরি করতে চাইনি, ওর যেদিন ২০ বছর পূর্ণ হলো, সেদিনই নিজেদের কাজটা সেরে, মেরে ফেলেছে ওকে। কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই এর। তাই এদের শাস্তিটাও দেয়া যাচ্ছেনা।” বলার পর হঠাৎ চোখ গেলো গেইটের কাছে। তিনটা লোককে পায়চারি করতে দেখলাম গেলো কালো পোশাকে। তিনজনের হাতেই বন্দুক। আমি সাবরিনাকে নিজের কাছে টেনে নিলাম। ও প্রথমে বুঝতে না পেরে বললো:
–এই এই কী করছেন?”
আমি তার ঠোঁটে একটা আঙুল দিয়ে বললাম:
–চুপ,,, কোনো শব্দ করবেনা। ওদিকে দেখো……”
লোক তিনটাকে দেখে সাবরিনা চমকে গেলো। তখন সে আমার বুকের সাথে আরো বেশি লেপ্টে গেলো। একদম শান্ত হয়ে গেলো। ওর চেহারা দেখে মনে হলো, ভয় পেয়েছে সে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম:
–এই বাড়িতে নাইট গার্ড আছে তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?
–আরে আমিও তো জানিনা, এই বাড়িতে নাইটগার্ড কবে থেকে হলো।” চাপাকণ্ঠে বললো সে।
–তারমানে আগে ছিলনা?
–না…..”
–কিছু একটা গরমিল লাগতেছে।
–কি?
–মনে হয় আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে ইউসুফ খান।
–এখন কী হবে?”
–এই বাড়িতে আর থাকা যাবেনা। কালকেই চলে যেতে হবে।”
–কিন্তু এখন আপনি বাসায় ঢুকবেন কী করে? ওরা তো দেখে ফেলবে? আর ওরা এতক্ষণ কোথায় ছিল?
–আমার চিন্তা বাদ দাও, তোমাকে আগে তোমার বাসায় পৌঁছে দিই। ওরা হয়তো এতক্ষণ এখানে আশেপাশেই ছিল।” কথা বলার সময় খেয়াল করলাম ওকে “তুমি” বলা শুরু করেছি। তাই ভুলটা আর শোধরালামনা। এমনিতেই কোনো মেয়েকে “আপনি” করে বলতে কেমনজানি লাগে।
–ওহ, এখন কী করবো, কিছু তো একটা করুন।
–তোমার বুকের উড়নাটা দাও…..
–হোয়াট?
–আরে আমি তাকাবোনা তোমার বুকের দিকে, দাও তো……
–কেন? কী করবেন আপনি উড়না দিয়ে?
–তোমার গলায় পেঁচিয়ে ফাঁসি দেবো তোমাকে। এতো কথা বলো কেন?” বলেই টান দিয়ে সাবরিনার উড়নাটা সরিয়ে নিলাম। তারপর গাছের নিচ থেকে কয়েকটা পাথর তুলে বাধলাম ওড়নার এক মাথায়। সাবরিনা বুকে হাত দিয়ে দেখছিল আমি করতেছি। উড়নার অন্যমাথাটা ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে ছুড়ে মারলাম দূরে। ওটা গিয়ে পড়লো ইউসুফ খানের বাড়ির দক্ষিণ দিকের দেয়ালের ওপাশে। একটা শব্দ হলো তখন। গার্ড তিনজন একসাথে দৌড় দিলো সেদিকে। আমি তখন সাবরিনাকে বললাম:
–কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে যাও বাসায়”
সাবরিনা বাধ্যমেয়ের মতো চলে যেতে লাগলো। আমিও তখন গেইটের ভেতর ঢুকে পড়লাম। তারপর রুমে এসে দরজা অফ করে দিলাম। যাক বাবা! একটুর জন্য বেঁচে গেলাম। এবার ঘুমানোর জন্য লাইট অফ করে শুইলাম। চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। তারপর শুনলাম ইরার কণ্ঠ। ও বলছে:
–মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া, ও মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া…. আমি তোমার অনেক বড় ফ্যান…..”

লাইট অন করে তাকালাম রুমের চারপাশে। কাউকে দেখলাম। নিচুকণ্ঠে ডাক দিলাম:
–ইরা……”
কারো সাড়া পেলামনা। তখন আবার লাইট অফ করে ঘুমিয়ে।পড়লাম।

সকালে ইউসুফ খানকে আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারটা জানালাম। শুনে উনি বললেন:
–কেন বাবাজি, আরো কয়েকদিন থেকে গেলেই তো পারো…..” বলার সময় উনার চেহারাটা উজ্জল দেখালো। মনে হয় আমার চলে যাওয়ার কথা শুনে উনি খুশি হয়েছেন। থেকে যাওয়ার কথাটা উনি এমনি মুখেই বলেছেন।
–না আঙ্কেল, চলে যেতে হবে……” একটু জোর গলায় বললাম কথাটা। তখন ইউসুফ খান বললেন:
–ঠিক আছে বাবাজি, চলে যাও….. সুযোগ পেলে আবার আসবে।”
–হুমমম….. আসবো আঙ্কেল। খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবো।” বলেই তাকালাম ইউসুফ খানের দিকে। উনার মুখটা কালো দেখালো তখন। আমার পুণরায় আগমনের কথাটা হয়তো উনার ভালো লাগেনি। করার কিছুই নেই। আসবো তো আমি আবার। ভেতর থেকে তসলিমা খান এলেন আমাকে বিদায় দেয়ার জন্য। উনি এসেছিলেন আমাকে হাসিমুখে বিদায় দিতে, কিন্তু আমার শেষের কথাটি শুনে উনারও স্বামীর মতো অবস্থা হলো। উনি মুখে একটু কৃত্রিম হাসি টেনে বললেন:
–আবার কি কোনো জরুরী কাজে আসবে?”
–হ্যাঁ আন্টি। জরুরী কাজে আসবো। আজ তাহলে আসি। ভালো থাকবেন।” বলেই বেরিয়ে আসলাম আমি। তারপর বাইক ছুটালাম ভালো একটা হোটেল খুঁজার উদ্দেশ্যে। আগের হোটেলটাতে উঠা যাবেনা। কারণ, ওখানে আমাকে ইউসুফ খানের লোকেরা খুঁজতে যেতে পারে।

অন্য একটা হোটেলে ঢুকে রুম বুকিং করলাম মাত্র। তখন কোথা থেকে যেন সাবরিনা এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–তুমি??”
–কেমন মানুষ আপনি? একবার না জানিয়ে চলে এলেন?” সাবরিনার কণ্ঠে অভিমান।
–আরে তোমার সাথে দেখা করার সুযোগ কোথায়? রাতেই তো বললাম আমি চলে আসবো ওখান থেকে।” বলতে বলতে লিফটে ঢুকলাম ৫ম ফ্লোরে যাওয়ার জন্য। লিফটে আমার পাশে দাঁড়িয়ে সাবরিনা বললো:
–আপনি দেখা না করেই চলে এলেন তাই আমি আপনাকে ফলো করে এখানে আসলাম।”
–কেন? প্রেমের টানে নাকি?
–যাহ, কী যে বলেন! আমি আসলে আপনার মিশনে সঙ্গী হতে চাই।
–তোমার উপর বিপদ আসলে কী করবা?
–কেন? আপনি আমায় রক্ষা করতে পারবেননা?” বলেই আমার চোখের দিকে তাকালো সে।
–হুমমম পারবো…..”
–আপনার নাম্বারটা দিন যোগাযোগ করার জন্য।
–অন্য কোনো মতলব নেইতো?
–থাকলে কী প্রবলেম হবে?
–বাদ দাও ওসব, তোমার ফোনটা দাও, আমি আমার নাম্বার সেভ করে দিচ্ছি তোমার ফোনে।” বলেই লিফট থেকে বের হলাম আমরা। সাবরিনা তার ফোনটা আমার হাতে দিলো। আমি আমার নাম্বারটা তার ফোনে সেভ করে দিয়ে রুমে ঢুকলাম। তারপর সাবরিনাকে জিজ্ঞেস করলাম:
–তোমার ফ্যামিলি যদি জানে তুমি আমার সাথে এভাবে মিশতেছো, তাহলে সমস্যা হবেনা তো?
–আমার ফ্যামিলি অলরেডি জানে তোমার ব্যাপারে। তারা চাই তুমি ইউসুফ খানকে ধ্বংস করে দাও।
–কেন? এতে তোমাদের পারিবারিক স্বার্থ আছে নাকি?”
কিছুক্ষণ নিরবতা নিয়ে সাবরিনা বললো:
–হ্যাঁ। কারণটা আমার ছোট চাচ্চু। আমার ছোট চাচ্চু অন্যায় একদম সহ্য করতেননা। ইরার উপর অত্যাচার হতে দেখে তিনি আদালতে মামলা করতে চেয়েছিলেন ইউসুফ খানের বিরুদ্ধে। এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। একরাতে মুখোশ পরা কয়েকজন লোক আমার ছোট চাচ্চুকে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন রেললাইনে একটা লাশ পাওয়া যায় ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়। ড্রেস দেখেই আমরা ছোট চাচ্চুর লাশটা সনাক্ত করতে পেরেছিলাম। ইউসুফ খান তার অপরাধের কোনো চিহ্ন রাখেননি। তাই তার কিছুই করা গেলোনা। সেদিন থেকে আমার পুরো ফ্যামিলি তার ধ্বংস কামনা করি। গতকাল যখন আপনার ব্যাপারে আমার ফ্যামিলি জানতে পারে, তখন তারা আপনার জন্য দোয়া করে, যেন আপনি ইউসুফ খানকে ধ্বংস করতে পারেন।” সাবরিনা থামলো। ও থামতেই আমি বললাম:
–আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। তুমি এখন বাসায় চলে যাও। প্রয়োজনে তোমাকে ফোন দিয়ে আমি ওখানকার খবর নেবো।”
সাবরিনা উঠে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম:
–সাবধানে থেকো….”
–তুমিও সাবধানে থেকো……
–উহু….. তুমি না, আপনি করে বলো…..
–ওকে, আপনিও সাবধানে থাকবেন।” বলেই সাবরিনা দরজা পর্যন্ত এগোলো। তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো:
–আসি…..”
আমি নিরবে মাথা নাড়ালাম। ও চলে গেলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম আমি। তারপর রুমে লক করে বের হলাম আমি। লিফট বেয়ে নিচে নেমে বাইক স্টার্ট করলাম। তারপর সোজা এলাম থানায়। রাতুল হাসান আমাকে দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন। উনার সাথে হ্যান্ডশেক করে বসলাম।
–তারপর কী খবর মি.রানা?” হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন রাতুল হাসান।
–এইতো আছি…. যে কারণে এসেছি, ইরার লাশটা তুলতে হবে পোস্টমর্টেম করার জন্য। আমার মনে হয় তাহলে কোনো না কোনো তথ্য পাওয়া যাবে অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছানোর। এজন্য আপনার সহযোগীতা চাই।
–অবশ্যই। আপনি কোনো চিন্তা করবেননা। আমার পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সহযোগীতা পাবেন, আগেই বলেছি।”
–আপনার ফোনটা দিন, আমার নাম্বারটা সেভ করে দিই। প্রয়োজনে ফোন করতে পারবো।”
রাতুল হাসান নিজের ফোনটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। তারপর আমি আমার নাম্বারটা উনার ফোনে সেভ করে দিলাম, আর উনার নাম্বারটা নিয়ে বেরিয়ে আসলাম থানা থেকে।

রাতে ডিনার সেরে বসলাম মাত্র রুমে। তখন রাতুল হাসানের ফোন পেলাম। ফোন রিসিভ করতেই রাতুল হাসান বললো:
–মি.রানা, একটা দুঃসংবাদ আছে…..”
–কি দুঃসংবাদ?
–ইরার লাশটা চুরি হয়ে গেছে। আমরা আসার আগেই কেউ এসে ওর লাশ তুলে নিয়ে গেছে কবর থেকে…..
–হোয়াট???”

–করার কিছুই নেই মি.রানা। আমি দুঃখিত।” বলেই ফোন কেটে দিলো রাতুল হাসান। আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম কে চুরি করতে পারে লাশটা। একবার কবরস্থানে গিয়ে দেখতে হবে।

দেরি না করেই চলে এলাম কবরস্থানে। আমি আসতে আসতে কবরস্থানটা ফাঁকা হয়ে গেলো। লোকজন, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট কেউ নেই এখন। একপাশে গার্ডের ছোট্ট একটা ঘর দেখা গেলো। আমি ওখানে গিয়ে দরজায় টোকা দিলাম। ভেতর থেকে কারো সাড়া পেলামনা। আরো কয়েকবার টোকা দিলাম দরজায়। একটা মধ্যবয়স্ক লোক দরজা খুলে বের হলো। মনে হয় এতক্ষণ ঘুমিয়েছিল। ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি লোকটার। আমি উনাকে দেখে হাসিমুখে বললাম:
–চাচা, আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
–আসো বাবা, ভেতরে এসে বসো।” চোখ মুছতে মুছতে বললেন লোকটা। উনি আমাকে ভেতরে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন বসার জন্য। আমি ওটাতে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম:
–চাচা কি এতক্ষণ ঘুমায়ছিলেন?”
–আরে নাহ। একটা কাজে দরজা খুলতে দেরি হলো।” বুঝলাম লোকটা কবর পাহারা না দিয়ে ঘুমিয়েছে, এটা ঢাকার জন্য মিথ্যে বলছে।
–তো চাচা, কতদিন ধরে আছেন এই কাজে?”
‘খুক খুক’ করে একবার কেশে গলাটা ঝাকিয়ে নিয়ে লোকটা বললেন:
–আছি প্রায় বছর দুয়েক ধরে…..
–কেন চাচা? এই কবরস্থানে পাহারা দিতে হয় কেন?
–এখানে আগে প্রায় লাশ চুরি হতো। আদমখোররা কবর থেকে লাশ তুলে কলিজা খেয়ে বাকি অংশটা ফেলে চলে যেতো। এইজন্য আমাকে রাখা প্রহরী হিসেবে।
–তো আপনি পাহারা না দিয়ে ঘুমাচ্ছেন কেন?”
–কি যে বলো বাবাজি? কই ঘুমালাম” হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেন উনি আমার কথাটা।
–আচ্ছা বাদ দিন…. তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, আদমখোররা লাশ তুলে কলিজা খেতো, চুরি হতোনা। নাকি চুরিও হতো?
–হ্যা, চুরিও হতো। কিন্তু আমি আসার পর ওসব আর হয়না।” বুকটা টান করে বললেন লোকটা, যেন উনি নিজে একটা বড় কিছু।
–শুনলাম আজ একটা লাশ চুরি হয়েছে এই কবরস্থান থেকে?”
আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন লোকটা আমার দিকে। তারপর গলাটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন:
–পুলিশের লোক?”
–আরে না না, আমি পুলিশের লোক না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।”
–ও আচ্ছা, বাবা তুমি এখন চলে যাও….
–কেন চাচা? আপনি কী জানেন আজকের লাশটা কে চুরি করেছে?
–জানিনা আমি…….”
–চাচা, কোথাও এমনটা নয়তো যে, লাশ চুরিতে আপনারও হাত ছিল?
–কি যা তা বলছো? চলে যাও তুমি এখান থেকে।” লোকটা আমার হাত ধরে তুলতে চাইলেন। আমি বললাম:
–আরে চাচা, কি করছেন? একটু বসেন?” লোকটা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি বুঝলাম সহজে কথা বের করা যাবেনা লোকটার মুখ থেকে। অন্য উপায়ে কথা বের করতে হবে। মানিব্যাগ থেকে একটা ৫০০ টাকার নোট বের করে উনার হাতে দিয়ে বললাম:
–চাচা, এটা রাখুন, একটু শান্ত হয়ে বসুন আপনি।”
টাকাটা হাতে পেয়ে উনার ঘুমের ঘোরটাও কেটে গেলো। লুঙ্গির পেছনে নোটটা গুজিয়ে রেখে হাসিমুখে বসলো লোকটা। তারপর বললো:
–কী যেন বলেছিলে বাবাজি?
–ইরার লাশটা কে চুরি করেছে?
–আমি জানিনা বাবাজি, আমি সন্ধ্যার পর থেকে আজ ঘুমাচ্ছি, পুলিশ এসেছিলো এখানে, তখন আমার ঘুম ভেঙে দিছিলো লোকজন। আমাকে পুলিশ কীসব জিজ্ঞেস করেছিল, ঘুমের জন্য ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারিনি। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবার ঘুমাচ্ছিলাম, এখন তুমি এসে ঘুম ভেঙে দিছো। এর বেশি কিছু জানিনা।”
–কিন্তু, আপনার কাজ তো কবর পাহারা দেওয়া রাতে, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন কেন? –সেটাই তো বুঝতেছিনা। আজ আমার কি হয়ছে আমি নিজেও জানিনা। শুধু ঘুম পাচ্ছে।” বলেই হাই তুললো লোকটা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–মানে? শুধু আজ ঘুম পাচ্ছে? আগে কোনোদিন এরকম হয়নি আপনার?”
–না, আগে কোনোদিন হয়নি। তুমি বাবাজি এখন যাও, আমি একটু ঘুমাবো।”
–আচ্ছা চাচা, শেষ একটা প্রশ্ন……
–আর কোনো প্রশ্ন না, আমি ঘুমাবো। যাও তুমি এখন……”
আমি আরেকটা পাঁচশ টাকার নোট বের করলাম উনার চোখের ঘুম দূর করার জন্য। নোটটা টান মেরে নিয়ে লোকটা বললো:
–কি প্রশ্ন?
–আপনি লাস্ট কখন খাবার খেয়েছেন? কোথায় খেয়েছেন? কী খেয়েছেন?
–মানে? আমার খাবারের সাথে লাশ চুরির কী সম্পর্ক?
–সম্পর্ক আছে। কেউ আপনার খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছে।
–আমি সন্ধ্যায় সামনের একটা চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খেয়েছি। তারপর থেকেই আমার ঘুম পেতে শুরু করেছে।
–সামনের চায়ের দোকান বলতে?
–এখান থেকে বের হয়ে রাস্তার ডানপাশে যে চায়ের দোকানটা আছে, ওখানে একটা ২৫/২৬ বছরের লোক চা বিক্রি করে।
–ওকে চাচা, ধন্যবাদ। আপনি ঘুমান।” বলেই আমি বের হয়ে আসলাম। লোকটা দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি চায়ের দোকানটার পাশে আসলাম। দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ভাগ্য খারাপ। কাল আবার আসতে হবে। করার কিছুই নেই। অগত্যা হোটেলে ফিরে এলাম।

পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে ফোন দিলাম সাবরিনাকে। ও ফোন রিসিভ করতেই বললাম:
–সাবরিনা, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে….
–কী কাজ?” প্রশ্ন করলো ও।
–তোমাকে কবরস্থানে রোডে যেতে হবে একটু…..
–কেন?
–ওখানে একটা চায়ের দোকান আছে, একটা ২৫/২৬ বছরে লোক বসে ঐ দোকানে।
–হুমমম….. চিনি তো….
–ওখানে গিয়ে লোকটার সাথে কথা বলবে।
–কিন্তু কী বলবো?
–লোকটাকে জিজ্ঞেস করবে গতকাল সন্ধ্যায় কবরস্থানের গার্ডের চায়ের কাপে ঘুমের ওষুধ মেশায়ছে কেন?
–হোয়াট?
–যেটা করতে বলছি করো।
–আচ্ছা….
–আর শোনো, বোরকা পরে যাবে, যেন তোমায় চিনতে না পারে….”
–ওকে…..”

সাবরিনার সাথে কথা বলা শেষ করে তারেককে ফোন দিলাম। ফোন দেয়ার সাথে সাথে রিসিভ করলো সে।
–হ্যা রানা, কী অবস্থা তোর?”
–এইতো আছি। অপরাধী ধরা ছোয়ার বাইরে এখনো। ইরার লাশটা চুরি হয়ে গেছে।
–হোয়াট? কীভাবে?
–কবর থেকে ওর লাশ তুলে পোস্টমর্টেম করার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশ ওখানে পৌছার আগেই অন্য কেউ ওর লাশ সরিয়ে ফেলে কবর থেকে।
–কে সরিয়েছে কোনো ক্লু পেয়েছিস?
–অপরাধী পর্যন্ত পৌছানোর একটা ক্লু পেয়েছি। কবরস্থানের গার্ডের চায়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে এই কাজটা করা হয়, আর চায়ে ওষুধ মিশিয়েছে এখানকার এক চা বিক্রেতা। ও হয়তো কারো কথায় এই কাজটা করেছে।
–তো এখন কী করবি?
–লোকটা থেকে কথা বের করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সহজে কথা আদায় না হলে ভয় দেখাতে হবে।
–ওকে, বেস্ট অব লাক। আমিও ছুটি নিয়েছি কয়েকদিনের। আসতেছি তোর কাছে।
–ওকে, আয়…..
–হুমমম….. সাবধানে থাকিস…..”
ফোন কেটে দিলো তারেক। আমি কিছুক্ষণ বসে থাকলাম চুপ করে। তারপর ফোন পেলাম সাবরিনার। ফোন রিসিভ করেই বললাম:
–হ্যা সাবরিনা বলো, কিছু বের করতে পেরেছো লোকটার কাছ থেকে।
–লোকটা তো কিছুই বলতে চাইনা। অস্বীকার করতেছে সব।
–টাকার লোভ দেখাও…..
–সেটাও বাদ রাখিনি। কিন্তু বলতে চাইনা।
–আচ্ছা তুমি চলে যাও বাসায়। যা করার আমি করতেছি।” ফোন কেটে দিয়ে আবার ফোন দিলাম রাতুল হাসানকে। উনি ফোন রিসিভ করে বললেনন:
–হ্যালো মি.রানা….”
–হ্যাঁ মি.রাতুল, আপনার একটা হেল্প লাগবে।
–কী হেল্প?
–একজনকে এরেস্ট করে আমার কাছে নিয়ে আসতে হবে। আমি ঐ লোকটার আর আমার ঠিকানা আপনাকে মেসেজ করে দিচ্ছি…….
–ওকে…..”
ফোন কেটে দিলাম আমি। তারপর চা বিক্রেতা আর আমার ঠিকানা মেসেজ করে পাঠালাম রাতুল হাসানকে।

দুপুরের সময় রাতুল হাসানের ফোন পেলাম। ফোন রিসিভ করে বললাম:
–হুমমম…. মি.রাতুল কি খবর বলুন…… এরেস্ট করছেন ওকে?”
একটু বিরতি নিয়ে রাতুল হাসান জবাব দিলো:
–করেছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য! কেউ আড়াল থেকে গুলি করেছে ওকে। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি এখন।
–হোয়াট? তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান। ওকে বাঁচাতেই হবে। আর ওর মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেন কিনা দেখুন।
–ওর সেন্স নাই এখন। কথা বলতে পারবেনা।
–আচ্ছা, আমিও আসতেছি হাসপাতালে। দেখা হবে ওখানে।” তারপর রাতুল হাসানের কাছ থেকে হাসপাতালের নামটা জেনে নিয়ে ফোন রেখে দিলাম।

লাঞ্চ না করেই বের হয়ে এলাম হোটেল থেকে। বাইকের স্পিড সর্বোচ্চ দিয়ে বাইক ছুটালাম হাসপাতালের দিকে। যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম, তখন রাতুল হাসান অপরাধীর মতো আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর মুখ নিচু করে বললো:
–স্যরি মি.রানা, ওকে বাঁচানো গেলোনা।”
খবরটা শুনবো বলে আশা করিনি আমি। একটা মাত্র পথ খোলা ছিল অপরাধী পর্যন্ত পৌছার, সেটাও এখন শেষ হয়ে গেলো। নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম লাশটার দিকে। নিজের ১২৮০ মডেলের মোবাইলটা হাতে আঁকড়ে ধরেছিল সে মৃত্যুর আগপর্যন্ত। হাতের পাশেই পড়ে আছে মোবাইলটা। ওটা তুলে নিলাম আমি। কিছুক্ষণ চেক করে দেখলাম মোবাইলটা, কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা। তারপর মোবাইলটা রাতুল হাসানের দিকে এগিয়ে দিলাম।
–কী করবেন এখন?” জিজ্ঞেস করলো রাতুল হাসান।
–বুঝতেছিনা এখনো।” বলতে বলতে মোবাইলটা বের করে লাশের কয়েকটা ছবি তুললাম।
–কিছু তো একটা করতেই হবে। অপরাধীকে তো এভাবে ছেড়ে দেয়া যাবেনা।
–অপরাধী পালিয়ে বাঁচতেও পারবেনা। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। আসি….” বলেই বেরিয়ে আসলাম আমি হাসপাতাল থেকে।

হোটেলে এসে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে রুমে এলাম। রুমে এসে বসতেই দরজায় টোকা পড়লো। এখন আবার কে এলো? এতো তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই খাবার আসেনি। দরজা খুলে সাবরিনাকে দেখে অবাক হয়ে বললাম:
–তুমি?
–কেন আসতে পারিনা আমি?
–হুমম…. পারো…. ভেতরে এসো। লাঞ্চ করছো?
–করেই এসেছি।
–তো কী মনে করে এলে?
–লোকটা গুলি খেয়েছে জানো?” চেয়ারে বেডের উপর বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো সাবরিনা।
–হুমমম জানি। হাসপাতালে মারা গেছে লোকটা।” একটা চেয়ারে বসতে বসতে জবাব দিলাম আমি।
–হোয়াট? তাহলে এখন কী হবে?
–কিছুই হবেনা। আমি জানি এর পেছনে কার হাত আছে।
–কীভাবে জানো? চা বিক্রেতা লোকটা তো মারা গেছে কিছুই না বলে।
–ও মরার পর আমাকে অনেক কিছু বলে গেছে…….
–মানে?”
একটা রহস্যময় হাসি দিলাম আমি সাবরিনার কথা শেষ হতেই……

–কী হলো? বলো?” উত্তেজিত হয়ে উঠলো সাবরিনা।
–এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, দাঁড়াও….. তুমি এতক্ষণ আমাকে “তুমি তুমি” করতেছো, তাতো আমি খেয়ালই করিনি। “আপনি” করে বলো।
–বলবোনা “আপনি” করে। “তুমি” করেই বলবো। বলো এবার কি বুঝেছো তুমি?
–উহু….. বলবোনা। আগে “আপনি” করে বলো….
সাবরিনা আমার শার্টের কলার ধরে বললো:
–বলবে কিনা?
–আরে আরে, কী করছো? এমন নাদুসনুদুস চেহারার আড়ালে যে একটা গুন্ডী চরিত্র আছে, জানতামনা তো…..” একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম। সাবরিনা আমার শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে, লাজুক ভাব নিয়ে বললো:
–তাহলে বলো…..
–বলবো তো…. এতো অস্থির হচ্ছো কেন? আরো শিওর হতে হবে আগে আমাকে। তারপর বলবো।
–উফ! আমার তো তর সইছেনা জানার জন্য।
–এক কাজ করো তুমি, জানিনা কাজটা পারবে কিনা…..
–কী কাজ?
–কাজটা খুব কঠিন কিন্তু….
–পারবো আমি, বলো…..
–কাজটা হলো…. তুমি এখন…. তুমি এখন বাসায় চলে যাও……” বলেই বিদ্রূপ করে একটা হাসি দিলাম। সাবরিনার রাগ বেড়ে গেলো। সে আমার শার্টের কলার চেপে ধরলো আবার। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো:
–ইউ…..
–কেন? তুমি আমাকে চেনোনা? আমি রানা…..”
–যাও, চলে যাচ্ছি আমি……” বলেই শার্টের কলার ছেড়ে দিও হনহন করে বেরিয়ে গেলো সে। বুঝলাম রেগে গেছে। কেন জানি ওকে রাগাতে আমার খুব ভালো লাগে। রেগে গেলে ওর সরল চেহারাটা অনেক বেশি সুন্দর দেখায়।

সাবরিনা চলে যাওয়ার পর রুমে লাঞ্চ নিয়ে এলো একজন। আমি লাঞ্চটা সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম চারটার দিকে। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। চোখ মেলতেই শুনলাম কেউ একজন দরজায় টোকা দিচ্ছে। এই সময় তো কারো আসার কথা না, তাহলে কে এলো?
–কে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি। কোনো উত্তর এলোনা। সাবরিনার আসার কথা নয় এই সময়। আর সে এলেও আমার ডাকে সাড়া দিতো। হোটেলের কেউ হলেও সাড়া দিতো। দরজায় আরো কয়েকবার টোকা দিলো ওপাশের আগন্তুক। বুঝলাম বিপদ অপেক্ষা করছে দরজার ওপাশে।

বেড থেকে নামলাম আমি। রুমে হালকা আলো ছিল, জানালার পর্দা টেনে দিয়ে একেবারে অন্ধকার করে ফেললাম রুমটা। তারপর এগিয়ে গেলাম দরজা খুলে দিতে। দরজার লক খুলেই একপাশে সরে দেয়ালে গা ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম আমি। একটা মুখোশ পরা লোক হাতে একটা পিস্তল উঁচিয়ে ধীরে ধীরে দরজা খুললো। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুষি চালালাম আমি আততায়ীর চোয়াল লক্ষ্য করে। হঠাৎ আক্রমণে লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে একহাত চোয়ালে বুলাতে বুলাতে অন্য হাত দিয়ে পিস্তল তাক করলো আমার দিকে। আমি বসে গিয়ে আরেকটা ঘুষি চালালাম ওর পেটে। ও দুহাত দিয়ে পেট চেপে ধরলো। হাত থেকে তার পিস্তল পড় গেলো। পরমুহূর্তেই সে আবার তুলে নিতে চাইলো পিস্তলটা। আমিও ঝাপ দিলাম পিস্তলটা লক্ষ্য করে। দুজনের হাতে লেগে পিস্তলটা অন্ধকারে সরে গেল। তখন লোকটা আমার মুখে একটা ঘুষি মারলো। আমি কিছুক্ষণ অন্ধকার দেখলাম চোখে। নিজেকে সামলাতে সামলাতে লোকটা পালিয়ে গেলো। তারপর আমি লাইট অন করলাম রুমের। একপাশে পড়ে আছে আততায়ীর পিস্তলটা। ওটা তুলে নিলাম হাতে। কিছুক্ষণ মুখে হাত বুলাতে বুলাতে দেখতে লাগলাম পিস্তলটা। মুখটা খুব ব্যথা করতেছে। শালা, আরেকটু আস্তে মারতে পারলিনা ঘুষিটা?

ফার্মেসিতে গিয়ে একটা পেইন কিলার কিনে খেলাম। তখন আমার পাশে কোথা থেকে যেন এসে দাঁড়ালো রাতুল হাসান। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হয়ে সে বললো:
–এ কি মি.রানা, আপনার এ অবস্থা কী করে হলো?
–আর বলবেননা ভাই, ঘুষি খাওয়ার সাধ হয়ছিলো। তাই খেলাম। চলুন রুমে যেতে যেতে কথা বলি।
–চলুন…..”
রাতুল হাসানকে নিয়ে রুমে যেতে যেতে উনাকে সব খুলে বললাম। রুমে এসে পিস্তলটা উনার হাতে তুলে দিলাম। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পিস্তলটা দেখে রাতুল হাসান বললেন:
–ফিঙ্গার প্রিন্ট চেক করে দেখবো?
–কোনো লাভ নেই। আমার আর আপনার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাবেন শুধু। কারণ, আততায়ী মুখোশ আর হাতে গ্লাভস পরে এসেছিলো আমাকে আপ্যায়ন করতে।
–ড্যাম! আচ্ছা, আমি তাহলে পিস্তলটা নিয়ে যাচ্ছি, আপনি সাবধানে থাকবেন।
–হুমমম…. শিওর।”
রাতুল হাসান বেরিয়ে গেলো পিস্তলটা নিয়ে। একা একা রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে ফোন দিলাম তারেককে। ও ফোন রিসিভ করার পর সব খুলে বললাম ওকে। শুনে ও জিজ্ঞেস করলো:
–তুই কী কাউকে সন্দেহ করেছিস?”
একটু বিরতি নিয়ে জবাব দিলাম:
–হ্যা, করেছি। দোস্ত, তুই যতো তাড়াতাড়ি পারিস, চলে আয় এখানে, তোর হেল্প প্রয়োজন আমার। কারণ ইরার হত্যার পেছনে তোদের পুলিশ প্রশাসনও জড়িয়ে আছে।
–মানে? কি বলতে চাস তুই?” তারেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
–মানে তোর ঐ রাতুল হাসান, লোকটাও জড়িত ইরার হত্যার পেছনে।
–হোয়াট!” চমকে উঠলো তারেক।

তারেককে অবাক হতে দেখে বললাম:
–চমকে গেছিস? আসলে এটাই সত্যি। তুই আয় আগে, তারপর সব খুলে বলবো তোকে…..”
–আচ্ছা আমি কাল রওনা দেবো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
–অপেক্ষায় থাকবো। রাখি তাহলে, বাই….” বলেই ফোন কেটে দিলাম।

পরদিন হোটেল থেকে বের হয়ে ইউসুফ খানের বাড়ি এলাম। আমাকে দেখে ইউসুফ খান আর তসলিমা দুজনেই চমকে উঠলেন প্রথমে। তারপর নিজেদের সামলে নিয়ে ওরা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করলেন। ইউসুফ খান জিজ্ঞেস করলেন:
–বাবাজি, তুমি এখনো যাওনি?
–না আঙ্কেল, যাইনি। কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেতে পারিনা।
–কি কাজ?
–আছে একটা কাজ। এ্যানিওয়ে আঙ্কেল, আপনাদের মেয়ে ইরার কবর থেকে তার লাশটা চুরি হয়ে গেছে শুনলাম, আপনাদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখছিনা কেন?”
আমার প্রশ্ন শুনে ইউসুফ খান এবং তার স্ত্রী পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর নিজেকে সামলিয়ে ইউসুফ খান বললেন:
–ওসব ভেবে কি হবে বাবা আর? ইরা তো আর ফিরে আসবেনা আমাদের কাছে।
–তারপরও আঙ্কেল একটা কিন্তু থেকে যায়। মনে হয় আপনারা ইরাকে খুব একটা ভালোবাসতেননা বেঁচে থাকতে।
–না, না, তা হবে কেন? আমরা তো ইরাকে খুব ভালোবাসতাম।” ইউসুফ খান কিছু বলার আগেই তসলিমা খান বললেন কথাটা। স্ত্রীর কথার রেশ ধরে ইউসুফ খান বললেন:
–হ্যা, আমরা তো ইরাকে খুব ভালোবাসতাম।
–খুব ভালোবাসতেন? শুনেছি ইরাকে আপনারা বের হতে দিতেননা, কারো সাথে কথা বলতে দিতেননা।
–ওটা তো আমরা আমাদের মেয়ের ভালোর জন্যই করতাম, যাতে করে ও খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে পারে।

দেখো বাবা, মানুষের চেহারায় তো লেখা থাকেনা কে ভালো, আর কে খারাপ, তাই ইরাকে কারো সাথে মিশতে দিতামনা।”
–ওহ… ইরাকে মনে হয় একটু বেশি ভালোবাসতেন আপনারা। এরকম ভালো যদি আপনাদের দুই মেয়ে ইরিন আর শিরিনকে বাসতেন, তাহলে কেমন হতো?
–মানে? কী বলতে চাও তুমি?” ইউসুফ খান কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলো আমার কথা শুনে।
–মানে কিছুনা, বাদ দিন। আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দিন, শুনেছি জন্মের পর থেকে ইরার কোনো জন্মদিন পালন করা হয়নি, কিন্তু হঠাৎ ওর ২০তম জন্মদিনে এসে কেন আপনারা ওর জন্মদিন পালন করতে চাইলেন? তাও আবার এই বাড়িতে না, ওর জন্মদিন পালন করার জন্য ওকে কোথায় যেন নিয়ে গেলেন, কিন্তু ফিরে আনলেন ওর লাশটা।”
আমার কথা শেষ হতেই তসলিমা খান উঠে ভেতরে চলে গেলেন। উনার মুখে আমি স্পষ্ট রাগ দেখতে পেলাম। ইউসুফ খানও রেগে যাচ্ছে, কিন্তু তা আমাকে বুঝতে দিচ্ছেনা। মুখে একটা কৃত্রিম হাসি এনে তিনি বললেন:
–দেখো বাবাজি, ইরার ইচ্ছেতেই তার এই জন্মদিনটা পালন করা হয়েছে। আর সে চেয়েছিল জন্মদিনটা তার একটা পছন্দের জায়গায় করতে।
–ওটা কোথায়?
–শহর থেকে অনেক দূরে। একটা পাহাড়ি এলাকায়। ওখানে যেতে যেতে ইরার শরীরে জ্বর এসে গেছিল। তারপরও জ্বর নিয়ে সে নাচানাচি করে, সবার সাথে মজা করে, তার শরীরের কন্ডিশন আরো খারাপ হয়ে যায়। রাতে যখন সে ঘুমায়, সকালে আর তার ঘুম ভাঙেনি।
–আপনি বলতে চাইছেন, সামান্য জ্বর নিয়ে নাচানাচি করেছে বলে মারা গেছে সে?
–না, আমি ওটা বলতে চাইনি। কিন্তু মাঝরাতে সে একবার ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল।
–ভয় পেয়েছিল? কেন?
–জানালা দিয়ে নাকি সে অদ্ভুত কিছু দেখেছে। তখন ভাবলাম আমরা জ্বরের ঘোরে হয়তো সে ভুলভাল বকছে, কিন্তু সকালে যখন আমরা তাকে মরা পাই, তখন তার শরীরে বিভিন্ন আঁচড়ের দাগ দেখতে পাই। মনে হয় খারাপ কিছু ওকে রাতে চেপে ধরেছে।
–খারাপ কিছু বলতে? জিন ভূত?
–ঐ ধরণের কিছু। শুনেছি জায়গাটা ভালোনা। ওখানে আগেও অনেকে এভাবে অদ্ভুতভাবে মারা গেছে।
–তো জানতেন যে জায়গাটা ভালো না, ওকে ওখানে নিয়ে গেলেন কেন?
–কী করবো? ও যেতে চাইলো যে? কিন্তু বাবাজি, তুমি এসব জিজ্ঞেস করছো কেন? তুমি আসলে কে?
–ইরার বন্ধু, বলেছি তো……”
–ইরার সম্পর্কে তোমাকে এতো কথা কে বলেছে?
–বাদ দিন ওসব, আমি তাহলে আসি আজ।
–যাবে? আচ্ছা, যাও…..” এতক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন উনি। উঠে দাঁড়ালাম আমি চলে যাওয়ার জন্য, তখন ভেতর থেকে তসলিমা খান এসে, কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললেন:
–বাবাজি, রাতে একবার এসো, তোমাকে ডিনারের দাওয়াত দিলাম।”
–শিওর…. আসবো।” বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। বুঝতে পারলাম ডিনারের দাওয়াত দিয়ে তসলিমা খান হয়তো নতুন কোনো ফন্দি এঁটেছেন। তবে কিসের ফন্দি তা এখনো বুঝতে পারিনি। খাবারে বিষ? না, তা করবেননা, কারণ আমি মারা গেলে, তারা ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে এতে। এতোটা কাঁচা খেলোয়াড় নিশ্চয়ই এই শয়তান দম্পতি নয়। দেখা যাক কী হয়। শুধু নিজেকে একটু সাবধানে রাখতে হবে।

দুপুরে সাবরিনাকে ফোন দিলাম। ও ফোন রিসিভ করতেই জিজ্ঞেস করলাম:
–সাবরিনা, তুমি কোথায়?
–এইতো আছি বাসায়, কেন?
–খেয়েছো?
–না, এখনো খাইনি।
–তাহলে খেয়েদেয়ে একটু আমার রুমে আসো, তোমাকে খাওয়াতে পারবোনা আবার আমি।
–হুহ, আমি যেন তোমার থেকে খাওয়ার জন্য বসে আছি। খেয়েই আসতেছি।
–থাক, আর খেতে হবেনা। আমি অলরেডি তোমার জন্য লাঞ্চ নিয়ে বসে আছি একসাথে খাবো বলে।
–হঠাৎ?
–কথা আছে, চলে এসো……
–ওকে, আসতেছি…….” ফোন রেখে দিলো সাবরিনা। আমি ওয়েট করতে লাগলাম তার জন্য।

সাবরিনা আসার পর দুজনে একসাথে লাঞ্চে বসলাম। খেতে খেতে ও জিজ্ঞেস করলো:
–কী জরুরি কথা বলো?
–ইউসুফ খানদের বাসায় আজ আমাকে ডিনারের দাওয়াত দিছে।
–হঠাৎ ডিনারের দাওয়াত?
–হয়তো আমাকে মারার কোনো ফন্দি করেছে।
–হোয়াট? তুমি যাবে?
–হুমম, যাবো। মরার আগে তোমার সাথে বসে শেষ বারের মতো খেতে ইচ্ছে হলো, তাই ডেকেছি তোমাকে।
–ধ্যাৎ! মজা করোনা তো। তুমি যাবেনা ওখানে।
–কেন? তোমার বুঝি কষ্ট হবে আমি মারা গেলে?
–জানিনা, তোমাকে নিষেধ করছি, যাবেনা ব্যাস!
–যাবো তো আমি, ডিনারের দাওয়াত দিছেনা?
–যদি খাবারে বিষ দেয়?
–দেবেনা। অন্য উপায়ে মারবে। তবে কী উপায় সেটা এখনো আন্দাজ করতে পারছিনা।
–তারপরও যাবে তুমি?
–আমি যে রিস্ক নিতে ভালোবাসি। এ্যানিওয়ে, আমার এক বন্ধু আসবে আজ। ওর সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিবো। আমি যখন ওদের বাসায় ডিনারে যাবো, তখন তোমরা দুজন একসাথে থাকবা। সবকিছু তোমাদের ইনফর্ম করবো আমি। আর তোমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
–আচ্ছা….ঠিক আছে।”

সন্ধ্যার আগেই তারেক এসে পৌঁছেছে। আমি আর সাবরিনা ওকে বাসস্ট্যান্ড থেকে রিসিভ করলাম। সাবরিনার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর রুমে এলাম তিনজন। রুমে এসে তিনজন পরিকল্পনা করতে লাগলাম কীভাবে কী করবো। ওদেরকে বলে দিলাম যেন আমার কাছ থেকে বেশি দূরত্বে না থাকে ওরা।
রাত দশটার দিকে আমরা বের হলাম হোটেল থেকে। সাথে ওয়ালথার আর ড্যাগারটাও নিয়েছি আমি। বিপদের সময় কাজে আসবে। ইউসুফ খানদের বাড়ির কাছাকাছি আসার পর আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। তারেক আর সাবরিনার কানে একটা করে অডিও ডিভাইস লাগিয়ে দিলাম, যাতে ভেতরে আমাদের কী কথা হয়, তা ওরা শুনে। ওদেরকে আড়ালে থাকতে বলে আমি ইউসুফ খানদের বাসায় প্রবেশ করলাম। ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে আমায়, আমি কি দাওয়াত একসেপ্ট না করতে পারি?

ইউসুফ খানদের বাসায় এসে দেখলাম ওরা আমার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে আছে। আমি প্রবেশ করার পর ওরা আমাকে কৃত্রিম হাসিতে অভ্যর্থনা করলো। তারপর সবাই মিলে খেতে বসলাম। খেতে খেতে তসলিমা খানের হাতের রান্নার প্রশংসা করে বললাম:
–বাহ আন্টি, রান্না তো খুব ভালো হয়ছে…..”
–খাও বাবা, পেট ভরে খেয়ে নাও…..” তসলিমা খান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। এমনভাবে কথাটি বললেন উনি, যেন আমি শেষবারের মতো খাচ্ছি, আর কখনো খাওয়ার সুযোগ পাবোনা। উনি মনে হয় আর সবুর করতে পারছেননা। যতো তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো আমি, ততো তাড়াতাড়ি যেন ওদের মুক্তি। আমার কারণে শয়তানের মনে ত্রাস সৃষ্টি হয়, এটা দেখে কেন জানি আমার খুব মজা লাগে। ওদের রাগটা বাড়ানোর জন্য বললাম:
–আন্টি, আপনার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য হলেও আমি আরো অনেক বছর বেঁচে থাকবো। দোয়া করে দেন।
–হ্যাঁ বাবা, দোয়া করি যেন অনেক বছর বেঁচে থাকো।” আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন কথাটি তসলিমা খান। বুঝলাম, কথাটি বলার সময় উনার গলায় ট্রাফিক জ্যামের মতো অবস্থা হয়েছে। ইউসুফ খানও রাগে ফুঁসতেছেন, কিন্তু আমাকে বুঝতে দিচ্ছেননা। চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন উনি। উনার দিকে তাকিয়ে বললাম:
–কী ব্যাপার আঙ্কেল, কোনকিছু নিয়ে টেনশন করতেছেন নাকি? এতো চুপচাপ আছেন যে?
–একটা বিষয় নিয়ে টেনশন করতেছি বাবা…..” মুখ তুলে বললেন ইউসুফ খান।
–কোনন বিষয়?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–আমি যেখানে চাকরি করি, মানে ঐ রেললাইনে, আমাকে একটু যেতে হবে এখন। ওখানকার একজন আমাকে জরুরি ডেকেছে, কিন্তু কেন ডেকেছে বুঝতেছিনা।
–তো গিয়ে দেখেন…..
–মনে হয় আমার চাকরি নিয়ে কিছু বলবে। কয়েকদিন নিয়মিত যেতে পারিনি, তাই হয়তো বরখাস্ত করতে পারে।
–এতো টেনশন করছেন কেন? গিয়ে দেখেন আগে…..
–ভাবছি তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো, তুমি একটু বুঝিয়ে বলবে…..”
এতক্ষণেই বুঝতে পারলাম এরা কোন ফন্দি এঁটেছে আমাকে নিয়ে। ভুলিয়েভালিয়ে রেললাইনে নিয়ে যেতে চাই। তারপর সবার মতো আমাকেও রেললাইনে নিয়ে গিয়ে মারতে চাই। আন্দাজ করলাম আমি, নিশ্চয়ই ইউসুফ খানের লোকজন আগে থেকে রেললাইনে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। দেখি শেষ পর্যন্ত কি হয়। ইউসুফ খান কীভাবে শত্রুকে শেষ করে একটু দেখে আসি। তাই অমত না করে বললাম:
–শিওর আঙ্কেল, চলুন যাওয়া যাক….” বলেই খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। ইউসুফ খানও উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দুজন বের হলাম একসাথে।

গেইট থেকে বের হয়ে হঠাৎ ইউসুফ খানকে জিজ্ঞেস করলাম:
–আঙ্কেল, নাইটগার্ডগুলোকে কি বিদায় করে দিয়েছেন? দেখছিনা যে?
–নাইট গার্ড? কিসের নাইটগার্ড?” অবাক হওয়ার ভান করলেন ইউসুফ খান।
–আমি যখন আপনাদের বাসায় থাকতাম, তখন দেখেছিলাম এখানে। মনে হয় একদিনের জন্য রেখেছিলেন গার্ডগুলো?
–আরে না, তুমি হয়তো ভুল দেখেছো। নাইট গার্ড কেন রাখবো বাসায়?
–আচ্ছা বাদ দিন, চলুন…..” কথা আর বাড়ালাম না। নিরবে অনুসরণ করতে লাগলাম ইউসুফ খানকে।

রেললাইনের কাছাকাছি আসার পর কয়েকজন মুখোশ পরা লোক আমাদের পথ আটকালো। সবার গায়ে একইরকম ড্রেস। এরকম ড্রেস আমি ঐ রাতে ইউসুফ খানের বাসায় গার্ডগুলোর গায়ে দেখেছিলাম, তারমানে এরা ইউসুফ খানের লোক। কিন্তু ইউসুফ খান এমন ব্যবহার করছেন ওদের সামনে, যেন উনি এদের চেনেনই না। উত্তেজিত হওয়ার ভান করে উনি জিজ্ঞেস করলেন:
–কারা তোমরা?”
কালো পোশাকধারী একজন ধমক দিয়ে বললো:
–চুপ কর একদম।”
ইউসুফ খান চুপ হয়ে গেলেন। তারপর ওদের দুইজন উনার দিকে বন্দুক তাক করে উনাকে কোথায় যেন নিয়ে চললেন। আমি বুঝলাম পুরোটাই এক্টিং। আসলে উনি আমার আড়ালে যেতে চাইছেন। বাকিরা সবাই আমার দিকে বন্দুক তাক করে রেললাইনের উপর নিয়ে গেলো। আমাকে সার্চ করে আমার প্রিয় ওয়ালথারটা কেড়ে নিলো একজন। তারপর রশি দিয়ে আমার হাত পা বেঁধে আমাকে রেললাইনের উপর ফেলে ওরা চলে গেলো। আমি ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পেলাম। মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম কবে তারেক সাবরিনা এসে আমাকে বাঁচাবে। কিন্তু ওরা দেরি করতে কেন আসতে? ওরা ধরা পড়েনি তো ওদের হাতে? তাহলে তো আমিও শেষ হয়ে যাবো ট্রেনের নিচে চাপা পড়ে। এদিকে ট্রেন আরো কাছে চলে এলো হর্ন বাজাতে বাজাতে। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললাম মৃত্যুকে বরণ করার জন্য……..

ট্রেনের আওয়াজ আরো কাছে চলে এলো, চোখ বুঝে আমি আন্দাজ করলাম আর হয়তো মাত্র কয়েক হাত দূরে ট্রেনটা, আর হয়তো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাকে শেষ করে দেবে। কিন্তু অনেক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও আমার কিছু হলোনা। চোখ খুলে দেখলাম কিছুটা দূরে থেমে আছে ট্রেনটা। আর একটা লাল কাপড় উড়তেছে ট্রেনের সামনে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। ট্রেন থেকে কয়েকজন লোক নেমে আমার বাঁধন খুলে দিলো, আর তারা জিজ্ঞেস করলো আমার এই অবস্থা কি করে হলো। আমি তাদের বললাম
–“যারা আমার এই অবস্থা করেছে, তাদের কাউকে আমি চিনতে পারিনি। মুখোশ পরা ছিল সবাই।”
এরপর তারা লাল কাপড়টা কীভাবে এলো জিজ্ঞেস করলো। লাল কাপড়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি তাকালাম ট্রেনের দিকে, তারপর আশেপাশে তাকালাম। কোথাও দেখলাম না আর ওটা। আমি লোকগুলোকে বললাম:
–আমি কিচ্ছু জানিনা লাল কাপড়টা কীভাবে এলো আর কীভাবে হাওয়া হয়ে গেল। হয়তো কোনো অলৌকিক ঘটনা এটি….”
লোকগুলো আর কিছু জিজ্ঞেস করলনা, আমাকে সাবধানে থাকতে বলে ট্রেনে উঠে গেলো। আমি ধীরে ধীরে হেটে চলে আসতে লাগলাম রেললাইন থেকে। মনে মনে কৃতজ্ঞ হলাম ইরার প্রতি। আমি জানি, আজ আমি তার জন্য বেঁচে গেছি। তাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার। তাই ডাক দিলাম তার উদ্দেশ্যে:
–ইরা…….
–হুমম….
–থ্যাংকস তোমাকে।
–এমনভাবে বলোনা। জানোই তো আমি তোমার ফ্যান, আমার মৃত্যুরহস্য বের না করে তুমি মরে যাবে এভাবে, তাতো আমি হতে দিতে পারিনা।
–তোমাকে একবার সামনে থেকে দেখতে ইচ্ছে করতেছে।
–এখন না, বলেছি তো যেদিন আমার হত্যার সাথে যারা যারা জড়িত, সবাইকে শাস্তি দিতে পারবে, সেদিন সামনে আসবো আমি।
–আচ্ছা….
–ভালো থেকো।”
ইরার অস্তিত্ব তখন আর পাওয়া গেলোনা।

একটা টেনশন থেকে গেলো। তারেক আর সাবরিনার তো আমাকে বাঁচাতে আসার কথা, তারা এলোনা কেন? ভাবতে ভাবতে চলে এলাম ইউসুফ খানদের বাসায়। গেইটে লক ছিল, তাই দেয়াল টপকে প্রবেশ করলাম ভেতরে। সাবধানে হেটে ইউসুফ খানের বাসার সামনের রুমের কাছে এলাম। ভেতরে কয়েকজনের কণ্ঠ শুনা গেলো। নিজেদের মধ্যে তারা কি নিয়ে যেন আলাপ করতেছে। কানটা খাড়া করলাম ভালোভাবে ওদের কথা শুনার জন্য। ইউসুফ খানের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। উনি হঠাৎ হেসে উঠে বললেন:
–ঐ ছোকরাটা মনে হয় এতক্ষণে ট্রেনের নিচে টুকরো টুকরো হয়ে পিষে গেছে।”
বুঝলাম উনি আমার কথা বলতেছেন। উনার কথা শুনে আরেকজন কর্কশ কণ্ঠের লোক বললেন:
–একটাকে তো শেষ করেছি, কিন্ত বাকি দুইটাকে কী করবো?”
লোকটার কথা শুনে নিশ্চিত হলাম তারেক আর সাবরিনা এদের হাতে বন্দী। আমাকে বাঁচানোর কথা ছিল তাদের, এখন তাদেরকেই বাঁচাতে হবে আমার। কিন্তু তাদেরকে এরা কোথায় আটকে রেখেছে?
ইউসুফ খান তখন কর্কশকণ্ঠী লোকটার উদ্দেশ্যে বললেন:
–শুনো মনসুর, বাকি দুইটাকেও বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা। আজ রাতের মধ্যেই শেষ করে দেবে ওদের। তোমরা এখন যাও, শেষ করো ওদের।
–আচ্ছা ভাই, আমরা যাচ্ছি।” বলেই লোকগুলো উঠে দাঁড়ালো। আমি একপাশে একটা ফুলবাগানে নিজেকে আড়াল করে ফেললাম।

লোকগুলো বের হলো বাসা থেকে। সংখ্যায় ওরা পাঁচজন। ওরা গেইট দিয়ে বের হতেই ইউসুফ খান গেইট লক করে দিলেন। তারপর উনি বাসার ভেতরে চলে গেলাম। আমি আবারো দেয়াল টপকে বের হলাম। পেছন থেকে ফলো করতে লাগলাম ঐ পাঁচজনকে। ওরা একটা সি.এন.জিতে উঠে চলে যেতে লাগলো। আমিও একটা সি.এন.জি ভাড়া করে ওদের পেছনে পেছনে যেতে লাগলাম। প্রায় ৩০ মিনিট পর ওরা নামলো একটা জায়গায়। ওদের কিছুটা দূরে আমিও নামলাম সি.এন.জি থেকে। একটা পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করলো ওরা। ওদের পিছু পিছু আমিও প্রবেশ করলাম, মাঝেমাঝে ওরা পেছনে ফিরে তাকালে আমি লুকিয়ে পড়ি গাছের আড়ালে। বড় একটা গুহার মুখে এসে থামলো ওরা। গুহার মুখে একজন কালো ড্রেস পরা, মুখোশধারী গার্ড বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তার সাথে কি যেন কথা বলে ভেতরে ঢুকে গেলো। আমিও সুযোগ খুঁজতে লাগলাম ভেতরে ঢুকার জন্য। কিন্তু গার্ডটার কারণে পারছিনা। কীভাবে ওকে পথ থেকে সরানো যায় ভাবতে লাগলাম। যেকোনোভাবে আমাকে প্রবেশ করতে হবে ঐ গুহার ভেতর। ওখানেই হয়তো আটকে আছে সাবরিনা আর তারেকে।

পায়ের গোড়ায় বাঁধা ড্যাগারটা খুলে হাতে তুলে নিলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম গার্ডটাকে শেষ করে দেবো……

গার্ডটা এদিক থেকে ওদিকে পায়চারি করছিলো। আর সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম ওকে আক্রমণ করার জন্য…. হঠাৎ দেখলাম গার্ড নিচু হয়ে জুতোর ফিতা ঠিক করতেছে। আমি সাবধানে এগিয়ে গেলাম আরো কাছে। ড্যাগারটা ছুড়ে মারলাম ওর বাহু লক্ষ্য করে। নির্ভুল লক্ষ্যভেদ। ও চিৎকার করে উঠার আগেই আমি ক্ষিপ্রগতিতে ঝাপিয়ে পড়লাম ওর উপর। তারপর মুখটা চেপে ধরে ঘাড়টা বাঁকিয়ে দিলাম। ধপাস করে একটা শব্দ হলো ও পড়ে যাওয়ার। তারপর ওর বাহু থেকে ড্যাগারটা টেনে নিয়ে, অজ্ঞান দেহটা টেনে নিয়ে গেলাম একটা ঝোপের কাছে। শরীর থেকে ওর ড্রেসটা খুলে আমি নিজে পরে নিলাম। তারপর মুখোশটা টেনে দিয়ে বন্দুকটা হাতে নিয়ে ঢুকে পড়লাম গুহার ভেতর। বাহির থেকে এটা গুহা বলে মনে হলেও, ভেতরে বড় কোনো ঘরের মতো। একটা সিড়ি নিচের দিকে চলে গেছে। আমিও একজন গার্ডের মতো নির্ভয়ে নেমে গেলাম সিড়ি বেয়ে। মনে হলো মাটির অনেক নিচে চলে এসেছি আমি। কিছু গার্ডকে দেখলাম আমার মতো পোশাক পরে হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্যিস বাইরের গার্ডের শারীরিক গঠনটা আমার মতো লম্বা ছিল, নয়তো এরা আমাকে দেখেই সন্দেহ করতো।

গার্ডগুলোকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতে লাগলাম নির্ভয়ে ওরা কেউ আমায় সন্দেহ করলোনা। একটা রুমে প্রবেশ করলাম আমি। ওখানে ঐ লোকগুলোকে দেখতে পেলাম, যাদের ফলো করে এলাম আমি। সাবরিনা এবং তারেককে দেখলাম বাঁধা অবস্থায়। তাদের পাশে কালো ড্রেস পরা দু’জন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে। কর্কশ কণ্ঠের লোকটা তাদের আদেশ দিলো তারেক এবং সাবরিনাকে গুহার বাইরে নিয়ে গিয়ে খুন করে মাটি চাপা দিতে। তারপর লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আমাকেও ওদের সাথে যেতে বললো, সাথে আরো দু’জন গার্ডকে নিতে বললো। আমিও নিরবে সম্মতি দিলাম।

আমিসহ আরো চারজন গার্ড মিলে তারেক এবং সাবরিনাকে নিয়ে বের হলাম গুহা থেকে। তারপর ওদের নিয়ে চললাম গভীর জঙ্গলের দিকে। বাকিদের উদ্দেশ্য ওদের খুন করে মাটি চাপা দেওয়া হলেও, আমার উদ্দেশ্য গার্ডগুলোকে শেষ করে ওদের বাঁচানো।

গভীর জঙ্গলে নিয়ে আসলাম ওদের। ওদের খুন করার আগে একজন গার্ড হঠাৎ বলে উঠলো:
–খুন করার আগে মেয়েটাকে নিয়ে একটু এনজয় করলে কেমন হয়? মেয়েটার যা রূপ…..”
ওর কথা শুনে বাকি তিনজন বললো:
–হ্যা, আমাদের মনের কথাটিই বলেছো। তাহলে আর দেরি কেন?” ওদের কথা শুনে সাবরিনা নিরহ দৃষ্টিতে তাকালো ওদের দিকে। কিছুই বলতে পারলোনা ও। কারণ মুখে টেপ লাগানো ছিলো।
প্রথম গার্ডটা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বললো:
–তুমি কিছু বলবেনা?”
আমি বললাম:
–আরে আমারো তো একই ইচ্ছে। মেয়েটার রূপ তো শুরু থেকেই আমার মাথা খারাপ করে দিছে।” আমার কথা শুনেই সবাই হেসে উঠলো। তারেক এবং সাবরিনা ক্ষপ্রগতিতে তাকালো আমার দিকে। আমার কণ্ঠ শুনেই চিনতে পেরেছে ওরা। দুজন একসাথে উপরের দিকে তাকালো। হয়তো আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হলো তারা আমার উপস্থিতি ঠের পেয়ে।

দুজন গার্ড সাবরিনাকে ধরে মাটিতে শুইয়ে চেপে ধরলো। বন্দুক দুইটা মাটিতে রাখলো তারা। আমি হাতে তুলে নিলাম বন্দুক দুইটা। ওদের বাকি দুই গার্ড বন্দুক হাতে অপেক্ষা করতে লাগলো কবে তাদের পালা আসবে সাবরিনাকে নিয়ে এনজয় করার। ওদের পালা আর আসবেনা। এক্ষুণি পাঠিয়ে দেবো জমের বাড়ি। তখন গুহার বাইরের গার্ডটাকে গুলি করিনি শব্দ হওয়ার ভয়ে। এখন এদের গুলি করলেও শব্দ হওয়ার ভয় নেই। কারণ গুহায় যারা আছে তারা শব্দ শুনে ভাববে তারেক এবং সাবরিনাকে গুলি করা হয়েছে। আমি দুইহাতে দুইটা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন গার্ডকে একসাথে গুলি করলাম, তারপর ঘুরে বন্দুকের বাড়ি মারলাম সাবরিনাকে জবরদস্তি করা দুইগার্ডের মাথায়। ওরা মাথায় হাত চেপে ধরে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। একজনকে গুলি করলাম আমি। অন্যজন তখন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো:
–কে তুমি?”
আমি মুখোশটা খুলে বললাম:
–মরার আগে আমার চেহারাটা দেখে নে।”
–প্লিজ, মেরোনা আমাকে।”
–কেন? একটু আগে তো আমার বন্ধুদের মারতে চেয়েছিলি। এখন তোকে বাঁচিয়ে রাখবো কেন? তাছাড়া তোমার তিনজন সঙ্গী অলরেডি উপরে চলে গেছে, তুমিও ওদের সঙ্গী হও।” বলেই আর দেরি করলামনা। গুলি করলাম ওর বুকে। একটা আর্তনাদ বের হলো ওর মুখ থেকে। তারপর মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তারপর আমি তারেক এবং সাবরিনার মুখ থেকে টেপ নিয়ে ফেললাম। দুজনে খুশি হয়ে ধন্যবাদ দিলো। ড্যাগার দিয়ে ওদের বাঁধন কেটে দিতেই দুজনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো একসাথে। তারেক বললো:
–আমি জানতাম রানা, তুই আসবি আমাদের বাঁচাতে।”
আমি তাদের বললাম:
–এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা। ওরা ঠের পেয়ে যেতে পারে। চলো এখন ফেরা যাক……”
–হুমমম…. চলো….”
তারপর তিনজন একসাথে জঙ্গল থেকে বের হয়ে এলাম।

সাবরিনাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি আর তারেক গেলাম গোরস্থানে। ওখানকার প্রহরীটা তখন কবরগুলো পাহারা দিচ্ছিলো। উনার কাছে যেতে যেতে উনার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলাম:
–চাচা, কেমন আছেন?”
লোকটা প্রথমে আমাকে চিনতে পারেনি। পরে আমার মুখে টর্চের আলো ফেলে চিনতে পেরে বললো:
–ভালো আছি বাবা, কিন্তু তোমার গায়ে এই পোশাক?
–কেন চাচা? এই পোশাকে কোনো সমস্যা?
–না আসলে, এইরকম ড্রেস পরা একজনকে দেখেছিলাম এখানে ঐদিন..
–কোনদিন?
–যেদিন লাশ চুরি হয়। আমি ঐদিন সন্ধ্যায় চায়ের দোকান থেকে ফেরার সময় এখানে তাকে এখানে ঘুরতে দেখেছিলাম, আমার খুব ঘুম পাচ্ছিলো তখন, তাই বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি।
–লোকটা একা ছিল? নাকি সাথে আরো কেউ ছিল?
–সাথে আরো দু’জন ছিল, চেহারা খেয়াল করিনি।
–তাদের গায়েও কি এইরকম পোশাক ছিলো?
–নাহ, এরকম পোশাক ছিলনা তাদের গায়ে।
–তারমানে ঐ দুজনই লাশ চোর। চাচা, আমার সাথে যাকে দেখতে পাচ্ছেন, ও একজন পুলিশ অফিসার। আপনি কোনো ভয় পাবেননা, সব সত্যি খুলে বলুন।
–সত্যি আমি আর কিছু জানিনা বাবা।
–আচ্ছা এটা বলুন, আপনি কি কোনো লাশ চোরের সন্ধান জানেন?
–তেমন কারো সাথে পরিচিত না, তবে রেললাইনে ধারে কিছু লোক ঘুরাফেরা করে, তারা মদ খাওয়ার টাকার জন্য এরকম কাজ করতে পারে।
–ওকে চাচা, ধন্যবাদ।” বলেই আমরা চলে আসার জন্য ঘুরলাম। তখন প্রহরী পেছন থেকে বললো:
–আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছি আমি…..”
–কোন ব্যাপার?” প্রহরীর দিকে আবার ঘুরে প্রশ্নটা করলাম।
–বলবো…. কিন্তু…..” প্রহরী নিচের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। বুঝলাম, টাকা হাতে ধরিয়ে না দিলে কথাটা উনার গলা বেয়ে বের হবেনা। তাই একটা ১০০ টাকার নোট বের করে উনার হাতে দিয়ে বললাম:
–চাচা, আজ এইটা রাখেন। দেখতেছেন তো আমাদের কী অবস্থা?”
–আচ্ছা ঠিক আছে, বলছি…. ঐদিন আমি এরকম ড্রেসে যাকে দেখেছি, সে তোমার মতো লম্বা।”
–ধন্যবাদ চাচা। এই তথ্যটাই আমার প্রয়োজন ছিল। আসি তাহলে।” বলেই তারেককে নিয়ে চলে আসতে লাগলাম। তারেক জিজ্ঞেস করলো:
–লম্বা লোকটাকে তুই চিনিস নাকি?
–হ্যাঁ চিনি, গুহার মুখে পাহারা দিচ্ছিলো। তাকে একেবারে না মেরে ভালোই করেছি।
–এখন তাহলে কী করবি?
–গুহার ঐ গার্ডটাকে তুলে আনবো।
–মানে ঐ জঙ্গলে আবার যেতে চাস?
–যেতে তো অবশ্যই চাই। না গেলে কি হয় বন্ধু?
–এই জন্যই তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর সাহস দেখে মাঝেমাঝে তোকে স্যালুট করতে ইচ্ছে হয়।
–স্যালুট পরে করিস। আগে রুমে চল, রাত অনেক হয়েছে।
–আচ্ছা চল…..” দুজনে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম।

পরদিন সকাল সকাল সাবরিনা এসে হাজির আমার রুমে। তখন আমি আর তারেক মিলে ব্রেকফাস্ট করতেছিলাম। সাবরিনাকে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম:
–তোমাদের বাসায় বুঝি ব্রেকফাস্ট বানায়না, তাই এখানে এসেছো?
–মোটেওনা, আমি ব্রেকফাস্ট সেরেই এসেছি। তোমার ব্রেকফাস্টে ভাগ বসানোর কোনো ইচ্ছে নেই।
–তুমি চাইলেও দেবোনা।”
–হুহহ, লাগবেনা।” মুখটা বাঁকিয়ে বসে পড়লো সে আমার পাশে। তারেক হেসে বললো:
–কি হচ্ছে রানা এসব? বেচারিকে আর কতো লজ্জা দিবি?”
নিজের প্রতি তারেকের সাপোর্ট পেয়ে সাবরিনা বললো:
–হুমমম ভাইয়া, কিছু বলেন আপনার বন্ধুকে। সবসময় আমার সাথে এরকম করে।
–আচ্ছা স্যরি, আর করবোনা, এই আমি কান ধরলাম।” বলতে বলতে একহাতে সাবরিনার কান ধরলাম। ও আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো:
–হুহ, আমার কান ধরছো কেন?
–কান যেকোনো একজনের ধরলেই তো হয়ছে। যাকগে, তারেক তোকে একটা কথা বলি….
–কি কথা?” আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো তারেক। আমি বললাম:
–এই যে এই মেয়েটা, মানে সাবরিনা আমার প্রেমে পড়েছে….”
আমার কথা শেষ হতেই সাবরিনা বললো:
–ঐ এখনো পড়িনি…..”
তার কথার সাথে তাল মিলিয়ে আমি বললাম:
–হ্যাঁ ও এখনো প্রেমে পড়েনি, তবে পড়বে…..”
সাবরিনা তখন রেগে উঠার ভান করে বেড থেকে বালিশটা নিয়ে আমাকে মারতে লাগলো, একই সাথে বলতে লাগলো:
–ঐ বান্দর, শয়তান, হনুমান, কলাগাছ, পঁচা পানি…… আজ তোমাকে ছাড়বোনা।”
আমি হাত দিয়ে বালিশটা ধরে বললাম:
–হয়ছে হয়ছে, আর করবোনা, আর করবোনা।
–হুমমম, মনে থাকে যেন।” বলেই বেডের উপর বালিশটা রেখে দিলো। আমি তখন আবার বললাম:
–তুমি যে আমাকে রাত তিনটায় কিডন্যাপ করে প্রেম করতে নিয়ে গিয়েছিলে এটা কিন্তু তারেককে বলিনি, কখনো বলবোও না।”
–আবার???” বলেই সাবরিনা বালিশটা নিতে চাইলো, আমি তার হাতটা চেপে ধরে, এক টুকরো পরোটা তার মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর বললাম:
–তোমাকে ব্রেকফাস্ট করালাম। আর রাগ দেখাতে হবেনা।”
সাবরিনা তখন পরোটার টুকরোটা খেতে খেতে মুখে হাসি নিয়ে আমার বাম কানটা আলতো করে টেনে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো:
–আজ কী কী করবে?
–আজ তোমার কোনো কাজ নেই, তুমি বাচ্চা মেয়ে। সন্ধ্যার দিকে আমি আর তারেক আবার যাবো ঐ জঙ্গলে।
–না না, তা হবেনা। আমিও যাবো, আমিও যাবো তোমাদের সাথে।” সাবরিনা বাচ্চা মেয়ের মতো আবদার করতে লাগলো। আমি তারেকের দিকে তাকিয়ে বললাম:
–বলছিলাম না ও বাচ্চা মেয়ে, আচ্ছা দোস্ত তুই বল, ওকে কি আমাদের সাথে নেয়া যাবে।”
সাবরিনা গলার জোর বাড়িয়ে বললো:
–না না, আমি যাবো। তারেক ভাইয়া আপনি কিছু বলুননা আপনার এই বন্ধুটাকে।
–আচ্ছা ঠিক আছে, তুমিও যাবে আমাদের সাথে।”
তারেকের কথা শুনে সাবরিনা খুশিতে “ইয়ে” বলে চিল্লায় উঠলো। তারপর বালিশ নিয়ে আবার আমাকে মারতে লাগলো।
সন্ধ্যার সময় তিনজনে আমরা তিনজনে রেডি হয়ে বের হলাম। সাথে গতরাতে জব্দ করা বন্দুকগুলোও নিলাম। তারপর বাইকে উঠে তিনজন রওনা দিলাম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। যেভাবে হোক ঐ লম্বা গার্ডটাকে তুলে আনতে হবে আজ…..

জঙ্গলের কাছাকাছি এসে বাইকটা একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখলাম, যাতে কারো নজরে না পড়ে। তারপর তিনজনে গেলাম জঙ্গলের ভেতরে। দূর থেকেই দেখলাম গুহার বাইরে আজ অনেকগুলো গার্ড পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু লম্বা কাউকে দেখলাম না। তারমানে গতকাল তাকে যেভাবে জখম করেছি, সে নিশ্চয়ই কোনো হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে এখন। এখন কোনো হাসপাতালে খুঁজতে হবে তাকে।

জঙ্গল থেকে আবার বেরিয়ে পড়লাম আমরা। তারপর সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে গেলাম খোঁজ করার জন্য। ভেবেছিলাম রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করবো হাতের বাহুতে জখম হওয়া কোনো রোগী ভর্তি হয়েছে কিনা। কিন্তু তা আর জিজ্ঞেস করতে হলোনা। দেখলাম মনসুর নামের সেই কর্কশ কণ্ঠের লোকটার সাথে বের হচ্ছে লম্বা লোকটা। আমরা তিনজন তখন আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। ওরা বের হওয়ার পর আমরাও পিছু নিলাম ওদের।

একটা প্রাইভেট কারে উঠলো দুজন। মনসুর নামের লোকটা ড্রাইভিং সিটে বসলো। তারপর জঙ্গলের পথে যেতে লাগলো ওরা। আমরাও বাইকে করে ফলো করতে লাগলাম। জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই সিদ্ধান্ত নিলাম, বাইক নিয়ে কারটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। এই জায়গাটিতে লোকজন নাই। এইটাই মোক্ষম সময়। তারেক এবং সাবরিনাকে বললাম, বাইক নিয়ে কারটার সামনে দাঁড়াতেই যেন বন্দুক তাক করে ওদের দিকে।

বাইকের গতি হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়ে কারটার কিছুটা সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাথে সাথে ওদের দিকে বন্দুক তাক করলো সাবরিনা এবং তারেক। কারটা থেমে গেলো। আমরা তিনজন কাছে যেতেই ওরা চমকে উঠলো। ভয়ে ভয়ে মনসুর নামের লোকটা বললো:
–তোমরা? কী চাও এখানে?
–চুপচাপ যেরকম আছো সেরকম বসে থাকো গাড়িতে।” গলার জোর বাড়িয়ে বললাম।
–দেখো, তোমরা কিন্তু ভালো করছোনা। খুব খারাপ অবস্থা হবে তোমাদের।
–একবার তো মেরে ফেলতে চেয়েছিলি। কিন্তু পারলিনা। আর কী খারাপ অবস্থা করবি? চুপচাপ গাড়ি যেদিকে নিয়ে যেতে বলবো সেদিকে নিয়ে চল।” বলেই কারে উঠে পড়লাম আমি, সাবরিনাও উঠে বাসলো। পেছন থেকে আমরা দুজন ওদের দুজনকে বন্দুকের মুখে রাখছি। তারপর আমরা যেদিকে যেদিকে যেতে বলছি, মনসুর সেদিকে গাড়ি চালাচ্ছিলো। আর আমাদের পেছন পেছন বাইক নিয়ে আসতেছিলো তারেক।

যেতে যেতে সাবরিনার উদ্দেশ্য হঠাৎ বললাম:
–সাবরিনা, এদের নিয়ে হোটেলে যাওয়া ঠিক হবেনা, কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?
–কোনো বাসা ভাড়া করা যেতে পারে…..
–নাহ, তাও ঠিক হবেনা।
–তাহলে?
–নির্জন কোনো জায়গা….”
কিছুক্ষণ ভেবে সাবরিনা বললো:
–একটা জায়গা অবশ্য আছে। পরিত্যক্ত এক প্রাসাদ। তবে শুনেছি ওটাতে খারাপ আত্মা ঘুরে বেড়ায় রাতের বেলায়।
–তাহলে ওখানেই যাবো।
–না বাবা, আমি ওসব খারাপ আত্মা ভয় পাই। আমি যাবোনা।
–তোমাকে ওখানে একা রেখে চলে আসবো।
–না না, প্লিজ……
–চুপ করে পথ দেখাও…….
–আচ্ছা, কিন্তু আমি থাকবোনা ওখানে, বলে দিলাম……” বলতে বলতে সাবরিনা পথ দেখালো। আর মনসুর তার নির্দেশনা অনুযায়ী গাড়ি চালাতে লাগলো।

শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আরেকটা জঙ্গল ঘেরা পরিবেশে এসে হাজির হলাম আমরা। পুরানা আমলের একটা প্রাসাদ দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢুকলাম আমরা সবাই। মনে হয় অনেক বছরের পরিত্যক্ত প্রাসাদ এটি। ভেতরে ঢুকে লাইট অন করতেই বুঝলাম, যিনি এই প্রাসাদটি বানিয়েছিলেন, তিনি অনেক শৌখিন ছিলেন। সুন্দর কারুকাজ করা ভেতরে। অনেকদিন আলো বাতাস প্রবেশ না করায় একটা ভ্যাপসা গরম অনুভব করলাম। একটা রুমে প্রবেশ করলাম আমরা। তারপর কিডন্যাপ করা দুই ব্যক্তিকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধলাম। ওদের সামনে বসলাম আমি, তারেক আর সাবরিনা। মনসুর আর তার সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, খুব ভয় পেয়েছে দুজনে। মনসুর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো:
–আমাদের কেন ধরে এনেছো তোমরা?”
আমি তার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলাম:
–আপাতত মুখটা বন্ধ রাখো তুমি। তোমার সঙ্গীকে কিডন্যাপ করতে গেছিলাম আসলে, সাথে তুমি ছিলে, তাই তোমাকেও ধরে আনলাম।”
আমার কথা শুনে লম্বা লোকটা কাঁপা গলায় বললো:
–আমাকে? আমি আবার কী করলাম আপনার?
–নাম কী তোমার?” লম্বা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম।
–সবুজ…..
–তা মি.সবুজ, কবরস্থানে ইরার লাশটা চুরি করতে গেছিলে কেন?
–আমি চুরি করিনি। আমি শুধু দেখিয়ে দিছি কবরটা।
–আচ্ছা, কার কথাতে তুমি এটা করেছো?
–মনসুর ভাইয়ের কথায়।” বলার সময় মুখ দিয়ে ইশারা করে মনসুরকে দেখিয়ে দিলো সবুজ। মনসুর তখন অবাক হয়ে বললো:
–আমার কথায় মানে? আমি তো লাশ চুরির ব্যাপারে কিচ্ছু জানিনা। ও মিথ্যে বলছে।
–ছিঃ মনসুর ভাই, আপনি এটা কী বললেন? মিথ্যে বলবো কেন? আপনিই তো আমাকে একটা চিরকুট দিয়ে বলেছিলেন, ইরার লাশটা কবর থেকে সরিয়ে ফেলতে।
–চিরকুট মানে? সবুজ তুই কিন্তু আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিস? কিসের চিরকুট? আমি তো তোকে কোনো চিরকুট দিইনি?”
দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ বাড়াবাড়ি চললো এটা নিয়ে। তখন আমি বললাম:
–দুজনে থামো। সবুজ, চিরকুটটা এখন কোথায়?
–আমার প্যান্টের পকেটে আছে। নিজ চোখে দেখতে পারেন।”
আমি সবুজের পকেট থেকে চিরকুটটা বের করে পড়লাম। ওখানে লেখা ছিল:
**সবুজ, আজ সন্ধ্যার পর যেকোনো ভাবে ইরার লাশটা কবর থেকে সরিয়ে ফেলবে। ইতি মনসুর**
মনসুর তখন গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললো:
–খোদারকসম এটা আমি দিইনি। এটা আমার হাতের লেখা না।”
আমি সবুজকেকে জিজ্ঞেস করলাম:
–এটা তুমি কীভাবে পেয়েছো?
–আমি ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম থেকে উঠেই এটা পাই পাশে।”
–মনসুর কি তোমাকে কোনোদিন চিরকুটের মাধ্যমে কোনো আদেশ করেছিল?
–না তো….
–তোমাকে “তুই” করে বলতো নাকি “তুমি” করে বলতো?
–তুই করে…..
–কিন্তু চিরকুটে তো “তুমি” করে বলা আছে?
–তাহলে কে দিলো আমাকে চিরকুটটা?” অবাক হলো যেন সবুজ।

চিরকুট কে দিয়েছে এটা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। আগে জানা দরকার ইরার লাশটা কোথায়। সবুজকে জিজ্ঞেস করলাম:
–ইরার লাশটা এখন কোথায়?”
সবুজ জবাব দিলো:
–লাশটা তো আমার সাথে যে ছিলো ও নিয়ে গেছে।
–তোমার সাথে কে ছিলো?
–রেল স্টেশনের এক লোক। সে ওখানে সবসময় মদের বোতল নিয়ে থাকে। মদখোর কালাম বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।
–আচ্ছা, তোমরা তাহলে এখানেই থাকো আপাতত। তোমাদের ছাড়া যাবেনা। আর তারেক, তুই এদের পাহারা দে, আমি সাবরিনাকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।” শেষের কথাটা তারেকের দিকে তাকিয়ে বললাম। ও নিরবে সায়য় দিলো। এরপর আমি আর সাবরিনা। বেরিয়ে আসলাম ঐ প্রাসাদ থেকে।

সাবরিনাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি রেলস্টেশনে গেলাম। আমার হাতে একটা মদের বোতল। হয়তো এই মদের বোতল দিয়েই বশ করা যাবে মদখোর কালামকে। খুব সহজেই পেয়ে গেলাম আমি তাকে। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই বেরিয়ে আসলো মদখোর কালামের সন্ধান। একটা পিলারে হেলান দিয়ে সে মদের খালি বোতলে মুখ লাগিয়ে মদ খাওয়ার চেষ্টা করতেছিলো। বোতলে যে মদ শেষ, সেদিকে তার খেয়াল নেই। আমি তার পাশে গিয়ে বসতেই, সে আমার দিকে নজর না দিয়ে, আমার হাতের বোতলটার দিকে তাকালো। বুঝলাম আমি এটা দিয়েই কাজ হবে। কালামকে জিজ্ঞেস করলাম:
–চলবে এটা?”
কালাম মুখে একটা হাসি দিয়ে আমার হাত থেকে বোতলটা নিতে চাইলো। আমি বোতলটা সরিয়ে নিয়ে বললাম:
–এটা তোমাকে দেবো, তার আগে তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।”
এবার কালাম আমার দিকে তাকালো। মাতাল হয়ে সে বললো:
–যেখানে নিয়ে যাবেন যাবো। শুধু এই মালটা আমায় দেন।”
–আচ্ছা, চলো তাহলে….”
কালামকে নিয়ে বাইকে উঠে বসলাম। তারপর আবার জঙ্গলের সেই প্রাসাদের দিকে যেতে লাগলাম। যাওয়ার সময় কিছু বাজার করে নিলাম খাওয়ার জন্য।

প্রাসাদে ফিরেই প্রথমে কালামকে গোসল করিয়ে নিলাম, যাতে তার মাতলামি ছুটে যায়। তারপর তাকে একটা ড্রেস পরতে দিলাম। অনেক পুরোনো ড্রেস, প্রাসাদেই ছিলো। মনে হয় এই প্রাসাদের মালিকের ড্রেস এটা। তাদের আরো ব্যবহারের জিনিস এই প্রাসাদে পড়ে আছে। কালামকে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতে বলে আমি আর তারেক মিলে রান্না শুরু করলাম। ঘণ্টাখানেক সময় লাগলো রান্নার কাজটা শেষ হতে। তারপর সবাই মিলে খেতে বসলাম। মনসুর এবং সবুজের বাঁধনটা খুলে দিলাম, শুধুমাত্র খাওয়ার সময়টুকুর জন্য।

খাওয়া শেষে ওদের দুজনকে আবার বেঁধে রাখলাম। ততক্ষণে কালামের মাতলামিটাও ছুটে গেছে। আমি আর তারেক ওকে অন্যরুমে নিয়ে গিয়ে ইনভেস্টিগেশন শুরু করলাম। প্রথমেই আমার প্রশ্ন ছিলো এরকম:
–কালাম, তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো, তুমি ঠিকঠাক উত্তর দিবে তো?”
কালাম স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো:
–কী প্রশ্ন?”
এবার তারেক বললো:
–যা প্রশ্ন করা হবে, তার উত্তর ঠিকঠাক দেবে, নয়তো তোমার বিপদ হতে পারে। এমনকি তোমার মৃত্যুও হতে পারে।”
তারেকের কথা শুনে কালাম কিছুটা ভয় পেয়ে বললো:
–আচ্ছা, আমি যা জানি বলবো।
–কিছুদিন আগে তুমি একটা লাশ চুরি করেছিলে?” প্রশ্নটা করলো তারেক সরাসরি কালামের দিকে তাকিয়ে। কালাম জবাব দিলো:
–হ্যাঁ চুরি করেছি। মদের পেলে আমি সব করতে পারি। সবুজ ভাই আমাকে অনেকগুলো মদের বোতল দিয়েছিলো, তাই তার কথায় আমি লাশটা চুরি করি।
–লাশটা এখন কোথায়?” প্রশ্ন করলাম আমি।
–সাগরে ভাসিয়ে দিছি।
–হোয়াট!” ওর কথা শুনে চমকে উঠলো তারেক। কিন্তু আমার মাঝে কোনো পরিবর্তন হলোনা। কালামকে আবার জিজ্ঞেস করলাম:
–তুমি নিজের ইচ্ছেতে সাগরে ভাসিয়ে দিছে? নাকি সবুজ তেমাকে বলেছিলো?
–সবুজ ভাই বলেছিলো।
–ইরার লাশটা পঁচে যায়নি তখন?
–না ভাই, একদম তরতাজা লাশ। একটুও পঁচেনি। আমি তো অবাক হয়েছিলাম লাশটা দেখে, কবরে এতদিন থাকার পরেও তার লাশ এমন তরতাজা থাকে কী করে।
–শুনেছি প্রকৃত বিচার না পেয়ে যাদের লাশ কবরে যায়, তাদের ডেডবডি এমনি হয়, ইরার লাশটা হয়তো….. বাদ দাও, এখন বলো, এই লাশ চুরির ব্যাপারে তোমার সাথে আর কে কে যোগাযোগ করেছিলো।
–আর কেউ না, শুধু ঐ সবুজ ভাই।
–আচ্ছা, তুমি তাহলে এখানেই থাকো।
–ঠিক আছে ভাই, কিন্তু আপনারা কারা? আর ঐ লাশটা কার ছিলো?”
কালামের প্রশ্নের জবাবে তারেক বললো:
–আমরা আইনের লোক, আর ঐ লাশটা ছিলো এক অভাগা মেয়ের, যে পৃথিবীতে কোনো সুখ পাইনি, কবরে গিয়েও শান্তি পাচ্ছেনা, এখন কবর থেকে সাগরে ভাসতেছে।
–আমি দুঃখিত ভাই, মদের নেশায় আমি এসব করেছি, আজ থেকে আমি ভালো হয়ে যাবো। মদ খাওয়াটাও ছেড়ে দেবো।
–আচ্ছা কালাম, তুমি তাহলে এখানেই থাকো এখন। আমরা না বলা পর্যন্ত যাবেনা। ঘুমিয়ে পড়ো আজকের মতো।
–ঠিক আছে ভাই।” মাথা নিচু করে বললো কালাম। তারপর ওকে ঐ রুমে রেখে আমি আর তারেক গেলাম অন্য আরেকটা রুমে। বিশাল প্রাসাদজুড়ে রুমের কোনো অভাব নেই।
বেডটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে আমি আর তারেক বসলাম, তারেক হঠাৎ প্রশ্ন করলো:
–এখন কী হবে?
–কেন?
–ইরার লাশটা তো পেলামনা। পোস্টমর্টেম তো করা হলোনা আর।”
তারেকের কথা শুনে আমি রহস্য করে একটা হেসে দিলাম। আমার হাসি দেখে সে বললো:
–আমার টেনশন হচ্ছে আর তুই হাসছিস? আমি না মাঝেমাঝে তোকে চিনতে পারিনা, এই মুহূর্তে তুই স্বাভাবিক আছিস কী করে? অথচ আমার কতো টেনশন হচ্ছে দেখ।”
তারেকের কাঁধে হাত রেখে বললাম:
–টেনশন করিসনা বন্ধু, টেনশন করিসনা, দাবার চালটা এবার অন্যভাবে চালতে হবে।” বলেই আবার রহস্য করে হাসলাম। তারেক বললো:
–আর রহস্য করিসনা তো, কী করতে চাইছিস খুলে বল……
–পত্রিকায় একটা নিউজ ছাপাতে দেবো ইরার লাশ নিয়ে।
–কিরকম নিউজ।
–শিরোনাম থাকবে এরকম: *সাগর থেকে এক যুবতী মেয়ের লাশ উদ্ধার*
–তাতে কী হবে?
–কী হবে? আগে পুরোটা শুন, বিস্তারিতের মধ্যে বলা থাকবে, “লাশটা একটা হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে এখন, ধারণা করা হচ্ছে কয়েকমাস আগে মৃত্যু হয়েছে তার।” এই নিউজটা পাওয়ার পর অপরাধীর মনে ভয় ঢুকে যাবে, সে কোনো না কোনোভাবে হাসপাতালের মর্গে যাবে লাশটা চুরি করার জন্য, তখন আমরাও উৎপেতে থাকবো তাকে ধরার জন্য।”
আমার কথা শুনে তারেকও হেসে ফেললো। আমার কাঁধ চাপড়াতে চাপড়াতে সে বললো:
–গ্রেট আইডিয়া!”
আমি মুখে হাসি নিয়ে বললাম:
–ওকে দোস্ত, এবার তাহলে ঘুমিয়ে পড়।”
–আচ্ছা……..”
তারেকটা আরেকটা রুমে চলে গেলো ঘুমানোর জন্য। আমিও লাইট অফ করে। ঘুমিয়ে পড়লাম। মধ্যরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলো কিছু একটার শব্দে। শব্দটা আবার শুনতে চেষ্টা করলাম। মনে হলো ছাদে কেউ হাটতেছে। আমি লাইট জালিয়ে বের হলাম রুম থেকে। তারপর সবাই আছে কিনা দেখলাম। সবাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু কালামকে কোথাও দেখতে পেলামনা। সিড়ি বেয়ে ছাদের দিকে উঠতে লাগলাম, তখন সিড়িতে তাজা রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম আমি। তারপরও ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম ছাদে। ছাদে উঠার পর দেখলাম, কেউ একজন জমিদারের মতো ছাদে পায়চারি করতেছে। মাথায় একটা মুকুট, গায়ে চাদর জড়ানো তার। দেখে আমি অবাক হলাম। কে এই লোকটা? এতো রাতে এখানে কী?

আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম লোকটার দিকে। পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলাম:
–কে আপনি?”
লোকটা ঘুরে তাকালো আমার দিকে। সাথে সাথে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম:
–কালাম তুমি? আর তুমি এরকম জমিদারের সাজ নিছো কেন?”
কালাম কোনো কথা না বলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। উজ্জ্বল চাদের আলোতে খেয়াল করলাম, চোখ দুটো তার অসম্ভব রকমের লাল। এরকম চোখ আমি আগেও দেখেছিলাম। বাংলোতে থাকাকালীন মাহমুদের শরীরে যখন এক ভয়ংকর আত্মা প্রবেশ করেছিলো, তার চোখ দুটোও ঠিক এরকম লাল হয়েছিলো। তবে কি কালামের শরীরেও প্রবেশ করেছে কোনো ভয়ংকর আত্মা?

কালাম হঠাৎ আমার গলা চেপে ধরলো হাত দিয়ে, ঠিক যেমন মাহমুদ ধরেছিলো। তারপর গলায় চাপ বাড়াতে লাগলো, আমি গলা থেকে ওর হাতটা সরাতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু অসুরের শক্তি যেন কালামের গায়ে। একসময় কালাম আমাকে উপরে তুলে ছুড়ে মারলো। একটুর জন্য আমি বেঁচে গেলাম। ছাদের রেলিং ধরে কোনোমতে আটকে রইলাম। নিচের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম এখান থেকে পড়লে আমার বাঁচার আশা শূন্য পার্সেন্ট।
কালাম আবারো এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে, হয়তো আমাকে ফেলেই দিবে সে। আমি চিৎকার করে বললাম:
–থামো কালাম, কী করছো?”
কালামের মুখে তখন পৈশাচিক হাসি দেখা গেলো। সে হাসতে হাসতে বললো:
–কে কালাম? আমি জমিদার আকরাম শাহ। আজ তোমার নিস্তার নেই, যেভাবে আমাকে মারা হয়েছে, তোমাকেও সেভাবে মরতে হবে। লাফ দাও নিচে। তারপর মরে যাও।” কথাগুলো বলেই “হা হা হা” করে হেসে উঠলো কালাম। আমি বুঝলাম আমার আর বেঁচে থাকা হবেনা, কালামের শরীরে যে পৈশাচিক শক্তি ভর করেছে সে আমায় বাঁচতে দেবেনা। কী করবো এখন? কিছুই বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ চারপাশে একটা শীতল হাওয়া অনুভব করলাম। তারপর কেউ একজন আমার কানে কানে বললো:
–মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া, ভয় নেই। আমি তো আছি…..”
অশরীরী কণ্ঠটা শুনে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ইরা এসেছে আমাকে বাঁচাতে। সে আমাকে আবার তুলে আনলো ছাদের উপর। কালামের মুখ থেকে তখন হাসিটা উবে গেলো। সে ভয়ংকর রাগ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো আবার মারতে। ইরার কণ্ঠটা তখন আবার শুনতে পেলাম। ও আমার কানে কানে বললো:
–মিস্ট্রুয়াস ভাইয়া, ভয় পেয়োনা। যুদ্ধ করো ওর সাথে। ওর জামাটা ছিড়তে পারলেই হবে। তারপর ওর শরীর থেকে আত্মাটা বেরিয়ে যাবে।”
ইরার কথায় বুঝলাম কালাম যার ড্রেসটা পরেছে ওটা জমিদার আকরাম শাহর জামা। এই জামার কারণেই ওর শরীরে জমিদারের আত্মাটা প্রবেশ করেছে।

কালাম আবার এগিয়ে এসে আমার গলা চেপে ধরলো। আর আমি দুই হাতে ওর গায়ের জামাটা ধরলাম। ও আমাকে শূন্যে তুলে ছুড়ে মারার আগেই টান মেরে আমি ওর গায়ের জামাটা ছিড়ে ফেলে দিলাম। তখন একেবারে শান্ত হয়ে যায় কালাম। সজ্ঞানে ফিরে সে নিজেকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়। তারপর আমাকে হাতাশার সুরে বললো:
–ভাই, আমি এটা কী করতে যাচ্ছিলাম?”
আমি তার কাঁধে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে বললাম:
–তোমার শরীরে এক জমিদারের আত্মা প্রবেশ করেছিলো ঐ ড্রেসটা পরার কারণে। এখন তুমি ঠিক আছো। নিচে চলো এখন।”
কালামকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম, তখন আর ঐ রক্তের দাগগুলো দেখতে পেলামনা। কোথায় গেলো সেই রক্তের দাগ? মনে হয় এর পেছনেও কোনো রহস্য আছে। হয়তো এই সিড়িতেই জবাই করা হয় কাউকে। কিন্তু কেন? কি ছিলো এর পেছনের ইতিহাস। জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠলাম আমি। রহস্য আমায় টানে।

পরদিন এক পত্রিকা অফিসে যোগাযোগ করে, ইরার লাশ উদ্ধারের মিথ্যে নিউজটা ছাপিয়ে দিলাম। একটা হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে ওখানের মর্গের কতো নাম্বার লাশটা ইরার তাও বলে দিলাম। যাতে কালপ্রিটের লাশ খুঁজতে কষ্ট না হয়। নিউজটা ছাপিয়ে আমরা হাসপাতালে গেলাম। ওখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে বিষয়টা কোনোভাবে ম্যানেজ করলাম। রাত ১১ টার পর আমাদের মিশনটা শুরু হবে। তাই সকল প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম আগে থেকে।

তারেক এবং সাবরিনাকে বাইরের দিকে নজর রাখতে বলে আমি ঢুকলাম মর্গে। তারপর একটা সাদা কাপড় জড়িয়ে লাশ নাম্বার টুয়েন্টি সিক্সের ভূমিকায় অভিনয় করতে লাগলাম। পত্রিকায় বলা হয়েছে টুয়েন্টি সিক্স নাম্বার লাশটা ইরার। অনেকগুলো লাশের মাঝে আমি এক জীবন্ত লাশ, কিছুটা ভয় ভয় লাগতেছে। লাশগুলো যদি এখন উঠে এসে আমাকে চেপে ধরে, ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? তারপরও সাহস নিয়ে সাদা কাপড়ের ভেতর অপেক্ষা করতে লাগলাম কালপ্রিটের জন্য। ঘড়িতে টাইম দেখলাম ১২ টা পেরিয়ে গেছে। আমার অনুমান অনুযায়ী আর একটু পর হাজির হবে কালপ্রিট। অনুমানকে সত্য প্রমাণিত করে একটু পর কেউ একজন মর্গের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আমার দিকে এগিয়ে আসার শব্দ শুনতে পেলাম তার। আমিও প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম কালপ্রিটের মুখোশ খোলার জন্য…….

