মৃত ব্যাক্তির আত্মা

মৃত ব্যাক্তির আত্মা

কয়েক দিনের একটানা ভারি বর্ষণে গরমটা বোঝা যাচ্ছেনা। শীতকালের মতই যেন ঠান্ডা নেমে এসেছে।
ওটি (অপারেশন থিয়েটার) থেকে বের হতে ডাক্তার অমরেশের রাত এগারোটা বেজে গেলো।
এর পর কৃষ্ম পক্ষ চলায় বাহিরটা একবারেই ‍ঘুট ঘুটে অন্ধকার মনে হচ্ছে। অমরেশের স্ত্রী শুক্লা দেবী দু’দিনের জন্য ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গেছেন। কাল বিলম্ব না করে অমরেশ গাড়ি চালিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলেন।
মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বাবুর্চির রাখা টেবিলের খাবার খেয়ে নিলেন। এরই মধ্যে রাত বারটার ঘন্টা বেজে উঠলো।

বিছানায় গা দিতেই গেটে কার যেন কন্ঠ শোনা গেলো।
ডাক্তার বাবু,ডাক্তার বাবু – -।
অমরেশ জানতে চাইলেন, কে – – ?
উত্তরে আগন্তক বললেন,আমি ডাক্তার বাবু।
উত্তর পাহাড় থেকে এসেছি।
আমার বাড়িতে ভীষণ অসুস্থ রোগী।
মৃত্য যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে, চলুন বাবু। অমরেশ জানালেন এত রাতে তার যাওয়া সম্ভব হবেনা।
আগন্তক নাছোর বান্দা, বললেন বাবু চলেন বাবু।
আপনি না গেলে রোগী যে মারা যাবে ? অমরেশের মনে একটু দয়া হলো কিন্ত এত রাতে শহর থেকে দশ কিলোমিটার দুরে পাহাড়ি এলাকায় যাওয়া,সাহস হচ্ছেনা।
তারপরও পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তখনও বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।
দ্রুত রেইনকোর্টটি পড়ে নিলেন।
গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করার আগে রিভলবরে গুলি লোড করে কোমরে সাটলেন।
টর্র্সটিও সঙ্গে নিলেন।
গভীর রাতে ড্রাইভারকে ডাকা গেলনা। তাই নিজেই ড্রাইভ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আগন্তক বাইরে দাড়িয়ে ছিল।
তার গায়েও কালো একটি রেইনকোট,মাথায় হ্যাট ।
উঁচু- লম্বা,সুঠাম দেহের অধিকারি। অমরেশ তাকে পিছনে উঠতে বললেন। দু’জনের যাত্রা শুরু হলো।

শহরের ল্যাম্পপোষ্টগুলোর আলো ক্ষীণ হতে থাকলো। ধীরে ধীরে রাস্তাও গাড়ি শূণ্য হয়ে পড়লো। অমরেশ জিজ্ঞাসা করলে কত দূর -?
আগন্তক জানালেন এইতো সামনের মোড় ঘুরলে যে পাহাড় তার পরেই। অনেকটা পথ এগুলেন কিন্ত কোন লোকালয় দেখা যায়না। অন্ধকারে কেবল মনে হচ্ছে বোধ হয় সামনে কিছু একটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল ফাঁকা পথ।
অমরেশ আবার জানতে চাইলেন আর কতদূর বাবু – ?
আগন্তক বললেন, সামনেই।
পাহাড়ি রাস্তা আঁকা-বাঁকা,উঁচু-নিচু।
অল্প পথ পারি দিতেই অনেক সময় লাগে।
এভাবেই কেটে গেলো দু’ঘন্টা।
এবার অমরেশ রেগে বললেন আমি ফিরে যাবো।
আপনি গাড়ি থেকে নামুন ।
আগন্তকের সেই একই সুরে অনুনয়-বিনয়, ডাক্তার সাহেব সামনের বাগানটি আমাদের।
অমরেশ এগোতে থাকলেন।

হঠাৎ গাড়ির হেড লাইটের আলোতে গ্লাসের ভিতর দিয়ে যা অনুমান করা গেলো তাতে মনে হলো বাগানের মধ্যে যেন একটি প্রাসাদ। কাছে যেতেই আগন্তক বললেন, থামুন বাবু–
অমরেশ বলনে, কেন- ?
আগন্তককে এখানেই নামিয়ে দিতে অনুরোধ করলেন।
অমরেশ গাড়ি থামালেন।
দরজা খুলে নামতেই আগন্তকের হাত থেকে রেইনকোর্ট নেমে যাওয়া অংশে চোখ পড়ে অমরেশ আঁতকে উঠলেন। তিনি দেখলেন আগন্তকের ডান হাতের কব্জি হতে কনুইর দিকে গভীর ক্ষত। সেখানে রক্ত জমাট বেধে আছে ।
এটা পরিষ্কার তাকেও কারা যেন ছুরি কাঘাত করেছে ।
তিনি নেমেই চোখের পলকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এক পায়ে চলার পথে হারিয়ে গেলেন।
মনে হলো এটি প্রাসাদের পেছন রাস্তা।
ভয়ে সমরেশের গা হিম হয়ে আসতে লাগলো।
একবার মনে হলো তিনি ফিরে যাবেন কিন্তু একজন কর্তব্য পরায়ন চিকিৎসক হিসাবে বিপদগ্রস্থ রোগীকে না দেখে ফিরে যাওয়া বিবেক সায় দেয়নি।

গাড়ি সামনের দিকে চালাতেই বামে একটি বড় গেট দেখা গেলো। তিনি কিছু না ভেবেই সোজা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লেন।
গাড়ির আলোতে দৃশ্যমান হয়ে উঠলো বিশাল একটি পুরাতন প্রাসাদ। লোকজনের কোন সারা শব্দ নেই। চারদিকে অন্ধকার,প্রাসাদেও কোন আলো দেখা যাচ্ছেনা। গাড়ি থেকে নামার আগে টর্স লাইটি হাতে নিলেন।
দেখে নিলেন রিভলবার।
এবার গাড়ির দরজা লক করতেই হঠাত কোথ্থেকে দুজন লোককে খোন্তা-কোদাল হাতে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন।
একজন চিৎকার করে বললেন,ভাগো-! নইলে খুন করে ফেলবো।
অমরেশের বুঝতে বাকি নেই যে,তারা কোন লাশ দাফনের জন্য কবর খুঁরে আসলো।
আরেকজন কোদাল উঁচিয়ে সমরেশকে আঘাত করতে উদ্যত হলে তিনি রিভলবার তাক করে বললেন,তোমরা আর এক এগিয়েছো তো দু’জনকেই ‍গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। অস্ত্রের ভয়ে দু’জনই পালিয়ে গেল।
এক পা দু’পা করে তিনি প্রাসাদের ভিতরে ঢুকলেন,কিন্তু না ! কোথাও কোন মানুষের সারা শব্দ নেই।

চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ও পেচার ডাকে প্রাসাদটি ভুতরে মনে হচ্ছিল।
টর্স লাইটের আলো জালিয়ে এদিক-সেদিক ভালো করে দেখলেন।
লম্বা বারান্দার বাম দিকে একটি গলির মত মনে হলো। সেদিকে এগোতেই সামনে বড় একটি সিড়ি চোখে পড়লো।
খুব সাবধানে সমরেশ উপরে উঠে গেলেন। উপরের ঘরগুলো সবই বন্ধ।
তিনি আরো সামনের দিকে এগোলেন। ডান দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটি কক্ষের দরজা খোলা।
রিভলবার হাতে ঢুকে পড়লেন কিন্তু না এখানেও কেউ নেই। ওয়ালে আলো ধরতেই চোখে পড়লো কারেন্টের মেইন সুইচ।
কে যেন অফ করে রেখেছে।‍ সুউইচটি বেশ উচুতে থাকায় একটি চেয়ার টেনে উপরে উঠে অন করার সঙ্গে সঙ্গে কেবল কক্ষটি নয় গোটা প্রাসাদই আলোকিত হয়ে উঠলো। কক্ষের দামি আসবাব পত্র আর ওয়ালের গাত্র ও মেঝেতে শ্বেত পাথরের কারুকার্য দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন।
তিনি ভাবলেন এটা নিশ্চয়ই কোন সৌখিন জমিদারের খাস কামরা। পিছন ঘুরতেই একটি খাট চোখে পড়লো।
কে যেন শুয়ে আছেন।
কাছে গিয়ে দেখলেন চাদর দিয়ে ঢাকা। সমরেশ কয়েকবার ডেকেও তাকে জাগাতে পারলেন না।
তিনি ভাবলেন তাহলে ইনিই কি সেই অসুস্থ ব্যক্তি ?
আর যিনি তাকে ডেকে আনলেন তিনিই বা গেলেন কোথায় ?
এসব ভাবতে ভাবতে মুখের উপর থেকে কাপর তুলে রীতিমত ভয় পেয়ে গেলেন সমরেশ।
কাপড়ের নিচ থেকে ডান হাতটি বের করতেই চোখে পড়লো সেই কাটা দাগ । এই লোকটিতো তাকে ডেকে নিয়ে এলেন! এত শিগিরিই কে এমন দশা করলো তার ?
তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন।
সমরেশ তারাতারি তার পালস দেখলেন।
না,শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে।
দুই/তিন ঘন্টা আগেই তাকে খুন করা হয়েছে।
তিনি অনুমান করলেন খুনিরা তাকে হত্যার পর দুই ডোমকে দাফনের দায়িত্ব দিয়ে গেছে।
সমরেশ আর দেরি না করে গাড়িতে উঠেই স্টার্ট, সোজা শহরের দিকে রওনা দিলেন।
দশ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ যেন দশ মিনিটে পাড়ি দিলেন। ঘটনা যা দেখলেন
তা কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারলেন না।
মনে পড়লো তার বন্ধু কোতয়ালি থানার পুলিশ অফিসার মতিউর রহমানের কথা।
তাই বাসায় না ঢুকে গাড়ি ঢুকালেন থানার মধ্যে।
ডিউটি অফিসারকে বলে মতিউরকে ডাকালেন,তাকে তিনি সব ঘটনা খুলে বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ছুটলেন সেই প্রাসাদে । লাশ নিয়ে আসা হলো মর্গে ।
থানায় নিয়মিত মামলা হলো।
খুনিদের অনুসন্ধানে নামলেন পুলিশের ডিটেকটিভ — !!!!!

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত