ঘটনাটি আমার ছােটবেলার। কিন্তু সেদিন এর রহস্য উদঘাটন করার মত আমার বুদ্ধি হয়নি। আজ এই ঘটনার কথা মনে করলে এখনও গা শিরশির করে ওঠে। তখন আমার বয়স কত হবে, পাঁচ কি ছয়। আমরা তখন গােবরডাঙ্গায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতাম।
আমাদের গ্রাম এখন বেশ বড় শহর হয়ে গেছে, কিন্তু সে সময় ছিল অজ পাড়া গা। চারিদিকে ছিল ঝােপঝাড়, ডােবা আর আমবাগান। আর আমরা যে পাড়ায় থাকতাম সে পাড়ার নাম যুগীপাড়া। পর পর কিছু বাড়ির পরই রেল স্টেশন পর্যন্ত এক মাইল ছিল বনবাদাড়। চারিদিকে আমবাগান থাকায় আমরা জ্যৈষ্ঠ মাস হলেই আম কুড়ােতে বেরুতাম। সকাল-দুপুর আমাবাগানেই পড়ে থাকতাম।
আমাদের বাড়ির
ঠিক পিছনে ছিল হাজারি বিশ্বাসের বাড়ি। হাজারি বিশ্বাস দিনমজুর খাটত এর-ওর বাড়ি। তার বউ-এর নাম ছিল গুরুদাসী। আমার বাবা-মা তাকে গুরুদাসী বলে ডাকতেন। দেখাদেখি আমিও নাম ধরে ডাকতাম।
হাজারি বিশ্বাস ও গুরুদাসীর একটি ছেলে ছিল। ছেলেটির বয়স বছর দুয়েক হবে। গুরুদাসী আমাদের বাড়ি আসত ছেলেটিকে নিয়ে। মা খুব ভালবাসতেন ছেলেটিকে।
এটা-ওটা খেতে দিতেন। গুরুদাসী ভীষণ ভালবাসত ছেলেটিকে। শীতকালে একটু সন্ধ্যা হলেই মাকে বলত : আমি বাড়ি চললুম মাসিমা, ছেলের ঠাণ্ডা লাগবে।
মা বলতেন : তাের বড় বাতিক হয়েছে গুরুদাসী। এখন তাে চারটেও বাজেনি। , মাসিমা। দেখছেন না, রােদ পড়ে এসেছে। কাল থেকে আবার ছেলের গা গরম হয়েছে।
মা বললেন : কই, গায়ে হাত দিয়ে দেখি। তারপর গায়ে হাত দিয়ে বললেন : তুই দেখালি বটে গুরুদাসী। গা তাে পাথরের মত ঠাণ্ডা।
না, মাসিমা, কাল রাতে গরম হয়েছিল। একটু সর্দিও ছিল আমি তুলসীপাতার রস করে খাইয়েছি।
হাজারি প্রায়ই ধেনাে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত আর গুরুদাসীকে ধরে পেটাত। আমরা শুনতে পেতাম। গুরুদাসী চেঁচিয়ে কঁদছে।
এক-একদিন বাবা গিয়ে বাধা দিতেন। হাজারি, ফের যদি বউ-এর গায়ে হাত তুলবি তাহলে তাের একদিন কি আমার একদিন।
হাজারি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতাে : দেখুন না, ছােটবাবু; বাড়ি ফিরলাম, কিছুতেই দরজা খুলে দেবে না। না মারলে কি এরা শায়েস্তা হয়, ওকে মেরে ফেলে জেলে যাব আমি।
বাবা বলতেন :তুই রােজ নেশা করে বাড়ি ফিরবি আর দরজা খুলে দেবে কেন? সারারাত উঠোনে পড়ে থাক, তখন মজা বুঝবি।
গুরুদাসী এসে দুঃখ করত মার কাছে। এই মানুষটাকে নিয়ে কী করি বলুন তাে মাসিমা, যা রােজগার করবে মদ খেয়ে উড়িয়ে দেবে। ছেলে একটা বিস্কুট খেতে
চেয়েছে আজ একমাস হয়ে গেল। তা একদিন নিয়ে এলাে না। মা বলতেন : কী আর করবি বল, তাের ভাগ্য। এই নে একটা পয়সা নে। পঞ্চাননের দোকান থেকে বিস্কুট কিনে ছেলেকে দিস।
গুরুদাসী বলত : ছেলেটার চেহারা দিন-দিন কী রকম হয়ে যাচ্ছে। ও বােধহয় বাঁচবে না মাসিমা। ওই ছেলের জন্যেই তাে যত ঝঞ্জাট আমার। মা বলতেন : ষাট, ষাট, অমন কথা মুখে আনিস নে গুরুদাসী। বাছার এতে অকল্যাণ হবে। আহা, বেঁচে- বরতে থাক। ওই ছেলেই দেখবি, বড় হয়ে তাের দুঃখ দূর করবে। মানুষ হবে।
হ্যা, তাহলেই হয়েছে। ছােটলােকের ঘরে কেউ কি মানুষ হয়, মাসিমা ? ওসব কথা বলিসনি গুরুদাসী। ছােটলােক আবার কি কথা! মানুষ নিজের কর্মদোষেই তার ফল পায়। হাজারি লেখাপড়া শেখেনি, কুসঙ্গে মিশল, তাতেই তাে গােল্লায় গেল।
তাের ছেলেকে যদি লেখাপড়া শেখাস, তাহলে দেখবি সে বড় হবে। সেই গুরুদাসী একদিন তিনদিনের অসুখে পট করে মরে গেল। সান্নিপাতিক জ্বর হয়েছিল। প্রথম দিন জ্বর অবস্থাতেই সব কাজকর্ম করেছে। দ্বিতীয় দিন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। আমাকে নিয়ে মা দেখতে গিয়েছিলেন। হাজারি সকালে কোথায় কাজ করতে বেরিয়েছে। সারাদিন পাত্তা নেই। আমার বাবাও সারাদিন বাড়ি থাকেন না। গ্রামের সুধীর ডাক্তার হাড় কঞ্জুষ। বিনা পয়সায় কোন রােগী দেখবে না । জ্বরে গুরুদাসীর গা পুড়ে যাচ্ছে। কে ওকে ওষুধ দেয়, কে পথ্য দেয়। ছেলেটা একা একা উঠোনে ধুলাে কাদা মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মা বললেন : খােকার বাবা না এলে
ডাক্তারকে তাে খবর দিতে পারব না। আমি তাের বাচ্চাটাকে নিয়ে যাচ্ছি গুরুদাসী। আর দুধ-সাবু পাঠিয়ে দিচ্ছি।
গুরুদাসী মার হাত জড়িয়ে ধরে বলল : আমি মরে গেলে আমার ছেলেটার কি গতি হবে মাসিমা ?
মা বললেন : আঃ, অত উতলা হচ্ছিস কেন? তুই সেরে উঠবি। জ্বর কি কারও হয়না !
বাবা ভট্টাচায্যি পাড়া থেকে ফণী ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। ফণীডাক্তার গরিবের মা বাপ। ডাকলে সবার বাড়ি যান। পয়সার দিকে তাকান না। তিনি এসে বললেন : বড় দেরি হয়ে গেছে। কিছু করার নেই। আগে হলে সদর হাসপাতালে পাঠাবার কথা বলতুম।
সেদিন রাতে গুরুদাসী মারা গেল। গুরুদাসীর ছেলের নাম অনিল। তাকে বলা হল মা গঙ্গা নাইতে গেছে। ছােট ছেলে কী বুঝল কে জানে। দেখতাম গুম হয়ে থাকত। কান্নাকাটি তেমন করত না। হাজারিই রান্না করে ছেলেকে খাইয়ে কাজে যেত দুপুরে আবার ফিরত।
এর মাসখানেক পরে শুনলাম হাজারি আবার বিয়ে করেছে। নতুন বউয়ের নাম শ্যামা। শ্যামার বাপের বাড়ি চারঘাট। তারও বয়স হয়েছে। কেউ কেউ বলল :শ্যামার নাকি আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল।
শ্যামা পাড়ার কারও সঙ্গে বেশি মিশত না। আমার মা একদিন যেচে আলাপ করতে গিয়েছিলেন। শ্যামা তাকে বেশি পাত্তা দিল না। তাতে মা অত্যন্ত রেগে গেলেন। শুনলাম বাবাকে বলছেন, বউটা একেবারে মুখপুড়ি।
বাবা বলছেন : তােমার যাওয়ারই বা দরকার কী?
: আমি যাই ছেলেটার মুখ চেয়ে।
আহা ছেলেটার কি দুঃখ।
সত্যি ছেলেটার বড় দুঃখ! প্রায়ই দেখতাম শ্যামা অতটুকু ছেলেকে লাঠি দিয়ে মারছে। ছেলেটি তারস্বরে চিৎকার করছে।
শেষে মা একদিন গিয়ে বলল : আহা, বাচ্চাটাকে অমন করে মারছ কেন মা?
শ্যামা বলে উঠল : মারছি, বেশ করছি। যাকে সামলাতে হয় সেই বােঝে। অমন আলুনি দরদ সবাই দেখাতে পারে।
আগে ছেলেটি আমাদের বাড়ি আসত। শ্যামা তার বেরুনাে বন্ধ করে দিল। বাবা একদিন হাজারিকে বলতে গেলেন।
হাজারি বলল : কী করব ছােটবাবু। ছােট বউ-এর মুখের ওপর কথা বলতে গেলে আবার আর এক অশান্তি। তার ওপর যখন সব ভার, তখন শাসন করার ভার তুলে না দিয়ে উপায় নেই।
কিছুদিন পরের কথা। জ্যৈষ্ঠ মাসের এক বিকেল। আমি আম কুড়ােতে-কুড়ােতে রেল লাইনের ধারে গলায় দড়ি বাগানে গিয়েছি। ওখানে কে একবার গলায় দড়ি দিয়েছিল তারপর থেকে নাম হয়ে গেছে ‘গলায়-দড়ি বাগান। কেউ কোথাও নেই।
ঝোকের মাথায় এতদূর চলে এসেছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে একজন মেয়েছেলে আম কুড়ােচ্ছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখতেই মেয়েছেলেটি আমার দিকে ফিরে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম।
তাকিয়ে দেখি মেয়েছেলেটি আর কেউ নয়—গুরুদাসী। আমাকে অবাক হতে দেখে
গুরুদাসী বলল : কী কালী, (আমার ডাক নাম) আমায় দেখে অবাক হয়ে গেছ, তাই?
আমি বললাম : তুমি? তুমি মরে গেছ না ?
গুরুদাসী বলল : কে বলল? এই তাে আমি তােমার সামনে ?
: তাহলে এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?
গুরুদাসী বলল! ওখানে আমাকে মারধর করে। আমি তাই চলে এসেছি।
: তােমার ছেলেকে নিয়ে যাও। তাকে যে তার নতুন মা ভীষণ মারে। গুরুদাসী ধরা গলায় বলল :আমি সব জানি। কিন্তু আমি ওকে এখন নিয়ে আসব না। মাসিমা বলেছে ও অনেক বড় হবে ভদ্দরলােক হবে। লেখাপড়া শিখবে।
: তুমি এখানে কী করছ?
: আম কুড়ােচ্ছি। এই দুটো আম আমি খােকার জন্য তােমাকে দিলাম। তুমি কিন্তু বােল না, কে দিয়েছে। শুধু তুমি হাতে করে দিও তাহলেই হবে।
এই বলে গুরুদাসী আম দুটো মাটিতে রেখে দিল। দেখলাম সুন্দর পাকা দুটো আম। কিন্তু আম দুটো আমার হাতে না দিয়ে কেন মাটিতে রেখে দিল তা বুঝলাম না।
আমি আম দুটো হাতে করে নিতে গুরুদাসী আবার বলল : কালী, একটা কথা কাউকে বলবে না বল।
আমি বললাম : বলব না।
: আমার সঙ্গে যে তােমার দেখা হয়েছে কাউকে বলতে পারবে না কিন্তু।
: বেশ বলব না।
আমি বাড়ি ফেরার পথে আম দুটো হাজারির বাড়ি দিয়ে এলাম। হাজারি বাড়ি ছিল।
আমি বললাম : কুড়িয়ে পেয়েছি, খােকাকে দিও।
সে সময় বয়স এত কম সকলের সব কথা বিশ্বাস করতুম। হাজারির বউ যে বলল সে মরেনি, আমি তাই-ই বিশ্বাস করলাম।
দিন দশেক পরে একদিন সন্ধ্যার সময় আমি একা একা ঘরে বসে আছি। মা পুকুরে গা ধুতে গেছে।
হঠাৎ দেখি আমার ঘরের দরজায় গুরুদাসী।
আমি বললাম ; ওমা, তুমি কখন এলে?
গুরুদাসী বলল : এই মাত্র।
আমি বললাম : তােমার আম খােকাকে দিয়েছিলাম।
: হ্যা, জানি। কিন্তু সেই আম ওরা খােকাকে খেতে দেয়নি।
: তুমি কী করে জানলে?
: আমি সব জানতে পারি।
: খােকাকে দেখবে নাকি?
: না, দেখলে বড় কষ্ট হবে। তােমার কাছে এসেছি, খােকাকে এই শশাটা দিও।
: তুমি কোথায় পেলে?
গুরুদাসী সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে একটা বড় শশা মাটিতে নামিয়ে রাখল।
আমি বললাম : আচ্ছা। কিন্তু তুমি এতদূরে এসেও দেখা করবে না?
গুরুদাসী বলল : না। আর একটা কথা, আমার কথা কাউকে বােল না কিন্তু।
শশাটা পরদিন গিয়ে হাজারির বউকে দিয়ে এলাম।
সে বলল : কে দিয়েছে?
মিথ্যে করে বললাম : আমাদের গাছের শশা। মা দিয়েছে খােকাকে খেতে।
এর কদিন পর-পরই গুরুদাসী আমার সঙ্গে দেখা করতে লাগল প্রতিদিন সে এটা ওটা নিয়ে আসে। একদিন নিয়ে এল এক প্যাকেট বিস্কুট।
কিন্তু আমি রােজ রােজ এত জিনিস দিই-ই বা কী করে। হাজারী এর মধ্যে বলেছে—কালীবাবু, তুমি এত জিনিস পাও কোথা থেকে বল তাে?
আমি বলি : মা দিয়েছে।
কিন্তু একদিন ধরা পড়ে গেলাম।
মাকে বােধহয় শ্যামা জিজ্ঞাসা করেছিল সত্যি-সত্যি মা পাঠায় কি না জানতে।
মা তাে গাছ থেকে পড়ল। আর বাড়ি ফিরেই আমার ডাক পড়ল। খােকা, গুরুদাসীদের বাড়িতে তুই নাকি বিস্কুট, মিষ্টি এসব দিয়ে বলেছিস আমি পাঠিয়েছি।
আমি নিরুত্তর।
ওসব জিনিস কোথা থেকে পেলি তুই?
আমি কী জবাব দেব এ প্রশ্নের।
মা আবার বললেন : হতচ্ছাড়া ছেলে। নিশ্চয়ই পয়সা চুরি করে তুই এসব কিনেছিস।
আমি বলি : না, মা।
সেই মুহূর্তে মা আমাকে ধরে চেলাকাঠ দিয়ে বেদম মারতে শুরু করে দিলেন। যন্ত্রণায় আমার দেহ কুঁকড়ে গেল। তবু আমি কঁদলাম না। দাঁতে দাঁতে কামড়ে পড়ে রইলাম।
অনেক রাতে দেখি আমাকে কে ডাকছে।
আমি ঘুম থেকে উঠে তাকিয়ে দেখি গুরুদাসী।
(সমাপ্ত)