“এই চা গরম -চা গরম ” – চিকন একটা গলায় চিৎকার করে চলেছে মিশকালো একটা লোক- হাতে এক বিশাল চায়ের ফ্লাক্স-
চিল্লাতে চিল্লাতে রাজু সাহেবের সামনে মিনিট তিনেক ধরে ঘুর ঘুর করছে। যত বার রাজু সাহেবের সামনে যাচ্ছে ততবার
রাজু সাহেব বিরক্ত হচ্ছেন- কিন্তু চা ওয়ালার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। লাকসামের রেলস্টেশনের ওয়েটিং এ রাজু সাহেব
আজ রাত্রের গুটি কয়েক যাত্রির মাঝে একজন। স্যুট বুট পড়া
বলে রাজু সাহেবের দিকে বার বার এগিয়ে আসছে একের পর এক হকার। তিনি সবাই কে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
উনার মা উনাকে ভরপেট খাইয়ে দিয়েছে। আর পই পই করে বলে দিয়েছে যেন তিনি কোন রাস্তার খাবার না খান।
আর মায়ের কথা তিনি কোনদিন ফেলতে পারেন না।
“এই ডিম- ডিম ডিম- সিদ্ধ ডিম”- বলে একটা ছোট বাচ্চা এসে ডিমের ঝুড়িটা রাজু সাহেবের সামনে রেখে বলল-
“স্যার একটা ডিম নেন- অনেক ভাল লাগবো- খাইবেন? দিমু? ছুইলা?”
বলেই একটা ডিম নিয়ে ছোলা শুরু করে দিল। রাজু সাহেব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন ডিম ওয়ালা ছেলেটার দিকে।
তারপর গলাটা একটু চড়িয়ে বললেন-
“তোমাকে আমি কি ডিম ভাংতে বলসি? তুমি ডিম ভাংলা কেন?”
হলদে দাঁত বের করে ছেলেটা একগাল হেসে বলল-
“স্যার সবাইরে আট ট্যাহা কইরা দেই- আপনেরে ছয়টাহায় দিমু- নেন খাইয়া দেহেন- কেমুন মজা।”
বলে ডিমটা একটা কাগজে নিয়ে চামচ দিয়ে দুই ভাগ করে নুন ছিটিয়ে দিল রাজু সাহেবের হাতে।
রাগে মাথা জ্বলতে শুরু করল উনার। কিন্তু একটু পড়েই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন- না আমি খাব না। তুমি টাকা নিয়ে বিদায় হও।
বলেই মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট দিলেন ছেলেটাকে। ছেলেটা নোট টা নিয়ে ডিম টা রাজু সাহেবের পাশে ব্যাঞ্চে
রেখে চলে গেল হন হন করে। সেই ছেলেটার চলে যাওয়া দেখে উনার মাথার ভেতর রাগে জ্বলতে শুরু করল।
কিন্তু তিনি মনে মনে বিড় বিড় করে কি যেন একটা বলে আবার মনযোগ দিলেন ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকা কে।
রাজু সাহেব থাকেন ঢাকায়। একা একটা ফ্লাট ভাড়া করে। উনি ঢাকা হাইকোর্টের একজন ঊকিল। মা থাকেন লাকসামের ফুল্গ্রামে।
উনি অনেক চেয়েছেন মাকে সাথে করে ঢাকায় নিয়ে আসতে- কিন্তু উনার বাব্র কবর ছেড়ে উনার মা আসতে কখনোই রাজি হননি।
উনি উনার স্বামীর কবর ছেড়ে কোথাও যান না। তাই আজ রাজু সাহেবের সাথে ও তিনি যাচ্ছেন না। উনাকে যাওয়াত
দেয়া হয়েছে সুনামগঞ্জে প্রফেসর আকমল সাহেবের বাসায়। প্রফেসর আকমল এর মেয়ের সাথে রাজু সাহেবের বিয়ের কথা চলছে দুই সপ্তাহ ধরে।
শেষে মেয়ে দেখার জন্য আকমল সাহেব রাজু সাহেবের পরিবার কে ডেকে পাঠান। কিন্তু রাজু সাহেবের মা যেতে রাজি হননি।
তাই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করার জন্য নিজেকেই একা যেতে হচ্ছে রাজু সাহেবের। উনার কোন ভাই বোন ও নেই যে উনার সাথে যাবেন।
তাই একা এই মাঘের শীতের রাতে তিনি টিকেট কেটে প্লাটফর্মে অপেক্ষা করছেন ঢাকা সিলেট গামী ট্রেনের জন্য।
