বাসাটা একদম ছােট্ট!
অবশ্য একে বাসা বলাটাও বােধহয় ঠিক হলাে না। ছাদের ওপর খানিকটা জায়গা ঘেরা দিয়ে বাস উপযােগী করে দেয়া হয়েছে, বাড়তি কিছু ভাড়া পাবার আশায় বেশ বড়সড় একটা রূম, ছােট একটা রান্নাঘর আর একটা টয়লেট। মাথার উপরে টিনশেড। গরমের দিনে কী হবে, এটা ভেবে এখনই ভয় লাগে।
তবু রক্ষা যে থাকার মত একটা জায়গা পাওয়া গেছে। আজকাল ব্যাচেলারদেরকে কেউ তাে বাড়ি ভাড়া দিতেই চায় না। সবাই শুধু ভাড়াটে হিসাবে ফ্যামিলি খোজে। বাসাটা অবশ্য খুব একটা খারাপও না। গ্যাস-পানির সমস্যা নেই। দেরি করে আসলেও বাড়িওয়ালা সমস্যা করে না। তার চাইতেও বড় কথা, ভাড়াটা খুব কম। মাত্র দু হাজার টাকা। রীতিমত অবিশ্বাস্য যাকে বলে।
কে জানে, চারতলা বাড়িটার বাকি ফ্লোরগুলােতে অফিস বলেই হয়তাে ছাদের উপরের ঘরের ভাড়া এত কম। সন্ধ্যার পর থেকেই একদম সুনসান হয়ে যায় এত বড় বাড়িটা। বাড়িওয়ালাও থাকে বিশ মিনিটের দূরত্বে। অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই এ বাড়িতে সে আর সজল ছাড়া অপর কোনও মানুষ বাস করে না। একদম একা তারা দুজন।
ও, না, না, আরও একজন আছে! দারােয়ান আমজাদ মিয়া। কানে বলতে গেলে কিছুই শােনে না, চিৎকার করে গলা ফাটিরে ফেললেও লাভ নেই কোনও। ষাটের ওপরে হবে বয়স। সারাদিন আফিম খায়, আর পড়ে পড়ে ঘুমায় দরজার কাছে। কাজ-কর্ম বলতে এটুকুই তার। একদমই কোনও সমস্যা নেই এখানে। দুহাজার টাকায় এমন বাসা পাওয়া স্বপ্নের মত। শুধু একটি সমস্যা আছে। সমস্যা না বলে যন্ত্রণা বলাই বােধহয় ভাল…
আশরাফ এখনও অফিস থেকে ফেরেনি, অগত্যা নিজেই এসে রান্নাঘরে ঢােকে সজল। দু’বন্ধু পালা করে রান্না করে, তবে প্রায়ই দেরি হয়ে যায় আশরাফের। বেচারার অফিস গাধার খাটুনি খাটায়। জানুয়ারি মাসের আরামদায়ক ঠাণ্ডা শহরের বুকে খিচুড়ি খেতে ভালই লাগার কথা। তা ছাড়া আশরাফও খিচুড়ি খুব পছন্দ করে। সুতরাং যত্ন করে রান্নাটা বসায় সজল। তার নিজস্ব রেসিপিতে। অল্প তেলের মাঝে অনেকগুলাে কাটা পিয়াজ আর রসুন। সাথে সামান্য একটু আদা বাটা, হলুদ, লবণ দিয়ে ভেজে চাল আর মুসুরির ডাল দিয়ে একটু কষিয়ে নেয়া। সাথে দিতে হবে সামান্য কিছু ভাজা মুগডালও। কষানাে হয়ে গেলে কিছু সবজি দেয়া, যেমন-আলু, গাজর, ঝিঙা, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। এবার ফুটন্ত পানি আর তেজপাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া সিদ্ধ হবার জন্যে।
খিচুড়িটা খুব একটা ঝরঝরে হবে না, মাখামাখা থাকবে। পানি একটু শুকিয়ে এলে ভাল করে নেড়ে দেয় সজল। ফ্রিজে লাউয়ের শাক ছিল, সেগুলােই ভাল করে ধুয়ে দিয়ে দেয় খিচুড়ির মাঝে। কমিয়ে দেয় জ্বাল । এবার বাগাড় দেয়ার পালা…
কড়াইতে অনেকটা ঘি নিয়ে কিছু কাটা পিঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, এক টুকরাে দারুচিনি আর অনেকগুলাে কিসমিস ভেজে নেয় পিয়াজ লাল হওয়া পর্যন্ত। তারপর সবটুকু ছড়িয়ে দেয় খিচুড়ির ওপর। চমৎকার একটা সুগন্ধ
ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। অনেকটা খিচুড়ি রান্না করেছে, দারােয়ান বুড়ােকে একবার ডাকবে নাকি? অকর্মা হােক আর যাই হােক-বুড়াে মানুষ, খেয়ে খুশি হবে। ঠিক আছে, আশরাফ ফিরলে না হয় ডাকা যাবে। তিনজনে একসাথে খেতে বসবে। সারাদিনের ক্লান্তি আর জমে থাকা ঘাম শরীরে, অগত্যা তােয়ালে নিয়ে গােসলে চলে যায় সজল। গরম পানি তার সহ্য হয় ঠাণ্ডা পানিই পছন্দ। শাওয়ার ছেড়ে দিতেই ঝরঝর করে নামে পানির ধীরা, আরামে চোখ বুজে আসে সজলের। এবং তখনই….
তখনই শুরু হয় বাজনাটা! কিছুদিন হলাে এই এক নতুন সমস্যা হয়েছে। গভীর রাতে কে যেন এই অদ্ভুত বাজনা শােনে। অদ্ভুত আর বিরক্তিকর। কী একটা যন্ত্র এক নাগাড়ে বেজেই চলে আর বেজেই চলে। রুক্ষ, কর্কশ আওয়াজ। কার যে এই অদ্ভুত যন্ত্র সংগীত ভাল লাগে আল্লাহ মালুম। একদিন দুদিন না হয় সহ্য করা যায়, রােজ রােজ কী আর ভাল লাগে? প্রথম প্রথম এই রকম সমস্যা ছিল না, তা হলে তাে বাসাটা তখনই বদলে ফেলা যেত। এখন আর সম্ভব নয়। অনেকগুলাে টাকা আগাম দেয়া হয়ে গেছে। বাড়ি ছাড়তে গেলে পুরােটাই লস। এই বাজনার সাথেই যখন বসবাস করতে হবে, তখন মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে সজল। এবং মজার ব্যাপার হলাে মন দিয়ে শােনার চেষ্টা করলে খুব একটা খারাপও লাগে না। বরং ভালই লাগে…বেশ ভাল!!
কী যন্ত্র বাজছে, তা অবশ্য বুঝতে পারে না সে। কেননা সংগীত সম্পর্কে তার জ্ঞান অতি সামান্য। তবে এটুকু বুঝতে পারে যে বাজনাটা ভাল…খুবই ভাল। শােনার সাথে সাথে অন্যরকম একটা অনুভব হয় শরীরের মাঝে। কেমন যেন ঝনঝন করে ওঠে মনের মধ্যে, একটু একটু ঘােরের মতনও লাগে…
কেটে যায় বাজনার ঘাের, কেননা বাজতে শুরু করেছে কলিংবেল। আশরাফ ফিরেছে নিশ্চিত। কলিংবেলটার ওপরে বিরক্ত হলেও তড়িঘড়ি করে গােসল শেষ করে সজল। জানতেও পারে না যে এই কলিংবেলটাই আজ তাকে ভীষণ ভয়াবহ একটা কিছু থেকে রক্ষা করল! সে রাতে বিরক্তিকর বাজনাটার হাত থেকে রেহাই পেতে যখন কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমায় আশরাফ, তখন সতিই ভীষণ অবাক হয় সজল। তার কাছে তাে চমৎকার লাগছে। চমৎকার, অসাধারণ, অপূর্ব!
সেই অপূর্ব বাজনা শুনতে শুনতেই সেদিন পার হয়ে যায় সজলের রাত। এবং পরবর্তীতে আরও অনেকগুলাে রাত!!
দুই
রাত বাড়ার সাথে সাথে ছটফটানিটাও বাড়তে থাকে সজলের মনে। একটু একটু করে গুটি গুটি পায়ে শুরু হয় অস্বস্তির রূপ নিয়ে, ক্রমশ চেপে বসে মনের ওপর নিঃসঙ্গতা হিসেবে। তারপর একটু যেন ভয় ভয় লাগতে শুরু করে অকারণেই। আর একসময়…।
তীব্র আতঙ্কের চেহারা নিয়ে বন্ধ করে দিতে থাকে নিঃশ্বাস!! অজানা কোনও কিছুর অস্তিত্বের আতঙ্ক, নিজের বােধের বাইরের কোনও একটা কিছুর আতঙ্ক…কিন্তু কীসের যে এত আতঙ্ক, সেটাই বুঝে উঠতে পারে না সজল।
ইচ্ছা হয় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে, কিংবা দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে কোনভাবে মরে যেতেঅথবা… অথবা… রান্নাঘর থেকে ছুরিটা নিয়ে আমূল বসিয়ে দিতে নিজের বুকের মাঝে?
ছুরিটা ঠিকই হাতে নেয় সজল । হাত কাঁপে শুকনাে পাতার মত। তবু নিশ্চিত সে…নিশ্চিত যে আজ এই ছুরিটাকে তার বসাতেই হবে নিজের পাঁজর ভেদ করে। কী জন্যে এটা করতে হবে, তা তাে জানা নেই। কিন্তু করতে যে হবেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সজল। এবং ঠিক তখনই…।
ঠিক ওই মুহূর্তেই বাজতে শুরু করে সেই বাজনা । অপূর্ব, অসাধারণ সেই বাজনা শান্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শিথিল হয়ে আসে মুঠি, হাত থেকে খসে পড়ে ছুরিটা। এক পলকে মন থেকে উধাও হয়ে যায় আতঙ্কের সকল অনুভব।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সজল। উঁচু বাউণ্ডারির মাঝে নেহাত সাদামাটা একটা একতলা বাড়ি। মলিন, বিবর্ণ, একটি ঘরেও জ্বলছে না কোনও বাতি আর অন্ধকারের চাদরে ডুবে থাকা সেই বাড়িটাই হচ্ছে অপূর্ব এই বাজনার উৎস। মনে হচ্ছে যেন হাওয়ার শরীরে ভর করে ভেসে ভেসে আসছে সেই বাজনা। কেবল মাত্র তারই জন্যে!
অনেকটা সময় নিজেকে হারিয়ে বাজনা শােনে সজল। অনেক… অ-নে-কটা সময়। এবং একসময় নিজের অজান্তেই দরজা খুলে বের হয়ে যায়।
বের হয়ে যায় সেই অপূর্ব বাজনার উৎসের সন্ধানে!!
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে সজলকে রীতিমত অসুস্থই দেখে আশরাফ। চোখ টকটকে লাল, মুখ ফুলে আছে-রাতে ঘুমায়নি নিশ্চিত! মানুষটা যে রাতে কখন ফিরেছে, তাও জানা নেই।
কাল রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় এগারােটা বেজে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে দরজা হাট করে খােলা। চুলায় ডিম সিদ্ধ বসানাে হয়েছিল, সেই ডিম পুড়ে-টুরে একাকার। টেবিলের ওপর রাখা চিরকুটে লেখা অপেক্ষা করে খেয়ে নিতে।
অবশ্য অপেক্ষা আশরাফ ঠিকই করেছিল। কিন্তু সারাদিনের পরিশ্রমের পর কখন যে চোখ বুজে এসেছিল, নিজেও বলতে পারবে না। নানা রকম দুশ্চিন্তা তখন ভর করেছিল মাথায়। এবং এখন তাে সজলের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ঘটনা বােধকরি সত্যিই গুরুতর। অফিসে যাচ্ছে, অথচ শার্টটা পর্যন্ত ঠিক করে পরেনি সজল, চুলগুলাে আঁচড়ায়নি। টেবিলে বসে ঝিমুচ্ছে মুরগির মতন।
প্রথমে তাই কিছু জানতে চায় না আশরাফ। ডিমের অমলেট করে বেশি মরিচ-পিয়াজ দিয়ে, আর সজলের জন্যে ডাবল ডিমের পােচ করে পুরু মাখন মাখায়, কড়া লিকারের চা তৈরি করে বাজিয়ে দেয় বন্ধুর দিকে।
‘তােকে দেখি মুরগির ঝিমুনি রােগে ধরেছে। ঝটপট এটা গিলে ফেল তাে! এক ঢেকে গিলবি!
একটু হাসার চেষ্টা করে সজল, তবে কাপটীতে ঠিকই চুমুক দেয়। টিফিন বক্সে দুপুরের খাবারটাও রেডি করে দেয় আশরাফ। আজকে আর বাইরে লাঞ্চ করিস না। কাল রাতে চাইনিজ ফুড আনছিলাম দুজনে খাব বলে। ফ্রাইড রাইস, প্ৰণ বল আর চিকেন ভেজিটেবল কারি। সেটা গরম করে দিলাম। দুপুরে লাঞ্চ করিস।
তুই কাল রাতে খাসনি? হাসে আশরাফ। তােকে ছাড়া কোনওদিন ডিনার করছি আমি?” এখন থেকে করতে হবে। কেমন যেন এলােমেলাে শােনায় সজলের কণ্ঠ।
‘আমি মিউজিক ক্লাসে ভর্তি হইছি। রােজ রাতে ক্লাস। এইটা আবার কোন দেশি স্কুল যে রাতে ক্লাস?
‘স্কুল না…ওই যে আমাদের পাশের বাসায় যিনি রাতের বেলা বাজনা বাজান, উনার কাছে শিখব।’
“কিন্তু তাের অফিস? রাতে বাজনা শিখলে ঘুমাবি কখন? ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’ একটু যেন রূঢ়ই শােনায় সজলের কণ্ঠ। তবে আশরাফ বােধহয় লক্ষ করে না। বলে, “শিখবি যখন, অফিসের পর সন্ধ্যা বেলা শেখ। গভীর রাতে শেখার দরকার কী? এবং সাথে সাথে অকারণ রাগে গম্ভীর হয়ে ওঠে বন্ধুর মুখ । আমার যখন শিখতে ইচ্ছা হয়, তখন শিখব। সব কাজ তােকে বলে, তাের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে করতে হবে নাকি? নাস্তা দূরে থাক, চা টুকুন পর্যন্ত শেষ না করে বেরিয়ে যায় সজল। পেছনে পড়ে থাকে টিফিন বক্স। এবং বিস্মিত আশরাফ।
তিন
দুহাতে কান চেপে ধরে বিছানার উপর বসে থাকে আশরাফ অসহ্য এই বাজনা! এর যন্ত্রণায় একটু গান শােনারও উপায় নেই। হেডফোন ভেদ করে যেন মগজে পৌছে যায় আওয়াজ। সংগীত চর্চা করতে হবে ভাল কথা, কিন্তু এত রাতে কেন? এখন তাে মনে হয় এই বাজনার যন্ত্রণাতেই এবাড়ির ভাড়াটেরা সব পালিয়ে যায় । এই জন্যেই ভাড়া এত কম। বাজনাটা শুনলেই এখন মেজাজ চিড়বিড় করতে থাকে আশরাফের। এই অপয়া বাজনার কারণেই সজলের মত ভাল বন্ধুকে হারাতে হয়েছে। আজকাল তাে সজলের সাথে দেখা প্রায় হয়ই না। কথা হয় আরও কম। গত এক সপ্তাহে একটা কথা হওয়া দূরে থাক, একবার মুখখামুখি দেখা পর্যন্ত হয়নি দুজনের।
একটা পত্রিকা অফিসে চাকরি করত সজল। বোধহয় ডিউটি বদলে নাইট শিফটে নিয়ে নিয়েছে। গভীর রাতে ফেরে সে, সম্ভবত ভােরের আগে আগে। আশরাফ তখন গভীর ঘুমে, দেখা হবার সুযােগ নেই। আর সকালে যখন আশরাফ বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশে, তখন চাদর মুড়ি দিয়ে বেঘােরে ঘুমায় সজল। আবার রাতে আশরাফ বেরিয়ে যাবার আগেই বােধহয় চলে যায় বাজনা শিখতে। কারণ বিগত দিনগুলােতে একদিনও ফিরে বন্ধুকে ঘরে পায়নি সে।
সে যাই হােক, সেদিনকার সেই সকালের পর আশরাফও আসলে আর চেষ্টা করেনি এই বাজনা শেখার ব্যাপারে কিছু বলতে । মনে মনে খুব আশা করেছিল সজল এসে নিজের রূঢ় ব্যবহারের জন্যে স্যরি বলবে। কিন্তু বাস্তবে আসলে সেরকম কিছুই ঘটেনি। ক্রমশ আরও দূরে চলে গেছে সজল। বাজনা ক্রমশ উচ্চ থেকে উচ্চ গ্রামে উঠছে। এই কর্কশ আওয়াজ কীভাবে কারও ভাল লাগতে পারে, সেটাই এখন পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি আশরাফ । কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমশ সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে।
বাজনার উৎস বাড়িটার ব্যাপারে কিছু খোঁজ-খবর করার চেষ্টা করেছিল সে। তাদের বিল্ডিংটার ঠিক উল্টো দিকেই বাড়িটা। কে থাকে, কী করে-এইসব হাবিজাবি খবর নেয়াটা কঠিন হবার কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হলাে এই গলিতে অপর কোনও বাড়ি নেই যে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে খোঁজ নেবে। আর তাদের দারােয়ান তাে বােধহয় জগতের বধিরতম মানুষ। ‘কালা বলেই তাে এই বাড়ির দারােয়ান!!’ আপন মনেই বিড়বিড় করে আশরাফ। বিছানা থেকে নেমে স্যাণ্ডেল গুলিয়ে নেয় পায়ে । আজ তাকে এই বাজনার ব্যাপারটা একটা সমাধান করতেই হবে!
আগে কখনও যা হয়নি, আজ তাই হয়। বাজনাটা কানে যাওয়ার সাথে সাথে কেমন যেন শিরশিরে একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীরের আনাচে- কানাচে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই হাত-পাগুলাে চায় একটা দৌড় দিতে। অথচ মনকে চরম ভাবে আকর্ষণ করে রাখে অদ্ভুত সেই বাজনা। শুনতে শুনতে কেন যেন আশরাফের মনে হয় অপার্থিব এই সুরের সৃষ্টি মাটির পৃথিবীতে নয়। মানুষের বােধের বাইরের অন্য কোনও জগতে, অন্য কোনও ভুবনে। অবাস্তব কোনও জগতে নিঃসন্দেহে। কেননা অসম্ভব… পৃথিবীর বুকের কোনও সুর এটা হতেই পারে না!
গাঢ় অন্ধকারে ডুবে আছে গােটা বাড়িটা। দাঁড়িয়ে আছে যেন কেবল একটা অন্ধকার অবকাঠামাে। ভেতরে ঢােকার বিশালাকৃতি গেটটা যখন অনেক ধাক্কাধাক্কির পরেও একতিল নড়ে না, তখন খােদার নাম নিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়ে আশরাফ। আর গিয়ে সােজা পড়ে না জানি কত বছর পরিষ্কার না করা আগাছার জঙ্গলের মাঝে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে দীর্ঘ অনেক অনেকগুলাে মুহূর্ত। না… তেড়ে আসে না কোন পাহারাদার। ন্যূনতম সাড়াশব্দও পাওয়া যায় না মানুষ অথবা অন্য কোনও প্রাণীর।
ব্যাপারটা একটু অবাকই লাগে। আর ভয়ংকরও। মানুষ না হয় নেই, কিন্তু অন্য কোনও প্রাণীর সাড়াশব্দ থাকবে না কেন? পরিত্যক্ত পুরানাে বাড়ি, চারপাশ ঘিরে থাকা জঙ্গলটা এককালে বাগান ছিল নিশ্চিত। এখন সে জৌলুস নেই ঠিকই, তবে গাছপালা তাে কমেনি আর ।
বরং বেড়েছে। সুতরাং আর কিছু না হােক, রাতজাগা কিছু প্রাণীর আওয়াজ তাে থাকবে অবশ্যই। নিদেনপক্ষে ইদুর আর ঝিঝি পােকা অন্তত । কিন্তু না….
কেউ নেই, কিছু নেই। অন্তহীন, সুনসান নীরবতা শুধু চারপাশে জানে না কেন নিঃশব্দে চুপিচুপি এগােয় আশরাফ। বুকের মাঝে অদ্ভুত এক রকমের অস্বস্তি বােধ, এত জোরে আওয়াজ করছে হৃৎপিণ্ড যেন বের হয়ে আসবে পাঁজর ছেড়ে। অকারণেই!!
বুনাে গােলাপের গন্ধে ভারী আওয়াজ, দম নেয় দাঁয়। তবুও বাড়িটার ঠিক সামনে ফুলের সমারােহ দেখে বিস্মিত হয়ে পড়ে সে। বুনাে গােলাপের ঘন ঝাড়ের মাঝে ছােট্ট একটা ডােবার মত, তাতে ভরা টলটলে পানিতে, আলাের অপার্থিব প্রতিফলন। ডােবাটা জুড়ে ফুটে আছে না জানি কত অসংখ্য পদ্ম আর শাপলা। এবং তাদের রঙ নীল…আকাশের মত নীল। আর কী অসম্ভব সুন্দর সেই নীল!!
পাঁচ
মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আশরাফ। জীবনে কখনও নীল পদ্ম কিংবা শাপলা দেখেনি সে। এসব ফুল যে নীল-ও হতে পারে, সেটাই জানা ছিল না তার। নীল হলাে তা হলাে, এতটা অপূর্ব নীল?
তবে বেশিক্ষণ দেখার সময় হয় না। কেননা ক্রমশ উচ্চগ্রামে উঠছে বাজনা । উঠছে তাে উঠছেই। আর অসহ্য হয়ে পড়ছে ক্রমশ… ভারি কাঠের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে আশরাফ। একবারও ভেবে দেখে না যে গাঢ় অন্ধকারে ডুবে থাকা এই বাড়িতে থাকতে পারে কোনও অস্বাভাবিকতা, লুকিয়ে থাকতে পারে কোনও বিপদ…. সুনসান এই বাড়িটির অন্ধকার চাদরের আড়ালেই রচিত হতে পারে তার জীবনের সর্বশেষ অধ্যায়। বুকের মাঝে নিঃশ্বাস আটকে দরজার আড়াল থেকে ভয়াবহতম দৃশ্যটা দেখে আশরাফ!
হাত-পা কাঁপে, পেটের মাঝে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আসতে চায়, মেরুদণ্ড বেয়ে নামে আতঙ্কের হিমশীতল অনুভব। তবু তাকিয়ে দেখে আশরাফ। আর দেখতেই থাকে… বাড়িটার ঠিক মাঝখানে এই উঠানের মত জায়গাটা-বাড়িটার কেন্দ্র বিন্দু। মাথার ওপরে ছাদ নেই কোনও, মেঝে বাঁধানাে মার্বেল পাথরে । চাঁদের নীলাভ-সাদা আলােয় আরও যেন বেশি অন্ধকার ঠেকাছে সবকিছু। জোছনার চাদরের ঠিক নীচে বসেই বাজাচ্ছে সে! বাজাচ্ছে আর বাজিয়েই চলেছে…
অশীতিপর এক বৃদ্ধ। গায়ের রঙ শুভ্র, নিম্নাঙ্গে সাদা এক টুকরাে কাপড় জড়ানাে কেবল। মাথার টাকে চুল অবশিষ্ট আছে কয়েক গুচ্ছ মাত্র। তাও ধবধবে সাদা। কানের ভেতর থেকেও বের হয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ কুৎসিত সাদা চুল।
আর এতটাই হাড় জিরজিরে শরীর তার-যেন জীবন্ত কোনও কঙ্কাল। নিজের চাইতেও বড় আকারের একটা বাদ্যযন্ত্র দুহাতে ধরে বাজিয়ে চলেছে। অনেকটা যেন তানপুরার মত দেখতে, কিন্তু ঠিক তানপুরা নয়। কদাকার দর্শন আজব একটা বাদ্যযন্ত্র। চোখ বন্ধ সেই বৃদ্ধের। বাজনার তালে এমন ভয়ানক ভাবে দুলছে যেন মাথা খসে পড়ে যাবে দেহ থেকে। কুঁচকানাে চামড়ার ওপরে কালাে কালাে কুৎসিত ফোঁটা ফোঁটা দাগ…
বলে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না, প্রথম দর্শনই বলে দেয় যে এই বৃদ্ধ পৃথিবীর কোনও মানুষ নয়। অন্য কোনও প্রাণী সে, অন্য কোনও কিছু। এবং তার মুখােমুখি বসে একই রকম আরও একটা যন্ত্র বাজাতে থাকা প্রাণীটাও দেখতে হুবহু তার মত। হুবহু!! এক টুকরাে সাদা কাপড় জড়ানাে শরীর, টাক মাথা, কান থেকে বের হওয়া কদাকার চুল, বাজনার তালে দুলতে থাকা মাথা… হায় খােদা! এ তাে সজল!
এতটা শুকিয়ে গেছে যে পেট লেগে গেছে পিঠের সাথে, চামড়া কুঁচকে গেছে নব্বই বছরের বৃদ্ধের মত। একসাথে থেমে যায় বাজনা। হঠাতই!! আর একসাথেই ফিরে তাকায় প্রাণী দুটি। তাদের টকটকে লাল চোখগুলাে তাকিয়ে থাকে সােজা এবং সরাসরি আশরাফকে লক্ষ্য করেই। একসাথে দাঁত খিচিয়ে আজব এক ভঙ্গি করে দুজনেই, যেন হিংস্র কোনও প্রাণী। তাদের হিসসস…হিসসসস গর্জন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসতে থাকে অনবরত। অবিরাম। এবং একই সাথে দুজনে লম্বা একটা লাফ দেয় আশরাফের শরীরটাকে উদ্দেশ্য করে!
ছয়
ছুট..ছুট…ছুট…
কাটা ভরা জঙ্গল বেপরােয়া ভাবে মাড়িয়ে জীবনটা হাতে নিয়ে ছােটে আশরাফ। শরীরের এখানে-সেখানে রক্ত ঝরছে, প্রাণীগুলাের দাঁতের চিহ্ন। সুযােগ পাওয়া মাত্র কামড়ই বসাতে চেয়েছে প্রাণীগুলাে। কী করে যে তাদের হাত থেকে রক্ষা পেল, নিজেও বলতে পারবে না তা।
এত কিছুর মাঝেও সজলের জন্যে চোখ ফেটে কান্না আসে। কী হয়েছে সজলের? এইসব কী হয়েছে? এই প্রাণীটা কী করেছে তাকে?
…পেছনে পাওয়া যাচ্ছে ছুটন্ত পায়ের আওয়াজ। এগিয়ে আসছে কাছে।
ক্রমশ আর ক্রমশ…
…ওটা কি দেয়াল?
হ্যা, বাউণ্ডারির দেয়ালই তাে মনে হচ্ছে। একবার উঠে যেতে পারলেই… তরতর করে তাই দেয়াল বায় আশরাফ। আর একটু…এই তাে, আর মাত্র একটু… দেয়ালে চড়ে বসতেই একটা হাত আঁকড়ে ধরে পা! কঠিন মুঠিতে। খামচে ধরে। আর টেনে নামাতে চায় সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে। একটার ওপরে আরেকটা চড়ে বসেছে প্রাণীগুলাে। নীচে সজল, ওপরে বুড়াে পিশাচটা।
দেয়ালের প্রান্ত আঁকড়ে প্রাণপণ ঝুলে থাকার চেষ্টা করে আশরাফ। হাত ছিলে রক্তাক্ত হয়ে যায়, উপড়ে আসে নখ। এদিকে ক্রমশ জোরদার হয় বুড়াে পিশাচের হাতের মুঠি। দুহাতে অমানুষিক জোরে টানছে সে, ইঞ্চি দুয়েক লম্বা নখ গেঁথে বসে যাচ্ছে মাংস ভেদ করে… তীব্র ব্যথায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে আশরাফ। পিশাচটা এবার শ্বাপদের মত কামড় বসিয়েছে পায়ের ওপর । নাছােড়বান্দার মত কামড়ে ধরে ঝুলে আছে।
উন্মাদের মত পা ছেড়ে আশরাফ। সজোরে লাথি কষাতে থাকে বুড়াে পিশাচটার মাথায়। লাভ হয় না কোনও, বরং কামড়ে এক খাবলা মাংস তুলে নেয় সে আশরাফের পা থেকে। আর চিবুতে থাকে আক্রশী ভঙ্গিতে… দুচোখ ফেটে পানি গড়ায়, তীক্ষ ব্যথায় এক নাগাড়ে চিৎকার করতে থাকে আশরাফ। বাঘের কবলে পড়া শিকারের মত ছটফট করতে থাকে। ‘এইটা লন ভাইজান…এইটা লন!! এক কোপে নামায় দ্যান শুয়ারের বাচ্চার গলা…’ আমজাদ আলী!!
প্রায় বধির, অকর্মার ঢেঁকি, বৃদ্ধ আমজাদ আলী । চড়ে বসে আছে দেয়ালের ওপর। বাড়িয়ে ধরে আছে ইয়া মস্ত এক রাম দা । তাড়াতাড়ি করেন ভাইজান… শুয়ারের বাচ্চাটা আপনেরে খায়ে ফেলতে চাইতেছে… এক কোপে মাথা নামায় দ্যান!’ তাই করে আশরাফ। অক্ষরে অক্ষরে তাই করে, ঠিক যেমনটা বলে আমজাদ আলী। অন্ধের মতন রাম দা-টা শুন্যে ঘােরায়…আমজাদ আলী গায়ের জোরে টানতে থাকে তাকে…দুজনে গড়িয়ে এসে পড়ে দেয়ালের অপর প্রান্তে। এরপর আর কিছু মনে নেই আশরাফের। কী হল, কীভাবে হলাে..কিছুই মনে নেই!
পরিশিষ্ট
বাসাটা খুব সুন্দর। একদম ছবির মত। ছােট্ট গােছানাে আপার্টমেন্ট, জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে লেকের গাঢ় নীল পানি। কিছুদিন পরেই ঠাণ্ডায় এ পানি জমে বরফ হয়ে যাবে। তখন তরুণ-তরুণী আর বাচ্চারা এর ওপর মহা আনন্দে আইস স্কেটিং করবে।
এক কাপ কফি হাতে বারান্দায় বসে থাকে আশরাফ। সেদিনের সেই ভয়াল রাতের পর থেকে একটা পা টেনে টেনে হাঁটতে হয় তাকে। দাঁড়ানাে বা হাঁটাচলার সমস্ত কাজকেই ভীষণ কষ্টকর মনে হয়। নতুবা আইস স্কেটিং নিঃসন্দেহে তার নিজেরও প্রিয় স্পাের্টস হতে পারত।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। অনেক অনেকটা সময়: তবে সেদিন থেকে এক বিন্দু ম্লান হয়নি তার ভয়াবহতা। সুস্থ হতেই অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল তার। প্রায় ছয় মাস। স্বাভাবিক বােধবুদ্ধি যখন ফিরে পেয়েছিল, ততদিনে পার হয়ে গেছে পনেরাে বিশ দিন। তবে আমজাদ আলীর কাছে শুনেছে পুলিশ কেস নাকি হয়েছিল। কিন্তু পুরাে বাড়ি খুঁজে কাউকে বা কোনও কিছুকে পায়নি পুলিশ। সে যাই হােক না কেন, মাতৃভূমির বাতাসও তখন বিষাক্ত লাগতে শুরু করেছিল আশরাফের কাছে। তাই তাে এত দূরে এই কানাডায় পালিয়ে আসা।
আমজাদ আলী অবশ্য সেই বাড়িতেই আছে। সে কানে খাটো, প্রায় বধিরই বলা যেতে পারে। কুৎসিত সেই বাজনার কোনও প্রভাব পড়ে না তার ওপর। তার ভাষ্য হচ্ছে-“এই বুড়া বয়সে আজাইরা টানাটানি কইরে কী লাভ ভাইজান? বিশ বছর এইখানে আছি। না আছে সংসার, না আছে পরিবার। যে কয়দিন বাঁচি, এইখানেই থাকব । আপনের মত আর কেউরে পাইলে তারে বাচাব…’
কেন যেন সব কথা শুনে আশরাফের মনে হয়েছে-তার বেলাতেই প্রথম। নয়, এর আগেও আমজাদ আলী দেখেছে এইরকম কিছু… ফোন বাজছে।
একটু নয়, বেশ অনেকটাই অবাক হয় আশরাফ। এমন অদ্ভুত সময়ে কে ফোন করল তাকে? সে তাে এখন পর্যন্ত দেশে কাউকে ফোন নম্বরই দিয়ে উঠতে পারেনি। মাত্র তাে আজ লাগল ফোনটা!
‘হ্যালাে!
শরীরে আতঙ্কের হিম হিম স্রোত তুলে শ্রবণ যন্ত্রে প্রবেশ সেই বাজনা … হ্যা, ভয়াল সেই বাজনাই। কোনও সন্দেহ নেই তাতে। কোনও সন্দেহ নেই!
কুৎসিত, কর্কশ সেই বাজনা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে আশরাফের শরীরের, মস্তিষ্কের প্রতি বিন্দুতে। সরীসৃপের মত ঘুরপাক খেতে থাকে তার অস্তিত্বের মাঝে।
কেন যেন আশরাফের মনে হয়…
মনে হয় যে ফোনের অপর প্রান্তের বাজনাটার উৎস হচ্ছে সজল। কিংবা সজল রূপী সেই কর্দর্য পিশাচটা!
(সমাপ্ত)