মহিলা দাঁড়িয়ে থাকতেন এখানে ওখানে
***
সুব্রত ভট্টাচার্য
আমাদের বাড়ি ছিল শ্যামনগরে। সেই সময় শ্যামনগর গ্রাম। প্রায়ই দেখতাম একজন মহিলাকে ভূতে ধরত। মহিলা অদ্ভুত গলায় শব্দ করে কথা বলত। সেই গলা তার নয়, অন্য কারও। নিম গাছতলায় ওঝা এসে মন্ত্র পড়ে কত কী করত। তার পরই মহিলার গলা স্বাভাবিক হয়ে যেত। শ্যামনগরে প্রায়ই উদ্ভট সব ঘটনা ঘটত। রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ হঠাৎ রাতের আবছা অন্ধকারে দেখতাম কে যেন রেললাইন দিয়ে হেঁটে আসছে। উলটো দিক থেকে প্রবল গতিতে ট্রেন আসছে। “ও মশাই থামুন থামুন থামুন”, বলে ছুটে গেলে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে যেত। শ্যামনগরের লোকজন এমন দৃশ্য রেললাইনে প্রায়ই দেখতেন। মা বলতেন,‘ওদের ধারে কাছে যাস না। ওরা অতৃপ্ত আত্মা।’’
৭৬ সালে সন্তোষ ট্রফি খেলার সময় একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। সেখানকার রাজবাড়িতে উঠেছিলাম। দিন নেই, রাত নেই একটা দৃশ্য চোখে পড়ত। মাথায় ঘোমটা দেওয়া, শাড়ি পরা এক মহিলা রাজবাড়ির আনাচে কানাচে রহস্যময় ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে তো মহিলা থাকার কোনও কথা নয়। একটা পরিত্যক্ত রাজবাড়ি। কাছে গিয়ে ডাকার চেষ্টা করলে মহিলা মিলিয়ে যেতেন। নির্জন জায়গা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে মহিলা এসে রাস্তা আটকে দাঁড়াবেনই। পরে জেনেছিলাম কোনও এক রানিকে তার ব্যভিচারের জন্য রাজবাড়িতেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তারই অশরীরী রূপ হাহাকার করে রাজবাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াত।
মামাবাড়িতে ভূত ছিল
***
অনীক দত্ত
আমি ভূতে বিশ্বাস করি না কিন্তু ভয় অবশ্যই পাই। ছোটবেলায় তো একা ঘরে থাকলে গা ছমছম অবশ্যই করত। আজকাল অবশ্য সে রকম কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি এবং না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।
তবে ব্যারাকপুরে মামাবাড়িতে অবশ্যই ভূত ছিল। বহু লোক ওখানে সাহেব-ভূত দেখেছে।
অন্য দিকে মুম্বইয়ের বান্দ্রার মাউন্ট মেরি রোডে আমার মায়ের কাকা, পরিচালক বিমল রায়ের বাড়ি। ওটা আসলে ছিল একটি পারসি বাংলো।
ওই বাড়িটাকে তো অনায়াসে ‘ভূত-বাংলো’ বলা যায়। ওখানে রোজই ভূত আসত। প্ল্যানচেট হত। আমি সেই রকম একটা প্ল্যানচেটের সাক্ষীও ছিলাম। আমার দাদুরা ছয় ভাই। সেই সময় তিন জন বেঁচে ছিলেন, বাকিরা মারা গিয়েছিলেন। যে তিন বোন বেঁচেছিলেন তাঁরা প্ল্যানচেটে তাঁদের মৃত ভাইদের ডাকেন, যার মধ্যে প্রয়াত বিমল রায়ও ছিলেন। আজও মনে আছে বেশ একটা রি-ইউনিয়ন হয়েছিল।
দিক হারিয়ে দৌড়তে লাগলাম
***
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়
ফেলুদা সিরিজের ‘গোঁসাইপুর সরগরম’-এর শ্যুটিং করতে গিয়েছিলাম একটা রাজবাড়িতে। রাজবাড়িটা এত বড় যে দু’টো সল্টলেক স্টেডিয়াম ঢুকে যাবে। সেই বিশালত্বের মধ্যে খাঁ খাঁ করছে নির্জনতা। জনশূন্য বাড়িটার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আর এক প্রান্তের দিকে তাকালে গা ছমছম করত দিনদুপুরে। রাজবাড়ির সিঁড়িগুলো নেমে গিয়েছে চোরকুঠুরির দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ দেওয়াল উঠে গেছে। দেওয়ালে কান পাতলে কাদের যেন কান্না শোনা যায়! সেই সময় রবিকাকু (রবি ঘোষ) জটায়ু করতেন। উনি আমাদের পইপই করে মানা করতেন এ দিক সে দিক যেতে। রাজবাড়ির জানলাগুলো খড়খড়ি ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করতাম ভেতরে।
আমরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এক রাত্রে শ্যুটিং ছিল রাজবাড়িতে। যেখানে শু্যটিং হচ্ছে শুধু সেখানে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। বাদবাকি রাজবাড়িটা অন্ধকারে ডুবে। বিরাট করিডরের মধ্যে চাপ চাপ অন্ধকার। কে যেন আমাকে ওই অন্ধকারের দিকেই টানতে লাগল। সবাই শ্যুটিংয়ে ব্যস্ত। আর আমি একা অন্ধকারের মধ্যে নিশির ডাকের মতো হাঁটতে শুরু করলাম। গরম কাল। লোকজন তখন দরদরিয়ে ঘামছে শ্যুটিংয়ের ঘরে। কিন্তু অন্ধকার করিডরে যেই ঢুকলাম, একটা ঠান্ডা বাতাস যেন আমাকে জড়িয়ে ধরল। কী রকম স্যাঁতস্যাঁতে একটা ঠান্ডা। আমি হাঁটছি আর মনে হল, পেছনে পেছনে কেউ যেন আসছে। কিন্তু একবারও ঘুরে দেখার সাহস পাচ্ছি না। হাঁটতে হাঁটতে কত দূর চলে গিয়েছিলাম জানি না। কোথাও এতটুকু আলো নেই। মনে হচ্ছিল আমার চার পাশে কারা সব হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে ঘুঙুরের শব্দ আসছে। দিক হারিয়ে ফেলে দৌড়তে শুরু করলাম।
মনে হচ্ছিল হাজার হাজার ঘণ্টা ধরে দৌড়চ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল শ্যুটিংয়ের ঘরটা। আলো জ্বলছে। ধড়ে প্রাণ এল।
কে যেন আমার গলাটা চেপে ধরল
***
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত
অনেক দিন আগে দার্জিলিং গিয়েছিলাম শ্যুটিং-এ।
তখন মাঝরাত হবে বোধ হয়। ঘর অন্ধকার। আমার স্যুইটে আমি ছাড়া পাশের ঘরে আমার হেয়ার ড্রেসার।
হঠাৎ মনে হল কে যেন আমার বুকের ওপর চেপে বসছে। দম আটকে আসছিল। চেঁচাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনও শব্দ বেরোল না। দু’হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চাইছি ভারটা, কিন্তু আমার হাত উঠছে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এ ভাবে কত ক্ষণ চলেছিল খেয়াল নেই। হঠাৎই গলা থেকে ভারটা সরে গেল। তত ক্ষণে আমি ভয়ে কাঠ। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ওই শীতেও কুলকুল করে ঘাম দিচ্ছে। পর দিন থেকে আমার ধুমজ্বর। আমার হেয়ার ড্রেসারকে ঘটনাটা বলতে সে পাত্তাই দিল না। বলল, “ধুস্, স্বপ্ন দেখেছ।” আমি শুধু ওকে বললাম, “সে যাই-ই হোক, তুমি আজ রাতে এ ঘরেই শোবে। ঘরের আলো জ্বালা থাকবে।”
রাতে ঘুম আসছিল না কিছুতেই। বহু ক্ষণ বাদে চোখের পাতাটা একটু বোধহয় লেগেছে, তখনই হঠাৎ আমার হেয়ার ড্রেসারের ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। “কী হয়েছে?” ওর মুখটা ফ্যাকাশে। আতঙ্ক ঠেলে বেরোচ্ছে চোখ দিয়ে। কোনও ক্রমে বলল, “আজ আমাকেও …।” আমার তখন আর কথা বলার শক্তি নেই। গোটা ঘরটা যেন গিলে খেতে আসছে। কোনও ক্রমে রাত কাটল।
আমার শরীর এত খারাপ হয়ে গেল, চারদিন শ্যুটিংই ক্যানসেল করতে হল। ডাক্তার এলেন। জানা গেল নিউমোনিয়া হয়ে গিয়েছে।
পরে শুনেছিলাম ওই ঘরে কেউ নাকি আত্মহত্যা করেছিল। এবং মাঝেমাঝেই তার উপদ্রব সইতে হত ট্যুরিস্টদের।
এখন আর সেই হোটেলটা নেই।
( ১৪২০তে আনন্দবাজারে প্রকাশিত শনিবারের নিবন্ধ “ওরা আসে” থেকে নেওয়া)