হ্যাপি ভিলা

হ্যাপি ভিলা

শিয়ালদার ফার্নিচারের দোকানের মালিক যেমন যেমন পথ নির্দেশ দিয়েছিল, ঠিক সেইমতোই পিকনিক গার্ডেন স্টপেজে বাস থেকে নামলাম। রাস্তা পার হয়ে সোজাসুজি একটি কাচা রাস্তা এঁকে বেঁকে একটি ছোট পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে গিয়ে পড়েছে। হাড়সর্বস্ব লোকের মতো দাঁত বের করা সিড়ি-সর্বম্ব পুকুর। বাসক আর আকন্দ শিরীষের হালকা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হলুদ রঙের বাড়িটা এবার চোখে পড়ল। খেয়াল করিনি এতক্ষণ। ওটাই মিঃ ডি কুনহার হ্যাপি ভিলা। কিন্তু দেখেশুনে বড়ই আনহ্যাপি মনে হচ্ছে।

ভেতর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই হয়তো বারান্দায় একটি লোক এসে দাঁড়াল। সিড়িতে নেমে দূর থেকে সে বলল, ‘হু ইজ দেয়ার? কাম অ্যালং দিস সাইড!’ তাই তো! ডান দিকেই একটা সরু রাস্তা রয়েছে। জঙ্গলের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। এগিয়ে গেলাম সোজা একেবারে বারান্দায় সিড়ি পর্যন্ত।

‘আপনিই কি মিঃ ডি কুনহা! আমি সবিনয়ে জিগ্যেস করি।
ইয়েস, মাই বয়। কী চাই তোমার? কী দরকার?’
‘নমস্কার। আমি অনেক দূর থেকে আসছি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। এই কথা বলে আমি সিড়ির ধাপ পেরিয়ে নিঃশব্দে তার পেছন পেছন ভেতরে গেলাম। মিঃ কুনহার বয়স ঠিক বলা যাবে না। পঞ্চাশ থেকে যাট হবে। ছিপছিপে গড়ন। খুবই লম্বা।

ছফুটের বেশি হবে। জাতে পর্তুগীজ। মাথায় ইউল বারনারের মতো টাক। লম্বাটে মুখ । সুন্দর নাক চোখ। খুব ফর্সা। অত্যন্ত আনমনা। বিমর্ষ। ময়লা ট্রাউজার। গায়ে গেঞ্জি। বলল, ‘দয়া করে ভেতরে আসুন। অনেকদিন বাদে আমার বাড়িতে মানুষের পা পড়ল। আফটার মেনি মেনি ডেজ। প্লিজ কাম ইন ।

সন্ধে হয়ে এসেছে। চারদিক নিস্তব্ধ। মিঃ কুনহার মস্ত ঘরটি প্রায় শূন্য। আসবাব বলতে একটি মাত্র ছোট চৌকি, এক কোণে। মনে হল বাড়িতে অন্য কোনও প্রাণী নেই। চামচিকে আরশোলা আছে বহু। চৌকিতে আমরা মুখোমুখি বসলাম। মিঃ কুনহা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বড় নির্ভর অথচ করুণ চোখ। আমার গা ছমছম করে উঠল। ‘বলুন কী দরকার! হঠাই চেচিয়ে উঠল সে। আমি চমকে উঠলাম।

–থাক, হ্যাপি ভিলার মিঃ কুনহার কথা এখন থাক । আগের কথা আগে বলে নিই

আমার অনেক দিনের শখ ছিল একটি রিভলভিং চেয়ারের। পায়ে ঢাকা লাগানো, চেয়ারের নীচে বল বিয়ারিং লাগানো, ভেলভেট লেদার দিয়ে গদিমোড়া। যেদিকে যেমন ইচ্ছে শরীর ছড়িয়ে বসব। বড় আরাম। কিন্তু তেমনি দাম। দর করেছিলাম একবার। সাড়ে তিনশো থেকে চারশো টাকা। আমার এক মাসের মাইনে।

অফিসের কাছে এক পুরোনো ফার্নিচারের দোকানে মনের মতো একটি রিভলভিং চেয়ার দেখে দরাদরি করে মাত্র একশো টাকায় পেয়ে গেলাম। ভাবতেই পারিনি যে সত্যি সত্যি দোকানদার আমার বলা দামে চেয়ারটা দিয়ে দেবে! দেখলে কেউ বলবে না চেয়ারটা পুরোনো বা ব্যবহার করা। সেগুন কাঠের ওপর বানিশ করা জামফলের রং, চওড়া হাতল, নরম ভেলভেটে মোড়া গদি, মস্ত। আকারের রাজকীয় ঐ চেয়ারখানা। হাতছাড়া যাতে না হয় সেইজন্য প্রথম দিন আমার পকেটে যে কটি টাকা ছিল তাই আাডভান্স করে এলাম। পরের দিন মুটে এবং গাড়িভাড়া খরচ করে চেয়ারটি বাড়িতে আনলাম। নিজের পড়ার ঘরের লাগোয়া দক্ষিণের বারান্দায় সেদিন কার মতো রেখেছিলাম। সেই রাত্রে খুব জোৎস্না ছিল।

দরকারি কাজকর্ম সেরে, রাতের খাওয়া দাওয়া সারতে রোজকার মতো সেদিনও রাত প্রায় দশটা হল। অভ্যাস মতো সিগারেট নিয়ে বারান্দায় এলাম। বাইরের ঘরবাড়ি পথঘাট গাছগাছালি জ্যোৎস্নায় মাখামাখি, বারান্দায় গ্রিলের ফাক দিয়ে জ্যোৎস্নার এক ফালি, আলপনা ঠিক আমার রিভলভিং চেয়ারটার ওপর। বাইরের বাতাস বারান্দায় খেলছিল বটে, কিন্তু আমার মনে হল আমার ঐ অপরিসর বারান্দায় ক্ষণিকের জন্য বাতাসের মত্ত এক দাপাদাপি হয়ে গেল। এবং তারপরই শান্ত। বারান্দার পর ছফুট রাস্তা সংলগ্ন একটা মাঠ। ছেলের দল খেলতে খেলতে মাঠের ঘাস নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ধুলো মাটি সম্পন্ন সাদা মাঠটি জ্যোস্নায় মনে হচ্ছে একটি ধবধবে সাদা চাদর। এইসব মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে করতে আমি এক সময় চেয়ারে বসলাম। নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই সামনের মাঠে চোখ পড়েছিল। এবং আমি চমকে উঠেছিলাম। আমার সমস্ত শরীরে হঠাৎ কাটা দিয়ে উঠেছিল। ঠিক আমার বারান্দার সামনে এ ধবধবে সাদা মাঠে তার চেয়েও সাদা একটি কুকুর। একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। এত সাদা কুকুর আমি জীবনে দেখিনি। সাদা রং যে কী ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেদিনই বুঝলাম।

কুকুরটাকে কোনও অশুভ প্ৰতীক বলে আমার মনে হল। চেয়ার থেকে উঠে মুখে শব্দ করে হাত তুলে আমি কুকুরটাকে তাড়াবার চেষ্টা করলাম। পলকের মধ্যে ঐ জ্যোৎস্নায় সে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফিরে চেয়ারে বসতে যাব, যেন কার শরীরে ধাক্কা লাগল। কে? কে! কই কেউ না তো! ভয়ে ছিটকে চলে এলাম বারান্দার অন্য প্রান্তে। চেয়ারে বসতে গিয়ে কীসের সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগল! তবে কি মনের ভুল? কিন্তু সাদা কুকুরটা! সেটাও কি চোখের ভুল!

ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে দশটা। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে আছি। এই প্রথম নজরে পড়ল যে চেয়ারটার দুই হাতলে বেশ কতগুলো দাগ। সাদা সাদা, যেন আঁচড়ের দাগ। আগে তো দেখিনি! কিনে আনার সময়েও নজরে পড়েনি! ব্যবহার করা জিনিস। এরকম হতেই পারে।

কিন্তু একী! চেয়ারে বসার গদিটা গোল হয়ে আস্তে আস্তে বসে গেল কেন ? একজন বসলে, তার শরীরের ভারে যেমন হয়, ঠিক তেমনি। চেয়ারের হেলান দেবার পেছনের জায়গাটা নড়ে উঠল কেন? একজন বসলে তার শরীরের ভারে যেমন নড়ে ওঠে। অথচ কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না! আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে উঠল। তবে কি আমি একটা ভূতুড়ে চেয়ার কিনে এনেছি বাড়িতে! সেইজন্যই কি এত কম দামে দোকানদার আমায় দিয়ে দিল! এই চেয়ার আমি ফিরিয়ে দেব। অথবা বিক্রি করে দিতে হবে অন্যত্র। কিন্তু তার আগে শেষ দেখা দেখতে চাই।

আমি ধীরে ধীরে শূন্য চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলাম। এবং বসতে গিয়ে কার আচমকা ধাক্কায় আমি বারান্দায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম। একটা চাপা আর্তনাদ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি সেই সাদা কুকুরটি বারান্দায়, চেয়ারের পাশে, নীচে মাটিতে বসে আছে জ্যোস্নার ফালিতে। আর দাঁড়াতে পারিনি সেখানে। ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঠান্ডা জলে মুখ-চোখ ধুয়ে শুয়ে পড়ি। সারারাত ঘুম নেই। আজগুবি,

নাকি ভৌতিক ঐ চেয়ারের কথা আমি না পারলাম কাউকে বলতে, না পারলাম মন থেকে তাড়াতে!

দ্বিতীয় দিন, অফিসের কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম চেয়ারটা ঘরে নিয়ে আসব। ভরসা পেলাম না। তবে সাহস করে বসলাম চেয়ারে। সব স্বাভাবিক। খেতে যাবার আগে ঘরেই নিয়ে এলাম চেয়ারটা। খাটের পাশে, জানলার ধারে, টেবিলের কাছেই বসালাম।

খেয়ে এসে সিগারেট নিয়ে বারান্দায় কিছুক্ষণ পায়চারি করে ঘরে এলাম। আমার বুক ধুকধুক করতে লাগল। ঘরের আলো জ্বালিয়ে রাখলাম। রেডিও খুলে দশটার খবর শুনলাম। এরই মধ্যে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম চেয়ার নড়ে উঠল, বসার গদিতে চাপ পড়ে বসে গেল। আলো নিভিয়ে ওদিকে আর না তাকিয়ে বিছানায় উঠতে গিয়ে জানলার ওপারে চোখ গেল। সেই সাদা কুকুর। অসম্ভব স্থির তার দুই কালো চোখ। কোনোক্রমে হাত বাড়িয়ে জানলা বন্ধ করে দিয়ে চোখ চাপা দিয়ে। শুয়ে পড়ি। আমার শরীর কাপতে থাকে।

পরদিন অফিস থেকে বেরিয়ে অফিসের কাছে যে ফার্নিচারের দোকান থেকে চেয়ারটি কিনেছিলাম সেখানে হাজির হলাম।

পরশু যে চেয়ারটা কিনে নিয়ে গেলাম সেটা সেকেন্ড হ্যান্ড তো?’

নিশ্চয়ই। আমাদের তো পুরোনো আসবাবেরই কারবার। ‘আচ্ছা চেয়ারটা আপনারা যার কাছ থেকে কিনেছেন, তার ঠিকানা দিতে পারবেন?’ কেন বলুন তো? আমরা চেয়ারের মালিকের খোজ তো দিতে পারব না। আমরা শিয়ালদার একটা বড় দোকান থেকে অন্যান্য কিছু আসবাবের সঙ্গে এনেছিলাম।’

শিয়ালদার কোন দোকান?

স্টেশনের কাছে, পুব দিকে, “ফার্নিচারস্ সিন্ডিকেট”।

ঐখান থেকে সোজা চলে গেলাম শিয়ালদার সেই দোকানে। কোনও রকম ভূমিকা না করে মালিককে সরাসরি জিগ্যেস করি, দেড় মাস আগে ডালহৌসি স্কোয়ারের ‘ফার্নিচার ট্রেডিং-এ আপনারা কিছু পুরোনো আসবাব বিক্রি করেছেন?

আমার প্রশ্নে দোকানের মালিক কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে জিগ্যেস করে, কেন, কী ব্যাপার! আপনি কোথা থেকে আসছেন?

আমি মিথ্যে করেই বলি, ‘পুরোনো দিনের আসবাব বিষয়ে আমার উৎসাহ আছে, আমি ঐ বিষয়ের উপর গবেষণামূলক কিছু কাজ করি।

দোকানদার বলে, ‘তাই বলুন! হা, ডালহৌসি স্কোয়ারের ঐ দোকানে কিছু মাল গেছে, দুটো আলমারি, তিনটে চেয়ার। তার মধ্যে একটা রিভলভিং চেয়ার ছিল। ঐ চেয়ারের মালিকের খোঁজ-সন্ধান ওখান থেকে নিয়ে সেদিনই চলে এসেছিলাম হ্যাপি ভিলার মিঃ ডি কুনহার কাছে। মিঃ কুনহার সঙ্গে পরিচয় হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় হঠাই সে চেচিয়ে উঠেছিল ‘বলুন কী  দরকার’ বলে।

এই আকস্মিক চিৎকারে আমি চমকে উঠেও সরাসরি জিগ্যেস করেছিলাম, ‘আপনার সব আসবাব বিক্রি করে দিয়েছেন কেন?

মিঃ কুনহা ঠিক স্বাভাবিক মস্তিষ্কসম্পন্ন যে নয় সেটা বোঝাই গিয়েছিল তার কথাবার্তার ধরনধারণে, চলনে, গমনে ও চোখের দৃষ্টিতে। বড় উদাস কণ্ঠে বলল, ‘ওহ! লেট মি ফরগেট দ্যাট। আমি ওসব ভুলে যেতে চাই, আমাকে একা থাকতে দিন।

আমি বিনীতভাবে মিঃ কুনহাকে বলি, দেখুন, চার বছর আগে আপনার বাড়িতে যে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, সে-কথা আমি আপনার বাড়ি খুঁজে আসার পথে স্থানীয় লোক-মুখেই শুনেছি। আপনার অনুপস্থিতিতে একদিন রাত্রিবেলায় একদল ডাকাত আপনার বাড়িতে ঢুকে আপনার স্ত্রী এবং তার পোষা প্রিয় কুকুরকে হত্যা করে অনেক গয়না ও টাকাপয়সা নিয়ে যায়। আপনি খবর পেয়ে বাড়িতে যখন এলেন তখন সব শেষ। শুনেছি তারপর থেকে আপনি ঘুরে ঘুরে বেড়ান, এই বাড়িটা পরিত্যক্ত পড়ে থাকে। স্ত্রীর ঐ মৃত্যু আপনার কাছে দুৰ্বহ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আপনি বাড়ির সব ফার্নিচার বিক্রি করে দিলেন কেন ?

স্থির শান্ত ভাবে মিঃ কুনহা এমনভাবে আমার কথাগুলো শুনছিল যেন সে এই বস্তুময় জগতের মনুষ নয়। কয়েক মুহুর্ত আমার দিকে নিম্পলক তাকিয়ে থেকে মিঃ কুনহা বলল, ‘আমার স্ত্রী তার পছন্দ মতো আসবাব ও শৌখিন জিনিস কিনে নিজের মতো করে এই বাড়ি সাজিয়ে ছিল। কিন্তু ভোগ করতে সে কিছুই পারল না।

আমি জিগ্যেস করি, ‘ফার্নিচার বিক্রি করলেন কবে?’

মি; কুনহা বলল, ‘ওটাকে ঠিক বিক্রি বলা যায় না, আসলে এই বাড়ি, বাড়ির সব জিনিসপত্রের মধ্যে আমি হাপিয়ে উঠছিলাম। খবর দিয়েছিলাম একটা ফার্নিচারের দোকানে। নামমাত্র মূল্য দিয়ে এসে তারা সব তুলে নিয়ে গেল।’

‘একটা রিভলভিং চেয়ারও ছিল ?’

হা, হা। ভারী সুন্দর চেয়ার। বাড়িতে কাঠের মিস্ত্রি ডেকে আমার স্ত্রী নিজে তৈরি করিয়েছিল সেটা। কিন্তু আপনি চেয়ারটার কথা জিগ্যেস করছেন কেন বলুন তো?

‘বলছি। তার আগে বলুন তো, ঐ চেয়ারটার সঙ্গে কোনও ঘটনা জড়িয়ে আছে কিনা?

আছেই তো। আমার স্ত্রী রোজ রাতে শুতে যাবার আগে ঐ চেয়ারটায় বসে বাইবেল পড়ত। এরকম অবস্থাতেই একদিন বাড়িতে ডাকাত পড়ল। আমি বাড়িতে ছিলাম না তখন ডাকাতরা অতর্কিতে তাকে আক্রমণ করল। আমার স্ত্রী বাধা দিতে গিয়েছিল হয়তো। ডাকাতরা তার মুখ চেপে গলা টিপে হত্যা করে। ঐ চেয়ারে বসা অবস্থাতেই।

মিঃ কুনহার কথাবার্তার মধ্যে খুব অন্যমনস্কতা ছিল। থেমে থেমে কথা বলছিল। আমি এই সময় জিগ্যেস করি, একটা কুকুর ছিল তো আপনাদের ?

হা হা! আপনি দেখছি সবই জানেন। বড় আদরের কুকুর ছিল লিসি। লিসি হয়তো ডাকাতদের আক্রমণ করেছিল। আমার স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য। কুকুরটাকেও তারা মেরে ফেলে।

আচ্ছা লিসিকে কেমন দেখতে ছিল ?

‘ওরকম ভালো জাতের কুকুর লাখে একটা মেলে। ধবধবে সাদা। কী সুন্দর !

হ্যা, সারা শরীর ধবধবে সাদা, কিন্তু আপনার লিসির কপালের রঙ এক জায়গায় কালো ছিল।

‘হাউ স্ট্রেঞ্জ ! আপনি জানলেন কী করে?’

‘আমি লিসিকে দেখেছি। পরপর দুদিন, রাত দশটা নাগাদ।
‘হোয়াট!’ মিঃ কুনহা চিৎকার করে ওঠে।

আমি শাস্ত গলায় বলি, ‘শুধু লিসি নয়, আপনার স্ত্রীকেও। কারণ আপনাদের ঐ রিভলভিং চেয়ারটা আপাতত আমার ঘরে আছে।

মিঃ কুনহা কোনও কথা বলতে পারছিল না। ঠোট দুটো কাপছিল। অনেক কষ্টে, খুব অসহায়ের মতো বলল, দুর্ঘটনার পর আমি কোনও দিন রাতে তার ঐ চেয়ারের কাছে যাইনি। এমন জানলে আমি অন্তত চেয়ারটা রেখে দিতাম। প্লিজ ঐ চেয়ারটা আমাকে ফিরিয়ে দিন। লেট আস লিভ ইন পিস।

ঐ রিভলভিং চেয়ার পরের দিনই আমি হ্যাপি ভিলাতে ফেরত দিয়ে এসেছিলাম। এসব বহুদিন আগের কথা। হ্যাপি ভিলা এখনও আছে। জীর্ণপ্রায়। আগাছা জঙ্গলে ঘেরা ঐ বাড়িতে শীর্ণ বৃদ্ধ এক পর্তুগীজ ভদ্রলোক বাস করে। রোজ রাত দশটায় সে দোতলার একটা ঘরে একটি রিভলভিং চেয়ারের সামনে বসে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে। হ্যাপি ভিলার কাছাকাছি বাড়ির লোকজন মাঝে মাঝে নাকি মেয়েমানুষের কণ্ঠও শুনতে পায়। কাপা কাপা সেই অস্বাভাবিক নারীকণ্ঠ শুনে সবাই ভয়ে কাটা হয়ে থাকে।

আজকাল দিনের বেলাতেও হ্যাপি ভিলার ধারে-কাছে কেউ যায় না। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস, মিঃ কুনহাও আর বেঁচে নেই। গত কয়েক বছরের মধ্যে কেউ তাকে একবারও দেখতে পায়নি। সন্ধ্যার পর হ্যাপি ভিলাতেও আলো জ্বলতে দেখা যায় না।

চেয়ারটা ফেরত দিয়ে আসার পর কত বছর পার হয়ে গেল। ভেবেছিলাম মিঃ কুনহার সঙ্গে দেখা করে আসব একদিন। কিন্তু দূর থেকে হ্যাপি ভিলার সম্বন্ধে যেটুকু খবরাখবর পেতাম । তাতে ভরসা পাইনি।

মাত্র সেদিন খবর পেলাম, সরকারি কর্তৃপক্ষের সহায়তায় হ্যাপি ভিলাকে নাকি অধিগ্রহণ ও যথাযথ সংস্কার করে সেখানে জনসাধারণের কল্যাণার্থে কিছু একটা করা হবে। কারণ মিঃ কুনহার সম্পত্তির কোনও দাবিদার পাওয়া যায়নি। খবরটা শোনার পর থেকেই আমার বার বার হ্যাপি ভিলার কথা মনে হয়। যদিও লোকে সেটাকে ভূতের বাড়িই বলত, আমার কাছে কিন্তু সেটা সত্যি সত্যিই হাপি ভিলা সুখের নীড়। কারণ আমার বিশ্বাস, আজও সেখানে দুটি প্রাণী পরম শান্তিতে বাস করছে।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত