অশুভ রাস্তা গল্প ১

অশুভ রাস্তা গল্প ১

২৮ বছর বয়স্কা ফ্লোরেন্স ওয়ারওইক রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করালেন। মনোযোগ দিয়ে এলাকার মানচিত্রটা দেখতে লাগলেন। আঁধার নেমে এসেছে। গাড়ির ভিতরের আলোতে একাগ্রচিত্তে মানচিত্রটার দিকে তাকিয়ে আছেন ভদ্রমহিলা। পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলোর হেডলাইট মাঝেমাঝে উজ্জ্বল আলো উপহার দিচ্ছে। হঠাৎই আবিষ্কার করলেন গাড়ির ভিতরটা ঠাণ্ডা বাতাসে ভরে গেছে। সময়টা মে,১৯৭৬। বছরের এ সময় আবহাওয়া হঠাৎ এমন শীতল হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে পেলেন না ফ্লোরেন্স। এসময়ই মনে হলো কে যেন একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। গাড়ির সামনের কাচ ভেদ করে বাইরে তাকালেন। বিশাল আকারের দুটো হাত চোখে পড়ল তার। মনে হলো উইণ্ডস্ক্রীনে চাপ দিচ্ছে। হাতের আঙুলগুলো কাঁচের ওপর যেন তবলা বাজাচ্ছে। তিনি ওগুলোকে দেখতেই আঙুলগুলোকে ব্যবহার করে হাতগুলো চলাফেরা করতে লাগল কাঁচের ওপর।

ফ্লোরেন্সের শরীর বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। আতংকে চোখ বড় বড় করে হাত-দুটোর ভীতিকর কাজ-করবার দেখছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল হাত জোড়া।

তবে এই রাস্তায় এমন ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। ফ্লোরেন্সেরই প্রথম এই অভিজ্ঞতা হয়নি। পোস্টব্রিজ থেকে ডর্টমুরের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার এই জায়গাটিতে যে-ই গাড়ি দাঁড় করিয়েছেন তাকেই পৈশাচিক এই হাত জোড়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ লোজনকে সতর্ক করে জায়গায় জায়গায় বোর্ড টাঙিয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে কারো যদি পেট্রোলে টান পড়ে বা গাড়ি মেরামতির প্রয়োজন হয় তবে রাস্তার আরেকটু সামনে এগুলেই তা মিলবে। চালকদের পরামর্শ দেওয়া হয় এই এলাকায় গাড়ি দাঁড় না করানোর আর এদিকটা অতিক্রমের সময়ই প্রয়োজনীয় সব কিছু পর্যাপ্ত পরিমাণে সঙ্গে রাখার জন্য। তারপরও অনেক আগন্তুক আগে থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানা না থাকায় মুখোমুখি হয়ে যান ভীতিকর দুই হাতের। এ ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা চলে আসছে আশি বছর হলো, যখন থেকে ভৌতিক সব ঘটনার শুরু তখন থেকে। যত বিপদই হোক গাড়ি চালকরা চান এই এলাকা দ্রুত অতিক্রম করে যেতে।

টরবেতে ফিরে এলেন ফ্লোরেন্স। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এখানে থাকেন তিনি। ত্রিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসলেও কীভাবে আবার গাড়িটা চালানো শুরু করেছেন আর কীভাবেই বা, ফিরে এসেছেন নিজেও জানেন না। টরবেতে পরিচিত জনদের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। মনে মনে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন, বন্ধুরা নিশ্চয়ই এটা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করবে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে তারা জানাল রাস্তায় মাঝে মাঝেই এমনটা ঘটে। এটাও বলল রাস্তার এই অংশটাতে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। আর অপ্রত্যাশিতভাবে দুই হাতের উপস্থিতিতে আতংকিত হয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছেন অনেক গাড়ি চালকই।

যতদূর জানা যায় ১৯২০ সাল কিংবা তার আশপাশের সময় থেকে এ ধরনের অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড-কারখানা শুরু হয় এই রাস্তায়। তখন তো এই রাস্তায় বেশি দেখা যেত ঘোড়া। প্রায়ই আতংকিত হয়ে সাওয়ারিদের ছুঁড়ে ফেলে দিত ঘোড়ারা। পোষা গবাদিপশু এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ভয় পেয়ে জোরে দৌড়তে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ত। সাইকেল চালকরা অস্বাভাবিক কিছু দেখে আতংকিত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড়ের খাদে পড়ত। একবার এক চিকিৎসক তাঁর মটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশেই সাইড কারে তার বাচ্চা দুটো। হঠাৎ মটর সাইকেলটা উল্টে পড়ল। তবে সৌভাগ্যই বলতে হবে চিকিৎসক আর তার দুই বাচ্চা সে অর্থে কোনো আঘাত পাননি।

১৯৪৫ সালের পর থেকে এই রাস্তায় অনেক চালকই গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য হাত দুটোকে দায়ী করেছেন। হাত দুটো কখনো কখনো, গাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে। এসময় গুডলোকে দেখে মনে হতে পারে কোনো আনাড়ী গাড়ি চালানো শেখার চেষ্টা করছে। আর গাড়ির ভিতরে ভুতুড়ে হাত দেখে কোন চালকেরই বা মাথা ঠিক থাকে! বেশিরভাগ সময়ই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারান তাঁরা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জেকব পিটার এক সাংবাদিককে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মসৃণভাবে আমার গাড়িটা চলছিল। পোস্টব্রিজের কাছে দুটি ছোট সেতু পেরোনোর পর আশ্চর্য একটা অনুভূতি হয় আমার। তারপরই দেখলাম দুটো হাত আমার হাতের ওপর চেপে বসেছে। ভয় পেয়ে গেলাম। এগুলো কার হাত কিছুই বুঝতে পারলাম না, কারণ হাত ছাড়া শরীরের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উল্টো দিক থেকে আসা একটা গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এক পাশে নিয়ে গেলাম গাড়িটা। হাতদুটো তখন আরো দ্রুত উল্টো দিকে ঘুরানোর চেষ্টা করল ওটাকে। বড় কোনো দুর্ঘটনা এড়ানো গেলেও জোরে রাস্তার ওপর লাফিয়ে পড়ল গাড়িটা।

একের পর এক দুর্ঘটনায় বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ বিকল্প রাস্তা তৈরি করল। কিন্তু মনে হয় গোটা এলাকাটাই শাসন করছে অশুভ হাত জোড়া। কারণ নতুন বিকল্প রাস্তাতেও সে ভড়কে দিতে লাগল চালকদের।

১৯৫৫ সালের ঘটনা। নব বিবাহিত এক দম্পতি গাড়ি নিয়ে এই রাস্তায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ প্রচণ্ড কুয়াশায় ঢেকে গেল চারপাশ। কুয়াশার কারণে একটু দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না, তারপর আবার সময়টা শীতকাল। রাস্তার পাশেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। সঙ্গে আনা খাবার খেয়ে গাড়ির পিছনের অংশে শুয়ে পড়লেন দুজনে। রাতে মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল। তার মনে হলো কেউ একজন গাড়ির দরজার কাঁচে টোকা দিচ্ছে। প্রথমে ভাবলেন এটা নিশ্চয়ই পাড়া বেড়ানো কুকুরের কাজ। শীতের থেকে বাঁচার জন্য ভিতরে আশ্রয় পাবার আশায় নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াচ্ছে। স্বামীর দিকের দরজার কাচে চোখ পড়তেই পাথর হয়ে গেলেন। দুটো ভয়ঙ্কর হাত চলাফেরা করছে কাচের ওপর। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। তারপরই অদৃশ্য হয়ে গেল হাত জোড়া।

এই অশুভ হাত জোড়া নিয়ে প্রচুর গল্প ছড়িয়ে আছে। এর কোনোটা সত্যি, কোনোটা আবার লোকের বানানো। তবে ১৯৬০ সালের একটা ঘটনা ভয়াল হাত দুটোর ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে ঘোরতর অবিশ্বাসীকেও বাধ্য করল।

রাস্তার অভিশপ্ত অংশটাতে নিজের গাড়ির ধবংস্তুপের নীচে পাওয়া গেল এক চালকের মৃতদেহ। গাড়িটা উল্টে গেছে। কিন্তু রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষের চিহ্ন নেই। গাড়ির এঞ্জিনও চমৎকার অবস্থায় ছিল। এমনকী অন্য কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটিরও আভাস মিলল না। ড্রাইভিং লাইসেন্স নিশ্চিত করছে ভদ্রলোক পাকা চালক। কারণ বারো বছর ধরে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মাতাল ছিলেন এমন কোনো তথ্যও পাওয়া গেল না।

পুলিশ আবিষ্কার করে মৃত ব্যক্তির হাত জোরে স্টিয়ারিংয়ের ওপর চেপে বসে আছে। আঙুল ভেঙে গেলেও স্টিয়ারিং থেকে হাত শিথিল করেননি ভদ্রলোক। ডিক কেলি নামের এই ভদ্রলোকের হাতে বল প্রয়োগের চিহ্নও মিলল। আতংকে বড় বড় হয়ে আছে তার চোখ। গলা নীচের দিকে বেঁকে আছে- যতদূর বোঝা যাচ্ছে ভীতিকর কোনো কিছুর দিকে কেন্দ্রীভূত ছিল তাঁর সমস্ত মনোযোগ।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত