রাত দ্বী প্রহর। জীবনযাত্রার শুনশান নিরবতা।মাঝে মাঝে কয়েকটি শিয়াালের ডাক ভেসে আসছে।বড় অদ্ভূত গ্রামটা।ওইদিকে আজ আবার কৃষ্ণপক্ষের ২য় দিন।চারদিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন।খুব একটা ভালো দেখা যায় ন।
গায়ের উচু নিচু পথ পেরিয়ে এগোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।এমনিতেই গ্রীষ্মের শেষের দিক।তার উপরে রাতে সাপ-কোপের ভয়;সবমিলিয়ে একটা লোমহর্ষক ব্যাপার। এই গ্রাম তো চিনি না আজই প্রথম পা পড়লো এখানে। তার সাথে রাস্তা হারানোর ব্যাকুলতা।এই ঘন জঙ্গলের ভিতর একটা ছোট্ট রাস্তা ধরে এগোচ্ছি গন্তব্য যেখানে ছিলো সেখানের কাছাকাছি চলে এসেছি না দুরে হারিয়ে যাচ্ছি তা নিয়েও সংশয়। যেভাবেই হোক এই জঙ্গল থেকে বের হওয়া চাইই চাই।না হয় আজ কোন ভয়ানক জন্তুর পেটে চলে যাবো নিশ্চিত।ওহ পিছনে তাকানোই যাচ্ছেনা ভয়ানক অন্ধকার ;আমি আর ভাবতে পারছি এখান থেকে বের হতে পারলেই বাঁচি। কোথা হতে একটা চাপা আওয়াজ আসছে মনে হলো।আরে এটা ভুতুম পেচা। এই বিদঘুটে অন্ধকারে পেচা আসবে কোত্থেকে ; সম্ভবত বাদুর।
এইতো সামনে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।ভিতর থেকে প্রদীপের নিভু নিভু আলো আসছে।বাড়িটা জনমানব শুন্য মনে হচ্ছে।বাড়িটা পুরোনো আমোলের চারদিকে লতাপাতা ঘেরা। কিছু লতা সাপের মতো উপরে উঠে গেছে।বাড়িটা দেখে কৌতুহল হলাম। আবার ভয়ও করছে,গায়ে কাটা দিচ্ছে,লোমগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে। লোমহর্ষক কিছুর কৌতুহল নিয়ে বাড়ির ছোট্ট গেট ঠেলে ঢুকলাম। বাড়ির বাইরের পরিবেশ আর ভিতরের পরিবেশ সম্পূর্নই আলাদা।চারদিকে ঘেরা বাড়ি মধ্যখানে উঠান। বাড়ির দুটি কক্ষ থেকে আলোক রশ্মি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
সহসা সচকিত হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললাম,
“ভিতরে কেউ আছেন “তিনবার বললাম।। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সারাশব্দ নেই।ভয়টা ক্রমশ বারছে। আমি রীতিমত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি।হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম।আওয়াজটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
আমার সামনে একটা বৃদ্ধ লোক দাড়ানো।হাতে একটা হাটার লাঠি।অনুমান করলাম বয়স ৭০-৮০ এর কাছাকাছি হবে।আমাকে থ হয়ে থাকতে দেখেে জিজ্ঞাস করলো।
“কে বাবা তুমি?পথ হারিয়ে এখানে এসেছো?”
–আমি তাজ।পথ হারিয়েছি না পেয়েছি তা নিশ্চিত নয়। বাড়িটা ভালো লাগলো তাই ঢুকলাম।একটু জল হবে?
জল খাইবেন
একটু দাড়ান বাবা।
এটুকু বলেই তিনি হাক ছাড়লেন..
“মা চন্দনা একটুখানি জল নিয়ে আয়তো।”
ভিতর থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ ভেসে উঠলো “”আসছি বাবা””
বৃদ্ধ লোকটি আমাকে একটা বেতের মোড়া দেখিয়ে বসার নির্দেশ করলো।আমার ভীত অবস্থা এখন আর নেই।।
এর ভিতর নুপুরের ঝংকার শুনলাম।এক অল্প রয়স্কা নারী মূর্তি আমার সামনে দাড়ানো হাতে এক পেয়ালা জল।ঘোমটা টানা, চেহারাটা স্পষ্ট নয়। মন বলছে এই চন্দনা।
জল পানের পর। বৃদ্ধ লোকটির সাথে আলাপ শুরু করলাম।
আপনার নাম?
-রইস আলী।
আপনিতো অনেক পুরানো আমলের লোক। এই বাড়িটা আপনার?
-নাহ। হরপদ জমিদারের। আমি তার লেঠেল বাহিনীর প্রধান ছিলাম।
ওও আর ঐ মেয়েটি?
– হরপদ জমিদারের একমাত্র কন্যা।
এতোক্ষনে আমি আর রইস আলী মোড়া ছেড়ে গোল পাতার হোগলায় এসে বসলাম।
এতোক্ষনে মোটামুটি ভালোই সহজ হয়ে গেলাম রইস আলীর সাথে। বারবার মন টানছে ঐমেয়েটির দিকে।ঐ নুপুরের ধ্বনি।
এবার রইস আলী নিজ থেকেই তার ভাঙা ভাঙা কন্ঠ বলা শুরু করলো তার জীবন কাহীনি।ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে শুনছিলাম রইস আলীর জীবনের গল্প।
আজ এই জমিদার বাড়ি একসময় হরপদ ব্যানার্জি রাজত্বের কেন্দ্রভুমি। অত্যাচারি শাসক হিসেবে যাকে চেনে এই এলাকার সকলে।।
রইস আলী বলে চলল,
“বাবা মা দুজনকেই হারিয়েছি ছোট বেলায়।জমিজমা সব নদীতে হারিয়ে গেছে।মাইনসের কাছে চাইয়া চিনতে খাইতাম। কেউ আছিলো না দেখার। বড়ই দুর্দিনের মধ্যে ছিলাম।এর ভিতর হঠাৎ একদিন গঞ্জের হাটে গেলাম ভিক্ষা করতে।
এক লোকরে গিয়ে বললাম “আম্রে দুইডা ট্যাহা দ্যান দুই দিন যাইত কিছু খাইনাই।”
লোকটা আমারে নিয়া অনেক কিছু খাওয়াই লো। বলল “তোর কে কে আছে বাড়িতে?”
-কেউ নাই।
:বাবা -মা?
-না ফেরার দেশে।
ওওও। তার পর আমারে কিছুক্ষন সান্ত্বনা দিয়া বলল,”যাবি আমার সাথে?”
যেহেতু আমার কেউ ই ছিলো না ধারায় তাই রাজি হইয়া গেলাম।
স্রষ্টা যেনো মুখ তুলে চাইলেন।আমার আর আগের মতোন ভিক্ষা করতে হয় না। দু বেলা দুমুঠো খাবার পেতাম। ভালোই চলছিলো।যেই বাবুর সাথে আাসছিলাম ওনার নাম তারাশঙ্কর।
কৃষিজীবী- বর্গা চাষী…
এছাড়াও তার একটা ব্যাবসা ছিলো।সব মিলিয়ে ভালোই চলছিলো।কিন্তু কথা আছে না “অভাগা যেখানে যায় সেখানে সাগর শুকিয়ে যায়।”
বাবু রা তিনজন আমায় নিয়ে তাদের পরিবারে সদস্যসংখ্যা মাত্র চার।বাবু র কোনো ছেলে ছিলো না বিধায় বাবুর স্ত্রী আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
এইবার আসি সংসারের প্রিয় সদস্যের কথা।
আমি বুবু বলে ডাকতাম।ভালো নাম প্রিয়দর্শিনী। আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো আদোর করতো।আমারসাথে ঘুরতো, আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে বুবু।ঘুড়ি উড়ানো থেকে শুরু করে। অন্যের গাছের আম চুরি করা পর্যন্ত।
-“কি হাসতেছেন?”
ঘুম ঘুম অবস্থা য় ছিলাম রইস আলীর সচকিত জিজ্ঞাসায় প্রান ফিরে পেলাম। স্বব্যাস্থ হয়ে বললাম “নাহ আপনি বলুন?”
-আপনি এই গ্রামের কোথায় যাবেন?
:এখানে আমার বাবার এক বন্ধু থাকে।সোমনাথ সরকার।ওনাদের বাড়িতে যাবো।
-সরকার বাড়ি?
:হ্যা.এখান থেকে কত দুর?
-এই একটা গ্রাম পেরলেই।মেইনরাস্তা দিয়া সোজা গিয়া বায়ে কিছুক্ষন হাটলেই সরকার বাড়ি।
:ওও।আচ্ছা।বললাম একটু জল হবে?(উদ্দেশ্য জল নয় উদ্দেশ্য সেই নুপুরের ঝংকার শোনা। কেমন একটা মায়া কাজ করে)
রইস আলী বলল,”মা চন্দনা একটু জল দিয়ে যা।”
কিন্তু সে আর এলোনা। ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো।
আমি বললাম, কি যেনো বলছিলেন আপনার বুবুর কথা।
রইস আলী আবার বলা শুরু করলো।
আরো গল্প পড়তে লিংক এ ক্লিক করুন……