শিলং পাহাড়ে শীতের শুরুতেই এবার বেশ ঠান্ডা পড়েছে। ধুতির ওপর গায়ে গলাবন্ধ কোট, কানঢাকা লাল উলের টুপি পরে পুলিশবাজার ম্যালে শেষ বিকালে বসে ছিলেন নকুড়বাবু!বেঞ্চে পাশে পড়ে ছিল সান্ধ্য ‘শিলং টাইমস।’ কাগজটা পড়া হয়ে গেছে। ‘বড়াপানি লেকে বাইচ ফেস্টিভাল’ ‘গারোপাহাড়ে ধস নেমেছে, ‘অরফ্যান হাউস থেকে গতকাল একটা বাচ্চা চেরাপুঞ্জি বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ’ –এছাড়া কাগজে কোনো খবর নেই। কাগজ পড়ার পর চুপচাপ বসে চারদিক লক্ষ করছিলেন তিনি।
পুলিশবাজারের এ অঞ্চলটাকে শিলংএর প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। রিং রোডের চারপাশে অনেক রাস্তা এসে মিলেছে। চারপাশে রঙচঙে শীতবস্ত্রর দোকান, ফুটপাতে খাসি বিক্রেতারা বসে থাকে রঙিন শাল আর অর্কিডের পসরা
নিয়ে। সারাদিন এ অঞ্চলে টুরিস্টদের ভিড় লেগে থাকে। তবে সারা দিন পর সে ভিড় ফাকা হয়ে এসেছে। দোকানপাটের ঝাপ বন্ধ হচ্ছে। ফুটপাতের বিক্রেতারাও তাদের মালপত্র গুটিয়ে রওনা দিচ্ছে দূরে খাসি গ্রামের দিকে। পাহাড়ি সব শহরেই সন্ধ্যা নামলে রাস্তা ফাকা হয়ে যায়। শিলং শহর আর তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো নকুড়বাবুর কাছে নতুন নয়। প্রতিবছর এসময় দিন কয়েকের জন্য শিলং-এ আসেন তিনি।
কিছুটা কাজের জন্য , কিছুটা চেঞ্জের জন্য। একলাই আসেন। কলকাতায় তার একটা আয়ুর্বেদ ওষুধের দোকান আর ছোট একটা বই প্রকাশনা সংস্থা আছে। শিলং হল বনওষধির স্বৰ্গরাজ্য। খাসি পাহাড়, গারো পাহাড়ে অজস্র ভেষজ লতা গুল্ম মেলে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও মেলে না। নকুড়বাবু এখানকার বন-জঙ্গল থেকে সে সব সংগ্রহ করে নিয়ে যান। এছাড়া অৰ্কিড সংগ্ৰহরও নেশা আছে তার। শিলংএর নানা রঙের বিখ্যাত অর্কিডও তাঁকে এখানে টেনে আনে। দিন তিনেক হল তিনি শিলঙে এসেছেন। এবার লতাগুল্ম আর অর্কিডও, সংগ্রহ করেছেন প্রচুর। নকুড়বাবুর মন বেশ খুশি। আরও একদিন থেকে তিনি গৌহাটি হয়ে কলকাতা ফিরবেন।
নকুড়বাবুর তাড়া তেমন কিছু ছিল না। আরও বেশ কিছুক্ষণ বসার পর নকুড়বাবু যখন উঠলেন তখন রাস্তা জনশূন্য। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে, ফুটপাতের দোকানীরাও নেই। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। আর তার সাথে সাথে কুয়াশার চাদরে ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। হোটেল বেশ কিছুটা দূর। সেখানে যাবার জন্য একটা নির্জন রাস্তা ধরলেন তিনি। কিছুটা এগোবার পর হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, রাস্তার পাশে ঘোলাটে ল্যাম্পপোস্টের নিচে লাল-কালো ডোরাকাটা খাসি চাদরমুড়ি দিয়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ। তার সামনে রাখা ছোটছোট পিচবোর্ডের বাক্সে রাখা অর্কিডের পসরা। পাশ দিয়ে যাবার পথে কৌতুহলবশত তার অর্কিডের পসরার সামনে দাঁড়ালেন নকুড়বাবু। মুখে অসংখ্য বলিরেখাময় বৃদ্ধ তার উদ্দেশে বলল, “খু – ব্লেই’ নকুড়বাবুও বললেন, “খু – ব্লেই’। খাসি ভাষায় এ শব্দের অর্থ, ‘গুড ইভনিং’।
অৰ্কিড দেখতে লাগলেন নকুড়বাবু। ‘লেডি স্লিপার, ‘রূ-ভেল্ডা, শিলং-এর বিখ্যাত সব অর্কিড বাক্সে রাখা। তবে এ সব তার সংগ্রহে আছে। হঠাৎ একটা বাক্সে খড়ের বিছানাতে রাখা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলেন তিনি। ঠিক টেনিস বলের আকৃতির একটা উদ্ভিদ। তাদের রং ঘোর রক্তবর্ণ। সংখ্যায় দুটো। প্রত্যেকটার গায়ে ইঞ্চিখানেক লম্বা ফিতের মতো দুটো অঙ্গ। তাদের আকৃতি দেখে নকুড়বাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘এগুলো কি রেড ক্যাকটাস?’
বৃদ্ধ মিটি মিটি হেসে জবাব দিল, ‘ক্যাকটাস নয়, অর্কিড’ এরকম অদ্ভুত আকৃতির অর্কিড হয় নাকি! ‘এ জিনিস কোথায় পাওয়া যায়?’ জানতে চাইলেন নকুড়বাবু।
বৃদ্ধ বলল, মোরা অর্থ্যাৎ চেরাপুঞ্জিতে মসমাই কেভের ভিতরে। মসমাই গুহা! সেখানে ইতিপূর্বে গেছেন নকুড়বাবু। তিনি বললেন, ‘কই সেখানে আমি এ জিনিস দেখিনি তো ?’
বৃদ্ধ হেসে বলল, ‘না দেখারই কথা। কুড়ি বছরে সে জিনিস একবার জন্মায়। তাছাড়া টুরিস্টরা যে পথে গুহায় ঢোকে সে পথে ও জায়গাতে পৌছানো যায় না। গুহা অনেক বড়। অন্য পথে সেখানে যেতে হয়। নকুড়বাবু অর্কিডগুলো ভাল করে দেখার জন্য সেই বাক্সর দিকে হাতবাড়াতে গেলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ বাক্সটা ছোঁ মেরে কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘ছোঁবেন না। এর গুণ নষ্ট হয়ে যাবে।’
“কি গুণ?’ জানতে চাইলেন তিনি।
বৃদ্ধ মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে তাকে অবাক করে দিয়ে বলল “এ খেলে মানুষের বয়স কমে যায়। খেলে বয়স কমে! সংস্কৃত আয়ুর্বেদিক প্রাচীন পুথিতে এধরনের কিছু উদ্ভিদের কথা পড়েছেন ঠিকই তিনি, কেউ কেউ এসব বিশ্বাস করলেও নকুড়বাবু কথাটা বিশ্বাস করেন না। বয়স আবার কমে নাকি! লোকটা হয়তো তার সংস্কার বিশ্বাস থেকে অথবা খদ্দেরকে প্রলুব্ধ করতে এ কথাটা বলছে। তবে জিনিসটা দেখে নকুড়বাবুর মনে হল, ক্যাকটাস না হয়ে সত্যি ওগুলো অর্কিড হয়ে থাকলে ওটা যে রেয়ার জিনিস তাতে সন্দেহ নেই। কোনো বইতে এ অর্কিডের ছবি দেখেননি তিনি। এ জিনিস তাকে সংগ্রহ করতে হবে।
কিছুক্ষণ অর্কিডগুলো দেখার পর নকুড়বাবু বেশ কৌশলী ভাবে বললেন, ‘বয়স কমার গল্প বলে দাম বাড়িয়ে লাভ নেই। কি দাম নেবে বলো ?’
বৃদ্ধ জবাব দিল, দাম বাড়াচ্ছি না। হাজার টাকা দিলেও এ জিনিস এখন আমি বেচব না। আমার নিজের কাজে লাগবে। আপনি যদি সত্যি এ জিনিস চান, তবে কাল বিকালে মসমাই কেভের কাছে ‘সেভেন সিস্টার্স ওয়াটার ফলস এর কাছে ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে চলে আসুন। আমি আপনাকে গুহায় নিয়ে যাব। যত খুশি অর্কিড সংগ্রহ করবেন।
নকুড়বাবু তার কথার জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলেন অর্কিড দুটোর দিকে। অদ্ভুত অৰ্কিড দুটোর প্রতি আকর্ষণ ক্রমেই বাড়ছে। সংগ্রাহকরা পছন্দসই জিনিসের খোজ পেলে তা হাতছাড়া করতে চান না। তার জন্য অনেক দূর ছোটেন।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বৃদ্ধ বলল, ‘কি ভাবছেন? গুহায় যেতে ভয় পাচ্ছেন? তাহলে এ জিনিস আপনার পাওয়া হবে না।’
নকুড়বাবু তার কথা শুনে বলল, “না, ভয় পাচ্ছি না। এখানকার অনেক কেভে আমি একলাই ঘুরেছি। কিন্তু ওখানে গেলে তোমাকে পাব তো? তাহলে যাব ওখানে ।’
উজ্জ্বল চোখে বৃদ্ধ বলল, “হা, আমি নিশ্চই থাকব। আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন ওখানে গেলে। আমি আপনার প্রতীক্ষা করব।
ও অঞ্চলে বেশ কিছু অন্য ভেষজ গাছও আছে। গেলে সেগুলো অন্তত সংগ্রহ করা যাবে। এই ভেবে এবং বৃদ্ধর শেষ কথাগুলোর মধ্যে এমন একটা আহ্বান ছিল যে শেষ পর্যন্ত নকুড়বাবু সেখানে যাবেন বলে রাজি হয়ে গেলেন।
বৃদ্ধর বলিরেখাময় মুখে আরও হাসির রেখা খেলে গেল। সে একবার শুধু বলল, “আমি লোক চিনি। জানতাম আপনি রাজি হবেন।’
কথাগুলো বলে সে তার জিনিসপত্র গুছাতে শুরু করল। নকুড়বাবু ফেরার পথ ধরলেন। বেশ কিছুটা এগোবার পর নকুড়বাবুর খেয়াল হল, লোকটার নাম-ধাম তো কিছু জানা হল না। আবার পিছু ফিরলেন তিনি।
কিন্তু সেই ল্যাম্পপোস্টের কাছাকাছি এসে তিনি দেখলেন, কুয়াশার চাদরমুড়ে ল্যাম্পপোস্টটাই একলা দাঁড়িয়ে আছে। সে চলে গেছে।
নকুড়বাবু পরদিন দুপুরবেলার মধ্যেই পৌছলেন মসমাইতে। হাতে সময় নিয়ে এসেছেন। কারণ, জঙ্গল থেকে নিজের প্রয়োজনে বেশ কিছু উদ্ভিদ সংগ্রহ করবেন তিনি। খাসি পাহাড়ে অবস্থিত এ জায়গাতে আগেও তিনি এসেছেন। উচু জায়গার মাথার ওপর দাড়িয়ে আছে পাইন, রডোডেনড্রন, বাঁশ ইত্যাদি গাছের ঘন জঙ্গল। তাছাড়া নানা ঝোপে ঝাড়ে বৃক্ষকাণ্ডে নানা ভেষজ লতাগুল্ম আর অর্কিডের সমারোহ তো আছেই। কাছেই মসমাই কেভ। মসমাই ফলস, সেভেন সিস্টার্স ফলস ইত্যাদি জলপ্রপাত। আকাশের মতিগতি এখানে বড় বিচিত্র। এই মেঘমুক্ত ঝকঝকে আকাশ, তার পরক্ষণেই আবার মুষলধারে বৃষ্টি। যে বৃষ্টি চির সবুজ করে রাখে এখানকার প্রকৃতিকে, পুষ্ট করে পাহাড়ের বুক থেকে , নেমে আসা দুধ- ফেননিভ অসংখ্য জলপ্রপাতকে। তৈরি হয়েই এসেছেন নকুড়বাবু। সঙ্গে বর্ষাতি, ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করার জন্য পলিথিনের ব্যাগ। তা ছাড়া জল, শুকনো খাবার ইত্যাদিও তাঁর সঙ্গে আছে। বিকাল হতে ঘন্টাখানেক বাকি। জঙ্গলে ঢুকলেন তিনি। কাজ মিটিয়ে ঠিক সময় যাবেন কাছেই সেভেন সিস্টার্সে।
জঙ্গলে ঢুকে প্রয়োজনীয় গাছ-গাছড়ার সন্ধান করতে লাগলেন তিনি। কিছু ব্যাগেও ভরতে লাগলেন। তিনি তখন বেশ অনেকটা ভিতরে প্রবেশ করেছেন, হঠাৎ কেউ যেন একটা বিরাট কালো চাদর বিছিয়ে দিল জঙ্গলের মাথায়।
তিনি ওপরে তাকিয়ে দেখলেন বিরাট একখণ্ড কালো মেঘ উপস্থিত হয়েছে জঙ্গলের মাথায়। চেরাপুঞ্জিতে এ ঘটনা হামেশাই ঘটে। অন্ধকার নেমে এল চারপাশে। আর তারপরই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। বর্যাতি আর ছাতা মাথায় একটা গাছের তলায় দাড়িয়ে নকুড়বাবু নিজেকে বাঁচাতে লাগলেন।
হঠাৎ তিনি দেখলেন কয়েক হাত তফাতে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। পরনে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা লংকোট। মাথায় একটা হ্যাট। যদিও টুপিটা তার মুখকে অর্ধেকটা আড়াল করে রেখেছে, তবুও নকুড়বাবুর মনে হল লোকটা যেন তাকেই দেখছে। লোকটা কে ? ভবঘুরে ধরনের কেউ ?
নকুড়বাবু তাকে দেখতে লাগলেন। লোকটাই প্রথমে মুখ খুলে স্পষ্ট ইংরাজিতে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি টুরিস্ট?” নকুড়বাবু জবাব দিলেন, ‘না, ঠিক তা নয়। আমি কিছু গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করতে এসেছিলাম। ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে। তা আপনি?”
লোকটা প্রথমে বলল, “ও আপনি বনওষধি সংগ্রহ করছেন! তারপর একটু থেমে বলল, “আমিও আপনার গাছ-গাছড়া খুঁজি । ”
লোকটার ইংরাজি কথা আর কথা বলার ঢং দেখে এবার তাকে ঠিক ভবঘুরে টাইপের বলে মনে হল না নকুড়বাবুর। লোকটা যেন একটু ইতস্তত করে এরপর নকুড়বাবুরর পাশে এসে দাঁড়াল। তাকে কাছ থেকে দেখে নকুড়বাবু বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন। লোকটার মুখ আর হাতের ধবধবে সাদা রঙ বলে দিচ্ছে লোকটা বিদেশী। ভবঘুরে দের চামড়া এত ফর্সা হয় না। এ জন্যই সে ইংরাজিতে কথা বলছে নকুড়বাবু জানতে চাইল, “আপনিও কি ভেষজ সংগ্রহ করেন? ”
সে জবাব দিল, “আসলে আমি একজন বটানিক। খাসি পাহাড়ের জঙ্গলে নানা ধরনের ফিচার প্ল্যান্ট, মাংসাশী উদ্ভিদ পাওয়া যায় আপনি নিশ্চই জানেন। তার ওপর একটা বই লেখার জন্য আমি দেশে এসেছি। মানে, এসেছিলাম।”
“কোথা থেকে? এসেছিলাম মানে, আপনি এখন এখানেই থাকেন ?”
“হা, এখানেই থাকি। অনেক বছর ধরে। আমার নাম উইলিয়াম স্পেনসর। জাতিতে ইংলিশম্যান। তবে সে দেশে আর ফেরা হল না।”
—একটা বিষগ্নতা যেন ঝরে পড়ল তার কণ্ঠস্বরে। সৌজন্যবশত এরপর নিজের পরিচয় দিয়ে নকুড়বাবু বললেন, “ফেরা হল না কেন? এখানেই সংসার পেতেছেন, নাকি বই লেখার কাজ শেষ হয়নি?”
সে জবাব দিল, “সংসার আমার নেই। আর, বই লেখার কাজও শেষ হয়ে গেছিল। জানেন, কত নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম তাতে! মানুষ জানলে উপকৃত হত। কত নতুন নতুন উদ্ভিদের কথা লেখা ছিল। হয়তো ভেষজ বিজ্ঞানের কাজে আসত।”
নকুড়বাবু বললেন, “তা বইটা কি হল? ছাপাননি নাকি?”
লোকটা বলল, “ছাপাবার আগেই তো …” প্রথম কথাটা সম্পূর্ণ করল না লোকটা। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা আপনার তো প্রকাশনার ব্যবসা আছে। বইটা দিলে আপনি ছাপাবেন?’ নকুড়বাবু জবাব দিলেন, “পাণ্ডুলিপিটা দেখা দরকার। ভালো হলে নিশ্চয়ই ছাপব। তা সেটা এখন কোথায়?”
স্পেনসর নামের লোকটা প্রথমে বেশ উৎফুল্ল ভাবে বলল, “ভালো হলে ছাপবেন! জানেন, ওতে এমন উদ্ভিদের কথা লেখা আছে যে সবাই চমকে যাবে! আসলে ওর ব্যাপারে জানতে গিয়েই তো..।”
আবারও কথা শেষ করল না লোকটা। একটু বিসন্ন কণ্ঠে বলল, “পাণ্ডুলিপিটা আমার কাছে এখন নেই। ওটা মসমাই কেভে রাখা আছে। আনতে হবে। তা আপনাকে আমি পাব কিভাবে?”
নকুড়বাবু একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন কথাটা ‘আজ আমি মসমাই কেভে যাব। আসলে সে কারণেই এখানে আসা একজন নিয়ে যাবে। আচ্ছা আপনি তো এখানকার উদ্ভিদ নিয়ে বসে করেছেন, এমন কোন অর্কিড দেখেছেন, যা লাল বলের মতো দেখতে? যা মসমাই কেভে পাওয়া যায় ?’
লোকটা প্রশ্ন শুনে যেন বিস্মিতভাবে তাকিয়ে থাকল নকুড়বাবুর দিকে। তারপর বলল, “হা, দেখেছি। ওটা ওখানেই পাওয়া যায়। আপনি নিশ্চই শিলংবাজারে কোন খাসি বৃদ্ধর কাছে ওটা দেখেছেন? আর সেটা সংগ্রহ করতেই তার আমন্ত্রণে এখানে এসেছেন?” বিস্মিত নকুড়বাবু বললেন, “হ্যা, ঠিক তাই। কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?”
একটু চুপ করে থেকে লোকটা বলল, “আপনি আমার লেখাটা পড়লে উত্তরটা পেয়ে যেতেন। আচ্ছা আমি এখন চলি।”
এই বলে লোকটা নকুড়বাবুকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হঠাই যেন বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
“অদ্ভূত লোক তো! যেমন হঠাৎ এল, তেমনই চলে গেল!” মনে মনে ভাবলেন নকুড়বাবু। বৃষ্টি ধরেছে, আকাশ আবার ফর্সা। নকুড়বাবু। কিছুক্ষণ লোকটার কথা ভেবে পা বাড়ালেন বনের বাইরে যাবার জন্য।
সেভেন সিস্টার্স ফলস। জায়গাটা নকুড়বাবুর চেনা। মসমাই কেভের গুহামুখ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। একটা প্রকাণ্ড গহ্বরের গা বেয়ে বর্ষণসিক্ত চেরাপুঞ্জির সাতটি দুগ্ধফেনিভ জলধারা নেমে গেছে পাতালের দিকে। তাই এর নাম ‘সেভেন সিস্টার্স’। জলপ্রপাতের কাছে একটা উচু জায়গাতে সেই লোকটার প্রতীক্ষা করছিলেন নকুড়বাবু। দূরে খাসি পাহাড়ের মাথায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে সামনের ঘাসবনে, কিছু দূরে অরণ্যের মাথায়, নির্জন প্রান্তরে। বেশ ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। নিস্তব্ধ চারদিক, অপূৰ্ব শান্ত সৌন্দর্য বিরাজ করছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামবে। সেই লোকটা ঠিক, আসবে তো? নিকটবর্তী খাসি গ্রাম মাইলখানেক দূরে। সে না এলে সেখানে পৌছতে রাত হয়ে যাবে। কথাগুলো ভেবে ঘড়ি দেখলেন নকুড়বাবু।
আর তার পরক্ষণেই তিনি দেখতে পেলেন তাকে। লাল-কালো সেই খাসি শাল গায়ে ঘাসবন ভেঙে এগিয়ে এসে নকুড়বাবুর সামনে দাঁড়িয়ে সে বলল, “খু – ব্লেই’। মুখে তার হাসি। শেষ বিকালের আভা এসে পড়েছে তার মুখে।
সেই আলোতে নকুড়বাবুর মনে হল, এ লোকটাকে গতকাল কুয়াশামাখা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে যত বৃদ্ধ মনে হয়েছিল, আসলে তা নয়। মুখময় বলিরেখা গুলো যেন তেমন আর নেই। লোকটাকে প্রৌঢ় বলা যায়।
নকুড়বাবুও তাকে “খু – ব্লেই’ জানিয়ে বললেন, “যাক তুমি তাহলে এলে! তোমার নাম কি? কাল সেটা জানা হয়নি।”
সে জবাব দিল, “আমার নাম ‘মত্ত-কাবা’। এই খাসি পাহাড়েই আমার ঘর।” তারপর চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “চলুন এবার রওনা দেওয়া যাক।”
নকুড়বাবু অনুসরণ করলেন তাকে। লোকটা গিয়ে দাঁড়াল জলপ্রপাতের খাদের কিনারে। নকুড়বাবুর উদ্দেশে একবার শুধু বলল, “সাবধানে নামবেন” তারপর দুটো জলপ্রপাতের মধ্যে দিয়ে ধাপ বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। নকুড়বাবুও তার পিছন পিছন নামতে লাগলেন।
পা ফসকালেই অবধারিত মৃত্যু, দু-পাশের জলপ্রপাতের জলের ছিটেতে ভিজে যাচ্ছে দেহ। প্রায় একশফুট নিচে নেমে দাঁড়াল লোকটা। পাথুরে দেওয়ালে নানা ঝোপঝাড়, জলজ উদ্ভিদ। দেওয়াল হাতড়ে একটা ঝোপ সে ফাক করতেই উন্মোচিত হল এক গহুর। অন্ধকার বিরাজ করছে ভিতরে। এই তাহলে গুহামুখ ! নকুড়বাবুকে নিয়ে প্রবেশ করল ভিতরে। ঠিক তখনই বাইরে ঝুপ করে অন্ধকার নামল। ভিতরে ঢুকে লোকটা একটা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করল।
সর্পিল গুহা। মাথার ওপর ছাদ অনেক জায়গাতে এমন নিচু যে অনেক সময় হামাগুড়ি দিতে হচ্ছে। দেওয়ালগুলো সাতস্যাতে। বরফের মতো ঠান্ডা। মাঝে মাঝে ওপর থেকে নেমে এসেছে স্তম্ভের মতো চুনা পাথরের ঝুড়ি। নিঃশব্দে এগোতে থাকল লোকটা। একবার শুধু নকুড়বাবুর প্রশ্নের জবাবে সে জানাল যে সেখানে পৌছতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে।
ঘন্টাখানেক পর নানা কসরত করে চলার পর নকুড়বাবুর তখন কাহিল অবস্থা। মত্ত-কাবা এবার যেন নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “আমরা এসে গেছি। আর এরপরই ধীরে ধীরে চওড়া হতে শুরু করল গুহা মুখ। মশালের আলোতে একটা অদ্ভত জিনিস দেখতে পেলেন নকুড়বাবু। দেওয়ালের গায়ে একটা পাথরের খাঁজে আটকে আছে বাচ্চা ছেলেদের লাল জামা।
নকুড়বাবু সেটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেওএ জামাটা কোথা থেকে এল!” লোকটা মুহুর্তের জন্য একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল, “জানি না, আসুন তাড়াতাড়ি পা চালান।” নকুড়বাবুর মনে হল, ইচ্ছা করেই যেন সে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা হলঘরের মতো জায়গাতে উপস্থিত হলেন। মাথার ওপর ফাটল বেয়ে আবছা চাঁদের আলো ঢুকছে সে ঘরে। তারা সে ঘরে পা রাখতেই এক ঝাক বাদুড় ডানা ঝাপটে মাথার ওপরের ফাটল দিয়ে বাইরে মিলিয়ে গেল। বাদুড় প্রাণীটা এখানকার প্রায় গুহাতেই থাকে। ঘাবড়ালেন না নকুড়বাবু। প্রৌঢ় খাসি লোকটার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, “এই সেই জায়গা। এই বলে সে মশালটা নিচের দিকে ধরে আলো ছড়াল মাটিতে। সেখানে ছড়িয়ে আছে নানা আকৃতির পাথর। বিস্মিত নকুড়বাবু দেখলেন তাদের খাজে খাঁজে জন্মে আছে বলের মতো অসংখ্য সেই উদ্ভিদ! তবে, তাদের রঙ ধবধবে সাদা। দেওয়ালের গা থেকেও বুলছে বেশ কিছু।
নকুড়বাবু বললেন, “কিন্তু, এদের রং সাদা কেন?”
