…শফিকের কয়েকদিন অফুরন্ত অবসর ।
রিজিয়া গত কিছুদিন আগে বাপের বাড়ি যাওয়াতে ,পাচটায় অফিস ছুটির পর বাজার করার ঝামেলা নাই।
তাই অফিস থেকে ফিরে কাপড় পাল্টে বের হয়ে যায়।চট্টগ্রাম শহরটা এখনও ঢাকার মত অতটা ব্যাস্ত হয়ে উঠেনি।
পাহাড়ের আড়ালে-আবডালে শুয়ে থাকা শহরটা ঢাকার তুলনায় অনেকটা শান্ত।
ইদানিং শফিক অফিস ছুটির পর একা একা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাটে আর দু চোখ দেখে শহরের শান্ত সৌন্দর্য।
ওয়াসার মোড় থেকে আলমাস সিনেমার দিকে যেতে পথে হাতের বাম দিকে সি এন জি ষ্টেশনের পাশে দোকানটা ।
অনেক দিনের পুরাতন রঙ চটে যাওয়া সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা “পুরাতন সামগ্রীর দোকান”….
নীচে ছোট্ট করে লেখা এখানে বিভিন্ন প্রকার পুরাতন সৌখিন সামগ্রী পাওয়া যায়।
শফিক হাটতে হাটতে রাস্তার অপর পার থেকে সাইন বোর্ডটা পড়ল।
এই পথ দিয়ে অনেকবার আসা যাওয়া করেছে তখন দোকানটা চোখে পড়লেও কখনও ঢুমেরে দেখা হয়নি।
আজ কৌতুহলী হয়ে রাস্তা পার হয়ে দোকানটাতে ঢুকল।
দোকানে ঢুকতেই পুরোনো জিনিসের গন্ধটা নাকে আঘাত করল। শফিক গন্ধটা নাকে সামলে নিয়ে দোকানের ভিতরে এসে দাড়াল।
বেশ বড় দোকান । দোকানে বেশির ভাগই আসবাব পত্র । নকশা করা চেয়ার, টেবিল, পালংকে ভর্তি । বেশ বড় কয়েকটা আলমারী ও আছে।
দোকানের কাউন্টারের পিছনের তাকে সারি সারি সাজানো আছে কাচের জিনিস পত্র। কয়েকটা কাঠের মুখোশও আছে। মুখোশগুলো অদ্ভুত সুন্দর ।
শফিক কাউন্টারের সামনে গিয়ে মুখোশটা চাইল। মধ্যে বয়স্ক সেলসম্যান মুখোশটা শফিকের হাতে দিল।
শফিক মুখোশটা উল্টে-পাল্টে দেখে মুখে লাগাল, এরপর আয়নার সামনে এসে দেখতে লাগল।
আয়নায় মুখোশ পড়া চেহারা দেখতে দেখতে হটাৎ আয়নার ভিতর দিয়ে ওর পিছনে একটা মূর্তি দেখতে পেল। অপূর্ব সুন্দর একটা নারী মূর্তি।
মুখোশটা খুলে পিছনে ফিরে দেখল ছোট্ট একটা আলমারীর উপর মূর্তিটা। মুখোশটা সেলসম্যানের হাতে দিয়ে, মূর্তিটার সামনে এসে দাড়াল।
প্রায় এক ফুট লম্বা অপুর্ব সুন্দর চেহারার নারী মূর্তি। পরনে নীল রংয়ের শাড়ী আকা। কপালে লাল রংয়ের গোল টিপ আকা ।
সামনে বাম দিকে ভরাট বুকের উপর লম্বা ঘন চুলগুলো কোমর পর্যন্ত ছড়ানো।
হালকা ত্রি-ভংগীমায় দাড়ানো, মুখে এক চিলতে মিষ্টি হাসি, মদিরা দৃষ্টিতে কেমন যেন রহস্যময় আহ্ববান।
শফিক মুর্তিটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল।
ঃ নেবেন নাকি মূর্তিটা ?
সেলস ম্যানের কথায় শফিকের ধ্যান যেন ভাংগল। জিঘ্গাসা করল মূর্তিটা কোথাকার ?
ঃ তা বলতে পারি না । পুরাতন ভাংগা জিনিস-পত্র বেচে এমন দোকান থেকে সংগ্রহ করেছি ।
ঃ সেলসম্যান মুর্তিটা আলমারীর উপর থেকে নামিয়ে শফিকের হাতে দিয়ে বলল,…
…আর যাই বলুন মুর্তিটা যেই বানিয়েছে, সে খুবই দক্ষ কারিগর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই।
শফিক হালকা মাথা নেড়ে সহমত প্রকাশ করল ।
ঃ শফিক মুর্তিটা কিনে নিয়ে এল। এনে শোয়ার ঘরের ড্রেসিং টেবিলে রেখে দিল।
রেখে মুর্তিটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ভাবল’ এটা যদি একফুট না হয়ে যদি মানুষ সমান হত তাহলে যে কেউ জীবন্ত নারী ভাবত।
বেশি চিন্তা করার সময় পেল না হঠাৎ মনে পড়ে গেল কাল রিজিয়া বাবার বাড়ি থেকে চলে আসবে। ঘরে কোন বাজার নাই ।
বাজারে যেতে হবে নিজের জন্য রাতের খাবার রান্না করতে হবে।
বাজার করে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করতে প্রায় রাত বারটা বেজে গেল। কাল আবার অফিসে যেতে হবে । সে তাড়তাড়ি শুয়ে পড়ল।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল আজকে কেনা নারী মুর্তিটার কথা । কাল রিজিয়া এসে মুর্তিটা দেখলে খুব খুশি হবে।
ওর মত খুত খুতে মেয়েও বলতে বাধ্য হবে এরকম শো পিস হাজারেও একটা পাওয়া যায় না।
শফিকের ঘুম পাতলা, তাই ঘরের ভিতর হালকা ধুপ করে শব্দ হতেই ঘুমটা ভেংগে গেল।
মাত্র কিছুক্ষন আগে দুচোখে গভীর ঘুম জড়িয়ে এসেছে তাই, হঠাৎ ঘুম ভেংগে যাওয়ায় বুঝে উঠতে পারছে না কিসের শব্দ হল।
ডিম লাইটের হালকা নীলাভ আলোয় ডুবে আছে রুমটা। দুচোখ খুলে কান পেতে থাকল আবার কোন শব্দ শোনা যায় কিনা ।
না শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করল, বেলী ফুলের তীব্র ঘ্রানে পুরো ঘরটা ভরে গেছে । শফিক অবাক গেল ।
দুচোখে লেগে থাকা ঘুমের রেশ চট করে কেটে গেল । ওর সব ইন্দ্রয় পূর্ণ সজাগ হয়ে গেল ।
এই সময় ঘরের ভেতর শুনতে পেল নারীর হাতের চুড়ির আওয়াজ।
আস্তে করে বালিশ থেকে মাথা তুলে ড্রেসীং টেবিলটার দিকে তাকাতেই দেখল টেবিলটাকে আড়াল করে আছে এক নারী।
গাঢ় নীল রংয়ের শাড়ি পড়া, ঘন কালো লম্বা চুলের গোছা সামনে ভারী বুকের উপর বিছানো।
দুহাতে স্বর্ণের বালা, গলায় স্বর্ণের বিশাল একহার যা বুকের গভীর উপত্যকাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে ।
ত্রি-ভংগিমায় দাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিট হাসছে।
নারীটাকে দেখা মাত্রই শফিকের কলজেটা ধক করে বুকের পাজরে সজোরে ধাক্কা খেল ।
ভয়ে নয় নারীর অসহ্য অপরুপ রুপের কারনে। কোন নারী এত রুপসী হতে পারে ভাবাই যায় না ।
যেন কোন গুনি শিল্পী নিজ হাতে আপন মনে বানিয়েছে অপার্থিব সৌন্দর্য দিয়ে। ও প্রায় লাফ মেরে শোয়া থেকে উঠে বসল।
ঃ কে আপনি ? কোথ্থেকে এসেছেন ? কিভাবে এসেছেন ? কেন এসেছেন ?
নারীটি এতক্ষন শফিকের কার্যকলাপ দেখছিল। যা সে প্রতিবারই উপভোগ করে।
নারীটি এবার নড়ে উঠল। বুকের উপড় বিছানো চুল গুলো পিছনে ছড়িয়ে দিল।
নারীটি নড়ে উঠাতেই সারা কামরায় বেলী ফুলের তীব্র ঘ্রানে ভরে গেল।
এতে শফিকের মাথার ভিতরটা কেমন যেন ফাকা হয়ে গেল। নারীটির গভীর কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে সম্মোহীত হয়ে পড়ল।
নারীটি যেন বাতাসে ভেসে এল। শফিকের সামনে এসে বসল।
নারী বললঃ আমি কুন্তলা । ভাওয়াল জমিদার কৃষ্ণকান্ত রায়ের প্রিয়তমা স্ত্রী ।
শফিক কম্পিত স্বরে বলল…
ঃ আপনি এখানে কেন এসেছেন ?
মেয়েটি কোমল হাতে শফিকের হাত দুটি ধরে বলল “আমি আসিনি”তুমিই আমায় এনেছ। আজ তুমি যে মুর্তিটা কিনে এনেছ সেই-ই আমি।
শফিক নিজের অজান্তেই হা হয়ে গেল।
ঃ আমি এখানে কেন এসেছি সেই কথা জানতে চাও ? শোন তাহলে ।
….আমি চারশো বছর আগে এই দেহে এই রুপে ভাওয়ালরের জমিদার কৃষ্ণকান্ত রায়ের প্রিয়তমা স্ত্রী ছিলাম।
জমিদার আমাকে খুব ভালবাসত আমিও জমিদারকে খুব ভালবাসতাম । তখন পৃথিবীটাকে মনে হত স্বর্গ ।
সে আমাকে ছেড়ে এক দন্ডের জন্য কোথাও যেত না । এই কারনে ওর আত্মিয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সব দুরে সরে গেল।
জমিদার এতে এতটুকুও বিচলিত হলো না। কারন তার রাত-দিনের ধ্যান এ ধারনা ছিলাম আমি শুধু , আমি কুন্তলা।
কিন্তু এত ভালবাসা এত সুখ বেশি দিন থাকল না । হঠাৎ করে আমি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলাম ।
সেই ব্যাধিতে আমার রুপ-লাবন্য সব হারিয়ে গেল। আমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম ।
আমার এই অবস্থায় কৃষ্ণকান্ত রায় পাগলের মত হয়ে গেলেন দেশ বিদেশের যত হেকিম কবিরাজ ছিল সবাইকে এনে দেখাতে লাগল।
ওরা সবাই এসে নিরাশার কথাই বলত। এর মধ্যে একদিন কে যেন বলল মুণি-ঋষিদের দেখাতে জমিদার তাও করল।
আরেকদিন আরেকজন বলল পীর-দরবেশ দেখাতে । তাও দেখানো হল । এত কিছুর পরও কিছুতেই কিছু হল না।
মৃত্যুর দুয়ারে আমার এগিয়ে যাওয়া কিছুতেই থামানো যাছ্ছেনা।
আমার জন্য এসব করতে যেয়ে কৃষ্ণকান্ত রায় তার জমিদারীর বেশির ভাগ খরচ করে ফেলল।
এসব নিয়ে দৌড়াদৌড়ি আর চিন্তা করতে যেয়ে নিজেও অসুস্থ হয়ে যেতে লাগল । তারপর সে ক্ষ্যান্ত দেয়নি ।
সারাদিন আমার চিকিৎসার জন্য ছুটে বেড়াতেন রাত হলে আমার পাশে বসে আমাকে সান্তনা দিতেন
ঃ কুন্তলা তোমাকে আমি যে করে হোক যমের কাছ হতে ফিরিয়ে আনবই । কোন শক্তিই তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা ।
তুমি চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে বাচব ?
আমি শুনতাম আর দুচোখের জল ফেলতাম । এভাবেই কাটছিল আমাদের বিষাদের বিদায়ি দিন গুলো ।
এর মধ্যে একদিন কৃষ্ণকান্ত রায়ের এক দারোয়ান এসে বললঃ মহাশয় যদি অভয় দেন তাহলে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
ঃ বল।
ঃ আমাদের গ্রামে এক কাপালিক আছে অদ্ভুত তার চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু ধনন্তরি ।
ওর কাছে গিয়ে কেউ ভাল হয়নি এমনটা শুনিনি। আপনি যদি চান তাহলে…….।
দারোয়ানের কথা শুনে জমিদার যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন ।
ঃ এতদিন এই খবরটা দিসনি কেন ? আমি পাগলের মত পথে প্রান্তরে দৌড়াছ্ছি আর তুই মজা দেখছিলি।
জমিদারের রাগ দেখে দাড়োয়ান কাপতে কাপতে বলল
: মহাশয় অপরাধ নেবেন না ওর চিকিৎসা পদ্ধতি একটু অন্য রকম বলে আপনাকে এতদিন ভয়ে বলিনি।
সেদিনই কাপালিককে নিয়ে আসা হল। প্রায় ছয় ফুট লম্বা কালো রংয়ের হ্যাংলা পাতলা দেহের মানুষ।
মাথা ভরা কোকড়া চুল, চোখ দুটো টকটকে লাল ।
কাপালিককে আমার কামরায় নিয়ে আসা হল । সে আমার পাশে এসে দাড়িয়ে কিছুক্ষন আমাকে নিরক্ষণ করল ।
তারপর আমার দুই চোখের মাঝখানে বাম হাতের বুড়ো আংগুলটা চেপে ধরে অনুচ্চস্বরে কি যেন পড়ল ।
তারপর আমার কামরা থেকে সোজা বের হয়ে গেল।
জমিদার আমার অন্য পাশে দাড়িয়ে ছিল। কাপালিকের সাথে সাথে সেও বের হয়ে গেল।
জমিদার উৎকন্ঠা নিয়ে জিগ্গাসা করল।
ঃ কাপালিক কেমন দেখেছ ?
ঃ কর্তা এই রোগীকে পৃথিবীর কেউ বাচাতে পারবে না ।
কাপালিকের কথা শুনে জমিদার কৃষ্ণকান্তর আশা জাগা মুখখানিতে কে যেন কালো ছোপ একে দিল।
সেদিন রাতে জমিদার আর আমার কাছেও এল না। সারারাত চিলেকোঠায় বসে কাটিয়ে দিয়েছে।
দাসীদের জিগ্গাসা করলামঃ তোদের জমিদার বাবু কোথায় ?
ঃ কর্তা বাবু চিলে কোঠায় চুপচাপ বসে আখি জল বিসর্জন করছেন।
আমারও দু আখিতে নেমে এল নোনা জলের ধারা।
সেদিন মধ্য রাতে আবার সেই দারোয়ান এল। জমিদার বাবুকে বললঃ কর্তা কাপালিক এসেছ , আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চায় ।
কাপালিক আসার কথা শুনে জমিদার খুশি হয়ে গেলেন।
মনে করলেন কাপালিক হয়ত এমন কোন ঔষধ পেয়েছে যার দ্বারা আমাকে বাচানো যাবে।
ঃ ওকে এই চিলেকোঠায় নিয়ে এস।
দারোয়ান কাপালিককে চিলে কোঠায় পৌছে দিয়ে চলে যেতেই জমিদার জিগ্গাসা করলঃ বল কাপালিক কোন আশার বাণী আছে কিনা।
ঃ না জমিদার তেমন কোন আশা বাণি নাই তবে………
এইটুকু বলে কাপালিক চুপ হয়ে যেতেই জমিদার বললঃ থামলে কেন বল।
ঃ কর্তা আপনি যদি চান বউঠাকরুন কে অন্য ভাবে বাচিয়ে রাখা যায়।
জমিদার কাপালিকের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন , “অন্য ভাবে মানে ?
ঃঅন্য ভাবে বলতে বউ ঠাকরুন বেচে থাকবেন , তবে এই দেহে নয়। অন্য জায়গায়।
ঃ কাপালিক বুঝিয়ে বল কারন আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ।
ঃ কর্তা প্রথমে নিয়ম মত ঠিক বউ ঠাকরুনের মত একটা মুর্তি বানাতে হবে।
তারপর সেই মুর্তিতে বৌ-ঠাকরুনের আত্মাকে একটা যগ্গের মাধ্যমে দেহ থেকে বের করে অধিষ্ঠান করাতে হবে।
ঃ কিন্তু তাতে কি হবে ? আমিতো ওকে এই রক্ত মাংসের জীবন্ত নারী হিসেবে পাব না।
ঃ না কর্তা পাবেন , তবে তা সব সময়ের জন্য নয়।
ঃ তাহলে ……..
ঃ প্রতি বার বছর পর পর শুধু এক রাতের জন্য বৌ ঠাকরুনকে পাবেন, অপুর্ব সুন্দরী সুস্থ-স্বাস্থ্যবান প্রান চান্চল্য ভরপুর নারী হিসেবে ।
যে নারী আপনাকে সারা রাত দেবে স্বর্গসুখের অনুভূতি। কিন্তু ……
ঃ কিন্তু কি ?
ঃ যেই দিন বার বছর পার হবে সেইদিনই উনার পান করার জন্য একজন যুবকের দেহের তাজা রক্ত লাগবে।
যদি যুবকের রক্ত না পায় তাহোলে আগামী বার বছর পর বৌ-ঠাকরুন আর দেহ ধারন করতে পারবে না।
কাপালিকের কথা শুনে জমিদার কৃষ্ণকান্ত হতভম্ব হয়ে গেলেন ।
কাপালিক জমিদারের অবস্থা দেখে বললঃ কর্তা এ ছাড়া বৌ-ঠাকরুনকে বাচানোর আর কোন উপায় নাই । আপনি ভেবে-চিন্তে আমাকে খবর দেবেন।
জমিদার সারারাত আর ঘুমাতে পারল না। পরদিন সকালে কাপালিককে ডেকে পাঠাল।
কাপালিক জমিদারের আদেশ পেয়ে দুই দিনের মধ্যে ঠিক আমার মত দেখতে এক ফুট লম্বা এই মূর্তিটা বানাল।
অমাবশ্যার রাত। নিকষ কালো অন্ধকারে সারা পৃথিবী ডুবে আছে।
অপার্থিব ফিসফিস শব্দ বাতাসের সাথে মিশে হাহাকার করে উঠছে নির্জন প্রান্তর , শ্মশান আর ছাড়া বাড়ির পরতে পরতে।
সেইদিন মধ্য রাত পেরিয়ে গেলে জমিদার বাড়ি থেকে বের হলাম আমরা তিনজন। কাপালিক, জমিদার ও আমি ।
আমি অসুস্থ তাই জমিদার কৃষ্ণকান্ত আমাকে পাজাকোলা করে নিয়েছে। আমরা তিনজন চলছি শ্মশানের দিকে।
কাপালিকের এক হাতে একটা হ্যারিকেন অন্য হাতে দুইটা দড়িতে বাধা দুটি ছাগল একটি সম্পূর্ন সাদা একটি সম্পূর্ন কালো , আর কাধে একটা ঝোলা।
চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার হারিক্যানের আলোকে যেন চেপে ধরেছে।
কতক্ষন মেঠো পথ কতক্ষন জমির আইল উপর দিয়ে হাটতে হাটতে এক সময় নদীর পাড়ে এক শ্মশানে এসে পৌছলাম।
আমাকে এনে শ্মশানের মধ্যখানে আগে থেকে রাখা একটা খাটিয়ার শোয়ানো হল। খাটিয়ার চারপাশে মাটির প্রদীপ জ্বালানো হল।
প্রদীপগুলো শিয়ালের চর্বিতে জ্বলছে। কাপালিকের কাধে ঝোলানো থলে থেকে মাটির মুর্তিটা বের করে আমার মাথার দিকে রাখল।
এরপর খাটিয়া থেকে অনেকটা দুরে মাটিতে একটা গোল দাগ দিয়ে জমিদারকে বলল
: আপনি এখানে বসে থাকুন সাবধান যাই কিছু ঘটুক এই গোল দাগ থেকে বের হবেন না । এখান থেকে বের হলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য ।
তারপর সাদা পাঠাকে আমার মাথার দিকে আর কালো পাঠাটাকে আমার পায়ের দিকে বাধল।
এরপর ঝোলা থেকে নানা ধরনের উপকরন বের করে সাজিয়ে রাখল । সাজানো শেষ করে এবার মন্ত্র পড়া শুরু করল।
কাপালিক মন্ত্র পড়া শুরু করতেই স্মশানের শান্ত আবহাওয়াটা হঠাৎ করে বদলে গেল ।
চারদিক থেকে শো শো শব্দে হিমেল বাতাস শ্মশানের বুকে আছেড়ে পড়তে লাগল ।
অমাবশ্যার নিকষ অন্ধকারের আরও অন্ধকার যেন ছেয়ে গেল ।
চারদিক থেকে অশরীরি আত্মারা এসে আমার পাঠখড়ির মত দেহটাকে ছিড়ে-ফেড়ে খাওয়ার জন্য অপার্থীব চিৎকার দিতে লাগল।
না পেরে ওরা জমিদারকে দেখে ওদিকে এগিয়ে গেল। জমিদার কাপালিকের মন্ত্র পড়া গোল দাগের ভিতর থাকায় কিছুই করতে পারল না ।
কাপালিক মন্ত্র পড়তে পড়তে আমার মাথার দিকের সাদা ছাগলটা জবাই করে রক্তটুকু একটা পাত্রে নিল,
…তারপর কালো ছাগলটা জবাই করে আগের পাত্রে এর রক্তটুকুও নিল।
ছাগল গুলো জবাই করে রক্ত নেওয়ার পর কাপালিক যখন মৃত দেহগুলো ছুড়ে ফেলে দিল তখন….
পিচাশ আত্মাগুলো ছাগলের দেহ মাটিতে পড়ার আগেই শূণ্য থাকতে ছিড়ে-ফেড়ে খেয়ে ফেলল।
কাপালিক রক্তের পাত্রে আরও কিছু উপকরন মিশিয়ে নিল।
তারপর আমার মাথার চুল ধরে এক টান দিয়ে, আমি ছয় মাসের রোগীকে খাড়া করে ধরল ।
এরপর পাত্রের রক্ত গুলো মন্ত্র পড়তে পড়তে আমার মাথার উপর ঢেলে দিল।
আমার গায়ে রক্ত পড়ার সাথে সাথে আমার মনে হল আমি সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে গেছি ।
আমার দেহে যেন অসুরিক শক্তি ভর করল । কাপালিকের হাত থেকে ছুটার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলাম ।
কিন্তু কাপালিকের শক্তির সাথে পেরে উঠলাম না।
কাপালিক এবার উচ্চ স্বরে মন্ত্র পড়তে পড়তে হঠাৎ করে থেমে গেল। এবার বললঃ কুন্তলা বের হয়ে আয় । কুন্তলা বের হয়ে আয় ।
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমার আত্মাটা আমার দেহ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে ।
তারপর আত্মাটা দেহ থেকে বের হতেই , কাপালিক আমার দেহটাকে ছুড়ে ফেলে দিল।
পিচাশরা আমার আত্মাবিহীন দেহটা পেয়ে সাথে সাথে টুকরা টুকরা করে খেয়ে ফেলল। আমি সবই দেখতে পাছ্ছিলাম কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।
কাপালিকের মন্ত্র বলে আমি হয়ে গেছি কাপালিকের দাসি। আমার আত্মাটা একটা অদৃশ্য দৈহিক আকৃতি নিয়ে কাপালিকের ডান হাতের মুঠায় ধরা ছিল।
কাপালিক এবার একহাত আমার আকৃতির মুর্তিটা বাম হাতে নিল।
মন্ত্র পড়তে পড়তে মূর্তিটা আমার আত্মার সাথে ধরতেই আমি মুর্তিটার অভ্যন্তরে বন্দি হয়ে গেলাম।
আমি মুর্তির ভিতর প্রবেশ করতেই চারদিকের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে গেল। পিচাশ আত্মাগুলো চলে গেল।
কাপালিক এবার তার জিনিসপত্র গুলো থলেতে ভরে , থলেটা কাধে ঝুলিয়ে নিল। তারপর জমিদারের দিকে এগিয়ে গেল ।
দেখতে পেল জমিদার কৃষ্ণকান্ত ভয়ে বেহুশ হয়ে গোল দাগের ভিতর পড়ে আছে।
কাপলিক এক হাতে মুর্তি অন্য হাতে জমিদারকে কাধে নিয়ে শশ্মান থেকে বের হয়ে গেল।
সকালে মুর্তিটা জমিদারের হাতে দিয়ে বলল, “কর্তা, এই নিন বৌ-ঠাকরুনকে ।
মনে রাখবেন ঠিক বার বছর পর পর বৈ-ঠাকরুন এক রাতের জন্য দেহ প্রাপ্ত হবেন এবং সেই রাতে,
উনার জন্য অবশ্যই একজন যুবকের দেহের রক্ত লাগবে।
এরপর কাপালিক চলে গেল ।
এই ঘটনার কয়েক বছর পর জমিদার কৃষ্ণকান্ত আমার বিরহে পাগল হয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল।
সারা বাড়ি আগুনে পুড়ে গেলেও আমার কিছুই হল না কারন আমি জমিদসারের হাতে ছিলাম। এর কিছুদিন পর জমিদার কৃষ্ণকান্ত মারা গেল।
এরপর আমাকে তার এক আত্মিয় পায় । আমার এই ব্যাপারটা এতই গোপনে হয়েছিল যে কেউই জানত না।
আত্মিয়টা আমার মুর্তিটাকে খেলার পুতুল মনে করে তার মেয়েকে দেয় । তার মেয়ে বড় হয়ে বিয়ের পর আমাকে সাথে করে তার শ্বশুর বাড়ি যায়।
সেখানে এক বছর পর আমার বার বছর পূর্ণ হয় ।
বার বছর পূর্ণ হওয়ার দিনই আমি রক্ত-মাংসের দেহ ধারন করে , তার যুবক স্বামির রক্ত পান করি।
সেই হতে চারশ বছর পর আজ আমি তোমার ঘরে । গতবারের পর আজই আমার বার বছর পূর্ণ হয়ে আজ দেহ ধারন করার রাত ।
তাই আজ যেভাবেই হোক আমার জীবিত মানুষের রক্ত পান করতে হবে। তানা হলে আগামী বার বছর পর আমি আর দেহ ধারন করতে পারব না।
এসো প্রিয় আজ তুমি আমাকে জীবন দান করবে।
অপরূপ সুন্দরী নারীটি শফিককে বুকে টেনে নিল।
পরদিন রিজিয়া বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেখকে বিছানায় শফিকের রক্তাত্ত লাশ আর ড্রেসীং টেবিলের উপর অপরূপ সুন্দর একটি নারী মুর্তি ।