বাজু একসঙ্গে মাথা আর হাত নাড়তে নাড়তে বলে, ‘না দাদাই, ভূত-টুত বলে কিস্সু নেই! স্রেফ গাঁজা?
বাজুর বন্ধু বিটুও ঠোঁট উন্টে দিয়ে বলে, একদম বোগাস।
ফি বছর বাজু পুজোর ছুটিতে মামাবাড়ি আসে। পুরো ছুটিটা কাটিয়ে একেবারে ভাইফোটার পর নিজেদের বাড়ি ফিরে যায়।
বাজুর অবশ্য আপন মামা নেই। তবে মাসি আছে, দাদাই আছেন, দিদন আছেন।
বেড়িয়ে, গল্প করে, মজার মজার বই পড়ে ছুটিটা তোফা কেটে যায়। এ বছর বাজুর সঙ্গে এসেছে তার প্রাণের বন্ধু বিটু।
দুজনের গলায় গলায় ভাব। একই স্কুলে তারা ক্লাস ফোরে পড়ে। দুজনেরই বয়স দশ।
দুই বন্ধুই লেখাপড়ায় দারুণ। হাফ ইয়ারলিতে বাজু ফাস্ট হলে, অ্যানুয়ালে বিটু। দুজনেরই দারুণ বুদ্ধি আর সাহস।
বাজু মামাবাড়িতে এলে সন্ধের পর রোজ ছাদে আলো নিভিয়ে শতরঞ্জিতে আরাম করে বসে গল্পের আসর জমানো হয়।
গল্প বলেন অবশ্য দাদাই অর্থাৎ দাদামশাই। মামাবাড়িতে অজস্র বই, আট-দশটা আলমারি একেবারে বোঝাই।
তবু প্রতি মাসেই দাদাই প্রচুর বই কেনেন। কত রকমের বই তার ঠিক নেই। দেশবিদেশের ইতিহাস, সায়েন্স ফিকশান,
কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি, রূপকথা, অ্যাডভেঞ্চার, প্রকৃতি বিজ্ঞান ইত্যাদি। এইসব বইয়ের প্রতিটি পাতা দাদাইয়ের মুখস্থ।
ছুটিতে বাজু মামাবাড়ি এলে তিনি তাকে এই বইগুলোর গল্প শোনান।
গল্পের আসরে শ্রোতা শুধু একা বাজুই নয়—মাসি, দিদন এবং মামাবাড়ির চারপাশে যারা থাকে যেমন বুম্বা, পাপাই, বুবলা
—এরাও বুম্বাদের সঙ্গেও খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বাজুর।
দিন তিনেক আগে এবার পুজোর ছুটি পড়েছে আর আজই দুপুরে বাজু বিটুকে সঙ্গে করে মামাবাড়ি চলে এসেছে।
বাজুর মা-ই তাদের পৌছে দিয়ে গেছেন।
দিনের বেলাটা হৈ হৈ করে কাটিয়ে এখন এই সন্ধেবেলায় ছাদে গল্পের আসর বসিয়েছে বাজুরা। এতদিন যারা গল্প শুনে আসছিল
বিটু আসায় এবার তাদের সংখ্যাটি বেড়েছে।
এবার মামাবাড়িতে পা দিয়েই বাজু খবর পেয়েছে, ইদানিং কিছুদিন ধরে দাদাইকে ভূতে পেয়েছে।
ইংরজি আর বাংলায় ভূত-প্রেত নিয়ে যত বই বেরিয়েছে, সবই কিনে ফেলেছেন। এগুলো রাখার জন্য নতুন আলমারিও করতে হয়েছে।
কাজেই দাদাইয়ের গল্পে ভূত যে এসে পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী। বেশ জমিয়ে খাস বিলেতের এক ঠ্যাঙা সাহেব-ভূতের কীর্তিকলাপ
যখন তিনি বলতে শুরু করেছেন সেই সময় বাজু আর বিট্টু প্রবল চেঁচামেচি জুড়ে দেয়।
তাদের দেখাদেখি শিয়ালের পালের মতো পাপাইরা কোরাসে বলে ওঠে, বাজে, বাজে, বাজে। আমরা ভূত বিশ্বাস করি না।’
দাদাই চোখ কুঁচকে সবাইকে দেখতে দেখতে জিগ্যেস করেন, কর না তো?
‘না, না, না।’
‘কেন কর না?’
আমরা কেউ ভূত দেখিনি, তাই।’
দাদাই কী একটু ভাবেন। তারপর বলেন, যদি তোমাদের ভূত দেখিয়ে দিতে পারি, তাহলে করবে?’
এদের মধ্যে বাজু এবং বিট্টুর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। তারা বলে, কবে দেখাবে? কখন দেখাবে? তাদের আর তর সইছে না যেন।
দাদাই বলেন, দু-একদিনের ভেতর দেখতে পাবে।
‘দিনের বেলা, না রাত্তিরে?’
‘রাত্তিরে।’ কোথায় দেখাবে?’
দাদাইদের বাড়ির পেছনে অনেকটা ফাঁকা মাঠ। মাঠটা ঝোপঝাড় আগাছায় ভর্তি। তারপর রেললাইন চলে গেছে।
আর রেললাইনের ধারে একটা প্রকাণ্ড পুরোনো ভাঙাচোরা জমিদার বাড়ি কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে।
বাড়িটায় লোকজন থাকে না, আলো-টালো নেই। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে ওটাকে ভূতুড়ে দেখায়। বাড়িটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দাদাই বলেন,
ঐ বাড়িটায় রাত বারোটার সময় দোতলার দক্ষিণের শেষ ঘরটায় পরশু যদি যাও, ভূত দেখতে পাবে।
তারপর ক্ষুদে শ্রোতাদের দিকে ফিরে পরপর সবাইকে দেখতে দেখতে চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলেন, তোমাদের মধ্যে কে কে যেতে চাও, বল।’
পাপাই, বুম্বা আর বুবলার মুখ চুপসে গেছে। তাদের বুকের ভেতরটা ভীষণ ঢ়িব ঢ়িব করছিল।
বুম্বা ঢোক গিলে বলে, ‘আমাদের বাড়ির গেটে রাত দশটায় তালা লাগানো হয়। আমি যে বেরুতে পারব না।’
পাপাই বলে, ‘কাল সকালে চন্দননগরে পিসির বাড়ি যাচ্ছি। ফিরব চারদিন বাদে। পরশু ভূত দেখতে যাব কী করে?’
বুবলা বলে, ‘নটা বাজলেই আমার ঘুম পেয়ে যায়। বারোটা পর্যন্ত আমি বাবা জেগে থাকতে পারব না।’
মুচকি হেসে দাদাই বলেন, ‘বুঝেছি তোমরা কেমন বীরপুরুষ। তারপর বাজুদের জিগ্যেস করেন, ‘কী, তোমরাও বুবলাদের দলে নাকি?
বাজু এবং বিট্টু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বুক ফুলিয়ে মোটা গলায় বলে, নেভার।
নিতান্ত ভালোমানুষের মতোই দাদাই জিগ্যেস করেন, তাহলে তোমরা পরশু রাতে ওখানে যাচ্ছ?
বাজু বলে, ‘নিশ্চয়ই। কিন্তু—
‘কী?’
‘পরশু রাত বারোটায় ওখানে গেলে ভূত দেখতে পাব, কী করে জানলে?’
আমি জানি, পরশু হল বুধবার। প্রতি বুধবার রাত বারোটায় ওখানে গেলে তাকে দেখা যায়।
বিট্টু বলে, ‘তুমি দেখেছ দাদাই?
দাদাই বলেন, ‘নিশ্চয়ই। না হলে তোমাদের অত জোর দিয়ে বলছি কী করে?’
বাজু আর বিট্টু এবার ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে গাদা গাদা প্রশ্ন করে যায়।
তাকে দেখতে কেমন? কথা-টথা বলেছে কিনা? বললে কী বলেছে? ইত্যাদি।
দাদাই বলেন, ‘আমি কিছু বলব না। সাহস থাকলে নিজেরা গিয়ে দেখবে। ঠিক আছে। আমরা পরশু যাচ্ছি।’
দিদন কিন্তু খুব রেগে যান। দাদাইকে বলেন, কেন বাচ্চা দুটোকে ঐ হানাবাড়িতে পাঠাচ্ছ? শেষে ভয়-টয় পেয়ে যদি কিছু হয়ে যায়?
