অপচ্ছায়া

অপচ্ছায়া

ধুপ! ধুপ! ধুপ!

কারও পায়ের শব্দ!

ছাদে মিলিটারির মার্চ করার ভঙ্গিতে কেউ একটানা পায়চারী করে চলেছে। ভয়ে জিভ শুকিয়ে গেল মায়ার। আজ মাত্র চব্বিশ দিন হলাে এই বাসায় এসে উঠেছে ওরা। এই প্রথম একাকী এভাবে আছে সে। সত্যি বলতে কী এই প্রথম তার ঢাকায় আসা। আর সেটা একেবারের জন্যই। অপরিচিত এই শহরে সব অচেনা লাগে তার। কিন্তু আর কিছুই করার ছিল না। উভয় পক্ষের সম্মতিতে বিয়ে করবে ভেবে দীর্ঘ ছ’বছরে প্রেমের পরে যখন পরিবারকে বিয়ের কথা জানাল, দুই পরিবারই বেঁকে বসল। প্রেমের বিয়ে-এটাই আপত্তি তাদের। ছেলে মেয়ে প্রেম করেছে এতেই মান-সম্মান চলে গেছে দু’পক্ষের গার্জিয়ানের। শেষ পর্যন্ত তানভীরের সিদ্ধান্তে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেলল ওরা। ভেবেছিল একবার বিয়ে করে ফেললে দুই পরিবারই মীমাংসা করে মেনে নেবে তাদের। কিন্তু উল্টো খেপে গেল। দুই পরিবারই মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। তানভীর পুরুষ মানুষ, তার যেটুকু না সমস্যা হচ্ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যা হচ্ছিল মায়ার।

বাসা থেকে সবাই চাপ দিচ্ছিল কাজী অফিসের নাম কা ওয়াস্তে’ বিয়ে, ঝেড়ে ফেলে তার দুলাভাইয়ের আনা বিদেশি পাত্রের সাথে বিয়ে বসে সুখের দেশ ইতালীতে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সব কিছু ঝেড়ে ফেলার জন্য তানভীরকে বিয়ে করেনি ও। সে কারণে তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেরাই নিজেদের পরিবারকে ঝেড়ে ফেলে লালবাগ কেল্লার কাছাকাছি এই লিফটবিহীন বাসার সাততলায় এসে উঠেছে।

সন্ধের আলাে মিলিয়ে রাত নেমে গেছে। আর এই অঞ্চলের সিস্টেমটা অদ্ভুত। বিকেল বেলা এমনকী ঠিক সন্ধের আগ পর্যন্ত ঠিকই ইলেকট্রিসিটি থাকে। তারপর যেই মাগরিবের আজান পড়ল সাথে সাথে বিজলী বিবির আর দেখা নেই। ডুবে যেতে হয় হতচ্ছাড়া অন্ধকারে। তারা এখনও ঠিক সংসার গুছিয়ে উঠতে পারেনি। সামান্য মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরির বলে তানভীর সাহস করে সংসার পেতেছে। এখনই জিনিসপত্রের ফিরিস্তি দিয়ে তানভীরের ব্যস্ত মাথাটাকে সে আর অস্থির করে দিতে চায় না। অল্প কিছু চলার মত আসবাবপত্র নিয়ে গুছিয়ে ফেলেছে ছােট্ট দুই রুমের সংসার।

চৈত্রের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে তানভীর অনেক কষ্টে কোথেকে গুলিস্তানের কোনও চোরাই মার্কেট থেকে একটা সবুজ রঙের সেকেণ্ডহ্যাণ্ড ফ্যান কিনে নিয়ে এসেছে। মায়া ভেবেছিল ওকে একটা চার্জার লাইটের কথা বলবে। কিন্তু রাতে এত ক্লান্ত হয়ে ফেরে দেখে এত মায়া লাগে যে আর কোনও কিছু কেনার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া তানভীর রাতে যখন আসে তখন ইলেকট্রিসিটি থাকে আর ও বেরিয়ে যায় ভাের বেলা। ওর চোখে লােডশেডিংয়ের ব্যাপারটা ধরাই পড়ে না। তাদের ফ্ল্যাটটা ছয়তলা বিল্ডিঙের ছাদের উপর দুই রুমের একটা বাসা।

এটাকে ঠিক চিলেকোঠাও বলা যায় না। ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে ভাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি করা। তানভীর অবশ্য ভাড়া নেয়ার সময় বলে নিয়েছে ছাদটাও তাদের অধিকারে। প্রয়ােজন হলে ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত কিছু টাকাও দিয়ে দেবে। পুরানাে ঢাকার বয়স্ক বাড়িওয়ালা অবশ্য আর ছাদের জন্য ভাড়া নেয়নি। জানিয়েছে ছাদটা তারা নিজেদের মত করে ব্যবহার করতে পারবে। শুধু দরকার পড়লে বাড়িওয়ালারা একটু আধটু ব্যবহার করবে। ছয়তলার উপর হেঁটে হেঁটে কোনও ফ্যামিলি উঠবে এটা বাড়িওয়ালা আশা করেনি। এর আগে ছাত্ররা মেস করে থাকত।

ধুপ! ধুপ! ধুপ!

মিলিটারির মার্চ এখনও চলছে। এবারে একটু থেমে থেমে। ভারী জুতাের মানুষটা এখনও ছাদে ঠিকই পায়চারী করছে। মায়া বিছানার উপর ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে রইল। রাস্তার দিকের জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে কিছুটা আবছা আলাে এসে পড়েছে। সেই আবছায়ায় ঘরের মধ্যের সবকিছু ছায়া ছায়া লাগছে। কোন আধিভৌতিক অবয়ব সব। তার বুকের মধ্যে ধুকপুক করতে লাগল। ডাইনিং-এর সাথে লাগােয়া রান্নাঘরে ম্যাচ আছে। বেডরুম ছেড়ে যেতে ভয় ভয় লাগছে। মােমবাতি গতকাল ফুরিয়েছে। তানভীরকে সে আনতে বলতে ভুলে গেছে। তানভীর এত সকালে বের হয় যে তখন কিছু আনতে বলতেও মনে থাকে না। আরও কয়েকটা দিন গেলে সে সাততলা থেকে নেমে নীচের দোকান থেকে সংসারের প্রয়ােজনীয় টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে আসতে শুরু করবে। ছাদের ধুপ-ধাপ শব্দটা যেন এবার তাদের ছাদের লাগােয়া ড্রইংরুমের দরজার দিকেই এগিয়ে আসছে। মায়া ভয়ে আরও শক্ত করে বালিশ আঁকড়ে ধরল।

ঠক! ঠক! ঠক!

ডাইনিঙের বন্ধ দরজার সামনে মিলিটারি বুট থেমে কাঠের দরজায় শব্দ হলাে।

মায়া কী করবে দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। অন্ধকারে রান্নাঘর থেকে হাতড়ে দা-বটি কিছু হাতে তুলে নেবে? নাকি জানালার কাছে যেয়ে চিৎকার করে ছয়তলার বাসিন্দাদের কাছে সাহায্য চাইবে! কিন্তু যদি ব্যাপারটা তেমন ভয়াবহ কিছু না হয়? তা হলে অতিনাটকীয় ব্যাপার হয়ে যাবে। আর তাকে কী লজ্জায় না পড়তে হবে! আবার দরজায় ঠক ঠকাঠক শব্দ। এক নাগাড়ে।

মায়া সন্তর্পণে বিছানা থেকে নামল। চোখ সওয়া আলােয় পরিচিত রান্নাঘরের দিকে গেল। নির্দিষ্ট জায়গা থেকে হাতে তুলে নিল নির্দিষ্ট জিনিসটা। তারপর দুরু দুরু বুকে পায়ে পায়ে হেঁটে চলে এল ড্রয়িংরুমের দরজার কাছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কে? কে ওখানে?

ওপাশ থেকে ঘড় ঘড় গলায় আওয়াজ উঠল, ভাবী! আমি! বাড়িওয়ালার ছেলে আমান। সেদিন তানভীর ভাইয়ের সাথে এসে আপনার সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম।

মায়ার ধড়ে যেন একটু প্রাণ ফিরে এল। বাড়িওয়ালার ছেলে। এর সাথে নিশ্চয় খারাপ ব্যবহার করা যায় না। তা হলে বাড়িওয়ালা হয়তাে বাড়ি থেকে উঠিয়ে দেবে। তারচেয়ে বড় ব্যাপার তানভীর রাগ, করবে। অনেক কষ্টে অল্প ভাড়ার এই বাড়িটা খুঁজে পেয়েছে। ঢাকা শহরে বাড়ি পাওয়া সোনার হরিণের মত।

মায়া দরজা না খুলেই একটু নরম গলায় বলল, “কিছু বলবেন, ভাই?

‘জ্বে। একটা জিনিস চাইছিলাম একটু।

কী?

‘একটা ম্যাচিস। মানে দিয়াশলাই। ছাদে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে গেল। পকেট হাতড়ে সিগারেট পেলেও ম্যাচিস আর খুঁজে পেলাম না। তখন আপনার কথা মনে পড়ল। ভাবলাম ভাবীর কাছ থেকেই চেয়ে নেই।

মায়া ফট করে দরজা খুলে ফেলল। তারপর দরজায় দাড়িয়ে মুঠো ভরা হাত বাড়িয়ে বলল, এই নিন।

আমান বিস্মিত চোখে চাদরের মধ্য থেকে পুরুষালী লােমশ হাত বের করে মায়ার দিকে বাড়িয়ে দিল। ম্যাচ চাইতেই পেয়ে সে একটু অবাকই হয়েছে। মায়া রান্নাঘর থেকে কিছু না পেয়ে ম্যাচই নিয়ে এসেছিল। আলাে, আগুন অনেক সময় অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করে।

আশপাশ থেকে আসা আলােয় আমানকে দেখে মায়া ভেতরে ভেতর একটু চমকে উঠল। লােকটাকে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থের মত লাগছে। একটু টলছেও কি? আর এই গরমে একটা চাদর জড়িয়ে আছে। আজব! সেই চাদর থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ বের হচ্ছে। মায়া গাঁজার গন্ধের সাথে পরিচিত নয়, নইলে সহজেই ধরে ফেলত গন্ধটা কীসের। চাদরের নীচে সরু জিন্সের প্যান্ট। অন্ধকারে সব কালাে লাগছে। সে লােকটার পায়ের দিকে তাকাল।

ওরকম মার্চের আওয়াজ আসছিল কোত্থেকে? লােকটার পায়ে বাটা কোম্পানির বুট জাতীয় এক ধরনের জুতাে। লােকটা মায়ার হাত থেকে ছোঁয়া এড়িয়ে ম্যাচ নিল। কায়দা করে ঠোটে ঝুলানাে সিগারেট ছাদের বাতাস এড়িয়ে ধরিয়ে আগুন ঠিক রাখার জন্য কষে একটা টান দিল। আর লােকটার গায়ের গন্ধের মত উৎকট তীব্র কড়া একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।

লােকটা ম্যাচ ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘নেন, ভাবী। এবার দরজাটা বন্ধ করে দেন। আমি আরও কিছুক্ষণ ছাদে থাকব। তারপর নেমে যাব। আপনারকোনও অসুবিধা হচ্ছে না তাে আমি ছাদে থাকায়?”

অসুবিধে হলেও সেটা মুখ ফুটে বলা যাবে না। একে তাে বাড়িওয়ালার ছেলে তারপর আমরা সবাই সভ্য সমাজে বাস করি।

মায়া তেলতেলে স্বরে মাথা নেড়ে বলল, না, না, কোনও অসুবিধা নেই।

লােকটা অন্য দিকে এক গাল ধোয়া ছেড়ে বলল, হয়তাে আপনিও ছাদে আসতে চেয়েছিলেন। না, মানে আমার এখন ঘরে কাজ আছে। রাতের রান্না বসাতে হবে।’ মায়া লােকটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে পারছে না। আবার লােকটার সরে যাওয়ারও কোনও নাম নেই। যেন দরজায় দাড়িয়ে তার সাথে খােশগল্প করতে এসেছে।

মায়া আর ভদ্রতা না করে আস্তে আস্তে দরজা ঠেলতে লাগল। তাই দেখে লােকটা একটু পিছিয়ে ছাদের ও-প্রান্তে চলে গেল। মায়া দরজা বন্ধ করে ঘরে এসে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে জ্বেলে মােমবাতির শেষ অংশ খুঁজতে থাকল। আর তখনই ইলেকট্রিসিটি চলে এল। রাত এগারােটার দিকে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার খাওয়ার সময় ভাবল মায়া তানভীরকে বাড়িওয়ালার ছেলের উৎপাতের কথা বলবে।

কিন্তু তানভীর নিজেই তার ‘রেভকো ফার্মার সমস্যার কথা শুরু করে, নতুন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা ফুলফিলমেন্ট হচ্ছে না। ডাক্তাররা নতুন ওষুধ লিখতে চায় না। তাদের নানারকম উপঢৌকন দিতে হয়। কোম্পানি কিছুটা বিয়ার করলেও ‘এম আর’দের নিজেদের পকেট থেকেও কিছুটা যায়। যেটার কোনও হিসেব হয় না। কোম্পানি থেকে আরও সময় বাড়িয়ে আরও বেশি ডাক্তারদের ভিজিট করতে বলেছে। অথচ বেতন বাড়ানাের নামে খোজ নেই। ঘােড়ার ডিমের প্রতিষ্ঠান। অন্য কোনও ফার্মা থেকে ভাল অফার পেলে,এটা সে ছেড়েই দিত। তানভীর গজগজ করতে থাকে। এর মধ্যে বাড়িওয়ালার পােলার প্রসঙ্গ তুললে তানভীর হয়তাে তার উপরেও রেগে যাবে। রাত দশটা পর্যন্ত ডাক্তারদের ভিজিট করে আসার পর তানভীরের মেজাজ একটু হট হয়ে থাকে।

পরিশ্রান্ত মানুষের বােধ হয় আবেগ ভালবাসাও পরিশ্রান্ত হয়ে যায় । তাদের বিয়ের দুই মাস না পেরুতেই রাতের ভালবাসা কেমন জানি কমতে শুরু করেছে। ও এত ক্লান্ত থাকে যে কিছু বলতেই’কেমন জানি মায়া লাগে। একটু কথাবার্তা শুরু করলেই ওর উত্তর এক শব্দে চলে আসে। হঁ্যা, হুঁ, না, উ’ এই জাতীয় উত্তর দিতে দিতে ঠুস করে ঘুমিয়ে পড়ে সকাল সাতটায় উঠে পড়তে হবে বলে।

আজও এর ব্যতিক্রম হলাে না। কাল অফিস ডে। বিছানায় গা এলিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল তানভীর। ওর একটা ভাল দিক, নাক ডাকে না। তালে তালে নিঃশ্বাস পড়ছে তানভীরের। নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘরের মধ্যে আর কোনও শব্দ নেই। লাইট জ্বলা অবস্থায়ও ঘুমিয়ে পড়তে পারে বেচারা । মায়ার আবার সব অন্ধকার করে না দিলে ঘুম আসে না। তানভীর আগে ঘুমায় বলেই দেয়ালের দিকটাতে ঘুমায়। তানভীরের এক ঘুমেই রাত কাবার। কিন্তু শােবার আগে পানি খায় বলে মায়ার উঠে বাথরুমে যেতে হয়। তা ছাড়া দেয়ালের দিকে ঘুমালে তার দম বন্ধ দম বন্ধ লাগে। তানভীরের দেয়ালের পাশ, বাইরের পাশ নিয়ে কোন চেতভেদ নেই।

বাথরুম সেরে পানি খেয়ে লাইট অফ করে দিয়ে মায়া বিছানায় এলাে। তানভীর ঘুমাচ্ছে। মায়া চিত হয়ে সটান শুয়ে রইল। তার ঘুম আসছে না। ঘুম সহজে আসার কথাও নয়। সে প্রায় সারাদিনই পড়ে পড়ে ঘুমায়। তানভীর অফিসে চলে গেলে তার আর তেমন কোনও কাজ থাকে না। তখন একলা বাসায় পড়ে পড়ে কয়েক শিফটে ঘুম দেয় সে। সকালের শিফট, দুপুরের শিফট, বিকালের শিফট। সে কারণে রাতে তার ঘুম আসতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। এমনকী কয়েকদিন সে ফজরের আযান পর্যন্ত শুনেছে। ঘরে কোনও আলাে নেই। আধখােলা জানালা দিয়ে স্ট্রিট লাইটের খুব ক্ষীণ একটা আলােয় ঘরটা আলােকিত। আর সুইচ বাের্ডের ইনডিকেটর লাইটের লাল আলােও বেশি রাত হলে কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে গােটা ঘর আলােকিত করে দেয়। তখন আবছা আলােয় ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র দেখা যায় ।

ঘুম না আসার কারণে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র দেখতে লাগল। নতুন পুরানাে মিলিয়ে দুজনের সংসার কোনওমতে চলে যাওয়ার মত জিনিসপত্র। একটা নতুন আলমারী। এটা ওয়ার্ডরােব। হঠাৎ ওয়ার্ডরােব থেকে চোখ চলে গেল সিলিং ফ্যানের দিকে। চিত হয়ে শােয়ার কারণে মাথার উপরে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকেই সরাসরি চোখ চলে যায়। পুরানাে হওয়ার কারণে অদ্ভুত ক্যাচক্যাচে একটা শব্দ করেই ফ্যানটা চলে। যখন বন্ধ হয় তখন ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ হয়। যেন মনে হয় সিলিং সহ ফ্যানটা ভেঙে মাথার উপর পড়বে।

মানুষের চিন্তার কী কোনও প্রতিফলন হয়? নাকি ব্যাপারটা কাকতালীয়? সে ফ্যান ভেঙে মাথার উপর পড়ার কথা ভাবতে ভাবতেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আর ঘড়ঘড় যান্ত্রিক গােলযােগের শব্দে ঘটাং ঘটাং করে ফ্যানটা থেমে গেল ।

গরমে তানভীর একটু আড়মােড়া ভেঙে নড়েচড়ে পাশ ফিরে শুলাে। মায়া তানভীরকে ডিঙিয়ে আধভেজা জানালাটা পুরােপুরি খুলে দিল। রাস্তার আলাে এবং মাঝরাতের আকাশের খণ্ডিত চাদের আলােয় ঘরের ভেতরে আবছায়ার সৃষ্টি হলাে। বাতাস পড়ে গেছে। গরমে হাঁসফাস লাগছে। সাততলায় হওয়ায় কেউ দেখবে না। শরীর থেকে শাড়ি ব্লাউজ সব খুলে ফেললে কেমন হয়? মায়া একবার জানালার দিকে তাকিয়ে একটানে শাড়ি খুলে বিছানার মাথার কাছে রাখল। তারপর ব্লাউজ খােলার জন্য হুকে হাত দিতেই তার মনে হলাে কেউ তাকে দেখছে। সে সাথে সাথে দুই হাত বুকের উপর রেখে বুকটাকে আড়াল করতে চাইল।

তারপর আবছায়ার মধ্যে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে কেন তার এমনটি মনে হলাে। কোথাও কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। এই সাততলার রাস্তার পাশের জানালায় কোনও চোরের বাপের সাধ্যি নেই ওঠার। হঠাৎ তার চোখের দৃষ্টিপথে এক জোড়া ঝুলন্ত পা বাতাসে নড়ার মত নড়ে উঠল। সে হতভম্বভাবে পায়ের অনুসরণ করে উপরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে বিস্ময়ে হিমশীতল হয়ে গেল।

স্থির হয়ে থাকা সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস নিয়ে কেউ একজন ঝুলছে। একজন মেয়েমানুষ! শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস নিয়েছে মেয়েটি। প্রায় তারই বয়সী হবে। শাড়ির আঁচল দিয়ে ফাঁস নেয়ার কারণে কিছুটা কাপড়-চোপড় এলােমেলাে হয়ে শরীরের অনেক অংশ দেখা যাচ্ছে। পায়ের উপর থেকে ছায়া এবং বুকের কাছে ব্লাউজের অবয়ব দৃশ্যমান। ফাস নেয়ার কারণে মেয়েটার চোখ বড় বড় হয়ে যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে জিবের কিছু অংশ। জিবটায় ঠোটের এক পাশে দাঁত কেটে বসে গেছে।

কতটা সময় ওই বীভৎস দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে ছিল সে বলতে পারবে না। হয়তাে এক সেকেণ্ড হবে কিন্তু তার মনে হয়েছে অনন্তকাল। সে সাথে সাথে ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। একটা অবশের মত অনুভূতি তার সমস্ত শরীরের ভেতর দিকে প্রবাহিত হয়ে তাকেচরম একটা ধাক্কা দিয়ে গেছে। সে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকা তানভীরের গায়ে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিল। তানভীরকে ডাকতে যেয়ে দেখে গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হচ্ছে না। সে আবার ধাক্কা দিল।

তানভীর পাশ না ফিরেই ঘুম জড়ানাে স্বরে বলল, “উ।’ বলতে বলতে আবার গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল। হঠাৎ অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে গেল। গন্ধটা কিছুটা বকুল ফুলের সাথে কপূর মেশানাে। তার সেই গন্ধের সাথে সাথে তার ভয়ও যেন কপূরের মত উবে গেল।

সে মাথার কাছ থেকে শাড়িটা টেনে নিয়ে বুকের উপর ওড়নার মত করে পেঁচিয়ে নিল। তারপর প্রবল সাহসের সাথে আবার তাকাল সিলিং ফ্যানের দিকে।

আশা করেছিল তার চোখের ভুল মুহূর্তেই মিলিয়ে গিয়ে দেখতে পাবে ফ্যানের সাথে কিছুই ঝুলে নেই। কেউ ফাঁস নিয়ে নেই। সিলিং ফ্যানের সাথের মেয়েটা আছে। তবে এবার দশটা একটু পরিবর্তিত হয়েছে। অর্ধ বিবস্ত্র মেয়েটা যেন আর ফ্যানের সাথে ঝুলে নেই। যেন সে ফ্যানের নীচে বাতাসে শরীর জুড়ানাের মত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। তার খোলা চুল উড়ছে বাতাসে। শাড়িটাও খুব সুন্দর করে শরীরে পরা । চোখ বড় বড় হয়ে নেই। স্বাভাবিক। ঠোটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে নেই জিবের অংশ।

মায়াকে ওরকম হতবিহ্বল ভাবে তাকাতে দেখে মেয়েটা ঠোঁই নাড়িয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, আমি তােমার মতই মেয়ে। একটি মেয়েকে দেখে অমন লজ্জা পাওয়ার কী আছে? তুমি তাে দেখি লজ্জায় অধােবদন হয়ে গেছে।’

মায়ার গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হলাে না। তুরুকি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? না হলে সে এসব দেখছে কেন? আর একমভাবে কথা শুনছেও বা কীভাবে? এই সব কি সে কল্পনা করছে? নাৰ্কি স্বপ্ন দেখছে? সে হয়তাে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে। ফ্যানের নীচের মেয়েটা দুহাত মাথার উপর তুলে উড়তে থাকা এলােমেলাে চুলগুলাে ঠিক করতে করতে আগের মতই ফিসফিস করে বলে উঠল, তুমি তাে দেখি ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। এখনকার যুগের মেয়েদের এতটা ভীতু হলে চলে না। আমিও তােমার মত ভীতু ছিলাম বলে আজ আমার এই অবস্থা হয়েছে।’

মায়া বিছানার উপর আড়ষ্ট হয়ে ভীতু গলায় ফিসফিস করে বলল, কী অবস্থা হয়েছে?
‘তুমি নিজের চোখে দেখেও বুঝতে পারছ না? ওরা আমাকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে সিলিং ফ্যানের সাথে।

‘কারা?’
‘আমার স্বামী আর দেবর। ওরা পরিকল্পিত ভাবে আমাকে মেরে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রটিয়ে দিয়েছে আত্মহত্যা করেছি। অথচ আমি আত্মহত্যা করিনি।’

‘ওরা কেন তােমাকে মেরেছে?

‘আমার দেবরটাই ছিল শয়তানের হাড়ি। ও আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিল। আমি ওর সেই প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় ও পরিকল্পিতভাবে ওর এক বন্ধুকে দিয়ে আমাকে হেনস্থা করায় । আমার স্বামীর কান ভাঙানি দেয় আমার নামে । ওর বন্ধুকে হাত করে বন্ধুকে জড়িয়ে আমাকে অসতী প্রমাণ করে। আর ওর সেই শয়তান বন্ধুটিও আমার স্বামীর সামনে যেয়ে স্বীকার করে যে আমার সাথে তার পরকীয়া আছে। তারপর একদিন আমার স্বামী আর দেবর মিলে আমাকে গলা টিপে মেরে আমার শাড়ি দিয়ে ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রটিয়ে দেয় আমি আত্মহত্যা করেছি।’

‘তােমরা আইনের আশ্রয় নাওনি?’

‘এদেশের আইন টাকায় চলে। ওরা টাকা খাইয়ে পুলিশ আর ডাক্তারকে হাত করে। একমাত্র আপনজন আমার মা ওই শয়তানদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারে না। ওরা আমাকে খুন করে আত্মহত্যা বলে প্রচার করে দিব্যি পার পেয়ে যায়।’

তুমি আমাদের ঘরে এলে কীভাবে? তােমরা কি এই বাসাতেই থাকতে? ‘উঁহু। আমি তােমাদের সিলিং ফ্যানের সার্থে চলে এসেছি। এই ফ্যানেই আমাকে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানাে হয়। এটা ছিল আমাদের বেডরুমের ফ্যান। মরার পরে প্রতি রাতে আমি ফ্যানে ঝুলে আমার স্বামী আর তার নতুন বউকে নানারকম ভয় দেখাতাম। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে আমার স্বামী পুরানাে মার্কেটে ফ্যানটা অল্প দামে বিক্রি করে দিয়ে আমার হাত থেকে মুক্তি পায়। পুরানাে মার্কেটে কিছুদিন বন্দি হয়ে থাকার পর তােমার স্বামী আমাকে কিনে নিয়ে আসে। আর এখন আমি কথা বলার একজন সঙ্গী পেয়েছি। তুমি সারাদিন ঘরের মধ্যে একাকী থাক। আর সিলিং ফ্যানে ঝুলে আমারও খুব একা একা লাগে। তুমি আমার বন্ধু হবে? তা হলে আর দুজনের কারােরই একাকীত থাকবে না। বলাে না আমার বন্ধু হবে?”

মায়া কিছু বলে ওঠার আগেই সিলিং ফ্যানে ঝুলতে থাকা মেয়েটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সারা ঘরে একটা বিজবিজানির শব্দে ভরে যায়। ইনডেকিটরের লাল আলাে জ্বলে ওঠে। বিজলী বিবি চলে এসেছে। মায়া মাথার কাছে হাতড়ে বেড সুইচ অন করে দেয়। গােটা ঘর আলােয় ভরে ওঠে। মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখে সবুজ রঙা ফ্যানটা বনবন করে ঘুরছে। সেখানে সেই হতভাগা নিঃসঙ্গ মেয়েটা ঝুলে নেই।

তানভীর অফিসের কাজে সাত সকালে বেরিয়ে যায় । ফেরে রাত দশটার পর। পুরাে একটা নিঃসঙ্গ দিন । টাকার অভাবে এখনও টেলিভিশন কেনা হয়ে ওঠেনি। প্রথম কিছুদিন গল্পের বই-টই পড়লেও এখন মায়ার আর ভাল লাগে না। মফস্বলের সেই কলেজ থেকে ডিগ্রিটা কমপ্লিট করলে না হয় সে-ও একটা চাকরি বাকরির চেষ্টা করে তানভীরের উপর থেকে সংসারের ঘানি টানার বােঝা কিছুটা লাঘব করত। গত রাতে ফ্যানে ঝােলা মেয়েটাকে দেখার পর মেয়েটার উপরে কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছে। তার মায়া হওয়ায় সবকিছুতে তার কেমন যেন একটা মায়া পড়ে যায়। তা ছাড়া নিঃসঙ্গ বাড়িতে মেয়েটার সাথে একটু কথাবার্তা বলতে পারলে, মেয়েটার গল্প শুনতে পারলে বা একটু সাহস করে তার নিজের গল্প বলতে পারলে ভালাে লাগত।

সে প্রায় সারাটা দিন মেয়েটার প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দেয়। আজ আর দিনে ঘুমিয়ে পড়ে না। যদি ঘুমিয়ে গেলে সে মেয়েটাকে দেখতে না পায়। এমনকীএই গরমের মধ্যেও বার কয়েক সে ফ্যান বন্ধ করে রেখে দেখেছে মেয়েটা আসে কিনা। মেয়েটা আসেনি। সন্ধেয় ইলেকট্রিসিটি চলে যেতেই মেয়েটা আসে। মেয়েটার দেখা পেতেই প্রচণ্ড একটা ভয় তাকে জ্বরের মত আচ্ছন্ন করে ফেলে। তারপর ভয় হঠাৎ করেই কেটে যায়। তখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত অনুভতি হয়। আর মেয়েটার সাথে কথা বলতে ভাল লাগে।

আজ সে মেয়েটার নাম জানতে পারে। জলি। তার মতই মফস্বলের ভীতু একটা মেয়ে। ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। সুন্দরী ছিল বলে আর পড়াশুনা হয়নি। বাপ মরে যাওয়া গরীবের ঘরের সুন্দরী মেয়ে সমাজ সংসারের সবার দাবীদার হয়ে পড়ে। তার মা তাড়াতাড়ি বড়লােকের ঘরে তাকে বিয়ে দেয়। কিন্তু ভিতু স্বভাবের কারণে শ্বশুর শাশুড়িকে বলতে পারেনি তার দেবর ও তার বন্ধুর কুকীর্তির কথা। মায়াও তার গল্প করে। তার বাড়ির গল্প । ভাই বােনের গল্প। তানভীরের সাথে প্রেমের গল্প। বিদেশি পাত্রের গল্প। তারপর কাজী অফিসে বিয়ে করে এই বাসা ভাড়া নেয়ার গল্প। দুজনের সুখ দুঃখের গল্প আর শেষ হয় না। সময় মত ইলেকট্রিসিটি চলে আসে।

একদিন মাঝরাতে হঠাৎ গরমে তানভীরের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ মেলে দেখে মায়া বিছানায় উঠে বসে একা একা কার সাথে জানি কথা বলে যাচ্ছে। এসব আর মায়াকে কিছু জিজ্ঞেস না করে ঘুমিয়ে পড়ে। ইলেকট্রিসিটি থাকা সত্ত্বেও মায়া কেন ফ্যান বন্ধ রেখেছে সেটাও সে জিজ্ঞেস করে না। পরের রাতেও একই ঘটনা। তানভীরের খটকা লাগে। কিন্তু বলি বলি করেও আর বলা হয় না। এরই মধ্যে কয়েকটা দিন কেটে যায়। ছুটির দিনে দুজনে দর্শনীয় স্থান লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল দেখে ঘুরে ফিরে আসে। লালবাগ কেল্লার নির্জনে একান্ত বসে তানভীর আদুরে গলায় বলে, মায়া, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কিছু মনে করবে না তাে?” মায়াও আদুরে গলায় বলে, ‘আশ্চর্য, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার জন্য অনুমতি নিতে হবে? আর এতে মনে করাকরির কি আছে।

“না, মানে কয়েকদিন জিজ্ঞেস করব করব ভেবেও করা হয় না।’

কী কথা এত ভণিতা না করে জিজ্ঞেস করে ফেললেই তাে হয়।

‘আচ্ছা, তার আগে বলাে তাে তুমি গত কয়েকদিন আমার কাছ থেকে কোনও কিছু লুকাচ্ছ কিনা।

মায়া একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘হুঁ, একটা বিষয় ঠিক লুকাচ্ছি তা বলা , যায় না। তুমি বিশ্বাস করাে কিনা ভেবে আর বলতে সাহস পাইনি।’

কী কথা?

‘ও তুমি বিশ্বাস করবে না। বড়াে অদ্ভুত কথা।’

শুনিই না তােমার সেই অদ্ভুত কথা। তারপর না হয় বিশ্বাসের প্রশ্ন।

‘তার আগে তুমিই বলাে তুমি আমার কাছে কী জানতে চাইছিলে? তুমি আগে জিজ্ঞেস করেছাে, তুমি আগে বলবে।

‘বেশ। গত কয়েকদিন রাতে গরমে আমার ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছি তুমি বিছানায় উঠে বসে বিড় বিড় করে কী জানি বকছ। ভাবটা যেন কারও সাথে তুমি কথা বলছে। প্রচণ্ড গরমেও তুমি ফ্যান বন্ধ করে রেখেছে সেটাই দেখেছি। অথচ তােমার গায়ে জ্বর জারির কোনও চিহ্ন দেখিনি।’

‘তুমি তা হলে জিনিসটা খেয়াল করেছাে?

ব্যাপারটা কী? তােমার কি মাথা টাতা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি?

আমি ওই কথাটাই বলব বলেই বলেছিলাম তুমি বিশ্বাস করবে না।

দেখেছাে এখন বলছাে আমার কি মাথাটাতা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি। ঘটনা কী, খুলে বলাে তাে।’

ঘটনা হচ্ছে আমি একটা মেয়ের সাথে কথা বলি।’

‘মেয়ের সাথে?

‘হা, মেয়ের সাথে। মেয়েটার স্বামী মেয়েটাকে খুন করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে। কী বলছ এসব আবােল তাবােল? সে মেয়েটা থাকে কই?

বাহ্, মরা মানুষ কোথায় থাকবে। বাসা বাড়িতে থাকবে নাকি!”

‘আমারও তাে সেইটাই প্রশ্ন। মরা একজন মানুষের সাথে তুমি কথা বল কীভাবে?

আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আমি কথা বলি। মেয়েটার নামও জানি। জলি। মেয়েটা আমাদের সিলিং ফ্যানে থাকে। সিলিং ফ্যান চললে ও আসতে পারে না বলে আমি রাতে ফ্যান বন্ধ করে দিয়ে ওর সাথে গল্প করি। প্রথম প্রথম শুধু অন্ধকারে আসত। এখন দিনের আলােয় আসে। দিনের বেলায়ও ও আমার সাথে গল্প করে।

‘আমার সাথে একদিন দেখা করিয়াে তাে।

‘সে কথা আমি ওকে একদিন বলেছিলাম। কিন্তু ও বলে তুমি নাকি ওকে দেখতে পাবে না। এজন্য আমি যখন ওর সাথে গল্প করেছি তুমি দেখতে পাওনি।

তানভীর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মায়া এসময়ের জলির সাথে দেখা হওয়া থেকে আদ্যোপান্ত তানভীরের কানের কাছে বলে চলল। মায়া, একটা কথা বলি। মাইণ্ড কোরাে না। তােমাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নেয়া দরকার। একা বাসায় থেকে তােমার যেটা হয়েছে সেটাকে বলে হ্যালুসিনেশন। এক ধরনের মানসিক সমস্যা। সাইকিয়াট্রিস্ট কাউন্সেলিং করে তােমার মাথা থেকে এটা দূর করে দিতে পারবে।’

‘এজন্যই আমি তােমাকে বলতে চাইনি। তুমি ভাববে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মাথা ঠিকই আছে। আর মরে গেলেও আমি কোনও পাগলের ডাক্তারের কাছে যাব না। কক্ষনাে না।’

সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়ার কথায় মায়া তার সাথে ঝগড়াঝাটির উপক্রম করছে দেখে তানভীর আর কথা বাড়াল না। এমনিতেও ওটা মুখের কথা, বললেও সে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে পারত না। টাকার টানাটানি চলছে। মানসিক ডাক্তারের কাছে ফাও টাকা দেয়ার উপায় নেই। এমনি ডাক্তার হলে সে ফ্রি দেখিয়ে আনতে পারত। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নেবে না কিন্তু মায়াকে সে শর্ত দিল, আজ রাতে আর ওই মেয়ের সাথে কথা বলতে পারবে না। লাইট জ্বালিয়ে ফ্যান চালিয়ে ঘুমাবে সে। আর দুইদিনের জন্য মােহাম্মদপুরে ওর চাচাত বােন লাকির ওখান থেকে বেড়িয়ে মন ঠাণ্ডা করে আসবে।

সেদিন রাতে তানভীর ও মায়া ঘনিষ্ঠ হলাে। আদরে আদরে ভরিয়ে তুলল একে অন্যকে। তারপর ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে দুজনেই তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। মাথার উপর বন বন করে ঘুরছে ফ্যান।

পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পথে তানভীর মায়াকে নামিয়ে দিয়ে এল। তারপর চলে গেল নিজের কাজে। তার পরদিন তানভীরকে এম আরের ব্যাগের পাশাপাশি আরেকটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। অফিসের কাজ সেরে গুলিস্তানের পুরানাে মার্কেটে কম দামে ফ্যানটা বিক্রি করে স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে নতুন একটা দামি ফ্যান কিনে নিয়ে এল।

মায়া ফিরে এসে নতুন ফ্যান দেখে খুশি হলাে। তা ছাড়া তানভীরকে ছেড়ে বক্র চাহনির চাচাত বােনের বাসায় তার ভাল লাগেনি। বিয়ের পরে মেয়েদের নিজের সংসার ছাড়া অন্য কোথাও আপন মনে হয় না। দুদিন পর নতুন ফ্যানের বাতাসে তানভীরের সাথে মায়া ঘনিষ্ঠ হয়। পুরানাে ফ্যানের কথা, ফ্যানের মেয়েটার কথা বেমালুম ভুলে গেল সে। তানভীর তার সব কিছু আঁকড়ে থাকে।

আবার নিত্য দিনের রুটিন। তানভীর সাত-সকালে অফিসে যায়। শুরু হয় মায়ার নিঃসঙ্গ দিন। তখনই তার মনে পড়ে জলির কথা। সেই সিলিং ফ্যানও নেই। জলিও নেই। সে জানত ফ্যানের ওই মেয়েটা কোনও মানুষ নয়। হয়তাে সত্যিই হ্যালুসিনেশন। একটা অপচ্ছায়া। কিন্তু সেই অপচ্ছায়ার জন্য তার মন কেমন করতে থাকে। সারাটা দিন তার নিঃসঙ্গতায় কাটে। তার কথা বলার একমাত্র বন্ধুটিকে তানভীর কোন ভাগাড়ে কোথায় বেচে দিয়ে এসেছে। কারা কিনে নিয়ে যাবে হতভাগ্য মেয়েটাকে? সেখানে সে কেমন থাকবে? তার মত কথা বলার কাউকে কি পাবে? এসব চিন্তায় সায়ার মাথা খারাপের মত হয়ে যেতে থাকল।

সন্ধেয় ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে অপচ্ছায়া না থাকার ভয় তাকে যমের মত পেয়ে বসে। যে জিনিসটাকে তার ভয় পাওয়ার কথা সেটা না থাকায় তার ভয় বেড়ে যায়। ভয় আরও বেড়ে যায় যখন ছাদের উপরে সেই বুটের ধুপ ধাপ আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। সে বারবার নতুন কেনা ফ্যানের দিকে তাকায়। না সেখান থেকে কোনও অপচ্ছায়া ঝুলে থাকে না। তার সাথে কথা বলার জন্য কেউ ফিসফিস করে না। তার বড়াে অস্থির লাগে। বুটের শব্দ তার দরজার কাছে এসে ফিরে ফিরে যায়। আর দরর্জার ফাক দিয়ে গাঁজার উতকট তীব্র কটু গন্ধ ভেসে আসে। এক অপার্থিব ভয়ে তার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে। সে কান খাড়া করে বাড়িওয়ালার ছেলের ভাবী ডাকের অপেক্ষায় থাকে। ওপাশ থেকে কোনও ডাক আসে না। পরিবর্তে পায়ের শব্দ দূরে সরে যায়। আর তখনই চলে আসে বিজলী বিবি। মায়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

রাতে বিয়ের পরে এই প্রথম মায়ার সাথে তানভীরের সত্যিকার অর্থে ঝগড়া বাধে। আর ঝগড়ার কারণটাও অদ্ভুত। মায়া প্রথমে আবদার জানায় সেই পুরানাে ফ্যানটা ফিরিয়ে আনার জন্য। তানভীর জানায় সেটা সে বিক্রি করে দিয়ে এসেছে। সেটা এতক্ষণে কোন বাড়িতে কে কিনে নিয়ে গেছে তার ঠিক আছে? চোরা বাজারে এক জিনিস একদিনের বেশি থাকে না। মায়া তবুও আবার সেই বিক্রি করা দোকানটাতে গিয়ে দেখে আসতে বলে। সেখানে ফ্যানটা আছে কিনা। একদিনের মধ্যে বিক্রি না-ও হতে পারে। ফার্মার ওখানে তানভীরের কিছুটা গােলযোগ চলছে। ড্রাগের রেসপন্স খারাপ। যেকোনও সময় কর্মচারী ছটাই হতে পারে। ছাঁটাইয়ের মধ্যে সে-ও পড়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু না। এমনিতে তার মেজাজ খারাপ। তার উপরে মায়া কানের কাছে পুরানাে ভূতে ধরা এক ফ্যানের কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করে মেজাজ চড়িয়ে দিল। সে গলা চড়িয়ে জানিয়ে দিল, জাহান্নামে গেলেও ওই ফ্যানের খােজে অফিস কামাই দিয়ে চোরাই বাজারে যেতে পারব না।’

মায়াও কম যায় না। আজ যেন তার কি হয়েছে। জলির সাথে কথা না হওয়ায় তার মন এমনিতেই বিক্ষিপ্ত ছিল। তারপর সন্ধেয় বাড়িওয়ালার ছেলের পায়চারী, গাঁজার গন্ধ, তানভীরের- ভারী গলা, সব মিলিয়ে মায়াও হিস্টেরিয়াগ্রস্ত রােগীর মত হয়ে গেল। সে-ও উজেজিত গলায় জানিয়ে দিল, তানভীর যদি ওই যান আর খুঁজে না নিয়ে আসে তা হলে সে তানভীরকে ছেড়ে বাড়িতে চলে যাবে। গিয়ে বিদেশি পুত্রকে বিয়ে করে পাড়ি দেবে ইতালীতে। এই নিঃসঙ্গ জীবন তার আর সত্য হচ্ছে না। তানভীর কোত্থেকে আনবে সে জানে না। কিন্তু ওই পুরানাে ফ্যান আবার নিয়ে আসতে হবে। না হলে ওই জলি মেয়েটার মতই সেও এই নতুন ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে আত্মাহুতি দিয়ে এই নিসঃঙ্গর জ্বালা জুরোবে। তানভীর চুপ করে গেল। এতদিনে সে যেটুকু মায়াকে চিনেছে তাতে মায়া খুব জিদ্দি মেয়ে। একবার যেটা বলে সেটা করে কোনও রকম পাগলামি যদি সত্যিই করে সে?

পরদিন সকালে অফিসে গেলেও কাজে মন বসাতে পারলাে না তানভীর। চাকরি চলে যায় যাবে। তবুও সে এবার গুলিস্তামেয় চোরাই মার্কেটে গিয়ে দেখবে সেখানে এখনও সেই ফ্যানটা আছে কিনা। যদি না থাকে তত ভাল। না থাকলে ঠিক ওই রকম দেখছে আরেকটা পুরানাে ফ্যান কিনে নিয়ে আসবে। মায়া কী সব অপচ্ছায়াটায়া দেখে, ওটা তাে মানসিক সমস্যা। একইরকম ফ্যান আনলে নিশ্চয়ই ধরতে পারবে না। তানভীরের ভাগ্য ভাল। এখনও ওই ফ্যানটা সেই ছােট্ট দোকানে পড়ে আছে। বিক্রি হয়ে যায়নি। তানভীর আরও একশ টাকা গচ্চা দিয়ে নিজের গতকাল বিক্রি করা ফ্যান কিনে নিয়ে বাসায় এল।

ফ্যানটা দেখে মায়ার চোখ-মুখ অন্য আলােয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যেন সে তার হারানাে সাথীকে আবার ফিরে পেয়েছে। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে ফ্যানের পাখাগুলাে সযত্নে মুছে দিলাে। মায়ার পাগলামি দেখে তানভীর আর দেরী না করেই সেই রাতেই নতুন ফ্যানটা খুলে তার জায়গায় পুরানাে ফ্যান লাগিয়ে দিলাে। সারাদিনের ক্লান্তি, ধকল, গুলিস্তানে ঘােরাঘুরি এবং রাতে বাসায় এসে একটা ফ্যান খুলে আরেকটা লাগানােয় তানভীর এত ক্লান্ত হয়ে পড়লাে যে সে খেয়েই ঘুমে এলিয়ে পড়ল। না হলে দেখতে পেতাে প্রায় সারাটা রাত জেগে মায়া অশরীরী বান্ধবী জলির সাথে গল্প করেছে। অল্প দিনের অসাক্ষাৎ হলেও যেন মনে হবে এক জনম পরে তাদের দেখা হয়েছে। সেভাবেই সাধ মিটিয়ে গল্প করছে তারা।

ঠক! ঠক! ঠক!

প্রায় সারারাত জেগে গল্প করায় এবং একা বাড়িতে থাকায় আলস্য করে শেষ বিকালে গােসল খাওয়া সেরে বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে চলে গিয়েছিল মায়া। দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুমের অতল থেকে ধড়ফড় করে উঠল ও। গােটা ঘর অন্ধকার। কোথায় কী হচ্ছে প্রথমটায় সে বুঝে উঠতে পারল না। দরজায় আবার ঠকঠক আওয়াজ হতেই সে একটু ঠাওর করতে পারল। আর তখনই দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এল আমানের ঘড়ঘড়ে গলা, ভাবী, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারেন? বড় তিয়াস লাগছে। ছাদে হাঁটাহাঁটি করে তিয়াস লাগছে।’ সন্ধে পেরিয়ে গেছে। খােলা জানালা দিয়ে বাতাস এসে এলােমেলাে করে দিচ্ছে। মায়া বিছানা থেকে নামল। একজন পিপাসার্ত মানুষ পানি খেতে চাচ্ছে, সে পানি না দিয়ে পারে কীভাবে?

সে ড্রয়িংরুমে এসে বলল, “একটু দাঁড়ান, ভাই। আলােটা জ্বেলে
নেই।’ ‘এই অসময়ে কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি, ভাবী? ‘এই একটু।’ বলে মায়া রান্নাঘরের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে মােমবাতি ম্যাচ নিয়ে মােম জালল। তারপর মােমবাতি এনে রাখল ডাইনিঙের টেবিলে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালল। তারপর এক হাতে পানির গ্লাস অন্য হাতে মােমবাতি নিয়ে দরজা খুলল। তখনই ভক করে সেই উটকট তীব্র কটু গাঁজার গন্ধটা নাকে এসে লাগল।

উর্ধ্বাঙ্গে চাদর মােড়া আমান মায়ার হাত ছুঁয়ে পানির গ্লাস নিল । মায়ার সমস্ত শরীর ভয়ে অসাড় হয়ে যাবার জোগাড়। ভাবী, পানি একটু বসে খাই, না কী বলেন। নবীজীর নুত।’ বলে অনুমতির অপেক্ষা না করেই মায়ার পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

মায়া দরজাটা হাট করে খােলা রেখেই ধীরে ধীরে দেখতে থাকে লােকটা ডাইনিঙের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। তারপর এমন চুক চুক করে পানি খেতে থাকে যেন গরম চা বা কফি খাচ্ছে। মায়া মােমবাতিটা ডাইনিং টেবিলে রেখে আরেকটা মােমবাতির জন্য বেড রুমের দিকে গেল। সে বেড রুমে আসতেই ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুম থেকে খুট করে একটা শব্দ হলাে। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেই ওরকম শব্দ হয়। হঠাৎ করে মনে হয় গাজার গন্ধটা তার বেড রুমে চলে এসেছে। মায়া কী হচ্ছে দেখার জন্য ড্রয়িংরুমের দরজার দিকে আসতেই দেখে আমান মােমবাতি হাতে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে।

আমান মােমবাতিটা মুখের কাছে ধরে একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে এক ফুয়ে নিভিয়ে দিয়ে খনখনে হেসে বলল, ভয় নেই, ভাবী। আমি আছি না। বাতাসে মােমবাতি নিভে গেল। ম্যাচিসটা দিন তাে।’ আমান হাত বাড়িয়েখপ করে মায়ার হাত ধরল।

দরজা খুট করে লাগানাে এবং মােমবাতি নিভানায় মায়া বুঝে গেল কী ঘটতে চলছে। এই নির্জন সাততলার ঘরের মধ্যে কেউ আসবে না তাকে বাঁচাতে। ওই নরপশুর হাতেই সঁপে দিতে হবে সব। এ ততক্ষণে আমান মায়ার শাড়ির আঁচল ধরে ফেলেছে। বিপদের মুখে আল্লাহ-খোদা বাবা-মা এমনকি স্বামীর নাম ধরে ডেকে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে চায় সবাই । মায়া সে সব কিছু না করে অশরীরী অপচ্ছায়াকে প্রাণ থেকে ডেকে উঠল, ‘জলি, কোথায় তুমি? বন্ধুর বিপদে তুমি কি আমাকে রক্ষা করবে না? শেষে তােমার মত আমার স্বামীও অবিশ্বাস করে আমাকে ঝুলিয়ে দেবে সিলিং ফ্যানে। জলি, আমাকে রক্ষা করাে।

আমাকে বাঁচাও। প্লিজ, হেল্প মি।’ আমান মায়ার সাথে যুঝতে থাকে। তার শাড়ি এলােমেলাে করে ফেলেছে। পুরুষের পুরুষালী শক্তির কাছে অসহায় মায়াকে প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলেছে আমান।।

ঠিক তখনই মায়া সেই গন্ধটা পায়। বকুল ফুলের সাথে কপূর মেশানাে গন্ধ। সে তাকায় সিলিং ফ্যানের দিকে। দেখতে পায় তার অশরীরী বান্ধবী চলে এসেছে ফ্যানের সাথে। অন্যরকম একটা শক্তি যেন ভর করে মায়ার শরীরে। এখন আর সে একা নয় । জলি এসেছে।

আমান হঠাৎ চমকে ওঠে। তার সামনের সেই সুন্দরী ভাবী যেন ধীরে ধীরে তার দুহাতের মধ্যে ঠাণ্ডা শীতল লাশে পরিণত হয়েছে। যেন একটা মৃতদেহ জড়িয়ে ধরেছে সে। সে দেহটির মৃত্যু ঘটেছে কয়েক মাস আগে। ঠাণ্ডা মৃতদেহ শক্তিশালী হাত দিয়ে যেন আমানকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। আমান তার হাত শিথিল করে মায়ার দিকে তাকায়। উস্কোখুস্কো চুলের জিব বেরিয়ে আসা ভয়াবহ রক্ত চোখের আজরাইল যেন স্বয়ং তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। মরণের ভয় পেয়ে বসে তাকে।

আমান মায়াকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসতে থাকে। বেড রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে সে চলে আসে দরজার কাছে। ভয়ে তার দুচোখ বড় বড় হয়ে গেছে। সে ভয়ংকর ফাস নেয়া মৃতদেহ এগিয়ে আসছে তার দিকে। মৃত্যুদূত আসছে তাকে গ্রাস করতে। তার নেশা ছুটে যায়। সে তড়িৎ গতিতে ছিটকিনি খুলে দরজার বাইরে বেরিয়ে আসে। সেই ভয়ংকর মূর্তিটাও দরজা দিয়ে বেরিয়ে তার মুখােমুখি হয়। সে পিছাতে থাকে। মূর্তিটা এগুতে থাকে। সে পিছায়। আরও। আরও। চলে আসে ছাদের কার্নিসে।

পরদিন সকালে বাড়িওয়ালার মাদকাসক্ত ছেলে মৃতদেহ সাততলা বাড়ির পিছন দিকে আবিস্কৃত হয়। পুলিশ রিপোর্ট-মাতাল অবস্থায় কার্নিশ থেকে পা পিছলে পড়ে মারা পড়েছে আমান।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত