কার্শিয়াংয়ের স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের এই বাংলোয় এসে উঠেছি গতকাল সন্ধের কিছু পরে। দিন দুই থাকতে হবে। অফিসের কাজে এলেও দুটো কারণে খুব আনন্দ হচ্ছে। প্রথমটা অবশ্যই কার্শিয়াংয়ের নয়নভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। হিমালয় যেন তার সবটুকুনি আবেগ ঢেলে কোলে টেনে নিয়েছে আমায়, আর দ্বিতীয় কারণটা একান্তই ব্যক্তিগত। আমার ছোটোবেলার বহুবছরের সাথী পাশের বাড়ির রোমিলাদি। রোমিলা চ্যাটার্জী। আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়ো, তাও সবচেয়ে বেশি ভাব ছিল ওর সাথেই আমার।
কার্শিয়াংয়ের নামী স্কুল ‘ডাওহিল গার্লস’-এ রোমিলাদি শিক্ষকতা করছে আজ দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে, মানে ওর বিয়ের পরে শিলিগুড়িতে শ্বশুরঘরে থেকে বছর খানেক শুধুমাত্র গৃহবধূর দায়িত্ব পালন করেছে। তারপর যত না সংসারের প্রয়োজনে, তার চেয়ে বেশি নিজেকে কোনও কিছু কাজের সঙ্গে জড়িত রাখার তাগিদে বসেছিল স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায়। তা সে পরীক্ষায় ভালো ফল করে জলপাইগুড়ির প্রত্যন্ত এক গ্রামের যে স্কুলে পোস্টিং পেয়েছিল, সেখানে জয়েন করা সম্ভব ছিল না। শেষমেশ ওর প্রভাবশালী শ্বশুরমশাইয়ের উঁচু মহলে চেনাজানার সুবাদে ‘ডাওহিল গার্লস’-এর শিক্ষক তালিকায় যুক্ত করতে পেরেছিল নিজের নাম। এসব কথাই রোমিলাদি আমায় জানিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
উত্তর কলকাতার বাদুড়বাগানে আমাদের পৈতৃকবাড়ির লাগোয়া খুবই পুরনো আমলের কড়িবর্গাওয়ালা বাড়ির ভাড়াটে হয়ে এসেছিল রোমিলাদির বাবা-কাকারা, তা প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় আগে। ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি দুই পরিবারের ভিতরকার ঘনিষ্ঠতা। রোমিলাদি আমাকে তার নিজের ছোটোভাইয়ের মতোই স্নেহ করত। হঠাৎ করে উত্তরবঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে রোমিলাদি যখন কলকাতার চেনা পরিবেশ, আত্মীয়-বন্ধু ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে চড়ে বসেছিল দার্জিলিং মেলে, তখন বিদায় জানাতে অন্য অনেকের সাথে আমিও যে গিয়েছিলাম শিয়ালদা স্টেশনের নয়ের বি নম্বর প্ল্যাটফর্মে, সে ছবিটা এখনও জ্বলজ্বল করছে মনের পর্দায়।
তারপর কাজের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে হারিয়ে গিয়েছিল রোমিলাদি, মনে করতে পারি না। পরে, অনেক পরে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ-এর দৌলতে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হালে মাত্র বছর খানেক আগে অফিশিয়াল কাজে কার্শিয়াং এসে দেখা করতে গিয়েছিলাম রোমিলাদির সঙ্গে তার ডাওহিলের কোয়ার্টারে। খুব যত্নআত্তি করেছিল রোমিলাদি, নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছিল আমায়। সারাটা দিন কাটিয়ে রাত্তির আটটা নাগাদ ফিরেছিলাম বাংলোয়।
একমাত্র সন্তান সাত বছরের অর্ঘ্যকে নিয়ে কার্শিয়াং-এ থাকে রোমিলাদি আর ওর স্বামী অপরেশ চ্যাটার্জী শিলিগুড়িতে থেকে পৈতৃক ব্যাবসাপাতি সামলায়। সপ্তাহান্তে ছুটিছাটায় রোমিলাদিই ছেলেকে নিয়ে শিলিগুড়িতে চলে যায়, কখনও সখনও উলটোটা ঘটে। “ব্যবসার দায়দায়িত্ব তো কম নয়,” বলেছিল রোমিলাদি, “আগে তাও পেরেছে অপরেশ, কিন্তু তারপর যখন একমাত্র দেওরকেও সরকারি চাকরি নিয়ে চলে যেতে হল অন্য শহরে, তখন থেকে আমাকেই ছুটে যেতে হয়। অর্ঘ্য তো ওর বাবাকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারে না! ধকল পড়ে আমার ওপর। কী আর করা যাবে!”
আমি বলেছিলাম, “কেন! স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে সংসার কর না সুখে! দু’নৌকোয় পা রেখে চলছিস কেন বল তো?” বলেই সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিলাম, কী জানি, আঘাত দিয়ে ফেললাম নাকি রোমিলাদির নরম জায়গায়।
আমাকে নিশ্চিন্ত করে সরব হয়েছিল ও, “আরে, কী ভাবছিস তুই, সন্তু? আমি টাকা রোজগারের জন্যে স্কুলের চাকরি নিয়েছি? না রে, তা নয়। কাজের মধ্যে থাকার জন্যেই পড়ে আছি এখানে। শিলিগুড়িতে অপরেশ তো প্রায় সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে ব্যাবসা নিয়ে। শ্বশুরশাশুড়িকে দেখাশুনো করার জন্যে দু-দু’জন লোক আছে, আমার কী নিয়ে সময় কাটবে বলতে পারিস? তাছাড়া অর্ঘ্যর কথা ভেবেও আছি এখানে।”
“মানে?”
“কার্শিয়াংয়ের স্কুলগুলোর মতন ভালো স্কুল শিলিগুড়িতে… অন্তত আমার শ্বশুরবাড়ির ধারেকাছে তো নেই।”
পথশ্রমে ক্লান্ত ছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়লাম। ঘুমনোর আগে ভাবলাম, রোমিলাদিকে ফোন করি একবার। কিন্তু পরক্ষণেই নিরস্ত করলাম নিজেকে। কাল একেবারে অফিসের কাজ সেরে বিকেল বিকেল চলে যাব রোমিলাদির কোয়ার্টারে, গিয়ে সারপ্রাইজ দেব।
নভেম্বরের শেষ বিকেল। সূর্য পাহাড়ের আড়ালে ঢলে পড়ার অনেক আগে থেকেই ঘনিয়ে এসেছে ছায়া ছায়া অন্ধকার। সকাল থেকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে ছিল কার্শিয়াংয়ের পথঘাট, পাইন-ফার-দেবদারুর সারি। এসে থেকে মুখ দেখিনি কাঞ্চনজঙ্ঘার, আজও তার হাসিমুখ অদৃশ্য। কুয়াশা কাটতেই গড়িয়ে গেল দুপুর। মুখটুকুন শুধুমাত্র এক ঝলক দেখিয়ে আবার মেঘের আড়ালে চলে গিয়ে দিনভর লুকোচুরি খেলে গেল দিনমণি। আর তারপর এখন টিপ টিপ করে শুরু হয়ে গেছে অকালবর্ষণ।
বাংলোয় ফিরে চা খেয়েই আমি গায়ে রেনকোট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এ-অঞ্চলের পাহাড়ের চরিত্র তো আমার অজানা নয়, তাই সঙ্গে ছাতা ছাড়াও রেখেছিলাম ওই বস্তুটা।
বেশি দূরে নয় রোমিলাদির কোয়ার্টার। রেলস্টেশন পেরিয়ে ডাওহিলের পথে কিছুটা চড়াই ভাঙলেই ছিমছাম ছোটোখাটো এক কটেজ। এ-অঞ্চলের অন্য অনেক বাসস্থানের মতোই কাঠের তৈরি। পাইন আর ফারগাছের জঙ্গলের মাঝে নিঝুম নিরালা পরিবেশ। গতবছর এসেছিলাম ছুটির দিনের সকালে। আর এবার এই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে সাঁঝবেলার আঁধারে।
কটেজ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে কেয়ারটেকার পদম বাহাদুরের ঘর। সেবার আলাপ হয়েছিল মানুষটার সঙ্গে। মাঝবয়সি। বিশ্বস্ত, রোমিলাদি বলেছে। প্রয়োজনে ফাইফরমাশ খেটে দেয়, তবে সন্ধের পর আফিমের মৌতাতে বুঁদ হয়ে থাকে।
আমি যখন কটেজের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম, তখন অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়েছে আর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সংখ্যায় ও আকারে বেড়েছে। হঠাৎ আমার মনে হল, আচ্ছা, এতটা পথ উজিয়ে এলাম, এখন যদি রোমিলাদি বাড়ি না থাকে কিংবা কোনও কাজেও তো বাইরে বেরোতেই পারে। সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই না শেষে বেকুব হই!
যা আশঙ্কা করেছিলাম, তা না ঘটলেও বেকুব আমাকে হতেই হল। তবে অন্যভাবে। দেখি, দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়ে আছে রোমিলাদি। আমাকে দেখামাত্রই স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলে উঠল, “জানতাম, তুই আসবি।”
“কেমন করে জানলি তুই?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করি আমি।
“সকাল থেকেই খুব মনে হচ্ছিল তোর কথা। সেই কবে, বছর পেরোতে চলল তুই এসেছিলি সন্তু!”
“তাতেই মনে হল যে, আমি আজ আসব!”
“টেলিপ্যাথি!” শব্দ করে হেসে উঠল রোমিলাদি, “আয়, ভেতরে আয়, নাকি দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কথা সারবি?”
আমি ভেতরে ঢুকেই ভেজা রেনকোট খুলে মেঝেয় ফেলে রাখতে যাচ্ছি, রোমিলাদি ছোঁ মেরে সেটা আমার হাত থেকে নিয়ে অতিদ্রুত ভেতরের ঘরে চালান করে দিয়ে ফিরে এল। “কী রে সন্তু, শীত করছে খুব? তুই তো দারুণ শীতকাতুরে ছিলি! সোফায় বা খাটে উঠে বোস জুত করে, রুম-হিটার চালিয়ে দিচ্ছি এখনই।”
“এখন আর মোটেই শীতকাতুরে নই, কাজের প্রয়োজনে শীতবোধ পালিয়েছে! জল-ঝড়-বৃষ্টিতে দিন নেই, রাত নেই, কোথায় না কোথায় ঘুরতে হয়! তুই দাঁড়িয়ে রইলি কেন, বোস।”
“এতদিন পর তাহলে দিদিকে মনে পড়ল!” বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে আমার মুখের দিকে চাইল রোমিলাদি।
“তুই তো জানিস, হোয়াটস অ্যাপ-এ লিখেছিলাম তোকে, কী অসম্ভব কাজের চাপের মধ্যে আমাকে থাকতে হয় আজকাল!”
“আমাকে কাজ দেখাসনি, সন্তু!” গর্জে ওঠে রোমিলাদি, “খবর আছে, তুই গতমাসেও এসেছিলি পাহাড়ে।”
“ঠিক, কিন্তু কার্শিয়াংয়ে তো নয়, তিস্তা বাজারে…”
“ইচ্ছে থাকলেই উপায় হত,” রোমিলাদির কণ্ঠস্বরে অভিমান, “দিদিটাকে তো ভুলেই গেছিস!”
“না, ভুলেছিস তুই, আমি নই!” জোরালো প্রতিবাদ করি আমি, “তোকেই তো আর পাই না হোয়াটস অ্যাপ-এ এবং মেসেঞ্জারের ইনবক্সে! অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিয়েছিস নাকি তুই?”
ম্লান হাসির রেখা ফুটে ওঠে রোমিলাদির মুখমণ্ডলে। পরক্ষণেই ব্যস্তসমস্তভাবে বলে, “তুই বোস সন্তু, আমি চটপট চা বানিয়ে আনছি তোর জন্যে।”
বাধা দিয়ে বলে উঠি আমি, “বোস তো তুই এখানে। কাজ সেরে বাংলোয় ফিরে খানিক আগেই আমি চা খেয়েছি। পরে দিস আমায়। কতদিন সামনাসামনি কথা হয় না তোর সাথে!”
একটা বেতের মোড়া টেনে নিয়ে আমার মুখোমুখি বসল রোমিলাদি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “অর্ঘ্য কই রে? ওকে দেখছি না যে!”
“ও গতকাল শিলিগুড়িতে গেছে ওর বাবার কাছে। আজ এখানে লোকাল হলিডে, তাই স্কুল ছুটি।”
“তার মানে, এত বড়ো বাড়িতে তুই একা! ভয় করে না তোর?”
“ভয়! কীসের? ভূতের?” হেসে ওঠে রোমিলাদি, “তুই চিরকালই ভিতু রয়ে গেলি রে সন্তু! গতবার এসেও ভূতের প্রসঙ্গ তুলেছিলি।”
“ঠিক। তুলেছিলাম আর এখন সে-কথাটাই আবার বলতে যাচ্ছিলাম তোকে,” মাঝপথে রোমিলাদিকে থামিয়ে দিয়ে আমি বলি, “জানিস, সেজন্যেই তোর সেদিনের বলা গল্পটা মানে হাড়হিম ভয়ের ওই ভূতের গল্পটা ভাবছি লিখে জমা দেব বাজারের সেরা পত্রিকা ‘নবভারতী’-র শারদীয়া সংখ্যার জন্যে। সম্পাদক বড্ড তাগাদা দিচ্ছে। গল্পকার হিসেবে কিছু নামডাক হয়েছে এখন আমার, জানিস?”
“সে তো খুব আনন্দের কথা,” উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ওঠে রোমিলাদি, “কিন্তু কোন গল্প বলেছিলাম তোকে মনে পড়ছে না।”
“ওই যে তোদের ডাওহিল স্কুল বিল্ডিংয়ের পাশে পুরনো যে হলঘরটা আছে, সেই হলঘরে নাকি মাঝরাত্তিরে বল-ডান্স করতে দেখেছে অনেকেই সাহেব আর মেমসাহেবদের, আর নাকি মেমদের হিলের জোরালো খটখট শব্দ শুনে একবার স্কুলের নেপালি দারোয়ানের দাঁতকপাটি লেগে গিয়েছিল এবং তার বউও ভিরমি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল একসাথে!”
“তুই সে গল্পই লিখতে চাইছিস তো, সন্তু!” রোমিলাদির চোখেমুখে একরাশ উচ্ছ্বাস, “আমার বলা গল্প ছাপার অক্ষরে বেরোবে তাহলে?”
“বেরোবে,” জবাবে বলি আমি, “বললাম না, যে সে পত্রিকায় নয়, এখনকার সবচেয়ে নামী এবং সবচেয়ে বেশি চালু মাসিক পত্রিকার পুজোসংখ্যার পাতায়।”
“শোন, সন্তু,” উত্তেজিত রোমিলাদি বলে চলে, “কিচ্ছু বাদ দিবি না কিন্তু। যা যা বলেছি বিস্তারিত, সব লিখবি।”
“বাদ দেব ভাবলি কেমন করে তুই!” আমি মাঝপথে রোমিলাদিকে থামিয়ে দিয়ে বলি, “পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, যা তুই দিয়েছিলি, সব মনে আছে আমার। নেপালি দারোয়ানের বউয়ের গা থেকে কম্বল আপনা আপনি সরে যেত নিশুত রাতে, ঘুম ভেঙে চোখ কচলে সে দেখত, কম্বল মেঝেয় পড়ে সরসরিয়ে চলেছে ওই হলঘরের দিকে। দরজাটাও কেমন করে জানি হাট করে খোলা। বউটা ঠেলেঠুলে তার বরকে ঘুম থেকে তুলে একসাথে দু’জনে মিলে উঠে গিয়ে হলঘরের জানালায় চোখ রেখে অবাক হয়ে একদিন দেখেছিল, সাহেব-মেমদের পার্টি চলেছে। ঠিক যেন ব্রিটিশ আমলের পুরনো দিনে হঠাৎ করেই পৌঁছে গেছে ওরা! এছাড়াও কল্পনার ডানায় ভর করে জুড়ে দেব আরও আরও অনেক রোমহর্ষক ব্যাপার-স্যাপার, মানে যা তুই বলিসনি, তাও…”
“না, বানাবি না কিছু!” উষ্মাভরা কণ্ঠস্বর রোমিলাদির। মোড়া থেকে উঠে এসে বসল সে আমার পাশে, আর ঠিক তখনই পাওয়ার কাট। লো ভোল্টেজের দরুন টিমটিম করে জ্বলছিল যে এল.ই.ডি ল্যাম্পগুলো, এখন সেগুলো নিভে গিয়ে একেবারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেল চারপাশ।
আমি পকেট থেকে তাড়াহুড়ো করে মোবাইল ফোনটা বের করে টর্চ জ্বালাতে গেলাম যেই, অমনি হাত ফসকে মেঝেয় পড়ে গেল সেটা।
পাশ থেকে খুনসুটিভরা কণ্ঠে রোমিলাদি বলল, “বেশ হয়েছে! অন্ধকারই সই, বোস না চুপচাপ লক্ষ্মীটি হয়ে!” আমার কাঁধে রোমিলাদির হাত চেপে বসল। “তুই না সন্তু, এখনও সেই একইরকম ভিতুই রয়ে গেছিস রে! তাও আবার কিনা ভূতের গল্প লিখে পাঠককে ভয় পাওয়ানোর ব্যবস্থা করিস? আশ্চর্য!”
ঠিক সেই সময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। ক্ষণিকের সে আলোতে আমি দেখলাম, আমার পাশে সোফায় রোমিলাদি নেই। তার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে দরজার দিক থেকে। “অনেকটা পথ পার হয়ে তোকে বাংলোয় ফিরতে হবে রে সন্তু, উঠে আয় চটপট। এ-বৃষ্টি আজ আর থামবে না।”
আগেই আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। বাইরে থেকে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগল চোখেমুখে। কখন যে আবার পাশে চলে এসেছে রোমিলাদি, বুঝতে পারিনি। হাত চেপে ধরতেই শরীর যেন অবশ হয়ে এল। বরফের মতো ঠাণ্ডা ওর হাত। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “যে গল্পটা আগেরবার বলেছিলাম, সেটা নয় রে সন্তু, আজকের গল্পটা লিখে পাঠাস সম্পাদককে। দেখবি, খুব পছন্দ হবে পাঠকদের।”
আমি যেন হঠাৎই কালা হয়ে গেছি। রোমিলাদির কোনও কথাই আর কানে ঢোকে না আমার। মেরুদণ্ড বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে হিমশীতল শিহরন। এবার আকাশে নয়, বিদ্যুৎ-ঝিলিকের মতো ঝিলিক দিয়ে ফুটে ওঠে রোমিলাদির মুখমণ্ডল! একঢাল কালো চুলে আংশিক ঢাকা। আমার পথ আগলে ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে। আলো-আঁধারিতেও স্পষ্ট দেখলাম, রোমিলাদির বিষণ্ণ মুখের করুণ আর্তি। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “আজকের গল্পটা কিন্তু লিখিস ভাই।”
আর কিছু মনে নেই আমার। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি আমার বাংলোর বিছানায়।
“এখানে কীভাবে এলাম?” আপনা আপনি আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল কথাগুলো।
“ভাগ্যিস আমি সে-সময় ফিরছিলাম ডাওহিলের পথে!” বলল আমার অফিসের সহকর্মী-বন্ধু সুগত, “প্রথমটায় বুঝিনি। শুধু একটা গোঙানির আওয়াজ কানে এসেছিল কটেজের দিক থেকে। তারপর গিয়ে দেখি, তুই পড়ে আছিস ঘরের ভেতরে দরজার কাছে।”
“এখানে আমাকে নিয়ে এলি কীভাবে?”
“পদম বাহাদুরের সাহায্যে,” বলল সুগত, “শুনলাম, তোর রোমিলাদি দিন পনেরো আগে ছেলেকে শিলিগুড়িতে রেখে যখন ফিরে আসছিল, তখন পাঙ্খাবাড়ি রোডে বাঁকের মুখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওদের জীপ পড়ে যায় গভীর খাদে। ড্রাইভারসহ ছ’জন যাত্রীর কেউই বাঁচেনি।”
“কটেজের দরজা খুলল কে তাহলে?”
“আরে, খুলে রেখে দিয়েছে নির্ঘাত পদম বাহাদুর নিজেই! সন্ধের পর আফিমের মৌতাতে ওর কি আর কিছু খেয়াল থাকে? ভেতরে ঢুকেছিল কোনও সময়, তারপর বেরিয়ে আর…” সুগত কথা থামিয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়।
“কী হল! থামলি কেন? বল!”
“আমি যখন কটেজে ঢুকি, তখন তোর পায়ের কাছে মেঝেয় পড়ে রেনকোট আর তোর মাথার পাশে এলো চুলে বসে ছিল এক নারীমূর্তি!”
(সমাপ্ত)