ক্যান্টিনে বসে নাস্তা করতেই চোখ যায় এক ছেলের উপর। তাকে আগেও কলেজে অনেকবার দেখছি, কিন্তু ইদানীং দেখিনি একবারও। আজকে কোত্থেকে উদয় হয়ছে কে জানে! ছেলেটা নিতান্তই ভালো। ক্যান্টিনে এই ছেলে মাঝের মধ্যে ভিক্ষুকের কিছু ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের এনে নাস্তা খাওয়াই। আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি। গিয়ে তার সাথে দিব ভাবছি। যেই ভাবা সেই কাজ। গিয়ে ছেলেটির সাথে মিলে বাচ্চাগুলোকে আমিও অনেক কিছু খাওয়ালাম। এখন ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম…
–শুনেন, আপনার নামটা যেন কি?
–(চুপ,কিছুই বলছে না)
আবার জিজ্ঞাসা করলে শুধু একটা মুচকি হাসি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই বলল না। আবার জিজ্ঞাসা করলাম..
–বাচ্চাগুলোকে পেট ভরে খাওয়াতে আপনার কি ভালো লাগে?
–হুম, এদের জন্যই ফিরে আসছি।
–আচ্ছা আপনি কই থাকেন?
এবার ছেলেটা কিছু না বলে সরাসরি আমার হাত ধরল। আমি একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। ছেলেটা এসবের পাত্তা না দিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে থাকল। আমি তার সাথেই যেতে থাকলাম। যেতে যেতে সন্ধা হয়ে গেছে,, ছেলেটা যে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বুঝতেই পারতেছি না,অনেক জিজ্ঞাসা করলাম কিছুই বলল না। অনেক দূরে চলে আসছি অসম্ভব ভয় করছে। ছেলেটা আমাকে একটা ফুল গাছের নিচে এনে দাড় করালো। ফুলগাছের পাশে একটা গর্তও আছে.. আশেপাশের জায়গাটা অনেক নির্জন। একটু দূরেই একটা বাড়ি। ছেলেটা হাত ছেড়ে দিয়ে ঠোটে এক মুচকি হাসি নিয়ে বলল..’আমি আরিয়ান,এখন থেকে এখানেই থাকি’। আমি একটু অবাক হলাম এটা শুনে। কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাব এমন সময় এক মৃদু হাওয়া বইতে শুরু করল,,ফুলগাছের সাদা সাদা ফুলগুলো গায়ের উপর পড়ে এক ধরণের শিহরণ জাগিয়ে তুলল। হঠাৎ কারো ডাক..’ফারিয়া, ফারিয়া’..। পেছনে ফিরে তাকালাম.. বেস্ট ফ্রেন্ড তাসনিম। ও দৌড়ে এসে বলল..
–তুই এখানে কি করছিস..একটু আগে আন্টি কল দিয়ে তোর কথা জিজ্ঞাসা করছে..তোর জন্য চিন্তা করতেছে আন্টি।আমি তোকে ফলো করতে করতে এখানে আসছি। তুই এখানে কি করছিস??-তাসনিম
–আমি এই ছেলেটার সাথে… বলে পেছনে ফিরে তাকে দেখাতে যাব দেখলাম ছেলেটা নাই।তাসনিম ঝাড়ি একটা দিয়ে বলল..কোন ছেলে!! তাসনিমের একটা অভ্যাস কোনো ছেলের কথা যদি বলি তাকে নিয়ে শুরু হয়ে যাই ইয়ারকি করা। তাই কথাটি চাপা দিয়ে চলে আসলাম। সারারাত ছেলেটির কথা ভাবলাম। আগে মনে হত যে, ছেলেটা একটু কম কথা বলে কিন্তু এত কম তা জানা ছিল না। পরদিন আবার ক্যান্টিনে গেলাম,,ছেলেটা আজ আসে নি। দুটা দিন কেটে গেল ছেলেটি আসছে না। ওর পক্ষ হয়ে ভিক্ষুকের বাচ্চাগুলোকে আমিই নাস্তা করালাম। তারাও জানে না সে কে ছিল। আমি আবার সেই ফুলগাছ তলায় আসলাম আগের মতই এক বাতাস বয়ে গিয়ে কিছু ফুল ঝরে পড়ছে। আমি সেখানে কিছুক্ষণ বসলাম। আবার চোখ পড়ল সেই ঘরটির উপর।ঘরের সামনে আরিয়ানের মত একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে,একটু পর ভেতরে ঢুকে গেল। সন্দেহ হতে লাগল ছেলেটি এখানে থাকে না তো!! ভাবতে ভাবতে সেখানে গেলাম। একটা থাইগ্লাস দিয়ে উকি মেরে দেখলাম ভেতরে কিছু লোক ড্রিংকস করতেছে। দেখতেই খুব বাজে লোক মনে হচ্ছে। কিছু কিছু সিগারেটও পান করছে। আরিয়ান এখানে নেই। হঠাৎ একটা লোক ভেতর থেকে একটা মেয়েকে চুল ধরে আনছে। কি বেয়াদব!! সে বাকি লোকের উদ্দেশ্যে বলল..এটাসহ এখন তো ৫০টা হয়ে গেছে। তাহলে কালকেই ডেলিভারি ফাইনাল। আমি তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে ছবি তুলে নিলাম তাদের।লোকটা মেয়েটাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হল…আমি লুকিয়ে তাদের পিছু নিলাম। লোকটা ইতিমধ্যে একটা গাড়ি বের করে মেয়েটিকে জোড় করে বসিয়ে নিয়ে গেছে,,আমিও দেরি করলাম না একটা টেক্সি থামিয়ে তাতে উঠে পড়লাম। ড্রাইভারকে ঐ গাড়িকে ফলো করতে নির্দেশ দিলাম। সামান্য দূরেই এক পুরনো ফ্যাক্টরির সামনে গাড়িটি থামল। আমি নেমে পিছু পিছু গেলাম। লোকটা মেয়েটাকে নিয়ে ফ্যাক্টরিতে চলে গেল। আশেপাশে অনেক বাচ্চাশিশু কাজ করতেছে। পরনে ময়লা কাপড়। এক বাচ্চাকে দেখে আমার পরিচিত মনে হল..তার পাশে গেলাম। হ্যা মনে পড়ছে..এই বাচ্চাটাকে প্রথম প্রথম ক্যান্টিনে আরিয়ান অনেকবার এনেছিল।আমি জিজ্ঞাসা করলাম-
–তুমি এখানে কি করছ? আর এইসব বাচ্চারা এখানে কেন? কি করছে!
–আপা, আমরা এখানে কাম করি।
–কি কাজ?
–ঐ মাঝেমাঝে.. টুকিটাকি কাম করি,নাইলে প্রায় সময় নেশার জিনিষ বানাই।
–কেমন নেশার জিনিষ?
–মদ বানাই, সাদা সাদা গুড়ের মত পাউডার বানাই এগুলো।
–এই কাজ তোমাদের কে করাই?
–আমাদের মালিক। আপা এখান থেকে চলি যান। কেউ যদি আপনারে দেখি ফেলে তবে শেষ।
–কেন? কি হয়ছে?
–গতবার এখানে এক ভাইয়া আইসে এভাবে আমাদের সাথে কথা বলে। ওনারে দেখে আমাদের এক মালিক ওনারে যেইভাবে পিঠাই। আপা তাই কইতাছি, চলি যান। আমাদের তো কাম কইরতে হইবো নাইলে খাইবার টেকা কই পামু।
ছেলেটার কথা ফেলে দেবার মত না। তবুও মনে হচ্ছে এখানে আরো অনেক অপরাধমূলক কাজ হচ্ছে। আমার ভেতরে যেতেই হবে।আমি ফ্যাক্টরির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর পুলিশকে কল দিয়ে বললাম, এখানে এক লোক একটা মেয়েকে জোড় করে তুলে আনছে।পুলিশ এই শুনে এড্রেস নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমি আবার সেই লোকটাকে দেখে সাথে সাথে লুকিয়ে গেলাম। সে ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে তালা লাগাতে যাবে এমন সময় আমি তার মাথায় সজোড়ে একটা লাঠি দিয়ে আঘাত করি। সে জোড়ে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পডে যাই অমনিতেই আমি ফ্যাক্টরিতে ঢুকে পড়ি। ফ্যাক্টরি পুরাই খালি আবার মাঝখানে একটা গুদাম। আমি গুদামে ঢুকার জন্য ঐ লোকটার পকেট থেকে চাবি নিয়ে গুদামে ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখি আগের মেয়েটি শুদ্ধ অনেক গুলো মেয়ে, সবার মুখ হাত বাধা।বুঝতে বাকি রইল না এদের পাচার করতে আনা হয়ছে। আমি তাড়াতাড়ি সবাইকে বের করালাম। আর মেইন গেট খুলে দিলাম..পুলিশও এসে পড়ল। কিন্তু আমি ঐ লোকটাকে ধরিয়ে দিতে গেলে দেখি সে নেই। অনেক খুঁজার পর না পেয়ে পুলিশকে মোবাইলে তোলা ক্রিমিনালদের ছবিগুলো দিলাম। পুলিশরা সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আমিও বের হতে যাব,তখন মনে পড়ল আমি আমার পার্সটা ফ্যাক্টরিতে হয়ত ফেলে আসছি,আমি সেখানে গেলাম। পার্স নিয়ে উঠব এমন সময় কে যেন আমার মাথায় ভারী একটা কিছু দিয়ে আঘাত করল।পেছনে ফিরে দেখি সেই লোকটা,,মুহূর্তেই চোখে ঝাপসা দেখি। আমি ব্যথা সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ঠিক কতক্ষণ বেহুঁশ ছিলাম জানা নেই।
হুশ ফিরতেই দেখি..আমার চারিপাশে মাটি, আর একটা বাজে গন্ধ। মনে হচ্ছে আমি কোনো গর্তে আছি।শরীরেও বিষন ব্যথা করছে কে যেন আমাকে পিঠিয়ে লাশ করছে এমন ব্যথা। বামকাতে ফিরতেই চিৎকার দিয়ে উঠি। আমার পাশে এতক্ষণ কেউ একজন শুয়ে ছিল। চারিদিকে অন্ধকার হওয়ায় ভালো করে দেখছি না। আমি পার্স থেকে মোবাইল বের করে ফ্লেশলাইট জ্বালিয়ে আলো ফেললাম। আলো ফেলতেই দেখলাম সেই পরিচিত আরিয়ানের চেহারা। অসম্ভব ভয় পেয়ে গেলাম আর গন্ধটা তার থেকেই বের হচ্ছে। তার মানে সে মৃত। আমার তো দম ঘুটে আসছে। মনে হচ্ছে এখন আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ব। নাহ, নিজেকে সামলালাম। গাল বেয়ে দুফোটা অশ্রু বেরিয়ে পড়ল এই উদার ছেলেকে মৃত দেখে। আমার এই গর্ত থেকে উঠতে হবে কিন্তু কারো সাহায্য ছাড়া উঠা হবে না। অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু উঠতে পারছি না। গর্তের উপরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না,অনেক চিল্লাইছি সাহায্যের জন্য নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম এমন সময় এক মৃদু হাওয়ায় কিছু সাদা ফুল গায়ে এসে পড়ল। বুঝতে বাকি রইল না,, আমি সেই ফুলগাছটার পাশের গর্তে আছি। তার মানে ঐ লোকগুলোই আমাকে এখানে ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ গর্তের বাইরে থেকে কে যেন হাত বারিয়ে দিল আমি উঠার জন্য,,গর্তের উপর থেকে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। আমি অসম্ভব দুর্বল এখন। হাত ধরেও উঠতে পারব না মনে হচ্ছে। তবুও তার হাত ধরলাম। একটানে সে আমাকে তুলে ফেলল,আমি তার গায়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
সকালে নিজেকে বেডে আবিষ্কার করি। একি আমি আমার রুমে কেমনে আসলাম!! পাশে আম্মু, তাসনিম বসে আছে। আমার হাতে পায়ে চারিদিকে ব্যান্ডেজ। আমি একটু বসার চেষ্টা করলাম,কিন্তু শরীরটা অসম্ভব দুর্বল। তাই পড়ে গেলাম। আম্মুরা আমাকে উঠতে দিল না। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম-
–আমি এখানে কেমনে আসছি?
–তুই কাল সারাদিন কোথায় ছিলিস আগে সেটা বল।-আম্মু
–এসব পড়ে বলব,আগে বলেন আমি এখানে কি করে এলাম।
–তোকে কালকে অপরিচিত একটা ছেলে এনেছে।তোকে পাঁজাকোল করে এনে দিয়ে যাই, আর কিছু বলেনি।আমি কালরাত এখানেই থেকে গেছিলাম।-তাসনিম
কিছু বলতে যাব অমনিতে ছোট ভাই চিল্লাইতে চিল্লাইতে দৌড়ে এসে বলে-
–আপু, পেপারে তোমার ছবি দিছে।
পেপার হাতে নিয়ে দেখলাম, কালকে যে মেয়েদের উদ্ধার করছি পুলিশদের সাথে তাদের সাথে আমার ছবি,আরেক সাইডে হ্যান্ডকাফ পড়া ক্রিমিনালগুলোর ছবি। পাশে এমন লিখা আছে…একটি পুরনো ফ্যাক্টরিতে এই মেয়েগুলোকে পাওয়া যায়,,,এদের মতে এদেরকে অন্য দেশে পাচারের জন্য বন্দি করেছিল (অমুক) নামের লোক। ফারিয়া নামে এক মেয়ের কারণে আমরা ফ্যাক্টরিতে মেয়েদের সন্ধান পাই। এছাড়াও আসামীরা ফ্যাক্টরিতে অনেক বেআইনি কাজ করত,,যেমন বাচ্চাদের দিয়ে নেশাজাত দ্রব্য বানাতো আরো অনেক কিছু। পুলিশরা এদের রিমান্ডে নিয়ে কারাদণ্ডে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়া হয়ছে। আসামীদের একজনকে আজকে সকালে কে যেন অনেক নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে তাদের বাড়ির পাশের এক গর্ত থেকে শনাক্ত করা হয়, তার সাথে আরেকটি লাশ সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়।
আমি সবই বুঝলাম। ছবিতে ঐ লোকটি নেই যে আমাকে মেরেছিল,তার মানে আজকে তারই লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু লোকটাকে কে মারল বুঝতে পারতেছি না। তাও তাকে আরিয়ানের লাশের পাশে ফেলে দেওয়া হয় এসবের মানে কি!! আর আমাকে যে এখানে এনেছে সে কে ছিল!!
মনে মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে দিন কেটে যাই। রাতে ঘুমানোর সময় কিছু সাদা ফুল আমার গায়ে এসে পড়ে।সেই পরিচিত ফুল। সামনে দেখি আরিয়ানকে..আমি গুটিশুটি হয়ে জড় পদার্থ হয়ে গেলাম,সারা শরীরে কম্পনের সৃষ্টি হল। কারণ কালরাত আমি নিজ চোখে তার লাশ দেখছিলাম। সে বলতে লাগল,,,ফারিয়া তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আজ তোমার কারণেই ঐসব লোকের শাস্তি হল।যে লোকটা তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে সে তার কর্মের করুণ শাস্তি পেয়েছে। আমি অনেকদিন আগে এক ভিক্ষুক ছেলের কাছে জানলাম সে নাকি একটা খারাপ ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। তাকে নিয়ে সেখানে যাই, সেখানে অনেক খারাপ খারাপ কাজ করা হয়। কিছু লোক কিছু মেয়েকে বেধে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে ফেলে আর ওরা আমাকে অনেক মারে। তারা আমাকে নিয়ে তাদের বাড়ির ফুলগাছের পাশে গর্ত করে সেখানে ফেলে দেই। জ্ঞান ফেরার পর অনেক চিল্লালাম কেউ শুনল না কিন্তু তোমার বেলায় এমন হতে দিইনি তোমাকে সঠিক জায়গায় পৌছে দিয়ে নিজের আস্তানায় চলে গেলাম…
এমন বলে মুচকি এক হাসি দিয়ে সে কোথায় যেন মিলে গেল। আমি ডুগর গিলতে লাগলাম। পাশের জগের পানি পান করে পুরো জগ শেষ করে দিলাম। এদিকে ফ্যান চলার শর্তেও আমার ঘাম ঝরছে। এতক্ষণ যা দেখছি সবই কি সত্যি ছিল?সেদিন যে আমার হাত ধরে ফুলগাছের নিচে নিয়ে গেছিল সে কে ছিল???….