সেদিন হরিপদ ব্যানার্জি বের হলেন প্রাতঃভ্রমনে বরাবরের মতো এবারও আমি তার সাথে বের হলাম।সাথে কয়েকজন গোমেস্তা।
উত্তর পারা পেরিয়ে একটু মোর নিতেই চন্দনা এসে পড়লো হরপদ ব্যানার্জির সামনে।
চন্দনা সামনে থেকে দৌড়ে চলে গেলো ওর সই দের সাথে।
কিন্তু এই স্বল্পসময় হরপদ ঠিকই চন্দনাকে দেখেফেলেছিলো।
হরপদ ব্যানার্জি সহসা জিজ্ঞাসা করলো :
– মেয়েটা কে? আগেতো কখনো দেখিনি এই গাঁয়ে।
হরপদের এই কথা শুনেই আমার বুকের ভিতর হু হু করে উঠলো।মনে এক অজানা আকস্মিক ভয় দানা বাধতে শুরু করলো।মনে হলো আমি হারিয়ে ফেলবো চন্দনাকে।
এর ভিতর এক গোমাস্তা বলে উঠলো। ওর নাম চন্দনা।রইস আলীর মেয়ে।
হরপদ: রইস আলী তুমিতো বিয়ে করোনি। মাইয়া পাইলা কই।
গোমেস্তাদের মধ্যে একটা হাসির রোল পরে গেলো। মানুষের দুঃখ কেউ দেখেনা। কিন্তু তামাশা দেখার নেশা এক বড় নেশা।
→আসলে আমার বুবুর মেয়ে।। মা মরা মেয়ে।
: কাইলকার নিয়া আইসো দেখি কি রকম লালন পালন করছো।
আবার হাসিরর রোল পড়লো গোমেস্তা দের মধ্যে।
আমি কোনো কথা না বলে ওখান থেকে বাড়ির পথ ধরলাম।বুবুর ঘটনার পরও ঐ চন্দনার মুখের দিকে তাকিয়ে হরপদ ব্যানার্জির সব প্রতিশোধ ভূলে ছিলাম।
কিন্তু এতো দিন কারর চুপসে থাকা শ্মশানচারী মনে আবার প্রতিশোধের দানা বাধতে থাকলো।
বাবা হয়ে নিজের মেয়ের দিকে কু দৃষ্টি।রক্ত টগবগ করছে। হরপদের এই অত্যাচার আর চলতে দেয়া যাবে না। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে এসে পড়লাম।মাথা টখনো টগবগ করছে আমি রাগে কাল নাগের মতো ফুসছি।
দেউরীতে গিয়েই রাগের সহিত হাক ছাড়লাম “চন্দনা”
সাথে সাথে চন্দনা বেরিয়ে এলো।
সজোরে একটা চর মারলাম ওর গালে।এই দীর্ঘ্য পনের বছরের ভিতর একবারও ওর গায়ে হাত তুলিনি।করিনি কোনো শাসনও।আজই তুললাম……নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোটো মনে হলো।দেখলাম হাতের পাচটি আঙুলের ছাপ ওর গালে পরে গেছে।ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরতেছে।।ও দৌরে ঘরের ভিতর চলে গেলে।
আমি প্রিয়দর্শীনিকে হারিয়েছি কিন্তু ওকে হারালে আমি কি নিয়ে বাঁচবো।
তাই স্থির করলাম কালল সূর্যোদয়ের পূর্বেই চন্দনাকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যাবো।চন্দনার ঘরে গিয়ে দেখি ও তখনো কাঁদছে।।
গিয়া চন্দনার পাশে বসতেই ও আমার বুকে মাথা গুজে আরো কান্না করতে লাগলো।ওকে স্বান্তনা দেয়ার,ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
আস্তে আস্তে ওকে বললাম চল মা আমরা এই গ্রাম থেকে অন্য কোথায়ও পালিয়ে যাই।
“কেনো?” বলে সেই মায়াবী মুখটা আমার পানে চেয়ে রইলো।একটু আগে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা ওকে খুলে বললাম।
চন্দনা বলল:ও তো বুইড়া। কিন্তু এতো খারাপ কেনে?
এই বার চন্দনাকে ওর মা প্রিয়দর্শীনির সর্বনাশের কাহীনি শুনালাম।ওকে যখন বললাম যে ওর মায়ের সর্বনাশ করেছে ওই হরপদ ব্যানার্জি এবং ওনি চন্দনার বাব।
চন্দবা বলল:আমার বাবা ওই নরপশু কোনোদিনই হতে পারে না।
এসব কথা ছাড় মা। তারাতারি মালপত্র গুছিয়ে নে। কালকে সূর্যদয়ের পূর্বেই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।
চন্দনা উঠে দাড়ালো ওর মুখে প্রতিশোধের স্পষ্ট চিন্হ দেখতে পাচ্ছি।চন্দনা আরো দৃঢ় হয়ে বলল “গ্রাম তো ছাড়বোই তার আগে আমার মায়েরর সর্বনাশের বদলা নিবো।আজ রাতেই হরপদের জীবনের শেষ রাত।”
এরকম বলিস না মা। হরপদ অনেক শক্তিশালী ওর সাথে লাগা আমাদের মতো গরীব মাইনসের খাটে না।
:নাহ বাবাই। ওই নরপিচাশ কে না মারতে পারলে আমার মায়ের আত্মা কোনোদিনও শান্তুি পাবেনা।
ওর কথা শুনে আমার গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটতে ছিলে আর মে পরতেছিলো বুবুর শেষ কথা গুলো ।
→ দেখ মা আমার জীবনে আকড়ে ধরার মতো তুই ছাড়া কেউ নেই।তুই এগুলো ছাড় মা। তারাতারি সব মালপত্র গুছিয়ে ফেল।
:না বাবাই।
চন্দনাকে গ্রাম থেকে পালানোর কথা শেষ পর্যন্ত মানাতে পারলাম না।সে স্থির করলো আজকেই সে জমিদারের রঙ মহলে যাবে।এজন্য কিছু বিষ জোগার করলো যা আজকে জমিদারকে নেশার ঘোরে খাওয়াবে।আমার শত বাধা ও মানলো না। প্রিয়দর্শীনির মতো ও আজ ঘুঙুর পড়লো।ঘুঙুর পরে যখন হাটছে তখন ঝুম ঝুম ঝুম নিপ্পন ধ্বনি ছড়িয়ে পড়লো চারদিক।চন্দনাকে নিয়ে আাশার কারনে জমিদার হররপদ ব্যানার্জি আমাকে কিছু উপঢৌকন দিলো।চন্দনাকল আজ অনেকটা রহস্যময়ী লাগছে। মনে হলো এই চন্দনাকে আমি চিনি না।মনের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক। ও পারবে তো কাজটা করতে। নাকি ওরও প্রিয়দর্শীনির মতো অবস্থা হবে।পৃথিবীর কোনো বাবা হয়তো তার মেয়েকে এমন বিপদে ফেলেনি।মনে মনেনে নিজেকে ধিক্কার দিলাম।ওকে পূর্বের ঘটনা না বলে অন্য কোনো ভাবে বলে কয়ে ওকে নিয়া গ্রাম ছেড়ে পালাতে পারতাম। আমি কাঁদছি যা কেউ শুনতে পেলো না।
সেদিন রংমহলে চন্দনার নিপ্পন ধ্বনি প্রথম বাররের মতো বেজেছিলো যেনো হরপদ ব্যানার্জির বিদায় ঘন্টা।বলে কাদতে ছিলেন রইস আলী।
→দুরে মুয়য়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে । সুবেহ সাদিকের অসচ্ছ রবির আলো আমার চোখে এসে পড়ল।আমি ধরমর করে উঠো বসলাম। চারপাশটায় একবার চোখ বোলালাম।একটা ভাঙা বাড়ি চারদিকে ঝোপঝার দেখা যাচ্ছে।ঘোর কাটতেই বুঝলাম এতেক্ষন এখানে ঘুমিয়েছিলাম।গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো।আমি একটা দ্বীতল পরিপাটি বাড়িতে ঢুকেছিলাম। তারপর!!!!!দীর্ঘ্য বিস্ময় নিয়ে গতকালকের ঘটনা গুলো মনে করার চেষ্টা করছিলাম।
হ্যা।রইস আলী আর চন্দনা। সব যেনো কেমন ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে গেলো।তারমানে এতোক্ষন স্বপ্ন দেখছিলাম।হঠাৎ খেয়াল হলো কারো পায়ের ঘুঙুরের শব্দ ঝুম ঝুম ঝুম।কই কেউইতো নেই এখানে তাহলে শব্দ কিসের?
এমন আচপাচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো এতো চন্দনার ঘুঙুরের শব্দ।আচ্ছা চন্দনা র কী হয়েছিলো শেষ পর্যন্ত?আর রইস আলী? মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো।নাহ এখানে আর সময় নষ্ট করা যাবে না।এই বাড়িটা খুব রহস্য ময়।তাই হর হর করে বাড়িটা থেকে বেরর হলাম। কিন্ত আমি যাবো কীভাবে।সোমনাথদের বাড়িওতো চিনিনা। এদিকে মোবাইলের চার্জ কালকে ট্রেনে বসেই শেষ করে এসেছি।
কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে ভাবছি হঠাৎ খেয়া হলো গতকাল রাতে রইস আলীর কথা।হ্যা রইস আলী বলেছিলো “এক গ্রাম পর।মেইন রাস্তা দিয়া সোজা গিয়ে বায়ে সরকার বাড়ি””।
অবশেষে পৌছলাম সমুদের বাড়িতে।চারদিন যাবৎ চললো সমুর দিদির বিয়ের উৎসব।বিয়ের দিন গুলো কেমন একটা ঘোড় এর ভিতর কাটলো।বারবার ভেসে উঠছিলো চন্দনা সেই নিপ্পন ধ্বনি ঝুম ঝুম ঝুম….
বিয়ের অনুষ্ঠান চুকে যাওয়ার পরের দিন সমুকে নিয়ে বেরোলাম গ্রাম টা ঘুরে দেখার জন্য।কিছুদূর হাঁটার পর ওকে জিজ্ঞাস করলাম।
→তোদের গ্রামে দেখার মতো কী কী আছে?
:পুরান আমোলের কয়েকটা মসজিদ,কিছু স্থাপনা, দুইটা বড় বড় দীঘি এই।
→রাজ প্রাসাদ ট্রাসাদ নাই?
: আছে একটা জমিদার বাড়ি অনেক আগের। তবে ওইখানে নাকি ভূত পেত্নীর আস্থানা হয়ে গেছে। তাই লোকজন তেমন একটা যায় না ঐ দিক টায়।
→চল আজকে ওই খানেই যাবো।
:না ভাই পরে ভুতে ঘাড় মটকালে
→দুর হাদারাম চল।
:আচ্ছা।
কিছুক্ষন পর
:এই ততাজ আমার না ভয় লাগতেছে।
→আরে কোনা সমস্যা নাই।
:বলছিস?!
→আরে চলতো আমি থাকতে তোর কোনো ভরসা নাই।
:এমনে বলিস না
→আচ্ছা চলতো এইবার।
:ওকে যাওয়া যাক।
আবারও ডুকলাম সেই দ্বীতল মনরম বড়িতে।তবে এইটা এখোন বন জঙ্গলে ভর্তি।
ঘুরে ঘুরে আমাকে সব দেখাতে থাকলো সমু।
আমি মনে তখনো সেই চন্দনার নিপ্পন ধ্বনি ঝুম ঝুম ঝুম।আচ্ছা চন্দনার কী হয়েছিলো??
চন্দনাকে নিয়ে এইরকম নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো মনে।
আমি বললাম→বাহ অনেক সুন্দর বাড়িটা। জমিদার মনে হয় খুব শৌখিন ছিলেন।
সমু::হুম। তবে অত্যাচারী এবং নারী লোভী
→কী বলছিস এই গুলো।তোর কথা বিশ্বাস করি না।
: জানিস এই জমমিদার রংমহলে যেদিন মারা যায় সেইদিন এর পার্শ্বে একটা নারীর মৃতদেহ ও পাওয়া গিয়েছিলো।
→বলিস কি? ওই মেয়াটাই মেরেছিলো জমিদারকে?
:মুরব্বিরা তাই বলে তবে
→তবে?
:এই দুটি শবদেহের পাশে আরেকটা লোক ছিলো।নাম রইস আলী।
→ও তারপর।
:লোকজন ওই লোকটিকে কারাগারে পুরে দেয়এবং তকে একটা বদ্ধ ঘরে আটকে রাখা হয়। কোনা খাবার দেয়া হতো না তাকে। সাত দিনের দিন সেখানেই রইস আলী মারা যায়।
আমার আরর বুজতে বাকী রইলো না। কালকে রাতে যে রইস আলী আর চন্দনার কথা শুননেছিলাম ওরা ভিন্ন জগতের মানুষ। হরপদ ব্যানার্জীকে চন্দনা তাহলে মারতে পেরেছিলো।রইস আলীর বুবু প্রিয়দর্শীনির আত্মা কিছুটা হলেলেও স্বস্তি পেয়েছিলো।
:কিরে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে ফিরতে হবে না?
সমুর কথায় আবার সম্বিত ফিরে পেলাম.
→হ্যা চল এইবার যাওয়া যাক।
ফিরে আসছিলাম সেই অভিশপ্ত জমিদার বাড়ি থেকে।গেটের কাছে আসতেই শুনতে পেলাম সেই চিরচেনা ঘুঙুরের শব্দ। ঝুম ঝুম ঝুম।
এতো চন্দনার সেই ঘুঙুর যা তকে জীবন মৃত্যুর রহস্যের ধাঁধার ভিতর নিয়ে গিয়েছিলো।
সন্ধ্যা নামছে তাই বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।আবার কানে ভেসে আসলো সেই শব্দ
“ঝুম ঝুম ঝুম”.
©©©©© সমাপ্ত ©©©©©
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……