“স্যার স্যার পেপার নেন পেপার- পেপার নেন- গরম গরম খবর – মজার মজার খবর’ – বলে উনার সামনে এসে ১৮-১৯ বছরের
একটা ছেলে এসে মাসিক পত্রিকা যাচতে লাগলো। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি যাত্রা পথে ঘুমিয়ে কাটান। এই রংচঙে পত্রিকা
কোনদিন উনাকে টানেনি। উনি বেশির চেয়ে বেশি দৈনিক পত্রিকা পড়েন। কিন্তু ছেলেটা নাছোড় বান্দা। উনাকে পেপার বিক্রি করে ই ছাড়বে।
শেষে বিক্রি করতে না পেরে একটা নগ্ন ছবি ওয়ালা চটি বই রাজু সাহেবের চোখের সামনে ধরে নাচাতে নাচাতে বলল- ‘
“স্যার দেখেন- কত গরম গরম জিনিস- নেবেন? স্যার আরো ভাল ভাল জিনিস আছে।” বলে দাঁত বের করে হাস্তে লাগল।
এবার রাজু সাহেব চোখ বড় বড় করে এমন ভাবে তাকালেন যে ছেলেটা প্রায় পালিয়ে বাঁচল।
উনি এবার নিজের ব্যাগ থেকে একটা শরত সাহিত্য সমগ্র বের করে পড়তে শুরু করে দিলেন। কিছু ক্ষন আগে স্টেশন মাষ্টার
জানিয়েছেন- ট্রেন আসতে আসতে আরো দুই ঘণ্টা লাগবে। তাই এই দুই ঘণ্টা কিভাবে কাটাবেন তিনি বুঝে ঊঠতে পারছেন না।
শরত বাবুর বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে তিনি খেয়াল করলেন উনার পাশের হাত বিশেক দূরে একটা দম্পতি নিজেদের মাঝে গল্প গুজব করছে।
তিনি প্রথমে ঊঠে গিয়ে উনাদের সাথে ভাব জমাবেন বলে চিন্তা করেছিলেন- কিন্তু পরে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন।
একটু পড়েই ঢাকা চট্টগ্রাম গামী ট্রেন আসলে উনারা উঠে চলে গেলেন সেই ট্রেন এ করে। ভাব দেখে উনাদের নতুন বিবাহিত বলে মনে হল।
মনে মনে চিন্তা করতে করতে উনি আবার পড়ায় মনযোগ দিলেন।
কিন্তু হটাত করে খেয়াল করলেন উনার চারপাশ কেমন যেন শুনশান – কোন সাড়া শব্দ নেই। বই থেকে মাথা তুলে
কান পেটে শুনতে চেষ্টা করলেন রাজু সাহেব। কিন্তু তিনি কোন শব্দ শুনতে পেলেন না। মাথা তুলে দুই পাশ দেখলেন।
হালকা টিমটিমে ৪০ ওয়াটের বাতি জ্বলছে চারটা – এতে চারপাশের অন্ধকার আরো গাঢ় বলে মনে হল উনার। এর মাঝে মাঘ মাসের কুয়াশা ও আছে।
উনি কান পেতে থাকলেন অনেকক্ষন। নাহ তিনি কোন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ও শুনতে পেলেন না।
এমনিতে তিনি তুখোড় উকিল হলেও একাকীত্ব কিছুটা ভয় পান। তাই বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে স্টেশন মাষ্টারের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কিন্তু সেখানে গিয়ে ও তিনি হতাশ হলেন- সেখানে একটা পাগলি ছাড়া কেউ নেই। স্টেশন মাষ্টার কোন ফাঁকে চলে গেছে
নিজের বাড়িতে এটা উনি টের ই পেলেন না। স্টেশন মাষ্টারের বেধে দেয়া সময় এর বাকি আছে মাত্র দশ মিনিট আছে।
তিনি ঘড়ি দেখতে দেখতে এসে বসলেন উনার আগের সিটে। এবং বসতে গিয়ে হটাত দেখলেন উনার পাশে এক বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন।
উনি গলা খাকড়ি দিয়ে গিয়ে বসে পড়লেন মহিলার পাশে।
এই ঠান্ডায় মহিলা অনেকটা কুকড়ে আছেন। শাদা শাড়ি পড়ে আছেন তিনি। মুখ অনেক তা ঢাকা ঘোমটার আড়ালে।
রাজু সাহেব ভাবতে লাগলেন এই শুনশান রাতে মহিলা বসে আছেন কেন – কে তিনি ? কেন এলেন এখানে?
এমন টা ভাবতে ভাবতেই মহিলা নিজে নিজেই বললেন-
“ ভাবছেন তো কেন আমি এখানে?”
শুনেই রাজু সাহেব বেশ চমকে উঠলেন। মহিলার গলার আওয়াজ অনেক ভাঙ্গা- শুনে মনে হচ্ছে উনি অনেক কষ্ট করে কথা বলছেন।
কথা টা বলেই তিনি রাজু সাহেবের দিকে তাকালেন। রাজু সাহেব সেই দৃষ্টির দিকে বেশি ক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলেন না।
ভয়ে শরীরের ভেতর টা ঘেমে ঊঠল উনার এই শীতের মাঝে। তিনি ভেবেছিলেন কোন এক ভুত উনার পাশে বসে থাকবে।
আস্ত মানুষ দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেও মহিলার চোখ দুটি দেখে উনি ভয় পেয়ে গেলেন।
“আমি সুনামগঞ্জ যাব বাবা- সেখানে আমার ছেলের কাছে যাব- শুনেছি ট্রেন আসতে অনেক ক্ষন বাকি তাই আমি ঘর থেকে বের হয়েছি দেরিতে।
এখন আসলাম- ঘরের পাশেই মাস্টার সাহেব থাকেন। তিনি আমাকে বললেন- পাঁচ মিনিট পরেই ট্রেন আসবে। তাই আমি চলে আসলাম।
আপনার কোন অসুবিধা নেই তো এখানে বসলে? বলেই জ্বলজ্বল চোখে তাকালেন বৃদ্ধা রাজু সাহেবের দিকে।
রাজু সাহেবের বেশ অস্বস্থি হল এই প্রশ্ন শুনে- তিনি মনে মনে অনেক কিছু চিন্তা করলেও ভদ্রতার খাতিরে বললেন-
“না না কোন সমস্যা নেই আপনি বসলে- আমি তো এখানে বসার সিট দখল করে রাখতে আসিনি” বলে বইটা খুলে পড়তে শুরু করে দিলেন।
আর মিনিট খানেক পড়েই ট্রেন আসল। তিনি ‘ট’ বগির সামনের একটা সিটে বসে ছিলেন। “ট” বগিটা এসে থামল উনার সামনেই।
উনি আসতে করে ঊঠে পড়লেন ট্রেনে। উনার পিছু পিছু বৃদ্ধা মহিলা ও ঊঠে পড়লেন। উনাদের সিট একই বগিতে পড়েছে।
এবং যথারিতি সেই বগিতে আর কোন মানুষ জন নেই।
সিটে বসেই রাজু সাহেব বই টা ব্যাগে ঢুকিয়ে আসতে করে ঘুমিয়ে পড়বেন বলে মনস্থির করলেন।
তিনি বই ব্যাগ গুছিয়ে বস্তে যাবেন এমন সময় স্টেশন মাষ্টারের রুমে বসে থাকা সেই পাগলি রাজু সাহেবের বগির বাইরে
থেকে জানালা দিয়ে রাজু সাহেব কে চিৎকার করে বলতে লাগল-
“ঐ তুই যাইসনা এই ট্রেন এ। এই ট্রেন তোর লাইগা আহেনাই। এটা তোরে শেষ কইরা দিব। তুই যাইস না- অমঙ্গল হইব- ঘোর অমঙ্গল”
চিৎকার করে বলতে বলতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। রাজু সাহেব মনে মনে পাগলের প্রলাপ মনে করে হেসে ব্যাগ টা মাথার
উপর র্যাদকে রেখে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। ততক্ষনে ট্রেনের গতি পেরিয়ে গেল লাকসাম স্টেশন।
কিন্তু একটা গুন গুন শব্দে রাজু সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেল।তিনি গলা বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন উনার বগি থেমে আছে। ট্রেন চলছে না।
চারদিকে প্রচন্ড বাতাসে শো শো শব্দ হচ্ছে।এই শব্দে উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উনি উঠে বাইরে যাওয়ার গেট এর দিকে গেলেন।
অনেক কষ্টে সেই গেট খুলে যা দেখলেন উনার তাতে হার্ট বিট বেড়ে গেল কয়েকগুণ।দেখলেন উনার বগির কোন দিকেই কোন বগি নেই।
উনি হয়ত খেয়াল করেন নি- যে উনি শেষ বগি তে ঊঠেছিলেন। এবং চলতি পথে কোন ভাবে উনার বগির সাথে মূল ট্রেনের সংযোগ ছিড়ে গেছে।
ভাবতেই উনি ঘেমে গেলেন। কেউ নেই চারপাশে। সুনসান নিরবতা। এমন কি বগিতেও কেই নেই।
চারদিকে ফাঁকা একটা যায়গায় তিনি একা একটা ট্রেনের বগিতে- চিন্তা করতেই উনার ঘাড়ের বাম পাশে ব্যাথা করতে লাগল।
উনার কয়েক বছর ধরে হাই প্রেশার। উনি বুঝতেই পারলেন না উনি কি করবেন। মাথার উপর আকাশ ছাড়া কিছুই
তিনি ভালভাবে খেয়াল করতে পারছেন না। বগিতেও বসে থাকতে পারছেন না। অন্ধকার বগি- বাইরে ঝড়। এবং এমন সময় হটাত করে ঝড় থেমে গেল।
উনি এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। এবং ঠিক সেই সময় খুট করে একটা শব্দ হল। শব্দটা এসেছে বগির পেছন দিক থেকে।
উনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানের বিপরিত দিক থেকে। তিনি ভালভাবে খেয়াল করতে চেষ্টা করলেন।
দেখলেন সেই ঘোমটা পড়া বৃদ্ধা এসে সামনে দাঁড়াল উনার। এবং উনার গলা চেপে ধরল প্রচন্ড শক্তিতে///
এক ঝটকায় উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উনি এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলেন। বইটা কোলের উপর রেখে ই তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন।
চারপাশে সেই কোলাহল শুনে শরীরে কিছুটা শক্তি পেলেন। তারপর দেখলেন উনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সিলেটগামী ট্রেন। উনার বগি নাম্বার “ট”।
উনি দেরি না করে ঊঠে বসলেন উনার বগিতে। উনার জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে নিতেই তিনি একটা চিৎকার শুনতে পেলেন বাইরে।
কোত্থেকে একটা পাগলি এসে চিৎকার করে বলতে লাগল-
“ঐ তুই যাইসনা এই ট্রেন এ। এই ট্রেন তোর লাইগা আহেনাই। এটা তোরে শেষ কইরা দিব। তুই যাইস না- অমঙ্গল হইব- ঘোর অমঙ্গল”
তিনি স্বপ্নের সাথে মিলাতে মিলাতে ট্রেন ছেড়ে দিল।উঠে জিজ্ঞাসা করবেন ভাবছিলেন পাগলিকে।কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দেয়ায় তিনি
পাগলি কে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি এসে তার সিটে বসতে গিয়ে ই হটাত খেয়াল করলেন- পুরো বগি খালি –কিন্তু একদম
শেষে দিকে একটা কাথা মুড়ি দিয়ে কেউ একজন বসে আছে এবং তিনি সিট পেয়েছেন একদম শেষ বগিতে। উনার বগির পরে আর কোন বগি নেই ……
………………………………………( সমাপ্ত )……………………………