বাজু আর বিট্টুর ওপর দাদাইয়ের দারুণ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘ওরা ভয় পাবার ছেলে নয়।
তুমি ভেবো না। দুজনে ঠিক পরশু রাত বারোটায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারবে।’
দিদনের দুশ্চিন্তা কাটে না। তিনি বলতে থাকেন, কী যে তোমার অলুক্ষণে কাণ্ড বুঝতে পারি না।
এই বাচ্চাদের কেউ অমন করে উসকে দেয়!
দিদন এবং মাসির ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও বুধবার রাত বারোটায় মাঠ পেরিয়ে দুই বন্ধু পোড়ো জমিদার বাড়িতে চলে আসে।
তাদের দুজনের হাতে রয়েছে বড় টর্চ আর লাঠি। পিঠে বাঁধা আছে এয়ারগান।
বাড়িটার সামনে বাজুরা থমকে যায়। কেউ কোথাও নেই, চারিদিক একেবারে সুনসান। এধারে ওধারে ঝিঁঝিঁরা একটানা ডেকে চলেছে।
অনেক দূরে, রেললাইনের ওপারে কোথায় যেন মিহি, মোটা, নানা সুরে ঝাঁকে ঝাঁকে কুকুর ডেকে ওঠে। এছাড়া কোথাও আর কোনো শব্দ নেই।
এ লাইনে লাস্ট ট্রেন চলে যায় পৌনে বারোটায়। তারপর এদিকটা একেবারে নিঝুম হয়ে পড়ে।
সব দেখে-শুনে বিট্টু দমে একটু যায়। বলে, ‘কি রে বাজু, ভেতরে যাবি?
বাজু বলে, ‘নিশ্চয়ই। এই পর্যন্ত এসে যদি ফিরে যাই, দাদাই ঠাট্টা করে করে আমাদের জ্বালিয়ে মারবে।’ বলে টর্চ জ্বালে।
ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে দশ-বারো ফিট দূরে ভাঙা লোহার গেট। সেটার একটা পাল্লা নেই, অন্য পাল্লাটাও ভেঙে হেলে পড়েছে।
গেটটাকে ঘিরে প্রচুর বুনো ঘাস আর কাঁটার ঝাড়।
বাজু বলে, ‘চল, ভেতরে ঢুকি।’
টর্চ জ্বেলে রেখেই দুজনে ঘাস এবং ঝোপঝাড় ঠেলে বাড়ির ভেতর চলে আসে।
গেটের পর মস্ত বাঁধানো চাতাল। তারপর দশ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে মোটা মোটা থামের ভেতর টানা বারান্দা।
থামে এবং বারান্দায় ফাটল ধরে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। ফাঁকে ফাঁকে বট-অশ্বথের চারা গজিয়ে উঠেছে।
দোতলায় উঠে দক্ষিণের শেষ ঘরখানায় যেতে হবে বাজুদের। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সিঁড়িটা বের করে তারা ওপরে উঠতে থাকে।
হঠাৎ নাকে ভক করে একটা বেটকা দুৰ্গন্ধ এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে ফর ফর করে অগুনতি চামচিকে মাথার ওপর উড়তে থাকে।
এদের দু-একটা আবার বাজু এবং বিট্টুর নাকে-মুখে নখের আঁচড় বসিয়ে যায়।
দুহাতে লাঠি আর টর্চ ঘোরাতে ঘোরাতে চামচিকেদের আক্রমণ ঠেকিয়ে কোনোরকমে দোতলায় উঠে আসে বাজু আর বিট্টু।
চারপাশে আলো ফেলে ফেলে দক্ষিণ দিকটা ঠিক করে নেয়। টানা একটা বারান্দা সোজা ওদিকে চলে গেছে,
যার শেষ মাথার ঘরটায় যাবার কথা বলে দিয়েছেন দাদাই। বাজুরা পা বাড়াতে যাবে, কোথায় কোন অদৃশ্য
ঘুলঘুলির ভেতর থেকে আওয়াজ ওঠে, তিক্খো তক্খো— অর্থাৎ তক্ষক ডাকছে।
তক্ষকটাকে ভেংচি কেটে বা পাশের সিলিংয়ের কোণ থেকে কারা যেন ভারী গম্ভীর গলায় হুমকে ওঠে, ভূতুম—ভূতুম—ভূতুম—
অমন যে দুর্জয় সাহসী বাজু, তার বুকের ভেতরটা পর্যন্ত ছমছম করে ওঠে। হাত-পা তার ভীষণ কাঁপছে আরেকটু
হলে তার হাত থেকে টর্চ আর লাঠি খসে পড়ত। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেয় সে।
বিট্টুর বুকটাও গুরগুর করছিল। বাজুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে কাঁপা গলায় বলে, কী ব্যাপার রে?”
বাজু বলে, ‘দাঁড়া দেখছি।’
সিলিংয়ের যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছে, আন্দাজ করে মুখ তুলে সেখানে তাকায় বাজু।
আর তখনই দেখতে পায় চারজোড়া জ্বলন্ত চোখ সেখানে স্থির হয়ে আছে। বিট্টু ‘বাবা গো’ বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পড়ে।
বাজুও পড়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী মনে পড়তে সেই চোখগুলোর ওপর টর্চের আলো ফেলে। তখনই দেখা যায়, সিলিংয়ের
লোহার বিমের ওপর সারি সারি চারটে পেঁচা বসে আছে।
বাজু হাত ধরে বন্ধুকে টেনে তুলতে তুলতে বলে, ভয় নেই বিট্টু, ওগুলো পেঁচা রে! ওঠ ।
বিট্টু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পেঁচাগুলোকে দেখে তার ভয় অনেকটা কেটে যায়। বলে, আর দাড়াস না। চল—”=’
পা টিপে টিপে বারান্দা ধরে দুই বন্ধু এগিয়ে যায়। তাদের বা পাশে সারি সারি ঘর। বেশিরভাগ ঘরেরই দরজা-জানালা লোপাট হয়ে গেছে।
বিরাট বিরাট ফোকরগুলো দিয়ে বাইরের ঝাপসা আলো ভেতরে গিয়ে পড়েছে। সেদিকে তাকালে মনে হয়, কারা যেন ঘরগুলোর
মধ্যে ওঁত পেতে বসে আছে যে কোনো মুহুর্তে তারা ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
শেষ পর্যন্ত দক্ষিণের শেষ ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ায় বাজুরা। এ ঘরের দরজার পাল্লা নেই, তবে জানালাগুলো আস্তই আছে।
বিট্টু ফিসফিসিয়ে বলে, কি রে, ভেতরে ঢুকবি?’
বাজু কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ঘরের ভেতর থেকে খোনা গলায় কেউ বলে ওঠে, ‘ঢুঁকবে বৈকি, অ্যাঁদ্দু এঁসে নাঁ ঢুঁকলে চলে?
এঁসো, এঁসো, তোঁমাদের সঁঙ্গে এঁকটু গঁল্প-টঁল্প কঁরি।’
দুই বন্ধুর হৃৎপিণ্ড বলের মতো লাফাতে থাকে। তারা কী করবে, ভেবে পায় না।
ঘর থেকে সেই গলাটা আবার ভেসে আসে, ‘কীঁ হঁল, দাঁড়িয়ে রঁইলে কেঁন? তোঁমাদের তোঁ দাঁরুণ সাঁহস। চঁলে এঁসো। আঁমি দেঁখতে পাঁচ্ছি,
তোঁমাদের সঁঙ্গে টঁর্চ, লাঁঠি আঁর এঁয়ারগাঁন রঁয়েছে।
অন্ধকারে দুই বন্ধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। তারপর দেখাই যাক না, কী হয়’—এমন একখানা ভাব করে খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ে।
বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা অনেক বেশি অন্ধকার। একটা দেওয়ালের কাছে সেই অন্ধকার যেন আরো জমাট বেঁধে আছে।
মনে হয় লম্বা কালো কোট পরে বেজায় ঢ্যাঙা কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে। কম করে সে আট-নফিট লম্বা তো হবেই,
মাথা প্রায় সিলিংয়ে গিয়ে ঠেলেছে। সেটার গায়ে দুটো জুলন্ত চোখ আটকানো।
আর যা চোখে পড়ে তা হল দশ-বারো ইঞ্চি মাপের বিরাট বিরাট ধবধবে ক’টা দাঁত।
দাঁত এবং চোখ দেখে দুই বন্ধুর দাঁতকপাটি লেগে যাবার অবস্থা। তাদের গলার ভেতর থেকে ‘আঁক’ করে একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসে।
সেই গলাটা আবার শোনা যায়, ‘কী নাম তোমাদের?’
ম্যালেরিয়া হলে যেমন হয়, ভয়ে তেমনি ঠকঠক করে কঁপিছিল বাজুরা। তারই মধ্যে কোনোরকমে দুজনে নাম বলে।
‘তোঁমরা কোঁথায় থাঁকো?’
বাজু বলে, সেলিমপুরে। বিট্টু বলে, ট্রাঙ্গুলার পার্কের কাছে।’
‘এখানে কোথায় এসেছিলে?’
কোথায় এসেছে, বাজুরা জানায়।
‘ওঁ মাঁমার বাঁড়িতে বেঁড়াতে এঁসেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘রাত দুপুরে এই হানাবাড়িতে ঢুকেছিলে কেন?
‘এই–মানে, মানে—’
বুঁঝতে পেঁরেছি। ভূঁত দেঁখতে এঁসেছ। তোঁমাদের মঁতো সাঁহসী ছেঁলে আঁর দেঁখিনি। আঁলাপ কঁরে ভাঁরী খুঁশি হঁলাম।
কাঁপতে কাঁপতে বাজুরা বলে, “আমরাও।”
সেই গলাটি শোনা যায়, তোমাদের সাহসের জন্যে কিছু উপহার দিচ্ছি। এই নাও।
দুটাে বেজায় লম্বা কালো হাত বাজু আর বিট্টুর দিকে এগিয়ে আসে। সেই হাতে কাজুবাদামের প্যাকেট, বড় চকোলেট বার ইত্যাদি রয়েছে।
বাজুরা নেবে কি নেবে না যখন ভাবছে, সেই সময় গলাটা ফের কানে আসে, ‘নাঁও, নাঁও—
কাঁপতে কাঁপতে বাজু আর বিটু কাজুবাদাম আর চকোলেট তুলে নিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ।
‘থ্যাঁঙ্কস তোঁ আঁমার দেঁবার কঁথা। আঁচ্ছা, এঁবার তোঁমরা বাঁড়ি যাঁও। নঁইলে দাঁদাই দিঁদুন আঁর মাঁসি ভাঁববে।’
পোড়ো বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজুরা আবার সেই ফাঁকা নির্জন মাঠের ওপর দিয়ে ফিরে আসে।
মাসি আর দিদন গেটের কাছের দুটো জোরালো আলো জ্বেলে বসেছিলেন। বাজুদের দেখে দৌড়ে আসেন।
দুজনকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে বলেন, তোদের জন্যে ভেবে ভেবে আমাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। কিছু হয়নি তো তোদের?
বাজু এবং বিটু একসঙ্গে জানায়, কী আবার হবে?
মাসি বলে, ‘ভয়-টয় পাসনি তো?’
ভয় যে যথেষ্টই পেয়েছে তা কি আর বাজুরা স্বীকার করে? তারা বলে, কিসের ভয়? ধুস—’
দারুণ কৌতুহল হচ্ছিল মাসির। সে জিগ্যেস করে, কী দেখলি ওখানে?
দিদন চান না পোড়ো বাড়ির ব্যাপারে আজ কোনো কথা হোক। তিনি মাসিকে বলেন, যা শোনার কাল শুনিস। রাত দেড়টা বাজে।
ওদের ঘুমনো দরকার। আয় বিট্টু, আয় বাজু— দুজনকে তাদের ঘরে নিয়ে যান তিনি।
ওরা যখন হাত-পা ধুয়ে জামা-প্যান্ট পাল্টে শুয়ে পড়েছে আর দিদন ওদের মশারি গুজে দিচ্ছেন সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে দাদাই এসে হাজির।তিনি বলেন, কি বাজুদাদা, বিটুদাদা— মোলাকাত হল?’
দুই বন্ধু বলে, তা হয়েছে। আমরা ভালো ভালো প্রেজেন্টও পেয়েছি। কিন্তু—’
কিন্তু কী?’
‘ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘কোনো খটকা লাগছে?’
‘হুঁ।’
‘কী?’
একটু চিন্তা করে বাজু বলে, ‘কাল বলব।’
‘ওকে। কালই শুনব। গুড নাইট।’
‘গুড নাইট।’
দাদাই দিদন আর মাসিকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
ভোরবেলা, তখনও রোদ ওঠেনি, আকাশটা আবছা মতো, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় বাজুর। রাত্তিরে ভালো করে ঘুমোতে পারেনি সে।
বার বার পোড়ো বাড়ির ঘটনাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। পোড়ো বাড়িতে তারা যা দেখেছে তার মধ্যে কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে।
গোলমালটা কী ধরনের সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
দুই বন্ধু একটা প্রকাণ্ড খাটে পাশাপাশি শুয়েছিল। আস্তে আস্তে বাজু বাঁদিকে কাত হতেই দেখতে পায় বিট্টু মশারির চালের দিকে
অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে আছে। সে ডাকে, এই—
বিট্টু সাড়া দেয়, কী বলছিস?
তক্ষুনি উত্তর দেয় না বাজু! কী যেন ভেবে কিছুক্ষণ বাদে বলে, ‘আচ্ছা, ভূতেরা তো শুনেছি দাঁত-মুখ খিচিয়ে খালি ভয় দেখায়।’
‘হুম।’
কিন্তু কাল রাত্তিরে কী হল? আমাদের সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলল, কাজু-চকোলেট দিল। জানিস, আমার কিরকম যেন মনে হচ্ছে।’
আমারও তাই। রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়নি, খালি এইসব কথা ভেবেছি।
খানিকক্ষণ চুপচাপ। ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে কিছু চিন্তা করে বাজু। তারপর বলে, ‘এক কাজ করি চল—’
বিট্টু বলে, কী রে?
কাউকে না জানিয়ে চুপি চুপি এখন একবার ঐ পোড়ো বাড়িটায় যাই চল। আমার মনে হয় কোনো একটা ক্লু-টু পেয়ে যাব।’
দুই বন্ধু অজস্র ডিটেকটিভ গল্প পড়েছে। তাদের ধারণা, শার্লক হোমস, কিরীটী রায়, ফেলুদার মতো তারাও একেকটি দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা।
পোড়ো বাড়ির ভূতটিকে মেনে নিতে তাদের আটকাচ্ছে। নিশ্চয়ই এর ভেতর কোনো রহস্য আছে।
আমিও তাই ভাবছিলাম। চল, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি। বিটু প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। মামাবাড়িতে এখনও কেউ ওঠেনি।
বিটু আর বাজু নিঃশব্দে গেট খুলে বেরিয়ে পড়ে। পোড়ো বাড়ির দোতলায় সেই ঘরটিতে এসে দেখতে পায়, দেওয়ালের কাছে
যেখানে কাল দুটো জুলন্ত চোখ আর লম্বা লম্বা সাদা দাঁত দেখেছিল সেখানে অনেকগুলো ইট থাকে থাকে সাজিয়ে উঁচু বেদির মতো করা হয়েছে।
তার ওপর কালো কাপড়ের বিরাট এক আলখাল্লা পড়ে আছে। সেটা তুলে ধরতে দেখা যায়, দু’জায়গায় গোল করে কী যেন লাগানো রয়েছে।
আবছা অন্ধকারে সে দুটো যেন জ্বলছে।
বাজু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে, ফসফরাস। কাল রাত্তিরে এই দেখে মনে হয়েছিল ভূতের চোখ। এদিকে বিটু সাদা শোলার তৈরি
দাঁতের পাটি আবিষ্কার করে ফেলে। বলে, এই দ্যাখ, ভূতের দাঁত। কাল এগুলো চোখের নীচে আটকে আমাদের ভয় দেখানো হয়েছিল।’
‘হুঁ।’ বাজু বলে, দ্যাখ তো আর কিছু ক্লু পাওয়া যায় কিনা।’
খোঁজাখুঁজি করতে করতে দু’বন্ধুর চোখে পড়ে ঘরের মেঝের ধুলোতে তাদের জুতোর ছাপ ছাড়াও বড় কেডসের দাগ পড়ে আছে।
দাগগুলোর পাশে বসে দুই বন্ধু অনেকক্ষণ ঝুঁকে দেখতে থাকে। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ভীষণ ব্যস্তভাবে বাজু বলে, ‘তুই এখানে থাক,
আমি দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসছি।’ বলে দৌড়তে দৌড়তে বেরিয়ে যায়।
দশ মিনিটও লাগে না, তার অনেক আগেই একজোড়া কেডস নিয়ে ফিরে আসে বাজু। তারপর পুরোনো দাগগুলোর পাশে কেডস
রেখে চাপ দিতেই নতুন দাগ হয়ে যায়। আগের দাগ আর এই দাগ হুবহু এক। অর্থাৎ বাজু যে কেডস নিয়ে এসেছে সেটা পরে কাল কেউ এখানে এসেছিল।
বাজু দাগগুলো দেখিয়ে বলে, বুঝতে পারছিস তো?
বিট্টু আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। বলে, ‘হু।
‘চল, এবার ফেরা যাক।’
কালো আলখাল্লা, দাঁত, কেডস ইত্যাদি নিয়ে যখন বাজুরা মামাবাড়িতে ফিরে আসে, দাদাই আর দিদন সামনের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন।
মাসিকে অবশ্য দেখা যায় না। সে একেবারে লেট লতিফ, সাড়ে আটটার আগে কোনোদিনই তার ঘুম ভাঙে না।
বাজুদের দেখে অবাক হয়ে যান দাদাই আর দিদন। দাদাই বলেন, এ কী, কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?
বিট্টু বলে, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল, তাই ভাবলাম ঐ পোড়ো বাড়িটায় একবার ঘুরে আসি।
দাদাই চমকে ওঠেন, ‘গিয়েছিলে নাকি?’
‘হ্যাঁ গেলাম। ভাবলাম দেখি যদি কালকের সেই মক্কেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।’
‘কী সর্বনাশ!’
বাজু বলে, দেখা হল না। তবে তার জার্সিটা নিয়ে এসেছি। বলে সেই আলখাল্লাটা এবং দাঁতগুলো তুলে ধরে।
তারপর সেগুলো নামিয়ে রেখে সেই কেডস দুটো দেখিয়ে বলে, ‘পোড়ো বাড়ির ঐ ঘরটায় ধুলের ওপর এগুলোর অনেক ছাপ রয়েছে।
চোখের কোণ দিয়ে দাদাইকে দেখতে দেখতে বলে, তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে এই কেডস দুটো তোমার। এ দুটো পরে তুমি বিকেলে
লেকের দিকে বড়তে যাও না?’
ঢোক গিলেই দাদাই বলেন, ‘হ্যাঁ আমারই তো। কিন্তু—’
‘আমরা কোত্থেকে নিয়ে এলাম, জানতে চাইছ কি?’
‘হ্যাঁ’
ছাপের সঙ্গে মেলাবার জন্যে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বাজু বলতে থাকে, দিস ইজ ব্যাড দাদাই।
আমাদের বিশ্বাস করাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভুত সাজতে হল!’
দিদন হঠাৎ ভীষণ রেগে গিয়ে দাদাইকে বলেন, ‘ছি ছি, এ কী করেছ তুমি! যদি কিছু একটা হয়ে যেত! তোমার কি আক্কেল নেই!’
দাদাই কাচুমাচু মুখে বলেন, “ওদের সাহস কতখানি সেটাই পরখ করছিলাম। ওখানে গিয়ে তো ক্ষতি হয়নি, কাজুবাদাম পেয়েছে, চকোবার পেয়েছে।’
বাজু বলে, ‘ভূত যে আছে, তা কিন্তু প্রমাণ করতে পারনি দাদাই। আমাদের স্রেফ ধাপ্পা দিয়েছ।
দাদাই বলেন, তা হয়তো দিয়েছি। কিন্তু একটা কথার জবাব দাও তো দাদারা—’
‘কী?’
‘কাল জুলন্ত চোখ আর লম্বা লম্বা দাঁত দেখে তোমরা ভয় পাওনি?’
বাজু, বিটু দুজনেই হকচকিয়ে যায়। বলে, মিথ্যে কথা বলব না, সত্যি ভয় পেয়েছিলাম।
দাদাই এবার হেসে হেসে বলেন, ভূত-টুত নেই, আবার আছেও। কোথায় আছে জানো? আমাদের মনের ভেতর। ভয় পেলেই সে
তোমাকে চেপে ধরবে, যেমন কাল ধরেছিল। ভয় না পেলে তোমাদের একশ মাইলের ভেতর সে ঘেঁষবে না।’
(সমাপ্ত)