এই অভিজ্ঞতাটি হয় ইংল্যাণ্ডের সম্রান্ত পরিবারের বিবাহিত এক নারীর। উনিশ শতকের শেষদিকে ঘটনা এটা। ঘটনাটি ঘটার বেশ কয়েক বছর পরে এটা বর্ণনা করেন তিনি। তবে জানান এটা এতটাই দাগ কেটেছে মনে যে এক বিন্দু মলিন হয়নি এর স্মৃতি। তার সবসময়ই মনে হয়েছে কেবল গত রাতেই এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটি হয়েছে। ভদ্রমহিলার ভীতিকর এই অভিজ্ঞতা শুনব আমরা তার মুখ থেকেই।
একবার আমার এক বান্ধবীর বাড়ি গেলাম বেড়াতে। পুরানো ধাচের একটা বাড়িতে থাকে তারা। আলো-বাতাস ঢুকতে পারে
এমন বিশাল সব হল আর করিডোর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর সবখানে। কী একটা অনুষ্ঠান ছিল। ইতিমধ্যে তাই অতিথিতে ভরে গেছে বাড়িটা। তাই আমার জন্য বরাদ্দ হলো এক তলার বিশাল একটা কামরা। লম্বা, টানা বারান্দার শেষে ওটা। কামরাটা বেশ আরামদায়ক। বিশাল আর উষ্ণ। তবে কেন যেন পরিবেশটা ভাল লাগল না। সত্যি কথা বলতে গোটা বাড়িটাই আমার মধ্যে ভয়ের একটা অনুভূতির জন্ম দিল। কী কারণে তা বলতে পারব না।
খুব তাড়াতাড়ি যেন শোবার সময় হয়ে গেল। বান্ধবী মোমবাতিসহ আমার যা যা দরকার সব ঠিকমত আছে দেখে শুভরাত্রি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় উঠে গেল।
পোশাক কেবল অর্ধেক বদলেছি এমন সময় দেখলাম কামরার দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। যেন একটা হাত চুপিসারে সতর্কভাবে চাপ দিচ্ছে এতে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখের সামনে পুরোপুরি মেলে গেল দরজাটা, কিন্তু ওপাশে কেউ নেই। স্বস্তির একট নিঃশ্বাস ফেললাম। নিশ্চয়ই দমকা হাওয়া। হলওয়ে দিয়ে নেমে এসেছে। ভাবলাম আমি। ঘাবড়ে যাওয়ার জন্য মনে মনে নিজেকে আচ্ছাসে শাসন করলাম। আবার দরজা লাগিয়ে কাপড় ছাড়তে শুরু করলাম।
বেশিদূর এগুতে পারলাম না, তার আগেই আমাকে চমকে দিয়ে আবার খুলে গেল দরজাটা। আগেরবারের মতই ধীর ও শান্তভাবে। আবার দোর লাগিয়ে পোশাক ছাড়তে লাগলাম। এবার কাজটা শেষ করে রাত্রিবাসটা গায়ে চাপাতে পারলাম। আর এসময়ই আতংকিত হয়ে আবিষ্কার করলাম তৃতীয়বারের মত খুলতে শুরু করেছে দরজাটা। আগের মতই নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে। একসময় পুরোপুরি খুলে গেল। একটু একটু ভয় লাগলেও ঘটনাটা তদন্ত করে দেখা স্থির করলাম। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে হল-এ বের হয়ে এলাম। তারপর সদর দরজার দিকে রওয়ানা হলাম। বড়জোর তিন কি চার কদম এগিয়েছি এমন সময় আমার হাতের মোমবাতিটা নিভে গেল। মনে হলো যেন হঠাৎ কোনখান থেকে একটা দমকা বাতাস ছুটে এসেছে ওটাকে নিভিয়ে দেওয়ার জন্যই। খুব একটা খুশি হতে পারলাম না। কারণ ম্যাচ রেখে এসেছি আমার কামরায়। কিন্তু রোখ চেপে গেছে আমার। অন্ধকারেই এটার একটা শেষ দেখার প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। কাজেই অন্ধকার পথ ধরে এগুতেই লাগলাম। বাম হাতে ধরা নেভা মোমবাতি, আর ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছি পাথরের দেয়ালের স্পর্শ পাওয়ার জন্য।
মোটামুটি অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছি এমন সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড হলো। মনে হলো যেন শীতল, ভেজা একটা কিছু আমার বাম গালে চড় কষেছে। হাত দিয়ে গাল স্পর্শ করতেই ভেজা ভেজা ঠেকল। একমুহূর্তের জন্য দোটানায় পড়লাম। তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। একসময় সদর দরজার সামনে চলে এলাম। ওটা বন্ধ এবং তালা আটকানো। তারপর অন্ধকারে পুরো হলটা ঘুরে কিছু পেলাম না। ফিরে চললাম আমার কামরার দিকে। এখনো আগের মতই এক হাতে মোমবাতি, এবং আরেক হাত বাড়িয়ে দেয়ালের স্পর্শ পাচ্ছি। হলের মোটামুটি অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছি এমন সময় আবার মুখে সেই শীতল, ভেজা হাতের চড় খেলাম। এবার চড়টা পড়ল ডান গালে। গাল স্পর্শ করতেই আগের মতই দেখলাম ওটা ভেজা।
আতংক পেয়ে বসল আমাকে। অন্ধকারে যত দ্রুত সম্ভব পা চালালাম নিজের কামরাটার দিকে। পৌঁছেই দরজা আটকে ওটার সামনে একটা চেয়ার রাখলাম বাড়তি নিরাপত্তা হিসাবে। এবার হাতড়ে হাতড়ে ম্যাচ বাক্সটা খুঁজে নিলাম। তারপর মোমবাতি জ্বেলে আয়নার দিকে তাকালাম, মুখের কী অবস্থা দেখার জন্য।
আয়নায় যা দেখলাম তা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমার দু-গালে রক্তের দুটো লম্বা রেখা। ভয়ে, আতংকে কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। পরের ঘটনা পরিষ্কার মনে নেই। শুধু আবছাভাবে মনে আছে আমার চারপাশ ঘিরে আছে উদ্বিগ্ন কিছু চেহারা আর ফিসফাস শব্দ। তারপরই জ্ঞান হারালাম।
এই রাতের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল আমার।
(সমাপ্ত)