অপবিত্র

অপবিত্র

ক্যাঁচ করে গাড়িটা থেমে গেলো শুনশান হাইওয়ে তে,বার ছয়েক চাবি ঘুরিয়ে দেখলেন অনির্বাণ বাবু,একটু কেঁদে ওঠা ছাড়া আর কোনো সাড়া এলোনা গাড়ি থেকে।মাথায় হাত দিয়ে বসলেন তিনি,গন্তব্য এখনো প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার, তারপর এই মুষলধারায় বৃষ্টি। সত্যি না জানি আজ কার মুখ দেখে সকালে উঠেছিলেন,নতুন কেনা ঝাঁ চকচকে অডি গাড়িটা যে এরকম ধোকা দেবে স্বপ্নেও ভাবেন নি,ঠিক লজঝড়ে মারুতি আটশোর মত আচরন করছে।
অনির্বাণ বাগচী শহরের বিখ্যাত নির্মাণ ব্যবসায়ী, এক কথায় প্রোমোটার।তাঁর বাবা ছিলেন একজন হাইস্কুল শিক্ষক,সারাজীবন আদর্শের সাথে নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনযাপন করেছেন এক মফস্বল শহরের সরকারী বিদ্যালয়ে।তাঁর সন্তান অনির্বাণ ছোট থেকে একটু অন্যরকম,নিজের সাফল্যের জন্য,নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুরনের জন্য সে করতে পারেনা হেন কাজ নেই।মাধ্যমিকের পরই পড়াশুনা লাটে তুলে এদিক ওদিক খুচরো কাজে জড়িয়ে পড়ে সে।

একদিন সৌভাগ্যক্রমে দেখা পেয়ে যায় বিবেক বাগচীর,তিনি তখন শহরের উঠতি নির্মান ব্যবসায়ী, স্ত্রী রেবাকে নিয়ে তাঁর শান্ত সুখের সংসার।বন্ধুর বেশধারী অনির্বাণ শত্রু হয়ে উঠতে সময় নেননি,কিছুদিনের মধ্যেই জাঁকিয়ে বসেন ব্যবসায়,একদিন হটাত নিখোঁজ হন বিবেক।নিন্দুকেরা বলে অনির্বাণ ই খুন করে গুম করে দেন বিবেক কে,ব্যবসা কুক্ষিগত করার আশায়,তারপর রেবাকে বিয়ে করে আপাত ভদ্রজীবন শুরু হয়ে যায়। সাফল্যের জন্য নিজের পিতৃদও হালদার পদবী বদলে বাগচী করে নিতেও দ্বিধা করেন নি তিনি,এরপর শুরু হয় তাঁর উল্কার গতিতে উত্থান। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আরো ফুলে ফেঁপে ওঠেন তিনি,এখন বিভিন্ন সরকারী কাজের টেন্ডারে তাঁরই একচেটিয়া রাজত্ব।

একটা চার অক্ষরের বিজাতীয় শব্দ প্রয়োগ করে ছাতা হাতে গাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালেন অনির্বাণ বাবু।গাড়ির মধ্যে নেশার ঘোরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে দেহরক্ষী উপেন,ড্রাইভার রামু অসুস্থ হওয়ায় আজ গাড়ি নিজেই চালিয়ে বেরোতে হয়েছিল তাঁকে।একজন মন্ত্রীর একমাত্র কন্যার বিবাহের আসরে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি,সেখানেই অতিরিক্ত মদ্যপানে চেতনা হারায় উপেন।অকুণ্ঠ গালাগাল করতে করতে আর বাড়ি গিয়েই এইসব অকর্মণ্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে চললেন তিনি,যদি কোনো বাড়ি বা ক্লাব জাতীয় কিছু পাওয়া যায় আজকের রাত্রিবাসের জন্য।বৃষ্টির তোড় যেন বেড়েই চলেছে,মাঝে মাঝেই আকাশে দেখা যাচ্ছে তীব্র বিদ্যুতের ঝলকানি।ঝোড়ো হাওয়া আর তার সাথে বুককাঁপানো কড়াত কড়াত বাজের শব্দ,আজ যেন প্রকৃতি সেজেছে রুদ্ররূপে।চমকানো বিদ্যুতের আলোয় প্রথম বাড়িটা দেখতে পেলেন অনির্বাণ বাবু।চলটা ওঠা দেওয়াল,নোনাধরা ক্ষয়িষ্ণু ইঁটের চারিদিকে আগাছা পরিবৃত বাড়িটা দুদিক বিস্তৃত ধানজমির মাঝে একলা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।অন্ধকারে এতক্ষন পরিষ্কার বোঝা যায়নি তবে এখন বোঝা যাচ্ছে হাইওয়ের ধার দিয়ে একটা মাটির কাঁচা রাস্তা নেমে শেষ হয়েছে ওই বাড়িটিতে।

এই নির্জন পরিবেশে ধানজমির ভেতরে এরকম একলা খাপছাড়া বাড়ি কেন এল সেটাই মাথায় ঢুকল না অনির্বাণ বাবুর,বাড়ির মালিক নির্ঘাত পাগল নয়ত বখে যাওয়া বড়লোক।যা থাকে কপালে ভেবে ছাতা হাতে বাড়িটির দিকে পা বাড়ালেন অনির্বাণ বাবু,কোনক্রমে বুক সমান আগাছা ভেদ করে বাড়িটির গাড়িবারান্দায় এসে উঠলেন তিনি।আহ এতক্ষনে বৃষ্টির ছাঁট থেকে মুক্ত হওয়া গেছে।ছাতাটা বন্ধ করে এবার বাড়িটির চারিদিক নিরীক্ষণ করতে শুরু করলেন তিনি,বুক সমান আগাছা,ছড়িয়ে থাকা ধূলোর আস্তরণ আর নোনাধরা ইঁটের গায়ে গজানো বট গাছ জানান দেয় বাড়িটি পরিত্যক্ত।কিন্তু বাড়িটি দেখে কেমন পরিচিত মনে হল তাঁর,কিন্তু মনে করতে পারলেন না কবে এসেছিলেন।দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন তিনি,সম্বল মোবাইলের টর্চ।বাড়িটি একতলা,সুবিশাল ড্রইংরুম ঘিরে চারটি বেডরুম, সাথে অ্যাটাচ বাথ।তবে কালের প্রভাবে ও সময়ের অভাবে সবগুলিই ব্যবহারের অযোগ্য। হতাশভাবে ড্রইংরুমে ফিরে এলেন অনির্বাণ বাবু।একটি কালো সোফা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার, সেখানে বসেই অপেক্ষা করতে লাগলেন সকালের।

মোবাইলের চার্জ কমে আসায় টর্চের অবস্থাও ভালোনা,অগত্যা তাকে বন্ধ করে পকেটে ঢোকালেন তিনি।নিচ্ছিদ্র অন্ধকার আর বাইরে পতনরত বৃষ্টির শব্দ,ঘরময় কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ।হটাত পায়ে কিসের কামড় অনুভব করে আন্দাজে হাত চালালেন তিনি,অনুমানে বুঝলেন নিতান্ত একটা পিঁপড়ে। এই বন্ধ পরিত্যক্ত ঘরে সাপ খোপ থাকা বিচিত্র নয় মনে করে আবার একবার মোবাইলের টর্চ টা জ্বাললেন তিনি,বুকের রক্ত শুকিয়ে হিম হয়ে গেল তাঁর।ঘরময় ছড়িয়ে কোটি কোটি কালো পিঁপড়ে, কালো সোফাটার চারপাশে থিকথিক করছে তারা।কিছু তাঁর শরীর বেয়ে উঠে কামড় বসাচ্ছে এদিক ওদিক।সোফা থেকে লাফিয়ে নামার চেষ্টা করলেন অনির্বাণ বাবু,কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন বেঁধে রেখেছে তাঁকে।

আর্তনাদ করার চেষ্টা করলেন কিন্তু স্বর বেরোল না গলা দিয়ে,পিঁপড়ের দল ধীরে ধীরে ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসছে শরীর বেয়ে,দূর থেকে দেখলে মনে হবে সোফায় বসা কালো পোশাকে আবৃত কোনো মূর্তি।বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন অনির্বাণ বাবু,নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়েছেন তিনি।একটা পচাগলা মূর্তি অনবরত হেসে চলেছে এককোনে দাঁড়িয়ে,বড় ভয়ানক সে হাসি।খুব চেনা সেই মুখ, বিকৃতির মাঝেও স্পষ্ট দেখলেন তিনি,বিবেক!!সেই মূর্তি এবার ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল,—“মনে পড়ে সেই নদীর চর?বেড়ানোর আছিলায় নিয়ে যাওয়া সেই নির্জন জায়গা?তারপর পানীয়ে নেশার জিনিস মিশিয়ে অর্ধ পুঁতে চলে আসা বালিয়াড়িতে?এভাবেই পিঁপড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিল,ঠুকরেছিল কাক,চিল,জীবন্ত।প্রতিটা আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছিল বাতাসে,কেউ শোনেনি।বড় যন্ত্রণাদায়ক সেই মৃত্যু,তিলে তিলে অপেক্ষা পরপারের।”

চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে অনির্বাণ বাবুর,মাংসের সতকার শুরু করেছে ক্ষুধার্ত পিঁপড়ের দল।কোনক্রমে ঠোঁট ফাঁক করে বলতে পারলেন,–“ক্ষমা!!” অট্টহাস্যে কেঁপে উঠল বাড়িটা,–“ক্ষমা??অপবিত্র আত্মার মুক্তি নেই,না চিতার আগুন না কবরের মাটি কিছুই জোটেনি।প্রতিদিন নরকযন্ত্রণা ভোগ করি এই পৃথিবীর বুকেই।আজ তুমিও আমার সাথে এসো বন্ধু!!এই সেই বাড়ি যেখানে প্রায় আমরা ছুটি কাটাতে যেতাম, মনে পড়ে??” আর কথা সরল না অনির্বাণ বাবুর মুখে,দেহ অধিকার করে ভোজসভা বসিয়েছে পিঁপড়ের দল।বাইরে বৃষ্টির শব্দ বাড়ছে। পরের দিন সকালে হাইওয়ে সংলগ্ন ধানক্ষেতে অনির্বাণ বাবুর পোশাক আর মোবাইল উদ্ধার হয়,তবে দেহ আজো পাওয়া যায়নি।।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত