বেবী আধশোয়া হয়ে আছে খাটে। পুরনো দিনের খাট। বেশ উঁচু। খাটের পায়ায় বেশ কারম্নকাজ। বেবীর ভাই বাবু মারা গেছে কয়েকদিন আগে। কিন্তু ওর মৃত্যুর শোক ভুলতে পারছে না কেউ। ওরা ভাবতেই পারছে না বাবু মারা গেছে। মেঝদি চা খাবি? ছবি জিজ্ঞেস করলো। ছবি বেবীর ছোট বোন। না খাবো না। ছবি চলে গেলো অন্য ঘরে। বেবী আধশোয়া হয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো। আধশোয়া হয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম আসলে ঠিক ঘুম না। তন্দ্রা।
একটু পরপর ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। জেগে থেকেও পুরো জেগে থাকা নয়। ঘুম ঘুম চোখ। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কারো দিকে চাইতে ইচ্ছে করে না। এমনকি কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করে না। এইচএসসিতে পড়তো বাবু । ছাঁদে ফুলের বাগান করেছিলো বড়দা। শুধু একশো এক জাতের গোলাপ ফুলই ছিলো।
বাবু প্রতিদিন গাছে পানি দিতো। আগাছা পরিস্কার করতো। মা বললেন তো এক দৌড়ে দোকানে। কলেজের সময় হয়েছে তো বই খাতা গোছগাছ করে কলেজে। মাছ কিনতে হবে তো দৌড়ে বাজারে। সাড়াৰন ছোটাছুটিতেই থাকতো প্রাণবনত্দ বাবু। একদিন বাবা মারধর করলো। তাই বলে অভিমান করে বাবু মরে যাবে? তন্দ্রার ভেতরেই ভাবছে বেবী। কে যেন গায়ে আলতো আলতো ধাক্কা দিচ্ছে। মেঝদি, মেঝদি। বেবী চোখ খুলল। বাবু দাড়িয়ে আছে। বেবী কিছুৰন তাকিয়ে রইলো বাবুর দিকে। যেন মৃত মানুষের চাহুনি। বিশ্বাস অবিশ্বাস মেশানো দৃষ্টি। মেঝদি কেমন আছিস? ভালো। বাবু তুই কেমন আছিস? ভালরে মেঝদি। তুই আমার জন্য কাঁদিস না। আমি ভালো আছি। কবরস্থানের ওসত্দাদজীটা ভালো। উনি আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমাদের মহলস্নার ওসত্দাদজীটা এতো খারাপ কেনরে মেঝদি? আমার জানাজাটাও পড়তে দিলো না?
আত্মহত্যা করলে নাকি জানাজা নামাজ পড়া যায়না। তাহলে কবরস্থানের ওসত্দাদজী কিভাবে পড়লো?
উনি খারাপ লোক মেঝদি। আমি নামাজ পড়তে গেলে আমাকে সবসময় পেছনে পাঠিয়ে দিতো। বলতো বাচ্চারা বড়দের মাঝে থাকলে নাকি বড়দের নামাজ হয়না। আগে আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম দেখতি না? উনি পেছনে পাঠাতে পাঠাতে মহলস্নার দুষ্ট ছেলেদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হলো। পেছনে নামাজ পড়লে ওরা আমার টুপি নিয়ে যেতো। খোঁচা দিতো। লুঙ্গি খুলে ফেলতো। ওদের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে একদিন আমার নামাজ পড়ার অভ্যাস চলে গেলো। আমাদের মহলস্নার ওসত্দাদজীটা অনেক খারাপ মেঝদি। এ লোকটাকে বকে দিতে পারবি? দিবো। তুই মন খারাপ করিস না।
আব্বাকে বলিস আমার জন্য কাঁদতে না। উনি আমাকে তো ভালর জন্যই মেরেছিলেন। আমি অভিমান করে বিষ খেয়ে ফেলেছি। খাওয়ার পরে মনে হলো ঠিক হলো না। আমি মরে গেলে আমার বাবা অনেক কাঁদবে। কিন্তু যখন বুঝলাম তখন আর কিছু করার ছিলো নারে। তুই বিষ খেলি কেনরে বাবু? জানিস তো আমাদের আব্বাটা একটু রাগী। বড় বড় ছেলেমেয়েদের ধরেও মারেন। তোকে তো আগেও মেরেছে। তাই বলে বিষ খেয়ে ফেললি? ঠিক হয়নি মেঝদি। ভুল করেছি। ভুল করে এখানে চলে এসেছি। আমার খুব ফিরে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখানে একবার আসলে ফেরা যায়না। যাই মেঝদি। ওরা ডাকছে। কারা ডাকছে? আমার সাথে যারা থাকে তারা। যাইরে। আমার জন্য কাঁদিস না। আব্বাকে, আম্মাকে বলিস যেন না কাঁদে। কেউ বাবুকে ডাকছে কিনা কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো বেবী। বাবুকে ডাকার কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে কেউ বেবীকে ডাকছে। মেঝদি, মেঝদি। বাবু আসত্দে আসত্দে দেয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ও ডাকছে না। তাহলে কে ডাকছে?
বাবু দেয়ালের ভেতরে মিলিয়ে গেলো। ডাকটি আসত্দে আসত্দে আরো স্পষ্ট হচ্ছে। মেঝদি, মেঝদি।
বেবীর বোনদের কেউ ডাকছে? ওরা কি কেউ কোন বিপদে পড়লো? কে ডাকছে? রম্নবি, ছবি, রোজি না রম্নমি? এই মেঝদি, এই… কে যেনো ধাক্কা দিলো শরিরে। বেবী ঘুরে তাকালো। ছবি ধাক্কা দিচ্ছে। ও, তুই ডাকছিলি আমাকে? আমি খুঁজছিলাম কে ডাকছে। কি হয়েছে? কিছু হয়েছে? তুই কার সাথে কথা বলছিলি মেঝদি? কেন বাবুর সাথে। বাবুর সাথে? হ্যা। ও এসেছিলো। আম্মা, আব্বাকে কান্নাকাটি করতে মানা করে গেছেন। তোরাও কাঁদিস না। আলস্নাহর ইচ্ছা ছিলো ও অসময়ে চলে যাবে। চলে গেছে। শেষ মূহূর্তে ও বুঝেছিলো ও ভুল করেছে। তখন ওর আর কিছু করার ছিলোনা। আর মহলস্নার ওসত্দাদজীটার ওপর ও বেশ রেগে আছে … বাবু কি কি বলে গেছে সব ছবিকে জানালো বেবি। মেঝদি তুই শুয়ে থাক। আমি তোর মাথায় তেল দিয়ে দেই। একটু ঘুমা। ছবি বলল। ছবির কথায় বিছানায় পুরোপুরি শুলো বেবি। ঘুমানোর চেষ্টা করছে। ছবি ওর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। সন্ধায় বেবীকে দেখতে এলেন ডা: নাজিম খান। বেবীর বাবার বন্ধু।
ডাক্তার জানালেন, বাবুর অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেনা বেবী। ওর মসত্দিস্ক ওকে সানত্দনা দিতে একটি কল্পনা সাজিয়েছে। ওর মনের ভেতর তোলপাড় করা নানা বিষয়ই ও বাবুর মুখ থেকে শুনেছে। বেবী যে সানত্দনা বাবা, মাকে দিতো তা-ই বাবুর মুখ থেকে বের হয়েছে। এটি এক ধরনের অসুস্থতা। তবে এ অসুস্থতা বেড়ে গেলে খুব খারাপ হতে পারে। তাই ওকে বুঝাতে হবে বাবু মারা গেছে। মৃত মানুষ আর ফিরে আসেনা। ডাক্তার কিছু ওষুধ দিলেন বেবীকে। ওষুধ খেয়ে বেবী বেঘোরে ঘুমুতে লাগলো।