একটি ভয় ও মুক্তি

একটি ভয় ও মুক্তি

ফকিন্নীর ঝি, তুই আমার কাছ থেইকা দূরে থাকতে পারস না? বলতে বলতে জাবেদ খাটে ঘুরে শোয়। কোলবালিশটা ওপাশ হতে মাঝখানে নিয়ে আসে। কারণটা মিতুর কাছ থেকে দূরে থাকা। মিতু কিছু মনে করে না। মিতু অভ্যস্ত। যখন চাহিদার জন্ম হয়, তখন আই লাভ ইউ, আমার জান, জানু, কোনটা বলতেই কার্পণ্য করেনা জাবেদ। কাজ শেষ তো সব শেষ। ভালবাসা, লুতুপুতু বাক্য, রসায়ন কেমিষ্ট্রি সব খতম। পদার্থ শুরু হয়। খানিকবাদে নামে অপদার্থে। কখনও মারেপিটেও পিছপা হয়না জাবেদ সাহেব। এটা নাকি প্রাপ্য মিতুর। কারণ বিয়ের অাগে মিতুর একটা প্রেম ছিল। সে বাটপার কৌশলে একবার মিতুর সংগে ফিজিক্যাল রিলেশনেও চলে যায়। ইটস নট রিয়েল, ইটস ভার্চুয়াল। স্কাইপের মাধ্যমে। তারপর মিতুর সংগে সমাপ্তি। কতটা বোকাই না ছিল মিতু। সে স্বামীর মর্যাদা দিয়ে বসে রুবেলকে। ভুল ভাঙে যখন অারেকটা মেয়েকে টাকার জন্য বিয়ে করে বসে রুবেল। মিতু ভেঙে পড়ে। নেতিয়ে যায় মিতুর জীবন। রঙহীন জলের মতন হয়ে ওঠে মিতুর জীবন। ওলটপালট। মিতু গুটিয়ে নেয় নিজেকে। ঘরবন্দী জীবন। হঠাৎ বিয়ের প্রপোজাল।

:মা, জীবনে আগে বাড়তে হবে।
:তাই বলে বিয়ে করে?
:তোর অারও একটে ছোটবোন অাছে।

মায়ের যুক্তির কাছে হেরে যায় মিতু। কারণ এটা সমাজের জলজ্যান্ত বাস্তবতা। ঘরবন্দী মিতু রাজি হয় বসুন্ধরায় ছেলের সাথে ‌দেখা করতে। হালকা মিস্টি কালারের ড্রেসে অপরূপা হয়ে ওঠে মিতু। ঝকমকে হয়ে ওঠে চোখজোড়া। বা গালের তিলটা চুপিচুপি যেন কথা বলে সেদিন। এমনিতেই সুন্দরী ও, আজ যেন পরী হয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীতে। বসুন্ধরা সিটিতে প্রায় দুঘন্টা ওয়েটের পর জাবেদের দেখা মিলল। লস্বা একহারা গড়ন। চৌকস চেহারা। পেটা শরীর জানান দেয়, স্পোর্টসম্যান অবশ্যই। একহাতে অফিসের ব্যাগ নিয়ে, অন্যহাতে একটা গোলাপ। মিতু হয়রান হয়! অাজতো প্রথম দেখা! ফুল কেন?

:ধরুন। অাপনার জন্য। মিতু ইতস্তত করে।
:অামাদের প্রথম সাক্ষাত!
:অাপনার ছবি অামি আরও এক সপ্তাহ আগেই দেখেছি। বেশ লাগল মিতুর। জোড়া ভ্রুতে বেশ আভিজাত্য।
:কি খেতে পছন্দ করেন? মিতু বলার অাগেই বলল নিজেই।
:মেয়েরা টক পছন্দ করে। ফুচকা নিই।

মিতু মাথা ঝাকায় কোনরকমে। ফুচকা আসে। কত গল্প হয়। পছন্দ, অপছন্দ। বিষয়, নাবিষয়ে। কত্ত কথা!
এর দুদিনপরেই হঠাৎ করে বিয়ে। জানার বা বোঝার সুযোগ আসেনি মিতুর। ওর পরিবার বেশ খুশী। কিন্তু মিতুর মনে খচখচ লেগেই রইল। কতকটা বঁধে থাকা আলপিনের মতন।
বাবা হাত ধরেন।

:সব ভুলে যা। প্রভু তোকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে। এখন স্বামীই সব।
:হুম। মা হাত ধরেন।
:অতীত শুধুই অতীত। কাউকে বলতে হয়নে।
:হুম।

মিতু মেনে নেয়। ‌কিন্তু অাস্তেআস্তে টের পায় মিতু। লোকটা ওকে গ্রাস করছে। পুতুলের মতন রাখার জন্য ওর খুঁত বের করার চেস্টা করছে। ওর মোবাইল ঘেটে নাম্বার নিয়ে লুকিয়ে অন্য সেজে ফোন করে পরিচয় বের করত। মিস্টি কথা বলে মেইল, ফেসবুক, স্কাইপ সব পাসওয়ার্ড নিয়ে নেয়। এরপর নিষিদ্ধ করে দেয় অনলাইন। অথচ তার সবই চলে। মিতু একবার জাবেদের মোবাইলে হাত দিয়েছিল। চিৎকার করে ওঠে সে।

:তোমার এত বড় সাহস! তুমি অামার ওপর গোয়েন্দাগিরি কর!

মিতু বোকা বনে যায়। ওর জীবনের লকলকে কচি পাতাগুলোন চিমসে যায়। দৃরন্ত সাঁতারের স্বপ্ন মৎসকুমারী কোথায় উঁবে পড়ে। খটখটে শুকনো উঠোনে একা করে দেয় জাবেদ নামক পুরুষটি। ধীরে অারও বাড়ে। বাড়তে থাকে পেঁচানো চক্র। মিতুকে দমাতে খুঁজে বের করে সেই মানুষ, প্রাক্তন রুবেলকে। দুনিয়ার কোন পুরুষ এমনটি করে কিনা জানেনা মিতু। খুঁজে বের করে কিনা স্ত্রীর প্রাক্তনকে! কারণ, স্ত্রীকে নিজের চাবি দেয়া পুতুল বানানো। বলে কিনা, “ভাই, একটা প্রমাণ দেন ওর বিরুদ্ধে।” আর সে প্রাক্তন বদমাশ কম কি গেল! বানিয়ে বানিয়ে অারও দশটা কথা হয়ত বলেছে। মিতু নিজ কানে শোনেনি। তবে হয়ত তাই।
মিতুর জীবনের কাঁচভাঙা জানালা গলে মহাসত্য হয়ে ওঠে সেই ভার্চুয়াল রাত।

:কয় রাত হোটেলে কাটিয়েছিস?
:একরাতও নয়।
:আমারে রুবেল ভিডিও দিছে অনেক রাতের। অারও দিব।
:তোদের বাসায় নাকি গিয়েছে?
:ইম্পসিবল!
:তাহলে তোর বাসার ঠিকানা জানে কেমনে?
:অনেকেই জানে!
:তোরা রিকশায় ঘুরেছিস?
:এটাও ইম্পসিবল!

মিতু অসহায় ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। ওর একটা ভুল তছনছ করে দিল সব। কেন সে এটা করল! এমন ভুল যেন আর কেউ না করে স্রষ্টা! মিতু ডিভোর্স চায় জাবেদের কাছে। ও মুক্তি দিতে চায় জাবেদকেও ওর কাছ থেকে। মিতু জানে ও কাউকে ঠকায়নি। বরঞ্চ ও নিজে ঠকেছে। ও ঠকেছে রুবেলের কাছে। জাবেদের কাছে। তবে ও জাবেদকেও ঠকাতে চায়নি। ও সব জাবেদকে বলতে চেয়েছিল। পারেনি সময়ের কারণে। কিন্তু বিয়ের পর টের পেয়েছে, ও আরেকবার ভুল করেছে। এলোক বউকে নিজের সম্পত্তি মনে করে, সম্পদ নয়। ‌মিতু সব কিছু থেকে মুক্তি চাইল। জাবেদ নারাজ। একটা ইস্যু সে পেয়ে গেছে। ব্ল্যাকমেইল শুরু হয়।

:তোর প্রাইভেট চাকরী বন্ধ ফকিন্নীর ঝি।
:কেন?
:তোর বাবাকে বলবি ঘুষ দিয়ে সরকারী চাকরী জোগার করতে।
:বাবা ঘুষ দিবে না।
:তাইলে তোর বাবা-মার সাথে যোগাযোগ বন্ধ। মনে করবি মইরা গেছে। অার আমার কতা যদি না মানছ তো তোর ভিডিও নেটে ছাড়মু। মিতু জানেনা কি ভিডিও! অাদৌ অাছে কিনা এমন ভিডিও তাও জানেনা। তবে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রতিদিন ফোন চেক হয়।

:তোর বাবার সাথে কোন কথা বলবিনা। যদি কস, তবে নেটে ছাড়মু। সবাইরে দেহামু।

মিতু ভেঙে পড়ে। কথা হয়না মায়ের সাথে। জন্মদাত্রী ওকে পেটে ধরে মনে হয় বিশাল ভুল করেছিল! কথা হয়না বাবার সাথে। কারণ সরকারী চাকরী, ঘুষ। কতটা জঘন্য হতে পারে মানুষ! তুইতােকারি, অত্যাচার, গালি! সব চলে। অার ভালবাসা রাতের চাহিদার সময়। সেটা উৎরে গেলেই অাবার ব্ল্যাকমেইল। ওর মাঝেমাঝে অাত্মহত্যার চিন্তা জাগে মাথায়। উদ্ভট চিন্তাটা মাঝেমাঝেই মাথাচাড়া দেয়। ও ঝেড়ে ফেলে অাবার। বাঁচতে হবে অন্যকারও জন্য নয়, বাবামার জন্য। দিনগোনে অাশার। সব গুড়েবালি। নতুন ইস্যু খুঁজে অানে জাবেদ।

:তুই নাকি রাকিবের সাথে রিকশায় চড়ছিলি?
:হুম, তো কি হইছে? রাকিব শুধু কলিগ না, ওকে অামি ছোটভাই মানি।
:তোর ঐ ছোটবাইয়ের লগে রাত কাটাইলে তোর বাচ্চা অইবনা?
:কতটা নীচে নামবে?
:নীচ? কাল থেইকা সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ। নো ছোটবাই, নো বান্ধবী।
:তোমার বোনওতো অন্যের সাথে ‌রিকশায় চড়ে!
:তুই কি অামার বোনের মতন ভাল? তার মানে ভালর সংগা শুধু তার বোন। টিভিতে কোন মেয়ে দেখলেই চলল।
:ওরা সব তোর মতই খারাপ। এতই যখন খারাপ মিতু, ওকে এ বন্ধনে আটকে কেন রেখেছে! মিতু মুক্তি চায়। তখনই অস্ত্র প্রয়োগ হয়।
:তোর ভিডিও সবাইরে দেখামু। মিতু হাপিয়ে ওঠে। দুমড়েমুচড়ে ভেঙে অাবার জোড়া লাগে। ওর ছোট্টবুকে শক্তি জোগায়।

:অামাকে বাঁচতে হবে। ভুল একটা অামি করেছি। তার শাস্তি কি এমন! বন্দীত্ব? বাবামাকে হারানো। সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া। সর্বোচ্চ ডিগ্রী অামাকে কি দিয়েছে?
উত্তর খোঁজে মিতু। দেয়াল কানে কানে প্রশ্ন করে।

:সকালে যাবার অাগে যখন প্রশ্ন করেছিল, “আমি অফিসের পিকনিকে নিয়ে গেলে যাবি?”তোমার উত্তর ছিল, ” তুমি নিলে যাব।” জবাব কি পেয়েছিলে? থাপ্পর। অার? “ফকিন্নীর ঝি, তোর বাপমা এই শিক্ষাও দেয় নাই যে, এসবে তোর মতন মেয়ের যাইতে নাই। মাগী কোনখানকার।” এমন স্বামীর ঘর চাও তুমি! ভুলে গেছ অাজকের থাপ্পর!
মিতুর বুকের ভেতর প্রবল সাহসেরা একটু একটু করে জায়গা নেয়। দমকা বাতাসের মতন উড়ে আসে তিরতির সাহসের তিতলী। ফোন দেয় বাবাকে।

:বাবা, অামি কি তোমার মেয়ে?
:বড় অাদরের কলিজার টুকরা।
:তবে অামাকে মুক্ত কর।
:অামি অাসব ‌তোকে নিতে?
:অবশ্যই। অার অামি রুবেল, জাবেদ ওদের শাস্তি চাই।
:অবশ্যই হবে।

মিতু টের পায় বাবা কাঁদছে। দুঃখে নয়, সুখে। কারণ তার মেয়ে ভয়কে জয় করতে পেরেছে। একটা ব্ল্যাকমেইলের ভয়, একটা ভিডিওর ভয়, অকথ্য ভাষায় গালির ভয়, দিনরাত যখনতখন মারের ভয়, মুখ বুঁজে কাঁদার ভয়, অাত্মহত্যার ভয়, সব । মিতু সব পিছনে ফেলে এক জাবেদ নামের অমানুষের ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছে। ওর একটি ভুলের মাশুল দেয়া শেষ হল বুঝি অাজ।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত