ছোটবেলায় ভূতের গল্প শোনেনি বা পড়েনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার! বাংলার লোকসংস্কৃতিতে ভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলা সাহিত্যে ভূত-বিষয়ক রচনা একটি বিশেষ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পুরনো কিংবা আধুনিক রূপকথায় ভূতের অস্তিত্ব থাকবেই। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, যেসব আত্মা পরলোকে শান্তি পায় না বা যারা অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন, তাদের আত্মা দুনিয়ায় ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ভূত বলতে ‘অতীত’ও বোঝায়। ভূত বোঝাতে সংস্কৃত শব্দ প্রেতও ব্যবহূত হয়। ভারতীয় লোকাচারে প্রচলিত বিশ্বাস হল, শুধু মানুষ নয়, অন্য প্রাণীও মৃত্যুর পরে ভূতে পরিণত হতে পারে।
বাংলার ভূতদের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এসব বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি অবশ্য দুনিয়ার সব দেশের ভূতের বেলাতেই দেখা যায়। ভূতেরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যেকোনো চেহারা ধারণ করতে পারে, মানুষের এমনকি পশুপাখিরও। বাংলার বেশির ভাগ ভূত কমবেশি মানুষের চেহারাতেই দেখা দেয়। তবে পা দেখে নাকি ভূতের অস্তিত্ব বোঝা যায়। ভূতের পা পেছনের দিকে ঘোরানো থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ভূতের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা জানা যায়। মাটি যেহেতু পবিত্র উপাদান, তাই ভূতেরা মাটির স্পর্শ এড়িয়ে চলে। অর্থাত্ ভূত মাটির ওপরে ভেসে থাকে। ভূতের আর দুটি নিশ্চিত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— এদের ছায়া পড়ে না এবং তারা নাকি স্বরে কথা বলে। গ্রামবাংলায় ভূত দেখা যায় গাছের ডালে সাদা কাপড়ে। বাংলার আদি ভৌতিক গল্পগুলোয়ও ভূতের এসব বৈশিষ্ট্যই দেখা যায়।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভূত চতুর্দশী পালনের রেওয়াজ আছে। সাধারণত কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশ দিনে এটি পালিত হয়। সে হিসেবে কালী পূজা বা দীপাবলির আগের রাতেই উদযাপিত হয় ভূত চতুর্দশী। ভূত চতুর্দশীর রাতে বাঙালিরা তাদের ঘরে ১৪টি মাটির প্রদীপ প্রজ্বলন করে তাদের পূর্বপুরুষদের ১৪ প্রজন্মের আত্মাকে শান্ত রাখে। ‘চৌদ্দ পুরুষ’ বিশেষণটি তো বাঙালির সংস্কৃতিতে বহুল ব্যবহূত! বিশ্বাস করা হয়, কালী পূজার আগের রাতে পূর্বপুরুষদের আত্মাগুলো দুনিয়ায় নেমে আসে এবং এ মাটির প্রদীপগুলো তাদের প্রিয়জনের ঘর চিনতে সাহায্য করে। প্রদীপগুলো বাড়ির চারপাশে জ্বালানো হয়, বিশেষত অন্ধকার কোণে, খারাপ আত্মাদের দূরে রাখতে। তবে এ ১৪ প্রদীপ সম্পর্কে আরেকটি মত প্রচলিত আছে। দেবী কালীর একটি রূপ মা চামুণ্ডাসহ আরো ১৪টি ভীতিকর আত্মাকে শান্ত রাখতেই এ ১৪ প্রদীপ। এ মত অনুসারে, মা চামুণ্ডা ও তার সঙ্গের আরো ভয়ানক ১৪টি আত্মা মানুষকে ভয় দেখায়। ডাকিনী ও যোগিনী এ ১৪ দুরাত্মার দুটি বলে মনে করা হয়।
পুরাণের বাইরে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসেও ভূতের প্রভাব রয়েছে। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে প্রচলন আছে ‘চোদ্দ শাক’, ভাতের সঙ্গে ১৪ প্রকারের শাক খেলে কোনো অশুভ আত্মা মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে না। বাঙালি ঘটিদের মধ্যে কালী পূজার দিন লক্ষ্মী দেবীকেও পূজার রীতি আছে। পূজার আগে ঘরের অপবিত্র, নোংরা সব কিছু বিদায় করা হয়, এটিই হলো ‘অলক্ষ্মী বিদায়’। এটিও এক রকমের অশুভ আত্মা বিদায়ের মতো ঘটনা।
হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকতে বেশ কটি সাক্ষাত্কারে সরাসরি ভূতে বিশ্বাস করেন, এমনটা না বললেও জগত্-সংসারে অতীন্দ্রিয় বিষয়ের কথা তিনি অবলীলায় স্বীকার করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে পশ্চিম বাংলায় জনপ্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শিশুদের জন্য প্রচুর লিখেছেন, যার মধ্যে ভূতের গল্পও একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, শীর্ষেন্দু সত্যিকার ভূতে বিশ্বাস করেন। ‘ভূতেরা আছে, আমি ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি এবং তাদের ভয় পাই। শীর্ষেন্দু মনে করেন, টেলিভিশনের এ যুগেও শিশুরা ভূতের গল্প পড়তে ভালোবাসে। নিজে ভয় করলেও শীর্ষেন্দু কিন্তু শিশুদের কাছে ভূতকে মজা করেই বর্ণনা করেছেন।
তবে বাস্তব জীবনে শীর্ষেন্দু কিন্তু সত্যিই ভূতকে ভয় পান। ‘সত্যিকার জীবনে ভূতের সঙ্গে আমার মোলাকাত ভীতিকর। আমার বইয়ের মতো তারা মোটেই মজার নয়।’ ১৯৪১ সালে শীর্ষেন্দু তার পরিবারের সঙ্গে বিহারের কাতিহারে বাস করতেন। ‘আমরা একটা বাঙলোয় থাকতাম। প্রতিরাতে এক মেমসাহেবের পায়ের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যেত। শোনা যেত তার হাই হীলের খটখট শব্দ কারণ তার আত্মা বাড়িটিতে ঘুরে বেড়াত। আমার বাবা একটা ডাইনিং টেবিল কিনেছিলেন। আত্মাটা এই টেবিলের সঙ্গে জুড়ে ছিল, প্রতিরাতে আত্মাটি টেবিলের চারপাশে ঘুরে বেড়াত, তারপর চলে যেত।’ ১৯৮০-এর দশকেও শীর্ষেন্দু একবার ভূতের কবলে পড়েছিলেন। সেটা ছিল এক মৃত নারীর ভূত। লেখক তখন কলকাতায় এক ভাড়া বাড়িতে থাকেন। ‘বাড়ির মালিকের মেয়ে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করে। চারদিন পর সেই মৃত মেয়ের আত্মা আমার ঘরে আনাগোনা শুরু করে। একদিন রাতে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়, দেখি কে যেন একটা লোহার চেয়ার তুলে নিয়ে মাটিতে আছাড় দিল। আমরা নিরুপায় দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। তারপর বাড়ির মালিক আমাদের বাসা ছেড়ে দিতে বলেন।’ বাংলা সাহত্যের আরেক বিখ্যাত লেখক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করতেন। শোনা যায়, তার বাড়িতে কেউ গেলে তিনি তাকে ভূতের গল্প শোনাতেন।
গোড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের ভূত-সংক্রান্ত অবস্থান, ভূত-আত্মা কিংবা তার জীবনে বিশ্ববিদ্যালয় ও পরবর্তীতে নুহাশ পল্লীতে নানা অদ্ভুতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা নানা সময়ে বলেছেন এবং তিনি ভূতের গল্প ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন। তিনি নিজের পছন্দের ভূতের গল্পের একটা সংকলনও করেছিলেন। ভূত ও বাংলা ভৌতিক গল্প নিয়ে তিনি তার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও মতামতও জানিয়েছেন ওই বইয়েও। এক জায়গায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, “গ্রামবাংলায় ভূতকে ঘরের মানুষ ভাবা হতো। ছোটবেলার কথা, নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। সন্ধ্যাবেলা অন্য পাড়া থেকে এক ভদ্রলোক এলেন। নানাজানের সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে যাবার বেলায় বললেন, ‘একটা পেততুনি বড় ত্যক্ত করতাছে।’ অর্থ হচ্ছে, কিছুদিন ধরে এক প্রেত তাদের বড়ই বিরক্ত করছে। বিরক্তের ধরন হচ্ছে, মাছ ভাজা হলে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ভাজা মাছ খেতে চায়। নাকি স্বরে অনুনয়-বিনয় করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভদ্রলোকের গল্পে কেউ বিস্মিত হলো না। ধরেই নিল এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, প্রেতরা ভাজা মাছ পছন্দ করে। এরা ত্যক্ত করবেই।”
লাল বিহারী দের ফোকটেলস অব বেঙ্গল গ্রন্থে ওয়ারউইক গবল-এর অলঙ্করণবাংলা সাহিত্যের ভৌতিক গল্প নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার সোজা কথা, ‘যে বড় গলায় যত কথাই বলুক— বাংলা সাহিত্যে ভৌতিক গল্পের ধারা খুবই ক্ষীণ। লেখকরা ভূতের গল্প যখনই লিখেছেন তখনই তাঁদের মাথায় চলে এসেছে— গল্পটার পাঠক শিশু-কিশোর। ভৌতিক গল্প তাঁরা লিখেছেন বাচ্চাদের জন্য। লেখা হয়েছে খানিকটা অযত্নে, খানিকটা হেলাফেলায়। সেই গল্পের বেশির ভাগই যেখানে শেষ হয় সেখানে দেখা যায় যে ভূত নেই— ভয়ের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য কারণে ঘটেছে। ব্যাখ্যাতীত কোনো কারণে ঘটেনি।’ হুমায়ূনের মতে, বাংলার চেয়ে পশ্চিমাদের ভৌতিক গল্প অনেক বেশি সমৃদ্ধ।
বাংলা সাহিত্য, লোকসংস্কৃতিতে বিভিন্ন ধরনের ভূতের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলার মানুষের বিশ্বাস কিংবা কুসংস্কারের সঙ্গে এসব ভূত এবং তাদের কর্মকাণ্ড মিশে আছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে এসব ভূতের বিশ্বাস আছে। এসব ভূত বাংলা সাহিত্যেও স্থান করে নিয়েছে। এমন কিছু ভূতের মধ্যে আছে—
পেত্নী: নারী ভূত। অবিবাহিত ও অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে মৃত নারীই পেত্নী হন। পেত্নী শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ প্রেতনী (প্রেতের স্ত্রী লিঙ্গবাচক শব্দ) থেকে। পেত্নী যেকোনো মানুষের চেহারা ধারণ করতে পারে। পেত্নীরা থাকে শ্যাওড়া ও তেঁতুল গাছে। পেত্নীদের ট্রেডমার্ক হচ্ছে, এদের পা উল্টোদিকে ঘোরানো থাকে।
শাকচুন্নি: নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ শঙ্খচূর্ণী থেকে। ইনিও নারী ভূত। তার হাতে থাকে শাখা, যা হিন্দু বিবাহিত নারীদের রীতি। শাকচুন্নি সাধারণত বিবাহিত ধনী নারীদের শরীরে ভর করে কারণ তারা বিবাহিত জীবন উপভোগ করতে চায়। শাকচুন্নির গায়ে থাকে সাদা বা লাল শাড়ি। তারা বাস করে পুকুর বা দীঘির পাড়ে এবং বিবাহিত নারীরা পুকুরে গেলে তখন শাকচুন্নিরা তাদের শরীরে ভর করে। পেত্নী কিংবা শাকচুন্নি ভারতের অনেক অঞ্চলে ‘চুরায়েল’ নামে পরিচিত।
চোরাচুন্নি: চোরাচুন্নি মৃত চোরের ভূত। অর্থাত্ চোর মারা গেলে তার আত্মা চোরাচুন্নি ভূতে পরিণত হয়। প্রচলিত মতে, এরা পূর্ণিমা রাতে মানুষের ঘরবাড়িতে ঢুকে ক্ষতিসাধন করে। এদের ঠেকাতে বাড়িতে গঙ্গাজল ছেটানো হয়।
বেঁশোভূত: বেঁশো শব্দটি এসেছে বাঁশ থেকে, অর্থাত্ বাঁশঝাড়ে বাস করা ভূত হচ্ছে বেঁশোভূত। এই ভূতের ভয়েই মানুষ সন্ধ্যার পর বাঁশঝাড়ে যেতে চায় না। বাঁশঝাড়ে দিনের বেলাতেও একটা গা ছম ছম করা ব্যাপার থাকে। শান্ত দিনেও বাঁশঝাড়ে হঠাত্ ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। সবই যেন বেঁশোভূতের কারসাজি।
পেঁচাপেঁচি: এই ভূত বাংলার বনে-জঙ্গলে জোড়া ধরে ঘুরে বেড়ায়। অর্থাত্ একটা পেঁচা, সঙ্গে তার পেঁচি। এরা সাধারণত বনে বিপদগ্রস্ত পর্যটকদের আক্রমণ করে এবং রক্ত পান করে।
মেছোভূত: মেছোভূতের গল্প বাংলা সাহিত্যে প্রচুর দেখা যায়। এই ভূতের মূল কাজ মাছ খাওয়া। এরা থাকে পুকুর, দীঘি কিংবা নদীর ধারে অর্থাত্ যেখানে জেলেরা মাছ ধরে। মেছোভূত জেলেদের নৌকা থেকে বা মানুষের রান্নাঘর থেকেও মাছ চুরি করে নিয়ে যায়। গ্রামের মানুষ বাজার থেকে মাছ কিনে ফেরার পথে নির্জন স্থানে মেছোভূতের পাল্লায় পড়ে। মোছোভূত ভয় দেখিয়ে মাছ কেড়ে নেয়।
নিশি: এরা খুব ভয়ানক ভূত। বলা যায় একেবারে ক্ল্যাসিক ভূত। এরা গভীর রাত ও নির্জন জায়গায় মানুষের ওপর আক্রমণ করে। রাতের বেলা এই ভূত নিকটজনের কণ্ঠে মানুষের নাম ধরে ডেকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এভাবে যারা নিশির ছলনার জালে আটকে যায়, তারা নাকি আর কখনো ফিরে আসে না, নিজেরাই নিশি হয়ে যায়। প্রচলিত আছে, জাদুকর, তান্ত্রিকরা নিশি প্রতিপালন করে। এই নিশিদের তারা বিভিন্ন মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে ব্যবহার করে। নিশিরা নাকি দুবারের বেশি ডাকতে পারে না, তাই গভীর রাতে অন্তত তিনবার কারোর ডাক না শুনে ঘরে থেকে বের হওয়া উচিত নয়।
গেছোভূত: নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এ ভূত গাছে থাকে।
মামদো ভূত: বাঙালি হিন্দুদের বিশ্বাস মতে, এটা মুসলিম ভূত।
আলেয়া: রাতের বেলা জলাভূমিতে এক রকমের রহস্যময় আলো দেখা যায়। এ আলোই আলেয়া। লোকজ বিশ্বাসে এটা ভূতের আলো। মনে হয় আলো যেন শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। জেলেরা এ আলো দেখে অনেক সময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং পানিতে ডুবে যান। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, মাছ ধরতে গিয়ে মারা যাওয়া জেলেদের আত্মা ভূত হয়ে যায় আর সেই ভূতই এ আলো সৃষ্টি করে। অবশ্য বিজ্ঞান জানিয়েছে, এটা গাছপালার পচন থেকে সৃষ্ট মার্শ গ্যাস থেকে সৃষ্টি হয়।
বেঘোভূত: বেঘো মানে বাঘ। সুন্দরবনে আছে বেঘো ভূতের গল্প। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হাতে নিহত হওয়া মানুষেরা বেঘো ভূত হয়ে যায়। সুন্দরবনের স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে, যারা বনে মধু বা কাঠ সংগ্রহ বা অন্য কোনো কাজে যান তাদেরকে এই বেঘোভূত ভয় দেখায় এবং পথ ভুলিয়ে বাঘের সামনে নিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে এই বেঘোভূত বাঘের গর্জন করে গ্রামের মানুষকে ভয় দেখায়।
স্কন্ধকাটা: মাথাবিহীন ভূত। দুর্ঘটনায় মাথা কেটে গিয়ে যারা মার যান, তাদের আত্মাই এ ভূত হয়ে যায়। এ ভূত স্কন্ধকাটা বা কবন্ধ নামেও পরিচিত। এই ভূত নিজেদের হারানো মাথা খুঁজে বেড়ায়। অনেক সময় মানুষকে আক্রমণ করে।
কানাভুলো: এ ভূতেরা মানুষকে পথ ভুলিয়ে দেয়, কোনো কোনো অঞ্চলে এ ভূতকে কানাওলাও বলে। সাধারণত ঘোরের মধ্যে ফেলে তারা মানুষকে অচেনা জায়গায় নিয়ে আসে। তার পর সেই মানুষকে কাবু করতে চায়। রাতের বেলা গাঁয়ের পথে এই ভূতদের দেখা মেলে। এদের কারসাজিতে মানুষ একই পথে বারবার ঘুরতে থাকে।
ডাইনি: বাঙালির অতি পরিচিত ভূত। গালি দিতেও হরহামেশাই এ নাম ব্যবহূত হয়। ডাইনি অবশ্য মৃত আত্মা নয়, এরা জীবিত। বৃদ্ধ নারী, যারা কালোজাদু জানেন, তাদেরকেই ডাইনি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। গ্রামে ডাইনি হিসেবে নারীদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা কিছুকাল আগেও ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটেছে। মানুষ বিশ্বাস করে যে, ডাইনিরা ছোট শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে তাদের রক্ত পান করে।
দেও: দেও মানুষকে পানিতে ডুবিয়ে মারে। তাদেরকে কেউ কেউ দানোও বলে।
ব্রহ্মদৈত্য: ভূত বলতে ভয়ানক আর মানুষের জন্য ক্ষতিকর— এমনটাই সবার ধারণা। তবে কিছু ব্যতিক্রমী ভূতও আছে। ব্রহ্মদৈত্য হচ্ছে ব্রাহ্মণের ভূত। এ ভূত সত্যিকার ব্রাহ্মণদের মতোই ধূতি, পৈতা পরে চলাফেরা করে। এরা পবিত্র, মানুষের উপকার করে। চলচ্চিত্রেও ব্রহ্মদৈত্যের রূপায়ণ দেখা যায়।
বোবা: সরল বাংলায় বোবায় ধরা। বোবা ঠিক ভূত নয়, এক রকমের অতি প্রাকৃত শক্তি। বোবা ঘুমের মধ্যে মানুষকে আক্রমণ করে। তখন মানুষ গোঙাতে থাকে। মনে হয় কারো মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কিন্তু সে কিছু বলতে চাইছে।
রাক্ষস: ‘হাউ, মাউ খাউ, মানুষের গন্ধ পাউ!’— এ বাক্য শোনেনি, এমন বাঙালির সন্ধান পাওয়া ভার! এটি রাক্ষসের মুখ থেকে মানুষ শিকারের অতি পরিচিত বাক্য। রাক্ষস বাংলার রূপকথায়ও বিশেষ স্থান নিয়ে আছে। বিকট দর্শন চেহারা, বড় বড় নখ, চুল আর আসুরিক শক্তি— এই হলো রাক্ষসের চেহারা। আর সে নারী হল তাকে বলে রাক্ষসী। বাংলার মায়েরা রাক্ষসের গল্প শুনিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়ান। যদিও এই ডিজিটাল যুগে গল্প শোনানোর চল আর নেই।
খোক্কস: এরা রাক্ষসের ছোট সংস্করণ।
পিশাচ: পিশাচরা মানুষের মাংসখোকো দানব। চিতা কিংবা গোরস্তানে এদের বাস। রাত হলে এরা তাদের আস্তানা থেকে বের হয়। পিশাচরা মানুষকে সম্মোহিত করতে পারে। পিশাচ চাইলে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে এবং মানুষের শরীরে ভর করতে পারে। তখন সেই মানুষের নিজের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। পিশাচের ইচ্ছাতেই সে চালিত হয়। পিশাচের স্ত্রীলিঙ্গ হচ্ছে পিশাচিনী। আরো অনেক নারী ভূতের মতো পিশাচও তরুণদের প্রলুব্ধ করে এবং তাদের রক্ত চুষে খায়। পিশাচ অনেকটা পশ্চিমাদের ভ্যাম্পায়ারের মতো। পিমাচের উপস্থিতি নাকি টের পাওয়া যায় তাদরে শরীরের বোটকা গন্ধ থেকে।
শিকল: বাংলার গ্রামে এমনকি মফস্বল শহরেও শিকলের গল্প প্রচলিত আছে। শিকল থাকে নদী, পুকুর বা দীঘির তলায়। এদের কাজ শিকলের মতো হলেও দেখতে এরা তরুণীদের মতো। স্বামীর নির্যাতন বা প্রেমিকের প্রতারণায় পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করা তরুণী কিংবা পানিতে ডুবিয়ে যদি কোনো তরুণীকে হত্যা করা হয়, তাহলে তার আত্মা এই শিকল-ভূতে পরিণত হয়। এরা তরুণদের প্রলুব্ধ করে গভীর পানিতে নিয়ে গিয়ে নিজের দীর্ঘ চুলের গোছাকে শিকলের মতো ব্যবহার করে শিকারের পা পেঁচিয়ে ধরে এবং ডুবিয়ে মারে।