লাশচোরটা এসে ধীরে ধীরে আমার উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরালো, হয়তো নিশ্চিত হতে চেয়েছিলো ভেতরের লাশটা ইরার কিনা। ও কাপড় সরাতেই সাথে সাথে আমি চোখ খুলে ওর দিকে তাকালাম। মুখোশ পরার কারণে তার মুখটা দেখা গেলোনা। তবে এটা যে রাতুল হাসান নয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত। কারণ রাতুল হাসান আসলে এভাবে আসতোনা, আইনিভাবে পুলিশ ফোর্স নিয়ে এসে লাশ নিয়ে যেতো। তাহলে এখন এই ব্যক্তিটা কে? দেখার জন্য ওর মুখোশ ধরে টান দিতে চাইলাম, কিন্তু ও সরে গিয়ে কোমরে হাত রাখলো। সাথে সাথে ওর হাতে চলে এলো একটা ওয়ালথার। আরে এটা তো আমারটা! তারমানে এটা ইউসুফ খানের লোক। ঐদিন আমাকে রেললাইনে নিয়ে গিয়ে মারার সময় তাদের মধ্যে কেউ একজন আমার ওয়ালথারটা কেড়ে নেয়। সেই ব্যক্তিটাই ইনি।.

অনেকদিন আমার সাধের ওয়ালথারটা আমার হাতের বাইরে ছিলো। এখন এই লোকটার হাতে দেখে তড়িৎবেগে উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ও আমার দিকে ওয়ালথার চালানোর আগেই আমি ওর চোয়ালে কষে একটা ঘুষি বাসালাম এবং হাতে থাবড়া দিলাম। হাত থেকে ওর ওয়ালথারটা ছিটকে পড়ে গেলো কিছুটা দূরে। ডাইভ দিয়ে ওটা তুলতে চাইলাম, তখন লোকটা দৌঁড় দিলো পালানোর জন্য। কিন্তু আফসোস! বেচারা পালাতে পারলোনা। দেয়াল হয়ে দাঁড়ালো সাবরিনা এবং তারেক। আর পেছন থেকে আমি ওয়ালথারটা তাক করে এগিয়ে আসতে লাগলাম ওর দিকে। ও আত্মসমর্পণ এর মতো করে হাত দুটো উপরে তুললো। খুব সহজেই ধরে ফেললাম লোকটাকে। কোনো ঝামেলা হয়নি, রক্তপাত হয়নি, বেশিক্ষণ সময়ও লাগেনি। ভেবেছিলাম ইরার হত্যাকারীরা অনেক কৌশলী এবং দুরন্তর হবে। যাদের কাছে পৌঁছাতে আমাদের অনেক বাঁধা আসবে। এরকম একটা লোক ইরা হত্যার পেছনে জড়িত ভাবা যায়না। পরবর্তী ১ ঘণ্টার মধ্যে লোকটাকে নিয়ে আমরা জঙ্গলের সেই প্রাসাদে এসে হাজির হলাম।

লোকটার নাম মিনহাজ। ইউসুফ খানের চেলাদের মধ্যে একজন। ঐদিন সবুজকে যে চিরকুটটা দেয়া হয়ছে, ওটা মিনহাজই দিয়েছে। সে মনসুরের নাম করে লুকিয়ে সবুজকে চিরকুটটা দেয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম:
–ইরার লাশ চুরি করার কারণ কী?”
মিনহাজ নিচু হয়ে রইলো। কোনো উত্তর দিলোনা। আমি আবার বললাম:
–লাশ চুরি করলে কি ভেবেছো, ইরার হত্যার দায় থেকে মুক্তি পাবে?”
মিনহাজ এবার গলা উচু করে বললো:
–আমি মারিনি ইরাকে। গড প্রমিস!
–তাহলে কে মেরেছে?
–আসলে আমি জানিনা। সবাই যা জানে, আমিও তাই জানি।
–সবাই কি জানে?
–সবাই জানে ইরা ঘুমের মধ্যে মারা গেছে।
–তাহলে তুমি কার কথায় ওর লাশ চুরি করিয়েছো?
–কারো কথায় না…..
–কারো কথায় না? নিজের ইচ্ছেতেই লাশ চুরি করিয়েছো?
–আসলে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ঐদিন আপনি যখন রাতুল সাহেবের সাথে কবর থেকে লাশ তোলার ব্যাপারে কথা বলছিলেন, তখন আমিও ছিলাম ওখানে। আড়িপেতে আপনাদের সব কথা শুনি। ওর লাশটা পোস্ট মর্টেম করা হবে শুনে আমি আর থাকতে পারিনি, লাশ চুরি করার ব্যবস্থা করি। নিজে চুরি করতে পারিনি ধরা পড়ার ভয়ে, তাই সবুজকে দিয়ে সব করায়।”
পাশে তখন বাঁধা অবস্থায় সবুজ ছিলো। তার পা দুইটা বাঁধা ছিলোনা। রেগে উঠে মিনহাজকে লাথি মেরে সে বললো:
–কুত্তে কামিনে, আমাকে দিয়ে করিয়েছিস?”
আমি সবুজকে থামিয়ে মিনহাজকে বললাম:
–কেন? তুমি কেন ভয় পেয়েছো? তুমি তো খুন করোনি ওকে। তাহলে?”
মিনহাজ চুপ করে রইলো মাথা নিচু করে। তখন আমার পাশ থেকে তারেক বললো:
–সত্যি করে বলো, কেন লাশ চুরি করেছো? নইতো ইরাকে হত্যার দায়ে তোমার ফাঁসি হবে।”
মিনহাজ তখন ভয় পেয়ে বললো:
–না, না, আমি খুন করিনি ইরাকে।”
–আমারো তাই মনে হয়, তোমার মতো ছেলে খুন করতে পারেনা। কিন্তু তুমি ভয় পেয়েছো কেন? কেন লাশ চুরি করিয়েছো?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
–আসলে….আমি…আসলে….
–আসলে?”
–আসলে আমি ইরার মৃত্যুর রাতে ওকে জোর করে রেপ করেছিলাম।
–হোয়াট!” চমকে উঠে ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় দিলো সাবরিনা। তারপর বললো:
–বদমাশ ছেলে, মেয়েদের ইজ্জতকে তোরা কি মনে করিস?”
আমি সাবরিনাকে শান্ত করে মিনহাজকে বললাম:
–তো তুমি তো অনেক আগে রেপ করেছো। এতোদিন পর লাশ চুরির কারণ কী?
–পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে যদি রেপের ব্যাপারটাও চলে আসে তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
–তুমি কি জানোনা, এতোদিন পর রেপের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়না পোস্ট মর্টেমে? পেলেও ২% পাওয়া যায় শুধু।
–এটা আমি জানতামনা।
–তোমার কাছে শেষ প্রশ্ন, তখন তুমি থানায় গিয়েছিলে কেন? কে পাঠায়ছিলো তোমাকে?
–আসলে আমাকে মনসুর ভাই পাঠায়ছে আপনাকে ফলো করার জন্য। তাই আপনাকে ফলো করতে করতে আমিও থানায় যায়। তখন আপনার সাথে রাতুল সাহেবের সব কথা শুনি।”
–আমাকে ফলো করার কারণ কী?” প্রশ্নটা করলাম মনসুরের দিকে তাকিয়ে। কর্কশকণ্ঠে সে জবাব দিলো:
–ইউসুফ ভাইয়ের কথায় আমি কাজটা করিয়েছি। আসলে আমি আর কিছু জানিনা।
–আচ্ছা, তাহলে তোমরা তিনজন এখানেই পড়ে থাকো। আপাতত বন্দি তোমরা।”
ওরা তিনজন মাথা নিচু করে রইলো আমার কথা শুনে। আমি তখন উঠে দাঁড়িয়ে কালামকে জিজ্ঞেস করলাম:
–কালাম, এদের দুইজনকে খেতে দিয়েছিলে? নাকি উপোস রেখেছিলে?”
–খেতে দিয়েছিলাম।
–তুমি নিজে খেয়েছো?
–খেয়েছি।” শান্তকণ্ঠে জবাব দিলো কালাম। ছেলেটা ভালো হয়ে গেছে। রান্নার কাজটা ও করেছে। আর আমরা যখন বের হয়েছিলাম তখন মনসুর এবং সবুজকে পাহারা দিয়েছিলো সে। তাদেরকে খেতে দিয়ে, নিজেও খেয়েছে। এবার আমি, তারেক এবং সাবরিনা মিলে ডিনারটা সেরে নিলাম। খাবার পর সাবরিনা বাসায় চলে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো। কিছুতেই থাকবেনা সে এই ভূতুড়ে প্রাসাদে। রাত অনেক হওয়ার দোহাই দিয়ে আমি তাকে কোনোমতে থাকার জন্য রাজি করালাম। কিন্তু সে আলাদা রুমে থাকতে রাজি হলোনা। আমার রুমেই থাকবে সে, তার এক কথা। আমিও রাজি হলাম। তাকে বেডে থাকতে দিয়ে আমি ফ্লোরে একটা বেডসিট বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত বাড়তে লাগলো আরো। একসময় আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু জেগে উঠলো প্রাসাদটা……

একটা কান্নার শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘুম ভাঙতেই বুঝলাম কেউ একজন আমার উপর শুয়ে আছে, আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি মৃদুকণ্ঠে ডাক দিলাম:
–সাবরিনা….”
আমার ডাক শুনে সাবরিনা উঠে বসলো আমার উপর থেকে। আমি শোয়া থেকে উঠে লাইট অন করলাম। সাবরিনা মুখ নিচু করে বললো:
–স্যরি….”
আমিও ফর্মালিটি রক্ষা করে বললাম:
–ইটস ওকে….”
–আসলে আমি ভয় পাচ্ছিলাম, তাই তোমার কাছে চলে আসি….”
সাবরিনার কথা শেষ হতেই কান্নার শব্দটা আবার শুনা গেলো। কেউ একজন মেয়েলী কণ্ঠে করুণ সুরে কান্না করতেছে। মনে হয় ছাদ থেকে আসতেছে কান্নার শব্দটা। আমি ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম, তখন সাবরিনা দৌড়ে এসে আমার হাত টেনে ধরলো। তারপর উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো:
–কোথায় যাচ্ছো?”
আমি ওর দিকে ঘুরে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম:
–শুনতে পাচ্ছোনা কেউ একজন কান্না করতেছে?”
–না, যাবেনা তুমি….” সাবরিনার চোখে স্পষ্ট ভয় দেখতে পেলাম আমি। হয়তো সেটা আমাকে হারানোর ভয়। আমি ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে, ওর গা ঘেষে ফিসফিস করে বললাম:
–ভয় পেয়োনা, কিচ্ছু হবেনা আমার।
–চলো তাহলে, আমিও যাবো তোমার সাথে।
–চলো…”
সাবরিনা আমার বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। তারপর আমরা ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম ছাদের দিকে। আগের রাতে যেমন সিড়ি বেয়ে রক্তস্রোত পড়ছিল, আজো একইভাবে রক্তধারা সিড়ি বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। সাবরিনা আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলো:
–কার রক্ত এসব?”
তখন পেছন থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠে বললো:
–আমার রক্ত!”
আমি আর সাবরিনা চমকে তাকালাম পেছনের দিকে। দেখলাম একটা মহিলা, বেশভূষায় রাণীর মতো, তার গলাটা কাটা, আর কাটাগলা বেয়ে গড়িয়ে পড়তেছে অঝোর ধারায় রক্ত। রক্তধারায় ভাসিয়ে নেবে যেনে পুরো প্রাসাদটা। একটু আগেও সিড়ি বেয়ে উঠার সময় আমরা কাউকে দেখিনি। অথচ এখন সিড়ির নিচেই মহিলাটি।
–কে আপনি?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
মহিলাটা পৈশাচিক হাসি হেসে চিৎকার করে বললো:
–আমি এই মহলের রাণী, আর তোরা কোন সাহসে এই মহলে উঠেছিস?” বলতে বলতে মহিলাটা এগিয়ে আসতে লাগলো আমাদের দিকে। আমরাও ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগলাম। একসময় ছাদে উঠে আসলাম, তখন ছাদে পুরুষকণ্ঠে একজন জোরে হেসে উঠলো। দেখলাম জমিদার আকরাম শাহ দাঁড়িয়ে আছে তার আসল চেহারায়। আগের রাতে কালামের শরীরে ভর করায় তার চেহারা দেখতে পাইনি, আজ দেখলাম। দুইদিক থেকে জমিদার আর তার স্ত্রী আমাদের ঘিরে ফেললো। সাবরিনা ভয়ে ভয়ে বললো:
–আমি তোমাকে প্রথমেই নিষেধ করেছিলাম এখানে আসতে। আমার কথা শুনলেনা, এখন কী হবে?” কাঁপতে লাগলো সাবরিনা। আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম:
–ভয় পেয়োনা সাবরিনা, দেখো কী হয়…..”
–আর কী দেখবো, ওরা আমাদের এখন মেরে ফেলবে, তারপর সব শেষ।”
সাবরিনার কথা শেষ হতেই আমি ইরার কণ্ঠ শুনতে পেলাম। ইরা আমার কানে কানে বললো:
–মিস্ট্রিয়াস ভাইয়া, ভয় পেয়োনা। তোমার পকেটে একটা লাইটার আছে দেখো, ওটা জালাও, ওরা তোমাদের কাছে আসতে পারবেনা আর।”
আমি পকেটে হাত দিলাম, সত্যি সত্যি একটা লাইটার পেলাম, অথচ এটা আমার না। লাইটারটা আমি জ্বালালাম। সাথে সাথে দুইদিক থেকে থমকে দাঁড়ালো, জমিদার আর তার স্ত্রী। জমিদারের স্ত্রীর কণ্ঠে আক্রোশ বেড়ে গেলো। তিনি রেগে উঠে বললেন:
–বন্ধ করো এ আগুন।” বলতে বলতে তিনি স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমিও লাইটারটা জ্বালিয়ে ওদের দিকে এগোতে লাগলাম। ওরা নিজেরাই এবার ভয় পেয়ে একসাথে বলে উঠলো:
–খবরদার, কাছে আসবেনা, আগুন নেভাও।”
আমি বললাম:
–আপনাদের ভয় দেখানোর কোনো ইচ্ছে নেয় আমার, আমি শুধু জানতে চাই কি ঘটেছিলো আপনাদের সাথে। আর কেন-ই বা আপনারা আত্মা হয়ে এই প্রাসাদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?”
–ওকে বেশ, বলছি….. কিন্তু কাছে আসবেনা তোমরা।”
–আচ্ছা বলুন, আমরা আপনাদের মঙ্গল চাই…..”
মহিলাটি তখন বলতে শুরু করলেন:
–আমার নাম শাহীনুর। আর ইনি আমার স্বামী। আমাদের একটা সুখী পরিবার ছিলো। শুধু একটাই দুঃখ ছিলো, আমাদের কোনো সন্তান ছিলোনা। আমি আমার স্বামীকে তখন আরেকটা বিয়ে করাতে চাপ দিতে থাকি। নিজেই পাত্রীর সন্ধান করতে থাকি। তখন হঠাৎ একদিন একটা লোক এসে এক পাত্রীর সন্ধান দেয় আমাদের। পাত্রী দেখে আমার পছন্দ হয়। শতকষ্ট বুকে নিয়ে তখন আমি ঐ মেয়েটার সাথে আমার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে দিই। কিন্তু এটাই আমাদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। নিজ হাতে যেন আমাদের সুখের সংসারটা শেষ কররে দিলাম। এই বিয়ের পর নতুন বউ এর সব আত্মীয় স্বজনরা আমাদের প্রাসাদে উঠে থাকে। সবাই মিলে চক্রান্ত করতে থাকে কীভাবে সব সম্পত্তি নিজের করে নেবে। তখন আমরা জানতে পারি নতুন বউ এর সাথে এক লোকের আগে থেকেই সম্পর্ক আছে, যে লোকটা পাত্রীর সন্ধান দিয়েছিলো তার সাথে। একদিন ওরা ধরা পড়ে যায়। আমরা যখন পরদিন ওদের সবার মুখোশ খুলতে যাবো, তার আগের রাতেই ওরা আমাদের স্বামী স্ত্রীকে ছাদে ধরে নিয়ে আসে, জোর করে সব সম্পত্তি নিজেদের নামে করে নেয়। তারপর ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আমার স্বামীকে। আমি চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, ওরা আমার গলাটা কেটে দেয়….. তারপর থেকেই আমরা প্রতিশোধের নেশায় এই প্রাসাদে ঘুরে বেড়ায় আত্মা হয়ে। যারা আমাদের শেষ করে দিয়েছে, তারা পালিয়ে গেছে প্রাসাদ ছেড়ে।
–কিন্তু আপনাদের মুক্তি হবে কীভাবে?
–যদি আমরা প্রতিশোধ নিতে পারি, তাহলে আমরা মুক্তি পাবো।
–যারা আপনাদের খুন করেছে, তাদেরও তো এতদিন বেঁচে থাকার কথা না, তাহলে প্রতিশোধ নেবেন কী করে?”
এবার জমিদার আকরাম শাহ বললেন:
–প্রতিশোধ আমরা ঐদিনই নিতে পারবো, যখন আমরা ঐরকম কোনো বিশ্বাসঘাতককে শেষ করতে পারবো।”
জমিদারের কথা শুনে আমি বললাম:
–আমি আপনাদের খুব শীঘ্রই মুক্তি দিতে চাই…..”
আমার কথা শুনে সাবরিনা চমকে তাকালো আমার দিকে। হয়তো ভাবছে আমি কীভাবে এই আত্মাগুলোকে মুক্তি দেবো।

রুমে এসে সাবরিনাকে বুঝিয়ে বললাম ব্যাপারটা। ও বুঝলো, কিন্তু এটা বুঝলোনা আমার পকেটে লাইটার আসলো কোথা থেকে। আমি তখন ইরার কথা বললাম। ইরার কথা শুনে সাবরিনা কিছুটা অবাক হলো। কারণ সে জানেনা ইরার সাথে আমার কথা হয় মাঝেমাঝে। আমি তাকে বললাম:
–সাবরিনা, ইরা এখনো আছে আমাদের আশেপাশে।”
–সামনে আসেনা কেন সে?” জিজ্ঞেস করলো সাবরিনা।
উত্তর দিলাম:
–আসবেনা সে। যেদিন আমি তার হত্যাকারীদের কাছে পৌছতে পারবো, যেদিন ওর হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে পারবো, সেদিন ইরা সামনে আসবে। যাইহোক, এই মাঝরাতে এসব কথা না বলে, চলো ঘুমিয়ে পড়ি।
–আচ্ছা….”
–আর শুনো…..
–কী?
–সহজ সরল ছেলে পেয়ে আবারো আমার উপর শুইতে আসবেনা যেন….”
সাবরিনা লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে ফেললো। লজ্জা পেলে ওর চেহারায় মায়া বেড়ে যায়। মনে হয় পৃথিবীর সব মায়া বুঝি ওর চেহারায় ঘিরে আছে। লজ্জামাখা বুলিতে ও নিচু হয়ে বললো:
–স্যরি…..”
–ইটস ওকে, ঘুমাও…..”
এরপর দুজন আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সাবরিনাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি ইউসুফ খানের বাসায় গেলাম। ইউসুফ তখন রাতুল হাসানের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে কি যেন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেছে। রাতুল হাসানকে এখানে দেখে কিছুটা খটকা লাগলো মনে। নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র করার পরিকল্পনা করতেছে। তবে কী ষড়যন্ত্র করতেছে সেটা এখন মাথায় আসছেনা।

আমাকে দেখে ইউসুফ খান এবং রাতুল হাসান একটু নড়েচড়ে বসলো। আমি ওদের দিকে এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করলাম:
–কেমন আছেন আপনারা?”
–ভালো আছি….” দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিলো। তারপর ইউসুফ খান আমতা আমতা করে বললো:
–বাবাজি তুমি? বেঁচে আছো তুমি?”
–কেন আঙ্কেল? আমার মৃত্যু আশা করছিলেন নাকি?”
–আরে না না, ঐদিন যা ঘটলো, ভাবলাম…. যাইহোক, বসো বসো।
আমি সোফায় বসলাম। তখন রাতুল হাসান উঠে দাঁড়িয়ে বললো:
–আমি তাহলে আজ আসি, একটু থানায় যেতে হবে। আপনারা তাহলে কথা বলেন। আমি মি.রানা…..”
আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে গেলো রাতুল হাসান। উনি বেরিয়ে যেতেই ইউসুফ খান বললেন:
–তারপর কী খবর? কীভাবে বাঁচলে?
–কীভাবে বাঁচলাম আমি নিজেও জানিনা। ওরা তো আমাকে রেললাইনে বেঁধে রেখেছিলো, আর ঐদিকে গর্জন করতে করতে ট্রেন আসছিলো, তারপর হঠাৎ দেখলাম একটা লাল কাপড় উড়তেছে। যার কারণে আমি বেঁচে যাই।”
–লাল কাপড়! লাল কাপড় এলো কোত্থেকে?” ইউসুফ খান যেন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছেননা।
আমি বললাম:
–তা তো আমিও জানিনা কোথা থেকে এলো। বাই দ্যা ওয়ে, আপনাকে কীভাবে ছেড়ে দিলো ওরা?”
ইউসুফ খান ইতস্তত করে বললো:
–ঐ আমি ওদের হাতেপায়ে ধরে মিনতি করেছি। বলেছি, আমার একটা সংসার আছে, বউ বাচ্চা আছে, আমাকে মেরে ফেললে ওদের কী হবে।”
ইউসুফ খানের কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম, লোকটা নাটক সিনেমায় অভিনয় করলে এতোদিনে সাইন করে ফেলতে। মুখে বললাম:
–কিন্তু আঙ্কেল, ওরা কারা? শুধু শুধু আমাদের মারতে চাইলো কেন?”
–কী জানি বাবা…. তুমি এক কাজ করো, এই শহরে আর থেকোনা। চলে যাও আজই। নইতো আবার বিপদ হতে পারে।”
–বিপদকে ভয় পাওয়ার পাত্র আমি নই আঙ্কেল। আমি একটা মিশন নিয়ে এসেছি। ইরা হত্যার রহস্য যতোদিন সামনে আনতে পারবোনা, ততোদিন অন্তত যাচ্ছিনা এই শহর ছেড়ে।”
ইউসুফ খান কিছুটা কেঁপে উঠলেন আমার কথা শুনে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন:
–তোমার কেন মনে হলো বাবা, ইরাকে খুন করা হয়েছে?”
–কারণ ইরাকে নিয়ে আমি স্টাডি করেছি। তারপর মনে হয়েছে, তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক না। খুন যে করুক, তাকে খুব তাড়াতাড়ি শাস্তি পেতে হবে।”
ইউসুফ খান কয়েকবার কেশে উঠে সামনের একটা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে একটানে সাবাড় করে দিলেন। মনে হয় সামলে নিতে পারেননি আমার কথাটা। আমি উঠে দাঁড়ালাম, তারপর বললাম:
–আসি তাহলে আঙ্কেল।”
ইউসুফ মাথা নেড়ে সায় দিলেন। আমি বেরিয়ে আসলাম উনার বাসা থেকে।

দুপুরে লাঞ্চ সেরে আমি সাবরিনার নাম্বারে ফোন দিলাম। কিন্তু কোনো সংযোগ পেলামনা। ভাবলাম ফোনে চার্জ নাই, তাই হয়তো অফ। কিন্তু বিকেল পর্যন্ত ওর নাম্বারে ট্রাই করেও কোনো সংযোগ পেলামনা। তখন মনের মধ্যে বাড়ি খেলো। কোনো বিপদ হয়নি তো ওর? তারেককে নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হলাম সাবরিনার খোঁজের জন্য। ওদের বাসায় গেলাম, পেলামনা সেখানে। ওর বাবা মার কাছ থেকে জানতে পারলাম, দুপুরের অনেক আগে থেকেই ওর কোনো খোঁজ নেই। তবে কী সে আবার আটকে পড়লো ইউসুফ খানের খাঁচায়? এতক্ষণ কী বাঁচিয়ে রেখেছে ওরা তাকে?

ইউসুফ খানের বাসায় গেলাম। ওখানে ইউসুফ খানকে পেলামনা। তবে কী উনি নিজেই গেছেন সাবরিনাকে শেষ করতে? নিজেকে কেন জানি অপরাধী মনে হতে লাগলো? আমার সাথে মেশার কারণেই সে ইউসুফ খানের নজরে এসেছে। একবার মরতে মরতে বেঁচে গেছে, এখন আবার সে ওদের ফাঁদে পড়েছে। জানিনা তাকে আবারো জীবিত ফিরে পাবো কিনা…….”

বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে ইউসুফ খানের জঙ্গল ঘেরা আস্তানার দিকে যেতে লাগলাম আমরা। জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই আমরা দেখলাম জঙ্গলের পরিবেশ থেকে সাবরিনা একা বের হচ্ছে। ব্যাপার কী? বাইক থামাতেই সাবরিনা এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। তারপর বাইকে তারেকের পেছনে বসে বললো:
–সব কথা পরে হবে, আগে চলো এখান থেকে…..”
আমি বাইক ঘুরালাম। তারপর সোজা চলে আসলাম প্রাসাদে। তখন সাবরিনার ব্যাপারটা তুললাম। সে জানালো, দুপুরের দিকেই তাকে কয়েকজন লোক কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। তারপর তাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়। যখন তার জ্ঞান ফিরে, তখন ছেড়ে দেয়া হয়। কেন ধরে নিয়ে গেলো? কেনই বা আবার ছেড়ে দিলো কিছুই বলতে পারলোনা সে। কেন জানি সাবরিনার কথাগুলো আমার বিশ্বাস হতে চাইলোনা। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কিছুই না করে ছেড়ে দেবে এটা নিশ্চয়ই ইউসুফ খানের প্লানের বাইরে। তবে কী সাবরিনাও জড়িত ওদের সাথে? সন্দেহটা এখন সাবীিনার উপরেও গিয়ে পড়লো। তাকে ধরে নিয়ে গেছে? নাকি সে স্বেচ্ছায় আমাদের খবর পাচার করতে গেছে? সাবধান হতে হবে আরো।

পরদিন সাবরিনাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি আর তারেক হোটেল রুমে যাচ্ছিলাম। তখন রাতুল হাসানের সাথে দেখা। উনি আমাদের সাথে হ্যান্ডশেক করার পর ইরা হত্যার রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। আমি জানালাম, খুব শীঘ্রই সামনে বেরিয়ে আসবে রহস্য। মুখোশের আড়ালে থাকা লোকগুলোর চেহারাও সামনে চলে আসবে।”
রাতুল হাসান কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন:
–বেস্ট অব লাক।” তারপর তারেকের দিকে তাকিয়ে বললো:
–আপনার বন্ধুটা কিন্তু অনেক জিনিয়াস। আমিও ফ্যান হয়ে যাচ্ছি উনার।”
তারেক হেসে জবাব দিলো:
–এইজন্যই তো আমি গর্ববোধ করি এমন একটা বন্ধু পেয়ে।”
–আচ্ছা, ভালো থাকবেন। আমাকে একটু যেতে হবে।” বলতে বলতে তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন রাতুল হাসান।
তারেক জিজ্ঞেস করলো:
–রাতুল হাসানকে কী কারণে তুই সন্দেহ করেছিস এখনো কিন্তু জানালিনা।
–সময় হলে জানতে পারবি।
–ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস?
–বলতে পারিস তাই…..
–আমার দোস্ত এতো ধৈর্য নাই, বল তো…..
–বলবো বলবো, এখন চল প্রাসাদে ফিরে যায়। ওদিকের অবস্থা কেমন দেখে আসি।” বলতে বলতে বাইক স্টার্ট দিলাম আবার।

প্রাসাদে ফিরে এসেই যে ব্যাপারটা প্রথমে চোখে পড়লো, তা দেখবো বলে আশা করিনি। দেখলাম কালামের রক্তাক্ত লাশ নিচে পড়ে আছে, আর যে তিনজনকে আমরা বেঁধে রেখেছিলাম সেই তিনজন নেই কোথাও। পুরো প্রাসাদ খুঁজলাম, পেলামনা তাদের। শুধু কালামের নিথর দেহটা শান্ত হয়ে পড়ে আছে। আমি আর তারেকে পরস্পরের দিকে তাকালাম। দুজনের দৃষ্টিতে একই প্রশ্ন, কী করে হলো এসব?

কালামের লাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম পুরো বিষয়টা। কালামকে গুলি করে মারা হয়েছে। তারমানে কেউ এসেছিলো এখানে। তারা এসে কালামকে মেরে বাকি তিনজনকে নিয়ে চলে গেছে। তারমানে ইউসুফ খানের লোক এসেছিলো। কিন্তু ইউসুফ খানের লোক কী করে জানলো আমরা প্রাসাদে আছি? এটা তো ওদের জানার কথা না, যদি আমাদের মধ্যে কেউ ওদেরকে না জানায়। তবে কী সাবরিনা? ঘুরেফিরে আবার সন্দেহটা সাবরিনার উপর গিয়ে পড়লো। হ্যাঁ, সাবরিনা ছাড়া কেউ নয়, সে-ই প্রাসাদের ঠিকানা দিয়েছে ইউসুফ খানের লোকদের। গতকাল কিডন্যাপের নাটক করে সে সব তথ্য দিয়ে এসেছে। সাবরিনা! সাবরিনা! সাবরিনা! রাগটা বাড়তে লাগলো ওর উপর।

কালামের লাশটা কবর দেয়ার পর আমি সাবরিনার নাম্বারে ফোন দিলাম। ফোন রিসিভ করতেই তাকে আমার সাথে দেখা করার জন্য হোটেল রুমে আসতে বললাম। তারপর ফোন কেটে দিয়ে ওর আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর তারেক আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো।

সাবরিনা আসার পর বেডের উপর বসলো। তারপর হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো:
–হঠাৎ জরুরী তলব? কী ব্যাপার বলো তো?”
আমি ওয়ালথারটা বের করে ট্রিগারে আঙুল রাখলাম। ওটা সরাসরি তাক করলাম সাবরিনার কপালের দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম:
–কে তুমি আসলে?”
আমার আচরণ দেখে সাবরিনার মুখ থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেলো হাসিটা। তারপর অবাক হয়ে বললো:
–কে আমি মানে? কী বলছো এসব?”
–সাবরিনা আর অভিনয় করোনা। তোমার আসল পরিচয় পেয়ে গেছি। তুমিও আসলে ওদের একজন……
–রানা! কী হচ্ছে এগুলো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।”
ওর কথা শেষ হতেই জোরে একটা থাপ্পড় দিলাম ওর গালে। তারপর বললাম:
–অভিনয় অনেক করেছো, সত্যিটা বলো এবার…….”

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত