আমার প্রাইভেট টিউটর মানুষটা যে ভালো নয় সেটা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।
কিন্তু কাউকে বলার প্রয়োজন বোধ করিনি। আমি থাকি একটা মেসবাড়িতে। দু তলা একটা বাড়ি, চারটা করে ইউনিট। একটা রুম, একটা এ্যাটাচড বাথরুম আর একটুখানি ছোট রান্নার জায়গা।
একা একা থাকার জন্য বেশ ভালোই, ভাড়ার অঙ্কটাও কম। মেয়েদের ভাড়া দেয়ার জন্যই
এভাবে তৈরি করেছেন বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। কলেজ তো কাছেই। এসএসসি দিয়ে
ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য বাড়ি থেকে এতটা দূরে চলে এসেছি। একা একা থাকছি। কেউই
ভালো চোখে দেখেনি। প্রথম থেকেই কারোর মত ছিলো না যে আমি এখানে আসি। তবু্ও আমি
জোর করে এসেছি, গণ্ডগ্রামে থেকে পড়ালেখা সম্ভব নয়। আর বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকবে
দুদিন পরপর। মা নেই, সারাদিন ব্যস্ত থাকে বাবা। আমার খেয়াল রাখার সময় কোথায়! আর
পিসি তো এমনিতেই ভুলে যাওয়ার রোগী। পানের বাঁটা থেকে পান খেয়ে কোথায় রেখেছে
মনে করতে পারে না। বাবা একা সামলাতে পারবে না। আর গ্রাম বলে যে বখাটে ছেলে নেই তাও নয়। একবার তো দিনদুপুরে বাজারের রাস্তায় একটা ছেলে বাজে কথা বলেছিলো।
আমি তাকে তখন কিছুই বলিনি। তবে পরেরদিন সকালে তাকে বিবস্ত্র অবস্হায় বাজারের ঠিক
মাঝখানে আলম চাচার দোকানের সামনে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো।
কিভাবে তার ঐ অবস্হা হয়েছিলো কেউ জানে না, আমিও কাউকে বলিনি। কিছু কিছু জবাব
কথায় নয়, কাজে করে দেখিয়ে দিতে হয়।
আমার প্রাইভেট টিউটর একদিন পড়ানোর সময় ইচ্ছে করে আমার গায়ে হাত দিলেন। আমি কিছুই
বললাম না। উনি আমাকে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি পড়ান। সম্ভবত আমাকে দেখেই ওনার পছন্দ
হয়, মেধা উনি যাচাই করেননি। ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের স্টুডেন্টদের এত কম টাকায় এমনি
এমনি কেউ পড়ায় না।
ওনার নাম ছিলো সুমন। কিন্তু সু- মন তার ছিলো না। বিকৃত মস্তিষ্ক ধরনের মানুষ। সুবিধাবাদী।
উনি যখন জেনেছিলেন আমি একা একা মেসবাড়িতে থাকি তখন ওনার চোখ চকচক করে
উঠছিলো।
এরকম চকচকে চোখ ছিলো মোতালেব চাচার।পুষ্প নামের ১৩ বছর বয়সী মেয়েটাকে দেখে
ওনার ৫৬ বছর বয়সী চোখ চকচক করতো। মেয়েটা পড়ালেখায় ভালো ছিলো, দেখতেও সুন্দর।
দুরন্ত মেয়েটা রোজ বিকেলে খেলতে যেতো। একদিন বিকেলে খেলতে যাবার পর থেকে পুষ্পকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। সারারাত বাড়ি ফিরলো না মেয়েটা। পরেরদিন বিকেলে খালপাড়ে ঘাসের ভেতর তার লাশ পাওয়া গেলো। আমি দেখতে গেলাম। দেখে মনে হচ্ছিলো জন্তু জানোয়ার খুবলে খেয়েছে ওর শরীর। রক্তাক্ত চারিদিকে।
জামাকাপড় শতচ্ছিন্ন। আমার বয়স তখন মাত্র ন’বছর। কিভাবে ঐ দৃশ্য সহ্য করেছিলাম নিজেও
জানিনা। কিন্তু এখনো শিউরে উঠি। পুষ্পর কথা আমার এখনো মনে পড়ে।যদিও মনে না পড়ে
উপায় নেই। আমার চে চার বছরের বড় হলেও ও আমার সাথে খুব মিশতো। তুই তোকারি করে কথা বলতাম। যেনো আমরা দু-বোন। আমড়া মাখা বানালে আমাকে না দিয়ে ও খেতো না। গরমকালে আমি ওর পিছুপিছু আম কুড়োতে যেতাম। সেই মেয়েটা আমাকে একা ফেলে চলে গেলো! আমি মানতে পারিনি। তিনদিন আমি কারো সাথে কথা বলিনি, আব্বুর সাথেও না। তারপর একদিন পুষ্পকে স্বপ্নে দেখলাম। একটা পাতলা সুতির জামা পরে থরথর করে কাপছে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে রক্তাক্ত অবস্হায় ঐ সাদা জামাটা ওকে পরে থাকতে দেখেছিলাম।
যদিও তখন রংটা হয়ে গিয়েছিলো সাদার বদলে লাল।
পুষ্প খুব কষ্ট নিয়ে আমাকে বলছিলো, জানিস ফাইজা আমাকে কোনো জানোয়ার খেয়ে
ফেলেনি। সবাই ভুল ভাবছে… মোতালেব চাচা আমাকে সেদিন ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো….
ওর কথা শুনতে গিয়ে স্বপ্নের মধ্যেও আমি ছটফট করছিলাম। ঘেমে উঠছিলাম। ঘামে বিছানাও
ভিজে জবজব করছিলো। আমি মরুভূমির তৃষ্ণার্ত পথিকের মত ওর কথা শুনছিলাম…বারবার গলা
শুকিয়ে আসছিলো।
ও বলছিলো, মোতালেব চাচা আমাকে কোথায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো জানিস? ওর
বাড়িতে… চাচী নেই তো বাড়িতে। তা তো আমি জানতাম না, কি বলেছিলো আমায় জানিস?
চাচী নাকি তেঁতুলের আচার বানিয়েছে, আমায় ডেকেছে। তুই তো জানিস বল আমার কত পছন্দ
ছিলো তেঁতুলের আচার। আমি লোভ সামলাতে পারিনি। ভেবেছি চাচী অপেক্ষা করছে আমার
জন্য। কিন্তু গিয়ে দেখি চাচী নেই…বাড়ি ফাঁকা।
কথাগুলো পুষ্প বলেছিলো স্বাভাবিকভাবেই। তারপরই ওর গলার স্বর বদলে যেতে লাগলো । ও
কাঁদতে লাগলো। আমি স্বপ্নের মধ্যেও ওর কান্নাকে একদম বাস্তবের মত দেখতে পাচ্ছিলাম।
মনে হচ্ছিল ও আমার সামনেই আছে। চাচা আমাকে ডেকে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। আমি বললাম, চাচা… চাচীকে তো দেখছি না। চাচী কি পাকঘরে? আমি যাই উনার কাছ থেকে আচারের বাটি ভরে নিয়ে আসি। কিন্ত জানিস? চাচা না আমাকে যেতে দিলো না, আটকে দিলো। তারপর তারপর….
পুষ্প কাঁদতে শুরু করলো। ওকে আমি কাঁদতে দেখিনি কখনো। একটা ন’বছর বয়সী মেয়ের জানার
কথা নয় যে সে কেনো কাঁদছে। কিন্তু তখন আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে মোতালেব চাচা
লোকটা ভালো নয়, খুব খারাপ… অনেক বেশি খারাপ। আর খারাপ মানুষদের শাস্তি পেতে হয়।
মোতালেব চাচার শাস্তি হয়েছিলো। কিভাবে হয়েছিলো না হয় অন্য একদিন বলব…
প্রথম প্রথম পুষ্পকে শুধু স্বপ্নেই দেখতে পেতাম। তারপর একদিন হঠাৎ দেখলাম ও আমার ঘরে
বসে আছে। বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে । ও যখন বেঁচে ছিলো এটা ছিলো ওর খুব প্রিয় একটা
কাজ। আমার ওকে দেখে ভয় পাবার কথা ছিলো, জীবিত মানুষেরা মৃতদের দেখে ভয় পাবে
এটাই নিয়ম। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হলো উল্টোটা। ওকে দেখে আমি প্রচণ্ড খুশি হলাম। ওকে
জড়িয়ে ধরতে গেলে ও আমাকে ধমক দিলো।
“এ্যাই পাগলী, করছিস কি? মরা মানুষের কি শরীর আছে নাকি যে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিস? ”
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। ও সাদা জামাটাই পরে এসেছিলো। ওর বোধহয় অন্য
কোনো জামা নেই। অথবা ও যেখানটায় থাকে সেখানে কাপড়ের ব্যবস্হাই নেই। তারপর থেকে
ওকে প্রায়ই এখানে সেখানে দেখতাম। কখনো ঘরে, কখনো খেলার মাঠে। মাঝে মাঝে স্কুলে
গিয়ে আমার পাশে দাড়িয়ে থাকত। তবে তখন ও আসতো অনেকদিন পরপর। এখন তো বলতে গেলে সারাক্ষণই আমার সাথে থাকে। আর আমারো এমন অভ্যাস হয়েছে যে ও না থাকলে ভালো
লাগে না।
যেমন কাল রাত্রিবেলা ভুঁইফোড়ের মত এসে হাজির হলো। কোনোরকম সূচনায় না গিয়েই বললো,
তোর মাস্টার টা ভালো না। কাল ওকে আসতে মানা করে দে। ও কিন্তু খারাপ মতলব নিয়ে
আসবে…
আমি মুচকি হেসে বললাম, তুই আছিস না সাথে? আমার কিচ্ছু হবে না….
সুমন স্যারকে কি শাস্তি দেব এখনো ভাবিনি। সালফিউরিক এসিড দিয়ে হাতটা পুড়িয়ে দিতে
পারি। আমার বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিলটাতে গ্লাস ভরা সালফিউরিক এসিড আছে।
পটাসিয়াম সায়ানাইড চায়ে গুলে খাইয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাতে উনি মারা যাবেন কিন্তু
তার সত্যিকার শাস্তি হবেনা।
এসব জিনিস আমার কাছে কিভাবে এলো তাও একটা বিস্ময় বটে। জাবেদ স্যার আমাকে
অন্ধস্নেহ করেন। এতবড় কলেজের কেমিস্ট্রি টিচার…চাইতেই পেয়েছি। স্যার একবারো প্রশ্নও
করেননি এগুলো দিয়ে আমি কি করব। স্যার জানেন যে আমি খারাপ কিছু করব না।
হ্যা…সুমন স্যারকে শাস্তি পেতে হবে। তিনি যে শুধুমাত্র আমার সাথে এরকম ব্যবহার করেছেন
তা নয়, অন্য অনেক মেয়েকেই তিনি অসম্মান করেছেন।
কিন্তু শারীরিক শাস্তি তার জন্য পর্যাপ্ত না, তাকে আমি মানসিক শাস্তি দেব।
সুমন স্যার জানতেন আজ মেসে বেশি কেউ নেই। দোতলায় তো আমি ছাড়া আর কেউই নেই।
কলেজ বন্ধ তাই মেস থেকে অনেকেই চলে গেছে ছুটিটা কাটিয়ে আসার জন্য।
স্যার আগেরদিন খোঁজখবর নিয়ে গেছেন। পুষ্প আমাকে বলেছিলো স্যারকে আসতে মানা করে
দিতে, আমি মানা করিনি। এই মুহূর্তে স্যার আমার সামনে বসে আছেন। পুষ্পকে দেখছি না…
প্রথমে স্যার স্বাভাবিকই ছিলেন! ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলাম স্যারের মুখভঙ্গি বদলে যাচ্ছে।
উনি ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন। খুব বড় ধরনের ঝুঁকির ভেতর যাবার আগে এরকমটা হয়। মস্তিষ্ক খুব দ্রুত কাজ করে। আমার কোনোকিছুই অনূভূত হচ্ছে না । আমি ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আমি অপেক্ষা
করছি। সুমন স্যার হঠাৎ বলে উঠলেন, “অতন্দ্রিলা…. এক গ্লাস পানি আনো তো…!”
আমি স্বাভাবিকভাবে উঠে গেলাম, পানির গ্লাসে পানি ভরলাম। তারপর পিছন ফিরতেই
দেখি স্যার দরজার ছিটকিনি আটকে দিচ্ছেন। আমি বেশ উঁচু স্বরেই বললাম, কী করছেন স্যার?
স্যার কোনো কথা না বলে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তারপর হঠাৎই আমাকে জাপটে ধরার
চেষ্টা করলেন। আমি নিজেকে এক ধাক্কায় ছাড়িয়ে নিলাম। সুমন স্যার আমার দিকে ফিরে তাকাতেই সপাটে তার মুখে একটা চড় কষালাম। চড়টা জোরেই লেগেছিলো। স্যারের মুখের ডানপাশটা লাল হয়ে গেছিলো। উনি হিংস্র হয়ে উঠছিলেন। আমি আশেপাশে তাকালাম, না পুষ্প আসেনি… বিপদের সময়েই ওকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সবটা আমাকেই সামলাতে হয়!
আমার মনোযোগ পুষ্পর দিকে ছিলো কিন্তু সুমন স্যার সেটা কাজে লাগালেন। উনি বাম হাতে
আমার ওড়নাটা টান দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলেন। আমি পুরোটা সামলানোর আগেই উনি
ধাক্কা দিয়ে আমাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে হাত চেপে ধরলেন।
পুষ্প এখনো আসেনি….
উনি জন্তুর মত শব্দ করছেন। উনি আমার কাপড় গুলো খুলে ফেলতে চাইছেন।আমার মোতালেব
চাচার কথা মনে পড়লো, উনিও কি পুষ্পর সাথে এমনই….
পুষ্প এসেছে! আমি এক ঝটকায় স্যারকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাড়ালাম। স্যার আমার দিকে
এগিয়ে আসছিলেন, আমি ওনার চোখের দিকে তাকালাম। আমি আমার সবটা শক্তি দিয়ে
ওনার চোখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছি….
আমার নীল চোখের দৃষ্টি কেউ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেনা। স্যারও পারলেন না। আস্তে
আস্তে ওনার চোখের হিংস্রতা কমে গেলো। উনি শান্ত হয়ে গেলেন। আমি স্বাভাবিক হলাম।
পুষ্প তখন পেছনে দাড়িয়ে হাসছে।
আমি ড্রয়ার খুলে একটা মোমবাতি বের করলাম। ওটা সবসময়েই আমার ড্রয়ারে থাকে,
ইমারজেন্সি দরকার হলে কাজে লাগে। আমি মোমবাতি টা জ্বালালাম। জ্বালিয়ে টেবিলে
উপর রাখলাম।
আমি বললাম, স্যার।
-হুঁ
আপনার বাম হাতটা এগিয়ে দিন।
উনি রোবটের মত বাম হাত এগিয়ে দিলেন! একটু আগে এই হাত দিয়ে উনি আমার ওড়না টেনে
ফেলে দিয়েছিলেন।
স্যার ওনার বাম হাত এগিয়ে দিলেন। মোমবাতির শিখায় ওনার হাতের তালু পুড়ে উঠলো।
কিন্তু উনি নির্বিকার। আসলে উনি তো এখন আর নিজের মধ্যে নেই। ওনাকে নিয়ন্ত্রণ করছি
আমি। উনি কিছু বলার, বোঝার ক্ষমতা এখন তার নেই।
স্যার? বাইরে বের হোন।
-হুঁ
স্যার বাইরের দিকে যেতে লাগলেন। ছিটকিনি খুলে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ওনার
দৃষ্টি সামনের দিকে। কোনো দিকেই তাকাচ্ছেন না উনি। কামিনীফুল গাছটার নিচে এসে
আমি ওনাকে থামতে বললাম। উনি থেমে গেলেন।
স্যার?
-হুঁ
শার্ট খুলে ফেলুন।
স্যার শার্ট খুলে ফেললেন, গেঞ্জী ও খুলে ফেললেন। আমি মার্কার পেন দিয়ে ওনার পিঠে বড়
বড় করে লিখলাম, “আমি মেয়েদের রেপ করতে চাই ”
স্যার?
-হুঁ
এখান থেকে সোজা হাঁটবেন। থামবেন না। বাড়ি চলে যাবেন। বুঝেছেন?
-হুঁ
আমি চলে যাবার পর সব কাপড় খুলে ফেলবেন। তারপর হাঁটতে শুরু করবেন। যান…
আমি চলে এলাম। পুষ্প বিছানার ওপর বসে খিলখিল করে হাসছে। আমি বললাম, পুষ্প তুই
হাসছিস?
পুষ্প হাসতে হাসতেই বললো, তোর মাস্টারটার এমনই হবার দরকার ছিলো হিহিহি। ঠিক কাজ
হয়েছে। হাতটা আগুনে পুড়িয়ে কাজের কাজ করেছিস। দেখবি এরপর আর কোনো দিন কোনো
মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। হিহিহি।
লোকে বলে ভুতেদের হাসি নাকি ভয়ানক হয়। কিন্তু পুষ্পর হাসি খুব সুন্দর…. অপার্থিব।
ও বললো, জানিস তো অতন্দ্রিলা… তোর এই নীল চোখের সামনে কেউ দাড়াতে পারে না। হিহিহি।
আমি ওকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, নীল চোখের জন্য? নাকি তুই আছিস তাই? বল তো আমায়….?
পুষ্প বললো, আমি কে? আমি কেউ নই। তোর কল্পনা। বুঝেছিস?
আমি বললাম, তুই আমার কল্পনাই যদি হবি তখন তুই…
আমার কথা শেষ হবার আগেই পুষ্প মিলিয়ে গেলো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। ও কোথাও
নেই।
আমি পড়ায় মন দিলাম। ইন্টার মিডিয়েটের আর একটা মাস বাকি…. এবার বোধহয় আমাকে
কোচিং ক্লাসেই জয়েন করতে হবে। যেটা আমার একদম পছন্দ না। সব টিচার রা খারাপ নয়,
কিন্তু তবুও আমার ঘৃণা ধরে গেছে। শিক্ষক শব্দটার সাথে একটা সম্মান, শ্রদ্ধা মিশে আছে।
তবুও এই নরপিশাচ গুলো শিক্ষকতার নামে নোংরামি কেনো বিলিয়ে বেড়ায়। জানা নেই…
কিন্তু তখন আমার ধারণাই ছিলো না পরেরদিন আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে….
“গতকাল সন্ধ্যায় দেখা মেলে এক নগ্ন যুবকের, বড় বাজারের ভেতর দিয়ে নগ্ন অবস্হায় হেঁটে
যাবার সময় স্হানীয় মানুষেরা এ দৃশ্যে বিস্মিত হয় এবং ভিড় জমে ওঠে। পরে পুলিশ এসে
পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। স্হানীয় থানার দারোগা বলেন যে, উক্ত যুবকের পিঠে কালো
কালি দিয়ে নানারকম লেখা ছিলো। ঐ যুবক কেনো ঐভাবে হাঁটছিলেন এবং তার সাথে ঐ
লেখার সম্পর্ক কি কিছুই জানা যায়নি। যুবক জ্ঞান ফেরার পর কিছু মনে করতে পারছেনা,
ডাক্তাররাও কিছু বলতে পারছেন না। বর্তমানে এলাকার মানুষের মধ্যে এক শঙ্কা বিরাজ
করছে। রহস্যের দ্রুতই সুরাহা হবে, বলেছেন স্হানীয় থানার দারোগা….”
রিয়ন ক্যান্টিনে বসে খবরের কাগজটা পড়েই যাচ্ছিলো। আমি চায়ের কাপটা নামিয়ে
রেখে ওকে থামালাম, “থাম তো আর পড়তো হবে না। বুঝেছি… ”
রিয়ন বললো, অবাক ব্যাপার দ্যাখ। এমনও হয়? কে যে করেছে এই কাজটা ভালোই করেছে।
নিশ্চই হারামজাদা খারাপ কিছু করেছিলো। তার শাস্তি পেয়েছে… বেশ হয়েছে।
আমি মুখে কুলুপ এটেছি।রিয়ন এ ব্যাপারে কিচ্ছু জানেনা। ওকে বলিনি কখনো। ওর মুখে
প্রশংসা শুনেও মু্খ বুজে হজম করে যাচ্ছিলাম। খবরের কাগজে সুমন স্যারের ছবিও বেরিয়েছে।
যদিও ঝাপসা…এরপর কি হয় কে জানে!
একই ঘটনাটা ঘটেছিলো সেই বখাটে ছেলেটার সাথে। সকালবেলা তো বাজে কথা
বলেছিলোই তারপর আবার সন্ধ্যাবেলা টিউশন করে ফেরার সময় আমার পথ আগলে
দাড়িয়েছিলো। ছেলেটা নেশাখোর ছিলো। বুঝতে পেরেছিলাম কারণ দূর থেকে দেখেছিলাম
লাল আলো। ছোট্ট কিন্তু স্পষ্ট বোঝাই যায় যে সিগারেট। কাছাকাছি আসতে বুঝেছিলাম যে
গাঁজা, হেরোইনেও ওর আসক্তি। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। তবে আমার নীল দৃষ্টির সামনে
বেশিক্ষণ সজ্ঞানে দাড়াতে পারেনি।
ছেলেটা যদিও আমার সাথে কিছুই করতে পারেনি, তবে ও কি করবে, কি করতে চায় তা আমি
ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। আগেও দেখছি অন্য মেয়েদেরকে উত্যক্ত করতে। আজ
রাস্তা ফাঁকা…. ওকে শাস্তি দেয়ার এর চে উপযুক্ত সময় আর কি হতে পারে। ভেবেছিলাম
চোখটা গেলে দেব কিন্তু ওর বাবা তেমন স্বামলম্বী নয় উপরন্তু বৃদ্ধ , একমাত্র ছেলে। যদি
শোধরায়…..তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরেরদিন বাজারের মাঝে আলম চাচার দোকানের
সামনে ওকে বিবস্ত্র অবস্হায় পাওয়া গিয়েছিলো। আচ্ছা অন্যের কাপড়ের ছিনিয়ে নেয়ার
আগে এরা একবারো ভাবে না যে তাদের নিজের কাপড়ও কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে? যাক,
সেসব অনেক পুরোনো কথা।
হঠাৎ দেখলাম তমা হেঁটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। সালোয়ার কামিজ, আর মাথায় হিজাব। আমার
ভালো লাগলো, এই মেয়েটা এমন ছিলো না। ওভার স্মার্টনেস আর অতিরিক্ত মর্ডান হবার
প্রবণতা ওকে ঘিরে ধরেছিলো। আর উগ্রতা তো ছিলই।
মজার ব্যাপার হলো ওর সাইফের সাথে ওর খুব ফ্রেন্ডলি রিলেশন ছিলো। সাইফ ছেলেটাকে
আমি পছন্দ করতাম না। তমার সাথে ওর বন্ধুত্ব টা একটু কেমন যেনো ছিলো। কথায় কথায় গায়ে
গড়িয়ে পড়া, রাতের বেলা পার্টিতে একসাথে যাওয়া । কিন্তু তমাকে ভালোবাসতো অন্য
একটা ছেলে। মাহিম। গোবেচারা ধরনের ছেলে। তবে মেধাবী। তমাকে কখনো সাহস করে
বলতেও পারতো না। কারণ তমা যেমন মেয়ে মাহিমকে তার জীবনে জায়গা করে দেবে তা
মাহিম ভাবেইনি।
একসময় তমা বলে ও নাকি সাইফকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু সাইফের আচরণ আমাকে
বলতো তমার প্রতি ওর আকর্ষণ টা শারীরিক, মানসিক না।
একদিন পুষ্প হঠাৎ আমাকে বললো, ” তমাকে বল সাইফকে ছেড়ে আসতে। সাইফ শুধুমাত্র নিজের
সুবিধার কারণে তমাকে ব্যবহার করছে মাত্র….”
তমাকে আমি বুঝিয়েছিলাম। ও বুঝেছিলো। যেদিন থেকে তমা পার্টিতে যাওয়া বন্ধ করে
দিলো, হ্যাংআউটে ওকে খুঁজে পাওয়া যেতো না সেদিন থেকে সাইফের ওর প্রতি
এ্যাট্রাকশন কমে যেতে লাগলো। তমার ড্রেস আপ বদলে যেতেই সাইফের ওকে আনস্মার্ট বলে
মনে হতে লাগলো। আমি নিজেই দেখলাম কিভাবে সাইফ তমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
তমা এখন ভালো আছে। মাহিম ওকে ভবিষ্যতেও ভালো রাখবে আমি জানি। তমাকে একটা
কথাই বলেছিলাম, “স্মার্টনেস কখনো ড্রেস আপ থেকে বা অতিরিক্ত মর্ডান হবার চেষ্টা
থেকে আসে না। সেটা আসে মন থেকে। নগ্নতা যদি ফ্যাশন হতো তাহল সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটিই
হতো সবচেয়ে আধুনিক। ”
রিয়ন হঠাৎ হাতে তুড়ি মেরে বললো, কি রে কি এতো ভাবছিস?
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, না না কিছু না। তোর পড়া কতদূর?
-পড়া তো শেষই…এক্সামটা হয়ে গেলে বাঁচি। আর তো একটা মাস….
ভেবেছিলাম কোচিং ক্লাসেই জয়েন করব। কিন্তু দুদিন পর হঠাৎ করে পুষ্প এসে সবটা উল্টে
পাল্টে দিলো।
অতন্দ্রিলা…. শোন।
– কি?
তোকে কোচিং ক্লাসে যেতে হবেনা।
– তাহলে কি করব?
তোর ঐ বাজে মাস্টার কে ডেকে নিয়ে আয়।
– মানে?? কি বলছিস এসব তুই?
সেদিনের পর ওর টিউশনগুলো চলে গেছে। আর জানিস ওর মা না খুব অসুস্হ….
– তুই কি করতে বলছিস?
ওকে নিয়ে আয়। ও ভালো হয়ে গেছে। আর আগের মাসের বেতনটাও তো তুই দিসনি এখনো।
টাকাগুলো তো তোলা আছে। দিয়ে দিস। আর একটা মাসই তো…
পুষ্পর কোনো কথা আমি কখনো ফেলিনি । জানিনা এই পাগল ভুতটার মাথায় কখন কি চলে। তবুও
আমি সুমন স্যারের বাড়িতে গেলাম তাকে বলতে যে টিউশনটা আমি ছাড়ছি না।
ঢুকতেই ধাক্কামত খেলাম। ঘরের ভেতর একটা মহিলা শুয়ে আছে। বিছানাটা নোংরা। উনি
বোধহয় স্যারের মা। বয়স আর কত….পঞ্চাশ একান্ন হবে হয়তো। স্যারকে ক্ষমা করা যায়না
কিন্তু তার মা তো কোনো দোষ করেননি। বিনা চিকিৎসায় তিনি পড়ে থাকবেন সেটা আমি
চাইনা। আর আমি জানি স্যারেন বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন কেউ তার পাশে থাকবে না এখন।
ব্যাপারটা যথেষ্ট জানাজানি হয়েছে।
স্যার বাড়ি ছিলেন না। আমি চুপচাপ বসে রইলাম একটা ফোম ছেড়া চেয়ারে। স্যারের অবস্হা
খুব একটা ভালো নয়। এই ধরনের মানুষগুলোর মন সাধারণত সাদা হয়। তাহলে স্যারের মানসিকতা
অতটা খারাপ কেনো ছিলো….
খানিকক্ষণ বাদে স্যার এসে ঘরে ঢুকলেন। ভুত দেখার মতই আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। আমি
খেয়াল করলাম ওনার বাম হাতে ব্যান্ডেজ। চার পাঁচদিন তো হলো। এখনো ক্ষত সারেনি।
সারবেও না, সারাজীবন দাগ রয়ে যাবে । যতবার ঐ দাগের দিকে তার নজর পড়বে এই ভয়াবহ
স্মৃতি তাকে ছারখার করতে থাকবে।
এইকদিনেই মানুষটা বদলে গেছে একেবারে। প্রবল ঝড়ের মধ্যে অথৈ জলে ভাসতে থাকা
মানুষগুলো বোধহয় এমনই হয়।
আমার ওনার প্রতি করুণা আর ঘৃণা দুটোই জন্মাচ্ছে। সেদিন আমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে
থাকলে সে নিস্তার পেতো না স্যারের কাছ থেকে । স্যারের একটা অন্যায়ের জন্য মেয়েটার
জীবন টাই শেষ হয়ে যেত। হয়তোবা মেয়েটা লড়াই করে বেঁচে থাকতো, কিন্তু মন থেকে ভেঙে
পড়তো।
এইজন্য স্যারকে আমি মানসিক শাস্তি দিয়েছি। এটাই তার প্রাপ্য ছিলো।
স্যার আমার কথা শুনে অবাক হলেন। তার চেয়েও বেশি লজ্জিত হলেন। আমার দিকে ফিরেও
তাকাতে পারছিলেন না। মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। অথচ তার এই দৃষ্টি আগে
কোথায় থাকতো…. যাইহোক আমি আবার পড়া শুরু করলাম স্যারের কাছে। আগের চেয়েও
ভালো করে পড়াতেন উনি । মেধাবী ছিলেন… বেকার চাকরী পাননি তখনো। শুধু মানসিকতাটা
যদি আগেই পরিবর্তন করতেন তাহলে আজ পরিণতি টা এমন হতো না তার।
আমি পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করলাম। স্যার হেল্প করতেন। নীলিমা ম্যাডামও খুব হেল্প
করতেন। তাঁর কাছে আমি অঙ্ক শিখতাম। ম্যাডামের স্বামী বেঁচে নেই। ওনার বাড়ির ড্রয়িং
রুমে তাদের দুজনের একটা জয়েন্ট ছবি বড় করে বাঁধিয়ে টাঙানো।
কিন্তু ছবিটার মধ্যে একটা জিনিসের খুব কমতি ছিলো। ভালোবাসার… ভালোবাসাহীন
ছবিগুলো নিষ্প্রাণ হয়। সেগুলো ছবিই থেকে যায় জীবনের চিত্র হয়ে উঠতে পারেনা।
আমাকে আরেকটা মানুষ সবকিছুতে অনেক হেল্প করে। সে হলো রিয়ন। রিয়ন এর সাথে
আমার পরিচয় টাও ঘটেছিলো অদ্ভুতভাবে…..
নেতাগোছের একটা ছেলে ক্যাম্পাসে একটা মেয়ের সাথে অসভ্যতামি করছে। আশেপাশে যে
কেউ নেই তা নয়, কেউ নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিতে ব্যস্ত। কোনো প্রেমিক প্রেমিকা গল্পে
মত্ত। সবাই বেশ দেখেও না দেখার ভান করছে।
আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিলো, কলেজে নতুন। একমাস হলো কেবল, কাউকেই চিনিনা। আর ভরা
ক্যাম্পাসে কিছু করতে গেলেও বিপদ। জানাজানি হয়ে যাবে। তবুও কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে
দাড়িয়ে দেখা যায়!
এগিয়ে গেলাম। ছেলেটাকে কিছু বলতেই হচ্ছে । কিন্ত তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলো।
একটা ছেলে হুট করে কোথা থেকে জানি এসে ঐ নেতাগোছের ছেলেটার মুখে প্রচণ্ড জোরে
ঘুষি বসিয়ে দিলো। পুরো ক্যাম্পাস থ হয়ে গেছে। সবাই তাকিয়ে আছে ঐদিকে। আমিও অবাক,
ভীষণভাবে। ছেলেটা ঐ নেতাগোছের ছেলেটার কলার টেনে ধরে বলতে লাগলো, ” আর কখনো
ক্যাম্পাসে অসভ্যতা করবি? মেয়েদের গায়ে হাত দিবি? হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেব। ”
নেতাগোছের ছেলেটা এতোটাই অবাক হয়েছে যে কিছু বলতেও পারছেনা। মেয়েটে চলে
এসেছে এদিকটায়। ছেলেটা ওকে ছেড়ে দিলো। তারপর নিজের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে
ক্লাসরুমের দিকে চললো যেনো কিছুই হয়নি!
আমি ডাকলাম, Excuse me! শুনছেন? এ্যাই যে…
ছেলেটা ফিরে তাকালো, আমার দিকে।
– হ্যা বলুন!
আমি ভালো করে ছেলেটাকে দেখলাম। অদ্ভুত সুন্দর। গায়ের রংটা এতোটাও যে ফর্সা তা নয়,
উজ্জ্বল শ্যামলা বোধহয় একেই বলে। চোখদুটো যে কি মায়াভরা আমি বলে বোঝাতে পারব না,
ছেলেদের চোখে এতো মায়া থাকে না। কিন্তু চোখেমুখে একটা অন্যরকম আত্মবিশ্বাস,
নিজের উপর। বেশ খানিকটা লম্বা, আমার চেয়েও দু তিন ইঞ্চি বেশি তো হবেই। দেখলে
বোঝাই যায় শক্তসমর্থ, সাহসী।
Thanks…
– কেনো?
মেয়েটাকে হেল্প করার জন্য।
– হেল্প করলাম তাকে আর থ্যাংকস দিচ্ছেন আপনি!
না, মানে….ক্যাম্পাসে এতোজন মানুষ ছিলো কিন্তু একমাত্র আপনিই এগিয়ে আসার সাহস
দেখিয়েছেন। ধন্যবাদ তো আপনার প্রাপ্যই…
– এ আর এমন কি। ছেলেটা তো একেবারে বলদ। আগের বার যখন অপুকে কয়েকটা ছেলে ডিস্টার্ব
করেছিলো এমন পিটিয়েছিলাম না….
অপু কে?
– আমার বোন। দিদিভাই।
ও….আচ্ছা, আপনি যেভাবে মারলেন ধরনটা কেমন যেনো অদ্ভুত ঠেকলো।
– হাহা। ধরে ফেলেছেন বুঝি! ক্যারাটের প্যাচ…
কি! ক্যারাটে শিখতেন?
– ঐ আর কি…ছোটবেলায় শখ করে শিখেছিলুম আর কি।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ক্লাস পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিলাম। ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে নোটিস
করলাম, আমাদের ক্লাসরুম একই! তার মানে ও আমার সেম ইয়ার। ছেলেটা হঠাৎ আমাকে বললো,
“এতো কথা হলো অথচ নামটাই জানা হলো না! ”
আমার নাম অতন্দ্রিলা।
– বাহ! সুন্দর নাম। কে রেখেছে নামটা?
জানিনা…
– জানেন না! এতো সুন্দর নামটা কে রেখেছে জানা উচিত ছিলো!
উহু… আপনার কি নাম?
-রিয়ন…
রিয়ন অর্থ কি বলুন তো?
– জানিনা তো! নামের অর্থ জানা লাগে নাকি সবসময়!
হুম লাগে তো। নাম কে রেখেছে যেমন জানা লাগে তেমনি অর্থও জানা লাগে। রিয়ন অর্থ
হলো Homeless, গৃহহীন!
– হাহাহা। কিন্তু আমার তো গৃহ আছে। আচ্ছা চলুন এখন ক্লাসে যাই….
এভাবে একদিন হুট করে রিয়ন এর সাথে আমার দেখা হয়ে যায়।
হুট করে পরিচিত হওয়া মানুষগুলো হুট করেই হারিয়ে যায় কিন্তু রিয়ন হারিয়ে যায়নি, ওর
নামটা ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল হয়েছে। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হয়েছে,
সম্পর্কটা আপনি থেকে তুই তে এসেছে। একসাথে ক্লাস, ক্লাসের শেষে আড্ডা, নোট
চালাচালি করা….
রিয়ন সবকিছুর সঙ্গী হয়েছে।
সেদিন যখন মেসে ফিরলাম দরজা খুলেই দেখি পুষ্প মুখ গোমড়া করে বসে আছে! বললাম, কি রে!
তোর মত ভুতেদের ও আবার মন খারাপ হয় নাকি?
ও বললো, তুই তো রিয়ন কে পেয়ে গেছিস। এরপর তো তুই আমাকে ভুলেই যাবি…
আমি বললাম, কে বলেছে আমি ভুলে যাব? তোকে আমি ভুলতে পারি কখনো?
পুষ্প বললো, আমি কেউ নই রে অতন্দ্রিলা । তুই খুব একা। তোর কথাগুলো শোনার মত, তোকে বোঝার
মত কেউ নেই রে। দেখিস, যেদিন তুই তোর সব কথা বলার জন্য, সবসময় তোর পাশে থাকার জন্য
কাউকে পেয়ে যাবি সেদিন আমি চলে যাব। আর আসবো না….
পুষ্পর ওপর মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। ও সবসময় মন খারাপ করিয়ে দেয়। পুষ্পকে এখনো আমি
দেখি সেই ১৩ বছর বয়সী মেয়েটা হিসেবে। আমি অনেক বড় হয়ে গেছি কিন্তু পুষ্পর বয়স একটুও
বাড়েনি। ওর বয়স থেমে গেছে। ও যদি আজ বেঁচে থাকতো এতদিনে হয়তো….
তখন পুষ্প মাঝে মাঝে আসতো। আমি ছোট ছিলাম কিন্তু মোতালেব চাচার উপর আমার যে ঘৃণা
তৈরি হয়েছিলো সেটার প্রতিশোধ নেবার জন্য ছটফট করতাম। সবসময় সুযোগের অপেক্ষায়
থাকতাম কখন তার মুখোশ আমি টেনে খুলে দেব।
একদিন সুযোগ পেলাম। তখন আমার টেস্ট পরীক্ষা শেষ। প্রস্তুতি নিচ্ছি পুরোদমে , স্কুলে
সকালবিকাল আলাদা করে কোচিং ক্লাস হতো শুধুমাত্র দশম শ্রেণীর জন্য। পথে যাওয়া আসা
করতাম একা একাই। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখলাম রাস্তার এক পাশে নির্জনে
দাড়িয়ে মোতালেব চাচা কে, একটা কলেজ পড়ুয়া মেয়ের সাথে কি যেনো কথা বলছে। আমি
আড়ি পেতে শুনলাম, অশ্লীল কথাবার্তা…মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। এতো বয়স্ক একজন
মানুষের কাছ থেকে এরকম কথাটা শোনাটা সত্যিই অস্বাভাবিক। আমি আর রাগ ধরে রাখতো
পারলাম না সেদিন, পুষ্পর কথাগুলো মনে পড়ছিলো বারবার।
আমি স্পষ্ট গিয়ে ওনাকে বললাম, “পুষ্পকে মেরে ফেলে আপনার শান্তি হয়নি? আর কার কার
জীবন নষ্ট করতে চান আপনি??”
মোতালেব চাচা তখন প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন, এতো বছর ধরেও কেউ জানতে পারেনি কি
হয়েছে পুষ্পের সেখানে আমার তো সেটা জানার কথাই নয়।
উনি আমাকে চোখ রাঙিয়ে বললেন, ” এইটুকুনি মেয়েছেলের সাহস দেখো, আমার সাথে গলা
উচিয়ে কথা বলে! দুর হ হারামজাদী। এসব কথা পরের বার বলতে এলে তোর জিভ টেনে ছিড়ে
ফেলবো। ”
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, ” যা খুশি করুন, আপনিই পুষ্পকে মেরেছিলেন, আপনিই ওর
সাথে…সেদিন ঐ বাচ্চা মেয়েটাকে মেরে ফেলে অনেক তো সাধু সাজলেন আর কত? ”
ততক্ষণে আমার চিৎকার চেঁচামেচি তে বেশ কয়েকজন আশেপাশের দোকান থেকে ছুটে
এসেছে। সবাই কি হয়েছে কি হয়েছে বলে ফিসফাস আরম্ভ করেছে। মোতালেব চাচা তাদের
সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন, ” আরে না না, কিছু হয়নি। এই মাস্টারের মেয়ের মাথায় সমস্যা।
উল্টাপাল্টা বকে, আপনারা আপনাদের কাজে যান..! ”
আমি সাথে সাথে জোর গলায় বললাম, ” আমি ঠিকই আছি, সমস্যা আমার নয়। এই মানুষটার, যে
ভালো মানুষের মুখোশ পরে এতদিন ধরে আপনাদের ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে… ”
হঠাৎ কোথ্থেকে যেনো রুহুল চাচা এসে পড়লেন, উনি এক অর্থে গাঁয়ের মাথা। উনি আবার
আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনি এসে ব্যাপারটা সামলালেন। ততক্ষণে বাজারের সবাই ছুটে
এসেছে, মোটামুটি একটা ভিড় জমে উঠেছে।
রুহুল চাচা জানতে চাইলে আমি ওনার সামনে, সবার সামনে সবটা বললাম। লোকলজ্জার ভয়ে চুপ
থাকতে পারিনি, পুষ্পর জন্য এটুকু তো করতেই হতো। সবটা শুনে রুহুল চাচা মোতালেব চাচার
দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন, ” মুরুব্বি, এই মেয়ে কি বলে? ও যা বলে তা কি ঠিক? ”
মোতালেব চাচা এক্কেবারে মুখে কুলুপ এটে বললেন, ” এই মেয়ের সাথে কি আপনাদেরও
মাথাটা গিয়েছে? ও যা খুশি বলে যাচ্ছে আর আপনারা বিশ্বাস করে যাচ্ছেন! ”
প্রচণ্ড রাগে আমার হাত পা তখন কাপছে। আমি বললাম, ” একটু আগেও একটা মেয়েকে উনি
বাজে কথা বলেছিলেন। প্রয়োজনে তার কাছে শুনুন, তাহলেই বুঝবেন উনি কেমন মানুষ! ”
মেয়েটাকে ডেকে আনা হলো। তাকে আমি বললাম, ” আপু, মোতালেব চাচা তোমার সাথে
বাজে কথা বলেননি? বলো, ভয় কোরো না। সবাইকে বলো..? ”
আমাকে প্রচণ্ড অবাক করে দিয়ে মেয়েটা সবটা অস্বীকার করলো! আমি ভাবতেও পারছিলাম
না এভাবে আমাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হতে হবে! মেয়েটার মুখে আমার থুথু দিতে ইচ্ছে
হলো কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম হয়তোবা স্বীকার করে নিলে মেয়েটার আর ওর পরিবারের
অনেক সমস্যা হবে! আজ এই একটা কারণেই কত মেয়ে মুখ বুজে সবটা সহ্য করে নিচ্ছে। অথচ
প্রকৃত দোষীরা মাথা উঁচু করে হেঁটে যাচ্ছে!
রুহুল চাচা সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। মোতালেব চাচার মুখে তখন হাসি, ”
বলেছিলাম না? এই মেয়ে মিথ্যে কথা বলছে আমার নামে? ”
আমি প্রচণ্ড রাগে আর ঘৃণায় মোতালেব চাচার চোখের দিকে তাকালাম। একবারের জন্যেও
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম না। হিসহিস করে বললাম, ” আপনি পুষ্পকে মেরে ফেলেননি? মেয়েটার
সাথে অপরাধ করেননি? আর কত দিন সবাইকে ঠকাবেন। কি ভেবেছেন আপনার আসল চেহারা
কখনো কারোর সামনে আসবে না? বলুন, স্বীকার তো আপনাকে করতেই হবে। এতো সহজে তো
আপনি পার পেয়ে যাবেন না! ”
আমি কি বলে যাচ্ছিলাম তা আমার নিজেরও খেয়াল ছিলো না। আমার ভেতরের সবটা রাগ
আর ঘৃণা দিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম….হঠাৎ খেয়াল করলাম মোতালেব চাচার মুখভঙ্গি
টা কেমন যেনো বদলে যাচ্ছে। কোচকানো ভ্রু সরল হয়েছে, যেনো উনি ওনার মধ্যে নেই!
সবাইকে প্রচণ্ড অবাক করে দিয়ে উনি বললেন, ” হ্যা, আমিই পুষ্পকে মেরেছিলাম…!”
সবচেয়ে বেশি অবাক হবার পালা ছিলো আমার। মোতালেব চাচা এতো সহজে স্বীকার করে
নিলেন কিভাবে! আমি যা যা তার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম অবিকল সেই সবকিছু উনি বলতে
শুরু করলেন। রুহুল চাচা সহ বাকি যারা ওখানে ছিলেন সবাই যেনো কথা বলতেই ভুলে
গিয়েছিলেন। মোতালেব চাচা রোবটের মত বলেই চলেছেন….
মোতালেব চাচার শাস্তি হলো। গ্রামের লোক তাকে একঘরে করে দিলো। তার বিরুদ্ধে আইনি
ব্যবস্হাও নেওয়া হলো। কিন্তু এতো বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ…..
বা প্রত্যক্ষদর্শী কেউ নেই বলে ওনার শাস্তির মাত্রাটা হলো কম। তার হুশ ফেরার পরে অবশ্য
তিনি বলা শুরু করেছিলেন যা বলেছেন সব মিথ্যে, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি।
তবুও মন থেকে অনেকটা শান্তি পেলাম। তাকে শাস্তি তো অন্তত দিতে পেরেছি!
কিন্তু একটা বিষয় সেদিন কিছুতেই আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে
থাকাতে মোতালেব চাচার ভেতর পরিবর্তন কিভাবে এলো। আমাকে তো নিশ্চই উনি ভয় পান
না যে ভয়ে সবটা স্বীকার করে নেবেন। তাহলে কি হয়েছিলো তার?
যদিও আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাকে পুষ্পই দিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন রাতে আমাবস্যা
ছিলো। পুষ্প আবার এসেছিলো। ও কাঁদছিলো! অদ্ভুত তার কান্না। আমি বলেছিলাম, ”
মোতালেব চাচা তো শাস্তি পেয়েছে তবে তুই কেনো এখনো কাঁদছিস বোকা মেয়ে? ”
ও বললো, ” শাস্তি না হয় সে পেয়েছে কিন্তু আমার জীবনটা কি আমি আর ফিরে পাব বল? ”
আমি চুপ করে ছিলাম। ওর প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিলো না। পুষ্প বলেছিলো, ”
আতন্দ্রিলা ….সবার সামনে মোতালেব চাচার মুখোশ খুলে দিয়েছিস। মোতালেব চাচা কি তোকে
এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? তোকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয় খুব….
আমি বললাম, ” কিন্তু পুষ্প তুই আমায় একটা কথা বল, মোতালেব চাচা যেখানে স্বীকারই
করছিলো না ব্যাপারটা সেখানে হঠাৎ করে সবটা স্বীকার করে নিলো কিভাবে? তুই কি কিছু
করেছিলি? ”
পুষ্প বললো, ” না অতন্দ্রিলা…আমি কিচ্ছু করিনি। যা করবার তুই করেছিস…।”
আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম, ” আমি করেছি মানে? আমি কিভাবে করলাম? ”
পুষ্প বললো, ” জানিস অতন্দ্রিলা, তোর চোখদুটো নীল। ক’জনের চোখ এমন হয় বল তো? তোর চোখদুটো
খুব সুন্দর….আর জানিস তোর এই নীল দৃষ্টির সামনে কোনো খারাপ মানুষ দাড়াতে পারবে না।
কেউ দাড়াতে পারবে না….”
সেসব দিনের কথা মনে পড়লে আজও শরীরটা শিহরিত হয়ে ওঠে। ঘৃণায় মুখ কুচকে যায়। থাক
সেসব কথা।
প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝে কখন যে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা টা শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেলো অনুভব
করারও সময় পেলাম না। তারপর আবার শুরু হলো কোচিং ক্লাস। প্রথমে আমারো রিয়ন এর সাথে
বুয়েটে এক্সাম দেবার কথা ছিলো। উদ্ভাসে কোচিং ও শুরু করেছিলাম। কিন্তু রেজাল্ট
দেবার পর পাশার দান উল্টে গেলো। রিয়ন সবগুলোতে প্লাস পেলেও ইংরেজিতে আমার
প্লাস মিস হয়ে গেলো।
অনি বললো, এখন কি করবি? বুয়েটে এক্সাম দিবি? তোর তো সায়েন্সের সবগুলোতে নাইনটি
আপ নাম্বার এসেছে।
– তুই তো বুয়েটে দিচ্ছিস।
হ্যা কিন্তু তুই?…
– আমি ঢাকা ভার্সিটিতে দেব।
মেডিকেলে ও তো ট্রাই করতে পারতিস!
– উহু। ওসব বাদ। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ব। ইংরেজি অনার্স মাস্টার্স শেষ করব।
আমার কথা শুনে রিয়ন বোধহয় খানিকটা বিষম খেলো। ও বললো, ” মানে টা কি! খারাপ করলি
ইংলিশে আবার ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চাস?
বললাম, ” যেটা পারি সেটা আরো পড়ে কি লাভ! তার চেয়ে যেটা পারিনা সেটা ভালো করে
শিখি? কি বলিস? ”
আমরা বকবক করছিলাম। হঠাৎ মারিয়া কোথ্থেকে হাপাতে হাপাতে ছুটে এসে বলতে শুরু
করলো,
“জানিস? আনিকা সুইসাইড করেছে! ” আমি ভীষণভাবে অবাক হলাম!
“আনিকা কেনো সুইসাইড করবে? ”
– জানিস না? ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে ওর ফিজিকাল রিলেশন ছিলো। ছেলেটা পরে ওকে
এক্সেপ্ট করেনি। ব্রেক আপ করে ফেলে। আনিকা মেনে নিতে পারেনি, ও প্রেগনেন্ট ছিলো!
এট লাস্ট সি কমিটেড সুইসাইড ইন এ হিউজ ডিপ্রেশন।
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম মারিয়ার কথাগুলো শুনে। আনিকাকে আমরা চিনতাম, ওর
প্রেমিক কে ও খুব ভালোবাসতো। নাম ছিলো আনান। ছেলেটাকে তো ভালই মনে হতো কিন্তু
সে যে এমন ছিলো কে জানতো….!
কিন্তু ভালোবাসা কি এমন হওয়া উচিত ছিলো? যেখানে শরীরটাই সব, মনের কোনো দাম নেই।
আনিকা কেনো নিজের সবটা তাকে দিয়ে দিলো। সবাই কানাঘুষো করছিলো আনিকাকে
নিয়ে। আমি জানি, পুরো দোষটা এখন আনিকারই হবে। তার পরিবারকে সবাই হেয় করবে। অথচ
দোষটা দুজনেরই ছিলো। কিন্তু ছেলেটার দোষটা কেউ দেখবে না। কেউ না, তবুও আনিকা এসব
কিছু না ভেবে কেনো…
আনিকা না হয় দোষ করেছিলো কিন্তু ওর বাচ্চাটা তো কোনো দোষ করেনি। তাকে জন্ম
নেবার আগেই চলে যেতে হলো। পৃথিবীটা সে দেখতেই পেলো না। সুইসাইড শব্দটাকে আমি
প্রচণ্ড ঘৃণা করি। এই শব্দটা আমার মা কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। কখনো মায়ের
ভালোবাসা আমি পাইনি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো আনানকে কিছু বলি .. কিন্তু লাভ কি। আনিকা
যদি ওকে সাপোর্ট না দিতো তাহলে ও এতদূর আসতে পারতো না। এই মেয়েগুলো এতো বোকা
হয় কেনো? পৃথিবীর জটিল নিয়মগুলো কবে বুঝবে তারা?
আমি চলে এলাম, রিয়নকে কিছু বলে এলাম না। চুপচাপ পার্কে একটা বেঞ্চে বসে রইলাম।
বাবা বলেছিলো আমার যখন আড়াই বছর বয়স তখন মা আত্মহত্যা করে। মায়ের আত্মহত্যার কারণ
জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু বাবা বলেছিলো বাবা জানেনা। বাবার কথা আমার একটুও
বিশ্বাস হয়নি। যেদিন গ্রাম থেকে এখানে চলে এলাম সেদিন এই সপ্তদশী তরুণী তার বাবাকে
আবারো প্রশ্ন করেছিলো তার মায়ের আত্মহত্যার কারন কি। বাবা চুপ ছিলো। আমার ক্ষীণ
সন্দেহ হয়েছিলো, মায়ের মৃত্যুর কারণ বাবা নয় তো?
তারপর থেকে এই দু বছর আমি গ্রামে যাইনি, একবারের জন্যও না। বাবা মাঝে সাঝে এসে
আমাকে দেখে গেছে। বাবা গ্রামে প্রাইমারি স্কুলের হেড টিচার, ব্যস্ত মানুষ। আমাকে
ছাড়া ভালোই আছে বোধহয়। আমাকে হয়তো তার মনেও পড়ে না। সেই দিনগুলো খুব মনে পড়ে
বাবার সাথে আইসক্রিম কিনতে যাওয়া, মোড়ের মাথার দোকানের সিঙ্গাড়া খাওয়া, গরম
জিলিপি আর রসগোল্লার কিনে এনেও লুকিয়ে রাখা। কি করেনি বাবা আমার জন্য। কিন্তু যখন
থেকে মায়ের কথাটা আমার মাথায় ঢুকে গেলো তখন থেকে
বাবার সাথে দূরত্ব টা বাড়তে লাগলো। আর সেটা বাড়তে বাড়তে কখন যে এতটা বেড়ে গেছে
টেরই পাইনি। শেষ কবে যে বাবার সাথে ভালো ভাবে কথা বলেছি মনে নেই।
একটা সময় মনে হতো আমি খুব একা। একমাত্র পুষ্প ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কিন্তু একটা সময়
অনুভব করলাম একজন আছে যে সবসময় আমার পাশে থাকবে, আমার কথাগুলো শুনবে। সেই
মানুষটা রিয়ন।
প্রতিটা মেয়ে তার স্বামীর মাঝে তার বাবা কে খোঁজে। যে তাকে কখনো ইনসিকিওর হতে
দেবে না, সবসময় আগলে রাখবে। আমি বোধহয় সেটা রিয়ন এর মাঝে খুঁজতাম। সবসময়…
আকাশে মেঘ জমেছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। এখন দিনকালই এমন, এই মেঘ এই
বৃষ্টি। পার্কের বেঞ্চে বসে আমি ভিজতে লাগলাম। রোজ এমন বৃষ্টি হয়না। আজ যেনো আকাশ
ভেঙে পড়ছে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা সারা শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে হঠাৎ পুষ্পকে দেখলাম,
সামনে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু বৃষ্টি ওর শরীরে লাগছে না। শরীর থাকলে তো লাগবে। ওর তো…
অতন্দ্রিলা , বৃষ্টিতে এভাবে ভিজিস না। তোর শরীর খারাপ করবে। বাড়ি ফিরে যা!
– আমি বাড়ি ফিরব না পুষ্প।
এই বৃষ্টি কিন্তু সহজে কমবে না, তুই অসুস্হ হয়ে পড়বি।
– তুই কি সব জেনে বসে আছিস নাকি?
হ্যা। সব জেনেই তো বসে আছি।
– তাহলে বল আমার মা কেনো আত্মহত্যা করেছিলো? চুপ করে থাকিস না, বল!
অতন্দ্রিলা , তোকে আমি বলেইছি আমি কেউ না। আমি তোর কল্পনা। তুই যেটুকু জানিস তার চেয়ে
বেশি জানার সাধ্য আমার নেই।
– মিথ্যে বলছিস তুই। তুই যদি কিছু নাই জেনে থাকবি তাহলে এতো বছর আগে স্বপ্নে এসে
কিভাবে বলেছিলি যে মোতালেব চাচা….আর সেদিনের ঘটনাটা, সুমন স্যারের ঘটনাটাই বা
কিভাবে আগে থেকেই আঁচ করেছিলি!
সেটা তোর স্বপ্ন ছিলো অতন্দ্রিলা, আর সুমন স্যারের কথাটা তো তুই নিজেও খানিকটা আন্দাজ
করতেই পেরেছিলি। পারিস নি?
– মিথ্যা বলে বারবার আমাকে থামানো যাবে না পুষ্প। আমি জানি তুই আছিস! তুই আমার
কল্পনা নোস।
উত্তেজিত হোস না অতন্দ্রিলা । আমি যেই হই না কেনো তোকে একটা কথা বলে রাখি, প্রকৃতি
অনেক কিছুই করে যা তার নিয়মের বাইরে। প্রকৃতিকে সবটা জানা কারো পক্ষে সম্ভব না। তুই
যতই প্রকৃতি কে জানতে চাইবি প্রকৃতি ততই তোকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। তোকে অতল গহ্বরে
টেনে নিয়ে যাবে….
পুষ্প মিলিয়ে গেলো, বৃষ্টি তখনও পড়ছে। আমার ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। কিন্তু কাঁদতে
পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিলো, আমাকে জানতেই হবে আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ কি?
হঠাৎ মনে পড়লো, সত্যিই তো আমি তো কখনো কারো জন্য কাঁদিনি। পুষ্প যেদিন চলে গেলো
সেদিন থেকে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, নীল চোখের মানুষগুলোর কি মন খুলে কাঁদারও
অধিকার নেই?
পার্কে বসে থাকতে থাকতে বেঞ্চে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। ঘুম
যখন ভাঙলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। অবাক ব্যাপার! আমি এতোক্ষণ ধরে ঘুমিয়েছি এভাবে!
ব্যাগটা আমার কোলেই ছিলো, ওয়াটারপ্রুফ বলে বইখাতা গুলো তখনো অক্ষতই। তড়িঘড়ি করে
উঠতে গিয়ে মাথাটাই ঘুরে উঠলো। আবার ধপাস করে বসে পড়লাম বেঞ্চের উপর। পুষ্প মানা
করেছিলো, ওর কথা শুনিনি। এখন ফল তো ভোগ করতেই হবে। টাকা পয়সা কিচ্ছু নেই সাথে,
হেঁটেই মেসে ফিরি রোজ। তাই হাঁটতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়েই
যাব। কিন্তু না…মেসে পৌছলাম। ঘরে ঢুকে দরজাটা লক করে দিয়ে ছুটে গেলাম ওয়াশরুমে।
প্রচণ্ড বমি করলাম, হাত মুখে জল দিলাম। ভেজা কাপড়চোপড় পাল্টাতে হবে। যেইনা টলতে
টলতে গিয়ে ওয়ারড্রোবের ড্রয়ারে হাত রেখেছি মনে জলো যেনো পৃথিবী শূণ্যে উল্টো হয়ে
দুলছে। টাল সামলাতে পারলাম না…তারপর….
জ্ঞান যখন ফিরলো তখন প্রচণ্ড ব্যথায় মাথাটা ফেঁটে যাচ্ছে। চোখ খুলে দেখি সবকিছু
ঝাপসা। কোথায় আছি আমি! আমার ঘরে..? হ্যা, আমার ঘরেই তো শুয়ে আছি। কিন্তু কি
হয়েছিলো কিচ্ছু মনে পড়ে না। ঝাপসা চোখে দেখলাম একটা ছেলে এগিয়ে আসছে আমার
দিকে। কে এই ছেলেটা!
ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বিছানার উপর বসে সে আমার হাত ধরলো। আমার
হাতটা প্রায় অবশ, আর ব্যথা করছে। কি হয়েছে কে জানে। আমি তবুও প্রায় ককিঁয়ে উঠলাম,
“কে আপনি? আমার হাত ছাড়ুন! ”
ছেলেটা বিস্মিত গলায় বললো,” আমি রিয়ন! চিনতে পারছিস না আমায়?”
আমি কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। হ্যা, রিয়ন ই তো। ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। ধীরে
ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো।
আমি বললাম, কিন্তু তুই এখানে কিভাবে এলি? আমি তো দরজা…
রিয়ন বললো, দরজা লক করে রেখেছিলি তাই তো? আমি তোকে আজ কোচিং এ খুঁজে না পেয়ে
তোর ফোনে ট্রাই করলাম। কিন্তু ফোন সুইচড অফ বলে। আমার তো টেনশন শুরু হয়ে গেলো। শুধু শুধু
ফোন অফ করে রাখার মেয়ে তো তুই না। ভাবলাম তোর মেসে এসে একবার খোঁজ নিই। কিন্তু
দ্যাখ তোর মেসে আমাকে ঢুকতেই দেবে না, অনেক বলে কয়ে তারপর এলাম। এসে দেখি তোর
রুমের দরজা লক। তারপর কত কাঠখড় পুড়িয়ে রুমের চাবি আনার ব্যবস্হা করে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকে
দেখি তুই ঘরের ভেতর মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস!
রিয়ন একনাগাড়ে সবটা বলে চললো। আমি বললাম, তারপর?
ও বললো, তারপর আর কি? দেখলাম জ্বরে গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে ডাক্তার
ডাকলাম…ইঞ্জেকশন দেয়ালাম। সেইই কখন….আর তোর জ্ঞান ফিরলো এই ভর সন্ধ্যেবেলা।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে ছ’টা বাজে। ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে প্রায় একটা দিন
অজ্ঞান হয়ে কাটিয়ে দিলাম। জ্বর যে এখনো কমেনি বুঝতেই পারছি, মাথার ভেতরটা যন্ত্রণা
করছে। এক হাতে স্যালাইন দেয়া, ঐজন্যই নাড়াতে পারছিনা হাতটা। ইঞ্জেকশন দেয়ার
জায়গাটা ফুলে আছে। কতবড় ইঞ্জেকশন দিয়েছে কে জানে! অবশ্য ইঞ্জেকশনে আমি ভয়
পাইনা। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার গায়ে লাল রঙের সালোয়ার কামিজটা…কিন্তু আমি তো
কালকে একটা কালো রঙের থ্রি পিস পরেছিলাম! আর…বাড়ি ফিরে তো চেঞ্জ করবার আগেই
সেন্সলেস হয়ে গিয়েছি। আমি কটমট করে রিয়ন এর দিকে তাকিয়ে বললাম, ” আমার কাপড় কে
বদলে দিয়েছে? ”
রিয়ন কিছু বললো না! আমি বললাম, কিরে বল? তুই বদলেছিস? ”
– না, অপুদি বদলেছে!
” অপুদি এখানে কোথ্থেকে আসবে? সত্যি করে বল!”
– আরে সত্যি বলছি, অপুদি…
” পাজি শয়তান!!!”
হঠাৎ একটা মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে এলো, ” কিরে এখানে কে পাজি আর কে শয়তান হুম??”
আমি অস্ফুটস্বরে বললাম, ” অপুদি তুমি?”
অাপু দি হেসে বললো, ” হ্যা, আমিই তো। কি জ্বরটা বাঁধিয়েছিস বল তো! রিয়ন না এলে তোর
কি হতো বলতো!”
” তুমি কিভাবে এলে?”
” আমাকে তো রিয়ন ডেকে আনলো, একা একা কি করবে বুঝতে পারছিলো না তাই। ”
রিয়ন প্রায় চেঁচিয়ে বললো, ” দেখলি তো অপুদি এসেছে। আমার কথা তো বিশ্বাস হয়না
তাইনা? অপুদিই তো তোর…”
আমি রিয়নকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ” এ্যাই থাম তো। চুপ কর এখন। অপুদি, শোনো না
মাথাটা খুব ধরেছে। এক কাপ চা বানিয়ে এনে দেবে কড়া করে? ”
অপুদি বললো, তোর জন্য দুধ গরম করে আনলাম যে! খাবি না?
আমি বললাম, ” না গো, এখন ওসব ছাইপাঁশ খেলেই বমি করে ফেলবো। তারচে এককাপ চা
বানিয়ে দাও না প্লিজ।”
” আচ্ছা দাড়া আনছি….”
অপুদি চলে গেলে রিয়ন বললো, ” তুই আমাকে একটুও বিশ্বাস করিস না!”
আমি মুচকি হেসে বললাম, ” সবচেয়ে বেশি তো তোকে বিশ্বাস করি!”
” আচ্ছা বাদ দে ওসব, দেখি তোর গায়ে এখন কতটা জ্বর?
রিয়ন আমার মাথায় হাত রাখলো। কি শীতল সেই হাত। একদম যেনো বরফ!
ও বললো, ” এখনো ১০২ আছে…”
-এসেছেন দেখো হিউম্যানয়েড থার্মোমিটার!
” হুম তাই তো!”
-কিইই? তুই থার্মোমিটার! সবার টেম্পারেচার বলে দিতে পারিস?
” উহু, সবারটা পারিনা। শুধু তোরটা বলে দিতে পারি। ”
রিয়ন হাত সরিয়ে নিচ্ছিলো ; আমি বললাম, হাত সরাবি না একদম।
ও অবাক হয়ে বললো, কেনো?
– আমি এখন ঘুমোব। চা খাব না, প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। তাই তুই হাত সরাবি না।
” হাত না সরালে কি হবে?”
– ঘুম ভালো হবে। বকবক করিস না তো, চুপচাপ কপালে হাত রেখে বসে থাক।
চোখ বন্ধ করে ফেলার আগে দেখলাম রিয়ন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, ওর চোখে
বিস্ময়!
কিন্তু পুষ্প তো একবারো এলো না!
একদিন রেস্টে থাকার পরই মোটামুটি সুস্হ হয়ে গিয়েছিলাম। কোচিং ক্লাসগুলো এখন খুব
ইম্পর্টেন্ট। মিস করা চলে না। সকালবেলা তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শুনলাম
ফারজানা আর নীতু আপু কিসব গল্প করছে । হঠাৎ আমার নামটা ভেসে এলো কানে । আমি
চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লাম ,ওদের কথাগুলো শুনতে ইচ্ছে হলো কেমন যেনো ।
” জানিস একটা ছেলে এসেছিলো অতন্দ্রিলার ওখানে…সে কত হ্যাপা করে চাবিটাবি এনে দরজা
খোলালো। কি হয়েছিলো কে জানে!”
কেন রে ? ওই ছেলেটা কি হয় ওর ?
“বন্ধু তো বললো । এখন আবার বন্ধুর নামে অনেকেই তো থাকে না..,সন্ধেবেলা ঘরে ঢুকতে গিয়ে
দেখলাম অতন্দ্রিলার মাথায় হাত রেখে বিছানার পাশে বসে আছে। তাই আর ঢুকিনি তখন, বেরিয়ে
এসছি।”
বলো কি ! সত্যি নাকি ? নাম কি ছেলেটার?
হ্যাঁ রে ঠিকই বলি । নাম বোধহয় রিয়ন !… ও মেয়েটাকে এমনিই সুবিধার মনে হতো না । এক
ইয়ং মাস্টার ডেকে প্রাইভেট পড়তো এখন আবার বন্ধু এসে সেবা করে । কত রং যে দেখবো…
“নীতু আপু সেদিন যখন আমি অসুস্থ ছিলাম আপনারা তখন কোথায় ছিলেন ?”
নীতু আপু আর ফারজানা থতমত খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে পড়লো ।
“দুটো বছর হতে চললো এখানে আছি । কখনো বেঁচে আছি না মরে গেছি জানতেও আসেননি ।
কাল ঐ বাইরের ছেলেটা না এলে হয়তো ওভাবেই পড়ে থাকতাম । ছেলেটা আমার জন্য এত দূর
থেকে আসল,ডাক্তার ডাকলো,ট্রিটমেন্ট করালো… কই আপনারা তো ফিরেও তাকাননি । নাহ
খুব ব্যস্ত মানুষ কিনা আপনারা ! আর যেই না সব মিটলো সেই আপনারা তাকে নিয়ে কি কি
খারাপ কথা বলবেন তার ফর্দ করতে বসলেন । বাহঃ…”
ফারজানা মুখ চুন করে দাড়িয়ে রইলো। নীতু আপু হাত তুলে বলতে গেলো, তাই বলে একটা
বাইরের ছেলে রুমে এসে…ভালো না মন্দ মতলব কে বলবে ?
আমি আপুকে থামালাম, “সে আমার বন্ধু, আর বন্ধু কখনো ভেতর বাহির হিসেব করে হয় না । আর
ভালো নাকি মন্দ ? রিয়ন দুদিনের পরিচিত বাইরের ছেলে হতে পারে কিন্তু মানুষ হিসেবে
ও আপনাদের সবার থেকে অনেক বেশি ভালো । আর তাছাড়া সে কেমন সে বিচার করার
অধিকার আপনাকে কে দিলো ? আমার বিপদের সময় যেমন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন এখনো তাই
থাকুন,ভালো থাকুন । ”
আমি জোর পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এলাম । মাথার ভেতর দপদপ করছে। জানিনা কখন এত রেগে
গেছি । রিয়ন কে নিয়ে কেউ কোনো বাজে কথা বললে আমি সহ্য করতে পারি না ।সহ্য করতে
পারি না ।
এই যে একই কথা বারবার বলছি । রেগে গেলে এটা খুব হয় । খুব হয় ।
১৩ তারিখ ভার্সিটির এডমিশন এক্সাম। সবাই পড়তে পড়তে চোখের পাওয়ার কমিয়ে ফেলেছে,
মুখের ফেনা তুলে ফেলেছে। আর আমি! সবসময় আজগুবি সব চিন্তাভাবনায় দিন কাটাচ্ছি।
নীলিমা ম্যাডাম তো বলেই দিয়েছিলেন চান্স না পেলে আমাকে ধরে রিমান্ডে নেবেন। উনি
আমাকে একদম তার মেয়ের মতই যত্ন করেন। ওনার ছেলেমেয়ে কেউ নেই। তাই হয়তো বা….
দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর চলে এলো। ন’ তারিখ আমার জন্মদিন। চারদিন পরে ভার্সিটি
এক্সাম! তার আবার জন্মদিন…
সেদিন সকালবেলা অনেকদিন পর পুষ্প এলো। আমার যে কি খুশি লাগছিলো বলার মত না।
পুষ্প বললো, কি উপহার চাস আজ?
আমি বললাম, কিচ্ছু না। শুধু বিপদ হোক বা সুখে সবসময় সাথে থাকবি। বল থাকবি তো?”
পুষ্প মুচকি হেসে মিলিয়ে গেলো… কিছু কিছু কথার উত্তর ও কখনোই দেয় না।
কোচিং ক্লাসে ঢুকতে দেখি…কেউ নেই। অদ্ভুত তো, এই সময়ে কে কোচিং মিস দিবে! প্রায়
বেরিয়েই আসছিলাম। হঠাৎ পাশের অন্য একটা রুম থেকে কে যেনো ডাকলো, “অতন্দ্রিলা….!”
আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম, দরজার কাছাকাছি যেতেই একসাথে চার পাঁচটা বেলুন
ফাটার আওয়াজ, আর প্রায় ৬/৭ জন একসাথে চিৎকার করে ঝাপিয়ে পড়লো!
” হ্যাপি বার্থডে মিস নীল নয়না, মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে! ”
আমি তো এতটাই অবাক হয়েছি যে কথাই বলতে পারছিনা! রিয়ন ছুটে এসে খানিকটা কেক
মাখিয়ে দিলো গালে। তাজ্জব ব্যাপার, কেক কাটাই হলো না তার আগেই কেক মাখিয়ে ভুত
বানিয়ে ফেলেছে।
মারিয়া, তমা, রিয়ন, শায়লা, তুষার, হাসান সবাই মিলে একসাথে এসব প্ল্যান করেছে! আজ
নাকি কোচিং বিকেলে তাও আমাকে কেউ বলেনি। সবটাই সারপ্রাইজ প্ল্যান। তারপর আর
কি… কেক কাটা হলো। সবাই মিলে হৈ হৈ করে এতো বড় কেকটা নিমেষে খেয়ে, মাখিয়ে
সাবাড় করে দিলো। তারপর ফুঁচকা খাওয়াতে হলো সবাইকে, এটা নাকি ট্রিট। যাইহোক,
সবকিছু মিটে যাবার পর অন্যরা চলে গেলে আমরা দুজন একসাথে একটা গাছের নিচে ঘাসের
উপর বসে পড়লাম। আমি আর রিয়ন….
ওর সাথে পরিচয় হবার পর আমার জন্মদিনে সেবার ও উপহার দিয়েছিলো একটা কাজল। সাধারণ
একটা কাজল….
বলছিলো, ” তোর নীল চোখে কাজলটা খুব মানাবে। আচ্ছা কি অদ্ভুত নীল তোর চোখটা।
কিভাবে এতো সুন্দর বলতে পারিস?”
সেই কাজলটা আমি একদিনও ব্যবহার করিনি!
গতবছর দিয়েছিলো একটা পায়েল। নিজে পরিয়েও দিয়েছিলো। সেই পায়েলটাও কাঠের
বাক্সে যত্ন করে রাখা আছে।
রিয়ন বললো, ” এবার কি উপহার চাস বল? বুঝতে পারছিলাম না তোকে কি দিব তাই ভাবলাম
তোর কাছেই শুনি…! ”
আমি বললাম, ” যা চাইব দিতে পারবি তো? পরে আবার বলবি না তো যে দিতে পারছিস না?”
রিয়ন বললো, চেয়ে দেখ। দিতে পারি কি না…?
আমি কয়েকমুহূর্ত চুপ থেকে বললাম, একটা সত্য জানতে আমাকে সাহায্য করবি?
ও বললো, কি সত্য?
ও যে অবাক হয়েছে তা বোঝাই যায়। জন্মদিনে এমন উপহার সচরাচর কেউ চায় না।
” আমি জানতে চাই আমার মা কেনো আত্মহত্যা করেছিলো। আর আমার একার পক্ষে সেই
কারণটা খুঁজে বের করা সম্ভব হবে কিনা জানিনা। তুই থাকবি আমার পাশে? ধরে নে এটাই
আমার উপহার।
রিয়ন মুখ শক্ত করে বললো, এডমিশন এক্সাম টা হতে দে। আমি কথা দিচ্ছি তোর সাথেই থাকবো।
তোকে এই সত্যিটা জানতে যতটা সাহায্য করতে পারি তার সবটা আমি করব….
আমি জানালার পাশে চুপচাপ বসে আছি। রিয়ন টিকিট কাটতে গেছে। আগে সিট বুক করে
রেখে তারপর টিকিট কাটার ব্যাপারটাও বেশ অদ্ভুত।
তেজগাঁও স্টেশনে বসে আছি, সাতখামাইর হলো আমার গ্রাম। এখান থেকে দু আড়াই ঘণ্টার
ভেতর পৌছনো যাবে। রিয়ন টিকিট কেটে নিয়ে ফিরে এলো আর বসে পড়লো ঠিক আমার
সামনের সিটটাতে। ও বললো, ” সন্ধ্যার মধ্যে পৌছতে পারব তো?”
– পৌছানোর তো কথা। এখন দেখা যাক।
” তোর গ্রামের লোকেশন টা বল তো ঠিক করে। ”
– গাজীপুর জেলা, শ্রীপুর উপজেলা, সাতখামাইর গ্রাম। ইউনিয়নের নাম লাগবে?
” না না, এতেই হবে। বাপরে কি নাম! সাতখামাইর! সাতটা খামার ছিলো নাকি গ্রামে?
কিসের, মুরগি না হাস? একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ছিলো বোধহয় তাইনা? হাহাহা।”
– এ্যাই শোন। বকবক করিস না, আমার গ্রামটা অনেক সুন্দর। নামটা একটু ইয়ে ধরনের হলেও।:
” তাই নাকি! তা কেমন সুন্দর বল তো!”
– হুমমমম, সুন্দর। ভাওয়াল গড়ের শুরু এখান থেকে…. শালবন আছে… এর মাঝের পাকা রাস্তাগুলো
দিয়ে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে আমার সেই লাগতো। মাটির রাস্তা, ধানক্ষেত সবই আছে। বিরাট
একটা মাঠসহ প্রাইমারি স্কুল আছে। প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যার আমার বাবা, বুঝলি? সাথেই
হাইস্কুল।
আমাদের ইউনিয়নে আরেকটা গ্রাম আছে। সাতখামাইর এর পাশে, টেংরা….
ওটা আরও সুন্দর। দুইপাশে সাগরের মতো ধানক্ষেত, মাঝে মাটির রাস্তা….. ভেবে দ্যাখ
একবার।
আরেকটা গ্রাম আছে, কাঠালি। এই ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি বিল আছে সেখানে….
” আচ্ছা আচ্ছা থাম এবার! পুরো রচনা বলে যাচ্ছিস দেখছি। বাদাম খাবি? তাতে যদি তোর
মুখটা একটু বন্ধ হয়! ”
আমি কটমট করে ওর দিকে তাকালাম। ও চুপ হয়ে গেলো। ততক্ষণে অবশ্য হুইসেল বাজিয়ে
পোপো করে ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে। কিন্তু ঝিকঝিকের বদলে কেমন যেনো ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে।
শব্দটা আমার মাথার ভেতর হচ্ছে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিনা। রিয়ন এর পাশের সিটে
একটা সুন্দরী মেয়ে বসেছে। রিয়ন আবার তার সাথে গল্প জুড়েছে। আমার রাগ হচ্ছে, কিন্তু
কিছু বলতেও পারছিনা। ঐ মেয়েটার সাথে এতো গল্প করার কি আছে! সুন্দরী বলে? হুহ! আমি
কি কম সুন্দর নাকি!
আমার পাশের সিটে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক বসেছেন। তাকে আস্তে আস্তে বললাম, ‘ভাই,
ট্রেনে উঠলেই না আমার খুব বমি লাগে। এখনই শরীরটা কেমন যেনো লাগছে। একটু সাবধানে
বসিয়েন। ”
উনি আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ট্রেনে উঠে মানুষের বমি লাগে এটা
অস্বাভাবিক লাগার মত কথা তবে ইনি ইস্ত্রি করা শার্ট প্যান্ট পরে আছেন, কেউ হড়হড় করে
গায়ে বমি করে ভাসিয়ে দিতে পারে এটা ভেবেই শিউরে উঠছেন । আমি বললাম, ” ভাই, তবে
আপনি একটা কাজ করতে পারেন… ঐ যে সামনের সিটে যে ছেলেটাকে দেখছেন ও আমার বন্ধু।
ওর সিটে গিয়ে বসুন, ওকে এখানে পাঠিয়ে দিন। ”
ভদ্রলোকের ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলেছি! উনি রিয়ন এর সিটে বসে রিয়ন কে আমার পাশে পাঠিয়ে
দিয়েছেন। আহা বেচারা রিয়ন ! সুন্দরী মেয়েটার পাশে বসতে পারলো না। চোখেমুখে কি
একটা বিরহ বিরহ ভাব! ইচ্ছে হচ্ছে ওকে ধরে ট্রেন থেকে নীচে ফেলে দিই।
বাকি রাস্তা রিয়ন এর সাথে একটাও কথা বললাম না, চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
ও দুএকবার কথা বলতে চাইলে কটমট করে তাকিয়েছি। আচ্ছা, আমি ওকে হিপনোটাইজ করতে
পারিনা কেনো? যদি পারতাম তাহলে হাজারবার ওকে দিয়ে বলাতাম, ” আমি তোকে খুব
ভালোবাসি অতন্দ্রিলা..!!”
ট্রেন থেকে যখন নেমেছি তখন প্রায় সন্ধ্যা। স্টেশনে নেমেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু
করেছি। রিয়ন হাপাতে হাপাতে ছুটে এলো, রীতিমত চেচাচ্ছে।
” এ্যাই, আমাকে ফেলে যাচ্ছিস নাকি! নিজের গ্রামে এসে একেবারে তুচ্ছতাচ্ছিল্য! এসব তো
সহ্য করা যায় না ”
” কি রে, কথা বলিস না কেনো? রাগ করেছিস? কিন্তু কেনো?”
” আজব তো! বলবি তো কিছু! ঐ মেয়েটার সাথে কথা বলেছি বলে রাগ করছিস? আরে ও তো
একটা হেল্প চাইছিলো। ঐজন্যই….”
আমি এবার মুখ খুললাম, ” সবাইকেই তো হেল্প করিস! সুন্দরী। মেয়েদের বেশি হেল্প করিস।
মিস্টার পরোপকারী! ”
রিয়নর কথাটা বোধহয় খুব লেগেছিলো। একদম আমার সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লো। আহত গলায়
বললো, ” আমাকে তোর ওরকম ছেলে বলে মনে হয়? এতোদিন ধরে এই চিনলি তুই আমাকে! আমার
নিজেরও একটা বোন আছে, মেয়েদের কিভাবে সম্মান করতে হয় আমি জানি…”
“হ্যা। মেয়েদেরকে সম্মান করতে শিখেছিস, কিন্তু কখনো কাউকে ভালোবাসতে শিখিসনি! “রিয়ন বোধহয় থমকে দাড়ালো। আমি সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। পাশে বিল…বহুদূর অবধি।
রাস্তাটা মাত্রাতিরিক্ত নির্জন। এমনিতেও খুব একটা ভালো নয়। দুর্নাম আছে খুব। আমি
জোরে জোরে হাঁটছি। রিয়ন আমার পিছু পিছু আসছে…
হঠাৎ যা নিয়ে ভয় করছিলাম সেটাই হলো। কোথা থেকে একটা ছিঁচকে চোর এসে সটান সামনে
দাড়িয়ে পড়লো। এরকম একটা ছিঁচকে চোরকে ভয় পাবার কিছুই নেই কিন্তু সমস্যা হলো তার
হাতে একটা বড় ধরনের ক্ষুর। আর ছিঁচকে চোরেরা যেখানে সেখানে ক্ষুর বসিয়ে দিতে পারে,
এদের হাতের টিপ ভালো হয়না। আর আমার গ্রামে এসেই এমন একট বাজে অবস্হায় পড়তে হবে
অনিকে সেটা ভাবিনি। এতো সুন্দর গ্রামটাতে এই বাজে মানুষগুলো খুব বেমানান।
ছিঁচকে চোর টা হিসহিস করে বলতে লাগলো, ” যা আছে সাথে বাইর কর, নাইলে ক্ষুর দিয়া এক
পোচে গলা কাইট্যা ফালবাম। আমারে চিনস না… ”
ওর কথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছিলো, এরকম একটা ছিঁচকে চোরের পাল্লায়ই পড়তে হলো আজ!
আমি কোনো ভয় পাচ্ছিনা দেখে চোরটা ঘাবড়ে গেলো। অনি একটু দূরে ছিলো, ও হয়তো
খেয়ালই করেনি ব্যাপারটা। নাহলে এতক্ষণে এটাকে পিটিয়ে সোজা করে ফেলতো। আমি
ওকে বলতেই যাব আচমকা চোরটা আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে পেছন দিকে দৌড়তে শুরু
করলো। একেবারে রিয়ন এর পিছনে গিয়ে ওর গলায় ক্ষুরটা চেপে ধরলো।
আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এমনভাবে রিয়ন এর গলায় ক্ষুরটা ধরেছে যে অনি চাইলেও কিছু
করতে পারবে না। অনির হাত থেকে ব্যাগ খসো পড়েছে। ও একদম স্হির হয়ে আছে। আর একটুও
এদিক ওদিক করলে যদি ক্ষুরটা গলায় চালিয়ে দেয়! আমি নিজেকে নিয়ে কখনো কিছু
ভাবিনি, কিন্তু রিয়ন আমার উইকপয়েন্ট। আর আমাকে সাহায্য করতেই ও এখানে এসেছে। এখন
কোনোক্রমে ওর কিছু হলে ওর অপুকে আমি কি জবাব দেব!
আমি এগিয়ে গেলাম। চোরটা তখনো হুমকি দিয়ে চলেছে। একদম সামনে গিয়ে আমি কয়েক
সেকেন্ড একদম স্হির হয়ে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে, আমি কি করতে
চাইছি ও বুঝতে পারছে না। এমনিতেও মেয়েদের এরা দুর্বল ভাবে।
লোকটা যখন ভাবতে ব্যস্ত আমি কি করতে চাইছি তখন আচমকা আমি প্রচন্ড জোরে চিৎকার
করে উঠলাম।
প্রচন্ড শব্দে মানুষের নার্ভ তার সাথে বিট্রে করে। আমার চিৎকার কাজে দিলো। আচমকা
এতো জোরে শব্দ হবার কারণে লোকটার হাত কেপে উঠলো, ক্ষুরটা পড়ে গেলো হাত থেকে।
রিয়ন ও ঠিকসময়মতো নিজেকে বাঁচিয়ে নিলো।
লোকটা বুঝতে পারলো আমি তার সাথে ট্রিক্স করেছি। কিন্তু সেও ছেড়ে দেবার লোক নয়,
লোকটা আবার এগিয়ে আসছিলো কিন্তু এবার আমি প্রস্তুত। আমি ততক্ষণে লোকটার চোখের
দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রয়েছি। বেশিক্ষণ লোকটা তার নার্ভ ঠিক রাখতে পারবে না,
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওকে নিয়ন্ত্রণ করব আমি।
লোকটা আমার নিয়ন্ত্রণে চলে এলো একটুখানি পরেই। আমি ধমকের স্বরে বললাম, ” দূর হয়ে যা
এখান থেকে। আর ভুলেও এই দিকে আসবি না। ”
লোকটা আমার দিকে তাকানো অবস্হাতেই উল্টোভাবে হাঁটতে শুরু করলো। একদম রোবটের মত।
যাক, ঝামেলাটা মিটলো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছন ফিরতেই দেখি অনি বিস্মিত
চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি তাকাতেই ও প্রায় কাঁপা গলায় বলে উঠলো, ” হি-হি- হিপনোটাইজ! ”
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সবটা বলতে হলো রিয়ন কে। আসলে এতদিন ধরে ওকে চিনলেও কখনো
ওকে এসব বলিনি, হয়তো বিশ্বাস করবে না ভেবে। কিন্তু আজ সামনাসামনি এটা দেখার পর ও
যা অবাক হয়েছিলো বলার মত না। মোতালেব চাচার কথা থেকে শুরু করে সুমন স্যারের কথা সব
ওকে বললাম। ও বিস্ময় নিয়ে সবটা শুনলো। কথা বলতে বলতেই বাড়ি পৌছলাম। তখন চারিদিক
অন্ধকার হয়ে গেছে। আর তাছাড়া বাড়িতে কাউকে জানাইনি যে আজ আমরা আসব, ইচ্ছে
করেই।
আমাকে আর অনিকে একসাথে ঢুকতে দেখে বারান্দা থেকে ফুপির গলার হাঁক শুনতে
পেলাম, ” কে রে? কে এসেছে? ”
আমি কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে ফুপির চোখ দাড়িয়ে গেলো।
” মামনি তুই এসেছিস? এতোদিন পরে বুড়ি ফুপির কথা মনে পড়লো তোর?”
আমি ফুপিকে জড়িয়ে ধরলাম। তার চোখে জল।
বাবা বোধহয় ঘরে ছিলেন, আমার আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলেন।
বাবা বললেন, ” তুই যে আসবি একবারো বললি না! হারু ময়রার দোকান থেকে বিকেলবেলা গরম
গরম জিলিপি নিয়ে আসতুম! আর এই সঙ্গে ছেলেটা কে?”
রিয়ন বললো, আঙ্কেল আমি রিয়ন। ওর বন্ধু। আপনাদের গ্রামটা দেখতে এলাম….
বাড়িতে প্রায় উৎসব শুরু হয়ে গেলো। কি করবে, কি খাওয়াবে….আচ্ছা এই মানুষগুলোর উপর রাগ
করে আমি এতগুলো দিন কিভাবে কাটালাম!
কলের ঠাণ্ডা জলে মুখ ডুবোতে দারুন মজা। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে পিছন ফিরেছি,
দেখি কামিনী ফুলগাছটার নিচে পুষ্প দাড়িয়ে আছে। আমি হাসিমুখে এগিয়ে যেতেই দেখলাম
ওকে কেমন যেনো বিষণ্ণ লাগছে।
” রিয়ন কে আমার কথা বলিসনি ভালো করেছিস। ও বিশ্বাস করতো না যে আমার সাথে তোর
এখনও কথা হয়….
কিন্তু আজ ঐ লোকটাকে এভাবে শাস্তি দিয়ে ঠিক করিসনি। তোর জন্য খুব ভয় হচ্ছে।
সাবধানে থাকিস…!”
পুষ্প যখনই কোনো কিছুর আভাস দিয়েছে তখন সেটা ঘটেছে। নিয়তি কি রেখেছে আমার জন্য
কে জানে! কিন্তু আমি অপেক্ষা করব….
আচ্ছা, তুই যখন মানুষকে হিপনোটাইজ করতে পারিস তখন তোর বাবাকে হিপনোটাইজ করে তোর
মায়ের সম্বন্ধে সবটা জেনে নিচ্ছিস না কেন?
রিয়ন এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেবে তা আমি জানতাম। কিন্তু আমি যদি বাবাকে আমার নিয়ন্ত্রণে
আনতে পারতাম তাহলে নিশ্চই এতদিন অপেক্ষা করতাম না সত্যিটা জানার জন্য।
” দ্যাখ রিয়ন, হিপনোটাইজ করাটা আমি শিখিনি। এটা আমি কিভাবে পারি তা আমি
নিজেও জানিনা। প্রথমবার আমি এটা জানতে পারি মোতালেব চাচাকে শাস্তি দেবার সময়।
সবাইকে আমি হিপনোটাইজ করতে পারি না, কিন্তু খারাপ মানুষগুলোকে সহজেই হিপনোটাইজ
করতে পারি, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে এনে শাস্তি দিতে পারি…”
” তাহলে তো বলতেই হচ্ছে এটা একটা সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার! আমি তো নিজের চোখে না
দেখলে কখনো বিশ্বাসই করতে পারতাম না তোর নীল চোখে এমন জাদু আছে!
জানিস, আমি একজনকে চিনতাম যিনি পয়সা খরচ করে অস্ট্রিয়া থেকে হিপনোটিজম শিখে
এসেছিলেন। কিন্তু তিনিও তোর মত এমন ভাবে মানুষকে হিপনোটাইজ করতে পারেন নাহ…”
রিয়ন কে আমি সবটা বলিনি। পুষ্পকে যে আমি দেখতে পাই, ও আমার সাথে কথা বলে,
বিপদের আভাস পেলে আমাকে সাবধান করে এসব আমি ওকে বলিনি। কিন্তু আমার ক্ষীণ
সন্দেহ আছে, আমার এই অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার কারণ পুষ্প নয় তো?
পুষ্পই কি আমার ভেতর দিয়ে, আমার চোখকে ব্যবহার করে ওদেরকে শাস্তি দেয়!
জানিনা…অথচ পুষ্প বলে ও নাকি আমার কল্পনা। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। সবটা
গুলিয়ে যায়।
“বাদ দে না এসব। আগে আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। আমার মায়ের কথা জানতে
হবে। বাবা বা ফুপি কেউ আমাকে কিছু বলবে না, আমাকে যা করার অন্য কোনো উপায়েই
করতে হবে। ”
ভোরবেলা হাঁটতে খুব ভালো লাগে, ঘাসের উপর জমে থাকা শিশিরগুলো আরো বেশি ভালো
লাগে। কিন্তু গ্রামে আমাকে আর রিয়ন কে একসাথে এভাবে হাঁটতে দেখলে আবার কে কি না
কি মনে করবে! তাই দ্রুত ফিরে এলাম বাড়িতে…
খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলো দশটা বাজবার আগেই। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন।
ফুপিক কেও কেথাও একটা পাঠাতে হবে, বাড়ি ফাঁকা থাকাটা দরকার। কিন্তু খেয়ে উঠে
ফুপি ঘুমিয়ে পড়লেন। এখন যা করার নিঃশব্দে করতে হবে…
আমরা সার্চ করছি, পুলিশ আর গোয়েন্দা রা যেভাবে সার্চ করে ঠিক সেভাবে। একটা ক্লু
পেলেই আমরা অনেকটা এগোতে পারব!
রিয়ন বললো, ” তোর মায়ের কোনো ছবি নেই? ”
– না রে। যতদূর জানি মায়ের সব ছবি বাবা পুড়িয়ে ফেলেছিলো। আর তাছাড়া তখন ছবির
এতোটা চল ছিলো না…
” তোর বাবা তোর মাকে ঘৃণা করতেন নাকি! একটা ছবিও রাখেননি, কোনো বড় ধরনের ঝগড়া
বিবাদ মন কষাকষির কারণেই কি উনি আত্মহত্যা করেছিলেন? আচ্ছা, নাম কি ছিলো ওনার?”
– আমি তো আমার মায়ের নামটাই ঠিকভাবে জানিনা! বাবাকে দু’একবার বলতে শুনেছি নীলু।
আবার বার্থ সার্টিফিকেটে অন্য নাম। নীলুফা বেগম ধরনের কিছু একটা হবে!
রিয়ন হাসতে শুরু করলো, ” নীলুফা? এ তো পুরাণকাল থেকে উঠে এলো রে হিহিহি।
নীলুফা নামের এক মহিলা তার মেয়ের নাম অতন্দ্রিলা রাখে কিভাবে! তোর নাম হওয়া উচিত
ছিলো অন্য কিছু হাহাহা। ”
– দ্যাখ, আমার নাম রেখেছে আমার বাবা। বাবার নাম আনিসুর রহমান।
রিয়ন তবুও খিকখিক করে হাসতে লাগলো । আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিলো। ওর কথায় কান না দিয়ে
পুরোনো ট্রাংকটা বের করে আনলাম।
কি ধুলো… কাশি লাগছিলো। কত সব পুরোনো হাবিজাবি। জমির দলিল, চামড়া ছেড়া
মানিব্যাগ,জং ধরা স্ক্রু ড্রাইভার, কাঁচি, হাতলভাঙা ছুরি…ছেড়া রুমাল কিচ্ছু বাদ নেই।
অনি তখন সবগুলো ড্রয়ার তন্নতন্ন করে খুঁজছে। আমরা কি খুঁজছি তা নিজেরাও জানিনা।
পুরোনো ট্রাংকটা আবার খাটের নিচে রেখেই দিচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ দেখলাম লাল কাপড়ে
মোড়া কিসব কাগজপত্র। ভাবলাম দেখি….চিঠি! হ্যা, অনেকগুলো চিঠি। একটা চিঠি বাবার
নামে, জয়িতা চৌধুরীর লেখা। বাকি সব চাকরী, অফিক নানারকমের…
চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম আমি। কিন্তু পড়ার পর স্তম্ভিত হয়ে রইলাম!
রিয়ন বললো, কি রে কি হয়েছে? কোনো ক্লু পেলি? কি লেখা আছে ঐ চিঠি তে?
” রিয়ন… খুব সম্ভবত আমার মায়ের কোনো বান্ধবী আমার বাবার কাছে চিঠিটা লিখেছে।
জয়িতা চৌধুরী, লিখেছেন যে নীলু মানে আমার মা তার বাড়িতে এক রাত আশ্রয় নিয়েছিলো।
তারপর সে চলে যায়…. উনি জানতে চেয়েছেন আমার মা আর বাবার মধ্যে ডিভোর্স হয়ে গেছে
কিনা! ”
– কি বলছিস কি! তারিখটা কত দ্যাখ তো?
” আমার জন্মের প্রায় আড়াই বছর পরের….”
আমি আর রিয়ন দুজনেই কি বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রিয়ন বললো, তোর মা এ বাড়ি ছেড়ে
চলে গিয়েছিলেন তার মানে তিনি কি আত্মহত্যা করেননি?
– আমি তো বুঝতে পারছি না কিছুই। বাবা আর ফুপিমাও আমাকে কিচ্ছু বলবে না আমি জানি।
” তাহলে উপায়?”
– জয়িতা চৌধুরীর সাথে আমায় কথা বলতে হবে!
” এত বছর পর জয়িতা চৌধুরী কে কোথায় পাবি তুই?”
– আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আর কোনো ক্লু নেই। কেনো জানিনা মনে হচ্ছে এই
জয়িতা চৌধুরীই আমাকে সবটা বলতে পারবে। দ্যাখ চিঁঠির খামে ঠিকানা আছে, ৩২
কিশোরগঞ্জ ; চৌধুরীবাড়ি।
” তুই কি ওখানে গিয়ে তাকে খুঁজতে চাইছিস?”
– হ্যা। আজ তো সম্ভব না, কাল সকালেই যেতে হবে। আমি কখনো কিশোরগঞ্জ যাইনি।
আমাদের তাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বার করতে হবে…
.
.
বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়েই ঘুরতে যাবার নাম করে আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম
পরেরদিন সকালবেলা। ভোরে….বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে প্রথমে গাজীপুর যাব তারপর
সেখান থেকে কিশোরগঞ্জ। লং ওয়ে জার্নি।
কিশোরগঞ্জ পৌছতে পৌছতেই বেলা গড়িয়ে গেলো আমাদের। নেমে অটো তে উঠলাম।
ঠিকানা টা ৩২ কিশোরগঞ্জ। জানিনা এটা ঠিক কি, কিন্তু অটোওয়ালা আমাদের একটা
এলাকায় নামিয়ে ঠিকই দিয়ে এলো।
সারা রাস্তা রিয়ন বসে বসে টেনশন করেছে আর বলেছে লাভ হবেনা, খালি খালি এলাম।
কিন্তু মাঝপথে হাল ছেড়ে দিতে আমি অন্তত পারব না। ঠিকানা চেনাতে সবচে ভালো পারে
চায়ের দোকানদারেরা। আমরা একটা টি স্টলে ঢুকে পড়লাম। চা খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক কথা
বলতে বলতে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কোনো চৌধুরীবাড়ি আছে কিনা!
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সত্যিই ওখানে একটা চৌধুরীবাড়ি আছে আর সেখানে যাবার
রাস্তাটাও বলে দিলেন ঐ চায়ের দোকানদার।
রিয়ন এর চেহারাটা তখন দেখবার মত হয়েছিলো। আমিও যে কম অবাক হয়েছি তা কিন্তু না।
চৌধুরীবাড়ি ঢুকতে লোহার তৈরি বিশাল এক গেট। দারোয়ান পাহারা দিচ্ছে, জয়িতা
চৌধুরীর পরিচিত আমরা ; এই বলে ভেতরে ঢুকলাম। দরজায় কলিংবেল বাজাতেই মধ্যবয়স্ক
হাসিখুশি ধরনের একজন মহিলা এসে দরজা খুললেন। বললেন, ” কাকে চাই?”
আমি বললাম, ” এখানে জয়িতা চৌধুরী বলে কেউ থাকেন? তার সাথে আমাদের খুব দরকার
ছিলো! ”
ভদ্রমহিলা বললেন, ” আমিই জয়িতা চৌধুরী। কিন্তু তোমাদের তো ঠিক চিনলাম নাহ…!”
” আমার নাম অতন্দ্রিলা, অতন্দ্রিলা রহমান । আর ও আমার বন্ধু রিয়ন। আমার বাবা আনিসুর রহমান, তাকে বোধহয় আপনি চেনেন!”
ভদ্রমহিলার চোখ হঠাৎ করেই বড় বড় হয়ে এলো। বিস্ময়ের সাথে উনি বললেন, ” তুমি নীলুর
মেয়ে? নবনী? ”
ড্রয়িং রুমটা সাজানো গোছানো। খানদানি পরিবার বোঝাই যায়…চা চলে এসেছে। রিয়ন
বাটার টোস্টে কামড় বসাচ্ছে। আমি জয়িতা চৌধুরীর কথাগুলো চুপচাপ শুনছি, একমনে।
” তোমার মা তোমার নাম রেখেছিলেন নবনী। কিন্তু তোমার বাবা তোমার মাকে এতোটাই
ঘৃণা করতেন যে তোমার মায়ের রাখা নামটাও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন…
আমি তোমার মায়ের স্কুল জীবনের বন্ধু। নীলুর ব্যাপারে সবটাই আমি জানি। আসলে নীলু
একটা ছেলেকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু ওর মা বাবা ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমার বাবার
সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দেয়। নীলু ভেবেছিলো সবটা মানিয়ে নেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর
হয়নি। তোমার জন্মের পর থেকে ওদের সংসারে অশান্তির মাত্রাটা ক্রমেই বাড়ছিলো।
একসময় নীলু আনিসুর সাহেব কে ছেড়ে চলে আসে। ভেবোনা যে তোমার মা তোমায়
ভালোবাসতো না, তোমাকে নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু তোমার বাবা
তোমাকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন। তখন তোমার বয়স আর কতই বা হবে, দুই কি আড়াই
বছর…”
– মা যখন আমায় ভালোবাসতেন তাহলে এতো বছরেও আমার খোঁজ নেননি কেনো? কেনো আমি
সারাজীবন জেনে এসেছি যে আমার মা মৃত? তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন?
” খোঁজ নেবার বহু চেষ্টা নীলু করেছিলো। তোমার বাবা আগে কিশোরগঞ্জে থাকতেন। নীলু
চলে যাবার পর উনি যে কোথায় চলে গেলেন আমরা কেউ জানতে পারিনি। আত্মগোপন করার
মতই আমাদের সবার সাথে সব যোগাযোগ উনি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। এই যে চিঠিটা
তুমি এনেছো এর উত্তরে উনি বলেছিলেন নীলু তার কাছে মৃত। নীলুর সাথে আর কোনো
যোগাযোগ তিনি রাখতে চাননা।
তারপর আর কখনো কোনো চিঠির উত্তর আসে নি, খোঁজ নিয়ে জানলাম উনি কিশোরগঞ্জেই
আর নেই। ”
– আমার মা এখন কোথায়? তিনি বেঁচে আছেন তো?
” হ্যা। তোমার মা এখন ঢাকায় কোথাও একটা আছে। একটা কলেজের প্রফেসর। সেই ছেলেটার
সাথে নীলুর বিয়েও হয়েছিলো। কিন্তু নীলু সুখী হতে পারেনি। কয়েকবছর হলো সে মারা
গিয়েছে। নীলু তোমার বাবার মত একজনকে ছেড়ে গিয়ে খুব বড় ভুল করেছিলো। তোমার কথা
ভেবে আরো কষ্ট পেতো মেয়েটা…. ”
– আচ্ছা আমার মায়ের নামটা কি বলুন তো? নীলু তো তা
র ডাকনাম। আরেকটা নাম জানি
নীলুফা বেগম । আমার মায়ের আসল নাম কোনটা?
” তোমার বাবা তোমার কাছ থেকে এটাও লুকিয়েছে! আমি তো ভাবতেই পারছি না….
নীলুফা বেগম নাম টা তোমার মায়েরই কিন্তু তা কাগজে-কলমে। তাবে আমরা ডাকতাম
নীলিমা….”
আমি আর রিয়ন দুজনেই বোধহয় বড় ধরনের শক খেলাম। নীলিমা নামে একজনকে আমি চিনি, যার
স্বামী মারা গেছেন। তিনি আমার ম্যাডাম, নীলিমা ম্যাডাম।
আমি দ্রুত রিয়ন কে বললাম ফোনটা বের করে নীলিমা ম্যাডামের ছবি খুঁজে বার করতে। একটা
দুটো ছবি তো থাকবেই, মিনিট পাঁচেক ঘাটাঘাটি করতেই বেরিয়ে এলো একটা ছবি। আমি
জয়িতা চৌধুরীকে ছবিটা দেখিয়ে বললাম, ” ইনিই কি আমার মা? ”
উনি অবাক হয়ে বললেন, ” হ্যা! এই তো নীলু। তোমরা তাকে চেনো?”
আমার কাছে সবটা জলের মত পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো। এজন্যই ম্যাডাম আমাকে এতো স্নেহ
করতেন। কারণ আমাকে দেখলে তার মেয়ের কথা মনে পড়তো। ম্যাডাম কখনো বলেননি কেনো
উনি আমাকে এতো ভালোবাসেন। তাহলে কি আমার নীল চোখ দেখে উনি চিনে ফেলেছিলেন
যে আমিই তার মেয়ে! আর আমার নামটাও তো উনি জানেন না।তাহলে কিভাবে…. মা আর
সন্তানের ভেতরের টান বোধহয় একেই বলে!
জয়িতা চৌধুরীর বাড়ি থেকে দুপুরে না খেয়ে বের হতে দিলো না। উনি বলছিলেন আমার
মাকে কিছু জানাবেন কিনা! আমি তাকে নিষেধ করলাম। আমি নিজেই তাকে জানাবো।
চৌধুরীবাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।
বুঝতে পারছিলাম না হাসব, নাকি কাঁদব নাকি রাগ করব?
রিয়ন বললো, তিনটেই কর। তোর মা বেঁচে আছেন সেইজন্য তোর আনন্দ হওয়া উচিত, মা থাকতেও
মা কে আজ অবধি কখনো দেখলি না সেটা দুঃখের, আর তোকে ফেলে রেখে তোর মা চলে
গিয়েছিলো। সেটার জন্য তোর রাগ করা উচিত!
এরকম একটা সময়েও মানুষ এ ধরনের মজা করতে পারে আমি ভাবতেই পারছিলাম না, আমার
রাগটা বরাবরই বেশি।
সাতখামাইর যখন পৌছেছি তখন গোধূলি। রিয়ন এর সাথে যাব না, ওর উপর রাগ হচ্ছে ভীষণ। দ্রুত
হাঁটতে লাগলাম। আয় পিছু পিছু দৌড়তে দৌড়তে কেমন পারিস!
হাঁটছিলাম ঠিকভাবেই, কিন্তু হঠাৎ কিসে যেনো হোঁচট খেয়ে ভীষণ জোরে মাটিতে আছড়ে
পড়লাম। আর তারপর…তারপর…
জ্ঞান যখন ফিরলো তখন আমি কোথায় আছি বুঝতে পারছিলাম না। হাত নাড়াতে গিয়ে
বুঝলাম চেয়ারের হাতল বা সেরকম কিছুর সাথে হাতটা বাঁধা। চোখটা বাঁধা শক্ত করে, আর খুব
সম্ভবত কালো কাপড় দিয়ে। বুঝতে পারছিলাম না এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব!
তখনই কারোর গলার আওয়াজ শুনলাম। বলছে, ” হ সাব। হেই মাইয়াডারেই আনছি। হের চউখ দিয়া
নীল রঙগের আলো বাইর হয়। কালো কাপড় দিয়া চউখ বাইন্দা রাখসি সাব… ”
গলাটা আমি চিনি! সেই ছিঁচকে চোর টার গলা…স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। পুষ্প কি তাহলে এই
বিপদের কথাই বলছিলো!
তখনই অন্য একটা মানুষের গলার আওয়াজ পেলাম।বলছে, ” ভালো কাজ করেছিস রে রতন। এবার
বুঝবে কত ধানে কত চাল। চোখ দিয়ে জাদুটোনা করা… আমার নামও সিরাজ…এর শেষ দেখে
ছাড়ব। ”
আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। সিরাজ! তার মানে মোতালেব চাচার ছোট ছেলে!
মায়ের ভাবনায় ভুলতেই বসেছিলাম এই গ্রামে আমার খুব বড় একজন শত্রু আছে! মোতালেব চাচা
এতো সহজে আমাকে ছেড়ে দেবে এটা ভাবাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো!
আমার চোখও ওরা বেঁধে রেখেছে।
প্রথমবার অনুভব করলাম আমিই সত্যিই অনেক বড় বিপদে পড়েছি। অনেক বড় বিপদ….
দ্বিতীয়বারের মত জ্বলন্ত সিগারেট আমার হাতে চেপে ধরেছে সিরাজ। হাতের তালু পুড়েছে,
কিন্তু তার চেয়েও বেশি পুড়ছি আমি। ওকে কিচ্ছু করতে পারছি না। আমি জানিও না আমি
কোথায় আছি, রিয়ন কোথায় আছে। এটাও বুঝতে পারছিনা সিরাজ ঠিক কি করতে চায় আমার
সাথে। ও কি আমায় মেরে ফেলবে?
” মাইয়ার বুকের পাটা আছে কইতে অইবো, ছিকারেট দিয়া পুড়াইতেছেন তাও মুখ বন্ধ কইরা
বইয়া আছে! ”
– দেখি কতক্ষণ সহ্য করতে পারে। এই মেয়ের জন্য সারা গ্রামের লোক আমাদের দেখলে থুথু
ছেটায়। আমার আব্বার শেষ জীবনটা এই মেয়েটা জ্বালিয়ে দিয়েছে…
” তা সাব, খালি হাত-পাও পুড়াইবেন? মাইয়ারে একটু পরখ কইরা দ্যাখবেন না? এই মাইয়ার
শইল্যে আগুন আছে। মাইরা ফেলানির আগে শইল্যের জ্বালাও জুড়ায়া নেন, সাব। ”
সিরাজ রতনের কথার উত্তরে কিছু বললো না। লাইটার দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরানোর মত শব্দ
হলো…
তারপর হিসহিস করে ও বললো,
” রতন…ওকে আমি মারব না। ওর চোখ দুটো গেলে দেব। নীল চোখ দিয়ে জাদুটোনা করে, তুকতাক
জানে।
না মারলেও এমন অবস্হা করব যাতে কোনোদিন সবার সামনে মাথা উঁচু করে হাঁটতেও না পারে।
”
শারীরিক কষ্টটাকে কখনো প্রাধান্য দিইনি আমি। সিরাজ আমার সাথে যা খুশি তাই করুক,
আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু ও যদি আমার চোখদুটো নষ্ট করে ফেলে তাহলে তো আমি
কখনো আর রিয়ন কে দেখতেই পাব না, ওকে না দেখে আমি কিভাবে বাঁচব!
ওদের টুকটাক কথার মাঝেই হঠাৎ অন্য একটা অজানা মানুষের গলার স্বর শুনতে পেলাম। সে
হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগলো,
” সিরাজ ভাই, সিরাজ ভাই! আপনাগো বাসায় পুলিশ আইছে আপনারে খুঁজতাসে আপনি
তাড়াতাড়ি বাসায় যান…! ”
সিরাজের বিস্মিত গলা শুনতে পেলাম, ” পুলিশ কিভাবে এলো? ”
– শহর থাইক্যা এই মাইয়ার লগে যে পোলাডা আইছিলো হেয় পুলিশ ডাইক্যা আনছে। হেয় নাকি
সন্দেহ করে আপনার বাপে এই মাইয়ার লগে কিসু করসে। বিরাট কেচ্ছা হইছে ভাই! ”
” তুই যা, আমি এক্ষুণি বাসায় যাচ্ছি…!”
সিরাজ তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে রতনকে বলে গেলো, ” এই মেয়েকে ফেলে
কোথাও যাবি না। হাত পায়ের বাঁধন খুলবি না, আর চোখের বাঁধন তো মোটেই খুলবি না। আমি
আসার আগে এই মেয়ের গায়ে হাত দিবি না। এরে যা শাস্তি দেবার আমি দেব….”
রিয়ন পুলিশ ডেকে এনেছে! রিয়ন কবে এতো বুদ্ধিমান হলো…. কিন্তু এতে কি কাজ হবে? ওর
কাছে তো প্রমাণ নেই। আর ও সন্দেহ করছে মোতালেব চাচাকে কিন্তু সবকিছুর মূলে তো
সিরাজ!
” আফামনি, হেইদিন তো বহুত খেল দেখাইছিলেন চউখ দিয়া। আইজ কি করবেন? হে হে। ”
রতনের কথাগুলো শুনে আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিলো। কিন্তু আমি ওকে বললাম, ” একটু জল! একটু জল
খাবো…”
-এইহানে পানি পাইবেন কই? খাড়ান দেখতাসি আনতে পারি কিনা…
রতন সত্যি সত্যি জল নিয়ে এলো, পাশে বোধহয় একটা রান্নাঘর আছে। কলস থেকে জল ঢালার
শব্দ হলো। আমার কাছাকাছি এসে বললো, ” এই নেন খাইয়া লন। সিরাজ ভাই থাকলে পাইতেন
না হে হে। সেই রতনের থিক্যাই তো পানি চাওন লাগলো…”
– খাব কিভাবে? হাতটা খুলে দাও?
” আফনে বহুত চালাক, ঐসব চালাকি খাটতেসে না আর। আমি গেলাস ধরতাসি আফনে খান ”
আমি জলের গ্লাসে ঠোঁট ছোয়ালাম! একটু বিস্বাদ তবুও ঠাণ্ডা স্রোত গলা বেয়ে নামতে
লাগলো। শেষের দিকে রতন বোধহয় গ্লাসটা বেশি উচু করে ফেলেছিলো, গ্লাস থেকে জল
উপচে আমার গলা বেয়ে নামতে থাকলো।
রতন জিহ্বা দিয়ে চুকচুক শব্দ করে উঠলো। আমার চোখ বাঁধা থাকলেও আমি স্পষ্ট বুঝতে
পারছিলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, খারাপভাবে। চোখ দিয়ে আমাকে গিলে খাচ্ছে।
আমার গা ঘিনঘিন করতে লাগলো।
রতন বললো, ” আফা…আফনি মাশাল্লাহ সোন্দর আছেন… ”
রতন আমার ঘাড়ে হাত রাখলো। ঘেন্নায় আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো। কিন্তু কি করব, দাঁতে
দাঁত চেপে সহ্য করা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই।
হঠাৎ করে রান্নাঘরে থালাবাসন পড়ার ঝনঝন শব্দ হলো। রতন ছুটে গেলো ঐদিকে। তারপর
আবারো ঝনঝন শব্দ হতে লাগলো, বারবার। মনে হচ্ছিলো যেনো ভূমিকম্প হচ্ছে বা সবকিছু
ভেঙে পড়ছে। তারপরই রতনের বিকট চিৎকার শুনলাম, ” আল্লাগো!….” আর সাথেসাথেই মাটিতে
পড়ে যাওয়ার মত শব্দ।
আর তারপরই চারিদিক একদম নিস্তদ্ধ হয়ে গেলো, ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ
নেই। আমি কয়েকবার রতনের নাম ধরে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিলো না… হঠাৎ মনে হলো কেউ
যেনো কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে, ” ভয় পাস না, আমি আছি তোর সাথে…”
আমি চমকে উঠলাম। কে কথা বলে? কিন্তু সেই শব্দটাও মিলিয়ে গেলো…
নির্জনতা ঘিরে ধরেছিলো আমায়। ওরা আমার মুখ বাঁধেনি কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে এখানে
আমি ডাকলেও কেউ শুনতে পাবে না তাই মুখ বাঁধা না থাকলেও কিছু আসে যায় না।
একসময় চেয়ারে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি সিরাজ চলে
আসবে…কিন্তু রাতে সিরাজ আর ফিরলো না।
সকালে আমার ঘুম ভাঙলো কারো একটা পায়ের শব্দে। নিশ্চই সিরাজ…
দরজাটা খোলার আওয়াজ পেলাম। একটা মানুষ এসে সামনেই দাড়ালো। মানুষটা জোরে
জোরে শ্বাস নিচ্ছে…
” অতন্দ্রিলা…!!”
আমি প্রচণ্ড অবাক হলাম রিয়ন এর গলা শুনে। ‘ রিয়ন , তুই এখানে! কিভাবে এলি?”
রিয়ন দ্রুত আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, ” সে অনেক
ঘটনা, কিন্তু তোকে এখানে কে আনলো? কাল সন্ধ্যায় তোকে খুঁজে না পেয়েই বুঝতে
পেরেছিলাম তুই কোনো না কোনো বিপদের মাঝে আছিস। জানিস, মোতালেব চাচার
বাড়িতে পুলিশ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সারা গ্রাম খুঁজেও তোকে পেলাম না..! ”
” আমি জানি…”
– তুই জানিস মানে? কিভাবে জানিস?
” আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে সিরাজ, মোতালেব চাচার ছোট ছেলে। ”
ততক্ষণে ও আমার সব বাঁধন খুলে দিয়েছে । কতক্ষণ পরে চোখ মেলে কিছু দেখছি, সবচে বড় কথা
রিয়ন কে দেখতে পারছি!
যেখানে আমায় আটকে রেখেছিলো সেই ঘরটা ছনের ঘর, চারিদিকে জঙ্গল। পাশেই
রান্নাঘরের মত একটা জায়গায় রতন পড়ে আছে, ওর মাথা ফেঁটে রক্তের ধারা বেয়ে পড়ছে।
থালবাসন মেঝেতে ছড়ানোছিটানো। আমি নিশ্চিত রেললাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা
জঙলামত এলাকা আছে আর ওরা আমাকে সেখানেই নিয়ে এসেছে।
রিয়ন বললো, চল এবার যাই।
” আমি হাঁটতে পারব না রে, একটু পরে চল পায়ে একদম জোর পাচ্ছি না। আচ্ছা, তুই কিভাবে
পৌছলি এখানটায়? আর এই জায়গাটা তো আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে মনে হচ্ছে। ”
– তুই শুনলে বিশ্বাস করবি না কিভাবে এখানে এলাম!
‘ তুই বল? ‘
– কাল তোকে খুঁজে না পেয়ে প্রচন্ড চিন্তায় ছিলাম। সারারাত প্রায় জেগেই ছিলাম। আর
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। হঠাৎ মনে হলো কাল যেখান থেকে তুই হারিয়ে
গিয়েছিলি সেখানটা দিনের আলো তে খুঁজে দেখি একবার…যেমন ভাবা তেমন চলে গেলাম
রেলস্টেশনে। খানিকক্ষণ এদিকসেদিক খুঁজলাম। হঠাৎ কি দেখলাম জানিস? একটা জায়গায়
মাটিতে কিছু একটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার দাগ!
রিয়ন এটুকু কথাতেই আমি বুঝে গেলাম কাল আমি স্বাভাবিকভাবে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাইনি।
নিশ্চই কোনো ফাঁদ ছিলো ওটা!
‘তারপর?’
– আমি ঐ দাগ ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলাম ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে। দেখলাম কিছুটা দূরে
লাল রঙের কিছু একটা চকচক করছে। কাছে গিয়ে দেখি মাটিতে লুটিয়ে আছে তোর এই লাল
ওড়না টা।
সত্যিই তো, আমি তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি রিয়নর হাতে একটা ওড়না রয়েছে আর সেটা
আমারই।
– শুনলে বিশ্বাস করবি না, আমি হাত বাড়িয়ে ওড়নাটা নিতে যাব এমন সময় প্রচণ্ড বাতাস শুরু
হলো। এতো ভোরবেলা এমন ঝড়ের মত বাতাস কিভাবে আসবে আর তাছাড়া আকাশও পরিষ্কার।
বাতাসে ওড়নাটা উড়ে গিয়ে অন্য একটা গাছের ডালে, আর আমি সেটার কাছাকাছি যেতেই
আবারো দমকা হাওয়ার সেটা উড়তে লাগলো। আমি সেটার পিছুপিছু ছুটতে লাগলাম। মনে
হচ্ছিলো যেনো কেউ পথ চিনিয়ে আমাকে কোথাও একটা নিয়ে যেতে চাইছে। বেশ
খানিকক্ষণ ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দেখলাম বাতাস থেমে গেছে। আর তারপরই দেখলাম জঙ্গলের
মধ্যে এই ভাঙাচোরা বাড়িটা। আর তারপর তো…
” ভেতরে ঢুকে আমাকে খুঁজে পেলি তাই তো?”
– হ্যা। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এটা কিভাবে হলো!
” বুঝতে হবেও না। বাদ দে, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে সিরাজ হয়তো চলে আসবে যেকোনো সময়।
আমাদের এখনি গ্রামে ফিরতে হবে। চল! ”
ঘর থেকে বেরিয়ে আমি আর রিয়ন ছুটতে শুরু করলাম। একবার রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছিলাম,
কিছুটা সময় নষ্ট হলো। চারিদিকে ঝোপ-ঝাড়। এখানে যে মানুষের চলাচল নেই বোঝাই যায়।
একটা জায়গায় এসে থমকে দাড়ালাম। দুদিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে, কোনটাতে যাব বুঝতে
পারছিনা। দাড়িয়ে পড়লাম, ” কিরে, আসার সময় কোন রাস্তা দিয়ে এসেছিলি? মনে নেই?
– ছুটতে ছুটতে এসেছি, খেয়ালই করিনি!
“একটা জিনিসও ঠিকভাবে করলি না কোনোদিন! ”
– আরে আমি তো…
কথা শেষ হবার আগেই রিয়ন “আঃ…” করে চিৎকার দিয়ে মাথায় হাত চেপে মাটিতে বসে
পড়লো।
আমি পিছনে তাকিয়ে দেখলাম সিরাজ দাড়িয়ে আছে ওর পেছনে, চোখে কালো রঙের চশমা,
কালো চশমা কি নীল দৃষ্টি থেকে বাঁচবার জন্য? আর… হাতে একটা মোটা শক্ত গাছের ডাল। ও
তার মানে পেছন থেকে রিয়ন ককে মেরেছে! আমি ছুটে গেলাম রিয়ন এর দিকে কিন্তু তার আগেই
সিরাজ আমার চুলের মুঠি ধরে ফেললো আর ঠেলে ফেলে দিলো মাটিতে। রিয়ন কে মারবার
জন্য শক্ত লাঠির মত ডালটা আবারো উচু করলো…
আমি উঠে ছুটে যাবার আগেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো! উঁচু করে ধরে রাখা গাছের ডালটা খসে
পড়লো ওর হাত থেকে। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম, কেমন যেনো যন্ত্রণায় ওর মুখটা কুচকে যাচ্ছে!
হঠাৎ করেই সিরাজ ছুটতে শুরু করলো যেনো কোনোকিছু দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। পালাতে
চাইছে, আমিও দৌড়তে লাগলাম ওর পিছু পিছু। কেনো ছুটছে ও?
ছুটতে ছুটতে একটা সময় ও হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। তারপর ঐ অবস্হাতেই মাটিতে
ঘষড়ে ঘষড়ে এগোতে লাগলো। এবার মনে হচ্ছিলো যেনো কেউ ওকে টানতে টানতে নিয়ে
যাচ্ছে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে খেয়ালই করিনি কখন রেললাইনের কাছে পৌছে
গেছি, দূরে একটা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি দাড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম কিন্তু সিরাজ
মাটিতে ঘষড়াতে ঘষড়াতে গিয়ে থামলো একদম রেল লাইনের ওপরে!
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে, সিরাজ রেললাইনের ওপর থেকে উঠে আসার চেষ্টা
করছে কিন্তু কেউ যেনো ওকে আসতে দিচ্ছেনা। ট্রেনটা ছুটে আসছে, ও ভয়ার্ত চোখে দেখছে।
ওর চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া, বাঁচবার আকুতি গভীরভাবে ফুঁটে উঠছে। কিন্তু না, চলন্ত
ট্রেনটা ওর শরীরের ওপর দিয়ে নিজের গতিতে ছুটে গেলো। আমি ওর বিকট চিৎকার শুনলাম, ওর
শরীরটা আমার চোখের সামনে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। আমি মাটিতে বসে পড়লাম। এইটুকু
সময়ের মধ্যে কত কিছু ঘটে গেলো! ট্রেনটা যখন চলে গেলো তখন আমার সামনে শুধু রক্ত আর
কিছু দলাপাকানো মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিচ্ছু নেই! মাথাটা থেঁতলে পড়ে আছে একটু দূরে।
সাথে আরেকজনকে দেখলাম আমি। পুষ্প!
রেললাইনের ওপারে দাড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে ও!
বিকেলবেলা সিরাজের জানাজায় গেলাম আমি, যদিও আমার যাবার কথা নয়। রিয়ন তখন
বাড়িতে ঘুমোচ্ছে, ওর মাথায় ব্যান্ডেজ। অনেকটা চোট পেয়েছে ও।
মোতালেব চাচা কে দেখলাম আমি। সিরাজের ছিন্নভিন্ন শরীর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা
হয়েছে, তার সামনে বসে হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি। অনেক বয়স হয়েছে ওনার…তবু ছেলের মৃত্যু দেখার জন্যই বোধহয় বেঁচে ছিলেন উনি।
আমি ওনার কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম। তারপর সবার অগোচরে ওনাকে বললাম, ” জানেন তো,
পুষ্প যেদিন মারা গিয়েছিলো সেদিন ওর বাবা মাও ঠিক এই একইভাবে কেঁদেছিলো…”
উনি আহত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি চলে এলাম। মোতালেব চাচা আজ সত্যিই
শাস্তি পেয়েছেন। তার পাপের শাস্তি….
# পরিশিষ্ট :
#
নীলিমা ম্যাডাম দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর কাঁপা কাঁপা
গলায় বললেন, ” আনিস তুমি! ”
বাবা কোনো কথা বললেন না। আমি বললাম, হ্যা। উনি আমার বাবা।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আনিস, অতন্দ্রিলা আমার নবনী? সেই নীল চোখ, ঠোঁটের ওপর
তিল। আমার বারবার মনে হতো ওই আমার নবনী! বারবার মনে হতো। ” তার চোখে জল টলমল
করছে। এক্ষুণি কেঁদে ফেলবেন হয়তো। কেঁদে ফেলার আগেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন,
কপালে চুমু খেলেন। উনি কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ” ম্যাম, আমি আপনাকে মা বলে
ডাকতে পারি? ”
রিয়ন দূরে দাড়িয়ে দেখছিলো, ওর চোখেও জল।
আমি বাড়ির ছাদে বসে আছি। নীলিমা ম্যাডামের বাড়ির ছাদে আগেও এসেছি কিন্তু আমার
মায়ের বাড়ির ছাদে আজ প্রথম এলাম। সামনে মাঠে কেউ খেলছে না, বাতাসে বড়বড় ঘাসগুলো
দুলছে।
অবশ্য আমি একা নই, পুষ্প আছে আমার সাথে।
” অতন্দ্রিলা? কার কথা ভাবছিস…”
– বাবার কথা…. মা চলে যাবার পর এতোগুলো বছর বাবা আমাকে আগলে রেখেছে। কখনো
মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি…আর আমি কিনা তাকেই… জানিস তো, সবাই মোতালেব চাচার মত
হয়না, কেউ কেউ একদম আমার বাবার মত হয়…
” আর সব ছেলেরাও সিরাজের মত হয়না, রিয়ন এর মত ছেলেরাও থাকে…. তোর মা তোর
বাবার মত একজনকে ছেড়ে চলে গিয়ে ভুল করেছিলো, অনেক বড় ভুল। তুই কোনো ভুল করিস না
অতন্দ্রিলা….”
– কি বলতে চাইছিস?
” সেটা তো তুই জানিসই। তুই খুব একা ছিলি, আমি সবসময় তোর সাথে থেকেছি। এখন তোর পাশে
তোর মা বাবা, রিয়ন সবাই আছে। তুই আর একা নোস, সবসময় মনে রাখবি। বুকে সাহস
রাখবি…”
– সিরাজ আর রতনকে তুই শাস্তি দিয়েছিস তাইনা? আজ অবধি সবাইকে তুই ই শাস্তি
দিয়েছিস….বল? দিসনি?
পুষ্প হাসলো। কি অপার্থিব ওর হাসি…. ও শান্তভাবে বললো, “নিয়তি ওদের শাস্তি দিয়েছে…”
হঠাৎ পুষ্প মিলিয়ে গেলো। রিয়ন ছাদে এসেছে…
” কি রে, একা একা ছাদে বসে আছিস যে বড়! ”
– এতদিন পর মা বাবা কে একসাথে মিলিয়ে দিতে পেরেছি। ভাবলাম ওদের একটু একা থাকতে
দিই…. আর আমি তো সবসময়ই একা।
” ও আচ্ছা, আমি কেউ না তাইনা?”
– কে তুই?
” চিনতে পারছিস না নাকি! আমি রিয়ন! ”
– কে রিয়ন?
” আমি, তোর বন্ধু!”
– শুধুমাত্র বন্ধু তাইনা?
রিয়ন আলতো করে আমার হাত ধরলো। বললো, ” রাগ করেছিস? একদম রাগ করবি না প্লিজ,
তুই রাগ করে থাকলে আমার খুব কষ্ট হয় ”
আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম, ” কেনো কষ্ট হয়? ”
” অনেক ভালোবাসি তো, তাই কষ্ট হয়… ”
– সত্যি ভালোবাসিস?
” হ্যা , বাসি তো… ”
-কতটা?
রিয়ন দুদিকে হাত ছড়িয়ে দিয়ে বললো, ” এই আকাশের মত এতোটা….”
আমি খেয়াল করলাম আমার চোখে জল চলে আসছে। রিয়ন সেটা দেখতে পেয়ে বললো, ” এ্যাই
বোকা মেয়ে, কাঁদছিস কেনো?”
– জানিনা কেনো কাঁদছি… আজ বহুদিন পর আমি কাঁদছি। আমি তো কাঁদতেই ভুলে গিয়েছিলাম।
আচ্ছা শোন, আমি কাঁদলে আমার চোখগুলো দেখতে কেমন লাগে রে?
হাওয়ায় আমার চুলগুলো উড়ছিলো। রিয়ন কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে আমার
কপালে চুমু খেলো। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম
পুষ্প ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, ওর মুখের হাসিটা কি মায়াবী…
আমি জানি, রিয়ন আমার হাত কখনো ছেড়ে যাবে না। পুষ্প বলেছিলো আমি খুব একা…কিন্তু
এখন তো আমি আর একা নই।
তাহলে পুষ্প? ও কি আর কোনোদিনও আসবে না?
(সমাপ্ত)