পৃথিবীর যেখানে যা কিছু সমস্যা, দুঃখ, কষ্ট ঝঞ্ঝাট থাক, তারা ঝেরে তার ছিটেফোটাও নেই।
জায়গাটা ছবির মতন সুন্দর, শান্ত আর আনন্দে ভরা। পুজোর আগে বেড়াতে এসে কুটুসদের তাই মনে হল। কুটুসদের বলছি কারণ, বয়সে সবচেয়ে ছোট হলেও দলের নেতা হচ্ছে সে-ই। বাকিদের ভুলিয়ে ভালিয়ে, রাজি করিয়ে এখানে আনার মূলে হচ্ছে কুটুস-ই। মিষ্টিদিদির অক্টোবরের শেষে পরীক্ষা–তাকে কলেজ থেকে একমাস পড়ার জন্য ছুটি দিয়েছে কিন্তু কলকাতার বাইরে গিয়ে পরীক্ষার পড়া করা নাকি অসম্ভব।
বড়দির ছোট বাচ্ছা ওদেরই বাড়িতে আছে তাকে নিয়েও যাওয়া সম্ভব নয়, রেখেও যাওয়া যাবে না। কাজেই মা-বাবাও কোথাও নড়বেন না। এদিকে আমেরিকা থেকে বেড়াতে এসেছে কুটুসের ফেসবুকের কমন’ বন্ধু ডেভিড পার্কার—সে একটা কোনও ‘ইন্টারেস্টিং’ জায়গায় যেতে চায়, যেটা মামুলি টুরিস্ট স্পট নয়। কুট্টস, যার ভালো নাম পারিজাত, বাড়িতে আর সবাই তাকে ডাকে “রাঙা’ বলে। কেবল মা ডাকেন ‘কুট্টস’ ছোটবেলায় মার পায়ে নতুন ওঠা দাঁতে কামড়ে দিয়েছিল বলে। সে যদিও উডবার্ন হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে, ডেভিড ওর চেয়ে বড়। গ্রাজুয়েশনের শেষ বছরে আছে।
সবচেয়ে মুস্কিল হল কুটুস ওরফে রাঙা যে ডেভিডকে সঙ্গে নিয়ে। ‘একা’ কোথাও বেরিয়ে পড়বে তারও উপায় নেই। বাবা-মা-ছোটকাকা নতুন পিসেমশাই সবাই হাঁ হাঁ করে ছুটে আসবেন। চারদিক নাকি বিপদ-ট্রেনে যে কেউ বিষ মেশানো চা কিংবা সরবৎ খাইয়ে দিতি পারে, মাওবাদী অঞ্চল দিয়ে যাবার সময় গাড়ি ডিরেইলড় হতে পারে, এছাড়া আছে গুণ্ডাচোর, ছাচড়, জঙ্গলে সাপ, হাতি, বুনো বেড়াল, বাঘ-—না বাঘ এখন সংখ্যায় গুটিকতক
—“আর ভূত, ভূতের নাম করলে না তো কেউ ?” চটে উঠে কুটুস তাতে ঠাকুমা বললেন, ‘আহা ভূত তো । আর বিপদের মধ্যে পড়ে না! ভূতেরা হচ্ছে অদৃশ্য মানুষ !”
শুনে সবার হো-হো করে কি হাসি!
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত “তাহলে আমি একাই’ বেরিয়ে পড়ছি”
টুসির এই হুমকিতেই কাজ হল। কারণ, সত্যিই তো, ডেভিড ছেলেটা বিদেশ থেকে এসেছে, পথে বেরিয়ে কিরকম বিপদে পড়বে—এটাও তো চিন্তার ব্যাপার। কুটুস তুফান তুললেও, বাবা-মা-কাকাদের তো আর মাথা খারাপ হয়ে যায়নি! কাজেই, মা-বাবা বললেন, “ঠিক আছে খুদেকে নিয়ে আমরা কদিন ঘুরেই আসি। জলটল না হয় ফুটিয়ে খাওয়া যাবে।” বড়দি বলল, “তবে আমি আর কি দোষ করলাম? জামাইবাবু গেছেন অফিসের কাজে জার্মানি। আমি কি করে খুদেকে ছেড়ে থাকব? আমি যাবই।”
মিষ্টিদিদিও, দেখা গেল একটা বড় ব্যাগে বইপত্র গোছাচ্ছে। এখানে নাকি এমনিতেই পড়া হচ্ছে না, মা-বাবা গেলে পড়ায় মন বসানো কঠিন হয়ে পড়বে। সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজটা দিলেন ঠাকুমা।
যাওয়ার দুদিন আগে বলেন, “বাড়িটা বানিয়েছিলেন তোদের দাদু। শেষ গেছিলাম তিরিশ বছর আগে। বড় ইচ্ছে করছে—একবার দেখেই আসি।”
ওদের বাড়িতেই থাকে রূপ সিং-বাজার দোকান, মাঝেমধ্যে রান্না টুকটাক গাড়ি চালানো! এই সব করেও তার সময় কাটে না। প্রাইভেটে পড়ে হায়ার সেকেন্ডারি দেবে প্ল্যান করছে। হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় যেতে পারেনি বলে রূপ সিং-এর মনটা খারাপ ছিল, “তাহলে আমিও একটু পুণ্য করে আসি,” বলে সে জিনিস গোছাতে লাগল।
—‘তারাঝের গ্রামে আবার তীর্থ করতে চললে নাকি?
—‘জী হাঁ, ঠাকুমা বলসেন, ওখানে বহত পুরানা শিউজী কা টেম্পল আছেন —”
–‘ওহো, সে তো সব গ্রামেই আছে। উই হোক, তুমি চল না। বেশ মজা হবে। ডেভিড তোমার হাতের ডিমের ঝোল আর লাউ-এর ডাল খুব পছন্দ করে ফেলেছে—
এইভাবেই সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ন’জনের একটা বড় দল তারাঝের চলল—ঠাকুমা, বাবা, মা, বড়দি, খুদে, মিষ্টিদিদি, কুটুস, ডেভিড আর রূপ সিং।
দিনের ট্রেন। সকাল সাড়ে সাতটায় হাওড়া থেকে ছাড়ে, তারপর বাংলাবিহারের বর্ডার পেরিয়ে ওড়িশার মধ্যে দিয়ে মস্ত মস্ত নদী পেরিয়ে খড়িয়ার বলে একটা জায়গায় পোঁছয় সন্ধে পার করে। ওখান থেকে ঘণ্টাদুয়েকের গাড়ির রাস্তা তারাঝের। পাহাড়ের নাম তারাঝের, গ্রামের নামও তাই। উল্কাপাতকে অনেকে তারাখসা বলে। কে জানে, তারা-খসা দেখে কেউ পাহাড়ের নাম তারাঝের রেখেছিল কিনা। কোন কালের কত পুরোনো মানুষ সব নদী-পাহাড়-গাছ পাথরের নাম রেখে গেছে, সেইসব নাম আবার তাদের বংশধরেদের মুখে মুখে ফিরেছে; সবার মুখস্থই হয়ে গেছে একসময়। অজানা অচেনা পৃথিবীর সঙ্গে এই ভাবেই ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে মানুষ-—প্রকৃতির নানা রূপ, চিহ্নকে নিজের দেওয়া নামে ডেকে।
—“আচ্ছা এমন একটা জায়গায় দাদুন কেন বাড়ি বানিয়েছিলেন?”
সকালে পিছনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাই চাপতে চাপতে বলল কুটুস। কী সুন্দর যে সকালটা। আশ্বিন মাস সবে পড়েছে। বর্যাটর্ষা সব শেষ। ঝকঝকে নীল আকাশ, এই সকাল আটটাতেই সোনালী রোদূরে টইটুম্বুর। বাড়ির পিছনে মস্ত মাঠে কোথাও ধান ক্ষেত, কোথাও ন্যাড়া পাথর জেগে আছে। দূরে নীল আঁকাবাঁকা চলন নিয়ে গভীর ছায়ার মতন পাহাড়। পাহাড়ের নীচে শুয়ে আছে উদন্তী নামের এক নদী। এরই মধ্যে
ঠাকুমা স্নান সেরে পিঠে ভিজে কাচাপাকা চুল মেলে বেরিয়ে এসেছে, হাতে একখানা কাঠের চিরুনি!
—“ওটা কি দেখি!” উল্টেপাল্টে দেখল কুটুস। প্লাস্টিকের চিরুনি দেখেছে ও, পুরীতে গিয়ে মোষের শিঙের চিরুনি! কিন্তু কাঠের? ‘এখানকার হাটে বিক্রি হয় গ্রামের মানুর পছন্দ, কাঠও তো অঢেল ছিল একসময়! শোবার ঘরের দেয়াল আলমারিতে ছিল, অনেকদিন ব্যবহার হয়নি। তুই কি জিজ্ঞেস করলি, রাঙা, বাড়িটা এখানে কেন কিনলেন তোর দাদু ! সে এক মজার গল্প।” গল্পের গন্ধ পেয়ে বড়দি, মিষ্টিদি দুজনেই উকি মারল। সারারাত বিকট চেঁচিয়ে, প্রায় পুরোটা জেগে, খুদে এখন ঘুমোচ্ছে। অঘোর ঘুম। বেলা দশটা পর্যন্ত তাই জন্য বড়দির ডিউটি অফ!
ঠাকুম বললেন, “তোমাদের দাদু তো অফিসে কাজ করতেন—কিন্তু ওঁর বন্ধু ছিলেন কার্তিক সেন, নানারকম ব্যবসা ছিল ওঁর—সেই ব্যবসার সূত্রে নানা জায়গায় ঘুরতেনও। তাতে-বোনা কাপড়ের জন্য সুতো রঙানোর ব্যবসা করেছিলেন, জঙ্গলের নিলাম করা কাঠ কেনা-বেচার, একবার সিমলিপাল গিয়ে তসরের গুটি দেখে তার ব্যবসা শুরু করলেন। কোনওটাই বেশিদিন টিকত না, কিন্তু ফাকতালে কার্তিক ঠাকুরপো-র দিব্যি ঘোরা হয়ে যেত।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এই অঞ্চলে ঘন জঙ্গল ছিল—সে। তোরা এখন কেউ ভাবতেই পারবি না। সেগুন, পিয়াল, শাল, হরিতকী, অর্জন এছাড়া কত যে ওষধি গুন্মলতা পাওয়া যেত। এখানকার সেগুন ছিল বিখ্যাত। জঙ্গলে বাঘ থাকত, ছোটখাট জন্তু জানোয়ার যেমন চিতা হরিণ, জঙ্গলী মোষ, হায়েনা এসব তো ছিলই। যে জমির উপর বাড়িটা দাঁড়িয়ে সেটাও ছিল জঙ্গলের ধার ঘেষা। একটুখানি ছোট মাটির বাড়ি ছিল, বাকি পুরোটাই ছিল বাগান, শাকসজি, ফুল আর গুম্মলতার। একজন মালির বাড়ি ছিল ওটা, মনের দুঃখে এই বাড়ি জমি সে বেচে দিয়ে কোথাও চলে যায়।”
—“কোথায় চলে গেল ঠাকুমা? কেন মনের দুঃখ ?”
—“মালির নাম ছিল পারাণ, তার ছোট একটি ছেলে ছিল, মা-মরা ছেলেকে মালি অনেক যত্নে মানুষ করছিল। ছেলেটাকে ডাকত জহ্ন বলে, এখানকার ভাষায় জহ্ন মানে চাদ। ছেলেটা আচমকা মারা চাপা পড়ে ।”
—“ওমা কেন?” বড়দি মিষ্টিদি সবাই আঁতকে উঠল ভয়ে।
-“আসলে, তারাঝের পাহাড়ে পাওয়া যেত নানারকম রত্নপাথর রঙবেরঙের। জহুরীদের কাছে আ-কাটা পাথর বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যেত। কিন্তু খনি থেকে পাথর তোলবার কোনও ভালো ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামের ছেলে বুড়ো গইিতি শাবল নিয়ে মুড়ি ধরে নিজেরাই যেত পাথর কাটতে—তারপর মাটি-পাথর বেচে রত্নপাথরের টুকরো তুলে ধুয়ে বিক্রি করত। আজও করে।”
‘বর্ষাকালে নতুন জল পড়ে নরম মাটি ফুলে কেঁপে উঠত, তারপর হঠাৎ করে ধ্বস নামত। সুড়ঙ্গ কেটে যারা চুকেছিল, তারা কেউ কেউ চাপা পড়ে যায়। জহ্ন ছিল ছোট ছেলে, সে বেরিয়ে আসতে পারেনি।”
“কার্তিক আসলে তারাঝের এসেছিলেন রত্নপাথরের খনির ইজারা নিতে। তখন ঘন বর্ষা। চারদিকে সবুজ নীল পাহাড়ের মালাকচি ধানের ক্ষেত, মালির হাতে সাজানো সুন্দর বাগান, সব দেখে তারাঝের ওঁর খুব ভালো লেগে যায়। কিন্তু ঐ মরশুমেই পাহাড় চাপা পড়ে গ্রামের কজন। মারা যায়, তার মধ্যে ছিল জহ্ন । মালির কান্নাকাটি কার্তিক সেনের খুব মনে লেগেছিল—তাই উনি খনির ইজারা নেওয়ার প্ল্যান বাতিল করলেন।
আবার কিন্তু ওঁকে আসতে হল পারাণ মালির পাঠানো খবর পেয়ে—সে বাড়ি, বাগান সব বেচে চলে যেতে চায়। এই বাগান আর ছোট্ট বাড়ি কিনে মালিকে টাকা পয়সা দেন কার্তিক সেন” আর তারপর বাড়িটা উপহার দেন তোমার দাদুকে। আমরা মাঝে মধ্যে এখানে এসে থেকেছি-তোমাদের বাবা তখন ছোট।”
কুটুস পনিটেল দুলিয়ে বলল-–“দুরছাই, দুঃখ দুঃখ ব্যাপার, ভাল্লাগে না। কোথায় এলাম ছুটি কাটাতে, তা না—”
ঠাকুমা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,-“‘এখন আর দুঃখ নেই রে রাঙা, দ্যাখ না চারদিকে কেমন সবুজ, পাহাড়ের ছায়া, ঝকঝকে রোদ, পাতা খসে খসে পড়ছে, ফড়িং উড়ছে, প্রজাপতি—সব দুঃখ শুষে নিয়ে প্রকৃতি কেবল আনন্দ রেখে দেয় মানুষের জন্য।”
বাবা গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঢুকলেন । ঠাকুমার শেষ কথাগুলো শুনে বললেন—“দুঃখের কারণ অবশ্য থাকবে যদি এখনও ওই ভাবে রত্নপাথর খুঁজতে গিয়ে মানুষ মারা যায়। দেখতে হবে, যে, —”
বাবার কথার মধ্যেই বাইরের জমি দিয়ে পিছনের বারান্দায় উঠে এল ডেভিড। হাঁফাচ্ছে। সোনালি চুল ঘামে লেস্টে কপালে লেগে আছে। খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ওকে।
বলল, “বাগানে তাজা পায়ের ছাপ । ছোট ছেলের!”
—“এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে, বাগানে কেউ ঢুকতেই তো পারে!” কুটুস বলল।
–“কি করে আসবে—সামনের গেট বন্ধ যে!”
—“আরে, গ্রামেগঞ্জে কি মানুষ গেট খুলে আসে! পাঁচিল টপকে এসেছে নিশয়ই,
—‘সাড়ে তিন-ফুট উচু পাচিল টপকে?”
—‘ভাঙা-টাঙা ছিল নিশ্চয়ই কোথাও!” কুটুস হাসতে হাসতেই বলল অবশ্য কিন্তু ওর গলা একটু কেপে গেল!
মা বললেন, “শোন, একটা ছোট মেয়ে এসেছে, বলছে, বাড়ি বাগান নাকি ও-ই দেখাশুনো করে। নাম বলল—মোতি!”
ঠাকুমা বলে উঠলেন, “ওহো, এরাই তো পাশের জমিটা চাষ করত। তোমার দাদুন বোধহয় এর বাবাকেই বলেছিলেন—ঘরদোর পরিস্কার রাখতে, বাগানের দেখাশুনো করতে! সে তখন কচি ছেলে!”
বোঝা গেল তাহলে—মোতিরই পায়ের ছাপ দেখেছে ডেভিড। “চল, চল, বাগান দেখি গে: —” বলে ওরা সবাই বাড়ির দক্ষিণে বাগানটা দেখতে গেল।
বাগানটা আগে অনেক বড় ছিল, কারণ পারাণ মালির কুঁড়েঘর খানা ছিল ছোট্ট। সেটাতে ভেঙে দাদুন যে বাড়ি বানিয়েছেন, তার তিনটে ঘর, দুদিকে দুই বারান্দা, মাঝখানে খাবার জায়গা। নতুন, মানে, দাদুনের বানানো বাড়িখানা বড়সড় বলে বাগানটা ছোট হয়ে একপাশে সরে গেছে।
তবু কী সুন্দর যে বাগানটা। কচি সবুজ রঙ্গনের চারার বর্ডার, কোণে কোণে রঙিন পাতাবাহার গাছ। ঠিক মাঝখানটায় জুই আর রজনীগন্ধার একটা চারকোণা কেয়ারি, তার বাইরে লাইন দিয়ে লাগানো হয়েছে। বাকি জায়গাটা নরম ঘাসে ঢাকা। মাঝে মাঝে উপচে উঠছে বোগেনভিলিয়া-কমলা, সাদা, বেগুনী।
“রোদ পেলে এরা ভালো বাড়ে।” ঠাকুমা বললেন। ফুলবাগানে ঢোকার মুখে একটা বাঁশের কঞ্চির তোরণ। তার ওপর মাধবীলতার ফুলে ফুলে ছাওয়া সবুজ পাতা। সেখানে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে, হাতে কিছু বই খাতা। গাছের চারা
—‘তুমিই মোতি ? বাগান দেখাশুনো কর তুমি?”
মোতি দেখা গেল খুবই ভীতু, বলল, “করতাম.. মানে ছুটি ছাটায় এখন আবার কলেজ খুলে গেছে, ফাস্ট ইয়ারে পড়ি ।”
ডেভিড কুটুসের কানে কানে বলল—“এ তো বড় মেয়ে, কক্ষনো এর পায়ের ছাপ নয়। ”
বাবা, মা, মিষ্টিদি, বড়দি বাগান দেখতে লাগল ঘুরে ঘুরে। কুট্টস ডেভিডের সঙ্গে চলে গেল রঙ্গনের বেড়া পেরিয়ে বাগানের পাশে ফাকা জমিটাতে। ওখান পায়ের ছাপগুলা ছিল।
—“এইগুলোর কথা বলছিলে কি?” কুটুস আঙুল দিয়ে দেখাল। ডেভিডের কপালের ঘাম শুকিয়ে গেছে, তবে মুখ খানা থমথমে। ও জোরে মাথা নেড়ে বলল, “উহু, কিছুতেই এগুলো নয়। তাছাড়া খালি পায়ের ছাপ ছিল এখানে, এখন দেখছি জুতোর।”
সত্যিই তাই। কুট্টসও দেখল, বড় অথচ খুব বড় নয়, এখন কেউ জুতো শুদ্ধ খালি পায়ের ছাপগুলো মাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ফলে তলার গুলো ঢাকা পড়ে গেছে।
—“মোতিই করে থাকবে। ওর পায়ের ক্যানভাস জুতোর সঙ্গে ছাপটা মিলছে।”
“কিন্তু কেন?” ডেভিড বলল।
—“হয়তো ওর চেনা কেউ ঢুকেছিল—ছোট ভাইটাই হবে। মোতি আড়াল করতে চাইছে বাচ্চাটাকে।”
—“আমরা সবাই এক একটি শার্লক হোমস হয়ে যাচ্ছি কি?”
ডেভিড হাসতে হাসতে বলল। তবে আমাকে ঠকানো যাবে না।আর্মি ওই ছোট পায়ের ছাপ তুলে নিয়েছি ক্যামেরায়।”
ডেভিডের কোমরে বেল্টের সঙ্গে বাঁধা ডিজিট্যাল ক্যামেরা। আসার পথে ট্রেনেও ও ছবি তুলতে তুলতে এসেছে।
রূপ সিং-এর বানানো গরম গরম ফোলা নরম আটার লুচি আর ধনেপাতা টমেটো দেওয়া আলুর তরকারি খেতে খেতে সকালের মন খারাপ করানো ব্যাপারগুলো ভুলে যাচ্ছিল ওরা। পায়ের ছাপ নিয়ে জমে ওঠা রহস্যটাও । তারপর বড় টী-পটে ঘন দুধ দেওয়া গরম চা এসে পড়ায়
কাপের ঠোকাঠুকি, প্লেটের ঠনঠন, কাড়াকাড়ি শুরু হল একটু আধটু। ডেভিড হঠাৎ উঠে চট করে সামনের বারান্দায় চলে গেল ফটো নিতে একটা নীল হলুদ অচেনা পাখি এসে রেলিঙে বসেছে নাকি। আঙুল চাটতে চাটতে ফিরল ডেভিড ফটো তোলা সেরে, কিন্তু বসতে গিয়েও খেতে বসল না আর। ওয়াশ বেসিনে সোজা হাত ধুতে চলে গেল । বড়দি বলল, ‘মোতি ছোট না হোক, খুব বড়ও তো নয়! কলেজে ঢুকেছে সবে—কিন্তু ওর কাজ দেখেছ? একটা কুটো পাতা পড়ে নেই । বাগানে, শুকনো ঝরা কিছু লেগে নেই গাছে। ঝকমকে পরিষ্কার সব। বাগান তো নয়, যেন নিকোনো উঠোন। ”
—“ফুলের কেয়ারি নাকি আবার মরশুমের সঙ্গে বদলে যায়। শীতে গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা..”
—“’ওদের অবস্থাও কিন্তু ভালো নয়।” বাবা বললেন, “ওর বাবা গেছে পাশের জেলায় জন খাটতে, সেখান থেকে অন্য কোথাও..ছমাস হল ফেরেনি। তাই বলছিল।”
“চারদিকেই কিন্তু দুঃখকষ্ট ছড়ানো, বুঝলে ঠাকুমা”—কুটুস বলল। ঠিক যেন ওর সঙ্গে রঙ্গ করছে এমনভাবে জোরে খিলখিলিয়ে উঠল খুদে।
শোবার ঘরের বিছানায় দুদিকে পাশ বালিশ, ওন্টানো ছাতার মতো মশারি দিয়ে ওকে শুইয়ে এসেছিল বড়দি। আট মাসের বাচ্ছা মশারি উল্টে ফেলেছে পায়ের ধাক্কায়, খুব জোরে জোরে হাসছে, হাত পা ছুরছে—যেন খেলছে, খুবই মজা পেয়েছে খেলায়। বড়দি তাড়াতাড়ি খুদেকে কোলে তুলে নিল, অমনি হাসি টাসি থেমে শান্ত হয় গেল ছেলে। খুব ছোট বেলায় ঘুমের মধ্যে আপনমনে হাসত খুদে। মা বলল, “ও বড় হচ্ছে, এখন কাছে রাখতে হবে কাউকে। খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারত তো! ”
পরের দিন প্রায় তেমন ই কিছু ঘটল। খুদের অবশ্য চোটও লাগেনি, পড়েও যায়নি—তবে বড়দি, মা দুজনেই ভয় পেয়ে অস্থির। হামাগুড়ি দিতে শিখেছে খুদে, দিন পনেরো হল—তবে সে কেবল সিমেন্টের মেঝেতেই, তা-ও কেউ কোল থেকে আলতো করে নামিয়ে দিলে। সকালবেলা হামা দিয়ে বারান্দার সিড়ি পেরিয়ে বাগানে চলে গেছিল ছেলে—তারপর ঘাসের ওপর বসে বসে হাসছে দুটো ছোট্ট তলার দাঁত বার করে। হাঁটুতে, হাতে মাটি লেগে। গরমজলে তোয়ালে ভিজিয়ে খুদের হাত পায়ের মাটি মোছা তো হল। দিদি বেশ ঘাবড়ে গেছে। জঙ্গুলে জায়গায় এসে ছেলেটা বেশ বন্য হয়ে গেছে। কি করি এখন?
কুটুস ডেভিডকে আড়ালে ডেকে বলল—‘বারান্দার তিনটে উঁচু সিড়ি খুদে পেরোল কি করে? ঠোটে দাঁতে চোট পায়নি কিন্তু ?”
ডেভিড হাসল, “দেয়ারস সামথিং স্ট্রেঞ্জ অ্যাবাউট দিস প্লেস। সেদিন ফটো তুলে টেবিলে ফিরে দেখি আমার প্লেট নেই। কি হয়েছিল বলো তো?
—‘রূপ ভাইয়া কি..”
—“না রূপ সিং তোলেনি। প্লেটটা পড়ে ছিল দু টুকরো হয়ে, পিছনের বারান্দায়। কিন্তু আমরা যে পটেটো দিয়ে প্যানকেক খাচ্ছিলাম, সেগুলো ছিল না।”
এরই মধ্যে বেশ কয়েকটা দিন কেটেছে।
রূপ সিং গিয়ে পুরোনো শিবমন্দিরে পুজো দিয়ে এসেছে। বাগানেই নাকি আকন্দ ফুল ছিল—মোতি তুলে দিয়েছিল। হেঁটে হেটে তারাঝের পাহাড়ে ট্রেকিং করে এসেছে মিষ্টিদি, ডেভিড আর কুট্টস। যেখানে পাহাড়ের পায়ের কাছে সুড়ঙ্গ কেটে মানুষ ঢোকে, দড়ি আর ইস্পাতের খুটি দিয়ে সেই পথগুলো বন্ধ করা আছে বর্ষার অনেক আগে থেকেই। বোর্ডে লেখা আছে-সুড়ঙ্গ কাটা বিপজ্জনক।
নানা অ্যাঙ্গল থেকে পাহাড় আর ওই জায়গাটার ছবি তুলল
ডেভিড। মিষ্টিদি আর কুটুসের ছবিও। বাড়ি ফিরে জিদখে মোতি
জড়োসড়ো হয়ে বাগানের মুখে দাঁড়িয়ে। হাতে একটড খুরপি।
মা রাগ রাগ মুখে বলছেন, “বলেছি না পরীক্ষা সামনে। এখন কদিন এসো না! সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিকেলে বাড়ি বসে পড়তে তো পারো, বড়দি বলল, “আচ্ছা ও সত্যিই কিছু পারে নাকি?
কোনও গাছই তো চেনে না, আগাছা নিড়োতে জানে না—কদিন ধরেই দেখছি, বিকেলবেলা আনাড়ির মত খুরপি ধরে বসে থাকছে— বাবা বললেন, “‘ওহ্, আর কাজগুলো করছে কে, ভূতে নাকি? ”
মোতি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমি এখন যাই মা? কাল আসবো।” বলেই পালিয়ে গেল।
ঠাকুমা আস্তে করে বাবাকে বললেন,-“ফেরার টিকিটটা এবার কেটেই ফ্যাল খোকন। কলকাতাতেও তো একটা সংসার ফেলে এসেছি- গিয়ে আবার সব গোছাতে হবে।”
তারাঝের থেকে চলে আসার আগের দিন ছোটখাট কয়েকটা ঘটনা ঘটল। মোতির বাবা ভিন রাজ্যে গেছিলেন, সেখান থেকে ফিরে এসে বাবা মা ঠাকুমকে নমস্কার করতে এলেন।
—“এখন থেকে দেখাশুনো আমিই করব বাবুমশাই, বাড়ি আর বাগান দুটোরই, মেয়েটা ছোট, কিছু তেমন পারে না-
বাবা বললেন, “কেন দিব্যি তো দেখাশুনো করেছে—বাগানে কুটোটি নেই, নতুন রজনীগন্ধা এনে লাগিয়েছে, গোলাপের কলম পুতেছে—
মোতির বাবা জিভ কেটে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন—“ওরে বাবা, সে কি আর ওই মেয়ের কাজ?”
তখন অবশ্য কুটুস, ডেভিড, মিষ্টিদি সবাই জিনিস প্যাকিং-এ ব্যস্ত। কাঠের চিরুনিটা ঠাকুমের কাছ থেকে চাইতে গেল কুটুস। ঠাকুমা আবার ওটা আগেই হারিয়ে বসে আছেন।
মোতিকে মা একটা সালোয়ার কামিজ কিনে দিলেন —সেটা ও কিছুতেই নিল না। আমারে আর লজ্জা দিবেন না’ বলে কেঁদে চলে গেল। মোতির বাবাকেই দেওয়া হল সেটা। বাড়ি ফিরে মোতিকে দেবেন। খড়িয়ারে গিয়ে ট্রেন ধরবে বলে একটা বড় ট্রেন্ডরোভার গাড়ি বলা হয়েছিল। তাতে বাক্স বিছানা তুলতে গিয়ে কুমড়োর মত গড়িয়ে গেল রূপ সিং—যখন উঠল কপালটা আলু হয়ে ফুলে গেছে। গাড়িতে বসার একটু আগে থেকেই কাঁদছিল খুদে, গাড়ি ছাড়তেই ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল—মার কোলে বসেই—ঠিক যেন বড় মানুষের কান্না।
বড়দিরও চোখে জল এল তাই দেখে। পিছনে পড়ে রইল, নতুন মরশুমি ফুলে সাজানো ঝকঝকে রঙিন একটা বাগান, হলুদ লাল রঙে রাঙানো দাদুনের সাধের বাড়ি–সত্যিই বড় মায়া পড়ে গেছিল–খুদেরই যদি কান্না পায়, তবে তো.. কুটুসের গলার কাছে শক্ত একটা কষ্টের ডেলা পাকিয়ে আছে। ডেভিড অবশ্য কিছুই দেখচ্ছে না—পটাপট ফটো তুলে যাচ্ছে। তারাঝের-এ আসার পর ফটো তোলাটা যেন নেশা হয়ে গেছে ওর টুরিস্ট স্পট নয় এমন অজানা গ্রাম দেখেই হয়তো।
ডেভিড আমেরিকা পোঁছনোর দিন পনেরো পর নিজের ইমেল খুলে ওর পাঠানো ছবিগুলো পেল কুট্টস। বাবা মা দিদিদের, রূপ সিংকে ভালোবাসা জানিয়েছে ডেভিড; ঠাকুমাকে একেবারে প্রণাম’ ইংরেজি অক্ষরে! কুটুসকে লিখেছে—ছবিগুলো দেখো, রাঙা । এই সিক্রেটটা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ হয়তো বুঝতে পারবে না।
ছবি দেখতে কুটুসের হাসি হাসি মুখটা ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছিল, এতো গাদা ছবি তুলেছে ডেভিড, ট্রেনের রাস্তামাঠ, ঘাট, জঙ্গল, এই তো দাদুনের বাড়ি—কিন্তু একি! একা ঘরে বসে ভয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগল কুটুস। কাদের ছবি এসব?
বাগানে মোতি বসে কাজ করছে, ওর পাশে হাতকাটা ফতুয়া, মোটা সাদা গোঁফ, সাদা কোকড়া চুল, ও কে? মোতি দাঁড়িয়ে- ওর পিছনে লুকিয়ে হাসছে খাটো ধুতি পরা ন্যাড়ামত একটা বারো তেরো বছরের ছেলে। এই তো, মোতি খুরপি হাতে, পাশে কলমের গোলাপ লাগাচ্ছে। ফতুয়া পরা সেই লোক—এই কি পারাণ মালি? ওই ছেলেটা কি চাদ, বা জহ্ন ? পিছনের বারান্দায় প্লেটে করে লুচি খাচ্ছে জহ্ন। ধাক্কা দিচ্ছে রূপ সিংকে হাসতে হাসতে। এই তো খুদে, হামা দিয়ে যাচ্ছে, আগে আগে নাচতে নাচতে ছোটো ছেলেটা—যার নাম ছিল চাঁদ ! তুর্যকির পাহাড়ের সামনে মিষ্টিদি আর কুটুসের পাশে এত লোকজন। -কারা এরা-বুড়ো মেয়েমানুষ, ছেলে, আর জহ্ন এখানেও যে! ল্যাভেন্ডারাভার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে জহ্ন, হাত বাড়িয়ে খুদেকে ধরতে যাচ্ছে, খুদের কান্না কান্না মুখ। সবশেষে গাড়ি থেকে তোলা তারাঝের এর বাড়ি—পারাণমালি মলিন মুখে দাঁড়িয়ে, ওর পাশে জহ্ন, আরও পিছন লাল হলুদ বাড়িটা আহারে! সত্যিই যেন কত আপন মানুষদের ছেড়ে আসতে হল কুটুসদের !
–ওরা, তারাঝেরের অদৃশ্য মানুষরা আবার একা হয়ে গেল। শরীর না থাকলে কি হবে—মন তো ওদের ছিলই, ভালোবাসা টান মায়া সবই! কটা দিন কত আনন্দ করে কাটিয়েছিল ওরা—দাদুনের বাড়ির লোকেদের পেয়ে। পারাণমালী, জহ্ন আর অন্য অদৃশ্য মানুষদের ছবিগুলো এক এক করে ডিলিট করে দিল কুটুস। ডেভিড আর ওর সিক্রেট’ সবার অজানাই থেকে থাক—চিরকালের মতন।
কম্প্যটারটা বন্ধ করতে গিয়ে একটা অদ্ভুত কথা মনে হল কুটুসের। খুদেও কিন্তু দেখেছে জহ্নকে, খেলেছে ওর সঙ্গে, আসার সময় মন খারাপ করেছে। খুবই ছোট্ট বলে ওর মনের চোখ দুটো কি ক্যামেরারই মতন—দৃশ্য অদৃশ্য সব তুলে আনতে পারে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মনটাই হারিয়ে যায় হয়তো! বাবা মা দিদিরা হয়তো ঠিক বুঝতে পারবে না, ঠাকুমাকে একদিন বলতে হবে কুটুস ঠিক করে ফেলল।
(সমাপ্ত)