ওঁ আসবেই | ভৌতিক গল্প

ওঁ আসবেই | ভৌতিক গল্প

৮ বছরের বাচ্চা মেয়েটির চেকাপ করার পর যখন ডাক্তার, আরিফ সাহেবকে বললেন, “ওহ মাই গড! আপনার মেয়েতো প্রেগনেন্ট।” কথাটা শুনে আরিফ সাহেব রিতীমত হতভম্ব হয়ে গেলেন। এটা কী করে হলো! একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে এই কাজ কে করবেন! তার বাড়িতে তিনি ছাড়া আর কোনো পুরুষ নেই। ডাক্তার সাহেব নিজেও বেশ চমকে গিয়েছেন রিপোর্টটা দেখে। তার এই পুরো জীবনে এত অল্প বয়সের কোনো মেয়েকে তিনি প্রেগনেন্ট হতে দেখেননি। এছাড়া মেয়েটার বয়সঃন্ধী শুরুর বয়সই হয়নি এখনও। কিন্তু চেকাপে তার পেটে স্পষ্ট একটা বাচ্চার ভ্রূণ দেখা যাচ্ছে। যার বয়স কম করে হলেও ৫-৬ মাস। ভ্রূনটির মানব আকৃতির মতোই হয়ে গেছে। অথচ বাচ্চা মেয়েটির পেট দেখে কিছুই টের পাওয়া যায় না বাইরে থেকে। এই পেটে এই ভ্রূণের অস্থিত্ব থাকা অসম্ভব। কিন্তু রিপোর্ট এটাকেই প্রমাণ করতে চাইছে। তাই ডাক্তার আরও কয়েকবার চেকাপ করলেন। না, তার কোনো ভূল হয়নি। আসলেই মেয়েটির গর্ভে একটি সন্তান রয়েছে।
সন্তান না হলেও কিছুতো একটা মানব আকৃতির আছেই তার গর্ভে।

মেয়েটার নাম মাইশি। মাইশির বাবা আরিফ সাহেব ডাক্তারের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। মাইশি ৩-৪দিন ধরে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কোনো খাবার মুখে দিচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। শরীর দুর্বল হয়ে যায়। তাই আরিফ সাহেব তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন। যদিও সমস্যাটা অনেক বছর ধরেই মাইশির সাথে ঘটছে। আর ডাক্তার কী আজব কথা বলছে! তাই আরিফ সাহেব বেশ উত্তেজিত হয়ে ডাক্তারকে বলতে লাগলেন, আপনি কী পাগল হয়ে গেছেন ডাক্তার? এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে সম্পর্কে এমন অদ্ভুত কথা বলতে আপনার মুখে বাজল না! এর চেহারা দেখে আপনার কী মনে হয় এর গর্ভে এতবড় একটা সন্তান থাকবে? আর থাকলে তা শরীরের বাহিরের অংশ জানান দিবে না?

ডাক্তার সাহেব মুখ গোমড়া করে রইলেন। এর উত্তর তার কাছেও নেই। এমন অদ্ভুত ব্যাপার তিনি এর আগে কখনই দেখেন নি বা শুনেননি। সন্তান ধারণের ক্ষমতার জন্য মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট বয়স রয়েছে। সেটা ১২ এর উপরে। কিন্তু মেয়েটার বয়স মাত্র ৮। তিনি নির্বাক। আরিফ সাহেবও বেশ রেগে উত্তেজিত হয়েই হাসপাতাল ত্যাগ করলেন। বাড়িতে ফিরে এসে মাইশিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চুপচাপ তার মাথার পাশে বসে রইলেন তিনি। মাইশির অসুস্থতা আগের মতই আছে। কিছুই খেতে চাচ্ছে না। কিছুদিন ধরেই প্রচন্ড জ্বর মেয়েটার। সামান্য জ্বর থেকে রোগটা বড় হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে একটা সুস্থ মস্তিষ্কের ডাক্তার এমন অদ্ভুত কথা কী করে বলতে পারেন! আরিফ সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইমরান হোসেন। খুব বড় ডাক্তার তিনি। পরিবার নিয়ে গেছেন বিদেশে বেড়াতে। আজই তার দেশে ফেরার কথা। তাকে এই বিষয়ে জানানো দরকার। আরিফ সাহেব ইমরান হোসেনকে কল করে জানতে পারেন তিনি গতকালের ফ্লাইটেই দেশে ফিরেছেন। মাইশির অসুস্থতার কথা শুনেই তিনি বলেন এখনই তিনি আসবেন।

আধা ঘন্টার মধ্যেই ইমরান তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আরিফ সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। মাইশি বিছানায় শুয়ে আছে। ইমরান কিছুক্ষণ মাইশিকে পরীক্ষা করে বলেন,তেমন কিছুইতো হয়নি। সামান্য জ্বর আর শরীরটা দুর্বল। কয়েকটা ভিটামিন খাওয়াতে হবে। এছাড়া ভালো কিছু খাবার খাওয়ালেই সে সুস্থ হয়ে যাবে। আরিফ সাহেব ডাক্তার ইমরানকে নিয়ে মাইশির ঘর থেকে বের হলেন। ইমরানকে চেকাপ করার পর সেই ডাক্তারের বলা সব কথা খুলে বললেন। ইমরান কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে বড় বড় চোখ করে আরিফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বেশ রেগেই বললেন, কোন ছাগল এমনটা বলেছে! একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে এই ধরণের রসিকতার কোনো মানে হয়! আরিফ সাহেব ডাক্তারের নাম বলতেই ইমরান বেশ অবাক হয়। এই ডাক্তারকে ইমরান চেনে। সে ইমরানের চেয়েও সিনিয়র ডাক্তার। এবং শহরে তার বেশ খ্যাতি রয়েছে। তিনি অকারণে এইরকম অদ্ভুত একটা কথা কখনও বলবেন না।

ইমরান আরিফ সাহেবের বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেলেন ডাক্তার ইলিয়াসের চেম্বারে। যেখানে মাইশিকে চেকাপ করা হয়েছিল। তার কাছ থেকে মাইশি সম্পর্কে সব কিছু জানতে চাইলেন ইমরান। ডাক্তার ইলিয়াস তাকে মাইশির সমস্ত রিপোর্ট দেখালেন। ইমরান রিপোর্টটা দেখে পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রিপোর্টে মাইশির গর্ভে স্পষ্ট একটা ভ্রুণের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সাধারণত মাতৃগর্ভে ভ্রুণের বয়স ২৪-২৬ সপ্তাহ হলে ভ্রূণ এমন আকৃতি হয়।
ইমরান বিস্ময়ভরা কন্ঠে ইলিয়াসকে বলল:
-ওহ মাই গড! একটা ৮ বছরের বাচ্চা মেয়ের গর্ভে এত বড় একটা ভ্রূণের অস্তিত্ব কী করে থাকতে পারে? এছাড়া মেয়েটাকে আমি মাত্র পরীক্ষা করে এলাম। তার শরীর দেখতে একেবারে স্বাভাবিক।
-আমিও কিছুই বুঝতে পারছি না। এইরকম বিরল কেস আমি এর আগে কখনও দেখিনি।
-এইটা কী টিউমার হতে পারে না?
-এতবড় একটা টিউমার হলে শরীরের বাহিরে তা জানান দিত অবশ্যই।
-মেয়েটাকে বাহির থেকে দেখতে তো স্বাভাবিক লাগে। তার কোনো বড় ধরণের রোগ থাকলেও বোঝার উপায় নেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ এতকিছু বাদ দিয়ে মেয়েটার পেট চেক আপ করতে গেলেন কেন? আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আপনার কেন মনে হলো মেয়েটের পেটে কোনো রোগ থাকতে পারে?
-আসলে আমি মেয়েটাকে স্বাভাবিক ভাবেই চেক আপ করছিলাম। মেয়েটা প্রচন্ড জ্বরে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। হঠাৎ সে ঘোরের মধ্যেই বলতে শুরু করল তার পেটের ভেতর থেকে নাকি অনেকদিন ধরেই কিছু একটা প্রচন্ড আঘাত করে, তাকে খুচায়। আমি বেশ অবাক হলাম। কৌতুহল বসতই চেকাপ করলাম। আর এইরকম অদ্ভুত একটা জিনিস দেখলাম।

ডাক্তার ইলিয়াস এবং ডাক্তার ইমরান বেশ কিছুক্ষণ নীরব ভাবে বসে রইলেন। এরপর ডাক্তার ইলিয়াস ইমরানের কাছে মাইশির পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। এবং তিনি কী করে আরিফ সাহেবকে চেনেন তাও জানতে চাইলেন। ইমরান এবার বেশ উত্তেজনার সাথেই বলতে আরম্ভ করলেন।

আরিফ আমার কলেজ বন্ধু। সেখান থেকেই তার সাথে আমার গভীর বন্ধুত্ব। আরিফ ২২ বছর বয়সেই শম্মী নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করে। তাদের বিয়ের পরের ৮ বছর কোনো সন্তান হয় না। শম্মী বা আরিফ যে কেউ হয়তো বন্ধা ছিল। তবে এবিষয়ে আরিফ আমাকে কিছুই বলেনি। একটা বাচ্চা সন্তানের জন্য যে তাদের মধ্যে হাহাকার ছিল তা বেশ বুঝতে পারতাম। আমি কয়েক বার বললাম চেকাপ করাতে। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। কিন্তু আরিফ আমাকে এড়িয়ে যেত। সে যে অন্য কোথাও আমাকে না জানিয়ে চেকাপ করাতো তা আমি টের পেয়েছিলাম। তাই আর এই বিষয়ে তাকে বেশি ঘাটাতাম না। বিয়ের ৯ বছরের মাথায় মাইশির জন্ম হয়। তারপরে তাদের সংসার বেশ আনন্দের সাথেই কাঁটতে থাকে। মাইশির বয়স যখন ৩ তখন শম্মীর গর্ভে আরও একটি সন্তান আসে। কিন্তু সেই সন্তান আর পৃথিবীর আলো দেখতে পারেনি। ভ্রুণের বয়স যখন ৬ মাস তখন হঠাৎ একদিন শম্মী আত্মহত্যা করে।

আত্মহত্যার কথাশুনে ডাক্তার ইলিয়াস বেশ চমকে উঠেন। বিস্মীত কন্ঠে বললেন, গর্ভাবস্থায় আত্মহত্যা করলেন কেন তিনি? ইমরান কিছুটা শান্তস্বরে উত্তর দিল, সেটা আমি জানি না।
এই বিষয়ে আমি আরিফকে কিছুই কখনও জিজ্ঞেস করিনি। সেও কিছু বলেনি কখনও। শম্মী কোনো আত্মহত্যার নোট রেখে যায়নি। তার লাশটা সিলিংএ ঝুলে ছিল। পুলিশ সন্দেহ করে আরিফ তাকে শ্বাসরোধ করে মেরেছে। আরিফকে তারা ধরেও নিয়ে যায়। কয়েক সপ্তাহ পরে এমনিতেই ছেড়ে দেয় তাকে। আরিফের স্ত্রীর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই তাকে ঘাটাতে থাকে। তাই তাদের সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে সে। একমাত্র আমিই এবিষয়ে তার কাছে কিছুই জানতে চাইতাম না। তাই এখনও তার সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে।

ডাক্তার ইলিয়াস বেশ মনোযোগ দিয়েই ইমরানের কথা শুনলেন। ইমরান সেই রিপোর্টগুলো নিয়ে ইলিয়াসকে বিদায় জানিয়ে তার চেম্বার ত্যাগ করেন। এবিষয়ে যেকোনো সহায়তা লাগলে ডাক্তার ইলিয়াস তাকে সহায়তা করবেন, এই বিষয়েও ইমরানকে তিনি আশ্বস্ত করেন।

ডাক্তার ইমরান তার চেম্বারে ফিরে আসেন। একটা আট বছরের বাচ্চা মেয়ের এই অবস্থা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। তার উপর মেয়েটা তার খুব পরিচিত। রিপোর্টগুলো বেশ ভালো করে দেখলেন ইমরান।দেখার পর আরিফ সাহেবকে কল করে মাইশিকে নিয়ে একবার তার চেম্বারে আসতে বললেন।

আরিফ সাহেব এবং মাইশি ডাক্তার ইমরানের চেম্বারে আসলেন। ইমরান, আরিফকে বসিয়ে রেখে মাইশিকে
নিয়ে গেলেন চেকাপের জন্য। মাইশিকে চেকাপ রুমে গিয়ে তার কাছ হতে জানতে চান, আচ্ছা মা মাইশি, তোমার পেটে কী কোনোরকম যন্ত্রনা হয়? মাইশি শান্ত স্বরে উত্তর দিল, মাঝেমধ্যে খুব যন্ত্রণা হয়। মনে হয় কেউ পেটের ভেতর থেকে খোচাচ্ছে। আবার মনে হয় পেটের ভেতর কিছু একটা নড়ছে।

ডাক্তার ইমরান মেয়েটার চেকাপ করালেন। চেকাপ করার পর রিপোর্ট দেখে আবার একবার বিষম খেলেন। ডাক্তার ইলিয়াসের রিপোর্ট ভূল না। ইমরানের রিপোর্টেও স্পষ্ট ৬ মাস বয়সের একটা ভ্রুণের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটাতো অসম্ভব। এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে। ইমরানের মাথায় কিছুই আসছেনা।

তিনি মাইশিকে রুমে বসিয়েই আরিফ সাহেবের কাছে যান। আর সব কিছু গুছিয়ে বলেন। বলেন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। দুটো জায়গায় একই ভূল কিছুতেই হতে পারে না। নিশ্চই মাইশির পেটে কোনো গন্ডগল রয়েছে। এখন অপারেশন করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। আগামীকালই তিনি ডাক্তার ইলিয়াসকে সাথে নিয়ে অপারেশন করতে চান। আরিফ সাহেব বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। ডাক্তার ইমরান তাকে আশ্বস্ত করেন, তার কোনো ভয় নেই। মাইশির কিছুই হবে না। আরিফ সাহেব মাইশিকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন।

মাইশি বিছানায় ঘুমাচ্ছে। তার ঘুমন্ত চেহারা দেখে মনে হবে এই পৃথিবীতে
তার চেয়ে সুখী মানুষ আর কেউ নেই। আরিফ সাহেব মুগ্ধ দৃষ্টিতে মাইশির মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মেয়েটার মুখটা হয়েছে মায়ের মতোই। হঠাৎ শম্মীর কথা মনে হতেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। এটা কান্নার পুর্বলক্ষণ। তার অশ্রুজল যেন শম্মীকে নিয়ে তার সমস্ত স্মৃতিগুলোকে একত্রিত করছিল। তাদের সংসারের কত কষ্টের পর মাইশি এল তাদের জীবনে। কত আনন্দেই না কাটছিল তাদের সেই দিনগুলো। মাইশির যখন ৩ বছর বয়স তখন তাদের জীবনে আরও একটি আনন্দের সংবাদ এল। শম্মী আবার মা হতে চলেছে। আরিফ সাহেবের আনন্দ দেখে কে! কিন্তু এই সংবাদের পর থেকেই যেন তাদের সংসারে অন্ধকার নেমে এল। শম্মী কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে চেচিয়ে উঠত। হঠাৎ একদিন আরিফ সাহেবকে শম্মী বলেছিল, চলোনা আমাদের একটা মেয়েতো আছেই। আর সন্তানের কী প্রয়োজন। গর্ভে যে আছে তাকে গর্ভপাত করে ফেলি। কথাটা শুনে আরিফ চমকে উঠেছিল। শম্মীর কাছ থেকে এমন কোনো কথা তিনি আসাই করেননি। শম্মীকে বেশ বকলেন তিনি। গর্ভের সন্তানকে নিয়ে শম্মীর দুঃশ্চিন্তা যেন বেড়েই চলেছিল। আরিফ এটা আঁচ করতে পারছিল। কিন্তু এর কারণ বুঝতে পারছিল না। বুঝতে চাইছিলও না। শম্মীর এই ইচ্ছাগুলোকেই অনেক হালকা ভাবে নিলেন তিনি। এতেই ঘটল
অঘটন। একদিন অফিস হতে বাড়িতে ফিরতেই দেখলেন বাড়ির বড় গেটটা খোলা। তিনি বাড়িতে ঢুকতেই মাইশির কান্নার শব্দ পেলেন ঘরের ভেতর থেকে। দ্রুত ঘরে ঢুকতেই দেখলেন মাইশি মেঝেতে বসে বসে কাঁদছে। সিলিংএ শম্মীর ঝুলন্ত লাশ। জিহ্বা বেরিয়ে রয়েছে। বড় বড় চোখ গুলো যেন তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই মৃত্যুর কারণ আর আরিফ সাহেবের জানা হয় নি। এরপর থেকেই তার জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। মাইশি বড় হলো। কিন্তু তাকে ঘিড়ে অনেকগুলো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেছে। মাইশি এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারেননি। শম্মী মারা যাওয়ার পর এই বাড়ির সব কাজের লোক ভয়ে পালিয়ে যায়। চলে যাওয়ার পেছনে তাদের অদ্ভুত কথাশুনে আরিফ বেশ অবাক হয়। কাজের লোকেরা বলে তারা নাকি রোজ রাতে অনেকগুলো কালো ছায়া দেখে। সবগুলো ছায়াই শম্মীর গলায় তাদের সাথে কথা বলে। তাদের নাকি চলে যেতে বলে এই বাড়ি ছেড়ে। আরিফের এই কথা বানোয়াট ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। শম্মী যদি মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরেও আসে। তবুও সে প্রথমে দেখা করবে তার সাথে বা মাইশির সাথে। এদেরকে ভয় দেখানোর কোনো মানেই হয়না। নতুন যেসকল কাজের লোক রাখা হয় তারাও এই একই কথা বলে। তারাতো আর শম্মীকে চিনত না। তাই বলতো, অনেকগুলো কালো ছায়া একটাই মেয়ের কন্ঠে তাদের বলত, চলে যাও এই বাড়ি ছেড়ে। আর কোনো উপায় না পেয়ে কাজের লোক এই বাড়িতে নিষিদ্ধ হলো। আরিফ সাহেব নিজের অফিস ছাড়লেন। যেহেতু নিজের বাড়ি এবং ব্যাংকে বেশ মোটা অংকের টাকা রয়েছে তাই তাকে আর তেমন কষ্ট করতে হয়নি। একটা ব্যবসা দাড় করান এবং নিজেই মাইশিকে বড় করে তুলেন। তবে ছোটবেলা হতেই মাইশি হঠাৎ হঠাৎ এমন অসুস্থ হয়ে যায়। টানা অনেকদিন জ্বর থাকে, মাইশি কিছু খেতে পারে না। শরীর দুর্বল হতে থাকে। একাই ঠিক হয়ে যায় বিধায় এই বিষয়ে তেমন মাথা ঘামায় না আরিফ সাহেব। তবে এই প্রথম এর জন্য ডাক্তারের চেম্বারে মাইশিকে নিয়ে গেলেন তিনি। আর তার বন্ধু ডাক্তার সহ আরেক ডাক্তার কী অদ্ভুত তথ্য দিলেন তাকে। কাল নাকি মাইশির অপারেশন হবে। আরিফ সাহেব বেশ চিন্তায় রয়েছেন। মাইশিকে এবিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। একটা বাচ্চা মেয়ে বুঝবেই বা আর কী!

পরেরদিন বিকালে শহরের একটা বড় হাসপাতালে নেওয়া হলো মাইশিকে। এই হাসপাতালে ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াস উভয়েই অপারেশনের কাজ করে থাকেন। মাইশিকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আরিফ সাহেব চিন্তিত মুখ নিয়ে অ.টির বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘন্টা খানেক পর ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াস গম্ভীর মুখে অ.টি থেকে বের হলেন। আরিফ সাহেব দ্রুত তাদের কাছে গেলে ইমরান বলেন, চিন্তা করো না বন্ধু। মাইশির কিছু হয়নি। আমরা পরীক্ষা করে কিছুই খুঁজে পেলাম না। তবে এর শেষ দেখে ছাড়ব আমরা। তোমার মেয়ের কিছুই হবে না। সে অচেতন হয়ে আছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরবে। এখনই তাকে বের করা হবে। কালকেই তুমি নিয়ে যেতে পারবে তাকে।

ইমরান এবং ইলিয়াস দুজনের মুখেই মাক্স পড়া। তাদের চোখ ভয়ংকর রকমের লাল। এই চোখ আর ইমরানের অদ্ভুত চাঁপা কন্ঠের কথা শুনে বেশ চমকে যান আরিফ সাহেব। তারা যেন একটা ঘরের মধ্যে রয়েছে। আর অপারেশনের পরের দিন পেশেনকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে এটা শুনেও তিনি বেশ অবাক হলেন। ইমরান এবং ইলিয়াস তাকে দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। অচেতন মাইশিকে বেডে স্থানান্তর করা হলো। সারারাত সে চোখ খুলেনি। আরিফ সাহেব সারারাত তার বেডের পাশেই জেগে ছিলেন। শেষরাতে চোখ লেগে যায় তার। সকালে মাইশির ডাকে তার ঘুম ভাঙে। বাবা, পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কেউ যেন ভেতর থেকে খোচাচ্ছে। আরিফ সাহেব চমকে ঘুম থেকে উঠেন। মাইশির অপারেশনের কাপড় সড়িয়ে পেট দেখে তিনি বেশ অবাক হন। পুরো পেটে অপারেশনের কোনো চিহ্ন নেই। এরইমধ্যে হাসপাতালের একজন নার্স এসে ভয়ংকর একটা সংবাদ শুনালেন। যা শুনে আরিফ সাহেবের হৃদপিন্ড যেন থেমে যেতে চাইছে। পায়ের নিচ হতে মাটি সড়ে যাচ্ছে। তার বন্ধু ডাক্তার ইমরান এবং ডাক্তার ইলিয়াস দুজনেই নাকি গতরাতে আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছেন।
মাইশির অপারেশনের কাপড় সড়িয়ে পেট দেখে তিনি বেশ অবাক হন। পুরো পেটে অপারেশনের কোনো চিহ্ন নেই। এরইমধ্যে হাসপাতালের একজন নার্স এসে ভয়ংকর একটা সংবাদ শুনালেন। যা শুনে আরিফ সাহেবের হৃদপিন্ড যেন থেমে যেতে চাইছে। পায়ের নিচ হতে মাটি সড়ে যাচ্ছে। তার বন্ধু ডাক্তার ইমরান এবং ডাক্তার ইলিয়াস দুজনেই নাকি গতরাতে আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছেন।

সব ঘটনাগুলো যেন আরিফ সাহেবের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হচ্ছেটা কী এসব! মাইশির অপারেশনটা কেন করা হলো না! ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াস শুধু শুধু অপারেশনের নাটক ইবা কেন করল! আরিফ সাহেবের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তিনি রুমের নার্সের কাছে জানতে চাইলেন, মাইশিকে গতকাল ও.টি তে নেওয়া হলেও অপারেশন কেন করেননি তারা। নার্স কথাটা শুনে বেশ অবাক হন। আরিফ সাহেবের কথা মানতে চান না। তিনি বললেন অপারেশন তো হয়েছে। অপারশনের প্রমাণস্বরুপ মাইশির পেটে সেলাইয়ের দাগ যেই দেখাতে যাবেন তখন নার্স আরও বেশি বিস্মীত হলেন। মাইশির পেটে অপারেশনের কোনো চিহ্নই নেই। নার্স বিস্মীত কন্ঠে আরিফ সাহেবকে বললেন, হায় খোদা! এটা কী করে হল। গতকাল অপারেশনের সময় আমি নিজে থিয়েটারে ছিলাম। নিজের চোখে মেয়েটাকে অপারেশন করতে দেখেছি। অপারেশনের মাঝপথে কিসের জন্য যেন আমি সহ বাকি ২ জন নার্সকে ও.টি থেকে বের করে দিলেন স্যাররা। অপারেশন শেষে আবার এসে মেয়েটাকে নিয়ে যেয়ে বেডে শুইয়ে দিতে। মেয়েটার পেট কাটতে আমি নিজে দেখেছি। কিন্তু মেয়েটার অপারেশনের কোনো চিহ্ন নেই কেন!

নার্সের কথাতে আরিফ সাহেব বেশ বিরক্ত হলেন। এদের কারোই কথার সাথে কাজের কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য আরিফ সাহেব মাইশির বর্তমান অবস্থা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেন। মেয়েটা যদিও বলছে তার পেটে এখনও যন্ত্রণা হয়। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে পুরোপুরি সুস্থ লাগছে। একরাতেই যেন চেহারার মাঝের সব ক্লান্তি মুছে গেছে। আরিফ সাহেব হাসপাতালের বিল মিটিয়ে মাইশিকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মাইশি সম্পুর্ণ স্বাভাবিক এখন। গায়ে জ্বর নেই, শরীরে দুর্বলতা নেই। অপারেশনটার যদিও কোনো চিহ্ন নেই তবুও এই অদৃশ্য অপারেশনটাই যেন মাইশিকে আবার সুস্থ করে দিয়েছে। যদিও এইরোকম সুস্থ মাইশি এর আগেও অনেকবার হয়েছে। আরিফ সাহেব এখন আর মাইশিকে নিয়ে ভাবছেন না। ভাবছেন ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াসকে নিয়ে। এরা হঠাৎ একসাথে আত্মহত্যা করল কেন? ও.টি থেকে বের হওয়ার পরইতো তাদের ব্যবহার বেশ অস্বাভাবিক লাগছিল। সেই লাল চোখ , গম্ভীর কন্ঠ! তাহলে কী তাদের আত্মহত্যার পেছনে মাইশির অপারেশনের কোনো যোগসুত্র আছে!

মাইশি যেহেতু এখন মোটামুটি সুস্থ তাই তাকে বাড়িতে রেখেই আরিফ সাহেব তার বন্ধু ডাক্তার ইমরানের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে গিয়ে যানতে পারেন ইমরানের লাশকে পোস্ট মর্টেমের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইমরানের পরিবারের সাথে তিনি দেখা করেন। যতটুকু জানতে পারেন তা হলো গতরাতে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে তিনি পরিবারের কারও সাথে কোনো কথা বলেন না। সোজা তার বেডরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা আটকে দেন। ইমরান প্রায়ই যখন কোনো অপারেশনে ব্যর্থ হতো তখন এমনভাবে ঘন্টা খানেক চুপচাপ দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতেন। তাই তার স্ত্রী ছেলে-মেয়েরা তাকে আর বিরক্ত করে না।

কিন্তু কয়েক ঘন্টা কেঁটে যাওয়ার পরেও যখন ইমরানের কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না। তখন তারা বেশ দুঃশ্চিনায় পড়ে যান। সমানে দরজা ধাক্কাতে থাকেন এবং ইমরানকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু ইমরানের কোনো উত্তর পান না তারা। হঠাৎ লক্ষ করলেন ঘরের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে তাকাতেই সেই অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটি দেখলেন। সিলিংএ ইমরানের ঝুলন্ত লাশ।

আরিফ সাহেব ঠিকানা জোগাড় করে ডাক্তার ইলিয়াসের বাড়িতেও যান। ঠিক ইমরানের মতো করেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এই দুজনের আত্মহত্যার পেছনের কারণ জানতে পুলিশ তদন্ত করছেন। তাদের প্রাথমিক ধারণা এই দুইজনকে বড় কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো ব্লাকমেইল করা হচ্ছিল। তাই তারা চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। তবে এটা স্রেফ একটা ধারণা। তারা কোনো সুইসাইড নোট রেখে যান নি। আরিফ সাহেবের মনে একটা পাপবোধ কাজ করছে। তার মনে হচ্ছে মাইশির কারণেই তারা মারা গেছে। আবার ভাবলেন, মাইশি বা তিনি এর সাথে কোনোভাবেই জড়িত নয়। তারা হয়তো অন্য কোনো কারণে আত্মহত্যা করেছেন। এর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। মাইশির পেটে যে কোনো ভ্রূণ আছে এটা হয়তো তাদের ভূল ধারণা ছিল। ও.টিতে গিয়ে তারা এটা বুঝতে পারে। তাই বাহির থেকে পর্যবেক্ষণ করে অপারেশন না করেই তারা বেড়িয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার হতে।
নার্স মহিলাটি ভয়ে বানিয়ে বানিয়ে আজেবাজে কথা বলছিল।

আরিফ সাহেব নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বাড়িতে ফিরলেন। মাইশিকে স্বাভাবিক আর সুস্থ দেখে তার মনটা এমনিতেই ভালো হয়ে গেল। দুপুরে রোজকার মতো তিনিই রান্না করেন। দুপুরের খাবার শেষে মাইশিকে নিয়ে গল্প করেন, বিকেলে বাড়ির উঠানে ক্রিকেট খেলেন। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আরিফ সাহেব ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াসের কথা ভূলেই যান।
ইমরান যে তার বন্ধু ছিল তার এই অস্বাভাবিক মৃত্যু কোনো এক অজানা কারণে তাকে ভাবায় না আর।

রাত ৮টা বাজতেই আরিফ সাহেব মাইশিকে বললেন, আজ বাড়িতে রান্না হবে না। আমরা বাইরে থেকে খাবার এনে খাব। তুমি কী খেতে চাও? মাইশি বেশ উত্তেজিত হয়েই বলল, আমি পিজ্জা খাব। আরিফ সাহেব মোবাইলেই পিজ্জা অর্ডার করলেন। আধ-ঘন্টার মধ্যে পিজ্জা আসার কথা। ৪০ মিনিট পার হয়ে গেল।

হঠাৎ ঘরের মেইন দরজায় জোরে কারও ধাক্কানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। নিশ্চই পিজ্জা বয়। কিন্তু কলিং বেল না বাজিয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে কেন? মাইশি বেশ ভয় পেয়ে গেল দরজা এত জোরে ধাক্কানোর শব্দ পেয়ে। তাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে আরিফ সাহেব ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলে দেখলেন পিজ্জা হাতে টি-শার্ট পড়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেয়েটার পুরো শরীর ঘামে চিপচিপে হয়ে রয়েছে। তার চোখে মুখে স্পষ্ট ভয় আর বিস্ময়ের ছাপ। মেয়েটা কী দেখে এত ভয় পেল! আরিফ সাহেবের দিকে চেয়ে মেয়েটা শুধু শান্ত স্বরে একবার বলল, আপনার পিজ্জা। আরিফ সাহেব পিজ্জাটা হাতে নিতেই মরা মানুষের মতো দরজার সামনে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা। আরিফ সাহেব বেশ চমকে উঠলেন। পানির জন্য মাইশিকে ডাকতে লাগলেন। মাইশির কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। আরিফ নিজেই পিজ্জাটা টেবিলে রেখে খাবার ঘর থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলেন। পুরো গ্লাস পানি ঢেলে দিলেন মেয়েটার মুখে। মেয়েটা আঁতকে ধড়ফড় করে উঠে বসল। ভয়ে এখনও তার পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছে। মেয়েটা বিস্ময় ভরা কন্ঠে আরিফ সাহেবকে প্রশ্ন করল, আপনি কে? আমি কোথায়? আমার কী হয়েছিল? মেয়েটার এই কথা শুনে আরিফ সাহেবের মেজাজ বেশ খারাপ হলো। তিনি তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা এবার কোনোমতে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, আপনাদের এই বাড়িতে কী ভূত আছে? আমি ভূত দেখে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আরিফ সাহেব শুকনো গলায় বললেন, বিল কত হয়েছ বলো। টাকা নিয়ে বিদায় হও। মেয়েটা বলল, বিশ্বাস করুণ। আমি যখন এই বাড়িতে ঢুকতে গিয়েছি। হঠাৎ দেখলাম দুটো কালো ছায়া আপনাদের উঠানের পাশের কাঁঠাল গাছটার পেছন থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। দুজনের গায়েই সাদা ডাক্তারী এপ্রোন। কালো ছায়ার গায়ে এপ্রোন দেখে আমি বেশ ভয় পেয়ে যাই। তারা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার হাত-পা যেন অবশ হতে থাকে আর আমি ঘামতে থাকি। তারা পুরুষালী কন্ঠে আমাকে বাড়ির ভেতরে যেতে নিষেধ করল! বলতে বলতে মেয়েটা দরজার সামনে থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। এরপর বলল, বিশ্বাস করুণ আমার তখন দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু গত কয়েকদিনে আমি অনেকগুলো পিজ্জা ডেলিভারী মিস করেছি নানান ভেজালে পড়ে। বস বলেছেন আরেকটা মিস করলেই চাকরী শেষ! চাকরিটা আমার ভীষণ প্রয়োজন। তাই ঐ ছায়াগুলো বেদ করেই পিজ্জা নিয়ে এখানে এলাম। ছায়াগুলো এখনও মনে হয় বাহিরে আছে!

মেয়েটার আজগুবি কথা শুনে আরিফ সাহেবের মেজাজ ক্রমেই খারাপ হচ্ছে! কিন্তু এপ্রোন পরা ডাক্তারের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে বেশ চমকালেন। গম্ভীরভাবে পিজ্জার টাকাটা মেয়েটির হাতে দিয়ে বললেন, তুমি এখন চলে যেত পারো। এইসব গল্প শুনার ইচ্ছা নেই আমার। মেয়েটা আমতা আমতা করে বলল, চলেই যাব। আমার একা যেতে ভয় করছে। আপনি আমাকে একটু বাড়ির বাহির পর্যন্ত পৌছে দিন।

আরিফ সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে মেয়েটাকে বাড়ির বাইরের তার স্কুটি পর্যন্ত পৌছে দিলেন। মেয়েটা দ্রুত চলে গেল। আরিফ সাহেব উঠানের কাঁঠাল গাছটা ভালো ভাবে দেখলেন। কিছুই নেই এখানে। মেয়েটার কথাশুনে মনে হয়নি যে মেয়েটা কোনো বানোয়াট কথা বলেছে। এই বাড়িতে কোনো একটা রহস্যতো রয়েছেই। নাহলে সবাই ছায়া দেখবে কেন! মেয়ের ছায়ার সাথে আবার যুক্ত হয়েছে এপ্রোণ পরা পুরুষ ছায়া। এই ছায়াগুলোর যদি অস্তিত্ব থেকেই থাকে তাহলে তার সাথে দেখা করছে না কেন! আরিফের ধীরে ধীরে অলৌকিকতার উপর যেন বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করল।

আরিফ স্বাভাবিক ভাবেই মাইশির ঘরে গিয়ে মানসিক ভাবে একটা বড়সড় ধাক্কা খেল। মাইশি মেঝেতে পড়ে রয়েছে। আরিফ দ্রুত তাকে বিছানায় উঠালেন। গায়ে হাত দিতেই রীতিমত চমকে গেলেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। পুরো শরীর ভরা ক্লান্তী আর দুর্বলতার ছাপ। এইতো কিছুক্ষণ আগেওতো মেয়েটা সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। হঠাৎ কেন এমন হলো!

সারারাত মাইশির কপালে জলপট্রি দিয়ে রাখা হলো, রাতে কয়েকবার স্পঞ্জ করা হলো পুরো শরীর। বেশ কয়েকবার মাথা ধুইয়ে দিলেন। জ্বর তেমন কমল না। মাইশি হঠাৎ হঠাৎ চোখ খুললেও কথা বলতে পারল না।

পরের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জ্বর কিছুটা কমলো। দুপুর থেকে মাইশির শুরু হলো প্রচন্ড পেট ব্যথা। তার পেটের ভেতর থেকে কিছু একটা নাকি তাকে খোচাচ্ছে। মাইশিকে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের একটা ক্লিনিকে। সেখানে বসেন ডাক্তার নাসিমা আক্তার।

মেয়েটার পেটে ব্যথা দেখে ডাক্তার নাসিমা আক্তার সিটি স্ক্যান এবং আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করলেন। রিপোর্ট দেখে তিনি ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াসের মতো হতভম্ব হয়ে বললেন,ওহ মাই গড! এটা কী করে সম্ভব! একটা বাচ্চা মেয়ের গর্ভে ৬ মাসের বাচ্চা! আরিফ সাহেব বেশ রেগেই বললেন, আপনাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই? নাসিমা আক্তার স্বাভাবিক
ভাবেই বললেন, অবশ্যই এর ব্যাখ্যা আছে। এটাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয়, ” ফিটাস ইন ফিটু”। এর মাধ্যমে মায়ের গর্ভের যমজ সন্তানের একটির ভ্রুণের ভেতর অপর একটি ভ্রুণের বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে সেই প্রথম জন্মানো বাচ্চাটির গর্ভে ২য় ভ্রূণটি পাওয়া যায়। তবে এইটা খুব বিরল ঘটে। ৫ লক্ষ শিশুর ভেতর একজনের এমনটা ঘটে। তবে ৮ বছর বয়সে এসে এমনটা হয় বলে আমার জানা নেই। হলে অনেক আগেই বোঝা যেত। তাছাড়া পেটের ভেতর এত বড় একটা ভ্রুণ থাকলে পেটের বাহিরে তা জানান দিবে। কিন্তু ওর পেট দেখেতো তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। যত দ্রুত সম্ভব একটা অপারেশন করতে হবে। তার আগে মেয়েটার জন্ম ও তার মা সম্পর্কে আমার কিছু জানতে হবে।

এই মহিলা ডাক্তারের কথা আরিফ সাহেবের বোধগম্য হয় না। ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াসের মৃত্যুর পর মাইশির অপারেশনের কথা শুনে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি যেন বুঝতে পারছেন এর কোনো লৌকিক ব্যাখ্যা নেই কারও কাছে। পুরোটাই অলৌকিক। তাই তিনি ডাক্তারকে বললেন, এই বিষয়ে তিনি পরে কথা বলবেন। ফিস মিটিয়ে মাইশিকে নিয়ে তিনি আবার বাড়িতে ফিরে এলেন।

২ দিন পর: মাইশি বিছানায় শুয়ে আছে। তার জ্বর প্রায় কমে এসেছে। শরীরও আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু আরিফ সাহেব আর চিন্তা মুক্ত হতে পারছেন না। তিনি জানেন মেয়েটা কিছুদিন পর ঠিক একই ভাবে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। পৃথিবীর কোনো ডাক্তারের সাধ্য নেই এ থেকে তাকে মুক্তি দিবে। এই রহস্যের শেষ কোথায়? মেয়েটা কী আর কোনোদিন সুস্থ আর স্বাভাবিক হতে পারবে না। এই ভয়ংকর অসুখ কী তাকে ছাড়বে না! আজ যদি শম্মী বেঁচে থাকত তার জায়গায়, তাহলে সে এই পরিস্থিতিতে কী করতো? আচ্ছা শম্মী কেন আত্মহত্যা করল? সেও কি মাইশির বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল। তাই সে মাইশিকে সাহায্য করতে চাইছিল আর কোনো এক অজানা অলৌকিক শক্তি তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। হায় খোদা এত প্রশ্ন মাথার ভেতর উত্তর দেওয়ার কেউ নেই!

খোদাই যেন তার আফসোসের আর্তনাদ শুনতে পেলেন। একটা প্রশ্নের ঝট যেন ধীরে ধীরে খুলতে লাগল তার মাথায়। মাইশি অসুস্থতা শুরু হয় তার মায়ের মৃত্যুর পর থেকে। এরপর থেকে কিছুদিন পরপর রহস্যজনক ভাবে তার অসুস্থ হওয়ার পেছনের কারণ যেন তিনি এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। এসব যেন একটা সহজ সমীকরণের মতো তার সামনে উপস্থিত হলো। এই জিনিসটা এতদিন তার মাথায় আসেনি কেন!

শম্মী মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর থেকেই তার বাড়ির কাজের লোকেরা সেই কালো ছায়া দেখে ভয় পেয়ে একে একে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে থাকে। তখনও মাইশি সম্পুর্ণ সুস্থ ছিল। কাজের লোকেরা চলে যাওয়ার পর বেশ কয়েক মাস কেটে যায় এই বাড়িতে শুধু তিনি আর মাইশি থাকতেন। তখনও মাইশি সুস্থ ছিল। শম্মী মারা যাওয়ার বছর খানেক পরে আরিফ সাহেব একটা কাজের মহিলাকে এই বাড়িতে রাখেন। তখনই প্রথম বারের মতো মাইশি এইরকম হঠাৎ অসুস্থ হয়। আর সেই কাজের মহিলাটি আরিফ সাহেবকে জানান একটা কালো ছায়া নাকি তাকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছে। মহিলাটি ভয়েই চলে যান। তার কয়েকদিন পরেই মাইশি সুস্থ হয়ে যায়। এর মাস কয়েক পরে মাইশিকে পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষিকা রাখেন তিনি। শিক্ষিকা এই বাড়িতে আসার পরের দিনই মাইশি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাইশি অসুস্থ থাকায় শিক্ষিকা তার পরের কয়দিন আর তাকে পড়াতে আসেননি। তারপর মাইশি আবার সুস্থ হলেও সেই শিক্ষিকা তাকে আর পড়াতে রাজি হননি। কেন রাজি হননি সেটা আরিফ সাহেব জানেন না। শম্মী মারা যাওয়ার পর আরিফ তার সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তাই তারা আর কেউ এই বাড়ির পথ মারায় না। এছাড়া অন্য কোনো নারীর সাথে তার কোনো জানা-শোনাও নেই যে তারা এই বাড়িতে আসবে। তবে হঠাৎ হঠাৎ কোনো নারী এই বাড়িতে উপস্থি হলেই মাইশি এর এই অস্বাভাবিক অসুস্থতা দেখা দেয়। আরিফ সাহেব এবার বেশ উত্তেজিত অনুভব করছেন। সমস্যাটা যেন তিনি বুঝতে পারছেন। এতদিন কেন এই কথাগুলো তার মাথায় এলো না! কোনো কোনো বার কোনো নারী এই বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই মাইশি অসুস্থ হয়ে পড়তো। কোনো কোনো দিন নারী বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু কোনো মেয়েলোক এই বাড়িতে পা রেখেছেন আর মাইশি অসুস্থ হয়নি এমনটা কখনও ঘটেনি। এখন যেন তার কাছে সব পরিষ্কার হচ্ছে। এইতো কিছুদিন আগে সন্ধ্যাঁয় এক অচেনা মহিলা এই বাড়িতে এল। মহিলাটি মূলত এসেছিল আরিফ সাহেবের পাশের বাড়িতে। তাদের ঘর নাকি তালা দেওয়া। তাই আরিফ সাহেবের কাছে জানতে এসেছিলেন তারা কোথায়। আরিফ সাহেব তাদের সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তৎক্ষণাত হঠাৎ বৃষ্টি হওয়াতে মহিলাটি এই বাড়িতে আধ-ঘন্টার মতো আটকা পড়ে ছিল। তখনি মাইশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। বৃষ্টি থামার পর মহিলাটি চলে যায়। নারীদের এই বাড়িতে আসার সাথে যে মাইশির অসুস্থতার সম্পর্ক থাকতে পারে এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি কখনও। এরপরেইতো মাইশিকে ডাক্তার ইলিয়াসের কাছে নিয়ে যান তিনি। মাইশি যখন প্রায় সুস্থ তখন আবার সেই পিজ্জা গার্ল আসে সেদিন রাতে। তারপরে মাইশি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনো নারী যদি এই বাড়িতে প্রবেশ করে তাহলে সেই নারীর কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, অসুস্থ হচ্ছে শুধু মাইশি। কোনো নারীর এই বাড়িতে প্রবেশের সাথে মাইশির অসুস্থতার কী সম্পর্ক থাকতে পারে! আরিফ সাহেবের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এর চেয়ে মুক্তির উপায় কী? আর মাইশির পেটে সেই বাচ্চার রহস্যটাই বা কী! এরও কোনো উত্তর তার জানা নেই। জানার উপায়টাও তার জানা নেই।

মাইশি ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে নীচে নেমে আরিফ সাহেবের কাছে এলেন। এখন তাকে একেবারে সুস্থ এবং স্বাভাবিক একটা মেয়ে মনে হচ্ছে। কতো সুন্দর একটা মেয়ে। কে বলবে এই মেয়ে গত দুই দিন ভয়ংকর অসুস্থ ছিল!

হঠাৎ করে আরিফ সাহেবের চোখের সামনেই থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মাইশি। আরিফ সাহেব আঁতকে উঠে তাকে ধরলেন। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। এইতো মেয়েটা সুস্থ ছিল। হঠাৎ ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। আবার কোন নারীর প্রবেশ এই বাড়িতে? কবে শেষ হবে এই রহস্যের? কেনই বা কোনো নারী এই বাড়িতে প্রবেশ করলে শাস্তি পাবে মাইশি?
হঠাৎ করে আরিফ সাহেবের চোখের সামনেই থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল মাইশি। আরিফ সাহেব আঁতকে উঠে তাকে ধরলেন। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। এইতো মেয়েটা সুস্থ ছিল। হঠাৎ ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। আবার কোন নারীর প্রবেশ এই বাড়িতে? কবে শেষ হবে এই রহস্যের? কেনই বা কোনো নারী এই বাড়িতে প্রবেশ করলে শাস্তি পাবে মাইশি?

মাইশিকে বিছানায় শুঁইয়ে আরিফ সাহেব গিয়ে দরজা খুললেন। দরজা খুলে বেশ অবাক হলেন। ডাক্তার নাসিমা আক্তার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি এই সময়ে এই বাড়িতে কেন এসেছেন আরিফ সাহেব বুঝতে পারছেন না। তাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিলেন। আরিফ সাহেব ভাবলেন অপারেশনের বিষয়ে হয়তো কোনো কথা বলতে এসেছেন। কিন্তু তিনি চান না তার মেয়ের আর কোনো অপারেশন হোক। আরিফ সাহেব ডাক্তার নাসিমা আক্তারকে বললেন:
-আপনি কী অপারেশনের বিষয়ে আমার সাথে কোনো কথা বলতে এসেছেন? তাহলে চলে যেতে পারেন। আমার মেয়ের অপারেশন আমি করাব না।
-অপারেশন করিয়ে কোনো লাভও নেই মিস্টার আরিফ। আপনার মেয়ের “ফিটাস ইন ফিটু” বা এই ধরণের কোনো রোগ নেই। তার সমস্যা অন্য জায়গায়।

আরিফ সাহেব এতক্ষণ মহিলাটির কথায় বিরক্ত হলেও এই কথা শুনে উৎকন্ঠা হয়ে বলেন:
-তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
-আপনার মেয়ের গর্ভে একটা ভ্রুণ আছে এটা বাস্তব। কিন্তু সেই ভ্রুণের অস্তিত্ব তার পেটের বাহিরে জানান দিচ্ছে না। আমার ধারণা তার অপারেশন করেও তার গর্ভে কোনো ভ্রুণের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। কারণ তার গর্ভে যে ভ্রূণটি রয়েছে সে এই পৃথিবীর নয়। ওঁ অন্য কোনো দুনিয়ার।

একজন ডাক্তারের মুখে এই ধরণের কথাশুনে আরিফ সাহেব বেশ চমকে উঠলেন। তিনি ডাক্তার হয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না দিয়ে দিচ্ছেন অলৌকিক ব্যাখ্যা! আরিফ সাহেব কোনো কথা বলতে পারলেন না। নাসিমা আক্তার বলেই চললেন:
-দেখুন আল্ট্রাসোনোগ্রাফি এর মাধ্যমে পাওয়া আপনার মেয়ের গর্ভের সেই ভ্রুণের রিপোর্ট আমি এই কয়দিন ভালোমতো পরীক্ষা করেছি। ভ্রুণটা সম্পুর্ণ মানুষের মতো দেখতে হলেও এর হাত এবং পায়ের আঙুলের সংখ্যা ৪টি করে। যেখানে মানুষের থাকে পাঁচটি। এছাড়া তার হাতে একটা ছোট ক্রস চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এটা কোনো সাধারণ ক্রস না। এই চিহ্নটা কেবল শয়তানের প্রতীক।
-আপনি একজন ডাক্তার হয়ে এই ধরণের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। আমার মেয়েকে আমি আপনার আগে আরও ২ জন বড় ডাক্তার কে দেখিয়েছে। তারা আপনার চেয়ে অনেক জ্ঞানী ডাক্তার। তারাতো এই ধরণের কোনো অদ্ভুত অবাস্তবিক ব্যাখ্যা দেননি। আর একটা যমজ ভ্রুণের ভেতর আরেকটা যমজ ভ্রুণ বেড়ে উঠে। এটা মাইশির সাথে হতে পারে এমন কিছুও তারা বলেননি। আপনি এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা কী করে বলেন?
-দেখুন এটা যে “ফিটাস ইন ফিটু” রোগ না এই বিষয়ে আমার এখন কোনো সন্দেহই নেই। এই রোগের অনেকগুলো লক্ষণই আপনার মেয়ের সাথে যায় না। তাই হয়তো সেই ডাক্তারেরা এই বিষয়ে আপনাকে কিছুই জানান নি। এছাড়া অধিকাংশ ডাক্তারই প্যারানরমাল ঘটনায় বিশ্বাস করে না। আমিও এক সময় করতাম না। কিন্তু এখন করতে হয়। আমার জীবনে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটার পর থেকে আমি এটা বিশ্বাস করি। এই শক্তির যে কত ক্ষমতা তা আমি সেইদিনই টের পাই। এই বিষয়গুলো অবিশ্বাস করে হেলায় উড়িয়ে দেওয়ার কারণে আমি আমার স্বামীকে হারাই। ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগের। তখন আমি নতুন বিয়ে করেছি। এই শহরের একটা পুরাতন একতলা বাড়িতে ভাড়া উঠি আমরা। একদিন . . . .

মহিলাটির কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বেশ বিরক্তি নিয়েই আরিফ সাহেব তাকে বলেন:
-দেখুন, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো ঘটনা জানতে আমি ইচ্ছুক না। আমার মেয়েকে সুস্থ, স্বাভাবিক করার কোনো উপায় জানা থাকলে সেটা আমায় বলুন।
-এর উপায় আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি এমন একজনকে চিনি যে আপনাকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু আপনি যেহেতু অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন না। তাই আপনার উচিত আপনার মেয়ের অপারেশন করে এবিষয়ে একেবারে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া।
-আমার এক ডাক্তার বন্ধু এবং আরেকজন বড় ডাক্তার একবার তার অপারেশন করিয়েছে।

ডাক্তার নাসিমা আক্তার বেশ বিস্মিত কন্ঠে বলল:
-কই! আমি চেকাপ করার সময়তো অপারেশন হওয়ার কোনো আলামত পেলাম না! কোন ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করেছিলেন? তাদের ঠিকানাটা দিন প্লিজ। এদের সাথে এই বিষয়ে কথা বললে রহস্যটা আরও ভালোভাবে পরিষ্কার হবে।

হঠাৎ এক অজানা ভয় আরিফ সাহেবের মনকে গ্রাস করে ফেলে। আরিফ সাহেব মনে মনে এটা বিশ্বাস করেন যে, ডাক্তার ইমরান এবং ডাক্তার ইলিয়াসের হঠাৎ মৃত্যুর পেছনে তার মেয়ের সেই রাতে অপারেশনের কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তাই তার ভয় হয় এই ডাক্তার যদি তাদের কথা জানতে পারেন তাহলে সেও বুঝে ফেলবে মাইশির জন্যই তাদের মৃত্যু ঘটেছে। সবার মাঝে এটা জানাজানি হলে এতে মাইশি এবং তিনি বিপদে পড়ে যাবেন। তাই প্রসঙ্গটা ঘুড়াতে তিনি ডাক্তার নাসিমা কে বলেন:
-মাইশির গর্ভে যে ভ্রুণটা রয়েছে সেটা যে শয়তানের তা আপনি এতটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে?
-আমার স্বামী এই শক্তির কবলে পড়ে মারা যাওয়ার পর এই শক্তি নিয়ে আমি ব্যাপক গবেষণা করেছি। সেই চিহ্নটা আমি চিনি। আপনার মেয়েকে আমি সাহায্য করতে চাই।
– তার পেটের ভ্রুণের হাতে যে সেই চিহ্নই রয়েছে এটা আপনি বুঝলেন কী করে? আল্ট্রাসোনোগ্রাফিতে তো এতটা স্পষ্ট করে হাতের চিহ্ন বোঝা যাওয়ার কথা না!

ডাক্তার নাসিমা আক্তার তার ব্যাগ হতে আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্টটা বের করে আরিফ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলেন। আরিফ সাহেব রিপোর্টে ভ্রুণের ছবিটা দেখলেন। ভ্রূণটার একহাতের উপর স্পষ্ট একটা ক্রসের চিহ্ন। ক্রসটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ক্রসটা সাধারণ কোনো ক্রসের মতো না। ভ্রুণের চেয়ে যেন স্পষ্ট ক্রসটাকে বোঝা যাচ্ছে! কেউ রিপোর্টটার ছবিটার উপরে এই ক্রশটা যেন একে দিয়েছে। আরিফ সাহেব আবার প্রশ্ন করেন:
-আপনার কী মনে হয়? এই শয়তানের ভ্রুণটা মাইশির পেটে আসল কী করে?
-যুগে যুগে অনেক শয়তান এই পৃথিবীতে আসে। তাদের এই পৃথিবীতে আগমনের অনেক গুলো উপায় রয়েছে। অধিকাংশ সময় শয়তানের উপাসকরা তাদের দেহ এবং আত্মাকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করে এবং শয়তানকে আহ্বান করে। পরে শয়তান তাদের দেহে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বড় শয়তানেরা এ কাজটা করে না। এরা মানুষের রুপেই কোনো এক নারীর শরীর থেকে জন্মায়। পৃথিবীতে তারা শিশু রুপে আসে। ধীরে ধীরে এরা বড় হয় আর তাদের শয়তানী শক্তি ফিরে পেতে থাকে। এই বড় শয়তানগুলোর আত্মা প্রথমে পৃথিবীতে আসে দেহ ছাড়াই। পরে সে কোনো নারীর সাথে সঙ্গম করে আর সেই নারীর গর্ভ থেকেই সে আবার জন্ম নেয়।
-আপনি বোঝাতে চাইছেন আমার মেয়ের সাথে কোনো এক শয়তানের আত্মা সঙ্গম করেছে তাই তার গর্ভে শয়তানের ভ্রুণ?
-বিষয়টা অনেকটা এমনই।
-আপনি একটা পাগল ছাড়া আর কিছুই না! শয়তানের যদি পৃথিবীতে আসতে হতো তাহলে এত নারী থাকতে একটা বাচ্চা মেয়ের শরীরে আশ্রয় কেন নিবে?মাইশির বয়স যখন ৪ বছর তখন থেকেই সে এইরকম অসুস্থ। আর আপনি কী আজেবাজে কথা বলছেন?
-আমিও এটাই ভাবছি। শয়তানকে যদি আহ্বান না করা হয় তাহলে সে কখনও আসে না। আপনার মেয়ে কী করে তাকে আহ্বান করল!

আরিফ সাহেব এবার উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তার নাসিমা আক্তারকে বললেন:
-দেখুন আপনি একজন ডাক্তার হয়ে শয়তানী শক্তির অস্তিত্ব নিয়ে আমার সাথে তর্ক করছেন। বিষয়টা বেশ হাস্যকর। আপনি দয়া করে আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।

ডাক্তার নাসিমা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, এই শক্তিকে তুচ্ছ করবেন না। যে কোনো সাহায্য লাগলে আমার কাছে আসবেন। আর আপনার বাড়িতে যে অলৌকিক কিছু আছে তা আমি নিশ্চিত। আমি যখন এই বাড়িতে ঢুকছিলাম কয়েকটা কালো ছায়া আমায় ভয় দেখাচ্ছিল।

মহিলাটি চলে গেল। আরিফ সাহেব বাড়ির গেট লাগিয়ে ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে বসে রইলেন। মাইশির সাথে এবং এই বাড়িতে অলৌকিক কিছু যে একটা আছে এটা তিনি অনুমান করতে পারছেন। তাই বলে এইসব হুজুগে আজেবাজে কথা বিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না।

হায় খোদা! মাইশি না ঐ ঘরে অসুস্থ অবস্থায় রয়েছে। আরিফ সাহেব তার কথা ভাবতে ভাবতে তাকেই কী করে ভূলে গেল! আরিফ সাহেব দ্রুত উঠে মাইশির ঘরে গেলেন। ঘরে ঢুকেই তার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড় হলো। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। মাইশি বিছানা থেকে কয়েক ফুট উপরে উঠে শুন্যে ভাসছে। তার পুরো শরীরে জামা কাপড় নেই। চোখ ভয়ানক ক্রোধে লাল হয়ে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। আরিফ সাহেব যেই মাইশির দিকে এগিয়ে যাবেন পুরো ঘর থরথর করে কাঁপতে লাগল। বুক সেলফ থেকে একটা একটা করে বই মেঝেতে পড়তে লাগল। আরিফ সাহেবকে অবাক করে দিয়ে কর্কশ একটা পুরুষ কন্ঠের শব্দ বেড়িয়ে এল মাইশির মুখ থেকে, ওঁ কারও পা ধরে না ওঁকে এই পৃথিবীতে আহ্বান করতে। তবে কেউ যদি ওঁকে আহ্বান করে একবার পৃথিবীতে আনতে চায় তাহলে কারও সাধ্য নেই যে ওঁকে আসা থেকে ফেরায়। যে হবে পথের কাঁটা, সেই হবে বলির পাঠা।

আরিফ সাহেবের বিস্ময় কাঁটার আগেই ঘরের একটা ফুলদানি একা একাই শুণ্যে ভেসে উঠে উড়ে এসে সজোরে তার মাথায় আঘাত করল। মুহুর্তেই তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।

যখন চোখ মেললেন দেখলেন পুরো ঘর অন্ধকার। তিনি মেঝেতে পড়ে আছেন। বিছানা থেকে মাইশির গুঙানোর আওয়াজ আসছে। তিনি ধীরে ধীরে উঠে ধারালেন। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পারলেন না। দেয়াল হাতড়ে সুইচ চেপে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করলেন। না সুইচ চালুই আছে, তাহলে বিদ্যুৎ নেই! দেয়াল হাতরে ঘর থেকে বারান্দায় গেলেন। বারান্দায় গিয়ে সুইচ চাপতেই আলো জ্বলে উঠল। আরিফ সাহেব বেশ অবাক হলেন। ঘরের লাইটে কী সমস্যা হলো!মোবাইল বা টর্চ কোথায় আছে
তার মনে পড়ছে না। তিনি রান্নাঘর থেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে আবার মাইশির ঘরে গেলেন। তার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। মোমের আলোতে স্পষ্ট পুরো ঘর দেখা যাচ্ছে। পুরো ঘর লন্ড-ভন্ড হয়ে গেছে, যেন কোনো বড় ঝড় এই ঘরের উপর দিয়ে কিছুক্ষণ আগে বয়ে গেছে। মাইশি বিছানায় শুয়ে গুঙাচ্ছে। পরনে একটা ফ্রক। মাইশির পাশেই বিছানায় সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়ে রয়েছে। ঘরের সব জিনিসপত্র ঘর জুরে এলেমোলো হয়ে পড়ে রয়েছে। বই ছড়িয়ে, ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে। বৈদ্যুতিক বাল্বটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্লাস্ট করেছে। ফুলদানিটাও টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। আরিফ তার মাথায় হাত দেয় যেখানে ফুলদানীটা আঘাত করেছিল। কিন্তু সে কোনো ক্ষত অনুভব করতে পারে না। সামনে এগিয়ে মাইশির কপালে হাত দিতেই বুঝতে পারে প্রচন্ড জ্বর। হঠাৎ মাইশির পেটের দিকে মোমের আলো পড়তেই তিনি আঁতকে উঠলেন। মাইশির ফ্রকটা আপনা-আপনি ছিরে যাচ্ছে আর তার পেটটা ফুলে উঠছে। পেট ফুলে একজন গর্ভবতী নারীর পেটের মতো আঁকার লাভ করল। আবার মাইশির নিঃশ্বাসের সাথে সাথে পেটটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। আবার নিঃশ্বাসের সাথে ফুলে উঠছে ভয়ংকর রকমের। ভয়ে আরিফ সাহেবের শরীর কাঁপতে থাকে। হঠাৎ তার পেছনে কোনো কিছুর উপস্হিতী অনুভব করতে পারেন তিনি। পেছনে ফিরতেই মোমের আলোতে স্পষ্ট ৩টা ছায়া দেখতে পেলেন তিনি দেয়ালে। মাঝখানের ছায়াটা একটা নারীর। তার দুই পাশের ছায়াগুলো দুজন পুরুষের। পাশের দুটো ছায়া যেন কালো ছায়ার গায়ে সাদা আলোর এপ্রোণ। ৩টা ছায়ার অবয়ব দেখেই যেন আরিফ সাহেব এদের চিনে ফেললেন। পুরুষ ছায়া দু’টি মুহুর্তের মধ্যে দেয়ালে মিলিয়ে গেল। নারী ছায়াটি ধীরে ধীরে আরিফ সাহেবের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। পাথরের মুর্তির মতো আরিফ সাহেব দাঁড়িয়ে রইলেন। মুহুর্তেই একটা ধমকা হাওয়া এসে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গেল। বারান্দার বাল্বটার ফাটার শব্দও স্পষ্ট শুনা গেল। পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। আরিফ সাহেবকে অবাক করে দিয়ে সেই চিরচেনা একটা কন্ঠ মিহি আওয়াজে বলল:
-কেমন আছো আরিফ?

আরিফ কন্ঠটা শুনে চমকে উঠে বলে:
-শম্মী, তুমি! ওহ মাই গড! আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুমিতো মারা গেছ। তুমি কোথা থেকে এলে?
-আমি কোথা থেকে আসব আবার! আমিতো ৫ বছর ধরে এই বাড়িতেই রয়েছি। যদিও ছায়া হয়ে। তাইতো দেখতে পাও না।
-শম্মী, তুমি দেখেছ আমাদের মেয়ের কী অবস্থা হয়েছে! আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না।
-মাইশির এই অবস্থার জন্যতো তুমিই দায়ী।
-আমি দায়ী?
-হ্যাঁ। তুমিই দায়ী। সবকিছুতো স্বাভাবিক ভাবেই চলছিল। মাইশি অসুস্থ হচ্ছিল আবার সুস্থ হচ্ছিল। তুমি কেন শুধু শুধু তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে গেলে? তোমার জন্যই বেচারা ডাক্তার ২জন মারা গেল। অপারেশন করার বড় শখ ছিল। দিলও ওঁ শেষ করে। আর তোমার এই বাড়াবাড়ির কারণে মাইশি আরও বেশি শাস্তি পাচ্ছে। ওঁকে রাগাচ্ছো কেন তুমি?
-এই ওঁ টা কে?
-মাইশির গর্ভে যিনি রয়েছেন তিনি।
-হেয়ালি করো না শম্মী। তোমার রহস্য আমি কিছুই জানি না। জানতেও চাই না। অন্তত মেয়েটাকে কিভাবে সুস্থ স্বাভাবিক করতে পারব এই উপায়টাতো বলবে?
-তোমার মেয়ে তুমি উপায় খুঁজো।
-আমার মেয়ে! মাইশি তোমার মেয়ে না?
-আমি এখন কেউ না। আমার কেউ নেই। কেউ আমার কিছু না।
-শম্মী এমনটা বলো না প্লিজ। আমি বড্ড একা হয়ে গেছি। তুমি হয়তো আমার অবচেতন মনের কল্পনা। তাও কল্পনা হয়েই এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় আমায় বলে দাও।
-এই অলৌকিকতার উপর অবিশ্বাসই তোমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এবার বলো এই লন্ড-ভন্ড ঘরও তোমার অবেচতন মনের কল্পনা! মাইশি যখন মারা যাবে তখনও এটা তোমার অবচেতন মনের কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিও।
-শম্মী!
-চেচিয়ে লাভ নেই। মেয়ের ভালো চাওতো আমার কথা শুনো। ওঁ যখন একবার পৃথিবীতে চলে এসেছে তার আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। যা হচ্ছে তাই হতে দাও। এই বাড়িতে মহিলা প্রবেশ নিষেধ করা দাও। মাইশির ওঁ কোনো ক্ষতি করবে না। মাইশিকে তুমি লালন করছ তাই ওঁ তোমারও কোনো ক্ষতি করবে না। মাইশির যখন সন্তান জন্মদানের বয়স হবে তখন ভ্রুণটা তার অস্তিত্ব জানান দিবে। ওঁ হবে মাইশির পুত্র। ততদিন পর্যন্ত ওঁকে মাইশির গর্ভে থাকতে দাও। ওঁ একবার জন্মালে তারপর মাইশি এবং তোমার মুক্তি। এর আগে ওঁকে রাগিও না। বিপদে পড়বে।

-এসব তুমি কী বলছ শম্মী! আর আমি বাবা হয়ে চুপচাপ এমনটা কী করে হতে দেই মাইশির সাথে।। আমার মেয়ে জন্ম দিবে একটা শয়তানকে? এই শয়তানের ভ্রুণটা মাইশির গর্ভে এল কী করে? ওতো শয়তানকে আহ্বান করেনি। তাহলে এই অভিশাপ তাকে কেন স্পর্শ করল?

-এই কথাটা শুনার পর হয়তো তুমি আমাকে ঘৃণা করবে। তাও শুনো। সন্তান হৃনতার যে একটা কত বড় কষ্ট তা তুমি আমার মতো অনুধাবন করতে পারতে না। যখন ডাক্তারী পরীক্ষায় জানতে পারলাম যে আমিই বন্ধা তখন আমার মনের ভেতর যে কী বড় একটা ঝড় গেল তা তোমাকে বোঝাতে পারব না! তুমি তখন প্রায় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলে। সেই সময়ে হঠাৎ একদিন এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে আমার কাছে খাবার চাইলেন। আমি তাকে খাবার দিলাম। তিনি খাওয়ার পর আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, মা, তুই পুরোপুরি বন্ধা না।তোর চিকিৎসা করা যাবে। তোর ফুটফুটে সন্তান হবে। আমি বিস্মিত হলাম! তিনি একথা জানলেন কী করে! তিনি আর কোনো কথা না বলে একটা ঠিকানা আমায় দিয়ে চলে গেলেন। আমি তোমাকে না জানিয়ে সেই ঠিকানায় গেলাম। পুরানো একটা বাড়িতে তারা কালো যাদু চর্চা করেন। ভয়ংকর ভয়ংকর মুর্তি দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারা আমায় বললেন, একটা কাজ করলে আমার সন্তান হবে। আমার নিজেকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করে দিতে হবে। আমার আত্মা বা দেহ শয়তান চায় না। সে শুধু আমার গর্ভের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসতে চায়। আমি শয়তানের পুজা করলে প্রথমে আমার গর্ভে একটা কণ্যা সন্তান আসবে। যে হবে আমার এবং তোমার মেয়ে। তার কয়েক বছর পর আমার গর্ভে আরেকটা সন্তান আসবে সেটা খোদ শয়তান! আমি তখন এতকিছু না ভেবে বাচ্চার লোভে রাজি হয়ে যাই।

আমাদের একটা কণ্যা সন্তান হলো মাইশি। আমরা বেশ আনন্দেই দিন কাঁটাতে লাগলাম। এরপর একদিন আবার আমি প্রেগনেন্ট হলাম। একটা শয়তানকে আমি পৃথিবীতে আনব! যে ধ্বংস করতে চাইবে পৃথিবীর সৌন্দর্য্য! মনের মধ্যে পাপবোধ জন্মালো আমার। ভুল বুঝতে পারলাম। সেই কালোযাদুর তান্ত্রীকেরাও তখন ভিক্ষুকের বেশে আমাকে প্রায়ই দেখে যেত। আমার ভয় লাগতে শুরু করে। তোমায় গর্ভপাতের কথা বললাম। তুমি রাজি হলে না। এই ঘটনাগুলো তোমায় খুলেও বলতে পারছিলাম না! ভাবলাম তোমরা সুখে থাক। আমার মৃত্যুর সাথেসাথে শয়তানটাও মরে যাবে।

আমার ধারণা ভুল হলো। আমি মরে হলাম অভিশপ্ত ছায়া। আর সেই শয়তানটার ভ্রুণ অদৃশ্য আকৃতি ধারণ করে মাইশির গর্ভে আশ্রয় নেয়। তাকেও করে অভিশপ্ত। সেই তান্ত্রিক গুলোও ভেবেছিল আমার মৃত্যুর সাথে সাথে শয়তানও চলে গিয়েছে। তাই তারা আর এ বাড়ি মুখো হয় না।

আরিফ সাহেব অন্ধঁকারে এক নিঃশ্বাসে শম্মীর কথাগুলো শুনছিলেন। এবার তিনি বললেন:
-সবই বুঝলাম। কিন্তু মাইশির হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা বুঝলাম না। মাইশি এমনিতে সুস্থ স্বাভাবিক থাকে কিন্তু কোনো নারী এই বাড়িতে প্রবেশ করলে সাথে সাথেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর পেছনের কারণটা কী? এর থেকে মুক্তি কি পাব না?
-তোমাকে যা বললাম তাই শুনো। এর বেশি কিছুই ঘাটাতে যেও না। তাহলে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হবে না। এই প্রশ্নটার উত্তরও খুঁজতে যেও না। তাহলেই সব শেষ! যেদিন এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাবে সেইদিনই শেষ হবে সব সমস্যার। প্রথমে তুমি মরবে তারপর তোমার মেয়ে মাইশি। তাই ওঁকে নিয়ে এইসব ঘাটিয়ো না। যেটা যেভাবে চলছে চলতে দাও। সব প্রশ্নের উত্তর জানতে নেই। তুমি শুধু এই বাড়িতে নারীর প্রবেশ বন্ধ করে দাও। আমি চলে যাচ্ছি চিরোদিনের মতো। আমার বলা কথাগুলো শুধু মনে রেখ।
-চলে যাচ্ছ মানে?
-আমি এতদিন পর্যন্ত এই বাড়িতে শুধু মাইশির জন্য রয়ে গিয়েছিলাম। এখন তোমায় দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। এতেই আমার মুক্তি। ওঁকে আসতে দাও, ওঁ আসবেই। ওঁকে যে বাধা দিবে তারই হবে দুর্গতি।

মুহুর্তের মধ্যেই কণ্ঠটা শুণ্যে মিলিয়ে গেল। আরিফ সাহেব ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেই তিনি আরও অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন।

সূর্যের আলো ঘরে প্রবেশের পর চোখ মেললেন তিনি। ঘর এখনও লন্ড-ভন্ড। মাইশি শুয়ে আছে বিছানায়। তার পেটের দিকের ফ্রক ছেরা। তাকে এখন দেখতে পুরো সুস্থ এবং স্বাভাবিক লাগছে। তিনি মাইশিকে ঘুম থেকে উঠালেন। ফ্রেশ হলেন দুজনে। একসাথে নাস্তা করলেন।

এখন রহস্যটা অনেকটাই যেন তার কাছে পরিষ্কার। তিনি কিছুতেই শয়তানকে এই পৃথিবীতে আসতে দিবেন না এবং নিজের মেয়েকেও তিনি এই বিপদ থেকে বাঁচাবেন। ডাক্তার নাসিমার অনেক কথার সাথেই গতরাতে শম্মীর বলা কথার মিল পাওয়া যায়। এখন ডাক্তার নাসিমাই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন।

মাইশিকে ঘরে রেখে বাড়ির বড় গেটে তালা দিলেন তিনি। যাতে কোনো নারী বা অন্য কেউ তার বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর সোজা চলে গেলেন ডাক্তার নাসিমার চেম্বারে। সেখানে পৌছে আরেকবার স্তম্ভিত হলেন আরিফ সাহেব। জানতে পারলেন গতরাতে নাকি ডাক্তার নাসিমা আক্তার তার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন।
মাইশিকে ঘরে রেখে বাড়ির বড় গেটে তালা দিলেন তিনি। যাতে কোনো নারী বা অন্য কেউ তার বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর সোজা চলে গেলেন ডাক্তার নাসিমার চেম্বারে। সেখানে পৌছে আরেকবার স্তম্ভিত হলেন আরিফ সাহেব। জানতে পারলেন গতরাতে নাকি ডাক্তার নাসিমা আক্তার তার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন।

আরিফ সাহেব কথাটা শুনে বেশ ভেঙে পড়লেন। ভাবছিলেন গতকাল এই মহিলাটিকে ঐভাবে অবহেলা করা উচিত হয়নি তার। মহিলাটি তাদের সাহায্য করতে চেয়ে ছিলেন। তাইতো তার এই অবস্থা হলো। তাহলে এখন এই সমস্যা থেকে তাদের কে বাঁচাবে। শয়তানকে এই পৃথিবীতে না আনার কোনো পথই কী খোলা নেই! তিনি আর ডাক্তার নাসিমার বাড়িতে গেলেন না। নিজ বাড়িতে এসে মাইশির দিকে মনোনিবেশ করলেন। আর কোনো উপায় না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন শম্মীর কথাই মেনে চলবেন। শয়তানী ভয়ংকর শক্তির সাথে তিনি একা পেরে উঠবেন না। তাকে এই পৃথিবীতে আসতে দেওয়াই ভালো। আরতো মাত্র কয়েকটা বছর। মাইশি বড় হবে আর অবসান ঘটবে এই অভিশপ্ত জীবনের। হয়তো তখন পৃথিবী পড়ে যাবে বিপদের মুখে। কিন্তু তারাতো মুক্তি পাবে। শুধু এইটা খেয়াল রাখতে হবে যে এর আগে কোনো নারী শরীর যাতে এই বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। হঠাৎ তার মনে পড়ল বাড়ির বড় গেইটটা তো খোলা রয়েছে। এখন যদি কেউ বাড়িতে প্রবেশ করে তাহলেতো মাইশি আবার সেই ভয়ংকর অসুস্থ হয়ে যাবে। আরিফ সাহেব দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎই বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠল।আবার কে এলো!আরিফ সাহেব চমকে মাইশির দিকে তাঁকালেন। না, মাইশি সুস্থ এবং স্বাভাবিক রয়েছে। একটা পুতুল নিয়ে খেলছে। তাহলে হয়তো কোনো পুরুষ মানুষ এসেছে। কিন্তু কে?

আরিফ সাহেব দরজা খুলে দেখলেন একজন চার্চের ফাদার দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আরিফ সাহেব কিছুটা অবাক হয়ে লোকটাকে বললেন:
-আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?

লোকটা মিষ্টি করে হেসে বলল:
-আপনার নাম কী আরিফ হোসাইন?
-জ্বি। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
-আমার নাম পিটার। আমি এই শহরের বাহিরের একটা চার্চের ফাদার। আমি কী ভেতরে এসে বসতে পারি?

আরিফ সাহেব দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। লোকটা বাড়িতে প্রবেশ করলেন। লোকটা ঠিক কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন এটা আরিফ সাহেবের বোধগোম্য হচ্ছে না। লোকটা ড্রয়িং রুমের একটা চেয়ারে বসে শান্ত কন্ঠে আরিফ সাহেবকে প্রশ্ন করলেন:
-ডাক্তার নাসিমা আক্তার আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছেন। আপনি জানেন বোধ হয়?

আরিফ সাহেবের বুকে একটা ধ্বক করে শব্দ হলো। ভয়ে তার চোখ-মুখ ছোট হয়ে এল। এই লোকটা ডাক্তার নাসিমার কথা বলছেন কেন! তাহলে লোকটা কী সব জেনে গেল! মাইশির কারণেই যে এই ৩ ডাক্তার আত্মহত্যা করেছে এটাও হয়তো তিনি বুঝে যাবেন বা গেছেন। শহরের সবার মধ্যে এখন এটা জানাজানি হয়ে যাবে।
তারা পড়বেন বিপদে।

ফাদার পিটার আবার বললেন:
-ভয় পাবেন না ডাক্তার আরিফ। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। এই কেসের ইনভেসটিকেশন করতেও আসিনি। আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন।
আমাকে এখানে ডাক্তার নাসিমা আক্তারই এখানে আসতে বলেছিলেন।
-ডাক্তার নাসিমা!
-জ্বি। তাকে আমি অনেক বছর আগে থেকেই চিনি। তার বাড়িতে তার স্বামী প্রেতচর্চা করতেন। তখন আমি তাকে সাবধাণ করেছিলাম। নাসিমা আক্তার বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিলেন এবং স্বামীকে হারালেন। তারপর তার সাথে আমার বেশ ভালো পরিচিতি হয়। তিনিই আমাকে ফোনে আপনার মেয়ের অদ্ভুত রোগ সম্পর্কে জানান। গতকাল আপনার সাথে তার কী কী কথা হয় তাও রাতে আমায় জানান। আমিও অনুমান করি আপনাদের বাড়িতে শয়তানের অস্তিত্ব আছে। আজ সকালে যখন নাসিমার সাথে দেখা করতে আসলাম এই বিষয়ে কথা বলতে তখন জানলাম সে আত্মহত্যা করেছে! এটা যে কোনো সাধারণ মৃত্যু না শয়তানের প্ররোচনা এটা আমি বুঝতে পারছি। তিনি আমাকে ফোনেই আপনার ঠিকানা দিয়েছিলেন। তাই সেখান থেকে সরাসরি আপনার কাছে চলে এসেছি। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি এ বিষয়ে।

আরিফ সাহেব যেন কিছুটা সাহস ফিরে পেলেন। তবুও বিচলীত কন্ঠে ফাদারকে বললেন, কিন্তু ওঁকে নিয়ে যেই ঘাটাতে গিয়েছে সেই মৃত্যুর পরিণতি স্বীকার করেছে। আমার ধারণা ওঁ আপনারও কোনো ক্ষতি করতে পারে।

যেদিন থেকে ফাদার হয়েছি এই নিজেকে নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আপনার মেয়েকে নিয়ে ভাবছি। বললেন, ফাদার পিটার। আরিফ সাহেব তাকে মাইশির কাছে নিয়ে গেলেন। মাইশি বসে বসে পুতুল দিয়ে খেলছিল। ফাদার পিটারকে দেখে একবার শুধু বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। আবার খেলায় মনোযোগ দিলো। আরিফ সাহেব এবং ফাদার পিটার আবার ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলেন। ফাদার, আরিফ সাহেবের কাছে এই রহস্যের ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পুরোটা জানতে চাইলেন। আরিফ সাহেব আর কিছু লুকালেন না। ডাক্তারদের আত্মহত্যা সহ পুরো ঘটনা তাকে খুলে বললেন। ফাদার একটানা পুরো ঘটনা শুনলেন। এরপর আরিফ সাহেবকে প্রশ্ন করলেন:
-আপনি কী নিশ্চিত যে গতরাতে যেই কালো ছায়াটা আপনার সাথে কথা বলেছেন সেটা আপনার স্ত্রীই?
-হ্যাঁ। আমি শম্মীর কন্ঠ চিনি। আর সে যেই কথাগুলো বলেছে তা শম্মী ছাড়া আর কারর জানার কথা না।
-গতরাতে আপনার সাথে যে কথা বলেছে সে আপনার স্ত্রী নয়। আপনি ইতো বললেন গর্ভাবস্থায়
তিনি আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছেন। আর যেহেতু তিনি শয়তানের উপাসনা করেছেন তাই তার মৃত্যুর পর তার আত্মা ইচ্ছাকৃতভাবে এই বাড়িতে থাকতে পারে না। তার মৃত্যুর পর তার আত্মাটা শয়তানের দখলে চলে যায়। শয়তান যা চায় তাই তাকে দিয়ে করাতে পারে। শয়তানই তাকে ছায়া মানব বানিয়ে রেখেছে। শয়তানের ইচ্ছাতেই সে আপনার ঘরে এসেছিল গতকাল। মৃত্যুর পর এই বাড়িতে এতবছর ছায়া হয়েছিল শয়তানের ইচ্ছাতেই। সে এখন আর আপনার স্ত্রী বা মাইশির মায়ের রুপে নেই। সে এখন শয়তানের ছায়া মাত্র।

-তার মানে বলতে চাচ্ছেন শম্মীর কন্ঠে ছায়াটা গতরাতে যা যা বলেছে তার সবই বানোয়াট? আমার কিন্তু কথাগুলো বেশ যৌক্তিকই মনে হচ্ছিল।
-তার বলা কথাগুলো বাস্তব নাকি বানোয়াট এটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কিন্তু সে যে শয়তানের ছায়া ছাড়া আর কিছুই না এটা নিশ্চিত। সে যা বলছে শয়তানের লাভের জন্যই বলছে।
-এইসব কথা বাদ দিয়ে বলুন এর থেকে মুক্তির কোনো উপায় কী আপনার জানা আছে? এই বাড়িতে কোনো নারী প্রবেশ করলেই মাইশি কেন অসুস্থ হয়ে পড়ে? নারীর এই বাড়িতে প্রবেশের সাথে মাইশির অস্বাভাবিকতার সম্পর্কটা কী?
-এটা আমি নিশ্চিত ভাবে জানি না। তবে আমার অনুমান শয়তানটার ভ্রুণ মাইশির গর্ভে আর থাকতে চায় না। তাই এমনটা হয়।
-মানে, ঠিক বুঝলাম না।
– দেখুন মাইশি এখন সন্তান জন্মদানের জন্য পরিপক্ব নয়। শয়তানকে আরও অনেক বছর মাইশির গর্ভে থাকতে হবে। তাই হয়তো সে চাচ্ছে অন্য কোনো নারীর গর্ভে প্রবেশ করতে। তাই কোনো নারী এই বাড়িতে প্রবেশ করলেই ভ্রুণটা মাইশির গর্ভ থেকে বের হতে চায়। আর তাই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
– ভ্রুণটা মাইশির শরীর থেকে অন্য শরীরে চলে গেলেতো শয়তানেরই ভালো। সে দ্রুত পৃথিবীতে আসতে পারবে। তাহলে অন্য কোনো নারী যখন আসে এই বাড়িতে তার গর্ভে চলে যায় না কেন?
বাড়ে বাড়ে মাইশিকে অসুস্থ হতে হচ্ছে কেন?
-আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভ্রুণটা সাথে সাথে কিন্তু মাইশির গর্ভে চলে আসেনি। অনেকটা সময় নিয়ে তার পর এসেছে। ভ্রূণটা চাইলে দ্রুত অন্য গর্ভে চলে যেতে পারে না। তবে চেষ্টা করে।

-শম্মী মারা যাওয়ার পর তো এই বাড়িতে কয়কজন মহিলা কাজের লোক ছিল। ভ্রুণটা তাদের গর্ভে না গিয়ে মাইশির গর্ভে কেন এল? অন্য কারও গর্ভে গেলেতো এতদিনে সে পৃথিবীতে চলে আসতো। আর আপনার কথামতে যদি ঐ ছায়াগুলো শয়তানের হয় তবে তারা নারীদের এই বাড়িতে প্রবেশ করতে নিষেধ করবে কেন বা ভয় দেখাবে কেন? এতেতো শয়তানকে সাহায্য করার বদলে তারা উল্টো বিপদে ফেলছে।

তারাতো সেই নারীকে এই বাড়িতে আটকে রাখতে পারে। যাতে ভ্রূণটা সময় নিয়ে তার গর্ভে যেতে পারে।
-হুম। এই জিনিসটা আমিও বুঝতে পারছি না। কিন্তু একটা বিষয় ভেবে দেখুন ছায়াগুলো যদি ভালোও হয় তাহলেও কিন্তু তারা নারীদের ভয় দেখাতো না। ঐ ছায়াটা যদি আপনার স্ত্রীর হতো অন্য কোনো নারী প্রবেশ করলে সে খুশিই হতো। কারণ এতেতো আপনার মেয়েই শয়তানের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেত। ভ্রুণটা চলে যেত অন্য নারীর গর্ভে।
-আপনিইতো আমাকে দ্বন্দ্বে ফেলে দিচ্ছেন। আসল কথা হচ্ছে কোনো নারী এই বাড়িতে প্রবেশ করলে ভ্রুণটা মাইশির পেট থেকে তার গর্ভে যেতে চায় আপনার এই অনুমানটাই ভূল।
-হতেও পারে।
-আর ডাক্তার ইমরান এবং ইলিয়াসের ছায়া যে শম্মীর ছায়ার সাথে দেখলাম। ওরাতো শয়তান পূজা করতো না। তাহলে ওরা শয়তানের ছায়া হলো কী করে?
-শয়তান যাদের হত্যা করবে তারা সবাই তার দাস হবে।
-বুঝলাম। এতকথা বললেন কিন্তু মাইশিকে কী করে রক্ষা করব এটাই তো বললেন না।

ফাদার পিটার উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, দেখুন আরিফ সাহেব। আমার বিশ্বাস আমার ধারণা ভূল নয়। আপনার মেয়ের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া নিয়ে আমি যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছি এটাই সঠিক। হ্যাঁ, এর মধ্যে
কিছু প্রশ্ন আছে। এর উত্তরগুলোও খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি আজ চললাম। কাল বা পরশু আবার আসব।
তখন হয়তো এই বিষয়ে আমি পরিষ্কার করে বলতে পারবো।

এই বলেই ফাদার পিটার, আরিফ সাহেবের বাড়ি ত্যাগ করলেন। আরিফ সাহেব বিষন্নমুখ করে তার চলে যাওয়া দেখলেন। তিনি যেন জানেন ফাদার আর কখনও এই বাড়িতে আসবেন না। আসলে ও কোনো ছায়ার চেয়ে বেশি মূল্য তার থাকবে না। ৩ জন ডাক্তারের মতো তিনিও হয়তো শয়তানের প্ররোচনায় আত্মহত্যা করবেন। যে শয়তানের বিরুদ্ধে লাগবে তারই হবে দুর্গতি। আর কতগুলো প্রাণ যাবে এটাও কল্পনা করতে পারেন না আরিফ সাহেব।

আরিফ সাহেব যদিও বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন ফাদার পিটার আর এই বাড়িতে ফিরে আসবেন না, তবুও একটা ক্ষীণ আশা তার মনে ছিল। কিন্তু ২দিন কেঁটে যাওয়ার পরও যখন ফাদার এলেন না তখন আশার বাতিটা যেন নিভে গেল। ৩য় দিন একটা পিয়ন আসে এই বাড়িতে একটা চিঠি নিয়ে। চিঠির উপরে ফাদার পিটারের নাম দেখে আরিফ সাহেব বেশ অবাক হলেন। চিঠিটা নিয়ে তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন। ড্রয়িং রুমে বসে চিঠিটা পড়া শুরু করলেন:

আরিফ সাহেব,
হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার কারণেই আমি স্বশরীরে আপনার ওখানে আসতে পারিনি। এর জন্য আমি লজ্জিত। আমি আরও কয়েক জন ফাদারের সাথে আপনার মেয়ের বিষয়ে কথা বলেছি। তারা এই বিষয়ে অনেক কিছুই খোলাসা করে বলেছেন। আমার অনুমাণটাই সঠিক। কোনো নারী আপনাদের বাড়িতে প্রবেশের পর মাইশির গর্ভের ভ্রুণটা তার গর্ভে চলে যেতে চায়। ভ্রুণটাকে দেখতে ৬মাস বয়সের হলেও এই কয়েক বছর মাইশির পেটে থেকে এর মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে। তাই সে দ্রুত পৃথিবীতে আসতে এই পথে এগোতে চায়। স্বয়ং শয়তানও চায় বাচ্চাটা দ্রুত পৃথিবীতে আসুক। যাতে সে দ্রুত শরীরটার ভেতর ঢুকে যেতে পারে। বস্তুত মাইশির গর্ভের শয়তান এবং বাহিরের শয়তান দুটি আলাদা সত্তা। ভেতরের শয়তানটা শুধু বাহিরে আসতে চায়। সে ছোট, তাই উপায়টা জানে না। বাহিরের শয়তানটাই একে নিরাপত্তা দিচ্ছে। ৩ জন ডাক্তারকে ওই হত্যা করেছে। সেও চায় ভ্রুণটা অন্য নারীর গর্ভে যাক। কিন্তু যেহেতু ভ্রুণটা একবার তার গর্ভ পরিবর্তন করিয়েছে তাই তাকে জন্ম নিতে হবে একজন কুমারী মেয়ের গর্ভে। অন্য কোনো কুমারীত্ব হারানো নারীর গর্ভে যদি ভ্রুণটা একবার প্রবেশ করে তাহলেই হবে সব শেষ। মহিলাটি হঠাৎই ৬ মাসের গর্ভভতী হয়ে যাবে এবং তার কয়েক মাস পরেই বাচ্চাটির জন্ম হবে। কিন্তু সেই দেহে আর শয়তান প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ তার আধ-ঘন্টা পর বাচ্চাটি মারা যাবে। শয়তানের আর কোনো উপায় থাকবে না। তাকে ফিরে যেতে হবে তার পৃথিবীতে। আপনাদের বাড়িতে যে সকল নারীরা প্রবেশ করেছে তারা সকলেই হয়তো কুমারীত্ব হারা। তাই প্রবেশের মুখে শয়তানী ছায়া তাদের বাধা দিত। কিন্তু মাইশির পেটের ভ্রুণটি না বুঝে যেকোনো একটা শরীর পেলেই প্রবেশ করতে চাইতো। কিন্তু একদিন এই বাড়িতে কোনো নারী থাকলে তার গর্ভে ভ্রুণটা প্রবেশ করতে পারবে না। নারীটাকে কমপক্ষে ৭ রাত এই বাড়িতে কাঁটাতে হবে। যে কোনো নারী একবার এই বাড়িতে প্রবেশ করলে এবং সেই ভ্রুণটা তার গর্ভে যেতে চাইলে অন্য কোনো শয়তানী শক্তি সেই নারীকে এই বাড়ি থেকে সড়াতে পারবে না। স্বয়ং শয়তানও না। এছাড়া শয়তানের পক্ষে জোর করেও কোনো নারীকে এই বাড়িতে ঢুকানো অসম্ভব। এগুলোই তাদের সীমাবদ্ধতা। তাই শয়তান ভাবে এই বাড়িতে সব নারীর প্রবেশ নিষেধ করে দিবে। সময় লাগুক। মাইশির গর্ভেই জন্ম নিবে সে। কিন্তু আপনাকে ভয় দেখানো যাবে না। তাহলে আপনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। এই বাড়ি ছেড়ে দুরে থাকলে মাইশির গর্ভের ভ্রুণটা তার ক্ষমতা হারাতে থাকবে। তাই আপনার স্ত্রীর বেশে আপনাকে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বোকা বানালো সে রাতে। একটা কথা। আপনি ভ্রুণটাকে নষ্ট করতে এই বাড়ি ছেড়ে দুরে যাবেন না। তাহলে ভ্রুণটা নষ্ট হবে ঠিকই। সাথে সাথে শয়তান আপনাকে ও মাইশিকেও শেষ করে দিবে। ভ্রুণটাকে নষ্ট করতে হবে অন্য উপায়ে। এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম তা সবই আমার অনুমান। শয়তানের সাথে কথা বলার ক্ষমতা যদি আমার থাকতো তাহলেই কেবল আমি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারতাম। তবে এটা অসম্ভব। তবে এই মুহুর্তে কোনো কুমারীত্ব হারানো মহিলাকে ৭রাতের জন্য এই বাড়িতে আটকে রাখতে পারলে মুক্তি পাবে মাইশি । তারপর বাচ্চাটা মহিলার গর্ভে জন্মালে ধ্বংস হয়ে যাবে শয়তানও। ভূল করেও কোনো কুমারী মেয়েকে এই বাড়িতে আনতে যাবেন না। তখন মাইশি ঠিক হবে ঠিকই, কিন্তু শয়তান রাজত্ব করবে পৃথিবী। আমি আরেকটা অনুমান আপনাকে বলি। যা করতে হবে দ্রুত করতে হবে। কোনো মহিলাকে ৭ দিনের জন্য আপনার বাড়িতে আটকে রাখা হয়তো আপনার পক্ষে সম্ভব না । তাই আপনাকে একটা অন্য উপায় বের করতে হবে। একটা নারীর লাশ জোগাড় করতে হবে। লাশটা বরফের মাধ্যমে বা পচনরোধক কেমিকেলের মাধ্যমে ৭ রাত আপনাদের বাড়িতে রাখবেন। ভ্রুণটা নতুন দেহ ভেবে সেই শরীরটার ভেতরে প্রবেশ করবে। তারপর সেই দেহটা মাটিতে পুতে দিলেই শয়তান শেষ। আমি প্রচন্ড অসুস্থতার কারণে আপনার কাছে আসতে পারছি না বলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

ইতি
পিটার

এইসব যুক্তিগুলো যেন আরিফ সাহেবের মাথায় গেঁথে গেল। তার এখন মনে হচ্ছে শম্মীর অবয়বটা আসলেই শয়তান ছিল। শয়তানকে পৃথিবীতে না আসতে দিয়ে মাইশিকে বাঁচানোর উপায় যেন তিনি পেয়ে গেলেন। কিন্তু লাশ জোগাড় করবেন কী করে! তার বন্ধু ইমরান বেঁচে থাকলে হয়তো একটা লাশের জোগাড় করতে পারতো সে। কিন্তু লিগাল ভাবে এখন লাশ নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। এখন কী তাহলে কবরস্থান থেকে লাশ চুরি করতে হবে তাকে? তার মেয়ের সুস্থতা এবং শয়তানকে ধ্বংস করার জন্য তিনি যেন সব কাজ করতে পারেন। এখন শুধু রাতের অপেক্ষা।

মাইশিকে ঘুম পাড়িয়ে রাত ২টা পর্যন্ত নিজ বাড়িতে অপেক্ষা করলেন আরিফ সাহেব। দুইটা বাজতেই গামছা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে, লুঙ্গি, সাদা গেঞ্জি পরে কোদাল হাতে মাটি কাটার লোকদের বেশে আরিফ সাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। বাড়ির দুটোগেটই খোলা রাখলেন। লাশটা নিয়ে ঢুকার সময় যেন সময় নষ্ট না হয়। গোরস্থানটা পাশের এলাকাতে। একটা লাশ চৌকিদারদের চোখ পেরিয়ে আনা কঠিন কিন্তু অসম্ভব না। আরিফ সাহেব গোরস্থান পর্যন্ত কোনো বাঁধা ছাড়াই পৌছালেন। গোরস্থানের গেইটটা খোলা। গোরস্থানটা বড় হওয়ায় রোজই এখানে লাশ দাফন করানো হয়। পুর্ণিমার আলোতে ৩টা নতুন কবর দেখা যাচ্ছে। কোনোটাতে মহিলা আছে নাকি বোঝার কোনো উপায় নেই। এখন পর্যন্ত যেহেতু আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে এরমধ্যে আর কারো আসার সম্ভাবনাও নেই। একটা করে কবর খুঁড়ে দেখতে হবে। আরিফ সাহেব মাঝখানের কবরটা দিয়েই খুড়া শুরু করলেন। যতটা সহজে খুড়তে পারবেন ভেবেছিলেন ততটা সহজে খুড়া গেল না। বেগ পেতে হলো বেশ। উপরের মাটি সড়িয়ে বাঁশ এবং পাটি দেখতে পেলেন। সেগুলো সড়াতেই কাফনে মোড়া লাশ। আরিফ সাহেবের ভাগ্য ভালো লাশটা একটা মহিলার। লাশটা যেই ছুতে যাবেন হঠাৎ বেশ কয়েকটা টর্চের আলো তার চোখ ধাধিয়ে দিল। উপর থেকে একটা কন্ঠ শোনা গেল, ঠিক টের পাইছিলাম স্যার। সাথে সাথেই আফনেরে কল দিছি। হালায় লাশ চুর।এর আগের ২টা লাশও এই হালায়ই চুরি করছে মনে হয়।

আরিফ সাহেবের বিস্ময় কাটার আগেই পুলিশ তাকে হাত কড়া পরিয়ে থাপ্রাতে থাপ্রাতে পুলিশ ভ্যানে তুললেন। তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না। গাড়ি সোজা চললেন পুলিশ ষ্টেশন।

মহিলাটির নাম আয়েশা। মাঝরাতে একা একা নির্জন রাস্তাটি ধরে হাঁটছেন। তার বাড়ি অজ-পাড়াগায়ে। স্বামীর সাথে রাগ করে ৬ মাস আগে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসেছিলেন। বিয়ের ১৩ বছর পরেও কোনো সন্তানের মুখ দেখাতে পারেনি সে স্বামীকে। সে যে বন্ধা এটা পুরো গায়ে রটে গেল। স্বামী এতবছর পর করল ২য় বিয়ে। সতীনের সংসারে মন টিকল না। পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই। রাগ করে চলে এলেন শহরে। কপাল ভালো থাকায় একটা বাড়িতে কাজ পেলেন। আজ ৬মাস পর মাঝরাতে চুরির অপরাধে সেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো তাকে। একটা বাসে উঠে শহরের এই প্রান্তে এলেন। কিন্তু এতরাতে এখন কোথায় যাবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। তার সাথে একটা পুটলা এবং জমানো ৩ হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই!

রাস্তার আশেপাশের সব বাড়িরই আলো বন্ধ। একটা বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। অবাক করার বিষয় বাড়ির বড় গেট খোলা। আয়েশার ভয় লাগলেও ধীরে ধীরে গেটের ভিতর প্রবেশ করলেন। উঠানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কাঁঠাল গাছের দিকে তাঁকালেন! সেখান থেকে ৩টা কালো ছায়া তার দিকে তেড়ে আসছে। আয়েশা ভয়ে দৌড়ে গেটের বাহিরে না বেরিয়ে উল্টো বাড়ির ভেতর চলে যায়। বাড়ির গেটটা খোলা দেখে সে আরও বেশি অবাক হয়। বাড়িতে ঢুকে ভাবে এখনি কেউ চোর চোর বলে চিৎকার করবে। কিন্তু বাড়িতে কেউ নেই। একটা ঘর থেকে শুধু বাচ্চা একটা কন্ঠের গোঙানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আয়েশা সেই ঘরে গিয়ে দেখে একটা ৮-৯ বছরের বাচ্চা মেয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছে। মেয়েটার শরীরে হাত দিতেই বুঝতে পারল প্রচন্ড জ্বর। পুরো বাড়িতে আর কাউকে খুঁজে পেল না সে! এই অসুস্থ মেয়েকে ঘরে ফেলে রেখে তার বাবা-মা কোথায় গেল এটাই ভেবে পাচ্ছে না আয়েশা। সে আর কিছু না ভেবে মেয়েটাকে বিছানায় উঠালো। বালতি এনে মেয়েটার মাথা ধুঁইয়ে দিলো, কিছুমাত্র জ্বর কমল না। আয়েশা চিন্তিত মুখে সারারাত মেয়েটার মাথার পাশে বসে রইল। সকাল হতেও কেউ বাড়িতে এলো না। মেয়েটার জ্বরও কমছে না। আয়েশা বাড়ি থেকে বের হয়ে ফার্মেসী থেকে জ্বরের ঔষধ আনলো, নাস্তা কিনে আনলো। নিজের বাড়ির মতোই চলাফেরা আরম্ভ করল যেন। আশেপাশের প্রতিবেশীদের দেখে কিছুটা ভয় পেলেও তারা তার কাছে কিছুই জানতে চায় না। মেয়েটার জ্বর কেন কমছে না। তার বাবা-মা ইবা কোথায়। আয়েশা নিজেই দুপুরে রান্না করেন। একবার সংকিত হন এটা ভেবে মেয়েটার বাবা-মাকে কেউ খুন করে মেয়েটাকে এখানে একা ফেলে যায়নিতো। তাকে পুলিশ এসে খুনের অপরাধে ধরে নিয়ে যাবে নাতো! পরে ভাবলেন,ধরলে ধরবে। মিথ্যা খুনের কথা স্বীকার করে বাকিটা জীবন না হয় জেলেই কাটিয়ে দিবেন। এখন আর তার হারানো বা পাওয়ার কিছু নেই। জীবন যেদিকে নিয়ে যাবেন সেইদিকেই ছুঁটবেন। আপাতত থাকার মতো তো একটা জায়গা পাওয়া গেল। আগে মেয়েটাকে সুস্থ করতে হবে।

মেয়েটার নাম আয়েশা জানে না। তার খোঁজও কেউ নিতে আসে না এই বাসায়। আলমারিটা তালা দেওয়া না। এখানে বেশ কিছু টাকা রয়েছে। আয়েশা স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েটার (মাইশির) সাথে থাকে। প্রথমে ৩ দিন মেয়েটার জ্বর এক রকম থাকে। এরপর দিন থেকে কমতে থাকে। কিন্তু আয়েশা যেন কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ছে এখন দিনে দিনে। তার পেট যেন একটু একটু করে ফুলছে। সে পেটের ভেতর যেন অন্য একটা প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। ৭দিন পর মাইশি পুরোপুরি সুস্থ আর স্বাভাবিক হয়ে যায়। আয়েশা যেন তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার পেট ফুলে পুয়াতী মেয়েদের মতো হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারে তার পেটে একটা বাচ্চা রয়েছে। মাইশিকে সুস্থ দেখে আয়েশা অনেক আনন্দ পায়। সে ভাবে একটা অচেনা বাচ্চা মেয়েকে এইভাবে বিনা স্বার্থে সেবা করারা জন্য বিধাতা তার প্রতি তুষ্ট হয়ে তাকে একটা গায়েবী সন্তান দান করেছেন। নাহলে এক সপ্তায় এমনটা হবে কী করে! তার এত জীবনের ইচ্ছা, স্বপ্ন পূরণ করেছেন তিনি।

মাইশির প্রতি তার হঠাৎ করে টান কী করে যেন কমে গেল। একসকালে মাইশি ঘুমাচ্ছিল। আয়েশা আলমারী থেকে টাকা এবং গয়না নিয়ে আবার তার স্বামীর বাড়িতে চলে গেলো। সেই বাড়িতে যাওয়ার পর সবাই আয়েশার এই অবস্থা দেখে বিস্মিত হলো। অনেকে আয়েশার চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলল। আয়েশা এসব গায়ে মাখলো না। সে যেন বাচ্চার নেশায় একটা ঘোরে চলে গেছে। তার সন্তান হবে! আর এটাতা তার স্বামীরই বাসা। সে রয়েছে এখানে। তার স্বামী বা সতীন এটা নিয়ে তাকে আর ঘাঁটালো না! কয়েক মাস পর তার প্রসব বেদনা শুরু হলো। দাই ডাকা হলো। তার সন্তান দেখে দাই হতভম্ব হয়ে গেল। হাত এবং পায়ে ৪টি করে আঙুল। চোখে কোনো মণি নেই। কী ভয়ংকর ভাবে চিৎকার করে কাঁদছে সে! জন্মের আধ-ঘন্টা পরেই মারা গেলো শিশুটি। তাকে কবর দেয়া হলো। আয়েশা ভেঙে পড়লেন।

ফাদার পিটার কোনো এক অজানা কারণে ভয়ংকর অসুখে ভুগতে ভুগতে মারা গেলেন।

আরিফ সাহেব ১৫দিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন এক পরিচিত পুলিশ কলেজ বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার পর। এর আগে লজ্জায় তিনি তার পরিচয় পুলিশদের দেয়নি। মাথা পেতে শাস্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। লাশ চুরি করতে যাওয়ার শাস্তি।

ভ্রূণটা মাইশির গর্ভ থেকে আয়েশার গর্ভে যাওয়ার পর মাইশি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। তার বাবা কোথায় আছে এটা সে জানতো না। আয়েশাকে বাবা প্রসঙ্গে কিছু বলেওনি সে। আয়েশার সাথে মাইশির ভালোই দিন কাটছিল। হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে সে দেখে আয়েশা বাড়িতে নেই। তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। মাইশি একা বাড়িতে ভয় পেতে শুরু করে। তার বাবার কথা মনে পড়ে। কিন্তু ভয়ে একা বাড়ির বাহিরেও যেতে পারে না। এছাড়া বাড়িতে কোনো খাবার নেই আর সে রান্নাও করতে পারে না। তাই সে দুর্বল আর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই সময়েই আরিফ সাহেব বাড়িতে ফিরেন। মেয়েকে অসুস্থ দেখে তিনি ভাবেন আবার কোনো নারী হয়তো এই বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন মাইশি একেবারে সুস্থ হয়ে গেছে। নারীদের এই বাড়িতে প্রবেশের পর মাইশি আর অসুস্থ হচ্ছে না। কিন্তু এইটা কী করে ঘটল আরিফ সাহেব আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন না। এটা তার কাছে একটা রহস্য হিসেবে থেকে গেল।

ও চলে গেছে। ওকে আর দেখা যাবে না। কিন্তু যখনি ওকে কেউ ডাকবে, ও আসবেই।

* * * * * সমাপ্ত * * * * *

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত