অশররী কূপের ভূতরে ঘটনা

অশররী কূপের ভূতরে ঘটনা

নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসে পায়ুপথ দিয়ে রমজান কুয়োর মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে। অনেক আগের থাক থাক করা ইট-গাঁথা নামার সিঁড়ি, চলে গেছে একদম অন্ধকার পর্যন্ত। অনেক আগের কুয়ো। ওর মনে পড়ে ছোটবেলায় মাতব্বর কাকার এই পেছনবাড়ির বাগানে কত খেলতো ওরা। আর এই জায়গাটা তখন এরকম জঙ্গল ছিল না। বেশ গোছানো একটা বাগান ছিল। আম জাম কাঁঠাল কামরাঙ্গা সব ধরনের ফলের গাছে ভরা ছিল জায়গাটা। আর মাঝখানে একটা বাঁধানো কুয়ো।দলবেঁধে ওরা মাঝেমাঝে আসতো বাগানে চুরি করে খেতে। মাতব্বর কাকা কখনো মানা করেননি ওদের। দেখলে বলতেন, আইসছে রে বান্দরের দল, গেল আমার জামগুলি সব গেল! কিন্তু ওই পর্যন্তই। কখনো মজা করে লাঠি নিয়ে দৌড়ে যেতেন মিছেমিছি। নিঃসন্তান ছিলেন কাকা, ওদের বেশ স্নেহই করতেন। জায়গাটা এখন বাগান কম জঙ্গল বেশি। মাতব্বর কাকা মারা গেছেন আজ দশ বছর হবে। কাকী আছেন এখনো, ওনার ডাকেই রমজানের আজ এখানে আসা।

কী রে রমজান, কী বুঝলি! রমজানের বউয়ের ঘাড়ে ভর দিয়ে বলে কাকী। রমজানের বউ এ বাড়িতে মাঝেমাঝে আসে, কাকীর সাথে গল্প করে, ছোটখাটো কাজ করে দেয়। কিছু তো দেখবার পারলাম না কাকী, আর দেখবো কেমন তরা। যে গভীর কুয়ো, ঘরে একটা টর্চ লাইট থাকলি পর দেখা যেত। তা কুয়ো বেশ গভীর রে রমজান। আমি যখন বিয়ে করে আসি তখন শুনি একবার নাকি আমার শ্বশুরআব্বার সোনাবান্ধানো লাঠিখানা নাকি পরে গেছিলো কুয়োর মধ্যে। কত খুঁইজলো, সেইচলো, জল ডুব দিয়ে দেখলো, তা সে নাকি তলই পালু না। তা তুমি কচ্ছ তোমার পানের বাটি এখন এই কুয়োর পানিতে খুঁইজে পাবে? বিরক্তমুখে বলে রমজান। আরে একি এখনো সেই কুয়ো আছে নাকি রে, উপরে হাজা গাছপাতা কতকিছু পইরেছে এই দশ বছরে।

তুই একটা টর্চলাইট এনে ফেললি পরই দেখতি পাবি। জিগেস কর না তোর বউকে, সে নাকি ঠন করে শব্দ শুনেছে, কাছেই ছেল তোর বউ। আর রফিকের ছাওয়ালটারে নিয়ে আর পারা গেল নারে বাপু, দুষ্টটা সব সমসময় আমার পানের বাটা নিয়ে খেইলবে! রফিক মেম্বার, কাকার ছোটভাই। কাকারা যৌথ পরিবার। সবাই একসাথেই থাকতেন, থাকেন। একটু থেমে বৃদ্ধা আবার বলেন, ও বাপ, দেখ না একটু নেইমে। তোর বাপ দাদারা তো কুয়ো সেইচেই দিন কাটাতো, তুইও তো কম জানতি নে, দেখ না বাপ, ও পানের বাটা যে উনি এনে দিয়েছেলেন আমাক, ওনার এই ছিতিখানই তো আমার সম্বল। দেখ না বাপ আমার! আচ্ছা আচ্ছা বিকেলে টর্চ নিয়ে আসি, তখন দেখবো খন। কতদিন এসব করিনি বলতি পার? এখন কি কেউ আর কুয়োয় নামে? কত গ্যাস হয় কিছু হয়, কত মানুষ মারা যায়। একি আর আমাগের কাজ, আগে যখন দমকলে ছেলাম তখন একটা ব্যাপার ছেল। যদি উপর থেকে দেখা যায় তবে সকালে নামবনি।

কুয়োটা আসলেই বেশ গভীর। ইটের সিঁড়িতে পা রেখে রমজান বুঝে, গাছে বাঁধা দড়ি ধরে নীচে তাকে একবার। তিরিশ ফিটের কম না হয়ে যায়ই না। দড়িটা আগেই কাছের একটা আম গাছে বেঁধে রেখেছিল সে। জয়নাল, জিজ্ঞেস করে, কোমরে বেঁধে নিলে ভাল হত না ভাই? জয়নাল রমজানের দোকানে কাজ করে। বাজারে রমজানের একটা মুদির দোকান আছে। দরকার হবি নানে রমজান দমকলে যখন ছিল তখনই তার হাঁপানী ধরা পরে বেশ। লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে অনেক। কিন্তু একবার গঞ্জের বাজারে আগুন লাগলে নিভাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গিয়েই ধরা পরে। চাকরিটা আর থাকে না তার।

রমজান পিঠে সিলিন্ডার ঝুলিয়ে মুখে পরে নেয় মাস্কটা। বিকেলেই জেলা শহর থেকে নিয়ে এসেছিল, নামতেই হবে যখন। একে রাহেলা কাকী বলেছে, তার উপর মেম্বারের বাড়ির কাজ। সিলিন্ডার আর মাস্ক চাইতেই দিয়ে দিলেন আসলাম ভাই, মনে হয় বলে ছিল, রফিক কাকাই বলেছিলেন হয়তো। কুয়োর মুখে একবার তাকায় রমজান। কি যেন একটা অস্বস্তিতে মনটা খচ খচ করে। জয়নাল উঁকি মেরে আছে। রমজান মাস্ক খুলে, এই জয়নাল মাথা সরা কুয়ো র মুখ থেকে, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। দড়িটা কোমরে এক প্যাঁচ দিয়ে হাতে ধরে নামতে শুরু করে রমজান। বিশ ফুট নামার পর রমজান আবারো টর্চ মারে নীচে, কালই বিকালে একবার দেখেছিল। কি মনে করে মাস্কটা খুলে একবার সন্তর্পণে শ্বাস নেয়। অবাক হয় রমজান, বাতাস বেশ পরিষ্কার এখানে।

নীচে গাছের ভাঙ্গা ডালপালা পাতা ঝোপঝাড় এর মধ্যে পানের বাটিটা চক চক করছে। পাশেই একটা বেড়ালের খট খটে কংকাল। কতদিন আগে পরে মরেছে কে জানে। আরো ফুটদশেক নেমেই ঘটে ব্যাপারটা। একটা মিহি গলার ডাক। একটা বাচ্চা ছেলের গলা। রমজান, এই রমজান ঘটনার আকস্মিকতায় দড়ি থেকে হাত ফসকে যায় রমজানের। ঝুলে পড়ে কোমরের উপরে। তারপর প্যাঁচ খুলে গিয়ে পড়ে একদম নীচে। কতক্ষণ এভাবে পরে আছে বলতে পারে না রমজান। সম্বিত ফিরে পেতেই ধড়মড় করে উঠতে চেষ্টা করে। তার নিচে শুকনো ডালপালা, পানি নেই এক ফোঁটা। রমজান অবাক হয়। এরকম তো হবার কথা না।

এত নীচে পানি থাকবে না কেন। সিলিন্ডার মাস্ক খুলে পড়ে আছে কাছে, পিঠে একটা ব্যাথা, মনে হয় সিলিন্ডারের উপরে পড়েছে পিঠ দিয়ে। উপরের দিকে তাকায় রমজান। আবছা একটা অন্ধকার চারদিকে। জয়নাল! এই জয়নাল! ডাকে রমজান, কোন সাড়া নেই। জয়নাল নাই, সে মানুষ ডাকতে গেছে ক..কে? কে কথা কয়? সেই বাচ্চার গলা। রমজান তাকায় এদিক ওদিক। কুয়ার দেয়ালে এক পাশে একটা খোড়লের মত একটা জায়গা থেকে আসে শব্দটা। মুখে ঝোপঝাড় হয়ে আছে। খস খস শব্দে এগিয়ে আসতে থাকে কী যেন তার দিকে। হামাক চিনলি না রমজান, আমি কফিল রে ছোট একটা মাথা বের হয়ে আসে গর্ত থেকে। রমজান চিনতে পারে। কফিল, তার খেলার সাথী কফিল। রমজান দ্বিতীয় বারের মত জ্ঞান হারায়।
রফিক মেম্বার হাতে ছাতি খানা দিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে আসতে থাকেন লতাপাতায় ঢাকা পথটি ধরে। রমজানের বাড়িতে তার বড় একটা আসা হয়নি কখনোই।

দাওয়ায় উঠে ভিতরে উঁকি দেন একবার। তার জন্য একটা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার নিয়ে আসে জয়নাল। হাতের ইশারায় ভিতরে নিয়ে যেতে বলেন তিনি। বাইরে থেকেই শুনছিলেন রাহেলা ভাবীর আহাজারি, তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। “ওরে রমজান রে! তোর কী হলো রে বাপ! ক্যান মরতে তোকে নামলাম কুয়োতে।” রমজানের বউ কাজলী পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কাশেম ডাক্তার বিছানার একপাশে বসে বিরক্ত মুখে রমজানের নাড়ি দেখছিলেন আর একটু পরপরই বলছিলেন, ” আরে আপনারা একটু থামেন তো, এই হাউকাউয়ের মধ্যে কি রোগী দেখা যায়, কিছু হয় নি রমজানক, গিয়ান ফিরলি সব ঠিক হয়া যাবি” “কী হয়েছে কাশেম ভাই, গুরুতর কিছু?” রফিক জিজ্ঞাসা করে ডাক্তারের কাছে এসে। রফিক মেম্বার তার ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। বয়স পঞ্চাশের ঘরে এখনো যায় নি তার। ঘুরে তাকায় কাশেম ডাক্তার, বলেন, “মাথায় চোট পেয়েছে, রক্ত যা পড়িছে বাইরেই বোধ করি। হালকা কাটাছেড়া।

মনে হয় পড়েনি বেশি উপর থিকে, জয়নাল ছেলেটার কথায় যা বুঝলাম। এমনিতে হাত পা যা ছিলিসে তা ব্যান্ডেজ কইল্লাম আর.. কিছু ভাংছে বলিতো মনে হল না। জ্ঞান ফিরলি হামাক একটা ডাক দিয়েন।” ব্যাগ গুছিয়ে চলে যায় কাশেম ডাক্তার। “আপনি রমজানক নাইমতে কয়েছিলেন কুয়োতে?” রাহেলা ভাবীকে জিজ্ঞাসা করেন রফিক। “কোন কুক্ষণে যে কলাম রে রফিক, ছাওয়ালটা কুয়োয় পড়ি মুর্ছা গেছু। কিছুই তো কচ্ছে নারে।” রফিক মেম্বারের কপালে ভাজ পড়ে। এবার জিজ্ঞেস করেন জয়নালকে, “তুই ছিলি? কি হয়েছিল, পানিত পড়ে গেছিলো?” জয়নাল পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, বলে “না কাকা, কুয়োয় পানি নেইকো একফোঁটা। রমজান ভাইকে যারে তুলিছে তারা সব বলাবলি কত্তিছেল নীচে নাকি পানি নেই, সব শুকনা খটখট কচ্ছিলো।” “আচ্ছা আমি গেলাম বাড়ির দিকে। ভাবী তুমিও বেশি দের করিও না। কাজলী, রমজান সুস্থ হলে একবার পাঠিয়ে দিস তো।” উঠে পড়েন রফিক মেম্বার।

বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেন। আরো ঘন্টা দেড়েক পরে চোখ খুলে রমজান। রাহেলা কাকী ছিলেন তখনো। “ও বাপ, তুই উঠেছিস বাপ! এখন কেমন বোধ হচ্ছে ? পানি খাবি? ও বউ, এক গেলাস পানি নিয়ে আয় না” রাহেলা কাকী ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পানি খেয়ে রমজান এদিক ওদিক তাকায়। ব্যান্ডেজ করা মাথায় হাত দেয়। “ধরিস নি বাপ, চোট পাইছিস। শুয়ে থাক এখন। এই কাজলী, ডাক্তারকে একটা খবর দে এখনই। “ ডাক্তার এসে সব দেখেটেখে ওষুধ দিয়ে বুঝিয়ে যায় রমজানের বউকে। তারপর সবাই চলে গেলে রমজান উঠে বসে আস্তে আস্তে। “আপনি শুই থাকেন, আজ আর উঠতি হবি না।” কাজলী বলে উঠে। হাতে রমজানের রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল সে, খাইয়ে দেবে বলে। রমজান কিছু না বলে পা ভাঁজ করে আসন কেটে বসে কাজলীর হাত থেকে থালাটা নিয়ে ভাত খেতে শুরু করে গোগ্রাসে। “কিছু হয়নি হামাক।” খেতে খেতেই বলে রমজান। জ্ঞান ফেরার পর এই প্রথম রমজানের কথা শুনতে পায় কাজলী।

রাত তখন দুইটার কাছাকাছি । পাশে থেকে কাজলীর নাক ডাকার মৃদু ডাকার শব্দ শোনা গেলে রমজান উঠে বসে। ভাল করে একবার কাজলীর মুখখানা দেখে বিছানা থেকে নেমে আসে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। আকাশে তখন আধফালি চাঁদ। রফিক মেম্বারের ঘুম ভেঙ্গে যায় দরজা ধাক্কার শব্দে। বিরক্ত স্বরে বলেন, “এই কে রে”। বালিশের পাশে রাখা ঘড়িটা দেখে নেন একবার ঘুমমাখা বিরক্ত চোখে। রফিক মেম্বরের এই দোতালা ঘরটা বড় উঠানের এক কোনায়। সারাদিন নানা জায়গা থেকে নানাধরনের মানুষ আসলে নীচের ঘরেই দেখা করে তারা রফিক মেম্বারের সাথে। রাতে একলাই থাকেন তিনি উপরের ঘরে। তার বউ তাদের বাচ্চাকে নিয়ে আলাদা শোয় ভেতরের বাড়িতে। দুম দুম দুম দুম! শব্দ চলে তার দরজায়। “আরে কিডা, কথা বলে না ক্যান।” বিরক্তস্বরে বলেন রফিক। টর্চলাইট নিয়ে উঠে স্যান্ডেল খুঁজে পায়ে দিয়ে দরজা খোলেন কাঁপা হাতে।

“রমজান, তুই এত রাত্রে.. কী হইছে রে?” ঘুম চোখে বলেন রফিক মেম্বার। ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে রমজান। রফিক সাহেব এবার রমজানকে ভাল করে দেখেন, তার মুখে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে বলেন, “আয় বস ভেতরে। তোর সঙ্গে কথা ছেল। বলতো দেখি কী হইছিল? কুয়োয় কী দেখেছিস?” ভেতরে যেতে যেতে বলেন রফিক মেম্বার। রমজান কিছু বলে না প্রথমে, মেম্বারে ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকায় তারপর ঘর থেকে বের হবার আগে যে পুতাটা নিয়ে এসেছিল হাতে করে তা দিয়ে সজোরে মারে রফিক মেম্বারের মাথায়। “হুক” করে একটা শব্দ করে রফিক মেম্বার ঢলে পড়েন রমজানের গা ঘেষটে। রমজান তাকিয়ে পরে থাকতে দেখে মেম্বারকে, তারপর এক পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে চলতে শুরু করে। রফিক মেম্বারের জ্ঞান ফেরে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে। শক্ত ঠান্ডা কিছুর উপরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। অন্ধকারে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেন না তিনি।

এক অদ্ভুত হেয়ালির মত লাগতে থাকে তার সবকিছু। তার পরনের লুংগি খুলেই তার চোখ মুখ হাত বেঁধেছে রমজান। এক অজানা আতংকে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় রফিক মেম্বারের। মুখবাঁধা অবস্থায় উঁ উঁ করে শব্দ করে উঠেন। তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন রমজান তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। রমজান রফিকের চোখমুখের বাঁধনটা আলগা করে। “রমজান পাগলামি করিস না। কী কচ্ছিস কী তুই! মাথায় চোট খেইয়ে সব গুলিয়ে গেছে নাকি হারামজাদা! হামাক চিনিস? আমি রফিক মেম্বার! এক্কেরে জানে শেষ করি ফেইলবো শুওরের ছাও!” রমজান তাকিয়ে দেখে তাকে। তারস্বরে চেঁচানো শুরু করেন মেম্বার এইবার, “ওরে কে আছিস বাঁচা রে, রমজান হামাক মেরে ফেল্লু রে।” “কাকা..” “অ্যা!” থতমত খেয়ে থেমে যায় রফিক মেম্বার। রমজানের দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে থাকেন। এক লাথি দিয়ে রফিক মেম্বারকে কুয়োর ভেতর ফেলে রমজান। এই কুয়ো থেকেই আজ তাকে তোলা হয়েছিল।

কতক্ষণ ধরে এভাবে পড়ে আছেন বলতে পারেন না রফিক। জ্ঞান ফিরলেও তাই সবকিছু বুঝতে সময় লাগে তার। এই অন্ধকারে চোখ মেলেছেন কি না মেলেননি তাও বোঝার উপায় নেই। বাঁধা হাতদুটো একবার নাড়াতে গিয়ে দেখেন জোর পান না। ব্যথার বোধ এখনো হচ্ছে না তবে মনে হয় বাম হাতটা সরে এসেছে কাঁধ থেকে। পাদুটো গেড়ে গেছে হাজা ডালপালার ভেতর, বোধ নেই। প্রাণ যে যায়নি এখনো তাই অনেক। আস্তে আস্তে উপরের আবছা আলোর উপস্থিতি ধরা দেয় তার চোখে। অন্ধকার সয়ে আসলে সাথে আসে প্রচন্ড ব্যথার বোধ। “বাঁচাওওও, আরি কিডা আছ বাঁচাও!” সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করেন তিনি। ফিকফিক করে হাসে কে যেন বাচ্চার গলায়। এতক্ষণ রফিক খেয়াল করেননি। সামনে একটা খোড়লের মত কী থেকে যেন একদলা অন্ধকার নড়চড়া করে। আতংকে মুখ হা হয়ে যায় রফিক মেম্বারের। বিস্ফারিত চোখে তাঁকিয়ে থাকেন সেই জমাট অন্ধকারের দিকে। তারপর তোতলাতে শুরু করেন, “ক্ক-কে ওখানে!” “কাকা আমি” “আ-আমি কেডা।

“আমি কফিলগো কাকা। চিনতি পাইরছাউ?” কথাগুলো ঘুরতে থাকে কুয়ার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে। রফিক মেম্বার বুঝতে পারেন আবছা আলোতে কালো একটা অবয়ব এগিয়ে এসে পা গুটিয়ে বসে যেন তার সামনে, একটা বাচ্চা। পিঠ দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যায় তার। সবকিছু কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে মাথার ভেতরে। “মাফ কর.. হামাক। হামাক মাফ কর কফিল। আমি সবাক গিয়ে বলবো। ” কাঁদতে শুরু করেন রফিক মেম্বার। “কী বইলবে?” হাসে কফিল। “আমি সব স্বীকার যাব, সব বইলবো।” “কী বইলবে? হামাক যে মার্বেল দিবে বলে দোতালার ঘরে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেলে, মুখ বেঁধে উদোম করে বিশ্রী সব কাজ কইল্লে সব বইলবে?… ‎…আমি পালাতে গেলু তো পেছন থেকে মাথায় মাইল্লে। সিঁড়ি থেকে পইড়ে জ্ঞান হারালাম। ভাবলে বুঝি মারা পড়ছি।

হামাক নি লুকাই রাখলে সারাদিন ওই উপরেরর ঘরে। আর রাত হলি পরে হামার পায়ে লোহার বাটখারা বেঁইধে টানতে টানতে কুয়োয় নিয়ে ফেইল্লে, বইলবে সব?” বলতে থাকে কফিল। ‎ রফিক মেম্বার ফুঁপিয়ে ওঠে। মাথা কাজ করে না তার, এসব কি সত্যিই হচ্ছে তার সাথে? প্রচন্ড পানি পিপাসা পায়। “তিয়াস লাগে কাকা? হামারও লাগছিলু। জ্ঞান ফিরলি পর আমি পানি পানি কই চেঁচাইলে তুমি হামাক কুয়োয় ফেলতি ফেলতি কয়েছিলে, এইতো পানি, কত পানি খাবি খা। … আমি কিন্তু খেয়েছি কাকা, পানিই খেয়েছি শুধু এদ্দিন। দেইখবে?” বলেই কফিল রফিক মেম্বারের কোমরে দুই পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে শক্ত হাতে তার মুখ খুলে ফেলে। তারপর মুখে মুখ রেখে প্রচন্ড তোড়ে উগড়ে দিতে থাকে পানি।

রফিক মেম্বার এর চোখ কপালে উঠে যায়, মুখ দিয়ে গার্গলের মত শব্দ করতে করতে ঝটপট করতে থাকে তার সারা শরীর। তার মুখে, শ্বাসনালী দিয়ে প্রচণ্ড বেগে পানি ঢুকতে থাকে, নাক দিয়ে রক্তের দমকে দমকে বের হতে থাকে পানি। একসময় বামচোখটা বের হয়ে আসে কোটর থেকে, পেট ফেসে যায়, নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসে পায়ুপথ দিয়ে। কিন্তু কফিল থামে না। এত বছরের এক বিশাল অন্ধকূপ উগড়ে দিতে থাকে সে রফিকের ভেতর। উপর থেকে চাতালে হাত রেখে রমজান দেখে নিষ্পলক চোখে। কালোপানির একটা স্তম্ভ কুয়ো বেয়ে উঠে থেমে যায় একসময়। আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরে রমজান।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত