এক টানা গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে মনন। বাঙ্গালী আইরিশ,বয়স বিশ কি একুশ,পেশায় ক্রিকেটার , ডাবলিন কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবে খেলে। জাতীয় দলে ঢুকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।আজও ক্রিকেট ম্যাচ খেলার জন্য যাচ্ছে কর্ক। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার পথে,তার উপর আকাশের মেঘগুল কাল রূপ ধারণ করে আছে অনেক খন ধরে,যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে।
‘‘উফ এত দূর আগে জানলে সকাল সকাল ঘর থেকে বের হতাম।’’ কথা গুলো যেন নিজেকে নিজেই শোনাল মনন। রাস্তা অচেনা তাই ন্যাভিগেটরের সাহায্য নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে মনন কে। আইরিশ আবহাওয়ার কোন ভরসা নেই এই বৃষ্টি এই রোদ। আয়ারল্যান্ডের আবহাওয়ার মতই রহস্যময় আয়ারল্যান্ডের রাস্তা ঘাট গুলও। কোথাও ঘন জঙ্গল আবার কোথাও লোকালয়। ঘন পাইন আর ওক গাছে ঘেরা রাস্তার দু পাশ। সাড়ি সাড়ি ওক আর পাইন গাছ গুলো দাঁড়িয়ে আছে এক জন আর এক জনের সাথে গা ঘেঁষে। দু পাশে ঘন জঙ্গলের জন্য আরও বেশি অন্ধকরাচ্ছন্ন হয়ে গেছে চারপাশ । আকাশে মেঘের আর ওক ও পাইনের জঙ্গলের সংমিশ্রণে গাঁ ছম ছম করা একটা পরিবেশর সৃষ্টি হয়েছে । পথে একটা গাড়ীও নজরে পরছেনা মননের। হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পরা শুরু হয়ে গেল। এতো জোরে বৃষ্টি পড়ছে মননের মনে হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা বোধ হয় গাড়ীর উইনশিল্ড ভেঙ্গে ফেলবে। বৃষ্টির জন্য পরিষ্কার ভাবে গাড়ীর এক হাত সামনের কিছু দেখা যাচ্ছেনা। তাই খুব সতর্কতার সাথে গাড়ী চালাচ্ছে মনন। ন্যাভিগেটরের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে বিরক্তিকর ভাবে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ লক্ষ্য করলো ন্যাভিগেটর থেকে কোন সাড়া শব্দ আসছে না । ও, আরচোখে ন্যাভিগেটরের দিকে তাকাল ।
‘‘কি হল আবার এই বোকা যন্ত্রটার?’’ ভ্রুকটি করে বলল মনন ।‘‘ এখন আমি যাই কি ভাবে?’’ গাড়ীর গতি কিছুটা কমিয়ে মনন এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো , যদি কোন লোকজন পাওয়া যায় , যাকে জিজ্ঞাস করে রাস্তাটা চেনা যাবে । কিন্তু ভাগ্য আজ ওর সাথে নেই , পনের মিনিট ধরে ন্যাভিগেটরের নির্দেশনা ছাড়াই গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে মনন কিন্তু এই পনের মিনিটে এক জন মানুষের দেখাও মেলেনি ।
‘‘ঘুম থেকে উঠেযে আজ কার চেহারা দেখেছি ।’’ হতাশার বহির প্রকাশ করে বলল মনন । ও এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি,গাড়ী চালাতে চালাতে কখনযে পীচ ঢালা পথ ছেড়ে জঙ্গলের কাঁচা রাস্তায় গাড়ী নামিয়ে এনেছে । রাস্তা হারিয়ে গাড়ী এদিক সেদিক করতে করতে সন্ধ্যা নেমে রাত হবার জোগার । শুনশান রাস্তা , লোকালয়ের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছেনা কোথাও , যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ । মাঝে মাঝে দূর থেকে নেকড়ের মায়া ডাক ভেসে আসচ্ছে মননের কানে । গাড়ীর ভিতরে বাইরের এত দূরের কোন শব্দ কানে আসার কথা না, মনন এই কথাটা ভেবে একটু ভয় পেল, ওর শিড়দারা দিয়ে ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল । কোন খেয়ালে বা কোন ধেনে ও, পাকা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের এই কাঁচা রাস্তা ধরলো তা কিছুতেই মনে করতে পারছে না । বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু আকাশে মেঘের জটলা বেঁধেই আছে ,কাল কাল মেঘগুলো যেন অশুভ কোন কিছু ডেকে নিয়ে আসছে । পূর্ণিমার রাত,তাই মেঘের যাতায়ত বুঝা যাচ্ছে স্পষ্ট । মনন প্রাণপনে রাস্তা খুঁজে যাচ্ছে এদিক সেদিক গাড়ী ছুটিয়ে। হঠাৎ গাড়ীটা মৃদু প্রতিবাদ করে দুটা ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল ।
‘‘দুরও ছাই। গাড়ীটার আবার কি হল ?’’ বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল মনন। গাড়ী থেকে নেমে এদিক সেদিক চেয়ে গাড়ীর হুড খোলার জন্য গাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আর সে সময় কোথাথেকে যেন একটা নেকড়ে ডেকে উঠল রক্ত হিম করা সুরে । মননের গাঁয়ের সব গুলো লোম দাঁড়িয়ে গেল। কাঁপা হাতে গাড়ীর হুড উঠাল আর ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক তাকালো । গাড়ীর হুড খুলে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে গাড়ীর এইভাবে থেমে যাওয়ার কারণ খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল ।
‘‘গাড়ীর ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে!” আবাক হয়ে নিজেই নিজেকে বলল । ইঞ্জিনের হিট দেখে গাড়ীর রেডিয়টর চেক করে দেখল কুলেন্ট শেষ , তাই ইঞ্জিন গরম হয়ে গাড়ী বন্ধ হয়ে গেছে ।
“হু এই হল ঘটনা। এখন পানি লাগবে , পানি দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ।” বিজ্ঞের মত কথাগুল বলে গেল মনন । গাড়ীর হুড নামিয়ে দিয়ে এদিক সেদিক তাকাল , এদিক সেদিক তাকাতেই ওর চোখে একটা আলো পড়লো। ‘ও, আলো লক্ষ করে এগিয়ে যেতে থাকল। কিছুখন হাঁটার পর ও পৌছে গেল আলোটার দিকে । আলোর উৎসটা দরজার দুই পাশে লাগানো দুইটা মশাল, মনন একটু অবাক হল,কিন্তু খুশি হল এই ভেবে একটা বাড়ি পাওয়া গেল, মনন দির্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ যাক বাবা বাচাঁ গেল, একটা বাড়ি পাওয়া গেল।’’ ও আর কাল বিলম্ব না করে দরজায় কলিং বেল না পেয়ে টোকা দিল । দরজায় টোকা পড়তে না পড়তেই সাথে সাথে দরজাটা ভিতর থেকে খুলে দিয়ে এক জন সতের কি আঠার বছরের অপুরুপা সুন্দরী মেয়ে, মনন কে জিজ্ঞাস করল “কি চাই?” মনন বেশি জোরেও দরজায় টোকা দায়নি, আর সাথে সাথেই দরজা খুলে এক জন সুন্দরী মেয়ে বলছে ‘কি চাই, এতে ও খানিকটা চমকেও গেল ? মনে হচ্ছে মেয়েটি জানত যে মনন আসবে , আর ওর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। মননকে এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দাখে মেয়েটা আবারো প্রশ্ন করল, “কি চাই, কোন সমস্যা?”
“আমার গাড়ীর ইঞ্জিনটা গরম হয়ে গেছে, তাই একটু পানি দরকার।”
“ ওহ, ওকে ভিতরে আস, ভিতরে এসে পানি নিয়ে যাও ।”
“ধন্যবাদ ।”
“ধন্যবাদ দেয়ার এখনো সময় আসেনি। তুমিতো এখনো ঘরেই ঢুকনি , আগে ঢুক তার পর পানি নাও তার পর ধন্যবাদ দিয়ো ।”
মনন একটা হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকল, আর তখনি মননের মনে হোল খুব কাছ থেকে যেন অনেক গুল নেকড়ে ডেকে উঠল এক সাথে। মনন ভয়ে তারা তারি ঘরে ঢুকে পরল। মেয়েটা একটু মুচকি হেসে দরজাটা বন্ধ করে দিল । মনন ঘরে ঢুকেই একটা ধাক্কা খেল, এত বড় লিভিং রুম ও খুব কম দেখেছে, ওর মনে হচ্ছে কোন রাজ দরবার, মনন ঘাবড়ে গেল আসলেইতো এইটা একটা রাজ দরবার। অন্ধকারে ও খায়াল করে নি, যে বাড়িটায় ও ঢুকেছে সেটা আসলে একটা বড় সড় ক্যাসেল । মনন চারদিক দেখছে আর ভাবছে , অন্য ক্যাসেল গুলতো এরকম না ,ঐ গুলোর সদর দরজা দিয়ে ঢুকার পর লম্বা করিডোর পেরিয়ে যেতে হয় দরবার হলে । কিন্তু এইটার দরজা দিয়ে ঢুকার পরই লিভিং রুম , তাও আবার পরিপাটি করে সাজানো সেকেলে সব আসবাবপত্র দিয়ে !
“তুমি যা ভাবছো আসলে সেটা তানা। এইটা কোন ক্যাসেল না। এইটা ক্যাসেল টাইপ একটা বাড়ী, সবাই এই ভুল করে হাহা হাহা হাহা।’’ মননের চিন্তারগুলকে যেন ছিন্তাই করে নিয়ে কথাগুল বলল মেয়েটি । মনন ওর কথা শুনে হা হয়ে গেল । পরিস্থিতি হালকা করার জন্য মেয়েটি একটু হেসে বলল “ আমি ইভলিন, ইভলিন ও কারনার ’’ মেয়েটি হাত বারিয়ে দিল মননের দিকে, মনন নিজের নামটা বলে হাত মিলাল । মনন আর এক দফা ধাক্কা খেল ইভলিনের সাথে হাত মিলিয়ে, মেয়েটার হাত বরফের মত ঠান্ডা । আবার ও ইভলিন ওকে অবাক করে একগাল হেসে বলল ,“আমার হাত ঠান্ডা কারণ আমি একটু আগে সিঙ্কে কিছু প্লেট ধুয়েছিলাম … হাহাহ হাহা হা” মেয়েটার হাসি মননের কাছে কেমন যেন মায়াবী মনে হয়।
“ তুমি সোজা গিয়ে ডানে যাও , ঐ খানে একটা বাথরুম আছে ঐ বাথরুম থেকে তুমি তোমার প্রয়োজন মত পানি নিয়ে যাও ।”
“ধন্যবাদ আপনাকে” এ বলে মনন ইতস্ত ভাবে লিভিং রুম থেকে বের হয়ে মেয়েটার দেখানো পথে বাথরুমের দিকে গেল। মনন বাথরুমে গিয়ে দেখল, যাকে কমন বাথরুম ভেবেছিল সেটা আসলে একটা বিশাল হাম্মাম খানা , কেউ মনে হয় জানত যে মনন এই বাথরুমে আসবে তাই ওর জন্য আগের থেকেই একটা বালতিতে পানি ভরে রাখা হয়েছে । মনন বালতিটা নিয়ে ফিরে আসলো লিভিং রুমে । এসে দেখে ইভলিন নেই । মনন ভাবল মেয়েটা মনে হয় ভিতরে গেছে । ও অপেক্ষা করতে থাকল ইভলিনের জন্য , কিন্তু ইভলিনের আসার কোন নাম গন্ধ নেই । অনেক সময় পাড় হয়ার পর মনন গলা বারিয়ে তিন, চার বার ডাক দিল, ‘ইভলিন …ইভলিন।’ কিন্তু ইভলিনের আসার কোন নাম নেই ।মনন এদিক সেদিক তাকিয়ে সব কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো, লিভিং রুমটা পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে সারা ঘড়ে মোম বাতি জ্বালিয়ে,মনে হয় এই বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। ইভলিনের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আবারো ইভলিন কে ডাকতে থাকল মনন । ইভলিনকে ডাকতে ডাকতে ওর চোখ পরলো ফ্লোরে দিকে। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে আছে । আঁতকে উঠল মনন , রক্ত দেখে মাথায় বিভিন্ন চিন্তা আসতে লাগলো । ফ্লোরে রক্ত কিভাবে আসল? এই সকল প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেতে থাকল । হঠাৎ ওর নজর গেল ওর হাতে থাকা বালতিটার দিকে । যা দেখল তাতে আতঙ্কে ওর চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বের হবার উপক্রম । স্ব জোড়ে না…বলে চিৎকার করে হাতের বালতিটা ছুরে ফেলে দিল ফ্লোরে। ফ্লোরে যে রক্ত পরে আছে সেগুল ওর হাতের বালতি থেকেই পড়েছে । তাজা রক্ত ভর্তি বালতিটি ফ্লোরে পড়ে গড়াতে লাগল । ওর চিৎকার শুনে ইভলিন অনেকটা হাওয়ার থেকেই উদয় হল।
“ আরে কি হল চেঁচাচ্ছ কেন? কি হয়েছে?’’
“ র…র…রক্ত ’’ ভীত গলায় তোতলাতে তোতলাতে বলল মনন ।
“ রক্ত, কোথায় রক্ত?’’
“ ঐ যে ফ্লোরে” মনন হাত দিয়ে বালতিটার দিকে দেখিয়ে বলল ।
“ কোথায় রক্ত ? তুমিতো পানি দিয়ে আমার ফ্লোর ভিজিয়ে দিয়েছ ।’’
মনন ফ্লোরের দিকে তাকাল , তাকিয়ে দেখল সেখানে বালতি পরে আছে আর আশপাশ পানি দিয়ে ভেজা ।
“ কি…কি…ন্তু আমি রক্ত দেখেছি ঐযে ফ্লোরেআর এই বালতিতেই ছিল রক্ত ।”
“ তোমার মনের ভুল হবে।’’ একটু থেমে মেয়েটা আবার বলল, “ পানিতো সব ফেলে দিলে যাও আবার নিয়ে আস, তোমার গাড়ীতে লাগবে না?”
ওর কথা শুনে মননের ভয় কিছুটা কমে আসল । ফ্লোরে পরে থাকা বালতিটা তুলে নিয়ে আবারো রওনা হল বাথরুমের দিকে । ধীর পায়ে লম্বা করিডোর পেরিয়ে পৌছে গেল সেই রাজকীয় বাথরুমে । বাথরুমে ঢুকে মনন চার পাশ তাকাল, বাথরুমে কোন কল নেই, কোন শাওয়ারও নেই । এদিক সেদিক চেয়ে ওর নজড় গেল বিশাল বাথটটার দিকে, গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ঢাকা পুরো বাথটব, তার চার পাশে জ্বলছে রং বে রঙ্গের মোমবাতি । মনন বাথটবে ঝুকে গোলাপের পাপড়ি গুল সরিয়ে বালতিটা চুবিয়ে দিল, বালতিটা তুলে আনতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, ঘাড়ের সবগুল পশম দাঁড়িয়ে গেল , ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে গেল । এক বালতি রক্ত তুলে এনেছে বাথটব থেকে । পুরো বাথটব রক্তে ভরা, গোলাপের পাপড়ির জন্য রক্ত দেখা যায়নি ।মনন চিৎকার দিয়ে বালতিটা ফেলে জোড়ে একটা দৌড় দিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে গেল । দৌড়াতে দৌড়াতে ও লিভিং রুমে চলে আসল । এসে যা দেখলো তাতে ওর চোখ কপালে উঠার জোগাড় । ওর মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের শীতল শিহরণ বয়ে গেল, পাগলের মত ও এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো আর ছুটা ছুটি করতে থাকল। ও যে লিভিং রুমে এসেছে সে রুমে কোন দরজা জানালা নেই । পুরো লিভিং রুম পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা । কিন্তু একটু আগে এই খানে দরজা জানালা ছিল মনন যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে সেখানে এখন পাথরের দেয়াল।
“ ইভলিন …ইভলিন তুমি কোথায় ?” আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মনন ইভলিন কে ডাকতে থাকল ।
কিন্তু ইভলিনের কোন সাড়া শব্দ নাই । এক ঝাটকায় লিভিং রুম থেকে বের হয়ে মনন বাথরুমে যাবার করিডোর ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকল । মননের কাছে এটা কোন বাড়ি মনে হল না,ওর কাছে মনে হল এ’টা কোন জেল খানা আর সব কিছুই কেমন যেন রহস্যময় অন্যরকম, ওর মনে হচ্ছে যে করিডোর ধরে ও এসেছে সেই করিডোরেই বার বার ফিরে আসছে , যেন গোলক ধাঁধাঁয় আটকে গেছে । করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় একটা বিষয় লক্ষ্য করল মনন, করিডোরের দু পাশেই সাড়ি সাড়ি দরজা, আর দরজার ভিতর থেকে গোংগানোর শব্দ, মনে হয় কেউ ব্যাথ্যায় কাৎরাচ্ছে । আগে এই দরজাগুল নজরে আসেনি । গোঙ্গানির শব্দপেয়ে আরো ভয় পেয়ে গেল, ভয়ের সাথে যুক্ত হল কৌতূহল । ওর খুব দেখার ইচ্ছে হচ্ছে দরজার ওপাশে কি আছে । ও দজারয় ধাক্কা দিল, কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । মৃদু স্বরে কয়েক বার ডাক দিল ,
“ কেউ কি আছেন ভিতর হ্যাল কেউ কি আছেন?” ওর ডাক শুনে ভিতরের গোঙ্গানির শব্দ থেমে গেল । আরো কয়েক বার ডাক দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল মনন,করিডোরটার শেষ প্রান্তে একটা দরজা খোলা দেখে,ঐ দরজার দিকে পা বাড়াল। রুমের সামনে আসতেই ওর কানে আসল কারা যেন ভিতরে কথা বলছে । ও আস্তে করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভিতরে উকি দিল । ভিতরে ইভলিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সাথে যান কথা বলছে
“এত অস্তির হচ্ছো কেন?” ইভলিন বলল ওর সামনে থাকা একটা ছায়া মূর্তি কে।
“অস্তির হবনা,আমার রূপ যে চলে যাচ্ছে । তার সাথে পেয়েছে ক্ষুধা। কত দিন খাই না।’’
“আমার চেহারাও তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । ছেলেটা বোধ হয় কিছুটা টের পেয়ে গেছে।”
মনন এতখন লক্ষ্য করেনি যে ইভলিনের সতের বছরের চেহারাটা এক ধক্কায় ত্রিশ বছরের নারীর মত হয়ে গেছে । মসৃণ গালের চামড়া গুলো অমসৃণ হয়ে গেছে, গলার স্বর হয়ে গেছে বাজখাঁই এর মত। চোখের নিচে কালি জমে গেছে, ঠোঁট শুকিয়ে কাল হয়ে আছে ।
“ ছেলেটা যদি টের পেয়ে যায় তো ওকে এখনো রেখে দিয়েছ কেন?” ছায়া মূর্তিটা বলল ।
“ এখনো যে সময় হয়নি, তুমি জানন , সময় হলেই ওর রক্ত দিয়ে আমি গোসুল করে ওর হৃদপৃন্ড টা খাব ।” ইভলিন বলল পৈশাচিক হাসি হেসে । মননের হাত ওর অজান্তেই ওর বুকের বাম পাশে চলে গেল । ইভলিন কার সাথে কথা বলছে এইটা দেখার জন্য মনন একটু উকি মারতে গিয়ে শরীরের ভার্সাম্য হারিয়ে পরে গেল দরজার পাল্লা হেলে ঘড়ের ভিতরে । ওকে দেখে ইভলিন একটুও অবাক না হয়ে বলল “ পরে গেলে? ব্যাথ্যা পাওনি তো?”
মনন লক্ষ্য করল ইভলিন দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে সেখানে কোন ছায়া মূর্তি নেই ,আর আয়নায় ইভলিনের কোন প্রতিবিম্বও নেই। ভয়ে মননের মূর্ছা যাওয়ার মত অবস্থা ।ওর দিকে লোলুভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইভলিন । ওর চোখ দুটো চকচক করছে, বহু দিনের ক্ষুধার্থ বাঘ যেমন তার শিকারের দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি ইভলিন তাকিয়ে আছে মননের দিকে। মনন দেখছে কি ভাবে এত সুন্দর একটা চেহারা পিশাচে পরিণত হচ্ছে । ইভলিনের চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ধীর ধীরে , চুলগুলো যেন শাজাহানের মত সাদা হয়ে গেল চোখের পলকেই । হাত গুল সরু হয়ে যেতা লাগলো , নখগুল বড় হয়ে বাঁকিয়ে গেল । চোখের সামনে সতের বছরের একটা অপরূপা মেয়ে হাজার বছরের এক ডাইনিতে পরিণত হতে দেখে মননের হাত পা সব জমে গেল , এত দিন এই সব শুধু সিনেমাতেই দেখতো আজ ওর চোখের সামনেই হচ্ছে ।
“ তোমার সময় এসে গেছে, তুমি সব জেনে গেছ , তোমার মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে । হাহাহাহহাহাহাহহাহ …” খড়খড়ে কন্ঠে বলল ইভলিন ।
মনন আর কাল বিলম্ব না করে কোন মতে ফ্লোর থেকে উঠে করিডোর ধরে দৌড় দিল, মনন ওদের ক্রিকেট দলে সবচাইতে দ্রুত দৌড়াতে পারে,তাই চোখের নিমিষেই মনন দৌড় দিয়ে করিডোর পেরিয়ে লিভিং রুমের দিকে গেল । ও যখন করিডোর পার হচ্ছিল তখন করিডোরের দুই পাশের দরজাগুল খুলে যেতে শুরু করলো একা একাই,আর ভিতর থেকে ইভলিনের মতই কত গুল পিশাচ বের হয়ে মননের দিকে আসতে লাগলো । মনন ওদের দেখে আরো জোড়ে দৌড়াতে লাগল, একের পর এক করিডোর পারিয়ে ও সেই লিভিং রুমে চলে আসলো । আর সেই পিশাচ গুলো গোংগাতে গোংগাতে মননের পিছে পিছে আসতে লাগলো । মনন লিভিং রুমে এসে থমকে দাঁড়াল কারণ সেখান থেকে বের হয়ার কোন রাস্তা নেই । পুরো লিভিং রুম পাথর দিয়ে ঘেরা,কোথাও এক বিন্দু ফাঁকা জায়গা নেই যেখান দিয়ে মনন বের হতে পারবে। মনন পুরপুরি ভাবে ফেঁসে গেছে ।এত বড় লিভিং রুমটাকে মননের ছোট মনে হচ্ছে , পুরো লিভিং রুমে ইভলিন, ইভলিনের মা,দুই বোন আর ইভলিনের খালা দাঁড়িয়ে আছে । পাঁচ জোড়া লাল টকটকে চোখ মননের দিকে তাকিয়ে আছে ।
ওদের মুখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে লালা ঝরছে আর মুখ দিয়ে বিচিত্র এক শব্দ করছে, মনে হচ্ছে কোন মন্ত্র আওড়াচ্ছে। ওরা একে একে মননের সামনে এসে দাঁড়াল, মনন ওদের ভয়ানক রূপ দেখে এক পা এক পা করে পিছাতে থাকে, এই ভাবে পিছাতে পিছাতে ওর ফেলে যাওয়া মায়াবী পানি রূপি রক্তে পা পিছলে পরে গেল ফ্লোরে । আর ডাইনি গুল এক পা এক পা করে মননের দিকে আসতে লাগলো । মনন ভয়ে আমসত্তা হয়ে গেল,ওর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। মনন এই ভাবে মরতে চায় না , ও মনে মনে সুরা পড়ার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু একটা সুরাও ওর মনে পড়ছে না এই মূহুর্তে। ও নিজেকে হাতের সাহায্যে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ক্রলিং করে । দেয়ালের পাশে মোমবাতি জ্বলছে আর সেই আলোতে ডাইনিগুলোর ছায়া দেখা যাচ্ছে না শুধু ডাইনি গুলকে দেখা যাচ্ছে ধীর পায়ে মননের দিকে আসছে ।
মনন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না । হঠাৎ মনন লক্ষ্য করলো পাথরের শক্ত দেয়াল ভেদ করে চাঁদের আলো এসে পরেছে ওর পায়ের কাছে । মনন মনে মনে ভাবল, ‘ দেয়াল ভেদ করে চাঁদের আলো আসছে তাহলে নিশ্চয় ঐ খানে কোন রাস্তা আছে , আর আলো দেখেতো মনে হচ্ছে কোন জানালা দিয়ে আসছে ।’ মনন সাত পাঁচ না ভেবে কোন মত উঠে দাঁড়াল আর আল্লাহর নাম নিয়ে চাঁদের আলো বরাবর একটা দৌড় দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়ার মত করে দুই হাত সামনের দিকে বারিয়ে ড্রাইভ দিল দেয়ালে। ও ভেবেছিল শক্ত কিছুর সাথে ও বাড়ি খাবে কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সেরকম কিছুই ঘটলনা, ও বিনা বাঁধায় একটা ঝোপের উপর পরে গেল। মনন ঝোপ থেকে উঠেই দিল একটা দৌড় , অন্ধকারে আন্তাজ লাগিয়ে মনন দৌড়াতে থাকল, দৌড়াতে দৌড়াতে ও হোঁচট খেয়ে পরে জ্ঞান হারানোর আগে শুধু একবার পিছনে ফিরে দেখল বাড়িটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে । মনন যখন ড্রাইভ দিয়ে দেয়াল ভেদ করছিল তখন ওর পা লেগে মোমবাতি পরে যায় সোফার উপরে, আর তাতেই দাউ দাউ করে আগুন লেগে যায় পুর বাড়িতে ।
রাত পেরিয়ে সকাল, সারা রাত মনন অজ্ঞান হয়ে পরেছিল ঝোপ ঝাড়ের ধারে । সকালে দুজন স্থানীয় বয়স্ক লোক ওকে ঝোপের ধারে পরে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে যায় নিজেদের বাড়িতে । মননের জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করল একটা অজানা ঘড়ে অপরিচিত জায়গায় বিছানায় শুয়ে আছে । ও উঠে বসল, ওকে উঠে বসতে দেখে স্থানীয় লোক দুটো ওর কাছে আসলো ।
“ তুমি কে বাবা? আর কি হয়েছিল?” স্থানীয় এক জন জানতে চাইল মনন কাছে ।
“ আমি মনন ,…. এ বলে মনন গত রাতের সব কাহিনী খুলে বলল তাদের কাছে।
“ হু… । গত দেড়শ বছরের মধ্যে তুমিই প্রথম মানুষ যেকিনা ঐ বাড়ি থেকে বেঁচে বের হয়েছ।’’ একটু থেমে আবার ও বলতে শুরু করলো বয়স্ক লোকটি, “ আমার বাপ দাদাদের আমলের কথা, এই গ্রামে তখন কালা যাদুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে, কারা যেন গোপনে ডাকিনী চর্চা করত । হঠাৎ করে গ্রাম থেকে ছোট ছোট বাচ্চা আর যুবতি মেয়েরা উধাও হয়ে যেতে থাকল , সবাই ভয়ে অস্থির হয়ে গেল , সন্ধ্যা না হতেই সবাই ঘরে ঢুকে দরজা জানালায় খিল দিত ।’’ বয়স্ক লোকটা বলতে থাকল আর মনন মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো ।
“ হঠাৎ গ্রামের এক জন দেখল, ঐ জঙ্গলে যে বড় বাড়িটা আছে ঐ বাড়ির আস পাশে নেকড়ের ভীর আর নেকড়েগুল কি যেন খাচ্ছে, নেকড়ে গুল যাবার পর ও কাছে গিয়ে দেখে যে নেকড়ে গুল লাশ খাছিল । ও গ্রামে এসে সবাইকে জানাল, গ্রামবাসিরা গ্রামের মাতবরের আপেক্ষায় রইল, মাতবর আসতে আসতে রাত হয়ে গেল , আর রাতে মাতবর সব শুনার পর ঠিক হল যে সবাই দল বেঁধে যাবে জঙ্গলে। জঙ্গলে এসে দেখল বাড়ির বাইরে লাশ পরে আছে। সবাই দল বেঁধে হাতে মশাল নিয়ে ঐ বাড়িটা ঘিরে ফেল্ল আর কয়েক জন দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকল আর গিয়ে যা দেখল তাতে ওরা বমি করতে করতে ঐ বাড়ি থেকে বের হল । ওরা এসে বলল ঐ বাড়িতে যারা আছে ওরা মানুষ না ওরা ডাইনি, ওরা রক্ত দিয়ে গোসুল করছে আর এক জন রক্ত মাখা কি যেন খাচ্ছে। ওদের দেখে তেরে এসেছিল , তার পর সবাই মিলে ভিতরে গিয়ে ডাইনি গুলকে বের করে এনে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ওদের ঐ বাড়িতেই আগুনে পুড়ে মারে। ওরা পাঁচ জন ছিল ।’’
“ তার পর?” মনন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাস করল ।
“ সেই রাত টা ছিল পূর্ণিমা রাত , এর পর থেকে প্রতি পূর্ণিমা রাতে ওরা ফিরে আসে আর কাউকে পেলে ওর রক্ত দিয়ে গোসুল করে । প্রতি পূর্ণিমা রাতেই আমরা ঐ খানে কাওর না কাওর লাশ পাই , তুমিই প্রথম যে কিনা বাঁচে বের হলে ঐ বাড়িতে ওদের হাত থেকে।”
মননকে লোকগুল ওর গাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিল , মনন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সোজা ডাবলিনের দিকে রওনা হল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল আর কোন দিনও এ মুখো হবে না । দূর থেকে একবার শুধু ঐ বাড়িটার দিকে তাকাল , তাকাতেই কেমন যেন ভয়ের একটা শিহরণ জেগে উঠল । মনে হল কে যেন তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ও আর কাল বিলম্ব না করে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল । আর আল্লাহ কে ওর নতুন জীবনের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে থাকল ।