মত্ত-কাবা হেসে জবাব দিল, রঙ ধরবে। চাঁদ ভালো করে ওপরে উঠুক। সেই আলো গুহায় ঢুকলেই রঙ ধরবে। তার আগে ওদের ছোঁবেন না। রঙ ধরলে ওগুলো সংগ্রহ করে বেরব এখান থেকে।” কিছু কিছু উদ্ভিদ আলো পেলে তবেই রঙিন হয়, এ ব্যাপারটা জানা আছে নকুড়বাবুর। তিনি জায়গার চারপাশে তাকালেন। আরও কয়েকটা গুহ পথ বেরিয়েছে নানা দেওয়াল থেকে। হঠাৎ একটা কোণে চোখ আটকে গেল তাঁর। সেখানে দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা নরকঙ্কাল! চমকে উঠে নকুড়বাবু বললেন, ‘ওটা কার কঙ্কাল?’
মত্ত-কাবা হেসে বলল, “ওটা আমি কুড়ি বছর ধরে ওখানে দেখছি। হয়তো লোকটা এখানে এসেছিল, তারপর বেরতে পারেনি।”
নকুড়বাবু গিয়ে দাঁড়ালেন কঙ্কালটার সামনে। লোকটা ঠিকই বলল, কঙ্কালটা অনেক পুরনো। চুনের প্রলেপ জমেছে তার গায়ে। একটা মাকড়সা তার চোখের এক কোটর থেকে বেরিয়ে অন্যটাতে ঢুকে গেল। একটা ছোট কাঠের চ্যাপ্টা বাক্স পড়ে আছে লোকটার পাশে ইঞ্চি ছয়েক লম্বা আর ওরকমই চওড়া। সম্ভবত মৃত লোকটারই জিনিস হবে। কৌতুহলবশত নকুড়বাবু সেটা তুলে নিতেই সেই খাসি লোক টা বলে উঠল, “ওখান থেকে চলে আসুন। সাপের বাসা আছে ওখানে।” সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে সরে এলেন নকুড়বাবু। মত্ত-কাবা এতক্ষণে মশালটাকে পাথরের খাজে খাজে একটা বেশ উচু পাথরের ওপর পা থেকে মাথা চাদরে মুড়ে বসে পড়েছে।
নকুড়বাবু এগিয়ে এসে সেই পাথরের নিচে মত্ত-কাবার মুখোমুখি একটা নিচু পাথরে বসলেন। তার চারপাশে পাথরের খাঁজে ফুটে আছে থোকা থোকা অসংখ্য সেই বলের মতো অর্কিড। নকুড়বাবু অর্কিডগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর প্রশ্ন করলেন, “তুমি এ গুহার খোঁজ পেলে কি ভাবে?”
চাদরে-মুখ-ঢাকা মত্ত-কাবা যেন হাসল, কিন্তু উত্তর দিল না। নকুড়বাবু এরপর মনোনিবেশ করলেন বাক্সটার দিকে। অনেক পুরনো বাক্স। মুখটা এঁটে গেছে। সেটা খুলতে না পেরে তিনি সেটা চালান করে দিলেন ব্যাগের ভিতর। পরে দেখা যাবে কি আছে। নকুড়বাবু প্রতীক্ষা করতে লাগলেন কখন চাদের আলো মাথার ওপরের ফাটল দিয়ে ঘরে এসে ঢোকে তার জন্য।
সময় এগিয়ে চলল। মত্ত-কাবার কোন সাড়াশব্দ নেই। চাদরে মুখ ঢেকে সে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। চাঁদের আলো ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। নকুড়বাবু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন অর্কিডগুলোর দিকে। একসময় চাদ যখন মাথার ওপর উঠল, তখন সেই আলোতে ভরে উঠল গুহা কিন্তু নকুড়বাবু দেখলেন কোন অর্কিডেই কিন্তু রঙ ধরল না। চাদের আলোতে সেগুলো শ্বেতপাথরের বলের মতো দেখাচ্ছে। ‘রঙ ধরছে না কেন?’ মত্ত-কাবাকে ডাকবেন ভাবলেন নকুড়বাবু।
নকুড়বাবুর ডান হাতটা পাথরের ওপর ভর দেওয়া ছিল অনেকক্ষণ ধরে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে মত্ত-কাবাকে ডাকতে যাবেন, হঠাৎ তাঁর মনে হল। হাতটা কেমন যেন বেশ লাগছে! হাতটা তিনি তুলে ধরতেই দেখতে এক অদ্ভুত ব্যাপার! তার কবজির কাছে আটকে আছে লাল টেনিস বলের মতো
একটা অর্কিড!! নকুড়বাবু বাঁ হাত দিয়ে তাকে কবজি থেকে তুলতে যেতেই তিনি বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। অর্কিডের ফিতের মতো অংশ দুটো। পেচিয়ে ধরেছে তার কবজি। আর তার প্রান্ত ভাগ দুটো প্রবেশ করেছে তার চামড়ার ভিতর। আসলে ঐ ফিতের মতো অংশদুটো চোষক নল। যা ধমনী থেকে নিঃশব্দে রক্ত চুষে নিয়ে রং ধরাচ্ছে মসমাই অৰ্কিডে! আর এর পর মুহুর্তেই তিনি অনুভব করলেন তার গোড়ালির উপরিভাগে, ঘাড় ইত্যাদি উন্মুক্ত স্থানগুলোতে একইরকম অসাড়তা। ‘মত্ত-কাবা!’ চেচিয়ে উঠে
নকুড়বাবু তার দেহ থেকে লাল অর্কিডগুলো মাটিতে ছুড়ে ফেলতে লাগলেন। ঠিক বিড়াল যেমন নিঃশব্দে লাফ দেয় ঠিক তেমনই পাথরের ওপর থেকে নেমে এল মত্ত-কাবা। তারপর যেন কোন মহাৰ্ঘ বস্তু সংগ্ৰহ করছে এমনভাবে কুড়োতে লাগল নকুড়বাবুর ছুড়ে ফেলা লাল অর্কিডগুলো। সবগুলো মিলিয়ে গোটা ছয়েক হবে। সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সে নকুড়বাবুর মুখোমুখি দাঁড়াল। চাদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। সেই আলোতে জ্বলজ্বল করছে তার চোখ, ঠোটের কোণে অদ্ভূত হাসি ফুটে উঠেছে। হিসহিস করে সে নকুড়বাবুর । উদ্দেশে বলল, বলেছিলাম না, চাদের আলো ফুটলে রঙ ধরবে অর্কিডে!”
কথাগুলো বলেই সে একটা অর্কিড মুখে পুরে চিবুতে শুরু করল। তার দু-কষ বেয়ে চুইয়ে পড়তে লাগল তাজা রক্ত! নকুড়বাবুর রক্ত! আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন নকুড়বাবু। অট্টহাস্য করে উঠল, মত্ত-কাবা। সেই পৈশাচিক হাসি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাথুরে দেওয়ালে।
সামনে একটা গুহামুখ দেখে আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে নকুড়বাবু ছুটতে শুরু করলেন সে পথে । পিছনে শোনা গেল মত্ত-কাবার কণ্ঠস্বর, “কোথায় পালাবেন? পালাবার কোন পথ নেই এখানে!” আর তার সঙ্গে সেই বীভৎস হাসি! পাগলের মতো গুহাপথ ধরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে অন্ধকারে দিকশূন্য ভাবে ছুটতে লাগলেন নকুড়বাবু। পাথরে অনুরণিত হচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর—‘কোথায় পালাবেন..কোথায় পালাবেন..’
হঠাৎ একটা ঝাঁকের মাথায় তিনি দেখতে পেলেন তাঁর রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি! আর মনে হয় পালানো গেল না। তবে বাঁচার শেষ চেষ্টা করার জন্য নকুড়বাবু একটা পাথর কুড়িয়ে দিলেন সে কাছে এলেই সেটা ছুড়ে মারবেন বলে। ঠিক সেই সময় ছায়ামূর্তি বলে উঠল, “আসুন, আমাদের সঙ্গে আসুন, নইলে আপনি বাচবেন না!” এ কার গলা? এ তো মত্ত-কাবা নয়! তার সঙ্গে একটা বাচ্চাও আছে মনে হয়! লোকটা আবার সাড়া দিল, “তাড়াতাড়ি! মত্ত-কাবা আপনাকে অনুসরণ করছে। ও এলে আপনাকে বাঁচানো যাবে না!”
“আরে এ তো জঙ্গলের মধ্যে দেখা সেই লোকটা!”—তার কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পারলেন নকুড়বাবু। পিছন ধেয়ে আসছে মত্তকাবার পদশব্দ আর সেই রক্তজল-করা হাসি। আর দেরি না করে নকুড়বাবু ছুটতে শুরু করলেন তাদের পিছু পিছু। কত সুড়ঙ্গ, কত গুহামুখ অতিক্রম করে ছুটে চললেন তিনি। শুধু ছুটতে ছুটতে নকুড়বাবুর একবার যেন মনে হল সেই ছায়ামূর্তি দুটোর যেন মাটিতে পা পড়ছে না, তারা যেন বাতাসে ভেসে এগোচ্ছে! এক সময় পিছনে পড়ে রইল মত্ত-কাবার সেই হাসি, গুহার বাইরে উন্মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালেন তারা। এ জায়গা নকুড়বাবুর চেনা। দিনের বেলা টুরিস্টরা এপথে মসমাই কেভে ঢোকে।
নকুড়বাবু তাকালেন তাদের দিকে। লোকটার মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি। মনে হয়ে সেটা নকুড়বাবুকে বাচানোর জন্য। সঙ্গের ছেলেটার বয়স বছর দশেক হবে। সে একটু বিসন্ন, গায়ে লাল জামা। নকুড়বাবু প্রাথমিক বিহুলতা কাটিয়ে বললেন, “মত্ত-কাবা লোকটা কে?
স্পেনসর বলল, “ও আমার আর এই বাচ্চাটার মতো। তবে ওর দেহ আছে। লাল মসমাই অৰ্কিড ওর দেহকে যুগযুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই অর্কিড ওকে বৃদ্ধ থেকে যুবক করে তোলে। সে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি থাকে ভয়ঙ্কর কেউ।”
নকুড়বাবু তার বক্তব্য সম্পূর্ণটা বুঝতে না পারলেও কিছুটা অনুমান করলেন। এরপর তিনি ছেলেটাকে দেখে বললেন, “এ কে?” সে বলল, “মত্ত-কাবার শেষ শিকার। গতকালই ওকে এখানে এনেছিল সে। ঠিক কুড়ি বছর আগে যেমন আমি ওর শিকার হয়েছিলাম। যেমন আপনি হতে যাচ্ছিলেন। তবে আপনি ফিরলেন আমাদের দুজনের আর ফেরা হল না।”
নকুড়বাবু মনে পড়ে গেল, একজন বাচ্চার নিখোঁজ হবার কথা তিনি কাগজে পড়েছেন। নকুড়বাবু বললেন, “কেন, ফেরা হবে না কেন?
লোকটা প্রশ্নর জবাব দিল না। একটা বিসন্ন হাসি । সে , হেসে বলল ‘আপনি যে বাক্সটা পেয়েছেন তার মধ্যে আমার পাণ্ডুলিপিটা আছে। দেখবেন ওটা ছাপানো যায় কিনা। তবে শেষ অনুচ্ছেদটা অসম্পূর্ণ আছে। ওটায় আমি লাল অর্কিডের ব্যাপারে লিখব ভেবেছিলাম, ঐ অংশটা নয় আপনি লিখে দেবেন।”
নকুড়বাবু অবাক হয়ে গেলেন তার কথা শুনে। লোকটা এরপর বলল, “ঐ দেখুন শুকতারা উঠেছে। আলো ফুটবে। শিলং পাহাড় থেকে আজই নেমে যাবেন। ও পিছু ধাওয়া করতে পারে। কুড়ি বছরে একবার ও যুবক হবার সুযোগ পায়। আপনি ভালো থাকবেন।”
কথা শেষ করল স্পেনসর। আর তারপর সেই ছেলেটার হাত ধরে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনের প্রথম সূর্য কিরণ দেখা দিল খাসি পাহাড়ের মাথায়।
ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে বসে সহযাত্রীদের সঙ্গে গল্প করছিলেন নকুড়বাবু। গৌহাটি স্টেশন থেকে কলকাতাগামী রাতের ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে করছে। খাসি পাহাড় থেকে শিলং হয়ে বেলাবেলি গৌহাটি নেমেছেন তিনি। ভয়টা তাঁর এখন অনেকটা কেটে গেছে। তাঁর মনে হচ্ছিল মসমাই কেভের ঘটনাগুলো যেন নিছক একটা দুঃস্বপ্নই ছিল। তিনি বেশ গল্প করছিলেন। বাইরে ট্রেন ছাড়ার আগে শেষ মুহুর্তে লোকজনের হাঁকডাক ব্যস্ততা। নকুড়বাবুর মুখোমুখি জানলার পাশে বসে থাকা এক যাত্রী বাইরের দিকে তাকিয়ে নকুড়বাবুর উদ্দেশে হঠাৎ বলে উঠল, “আরে দেখুন দেখুন, কি সুন্দর ক্যাকটাস!
নকুড়বাবু জানলার বাইরে তাকালেন। কয়েক হাত তফাতে ভিড়ের মাঝে লালকালো খাসি শাল গায়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। হাতে ধরা বাক্সে রাখা লাল বলের মতো দুটো মসমাই অর্কিড। মুহুর্তের মধ্যে নকুড়বাবু চিনতে পারলেন তাকে—মত্ত-কাবা!! যদিও তার বয়স এখন আরও কমে গেছে, প্রায় যুবকই বলা যায় তাকে। রাতের প্লাটফর্মে শিকার ধরতে এসেছে সে!
তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই নকুড়বাবু ঝুপ করে জানলার লোহার ঝাপটা নামিয়ে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনও দুলে উঠে চলতে শুরু করল। বিস্মিত সহযাত্রী প্রশ্ন করল, “কি হল মশাই?”
নকুড়বাবু জবাব দিলেন, “আমার আবার ঠান্ডা লাগার ধাত আছে, তাই জানলা বন্ধ করে দিলাম।”
(সমাপ্ত)