হানাবাড়ি

হানাবাড়ি

মধুপুরের জঙ্গলে ক্যাম্পিঙ করতে এসেছে ওরা ক’জন৷ ফয়সাল, রাকিব, জাহিদ, বিল্টু সহ আরও কয়েকজন৷

ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের ক্লাস লাইনের ছাত্র সবাই৷ প্ল্যনটা ফয়সালের। ও ই প্রস্তাবটা দিয়েছে ‘অরণ্য অভিযান’ এর।

এখানে একটা রেস্ট হাউস আছে। ফয়সালের প্রভাবশালী মেজর চাচাকে ভজিয়ে রেস্ট হাউসে উঠতে তেমন কষ্ট করতে হয়নি ওদের ৷

আবদুল মােতালেব নামের এক লোক পাহারা দেয় ঘরটা। সে এটার দারোয়ান কাম বাবুর্চি ৷

মােতালেবের সাথে ফয়সালের পরিচয় অনেক আগে। এখানে বছর দুই আগে একবার ছোট চাচার সাথে বেড়াতে এসেছিল ফয়সাল।

প্রথম দিনেই রােমহর্ষক গল্পটা তাকে শুনিয়ে দেয় মােতালেব ৷ নিষেধ করে জঙ্গলের পশ্চিম দিকে যেতে ।

ওদিকে নাকি প্রায় একশো বছরের পুরানো একটা বাড়ি আছে । স্থানীয় লোকজন নাম দিয়েছে হানাবাড়ি ৷

ভূতের ভয়ে কেউ ধারেকাছেও ঘেষে না পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িটার ৷ শোনা যায়, ওই বাড়ির মালিক ছিলেন পড়ন্ত জমিদার বীরেন্দ্র নারায়ণ ।

নিজের কোন সন্তান ছিল না তাদের। তবে মা বাপ হারা একমাত্র ভাগ্নে অমরনাথকে তিনি সন্তানের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন ।

অমরনকুথের বয়স যখন পনেরো, সে সময় হঠাৎ এক রাতে অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে মারা যান বীরেন্দ্র চৌধুরী ৷

নরক নেমে আসে অমরনাথের কপালে ৷ কারণ তার মামী অমরনাথকে দু চোখে দেখতে পারত না।

জমিদারের মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর বখে যাওয়া দুই শ্যালক স্বর্গবাসী জামাই বাবুর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি

হাপিশ করার লোভে খুলনা থেকে চলে আসে ঢাকায় এবং গেটঁ হয়ে বসে জমিদার বাড়িতে।

মামী এবং তার ভাইয়েরা মিলে এবার নিদারুণ অত্যাচার চালাতে শুরু করে অমরনাথের উপরে যাতে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় ৷

অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় অমরনাথ। তবে তার আগে একটি ভয়াবহ কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে সে।

ধারণা করা হয়, তীব্র অবহেলা অপমান এবং শারীরিক নির্যাতন অমরনাথের বুকের ভিতর জাগিয়ে তোলে ভয়ঙ্কর প্ৰতিহিংসা।

আর তারই প্রতিফলন ছিল তার দুই অত্যাচারী মামা এবং মামীর নৃশংস মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে ধারাল কুড়ােলের আঘাতে

দুই মামাকে জবাই করার পরে মামীকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে অমরনাথ ৷ তারপর দেয়ালে রক্ত দিয়ে লিখে রেখে যায়,

‘এই বাড়িতে কারও অনুপ্রবেশ সহ্য করা হবে না।

তারপর অমরনাথ কোথায় চলে গেছে তার হদিশ কেউ পায়নি। কিন্তু পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে বাস করার সাহসও কারও হয়নি।

ওটা এখন রাজ্যের চামচিকে, ছুঁচো আর মাকড়সাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ৷

বহু কালের অব্যবহৃত দরজা জানালাগুলো সাংঘাতিক নড়বড়ে, সামান্য বাতাস বইলেই মাকড়সার জালে

বোঝাই কড়ি বরগা থেকে ভীতিকর সব আওয়াজ বেরুতে থাকে।

অনেকেই নাকি রাতের বেলা মনুষ্য কণ্ঠের বুক হিম করা আর্তচিৎকার শুনেছে বাড়িটার ভিতর থেকে।

অপঘাতে মরা লােকগুলাের অতৃপ্ত আত্মা বাড়িটাকে পাহারা দিয়ে রাখে, এই ভয়ে-আশ পাশের কেউ ভুলেও ওদিকে পা বাড়ার না।

এটা এখন সরকারী সম্পত্তি ৷ তবে ভুমি জরিপকারী কোন সরকারী অফিসারকে কস্মিনকালেও ধারে কাছে ঘেঁষতে দেখেনি গ্রামের লোকজন।
সেবার মােতালেব মিয়ার মুখে গল্পটা শুনে যতটা না ভয় পেয়েছিল ফয়সাল, তারচে’ অনেক বেশি আগ্রহ জেগেছে হানাবাড়িটাকে কাছে থেকে দেখতে ৷

কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে হঠাৎ কী একটা জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় ছোট চাচা তড়িঘড়ি করে ঢাকা ফিরে এলে ফয়সালকে

হানাবাড়ির রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা থেকে বাধ্য হয়ে নিবৃত্ত থাকতে হয়। এবার অবশ্য ফয়সাল মধুপুরে এসেছে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ।

বে সে কথা একটু পরে বলছি।

ফয়সালের প্রাণের বন্ধু রাকিব আর জানের শত্রু হলো বিল্টু। বিল্টু ক্লাসের ফার্স্ট বয় ৷

বিল্টু ওদের ক্লাসে ভর্তি হবার আগে এক নম্বর রােলটা ফয়সালেরই ছিল।

কিন্তু বিল্টু এসে প্রমাণ করে দিল তার কাছে ফয়সাল কিছু না। মফস্বলের একটা ছেলে হঠাৎ তাকে এভাবে ল্যাং মাববে, কল্পনাও করেনি ফয়সাল ।

শুধু পড়াশোনা কেন, তারমত ভাল ফুটবল খেলতে পারে না স্কুলের কেউ ৷ ফলে অল্পদিনেই টীচারদের প্রিয় পাত্র হয়ে যায় বাদল রায় ওরফে বিল্টু ৷

ওদিকে ‘স্মার্ট’ ছেলে বলে খ্যাত ফয়সাল আহমেদের জনপ্রিয়তা হু হু করে নেমে গেছে। বিল্টুকে ‘বিট’ করার নানা ধান্ধা করেছে ফয়সাল ৷

কিন্তু প্ৰতিবারই আশ্চর্য উপায়ে যে সব ষড়যন্ত্র আগে থেকে টের পেয়ে সাবধান হয়ে গেছে বিল্টু।

ফলে ওকে ফাঁসানাের সমস্ত চেষ্টাই বিফল হয়েছে ফয়সালের। শেষে মরিয়া হয়ে শেষ চালটা চেলেছে ফয়সাল।

বিল্টুকে প্রস্তাব দিয়েছে, ‘চলো, মধুপুর থেকে ঘুরে আসি ৷ ওখানে একটা হানাবাড়ি আছে। সাহস থাকলে একটা রাত বাড়িটাতে কাটিয়ে এসো।’
ফয়সালের চ্যালেঞ্জ হাসি মুখে গ্রহণ করেছে বিল্টু। ভুত টুতের ভয় তার একদম নেই। সে মধুপুরে যেতে রাজি হয়েছে জঙ্গল অ্যাডভেঞ্চারের লোভে ৷

বিল্টু জানে, ফয়সাল তাকে পছন্দ করে না । বন্ধুত্বটা সের্ফ লোক দেখানো ৷ তবে বিল্টুর আচরনে আজ পর্যন্ত এমন

কিছু প্রকাশ পায়নি যাতে সহপাঠীদের মনে কোনরকম সন্দেহের উদ্রেক হয়।

ফয়সালের সাথে সব সময় হাসিমুখেই কথা বলে বিন্টু ৷ সেধে স্কুলের সামনে হোসেন চাচার রেস্টুরেন্টের গরম সিঙ্গাড়াও খাওয়ায়।

দু’জনের কৃত্রিম সখ্যতা দেখে বোঝার উপায় নেই এদের মধ্যে একজন আরেকজনের রক্ত পান করার তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে আছে।

ফয়সাল কী উদ্দেশে তাকে মধুপুরের জঙ্গলে নিয়ে যেতে চাইছে বিল্টুর তা অজানা নেই। হানাবাড়ির গল্প তাকে ফয়সাল একাধিকবার শুনিয়েছে ।

তবে ফয়সাল একটু বেশি চালাক বলে বিল্টুর রহস্যময় হাসির মানে বুঝতে পারেনি ।

যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেত ওকে নিয়ে বিল্টুও এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করছে, মধুপুর দূরে থাক, বাড়ি থেকেই সে বের হবার সাহস পেত না ।
ঢাকা থেকে মধুপুর খুব বেশি দূরে নয়। ভাড়া করা মাইক্রোবােসে চড়ে দুপুর নাগাদ ছেলেদের দলটা পৌছে গেল গন্তব্যে।

ওরা দু’দিন থাকবে এখানে। শুক্র শনি স্কুল বন্ধ ৷ রোববার সকালেই আবার ঢাকা ফিরে আসবে ৷
শুক্রবার রাতে দলের ছেলেদের কাছে গল্পটা বলল ফয়সাল। এটাও জানাল পরদিন রাতাটাও ওই ভুতুড়ে বাড়িতে কাটানাের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে বিল্টু।

শুনে আমতা আমতা করে উঠল সুমন ৷ ভূতের ভয় ওর সাংঘাতিক। চোখ বড় বড় করে বলল,

‘খবরদার ও কাজ ভুলেও করতে যেয়ো না, বিল্টু ৷ নির্ঘাত জানে মারা পড়বে ।’

বলে গড়গড় করে সনি চ্যানেলে কয়েকদিন আগে দেখা হরর সিরিজ ‘আহাট্’ এর একটা গল্প বলে ফেলল সে।

ওই ছবিতেও এক বন্ধু রাজি ধরে এক হানাবাড়িতে রাত কাটাতে গিয়েছিল। পরে বুকে ছুরি বিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে ।

হানাবাড়ির পিশাচরা মেরে ফেলেছে ওকে।
গল্পটা শুনে ওকে তেড়ে প্রায় মারতে এল জাহিদ ৷ “আরে যা! যা! তুই শালা আছিস শুধু হরর ছবি নিয়ে ।

ওসব ভূত প্রেত শুধু ফিল্ম আর টিভিতেই দেখা যায়। হরর ছবি দেখে আর ভুতের গল্প পড়ে তোর মাথাটাই গেছে ।

বিল্টু! ঘাবড়াসনে, দোস্ত ৷ দরকার হলে আমি তোর সাথে যাব একরাত কাটিয়ে আসব হানাবাড়িতে ৷’
বাধা দিল ফয়সাল ৷ ‘তার আর দরকার হবে না। আমি নিজে বিল্টুকে ও বাড়িতে নিয়ে যাব ৷ ওকে ওখানে রেখে আবার চলে আসব।’
মৃদু হাসল বিল্টু। ‘রাতের আঁধারে একা ফিরতে পারবে তো ক্যাম্পে ? ভয় করবে না ?’
চটে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল ফয়সাল ৷ তীব্র ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল ওর কণ্ঠে। ‘কে ভয় পায় তা যথাসময়েই প্রমাণ হবে।

দরকার হলে আমি থাকব তোমার সাথে ও বাড়িতে।’
কোন মন্তব্য করল না বিল্টু ৷ ঠোঁটে সেই পিত্তি জ্বালানাে রহস্যময় হাসিটা ফুটেই থাকল ।

পরদিন রাত দশটায় বিল্টুকে নিয়ে হানাবাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো ফয়সাল ৷

সঙ্গে আছে টর্চ, মোমবাতি আর রাতে খিদে পেলে কিছু শুকনো স্ন্যাকস।

সুমন ওদের পইপই করে নিষেধ করল যেতে। কিন্তু মানা শুনল না বিল্টু। ফয়সাল ওর পথ প্রদর্শক।

হাতে টর্চ নিয়ে হন হন করে এগােচ্ছে ফয়সাল মসৃণ আল ধরে, পেছনে ওকে অনুসরণ করছে বিল্টু।

কাঁধে একটা হ্যাভারস্যাক ঝুলিয়ে। অদ্ভুত, সরু চোখে তাকিয়ে আছে সে ফয়সালের দিকে।
বিল্টুকে হানাবাড়িতে পৌছে দিয়ে ফেরার কথা থাকলেও ফিরল না ফয়সাল । চিন্তায় পড়ে গেল রাকিব। ওকে সান্ত্বনা দিল জাহিদ।
‘ভয়ের কিছু নেই। ফয়সালের হয়তো একা ফিরতে ভয় লাগছিল তাই বিল্টুর সাথে থেকে গেছে।

যদি বলত, চলো, আমরাও গিয়ে পাত্তি লাগাই ৷’
এত রাতে জঙ্গল ঠেঙিয়ে ভূতুড়ে বাড়িটাতে যাবার কথা মনে হতেই বুক শুকিয়ে গেল রাকিবের।

ফয়সাল, বিল্টু বা জাহিদের মত অত সাহসী নয় সে। এসব রাজি টাজি ধরতেও তার কোন আগ্রহ ছিল না।

কিন্তু ফয়সালের একান্ত অনুরোধ ফেলতে না পেরে এখানে আসতেই হয়েছে রাকিবকে। শত হলেও জিগরী দোস্ত ৷

তবে বিল্টুকে খামােকা ভয় দেখানোর প্রস্তাবটি মনঃপূত হয়নি তার। ফয়সালকে নিষেধও করেছিল রাকিব ৷
‘আরে, ব্যাপারটা এত সিরিয়াসভাবে নিচ্ছিস কেন?’ ওর কাঁধে চাপড় মেরে বলেছিল ফয়সাল ৷ ‘ফান ইজ ফান।

আসলে ব্যাটাকে ভয় দেখিয়ে সাইজ করতে চাইছি আমি। ওকে নিয়ে এমন খেলা খেলব যে আর কােনদিন আমার সামনে চোখ তুলে দাড়াতে হবে না ৷’
‘দেখিস নিজেই যেন সাইজ হয়ে যাসনে আবার,’ বন্ধুকে সাবধান করেছে রাকিব। হা হা করে হেসে উঠেছে ফয়সাল।

‘আরে, আমার নাম ফয়সাল আহমেদ খান ৷ একবার যার ওপর আমার রােখ চাপে তার চিতার ছাই উড়িয়ে দেখি আমি।’
সে রাতে ভাল ঘুম হলো না রাকিবের। প্রায় ভোর রাতের দিকে বিকট এক দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে গেল সে।

জাহিদকে ঠেলে তুলল ও ঘুম থেকে ‘চল, ওরা কী করছে দেখে আসি।’
এককথায় রাজি জাহিদ ৷ মুখটুখ ধুয়ে দ্রুত রেডি হয়ে নিল সে। সুমন প্রথমে বলেছিল যাবে না। কিন্তু… এতবড় রেস্ট হাউসে একা থাকতেও ওর ভয় ৷

আবদুল মােতালেবের জ্বর। সে নিজের বাড়িতে। অগত্যা মুখখানা বাংলা পাঁচের মত করে দুই বন্ধুর সাথে রওনা হতে হলো বেচারাকে।

মাইলখানেক হাঁটতে হলো ওদেরকে হানাবাড়িতে পৌছুতে। দূর থেকে চাঁদের আলোতে ভৌতিক কাঠামােটাকে দেখে বুকের ভিতর

গুডগুড় করে উঠল সুমনের। নভেম্বর মাস। বেশ শীত পড়েছে। হালকা কুয়াশার চাদর ঘিরে আছে কাঠের প্ৰকাণ্ড বাড়িটাকে ৷

যতই সামনে এগােল বুকের ভিতর একটা চাপ অনুভব করল সুমন। দ্রুত একবার জাহিদ আর রাকিবের দিকে তাকাল সে।

জাহিদের চেহারায় উত্তেজনার ছাপ ৷ যেন গুপ্তধন আবিষ্কার করতে চলেছে ৷ তবে মুখ কালো করে কী যেন ভাবছে রাকিব ৷
কালো, আবলুস কাঠের সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল তিনজনের দলটা। ধাক্কা দিতেই ক্যা…অ্যা…চ করে খুলে গেল কবাট।

ঠিক সেই মুহুর্তে দােতলা থেকে তীক্ষ্ণ একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল চিতকারটা শুনে তিনজনের প্রতিক্রিয়া হলো তিন রকম ৷

রাকিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, যাক্, ফয়সাল ওরা তা হলে ঠিকই আছে। সে জানে, চিৎকারটা নকল ৷

টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করা কৃত্রিম চিৎকার। ফয়সাল আগেই ওকে বলেছিল বিল্টুকে ভয় দেখানোর জন্য

সে রেকর্ডারে চিৎকার, চেঁচামেচি, কুকুরের ডাক, পায়ের শব্দ ইত্যাদি রেকর্ড করে রেখেছে।

কাজটা যে করেছে দলবল নিয়ে মধুপুরে আসার আগের দিন। তার এই দুষ্কর্মের সঙ্গী ছিল যথারীতি রাকিব। ওকে জোর করে নিয়ে এসেছিল।

ফয়সাল৷ হানাবাড়িতে রেকর্ডার, সাউন্ডবক্স এমনভাবে ফিট করে রেখেছে যেন অটোমেটিক ভাবে ওগুলো বাজতে থাকে। এখন তাই বাজছে।
তীক্ষ্ণ চিত্কারটা শুনে ভয়ে নীল হয়ে গেল সুমন। খামচে ধরল সে জাহিদের কনুই ৷ ওর দিকে তাকিয়ে অভয় হাসি দিল জাহিদ।

‘খামােকাই ভয় পাচ্ছিস তুই, সুমন। ফয়সাল আসলে আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে ৷

কিন্তু সবজান্তা শমসের তো আর জানে না ওর এসব ট্রিকসের ধান্ধাবাজি আমি ধরে ফেলেছি। ও আসলে রেকর্ডার বাজাচ্ছে।’
‘কী করে বুঝলি ?’ অবিশ্বাসের সুর সুমনের গলায়।
“ওই দ্যাখ!’ সিঁড়িঘরের দিকে হাত প্রসারিত করল জাহিদ ৷ ‘দােতলার সিঁড়ির শেষ ধাপের নীচে ঢাকা। একটা লুকানাে সাউন্ড বক্স দেখতে পাবি।’
সত্যি তাই। পাঁচ ব্যাটারির শক্তিশালী টর্চের আলোতে ছোট একটা সাউন্ড বক্স দেখা যাচ্ছে ওখানে ৷ জাহিদের প্ৰতি ভক্তি বেড়ে গেল সুমনের।

নাহ, জাহিদটার সাহস আছে স্বীকার করতেই হবে। আর পর্যবেক্ষণ শক্তিও সাংঘাতিক তীক্ষ্ণ ৷ রাকিব নিজেও অবাক হয়ে গেল ৷

তবে চেহারায় ভাবটা ফুটতে দিল না সে।
‘চল, দোতালায় যাই ৷ দেখি ওখানে ওরা আছে নাকি।‘ বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সে।
সিঁড়িতে পা রেখেছে রাকিব, হঠাৎ দোতলা থেকে ভেসে এল পায়ের শব্দ। কে যেন পা ঘষটে আসছে এদিকেই ৷
“ফয়সাল ?’ গলা চড়িয়ে ডাকল রাকিব। থেমে গেল পদশব্দ।
‘ফয়সালটা দেখি ফাজলামাে শুরু করেছে আমাদের সাথে,’ বিরক্তি প্রকাশ কালে জাহিদ। ‘শালাকে লাগার এক চড়।’
ওর কথা শেষও হলো না, অমানুষিক গলায় দােতলা থেকে তীক্ষ্ণ, তীব্র চিৎকার করে উঠল কেউ। চিতকারটা প্রলম্বিত, ভয়াবহ ৷

এমনকী জাহিদের গায়ের রোম পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল ৷
‘ফ…ফয়সাল !’ কাঁপা গলায় বৃথাই জোর অন্যের চেষ্টা করল সুমন। ‘ভা…ভাল হবে না বলছি।‘
যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবেই হঠাৎ করে থেমে গেল চিৎকার। ওরা তিনজন জুতাের শব্দ তুলে এবার উঠে এল দােতলায় ৷

এদিক ওদিক তাকাল। দেখা যাচ্ছে না কাউকে। ওদের সাড়া পেয়ে কয়েকটা ধাড়ি, ইঁদুর প্রায় গায়ের উপর দিয়ে ছুটে পালাল ৷

আঁতকে উঠল সুমন। ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল জাহিদ। কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছে, হঠাৎ থপ থপ আওয়াজ শুনে থেমে গেল সে।

শব্দটা ক্রমশ কাছিয়ে আসছে ৷ যেন কেউ হেঁটে আসছে কাঠের মেঝের উপর হাতির মত পা ফেলে। ‘ফয়সাল ?’ গলা চড়াল রাকিব।

‘নাকি বিল্টু তুই ?’
থপ থপ শব্দটা ক্রমশ জোরাল হয়ে উঠল। কিন্তু দেখা গেল না কাউকে ৷
‘দুই হারামজাদা দেখি ভালই ফাজলামাে শুরু করেছে আমাদের সাথে।’ দাঁত বিড়বিড় করল জাহিদ। ‘অনেক হয়েছে ফয়সাল এবং বিল্টু।

এবার তোমাদের চাঁদ বদন দুটো দেখাও দেখি বাছাধনেরা।‘
কিন্তু ফয়সাল বা বিল্টুর কোন পাত্তা দেখা গেল না। শুধু থপ থপ আওয়াজটা বেড়ে চলল।

চিলেকোঠার দিক থেকেই যেন শব্দটা আসছে, কান খাড়া করে শুনল রাকিব। হুম, ঠিক তাই।

‘চল তো, একটু খুঁজে দেখি ওরা কোথায় বসে লুকােচুরি খেলছে।’
আক্ষরিক অর্থেই ভাবনায় পড়ে গেছে রাকিব ৷ এমন তো কথা ছিল না। দ্রুত একবার ঘড়িতে চোখ বোলাল সে।

সকাল পাঁচটা বাজে। বাইরেটা এখনও চাপ চাপ অন্ধকার। তবে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে ৷

দােতলায় বেশ বড় বড় জানালা ৷ গরাদহীন একটা জানালা খোলা। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে ভিতরে। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে ৷

রাকিব চিলেকােঠার দিকে এগােল। চিলেকােঠাটি বেশ বড় ৷ আগেরবার দেখে গেছে সে। তবে ভিতরে ঢোকার সাহস পায়নি।

ফয়সালের কাছে শুনেছে এ ঘরেই নাকি অমরনাথ তার দুই মামাকে কুপিয়ে মেরেছে।

প্রচণ্ড গরমের সেই রাতে ওরা দু’জন চিলেকোঠার ঘরে ঘুমিয়েছিল দখিনা বাতাসের লােভে৷
সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠায় চলে এল রাকিবরা ৷ হাত বাড়াল কবাটের দিকে। কোন সন্দেহ নেই, থপ থপ শব্দটা এই ঘরের ভিতর থেকেই আসছে।

হঠাৎ থেমে গেল থপ থপ্ ৷ আরেকটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল ৷ যেন টপ টপ করে জল পড়ছে মেঝের উপর ৷

দরজায় ধাক্কা মারল রাকিব দম বন্ধ করে। এবং চিৎকার করে উঠল সাথে সাথে।
কড়ি কাঠের সাথে, দড়ির ফাঁসে ঝুলছে ফয়সাল ৷ খোলা পা দুটো কাঠের দেয়ালে গিয়ে লাগছে থেকে থেকে, শব্দ হচ্ছে থপ থপ।

বিষ্ফারিত এবং আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে যে ওদের দিকে। গলাটা দু’ভাগ করা। গলা বেয়ে রক্ত পড়ছে মেঝের উপর।

শব্দ হচ্ছে টপ…টপ…টপ…
‘ব্যাটা দেখি ভালই ভরং ধরতে জানে,’ নিজেকে ইতিমধ্যে সামনে নিয়েছে জাহিদ ৷ ঠোঁট বাকিয়ে হাসল।

“গলায় মিছে ফাঁস ঝুলিয়ে আর ফলস রক্ত মেখে আমাদের ভয় দেখানোর কারসাজি, না ? দাড়া ! দেখাচ্ছি মজা !’
ওর হাত টেনে ধরল রাকিব ৷ আস্তে গিয়ে দাড়াল ঝুলন্ত শরীরটার সামনে। ফয়সালের ফাঁকা এবং ভয়ার্ত চাউনি দেখেই বোঝা যায় ভরং করছে না সে।

মারা গেছে অন্তত দু’তিন ঘন্টা আগে। ওকে নির্মমভাবে কুপিয়ে মারা হয়েছে ৷ লাশটার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে এবং অবিশ্বাসে মাথা নাড়ল রাকিব ৷

মনে পড়ে পেল রােমহর্ষক সেই গল্পটা ৷ ঠিক এভাবে কুপিয়ে, মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছিল অমরনাথ তার দুই মামাকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে।
কিন্তু কে ? কেন মারল ফয়সালকে? জবাবটাও পেয়ে গেল সে তক্ষুণি। এক পাশের দেয়ালে, রক্ত দিয়ে লেখা ফয়সালের রক্ত…

একটা নাম লেখা অমরনাথ।
অমরনাথ চৌধুরী ফিরে এসেছিল ৷ চলে গেছে আরেক বার প্রতিশোধ নিয়ে।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত