সেদিন রাতের ঘটনাটা সাঈফুলের মনে পড়লে আজো গাঁয়ের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়। কি ছিল সেটা। কোন মাংসাশী জানোয়ার না কোন অশরীরি ?গ্রীষ্মের শেষদিকে। চারদিকে চাঁদিফাঁটা রোদে সাধারণ মানবজীবন অসহায় হয়ে পড়েছে। রাত্রিবেলাতেও কেউ কেউ এখন ঘরের বাইরে টং বানিয়ে শুয়ে পড়ে। তরুণ ছেলেপেলেরা এই সময় এদিক-ওদিক আড্ডা জমিয়েই সময় কাটায়।পাতিলাপাড়া। মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রাম। চাষ-বাষমস করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের দু’চারজন গেরস্ত মোটামুটি বাহিরের দুনিয়া সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। তাদের মাঝেই একজন রশিদ মন্ডল। তার সেই আশির দশক থেকে ডিম নিয়ে দূর দূরান্তের গাও-গেরামে আসা-যাওয়া। এ জীবনে দেখেছেন অনেক কিছুই। তরুণ বয়স থেকে তাই আজো পর্যন্ত নামায কামাই দেন নি। তার ছিলদু’টো ছেলে আর একটা মেয়ে। মেয়েটা ছোট আর ছেলে দু’টো নজরুল,সাঈফুল ছিল বেয়াড়াপনায় ভর্তি। বেয়াড়াপনা বলতে লেখা-পড়া ছাড়া তারা সব অকাজ করতেই রাজি ছিল। বড় ছেলেটা অবশ্য ইদানিং লেখা-পড়ায় মন দিয়েছে। তবে, ছোটটা সারাদিন-রাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর যতসব নাই-কাম। কারো গাছের এটা ছেঁড়া, কারো পুকুরের মাছ ধরা, গাছের মগডাল থেকে মধুর চাক কেঁটে আনা। বয়সআটারো-ঊনিশ হলেও বুকে ছিল তার অদম্য সাহস। রাত বিরাতে এদিক-ওদিক একাই চলে যেত। কোন টর্চ কিংবা কুপি বাতি নেয়ার ছিলনা কোন বালাই। সম্পূর্ণ আধ-ভৌতিক এক মানুষ।গ্রীষ্মের এক মাঝরাতে। প্রচন্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে সবাই। তবুও, কেউ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। অথচ, সাঈফুলের ঘুম আসছেনা কিছুতেই। শেষমেষ, বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাঈফুল তবুও ঠিক ঠিক অন্ধকার ফুঁড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু’ধারে আছে বিশাল বিশাল দু’টো পুকুর। এতটুকুন হাঁটায়ও যদি ব্যাসকম হয় তাহলে সোজা গভীর পুকুরে। সন্ধ্যে হলেই যেন এই রাস্তাগুলোতে আপনা-আপনি কারফিউ জারি হয়ে যায়। কেউ একবারের জন্যও এই পথ মাড়াতে সাহস করেনা।গত গ্রীষ্মের সন্ধ্যেবেলায় ঘটা এক আতংকপূর্ণ ঘটনা থেকে গ্রামবাসী সবাই এই রাস্তার ব্যাপারে সাবধান হয়ে গেছে। তোফায়েল নামের এক বয়োবৃদ্ধা হাট শেষে তার মালপত্র নিয়ে ফিরছিল। শুন-শান রাস্তা। রক্তাভাব আকাশ যেন কোন এক অঘটনের জানান দিচ্ছে। তিনি হঠাৎ দেখেন, তার রাস্তার উপর একটি খাটিয়া রাখা। তার মাঝে ফকফকে সাদা কাফনের লাশ। নতুন বালি বলে বালিগুলোও যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঝিঁঝি-পোঁকারাও হঠাৎ ঘন ঘন ডাকতে আরম্ভ করে। তোফায়েল বুড়ো আজকের না সেই পাকিস্তান আমলের মানুষ। হাড্ডি পুরোনো হলেও তার হৃদয় পুরোনো না। সেদিকে না তাঁকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে এলো। পেছন ফিরে আর তাঁকালোনা। তবে, মনে হলো পেছনের বস্তুটা আর সেখানে নেই। মানুষের ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় বলে একটা ব্যাপার আছে। প্রচন্ড শ্বাসরুদ্ধকর ব্যাপারগুলোতে সেটা আপনা-আপনিই খুলে যায়। তোফায়েল বুড়ো আরো কয়েক কদম যাওয়ার পর পুকুরের রাস্তায় উঠার সময় দেখলো, দমকা হাওয়ায় কিছুটা বোটকা গন্ধ ভেসে আসছে। বমি এসে পড়ার উপক্রম। নাক চেপে ধরে তোফায়েল বুড়ো পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ, পেছন থেকে শেয়ালের আক্রমণ। সোজা ঘাড়ের উপর। জোড়ালো কামড়ে কয়েকটা ছিঁড়েই গেল। কাঁধের মালপত্র সব নামিয়ে তোয়াফেল বুড়ো শেয়ালটাকে ধরে ইচ্ছেমতন আঁছড়ালো। একটা সময়তে এসে শেয়ালটা চার-পা ছেড়ে দিল। বুড়ো মনে করলো, শেয়ালটা নিশ্চয়ই মরে গেছে। ঘাঁড়ের কাছে শার্টটা দিয়ে বেঁধে জোর পায়ে হাঁটতে লাগলো। গলা দিয়ে গল গল করে ঈষৎ উষ্ণ রক্ত বেরোচ্ছে। পুকুরেরসরু রাস্তা শেষ করার কিয়ক্ষণ পরেই মৃতপ্রায় শিয়ালটার ভয়ালো থাবায় তোফায়েল বুড়োর ঘাঁড়ের সবকটা রগ ছিঁড়ে গেল। গোঁস গোঁস শব্দে তোফায়েল বুড়োতার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। জমির মাটি তার রক্তে ভেঁজে উঠে।পরদিন সকালে, গাঁয়ের কৃষকরা সূর্যের প্রথম আলোয় তার ফ্যাটফ্যাটে সাদা দেহটা সেখানে খুঁজে পায়। গ্রামের বয়োবৃদ্ধারা সেখানে পৌঁছালে বুঝতে পারেসেটা সাধারণ কোন শেয়ালের কর্ম নয়। অবশ্য একটা জিনিষ সকলকে শিউড়ে তুলেছিল। তোফায়েল বুড়োর শরীরে একফোঁটা রক্তও ছিল না। খোলা চোখ দু’টো যেনঅশুভ কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিল গ্রামবাসীদের।তরুণ সাঈফুলের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। ভূত অর্থাৎ খারাপ জ্বীন বলতে যে দুনিয়ায় কিছু আছে সেটা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনা। এই মাঝরাতে সে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় চলে যায়। সেলিম মন্ডল। সাঈফুলের চাচাত ভাই। সমান সমান বয়সী। সবসময় দু’জন একসাথেই চলাফেরা করে। পড়তও একই কলেজে। সেলিম সারাদিন-রাত পড়েও ভালো রেজাল্ট করতোনা। সে হিসেবেসারাদিন ঘুরে-ফিরে সাঈফুল ঢের ভালো রেজাল্ট করতো। রাত্রিবেলায় সেলিমকে ডেকে দু’জনে বেরিয়ে পড়লো। একা একা হেঁটে নাকি কোন মজা নেই।সেলিমের হঠাৎ পেট ডেকে উঠলো। সন্ধ্যের সময় খাওয়া রাতের খাবার হয়তো এতক্ষণে হজম হয়ে গেছে। সাঈফুলের পেটটাও চোঁ চোঁ করছিলো।“সাঈফুল ভাই, ক্ষিদা লাগছে”‘কি করবো, এখন তো দোকান-পাটও বন্ধ’“ইস! কারো গাছে যদি পাঁকা কিছু থাকতো।”গতকাল সেলিমদের বাড়ির পিছনে বিশাল আকৃতির কাঁঠাল গাছটার কথা মনে পড়লো সাঈফুলের। বাড়িওয়ালা মহিলা বলেছিল, যে এই কাঁঠালে হাত দিবে তার হাত কাইট্টা ফালামু, যার পোলাই হোক। কাঁঠাল অবশ্য দেখেনি সাঈফুল তবে কাঁঠালটা ছেঁড়ার একটা অদৃশ্য ইচ্ছা অনুভব করলো। সেলিমকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি কাঁঠাল গাছে উঠলো সাঈফুল। পুরো গাছ তালাশ করে একটা কাঁঠাল ছাড়া আর কোন কাঁঠালই দু’জনে খুঁজে পেল না। শেষ মেষ বিশাল আকৃতির কাঁঠালটা সিঁধেলচোরের ন্যায় কাঁদে করে পুকুরের পাশের নতুন জমিতে নিয়ে এল। রাত্রিবেলায় লোকজন এদিক দিয়ে আসা-যাওয়া করে না বলে জায়গাটা নিরাপদ। রশিদ মন্ডল অথচ পই পই করে সাঈফুলকে এই জমিতে আসতে বারণ করে দিয়েছে। কিন্তু, সাঈফুল বারণউপেক্ষা করে আজ এসে পড়েছে। কাঁধে করে বয়ে আনা তাদের কাঁঠালটা ছিল কাঁচা।দু’জনেরই মন ভেঙে যায়। পরে বুদ্ধি করে নতুন বালির নিচে কাঁঠালটা গেঁথে রেখে যায়। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সেদিন অবশ্য দু’জনেই ধীরে-সুস্থে বাড়ি ফেরে।দু’দিন পরের ঘটনা। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে গেছে গতকাল। বর্ষার লাগাতার বর্ষণে ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার জো নেই। ওদিকে, সেলিমের কাছে সাঈফুল জানতে পারলো, কাঁঠাল চুরি হওয়ায় কাঁঠাল গাছের মালিক আয়না পড়া দিবে। যে চুরি করেছে তাদের চেহেরা সেখানে দেখা যাবে। সাঈফুল ও নিয়ে কোন মাথা ঘামালো না। বৃষ্টি শেষে আকাশটা একটু পরিষ্কার হয়ে এসেছে। তাই, অন্ধকারের পরিমাণটাও অহেতুক বেড়ে গেছে। বাধ্য হয়েই সাঈফুল আজকে রশিদ মন্ডলের টর্চ নিয়ে কাঁঠাল দেখতে বের হল। সেদিনের মত দু’জন আজ নতুন ভিটায় উপস্থিত। অনেক দূর থেকেই কাঁঠাল পাঁকার মিষ্টি ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে আসছে। দু’জনে আজমনে মনে বেজায় খুশি। ভরপেট কাঁঠাল খাওয়া যাবে। নতুন ভিটায় এসে দু’জনে ভেজা বালি সরিয়ে দেখলো, কাঁঠাল পেঁকে একাকার। দু’জনে জমিয়ে কাঁঠাল খাচ্ছে। সেলিম বিশ-ত্রিশ কোয়া মুখে দিয়ে বললো, আর না। পুটলি থেকে সিগারেট বের করে সে আপনমনে সিগারেট টানতে লাগলো। হঠাৎ সেলিম সাঈফুলের দিকে তাঁকিয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো। সাঈফুল আপনমনে তখনও কাঁঠার খাচ্ছে। সেলিম সাঈফুলকে এক গোত্তা মেরে দিল ভোঁ দৌড়। সাঈফুল আগ-পিছ না ভেবে ঘাঁড় ফিরিয়ে দেখল তার থেকে বরাবর এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বিশাল এক ছায়ামূর্তি। অন্ধকারে সেটার উপস্থিতি অন্ধকারকে যেন আরো ঘন কালো করে দিয়েছে। সাঈফুল এদিকে গগন-বিদারী এক চিৎকার দিয়ে হাতের টর্চ আর ঘড়ি ফেলেএক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে গেল। হৃদপিন্ডের এত দ্রুত হৃদস্পন্দন যেন কিছুতেই থামতে চাইছেনা তার। বার বার কল্পনায় ভেসে বেড়াচ্ছে অন্ধকার সেই ছায়ামূর্তির চিত্র।ভোর হয়ে এসেছে। সাঈফুলের চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। সাঈফুলের মনে রশিদ মন্ডল অর্থাৎ বাবার টর্চ আর নিজের দামী ঘড়ির কথা হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। বুকে থুতু দিয়ে পা বাড়ালো আবার নতুন ভিটার দিকে। ফজরের আযান হয়ে গেছে। তাই, ভয়টা অবশ্য নেই। তবে গত রাত্রের ব্যাপারটা মনে পড়তেই হৃদপিন্ডটা অহেতুক ধুক ধুক শব্দ করে উঠে। নতুন ভিটার জায়গাটা সেই আগের মতই আছে। টর্চ আর ঘড়ির কিছুই হয় নি। শুধু নেই কাঁঠালটা। কাঁঠালের বিঁচি তো দূরের কথা একবিন্দু কষও নেই সেখানে। সাঈফুলের মনে তখন একটাই প্রশ্ন কি ছিল সেটা???
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক