এক রাতের কাহিনী

এক রাতের কাহিনী

রাত ১২ টার সময় বউ আঙুল দিয়ে বার বার খোচাচ্ছে।

– এই ওঠো। ওঠোনা।
– উম কি হয়েছে, ঘুমোতে দাও তো।
– ইশ, তুমি কি উঠবে? নাকি পানি ঢেলে দিব? আমি চোখ ঢূলু ঢুলু করে উঠে বসলাম।
– এই আমার ওয়াসরুম পেয়েছে। চলো আমাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে চলো।
-গ্রামীণ বাংলায় কোন ওয়াসরুম নেই। আছে শুধু পায়খানা। যাবে ওখানে?
– হুম ওখানেই যাবো।
– থাক এখন যেতে হবে না। ঘুমাও, সকালে যেয়ো।
– ইশ আমার এখনই যেতে হবে। অনেক চাপ।
– কোনটা পেয়েছে? ছোট না বড়?
– দুটোই।
– ধুর বাবা, চলো তো।

ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বউকে নিয়ে রওনা হলাম পায়খানার দিকে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে এখনো ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি । অনেক আগে দরখাস্ত দিয়ে রেখেছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। মনে হয় টাকা খাওয়াতে হবে । কিন্তু বছরে দুই একদিনের জন্য এসে এত কিছু কে করে? মোবাইলের ফ্লাস লাইট অন করে বউকে নিয়ে রওনা হলাম গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী পায়খানার দিকে। পায়খানার টিনের দড়জা খুলে দিতেই বউ হুর হুর করে ঢুকে পরল।

– আরে সাবধানে যাও পরে যাবে কিন্তু। বউ কোন কথা বলছে না। কিছুক্ষন পর,
– এই শুনছ? ফ্লাস লাইটটা দাও তো। ভিতরে অনেক অন্ধকার। আমার খুব ভয় লাগছে।
– কিভাবে দিব? দরজা খোলো।
– দাড়াও একটু। আমি দরজা খুলছি তার আগে তুমি ফ্লাস অফ করো। বউ দরজা সামান্য ফাক করল। আমি ঐ ফাক দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম। মোবাইল। বউকে বললাম ঠিকাছে তুমি তাহলে করো। আমি গিয়ে ঘুমালাম।
– ঠিকাছে যাও। ঘরের দিকে দু পা বাড়াতেই বউ আবার ডাকছে।
– এই শোনো। তুমি কি চলে গেছো?
– না যাইনি, বলো।
– এখানে তো কোনো জেট স্প্রে দেখছি না। পানির ট্যাবও নেই। কিভাবে করব?

এইবার আসল সমস্যা শুরু হল। বদনা না ভরে ঢুকেছো কেন?(রেগে গিয়ে) এটা কি ঢাকার লাক্সারি ওয়াশরুম পেয়েছো? এটা ল্যাট্রিন। এখানে ভেতরে কোনো জল থাকেনা। জল ভরে নিয়ে যেতে হয়। তোমাকে কতবার নিষেধ করেছিলাম আমার সাথে বাড়ীতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি গ্রামে থাকতে পারবে না। তবুও আসলে কেন আমার সাথে ?

– তুমি কি এখন আমার সাথে ঝগড়া করবে? নাকি বদনা ভরে দিবে?
– টয়লেটে বদনা নেই
– হ্যা আছে কিন্তু তাতে এক ফোটাও পানি নেই।
– আমি এখন কি করতে পারি?
– স্টুপিড বদনা ভরে দাও।

নিজেকে শান্ত করে বললাম, ঠিক আছে, দরজার ফাক করে বদনাটা বের করে দাও ভরে দিচ্ছি। বদনা নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে চলে গেলাম। টিউবওয়েলে চাপ দিতেই হ্যান্ডেল নেমে গেল। টিউবওয়েল লিক হয়ে গেছে। সারারাত চাপলেও পানি বেড় হবে না। অন্তত এক বালতি পানি ঢাললে টিউবওয়েল ঠিক হবে। কিন্তু ওতো পানি তো নেই। এখন কি করি? বউকে আস্তে করে ডাক দিলাম।

– আরিয়াত শুনছ, একটা সমস্যা হয়েছে। বউ টয়লেটের ভেতর থেকে দাত কিড়মিড় করে জবাব দিল,
– আমার নাম আরিয়াত না, আইরাত। তাড়াতাড়ি বদনা ভরে দাও নইলে খবর আছে কিন্তু ।
– কিভাবে ভরব? চাপকলে পানি নেই। লিক হয়ে গেছে।
– আমি জানিনা কিভাবে ভরবে। ওমাগো এত মশা কেন ভেতরে? অয়ন আমাকে বাচাও প্লিজ।
– আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে, তুমি বসে থাকো। আমি দেখছি। আমি বদনা ভড়ে আনছি । তুমি রেষ্ট করো।

আমাদের বাড়ির পাশেই মজিদ চাচার বাড়ি। বেচারা এককালে উকিল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধও করেছেন। রাতের ১২ টার সময় তার বাড়িতে বদনা ভড়তে চলে গেলাম। টিউবওয়েলে চাপ দিতেই ক্যার ক্যার আওয়াজ করতে শুরু করল । প্রকট আওয়াজে মজিদ চাচার ঘুম ভেঙে গেল।মজিদ চাচা ঘরের ভিতর থেকে জিজ্ঞস করল,

– কল পারে কেডা?
– চাচা আমি অয়ন।
– এত রাতে কলপারে কি করো বাবা?
– চাচা পানি নিতে এসছি।
– তোমাগো টিউবওয়েল আবার খারাপ হইয়া গেছে?
– জ্বি চাচা।
– এত রাতে পানি দিয়ে কি করবা বাবা?
– চাচা, আপনার বউমা টয়…
– চাচা আমি নিজেই একটু টয়লেটে যাবো তো এজন্য পানি নিতে আসছি।
– আমাগো টয়লেটে কইরা যাও সমস্যা নাই।
– না চাচা আমি বাড়িতে গিয়েই করব।

টিউবওয়েল এত শক্ত যে, চাপ দিতে গিয়ে হ্যান্ডেল ফসকে গিয়ে নাকে এসে লাগল। নাক দিয়ে ঝর ঝর করে রক্ত পরতে লাগল। এরই মধ্যে চাচা আবার জিজ্ঞেস করল।

– বাবা সমস্যা নাই আমাগো টয়লেটে কইরা যাও। ব্যাথার চোটে চাচাকে উল্টা পাল্টা বকা শুরু করে দিলাম,
– এই মিয়া!! আপনি কথা বুঝেন না? বলতেছি বাসায় গিয়ে করব। তারপরও বার বার বলেন এখানে করো, এখানে করো । আমার পাছায় কি সোনা দানা আছে যে এখানে করে রেখে যাবো?
ফালতু লোক কোথাকার।

– এই পুলা তোমার সাহস তো কম না। তুমি উকিল মজিদরে ফালতু লোক কও, বলতে বলতে চাচা বাইরে বেড়িয়ে এলো।
– ফালতু বলব না কি করব? এক বদনা পানির জন্য এত প্রশ্ন কিসের?
– এই পুলা, রাইত বারোটার সময় তুমি বদনা ভড়তে আইবা আরেকজনের বাড়ি। টিউবওয়েল চাইপা সবার ঘুম হারাম করবা, আর তোমারে কেউ জিগাইলেই দোষ?
– আপনি আসলেই একটা ফালতু লোক। বেশি কথা বলেন।
– এই পুলা একটা থাপ্পড় দিয়া দাত ফালায়া দিমু।
– দেন থাপ্পড় দেখি আপনার কত বড় সাহস? আপনের বাপের কামাই খাই না। আমার বাপের কি কম আছে?
আশপাশের বাড়ি থেকে লোক জন জরো হতে লাগল। সবাই টর্চ লাইট হাতে নিয়ে এমন ভাবে ধেয়ে আসতে লাগল মনে হচ্ছে চোর ধরা পড়েছে।

– একজন আমার মুখের উপর টর্চ ধরতেই আবিষ্কার করল আমার নাক দিয়ে রক্ত বেড় হচ্ছে। দূর থেকে কে যেন চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিল, এই মজিদের বাড়ি মারামারি লাগছে, সবাই ওঠো রে ওঠো। রাত তিনটা পর্যন্ত এই নিয়ে ঝগড়া ঝাটি। ভোর রাতেই গ্রামের মধ্যে শালিশ বসল। সব মুরুব্বিরা এসে মজিদের বাড়ি জরো হল। বাড়ির মহিলারা আমাকে সাপোর্ট করছে। কিন্তু মুরুব্বিরা মজিদের দিকে টানছে । কে জানে এর মধ্যে ঘুসও দিয়ে ফেলেছে নাকি? উকিলদের স্বভাব খারাপ। ঘুস নেওয়া এবং দেওয়া ওদের কাছে পান খেয়ে পিক ফেলার মত সহজ কাজ। মেম্বার চাচা আমায় পশ্ন করল,

-অয়ন বাবা, ঘটনা কি হইছে একদম শুরু থেকে বলো। আমি বলতে শুরু করলাম,

– চাচা একেবারে সাধারন বিষয়, রাত বারোটার সময় আপনাদের বউমা বলল টয়লেটে যাবো। তাকে টয়লেটে বসিয়ে রেখে আমি এই বাড়িতে আসলাম বদনা ভরতে। কলের শব্দে মজিদ চাচার ঘুম ভেঙে গেল। তার পর মজিদ চাচা নানান প্রশ্ন করতে লাগল, তার সাথে কথা বলতে চাপ কলের হ্যান্ডের এসে নাকে লাগল আর তারপর থেকেই এই কথা না শেই কথা দিয়ে বিবাদ শুরু হল । আমার কথা শুনে মুরুব্বিরা সবাই হো হো করে হাসতে লাগল। চাচীরা সবাই আহারে আহারে করে আমাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। আমি বললাম,

– দাড়ান চাচী। বদনাটা ভরে নেই।
– মজিদ চাচা সহ সবাই খিল খিল করে হাসতে লাগল। (সাথে আমিও)

বদনা ভরে বাড়িতে চলে গেলাম। আমার সাথে কয়েকজন চাচীও আসলো। একজন চাচী টয়লেটের সামনে গিয়ে আইরাতকে ডাক দিলো,

– ও বউমা। বদনা নেও।
– বউ কোনো কথা বলছে না। চাচী আবার ডাক দিলো,
– ও বউমা?

আহারে কখন মনে হয় গেছে। আমি তখন ঘড়ি দেখলাম। পাচ ঘন্টা হয়ে গেছে আইরাত টয়লেটের ভেতরে। ভাবতেই চোখ কপালে উঠে গেল আমার। চাচীকে বললাম চাচী দেখেন তো, দরজা লক করা আছে কিনা?

– না- বাবা। দরজা খোলা আছে।
– ভিতরে ঢুকে দেখেন, কি অবস্থা।

চাচী ভিতরে ঢুকে টর্চ লাইট মেরে দেখে বউ আমার নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। বেলা দশটার সময় বউ এর ঘুম ভাঙল। বউ এর হাতে একটা গরম চা ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

– সত্যি করে বলোতো তুমি আমার সাথে কেন এসেছো? তুমিতো এর আগে কখনো আমার সাথে বাড়িতে আসতে চাইতে না। এবার কেন এলে?
– তুমি আগে প্রমিজ করো। রাগ করবেনা এবং আমাকে কিছু বলবেওনা।
– আচ্ছা প্রমিজ।
– তুমি সেদিন বললেনা, তুমি জীবনে একটা মেয়ের সাথেই প্রেম করেছো, আর সে তোমার গ্রামেই থাকে। আমি ভেবেছিলাম তুমি ওই মেয়ের সাথে দেখা করার গ্রামে যাবে। এজন্য তোমার সাথে এসেছি।
– কিছুক্ষন বউয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। (বিধি) বউও আমার দিকে কিছুক্ষন ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল,

– আচ্ছে গতরাতে কি হয়েছিল?
– মানে!! তোমার কিছু মনে নেই?
– না, শুধু টয়লেটে গিয়েছিলাম এটা মনে আছে। বাকিটা কি?
– বাকিটা ইতিহাস। ঢাকা গিয়ে বলব।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত